টাঙ্গাইল শহরের প্রাণকেন্দ্রের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আদালত পাড়ার একটি বিশেষ সুবিধা ও অগ্রসরতা লক্ষণীয়। আমি আদালত পাড়ার বড় কালিবাড়ি রোডের বাসিন্দা। খান মাহবুবের বসবাস এই আদালত পাড়ায়। একই পাড়ায় বসবাসের কারণে ওকে ওর কিশোর বয়স থেকেই চিনি।
আশি দশকের শেষ আর নব্বইয়ের শুরুকাল। আমি তখন শিক্ষকতা জীবন শুরু করেছি। টাঙ্গাইলের শিশুকিশোর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে আমার আবাল্য যে ঘনিষ্ঠতা, সেটি এসময়ে আরেকটু বিস্তৃত মাত্রা পায়। বেশ কটি শিশুকিশোর সংগঠন সক্রিয় ছিলো এসময়। সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগে প্রায়শ সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানে মুখর থাকতো শহর। বলা বাহুল্য, সাহিত্য প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানের অধিকাংশ আর ছোটখাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা সাধারণ গ্রন্থাগারেই হতো। সেদিন আজকের বহুতল সাধারণ গ্রন্থাগার ভবন হয়নি, তা ছিলো দ্বিতল পুরোনো ‘রমেশ হল’। নিচতলা ও দোতলায় এসব অনুষ্ঠান হতো। সাহিত্য বিষয়ক প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে প্রায়ই ডাক পেতাম। সেদিনের এক একহারা গড়নের প্রতিযোগী, কৈশোরোত্তীর্ণ মুখ, আজকের খান মাহবুবের সাথে এই সাহিত্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই আমার নতুনভাবে পরিচয়।
খান মাহবুবের একটি দিক সেসময়েই আমার চোখে পড়ে; সেটি হচ্ছে প্রতিযোগিতার মানসিকতা। সেসময় শহরের তিন চার জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সেও ছিলো একজন, যে ছিলো নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। এটিও মনে আছে, সাহিত্য বিষয়ক যতটি আইটেমে সম্ভব, সে অংশ নিতো। পুরস্কারপ্রাপ্তদের নামের তালিকাতেও সেসময় যে দুতিন জনের নাম ঘুরে ফিরে আসতো, খান মাহবুবও তাদের একজন। সেসময় সে অনেক পুরস্কার অর্জন করেছে, সন্দেহ নেই। ওর এই সাহিত্যনিষ্ঠা আর মাছি’র একাগ্রতায় লেগে থাকার বৈশিষ্ট্য ওর বেড়ে ওঠার মূল্যবান পাথেয়। স্থানীয় পর্যায়ে তার এই সাফল্য তো নিজেই দেখেছি; জাতীয় পর্যায়ে বিতর্কে পুরস্কারও অর্জন করেছে জেনেছি।
নিষ্ঠা তাকে বড় করেছে। গবেষক, প্রকাশক, সংগঠক ও শিক্ষক হিসেবে ওর পরিচিতি। দৃশ্যত একরৈখিক মনে হলেও এসব ক্ষেত্র অত্যন্ত জটিল ও কষ্টসাধ্য। এর যে কোনো একটিতে সফল হতে গেলেও প্রচুর পরিশ্রম ও মেধার প্রয়োজন। উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে খান মাহবুবের সাফল্য আমরা চোখে দেখছি। মেধার বাইরেও শরীর ও মনের সদর্থক সংহতি না থাকলে তো এটা হবার নয়। মুদ্রণ ও প্রকাশনাসহ জাতীয় গ্রন্থ ভাবনার সে একজন স্বীকৃত জন, এটি আমাদের গর্বের বিষয়। সে নিজ জেলার ইতিহাস লিখেছে, স্বীকৃত জার্নালগুলোতে লিখছে। এছাড়া রয়েছে রচিত ও সম্পাদিত অনেক বই, যেগুলো রেফারেন্স হিসেবে দেশবিদেশের উচ্চশিক্ষালয়ে পঠিত হয় বলে জেনেছি। ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, মানবসম্পদ বিষয় এমনকি রম্যরচনায়ও সে পারদর্শিতা দেখিয়েছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে ও শিক্ষকতায় জড়িত থেকে সে তার নিষ্ঠা ও প্রতিভার আলো বিতরণের যথার্থ সুযোগ পেয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের গ্রন্থমেলা আয়োজনে তার সম্পৃক্ততা দীর্ঘদিনের। এছাড়াও রয়েছে প্রকাশনা শিল্পের সংগঠনে নেতৃত্ব। এসবই আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রেরণাদায়ক। গবেষক, প্রকাশক, সংগঠক ও শিক্ষক হিসেবে সে আজ প্রতিষ্ঠিত। সে তার ঐকান্তিকতায় এসব ক্ষেত্রকে ভিন্ন মাত্রিকতা সত্ত্বেও আপন করে নিতে পেরেছে। সব কটিতেই তার স্বচ্ছন্দ ও সপ্রতিভ বিচরণ।
খান মাহবুব পলল প্রকাশনী ও ছোঁয়া এডভার্টাইজিং এর স্বত্বাধিকারী। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি শিক্ষকতা কাজে নিয়োজিত মানুষের সাথে ব্যবসার লক্ষ্মী সবসময় সহাস্য থাকে না বলেই শুনি। ওর ব্যবসায়ে লক্ষ্মীর আনন কেমন, তা জানা নেই। তবে সত্যি বলতে, আমি ওর ভেতর ব্যবসায়িক প্রবণতাটি দেখিনি। সে যেখানেই থাকুক, একটি সেবা’র মনোবৃত্তিকেই সে বড় করে তুলে আনতে পেরেছে বলে মনে করি। কখনো হঠাৎ আজিজে’র পলল কিংবা ছোঁয়া’য় ঢুকলে আমি বেশ সহজ স্বস্তি অনুভব করতাম এই ভেবে যে এ-তো আমাদের খান মাহবুবের প্রতিষ্ঠান। সেখানে ওর সাথে কখনো দেখা হতো, কিছু সময়ের জন্য আড্ডাও হতো। আজিজের আড্ডা ছেড়েছি প্রায় দশ বারো বছর। কাঁটাবন কনকর্ডেও খান মাহবুবের কর্মস্থল আছে। এখন এখানটাতেই মাঝেমাঝে দেখা হয়। দেখা হলে কুশলাদি জিজ্ঞেস করি, তাতে থাকে আন্তরিকতার স্পর্শ।
খান মাহবুব দেশের বিভিন্ন স্থানের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংগঠকদের একজন বিশ্বস্ত সেতু। টাঙ্গাইলের কথাই বলি। কবিধাম বলে পরিচিত এই শহরে মাঝেমাঝেই সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। আতিয়েতা হচ্ছে সেসব অনুষ্ঠানের মহার্ঘ্য অলঙ্কার ও অহঙ্কার। সেখানে আমন্ত্রণ পেলে সাহিত্য ও শিল্পজন আনন্দিত হন। এসব অনুষ্ঠানের যারা আয়োজক ও সংগঠক তাদের ত্যাগ বিশাল। দেশের নানাপ্রান্ত থেকে, বিদেশ থেকে অনেক গুণীর সমাবেশ ঘটে এখানে। তাদের যাতায়াতটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারত থেকে যারা আসেন তারা প্রায়শই ঢাকা হয়ে টাঙ্গাইল আসেন। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় থাকেন শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে জড়িত একটি বড় অংশ সুধী। এদেরকে টাঙ্গাইলে আনা-নেয়ার যে জটিল কাজটি, সেখানে খান মাহবুব তার অপরিহার্যতার প্রমাণ দিয়েছে বরাবর। কবিধামের লোক বলে আমিও আমন্ত্রণ পাই। অনেক কবি সাহিত্যিক সংস্কৃতিজন মিলে বাসে করে টাঙ্গাইল যাত্রার আনন্দটিই অন্যরকম। শাহবাগে ভোর থেকে অপেক্ষা করে বড় ক’টি বাস। একে একে আমন্ত্রিতরা এসে জমায়েত হন। তার পর স্নিগ্ধ সকালের রেশ থাকতে থাকতেই টাঙ্গাইল অভিমুখে রওনা; পথে বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা আমন্ত্রিতকে গাড়িতে তোলা। সেই গাড়ি পৌঁছুলেই তবে টাঙ্গাইলের অনুষ্ঠান শুরু। সবার নিরাপদ আরোহণ ও গন্তব্যে পৌঁছানোর যে আয়োজন তার ঝক্কি অনেক। এই হ্যাপা সামলানোর পুরোভাগে যে এসে সবসময় দাঁড়ায় সে আমাদের খান মাহবুব। বাল্যসামাজিকীকরণে মন ও মগজের গড়নটি একটি সবল আদল লাভ করেছিলো বলেই বোধ করি জীবনের কঠিন পথে সে প্রতিশ্রুতি রেখে চলছে। এটি অটুট থাকবে অবশ্যই।
একসময় ওর প্রতিযোগিতার কিছু ইভেন্টের মূল্যায়ন করেছি; আজ ওর কর্মজীবনের ইভেন্টগুলো আরো অনেক বেশি শক্ত, আরো বেশি প্রতিযোগিতামূলক। সেসবের খণ্ড খণ্ড মূল্যায়নে নানা স্থান থেকে নিশ্চয়ই সে তার পুরস্কার অর্জন করছে। কিন্তু ওর সম্পর্কে অল্প কটি কথা লিখতে গিয়ে আজ ওর অর্জন ও অগ্রসরতার ব্যক্তিকৃত যে সমগ্র রূপটি সামনে এসে দাঁড়ায়, অলক্ষ্যে সেটিরও দাবি ‘বিচার’ কিংবা ‘মূল্যায়ন’। এই বকুল শহরের মাটি ও মুগ্ধতায় বেড়ে ওঠা আমাদের পরবর্তী পথিকদের একজন কর্মপ্রবণ ব্যক্তিত্ব এই খান মাহবুবের জন্য অগ্রজের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। এর চেয়ে সতেজ পুরস্কার তো সঞ্চয়ে নেই।