নিজেকে নিদ্রিত দেখে
মৃদুল দাশগুপ্ত
নিজেকে নিদ্রিত দেখে আকস্মিক মনোবেদনায় শিয়রে বসেছি ঝুঁকে
কোনও কোনও রাত্রিকালে একাকী নিশ্চুপে
হয়ত দু-এক ফোঁটা অশ্রুপতনের ফলে আধো চোখ মেলে
আবার নিদ্রায় ডুবে যেতে যেতে সে ভেবেছে, স্বপ্ন দেখা যায়
মৃদুল দাশগুপ্তের এই কবিতাটি অনেক দিন থেকেই প্রিয়, পরে কবিতার জন্মমুহূর্ত পড়েও জানলাম, এটি পড়ে কবিকন্যা ঘ্যাংঘুংও নাকি তার নয় বছর বয়সে এই মত দিয়েছিল যে, সেসময় পর্যন্ত লিখিত সকল কবিতার মধ্যে সেটিই নাকি তাঁর বাবার শ্রেষ্ঠ কবিতা। আসলে যে লেখা যুগজয়ের দাবি নিয়ে দাঁড়ায়, তাকে তো প্রথমে পরিজনের সীমাই ডিঙাতে হয়, এরপরেই না সমাজ-রাষ্ট্র ও দেশকালের প্রশ্ন।
কোনো কবিতাই কখনো এমনি এমনি কারো প্রিয় হয় না, সেটা, অর্থাৎ এমনি এমনি পছন্দ (অল্পসংখ্যক ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে) শুধু ফেসবুকেই সম্ভব; অন্যত্র, এর পেছনে নানা কারণ—জীবনানন্দের ভাষায় `সারবত্তা`—থাকে। তবে এই কারণও যে সবসময় যুক্তিশৃঙ্খলায় বাঁধা থাকে তা নয়, এতে থাকে সত্যমিথ্যার দ্বন্দ্ব, নানা এলোমেলোমি, আনন্দ-বেদনার রহস্য এবং কখনোসখনো বেদনাজড়িত কৌতুকও। আমার ধারণা, এই কবিতায় শেষোক্ত কৌতুকী প্রবণতাটি বর্তমান, এবং বলাই বাহুল্য, আমার ভালোলাগার কারণও সেটি।
কবি অবশ্য সে কবিতার জন্মমুহূর্তের উল্লেখ করতে গিয়ে জানিয়েছেন তিনি `ঘোর নিশাকর’ অর্থাৎ নিশাচর-রাত যত গভীর হয় তিনি উড়ে বেড়ান, ঘুরে, উড়ে বেড়িয়ে শেষরাতে আস্তানায় ফিরে বিকল্প চাবি দিয়ে গ্রিলের দরজা খুলে, ভেতরের ভেজানো দরজা ঠেলে, ঘুরে ঢুকে, একা-একা রাতের খাবার খেয়ে চুপিসারে বউ-মেয়ের পাশে শুয়ে পড়েন, কিন্তু প্রতিবারই কীভাবে যেন ঘুমঘোরের মধ্যেও তাঁর ছোট্ট মেয়ে ঘ্যাংঘুং উপস্থিতি টের পেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। কিন্তু এই প্রাত্যহিকতার মধ্যেই একদিন এই কবির যে প্রতিক্রিয়া হলো সেটিই এই কবিতার জন্মমুহূর্ত—তাঁর কথায়:
`একদিন, ওই ভোররাতে ফিরে খেতে খেতে ভাবলাম...পাশের ঘরে ঢুকে নীল আলোয় আমি দেখব...আমার জায়গাটিতে আমি শুয়ে আছি, ঘুমোচ্ছি মেয়ে-বউয়ের পাশে!...নিজেকে নিদ্রিত দেখে কেমন লাগবে আমার? খুব কষ্ট হবে, করুণায় মন ভরে যাবে এই ভেবে যে, এই যে মানুষটি সারাদিন কত না রোদে রোদে পুড়েছে, আঘাত সয়েছে, অপমান সহ্য করেছে, ক্ষত বিক্ষত হয়ে আজ ঘুমোচ্ছে। মাথার কাছে ঝুঁকে বসব। দু-ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়বে আমার, নিজেরই ঘুমন্ত মুখের ওপর।'
এই ভাবে কষ্ট ও করুণায় আর্দ্র হয়ে কবি লিখে ফেললেন চার পঙ্ক্তির এই চমৎকার কবিতাটি। কষ্ট-করুণা-সংবেদনা কি আত্মবেদনা যাই বলি না কেন, আমার ধারণা এর মধ্যে রয়েছে এক সূক্ষ্ম-গভীর কৌতুক এবং বিহ্বলতা, কারণ কবিতার মূল বক্তব্যে বাস্তব সম্ভব বেদনার সত্য ব্যক্ত হলেও এতে রয়েছে এক অবাস্তব ও অসম্ভব অভিজ্ঞতার/ক্রিয়ার বয়ান।
অবাস্তব এজন্য যে, বাস্তবে কারো পক্ষে তার নিজের নিদ্রিত রূপ দেখা সম্ভব নয়, আর এখানে অন্য কাউকে নিদ্রিত দেখার মধ্যে যেমন কবিতাত্ব নেই, তেমনি কৌতুকও নেই, এখানে কৌতুক সৃষ্টি হয়েছে দ্রষ্টা ও দৃশ্য/নিদ্রিত দু-জনেই একই ব্যক্তি বলে। একে ঠিক কৌতুক না বলে কৌতুকী বিহ্বলতা বলা ভালো—অঁরি বেয়র্গসোঁ তাঁর বইয়ে কাঙ্ক্ষিত কৌতুকহাস্য সৃষ্টির পক্ষে একজন সাংবাদিককে দেওয়া মার্ক টোয়েনের একটি সাক্ষাৎকারের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এমনটিই বলতে চেয়েছিলেন। এই কবিতাটির নিজেকে নিজের নিদ্রা দেখার তথ্য অথবা অদ্বৈত চেতনার কৌতুককর বেদনা আমাকে আলোড়িত করে নিয়ে গেল একশ চোদ্দো বছর আগে বলা অঁরি বেয়র্গসোঁর কথাগুলোর কাছে। শুধু শত বছর আগের কথাই বা বলছি না কেন, মনে পড়ছে সদ্যপঠিত ওরহান পামুকের ইস্তাম্বুল বইটির `আর এক ওরহান’ শিরোনামের প্রথম অনুচ্ছেদটির কথাও—`খুব ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম যে, আমার এই পৃথিবীতে যা দেখতে পাই, তার চেয়েও বেশি কিছু আছে। ইস্তাম্বুলের রাস্তায় কোথাও আমাদের বাড়ির মতোই দেখতে অন্য কোনো বাড়িতে আর এক ওরহান থাকে যে কি না হুবহু আমারই মতো দেখতে আর ওকে আমার যমজ ভাই কিংবা দ্বিতীয় আমি বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।’
ওরহান পামুক লিখেছেন গুজব, ভুল বোঝাবুঝি, কল্পনা এবং ভয় থেকেই তাঁর এই ধারণার উৎপত্তি, মার্ক টোয়েনের ধারণায় রয়েছে `আত্ম-`পর’-তার দ্বন্দ্ব, কিন্তু মৃদুল কোন অনুভব থেকে নিজেকে নিদ্রিত দেখার ধারণায় পৌঁছেছিলেন তাঁর লেখায় এ-বিষয়ে অল্পই বলেছেন, বলেননি ঠিক কোন প্রবণতা থেকে তিনি এই কবিতার মূলাধারে পৌঁছেছেন। ভয় না কি সেই আত্মকরুণা, যা আসলে আত্মপ্রেমেরই নামান্তর?
তবে বই করার আগে ১৯৯৮ সালে এবং মুশায়েরার কবি ও কবিতা বিশেষ সংখ্যায় কবিতাভাবনার শেষে এই কবিতাটি যখন ছাপতে দিয়েছিলেন, তখন, দেখতে পাচ্ছি সেই কবিতাটির শিরোনাম ছিল `মূর্খ’—সেখানে কি কোনো বিশেষ ইশারা ছিল? নিজেকে নিদ্রিত-দেখার মধ্যে নিশ্চয়ই মূর্খতার পরিচয় পেয়েছিলেন? তবে, শেষমেশ তিনি নামটি প্রত্যাহার করে নেন। সেটি ছিল এক অতি উত্তম সিদ্ধান্ত, তা করে কবিতাটিকে মঞ্জিলে যাওয়ার পথ করে দিয়েছিলেন।
উল্লেখ করা জরুরি, এই কবিতা ভালোলাগার আরেক কারণ আমি নিজেও একসময় এই অভিজ্ঞতা যাপন করেছি (এখনো একটু অন্যভাবে তা করে চলেছি), মৃদুলেরই মতোই প্রায় এরকমই আমারও প্রাত্যহিকতা। আমি মৃদুলের মতো ঠিক `নিশাকর’ নই, তবে রাতে মাঝেসাঝে একা একা ফিরি, গেট খুলি, বাইরে থেকে দরজা খুলি, চুপিসারে স্ত্রীপুত্রের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ি, কখনোসখনো ঘ্যাংঘুং-এর মতো আমার ছেলেটিও জেগে ওঠে; অথবা, কখনো একসঙ্গে শুয়ে, স্ত্রী-পুত্র ঘুমিয়ে পড়লে, উজাগরির কারণে অসুস্থতা বৃদ্ধির উদ্বেগ না-বাড়ানোর জন্য, চুপে চুপে শয্যা ছেড়ে পড়ার ঘরে এসে অল্প আলোয় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে আবার চুপে-চুপে ভোররাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। তবু ভয়ে কি আত্মকরুণায়/আত্মপ্রেমে এরকম কবিতা লিখিনি, তবে, মাঝেসাঝে এমন আচরণে নিজেই আচ্ছন্ন ও বিহ্বল হই, আর আমার নিজের প্রতি স্ত্রী-পুত্রের স্বাস্থ্যহানির আন্তরগত কাতরতা সত্ত্বেও, কখনো নিজের প্রতি নিজেরও মায়া হয়, মিথ্যে অভিমান হয় এবং নিজেকেও যেন কীরকম অপরিচিত ও অবাস্তব মনে হয়।
এই সকল সূত্রে, এই কবিতার মুখোমুখি হয়ে আমি যে কথাটি বলতে বাধ্য যে, এমন কবিতা বাংলা কবিতার জগতে মোটেই সুলভ নয়। আমরা এখন খুব সচেতন, সতর্ক ও গাণিতিক; বুদ্ধি ও যুক্তিনির্ভর; কিন্তু এই কবিতায় অবাস্তব ক্রিয়াকে আমলে এনে অন্তরিত মনোবেদনাকে প্রধান করা হয়নি, বরং স্বপ্ন দেখার কথায় ব্যক্ত হতে পেরেছে অবাস্তব/অস্বাভাবিক ক্রিয়ারই স্বাভাবিকতা এবং এতেই মুদ্রিত হতে পেরেছে কবির ভারী গম্ভীর গোঁফের আড়ালের কৌতুক : কৌতুকী বিহ্বলতা ও দ্বন্দ্বের ব্যঞ্জনা।