৪৫ বছর বয়স কি নিজের আত্মস্মৃতি লেখার জন্য যথেষ্ট সময়? এই প্রশ্নটি তুলে বাবার একটি প্রবচন মনে পড়ছে বারবার—‘…বাঙালির আত্মজীবনী হচ্ছে শয়তানের লেখা ফেরেশতার আত্মজীবনী।’
নিজে যখন কারো আত্মজীবনীতে কেবল ভালো ভালো কথা পড়ি তখন মুচকি হাসি আসে—অবশ্য অন্যকে হেয় করে তাকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে বিতর্কিত কথা লিখে নাম কামিয়ে কী লাভ? তাহলে কী করা যায়, কী লিখব, কোথায় থেকে শুরু করব ভেবে জীবনের শুরু থেকেই শুরু করার সিদ্ধান্ত নেই।
আমার জন্ম ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের নিউ পলি ক্লিনিকে। সেসময় খুব একটা ক্লিনিকে কারো জন্ম হতো না (ব্যয়বহুল ছিল বিধায়)। জেনেছি, জন্ম-মুহূর্তে মাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিয়েছি। মাকে কষ্ট দিয়ে পৃথিবীতে এলেও আমি না কি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠিনি। কাঁদানোর জন্য পা উপরে, মাথা নিচে রেখে ডাক্তারের ঝাঁকুনির পর চিৎকার দিয়েছিলাম। হয়ত ভাববেন, মেয়ে বেশ অন্যরকম হবে বলেই এরকমটা করেছিল। কী জানি, কেমন হয়েছি! প্রথম মেয়ে এবং ৭ বছর পর আমার ছোটোবোনের জন্ম হওয়ায় ভালোই আদর পেয়েছিলাম।
জন্ম থেকে কৈশোরকাল পর্যন্ত আজিমপুর থেকেছি। যৌথ পরিবার। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমরা ছাড়াও দাদা-দাদি, চাচা-ফুফুরা আমাদের সাথে থাকতেন। পারিবারিক সব খরচ বাবাই বহন করতেন। তাই আদর মানে এমন নয় যে, চাইলেই সব পেতাম! পেতাম প্রাণঢালা স্নেহ ও কড়া শাসন। রংবেরংয়ের কাপড়চোপড়, খেলনা, বারবি, যখন তখন চাইনিজ/ফাস্টফুড খেতে পাইনি বললেই চলে।
শুনেছি, ছোটোবেলায় আমার না কি আজব কিসিমের অভ্যাস ছিল। যেমন—ইট খেতাম। বা, কারো জন্মদিনে নিয়ে যাওয়া উপহার ফিরিয়ে আনতে চাইতাম। মা বলতেন ছোটোবেলায় আমি না কি ভীষণ হিংসুটে ছিলাম। জানি না এসব বাজে অভ্যাস সে সময়ে কীভাবে হয়েছিল।
আগেই বলেছি, যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। তাই বহু বছর আমার নিজের কোনো রুম ছিল না। ৫ম/৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বাবার সাথে একখাটে ঘুমাতাম। বাবার ছিল রাজ্যের বই কেনার শখ। ঘরময় বই-ই ছড়ানো ছিটানো থাকত। মা মাঝারি ধরনের শৌখিন মানুষ। বাবাকে বেশ ভয় পেতেন, তাই তাঁর পছন্দের বাইরে তেমন কিছু করতেন না।
নূহ-উল-আলম লেনিন স্যার একদিন আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ‘আমার আজকের যে স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে তা কীভাবে তৈরি হয়েছে?’ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের মেয়েদের মতো বড়ো হইনি। আমাকে খেলার জন্য বারবি কিনে দেওয়া হয়নি। আমাকে স্কুল-কলেজ-কোচিংয়ে মা-বাবা নিয়ে যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাগুলির সময়ও আমি একা একা বাড়ি ফিরেছি। স্কুলজীবন থেকেই আমি নীলক্ষেত থেকে একা একা বই কিনতাম। আমি রিকশায় করে কাজের জন্য একা একা কত জায়গায় যে গিয়েছি! মা তার অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বাবা লেখালেখি। তাই তারা আমাকে বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছিলেন। একা একা কাজ করতে করতে অল্প বয়সেই বলা যায় চিন্তাধারায় বেশ পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার নিজেকে রক্ষা করে সব কাজ করতে দেখে আমার উপর বাবার ১০০% ভরসা তৈরি হয়েছিল। আমাকে নিয়ে তাঁকে কখনো দুশ্চিন্তা করতে দেখিনি।
বইয়ের মাঝেই বড়ো হচ্ছিলাম। শিল্প-সাহিত্যের মানুষদের দেখে বড়ো হচ্ছিলাম। কিন্তু আমার মনে হত আমি ভেতরে ভেতরে উদার না হয়ে বরং উচ্চাভিলাষী ও আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছিলাম। হয়ত কোনোকিছুর অবদমন থেকেই এসবের সৃষ্টি। বাবাকে ভীষণ ভয় পেতাম। প্রচণ্ড রাগী মানুষ ছিলেন। নিজে পড়তেন, আমাদের পড়াতেন। বাবার কাছে নামতা শিখেছি। বাবা ক্লাবে দাবা খেলে বাসায় ফিরেই নামতা ধরতেন। কখনো এই নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি। নামতা না পারলে বকার সাথে মারও খেতাম।
স্কুলজীবনে কখনো প্রথম থেকে তৃতীয়ের মধ্যে থাকিনি। মাঝারি রেজাল্ট করতাম। চারপাশের ঘনিষ্ঠ সবাই আমার চেয়ে ভালো ফলাফল করত। মা আমার ফলাফল নিয়ে সবসময় খুব দুশ্চিন্তা করতেন। আর আমার দুশ্চিন্তা ছিল বাবাকে কীভাবে রিপোর্ট কার্ড দেখাব সেই ভেবে। উফ্! কী যে ভয়ংকর সময় পার করে এসেছি! আজও এ নিয়ে আমি দুঃস্বপ্ন দেখি।
মনে পড়ে, ক্লাস টেন-এ টেস্ট/প্রিটেস্ট দুটো পরীক্ষাতেই খুব খারাপ করেছিলাম। মা চিন্তায় ফ্যাকাশে হয়েছিলেন আর বাবার ছিল রক্তজবার মতো লাল চোখ। এস.এস.সি পরীক্ষার আগের ৩ মাস যেন মানুষ ছিলাম না। হয়ে গিয়েছিলাম অতিমানবী। দিন-রাত পড়তাম। দৌড়াতাম এই স্যার থেকে ঐ স্যারের কাছে। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। বিজ্ঞান বিভাগে স্টার মার্কস ও গণিতে (গণিতকে যমের মতো ভয় পেতাম) লেটারসহ পাস। মনে পড়ে, বাবা সেই রাতেই পত্রিকা অফিসে গিয়ে এস.এস.সি’র ফলাফল দেখে এসেছিলেন। প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগ থেকে স্টার মার্কসসহ পাশ করলাম। বাবা আবারও খুশি হলেন। তিনি উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন না, তাই ভালো ফলাফল করেননি। কিন্তু আমি মানবিক বিভাগে স্টার মার্কস পাওয়ায় তিনি বললেন, ‘তুই তো আমাকে দেখিয়ে দিলি রে।’ নিজের মধ্যে কনফিডেন্সই আসল। বাবা তো কেমন তা ভালোভাবে জানতাম (আমার ভর্তির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকেই বলবেন না) তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ‘খ’ ইউনিটে চান্স পাওয়ার জন্য বলা যায় আদাজল খেয়ে নামলাম। ফলাফল—খ ইউনিটে ৬৪তম হলাম। কী যে আনন্দ!
বাবার সাথে নানারকম পরামর্শ করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হই। আইন বিভাগের ক্লাস হতো এনেক্স ভবনে। এনেক্স ভবনকে আমার বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুল বলেই মনে হতো। ভালো ভালো শিক্ষকেরা পড়াতেন। তবে মনে হত স্কুলের মতো পড়াচ্ছেন। অনেক বড়ো প্রেক্ষাপট/বিষয় নিয়ে পড়ানোর মতো করে কেউ পড়িয়েছেন কি না মনে পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কোনো শিক্ষকের কাছে বাবার পরিচয়ে পরিচিত হইনি।
পড়াশোনায় মন বসেনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। হয়ত অন্য কিছুর স্বপ্ন দেখতাম। ফলাফল সেকেন্ড ক্লাস, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই পায়। ক্লাসের দুজন বান্ধবীর কথা সবসময় মনে রাখব। তারা দুজন হলেন—ব্যারিস্টার রিমি নাহরিন ও জজ নাজিয়া নাহিদ। এদের দুজনের নোট পড়ে এল.এল.বি অর্নাস পাস করে যাই, এইতো অনেক।
যাই হোক, এবার চাকরির চেষ্টা। কখনো বেসরকারি চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না। প্রথম থেকেই সরকারি চাকরি করব বলে ঠিক করেছিলাম। নিচ্ছিলাম প্রস্তুতিও। মা আমার চাকুরি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করতেন, বাবা স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল মাঝারি হলেও আমার কখনো চাকুরি নিয়ে দুঃচিন্তা হয়নি। সবসময় মাথায় ছিল প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকুরি করব এবং সেই চাকুরি হতে হবে ঢাকায়। তাই বিসিএস বা জুডিসিয়াল সার্ভিসের চাকুরির পরীক্ষার জন্য সময় অপচয় করলাম না। সে সময়টা আমাদের জন্য তেমন অনুকূল ছিল না। তাই আধাসরকারি/স্বায়ত্তশাসিত যে-সকল প্রতিষ্ঠানে চাকুরির পরীক্ষা দিলাম, ভালো পরীক্ষা দেয়া সত্ত্বেও অকৃতকার্য হলাম। নিঃসন্দেহে খারাপ লাগছিল। কিন্তু কী করব বুঝতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে ২০০৪ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাবার উপর আক্রমণ হলো। সেসময়ে আমাদের অবস্থা সারা বাংলাদেশ জানে। তাই আর বিস্তারিত কিছু লিখলাম না। একবাক্যে বলতে পারি ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সময় দেয়া, চাকুরির পরীক্ষার প্রস্তুতিসহ সকল কিছুই চাপা পড়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ মাথায় দুশ্চিন্তা কাজ করত। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকার দেখতাম। আগেই বলেছি, চাকুরি নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা আমার হতো না। বাবার মৃত্যুর সাথে সাথেই হঠাৎ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনের চাকুরি পেয়ে যাই। চাকুরিটা আমাকে যেন আবার কনফিডেন্স ফিরিয়ে দিলো।
সময় বয়ে যাচ্ছিল। আমার বয়স তখন ২৫/২৬। নিজের ব্যক্তিগত জীবন গুছিয়ে নেওয়ার সময়। কিন্তু সেসময় আমি বারবার হোঁচট খেয়েছি। বিশ্বাসে গড়া ভালোবাসার সম্পর্কগুলো ঝনঝন করে ভেঙে গিয়েছিল কাঁচের বাসনের মতো। আজ পেছনের সেসব কথা মনে করে হাহাকার হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু সেসময়ে পাশে কাউকে না পেয়ে কীভাবে আমি একা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম আজ এসে তা ভাবতে গেলে আমার ভয় হয়। সেসময় আজকের মতো অনলাইনে মনোবিদ পাওয়া যেতো না। সরাসরি গিয়ে আমার বয়সী কয়জনই বা মনোবিদের শরণাপন্ন হতো? অল্প বয়সে এতো সহ্যশক্তি কীভাবে হয়েছিল জানি না। বারবার প্রতারিত হয়েও কখনো আত্মহত্যার কথা মনে হয়নি। হয়ত বাবা বিখ্যাত মানুষ, তাই তাঁর সম্মানের কথা মাথায় থাকত। এই ভাবনা হয়ত আমাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে।
জীবনের চলার পথের বাঁধাকে খুব কম ক্ষেত্রেই মেনে চলছি। একান্ত বাধ্য না হলে নয়। কেউ যখন আমাকে নানাভাবে পীড়নের চেষ্টা করেছে তখন দু-একজনকে ঘা বসিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দেরি করিনি। মেনে নেয়া জীবনকে আমার জীবনই মনে হয় না। তাই নিজের মতো চলছি। বলা যায়, এজন্যই এখন আমার স্বস্তির জীবন।
সেলিব্রেটি ব্যক্তির মেয়ে আমি। সেইসাথে অনেক বিখ্যাত/বড়ো বড়ো ডিগ্রিধারী মানুষ চারপাশে দেখে বড়ো হয়েছি। কিন্তু জানি না কেন যেন সেলিব্রেটিদের প্রতি আমি আকৃষ্ট হতাম না। তাদের অনেকের বাইরের ও ভেতরের রূপ দেখেছি সম্পূর্ণ আলাদা। অনেককে দেখেছি ভেতরে চরম স্বার্থপর ও ঘরে কর্তৃত্ব ফলাতে পছন্দ করতেন। বাবার নামের সুবাদে হয়ত ইচ্ছে করলেই নিজের জীবনেও পেয়ে যেতাম কোনো সেলিব্রেটি পুরুষ। কিন্তু আমি বিখ্যাত কয়েকজন ব্যক্তির স্ত্রীর যে চরম দুরবস্থা নিজের চোখে দেখেছি (তাদের প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে ভালো থাকার মিথ্যা অভিনয় করতে দেখেছি) সেই ভয়েই সেসময়ে উঠতি সেলিব্রেটিদের থেকে দূরে থাকতাম। বলা যায়, এজন্যই বেঁচে গিয়েছি। আর হ্যাঁ, বাবা নিজেও চাইতেন না আমার পার্টনার কোনো সেলিব্রেটি পার্সন হোক!
জীবনে কোনোকিছুই সহজে পাব না, এটাই বোধহয় আমার নিয়তিতে লেখা। তাই সহজে মাতৃত্বের স্বাদও পাইনি। বেশ কয়েকবার মিসক্যারেজের সাথে একটোপিক প্রেগনেন্সির মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জীবনে হয়েছে। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম মা আর বোনের দেয়া রক্তে।
তারপর ২০০৯ সালে পেয়েছি আমার আনন্দ আমার শাইনিকে। আমার ছেলে। যে আমার জীবনে এনে দিয়েছে প্রচণ্ড গতি। শাইনি জীবনে না এলে হয়ত জীবনটা কাটাতাম কচ্ছপের মতো।
এত কষ্ট করে যে সন্তান পেলাম তাকে নিয়ে যে সারাক্ষণ মেতে থাকব তা হয়নি। বোধহয় কেউই তা পারে না। শাইনি হওয়ার একবছরের মাথায় আবার বিভিন্ন সরকারি চাকুরির জন্য আবেদন করতে থাকি। শাইনি বোধহয় আমার জীবন সাজাতে এসেছে। সময় ২০১০ সাল। প্রায় একইসাথে দুটি সরকারি চাকুরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চাকুরিতে যোগদান করি এবং সেখানেই আছি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সেসময় চেয়ারম্যান ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম স্যার। স্যারের কাছে নানা কারণে আমি কৃতজ্ঞ।
স্কুলে পড়ার সময় দেয়াল পত্রিকায় লেখালেখি করতাম। কিন্তু আজকের মতো একের পর এক বই প্রকাশ করব তা কখনো ভাবিনি। বাবা লেখক ছিলেন বলেই আমিও যে তাকে দেখে লেখালেখির জগতে আসব আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। বরঞ্চ বাবার মৃত্যুর পর আমার লেখা শুরু। সেসময়ে প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছিলাম ‘আব্বার কাছে খোলা চিঠি’। লেখাটি পড়ে কবি শামসুর রাহমান আমার মাকে ফোন করে বলেন, আমি যেন লেখালেখি চালিয়ে যাই। বলা যায় এই ফোনকলটি আমার লেখার পেছনে প্রথম উৎসাহ। এরপর যুগান্তর পত্রিকায় একটি গল্প লিখলাম—নাম ‘বোবা’। গল্পটি পড়ে কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমাদের বাসার ল্যান্ডফোন নম্বর জোগাড় করে আমার মাকে ফোন দেন। তিনি মাকে বলেন—‘মৌলি ভালো লেখে, ওকে লিখতে বলবেন।’ আরেকটু উৎসাহ ও সাহস পেলাম লেখার জন্য। আগেই বলেছি, বাবাকে নিয়ে একটি বই লিখব সেই চিন্তা ছিল। লেখাও অনেকখানি হয়ে গিয়েছিল। চিন্তায় ছিলাম কোন প্রকাশনী থেকে বইটি বের করব। পরিচিত সবাই বললেন আগামী প্রকাশনী থেকে বই বের করবে, চিন্তা কী? আমার চিন্তা ছিল আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি চাচাকে নিয়ে। কারণ আমি জানি, গনি চাচা যত ঘনিষ্ঠই হোক না কেন যেমন তেমন বই তিনি প্রকাশ করেন না। একদিন সকালবেলা পাণ্ডুলিপি নিয়ে ভয়ে ভয়ে গনি চাচার বাসায় হাজির হলাম। আমি বাবাকে নিয়ে বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি বলে তিনি খুশি হলেন। পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমি পড়ব।’ গনি চাচা ব্যস্ত মানুষ। তিনি কি আদৌ আমার পাণ্ডুলিপি পড়বেন? এই চিন্তা নিয়েই তার বাসা থেকে বের হলাম। এরপর সপ্তাহখানেক চলে গেল। আমি ভয়ে গনি চাচাকে আর ফোন দেইনি। একদিন গনি চাচা নিজে থেকেই ফোন দিলেন। ফোন দিয়ে বললেন—‘বই পড়েছি। ভালো হয়েছে। পাণ্ডুলিপি কারেকশন করেছি। বাসায় পাঠাচ্ছি।’ আমি তো মহাখুশি। গনি চাচার মতো একজন প্রথম শ্রেণির প্রকাশক আমার লেখা পছন্দ করেছেন এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে? বিকেলবেলায় আমার বাসায় সংশোধিত পাণ্ডুলিপি হাজির। পাণ্ডুলিপিতে গনি চাচার কাটা-ছেঁড়া সংযোজন-বিয়োজন। কিছুক্ষণ পরেই গনি চাচা হাসতে হাসতে ফোন দিলেন এবং বললেন—‘মৌলির তো ধারণা ছিল আমি পড়ব না, কেমন পড়লাম?’ আমি বললাম—‘গনি চাচা, আমার ধারণা ছিল, প্রকাশক কেবল বই বের করে, এত পড়ে দেখার সময় কই?’ গনি চাচা হাসতে হাসতে বললেন— ‘আমি সেই প্রকাশক নই, পাণ্ডুলিপি দিলেই বই প্রকাশ করব। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে তাঁর যত কাছের মানুষই লিখুক না কেন, সেটা ঠিক কি না আমার পড়ে দেখতে হবে।’ গনি চাচাই বইয়ের নাম দিলেন ‘হুমায়ুন আজাদ আমার বাবা’। বইটি প্রকাশের পর বইমেলায় প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়। প্রথম আলো পত্রিকা সেসময় সাহিত্য পাতায় বই মেলায় তরুণ লেখকদের প্রকাশিত ১০টি বইয়ের উপর রিভিউ করত। আমার বইটি রিভিউয়ে প্রথম স্থান পায়। রিভিউ করেন, লেখক আহমাদ মাযহার। এরপর একে একে আগামী প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশিত হয়েছে।
প্রিয় কবি পিয়াস মজিদ বইমেলায় লেখক মঞ্চে আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন—‘লেখকের ছেলেমেয়েরা একটি বই প্রকাশ করেই থেমে যান, আপনি কীভাবে অনবরত লিখছেন?’ মাঝে মাঝেই পিয়াসের প্রশ্নটি আমার মাথায় আসে। নিচে এর কারণ সামান্যই উল্লেখ করলাম:
বই লেখার সময় গতানুগতিকতার স্থান দেইনি। বিষয়ের বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দিয়েছি। বাবা যেহেতু দেশের প্রথম সারির লেখক ছিলেন, তাঁর জীবিতকালে দেখেছি লেখকদের মধ্যে ব্যাপক ঈর্ষা। একে অপরের বিরুদ্ধে কাদা-ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত তাঁরা। তবে সে সময়ে আমার ধারণা ছিল, একজন লেখক আরেকজন লেখকের লেখা পড়তেন এবং মন্তব্য করতেন। নিজে যখন লিখতে আসলাম তখন দেখলাম—এখন বলতে গেলে কেউ কারো লেখা পড়ে না। এখানে বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন জনকে ওপরে তোলে বা নিচে নামায়। এখন পর্যন্ত কোনো রকম গ্রুপে জড়িত না হয়ে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থেকে লেখা চালিয়ে যাচ্ছি। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অভ্যাসটা বোধহয় বাবার কাছ থেকে পাওয়া। বিচ্ছিন্ন থাকলে সুবিধা এই যে, অনেক কিছু চিন্তা করা যায়, অবিরাম লেখা যায়।
নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকায় লিখছি। কখনো কোনো পত্রিকায় লেখা ছাপানোর জন্য পত্রিকার কারো সাথে খাতির করার প্রয়োজনবোধ করিনি। ছোটো বড়ো সব পত্রিকা থেকে অনুরোধ পেয়েছি নিজের লেখার গুণেই। বরং সময়ের অভাবে তাদের লেখা দিতে পারি না।
বইয়ের কাভারে যেমন নিজের নাম দেখতে ভালো লাগে, তেমনি উৎসর্গপত্রে নিজের নাম দেখাটা আনন্দের। বাবার বিভিন্ন বইয়ের উৎসর্গে আমি ছিলাম। বাবার মৃত্যুর পর ভেবেছিলাম, আর কারো বইয়ের উৎসর্গপত্রে হয়ত আমার নাম থাকবে না। কিন্তু থেকেছে। ‘বুনন’ নামে একটি ছোটো পত্রিকা তাদের উৎসর্গে লিখেছে ‘মৌলি আজাদ—বহুমাত্রিক পথ চলায় বাবার আদর্শ নিয়েই যার এগিয়ে চলা।’
প্রিয় কবি মারুফুল ইসলামের চমৎকার কবিতার বই ‘কষ্টের রংধনু’ আমাকে উৎসর্গ করেছেন। কবিকে ধন্যবাদ।
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ঝর্না রহমান আমার লেখা পড়ে নানাভাবে উৎসাহ দেন। আপাকে ধন্যবাদ।
বিখ্যাত লেখক হাসনাত আব্দুল হাই স্যার যখন আমার বই পড়ে ফেসবুকে লেখেন—“লেখক/গবেষক হুমায়ুন আজাদের মেয়ে যে জন্মসূত্রে লেখকের স্বভাব পাবে এবং লিখবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মৌলি আজাদের এরই মধ্যে ৮টি বই বেরিয়েছে। ‘ইগলের চোখ’ তার সাম্প্রতিকতম গল্পগ্রন্থ। এই সংকলন যে জন্য বিশিষ্ট তা হলো বিষয়ের বৈচিত্র্য। নামগল্পের মূল চরিত্র বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ডকুমেন্টারি আঙ্গিকে লেখা এই গল্পে বর্ণনায় ব্যবহার করা হয়েছে একইসঙ্গে প্রথম ও তৃতীয় পুরুষ, যা গল্পটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। মৌলি প্রবাস জীবনের বঞ্চনা হতাশা নিয়ে লিখেছে অভিজ্ঞদের মতো। একই দক্ষতা দেখা যায় গ্রামের নিম্নবিত্ত দরিদ্রদের জীবনের আলেখ্য বর্ণনায়। লেখক হিসাবে মৌলির আগ্রহ ও কৌতূহল সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জীবন। এই মানবতাবাদী দৃষ্টি, তাকে অনেকদূর নিয়ে যাবে।” তখন আরো লিখতে ইচ্ছে হয়।
জানি না কেমন লিখছি, তবে লিখে চলছি। ইতোমধ্যে আমার বেশকিছু গল্প ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। যারা করেছেন দুজনেই অভিজ্ঞ অনুবাদক। একজন হলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুবাদক জনাব আলম খোরশেদ, অপরজন হলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অনুবাদক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। দুজনের কাছে কৃতজ্ঞ আমি।
প্রায়শই প্রশ্নের সম্মুখীন হই, কখন লিখি? লেখার জন্য কোনো টাইমটেবিল নেই আমার। বলতে গেলে সারাক্ষণ বিভিন্ন টপিক মাথায় ঘুরতে থাকে। নোট ডাউন করে রাখি। অবসর না কাটিয়ে লিখে ফেলি। একা ঘুরতে পছন্দ করি, সে সময়টা নানা বিষয় ও চিন্তার সময় আমার।
মনের আনন্দে কিছু কাজ করি। যেমন উপস্থাপনা। এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা/প্রশিক্ষণ ছিল না। ইউজিসিতে অফিসিয়াল কিছু প্রোগ্রাম উপস্থাপনা করে এ কাজের শুরু। জানি না, কীভাবে তা অন্যরা জেনেছিল! একে একে উপস্থাপনার জন্য ডাক পেয়েছি চ্যানেল ২৪, বিটিভি, এসএ টিভি ও সংসদ টিভিতে। এ কাজ করার জন্য কারো কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়নি।
এরকম আরেকটি কাজ হল সমাজসেবা। থার্ড জেন্ডার নিয়ে কাজ করা প্রথম পছন্দ। এরপর দুঃস্থ শিশু ও প্রবীণদের নিয়ে। এখানে একটা কথা আসে—এদেরকে সার্পোট করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা আমি পাচ্ছি কোথা থেকে? আমি কোনো ফাউন্ডেশন করে কাজ করি না। আমার বাবাও আমার জন্য টাকার খনি রেখে যাননি। তাহলে কোথা থেকে সাহায্য করছি? সম্পূর্ণ নিজের অর্থে আমার কাজ করার পছন্দের জায়গায় আর্থিক সাপোর্ট করছি। নিজের বিলাসিতা, সঞ্চয় বাদ দিয়েই তা করা সম্ভব হয়েছে। যখন নিজের ইচ্ছে পূরণ না করে যার যেখানে দরকার সেখানে সার্পোট করি তখন সত্যিকার অর্থেই মানসিক তৃপ্তি পাই। যারা এ কাজ করেন না তারা কখনো এই তৃপ্তির স্বাদ কেমন তা বুঝবেন না।
দিন কাটছে। বয়স বাড়ছে। চুল পাকছে। চোখের নিচে বলিরেখা পড়া শুরু করেছে। এভাবেই বোধহয় জীবন এগিয়ে যায়।
জীবনে সাফল্য বলতে কী বুঝি—সে তো একেক জনের কাছে একেকরকম। নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে সাফল্য বা ব্যর্থতা কিছুই খুঁজতে ইচ্ছে হয় না। কেন ইচ্ছে হয় না তার কৈফিয়তও নিজের কাছে তলব করিনি। নানারকম কষ্ট-অপমান-ব্যর্থতা ছাপিয়ে জীবনকেই এখন প্রাধান্য দেই। হয়ত চল্লিশের পর জীবনকে বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়।