X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’

খান মাহবুব
১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:২০আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:২১

বাঙালির সংস্কৃতির আকাশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। আমাদের মনোভুবনে স্থায়ী হয়ে আছে এঁদের সৃজনকলা। রবীন্দ্র-নজরুলের সৃজনর্কম শুধু চর্চা নয়, অবিকৃত রাখার নৈতিক দায়ও আমাদের। এজন্য অস্কারজয়ী ভারতীয় সংগীত পরিচালক এ আর রহমান (আল্লাহ্ রাখা রহমান) সম্প্রতি হিন্দি ‘পিপ্পা’সিনেমার জন্য নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’গানটি নতুন করে সুরারোপ করে বির্তকের জন্ম দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বইছে নানান জনের আবেগের ঢেউ। কেউ এ আর রহমানকে তুলোধুনো করছেন, কেউ বা বলছেন একটা গানই তো, নতুন সুরে এনেছে শুনলে শুনবেন, নচেৎ নয়। এতে এত উত্তেজনা কেন? বিষয়টা আবেগ পরিহার করে যৌক্তিকতা, রীতি, বিধি, পরম্পরা মেনে দেখলে কেমন দাঁড়ায়? এসব ছাপিয়ে কপিরাইট আইন এ বিষয়ে কী বিধান দেয় তাও পরখ করা জরুরি।

১৯২১ সালে নজরুল সবে ফিরেছেন সৈনিক ব্যারাক থেকে। তাঁর চিন্তা থেকে কর্ম সবই বারুদ মাখা। ভারতের স্বাধীনতার পথিক হিসেবে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করে তোলপাড় সৃষ্টি করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ স্বাধিকার সংগ্রামীরা কারারুদ্ধ হচ্ছেন। যদিও মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নজরুলের মত ছিল না, কিন্তু দেশবন্ধুর প্রতি নজরুলের ভালোবাসা ছিল।

দুই
এজন্যই দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে দেশবন্ধু সম্পাদিত ‘বাঙ্গালার কথা’ পত্রিকার জন্য এই বারুদ-মাখা কবিতাটি লেখা। নজরুলের বন্ধু মুজাফ্ফর আহমদ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “নজরুল বসে খানিক সময়ের মধ্যে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ রচনা করেন। কবিতাটি পরবর্তীতে ভাঙার গান (১৯২৪) কাব্যগ্রন্থে অর্ন্তভুক্ত হয়। কবিতা হিসেবে রচিত ও ‘বাঙ্গালার কথা’ পত্রিকায় ছাপা হলেও শোনা যায় হুগলি জেলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ রাজবন্দীরা কোরাস করে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গেয়ে উঠতেন। গান হিসেবে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ভারতের স্বাধিকার সংগ্রামের সঞ্জীবনী জুগিয়েছে মানুষের রক্ত বারুদে। এজন্য ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থ ব্রিটিশ শাসক বাজেয়াপ্ত করেছিলো।”

নজরুল তার সব গান সুর করেননি। তবে অধিকাংশ গান নিজেই সুরে করেছেন।‘কারার ঐ লৌহ কপাট’নজরুলের নিজের সুরের দাবি থাকলেও রেকর্ড হিসেবে ১৯৪৯ সালে কলম্বিয়া রেকর্ড কোং (আই ডি: জিই ৭৫০৬)-এ শিল্পী হিসেবে গিরীন চক্রবর্ত্তীর নাম আছে। সুর যদি নজরুলের না হয়েও গিরীন চক্রবর্ত্তীর হয় সেক্ষেত্রেও ওই সুরটি নজরুল মেনে নিয়েছিলেন এবং আদি সুরটিই ভারতের আন্দোলন সংগ্রামের জনসংস্কৃতিতে পরিণত হয়। গিরীন চক্রবর্ত্তীর ছিলেন নজরুলের স্বীকৃত একনিষ্ঠ সহকরি। কাজেই সুর ও বাণী একীভূত হয়েছে। এমনকি কলম্বিয়া রেকর্ড কোং ও পরবর্তীকালে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ সিনেমায় ব্যবহৃত ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’গানটির সুরও প্রায় অভিন্ন ও শিল্পীও এক।

তিন
‘কারার ঐ লৌহ কপাট’গানটি স্থানকালভেদে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামী চেতনার বাতিঘর হয়ে ওঠে। পূর্ববঙ্গে ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘জীবন থেকে নেয়া’সিনেমা। এই সিনেমায় আলতাফ মাহমুদের সুরে খান আতাউর রহমানের সংগীতায়োজনে যখন সেলুলয়েডের ফিতায় দর্শক দেখেছেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’গানটি, তখন ঝংকার তুলেছে মানুষের মনে দ্রোহের আগুন জ্বেলে। এখানেও গানটির আদিসুর ও মেজাজ নষ্ট করা হয়নি।

সংগীত বাণী প্রধান নাকি সুর প্রধান এ নিয়ে তর্ক থাকলেও সবাই একমত বাণী ও সুরের যোজনা সংগীতকে মোহনীয় ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। সম্প্রতি এ আর রহমান ‘কারার ঐ লৌহ কাপাটের’নব সুর যোজনা করে এই গানের মেজাজ ও আবেদন ছুঁতে পারেননি তাতেই বিপত্তি হয়েছে। সবচেয়ে বড়কথা সৃজনকর্মের স্রষ্টা হিসেবে যেহেতু নজরুলের মৃত্যুর এখনও ৬০ বছর পেরোয়নি তাই নজরুল-পরিবার সমস্ত মেধাস্বত্বের আর্থিক ও নৈতিক অধিকার দাবিদার। একটি বিষয় জেনে রাখা ভালো সৃজনকর্মের আর্থিক স্বত্ব বাংলাদেশের আইনে স্রষ্টার প্রয়াণের পর ৬০ বছর বলবৎ হলে পাবলিক ডোমেইন হয় ঠিকই, কিন্তু পিতৃত্বের স্বত্ব অনাদিকাল বিরাজমান। এজন্যই কোনো সংগীতের বাণী, আদি রীতি ও সুর খেয়াল-খুশি মতো রিমেকের নাম করে বারোটা বাজানো যাবে না। শোনা যাচ্ছে, নজরুলের একজন উত্তরসূরি কল্যাণী কাজী জীবিত অবস্থায় ‘পিপ্পা’সিনেমার প্রযোজককে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’গানের জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। এই বিষয়টি কতটুকু সত্য এবং ন্যায়নিষ্ঠ তা তর্কের বিষয়।

চার
নজরুলের মতো যুগস্রষ্টার কর্মে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছুরি-কাঁচি চালানো সংগত নয়। এক্ষেত্রে সদ্য গেজেট হওয়া বাংলাদেশের নতুন ২০২৩-এর কপিরাইট আইনের বিধান হচ্ছে, স্রষ্টার অনুমতি ব্যতিরেকে বিন্যাস বা প্রতিলিপিকরণ, বা পরিবর্তনক্রমে ব্যবহারে বারণ আছে। এমনকি উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, সম্পাদনা ও প্রকাশ করা যাবে না। এক্ষেত্রে শুধু স্রষ্টা বা তাঁর বৈধ উত্তরসূরিকে আয় অর্জনের অংশ শেয়ার করার চাইতে জরুরি তাদের বৈধ অনুমতি এবং বিকৃতি সাধন না করা।

বাংলাদেশে নজরুলেকে নিয়ে কাজ করার সরকারি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান কবি নজরুল ইনস্টিটিউট। এই প্রতিষ্ঠানে নজরুলের গানের আদিসুর ও প্রমিত স্বরলিপি রয়েছে। তাই গানটির নতুন সুরারোপের মহান দায়িত্বের জোয়াল কারো কাঁধে না নেওয়াই মঙ্গলের। যা সামাজিক দৃষ্টিতে নজরুলের চেতনা-বোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’কেবল একটি গান নয়, এটা নজরুলের স্বাধীনতাকামীতার স্মারক।

নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী এ আর রহমানকৃত ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’গানটির সুরারোপকে গর্হিত কাজ বলে বর্ণনা করেছেন। এবং অতিসত্বর তিনি ভারত গিয়ে এ বিষয়ে সামাজিক ও আইনগত বিষয়টি এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

পাঁচ
এ আর রহমান সুরটি ভালো করেছেন নাকি মন্দ করেছেন সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তিনি গানটির মোটিভ র্স্পশ করতে পারেনি। গানটির গতি নষ্ট করে দিয়েছেন। গানটিতে সুরেলা রোমান্টিক ঢং এনে গন্তব্য পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এসবের চাইতে বড় বিষয় তিনি নজরুলের রীতিশুদ্ধ সুরের ভিন্ন ব্যঞ্জনের জন্য আইনানুগ ও নৈতিক উভয় বিষয়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। তিনি স্রষ্টার বা উত্তরসূরির পূর্ব অনুমতি যথার্থভাবে গ্রহণ করেননি এবং তিনি শুধু রিমেক/রিমিক্স করেই থেমে থাকেননি চলচ্চিত্রে গানটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অথচ কপিরাইট আইনের সুষ্পষ্ট বিধান স্রষ্টার অনুমতি ব্যতীত চলচ্চিত্রে কোনো গান অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। (ধারা ২, ৭(ঈ) অধ্যায় ১, কপিরাইট আইন ২০২৩) ‘পিপ্পা’ সিনেমার জন্য অনুমতি গ্রহণের ব্যাপারটি নিয়ে নজরুলের উত্তরসূরিদের মধ্যে বিভেদ রয়েছে।

আইনের বিধিতে আবেগের চাইতে বিবেক ঘটনাপ্রবাহ, পরম্পরা, পারিপার্শ্বিকতা সাক্ষ্যপ্রমাণ, মানবিকতা, অধিকার হরণ ইত্যাদি বিষয়ের গুরুত্ব বেশি। আইন বিবেচনা করে নির্মোহভাবে। এজন্যই আইনের চোখ বাঁধা। আইন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি ভাবাবেগের দোলায় এদিক-সেদিক বেঁকে যায় না। আইন স্বচালিত নিজস্ব দর্শনে, নিজস্ব রাস্তায়। সেই বিবেচনায় বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই অনেকরকম বলছেন এবং নিজের বলাকে সর্বমান্য করতে যুক্তি দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, এটি নেটিজনদের ভাষায় ‘হট’ইস্যু। এমনিতেই নজরুলের প্রতি সভা-সমিতিতে আবেগের বন্যা বইলেও কার্যত আন্তরিকতা যোজন-যোজন দূর-ঘটনা এবারও সেই সাক্ষ্যই দেয়।

ছয়
নজরুলের প্রতি প্রেমও যেন পরকীয়ায় মতো গোপন অভিসার। তবে এ আর রহমানের বিষয়েকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে তোলপাড় সত্যিই নজরুলচর্চার জন্য প্রেরণাদায়ক।

ভারতের প্রখ্যাত বাঙালি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী বলেছন, “কেবল ধিক্কার জানালে হবে না, এটা নিয়ে তো মামলা হওয়া উচিত। তবে মামলা হয়ে কী শাস্তি হবে তা আইন আদালতের বিষয়। কিন্তু ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’গানটি আদিসুরে শুনে যে কাঁটা দিত এ আর রহমান সেই চেতনার জায়গাটা নষ্ট করার প্রয়াস নিয়েছেন, যা কাঙ্ক্ষিত নয়।”

অনেক ঘটনায় তাৎক্ষণিক পূর্বাপর না ভেবে ঘটানো হয়। রাধাকৃষ্ণ মেনন পরিচালিত ‘পিপ্পা’সিনেমার জন্য এ আর রহমানের সুরে ও কণ্ঠে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’গানের সহশিল্পী ছিলেন তীর্থ চক্রবর্তী, রাহুল দত্ত, পীযূষ দাশ, শালিনী মুখোপাধ্যায়। এরাও কিন্তু ভালো-মন্দ বিবেচনার বাইরে নয়। কারণ কপিরাইট আইনে সবই রিলেটেড রাইটস্-এর আওতাভুক্ত।

বাংলাদেশের কপিরাইট আইনের সাথে ভারতীয় কপিরাইট আইনের সাযুজ্য রয়েছে। ভারতীয় আইন বাংলাদেশের আইনের চাইতে কালবিচারে আরো সুসংহত।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘ধর্ষণে’ অসুস্থ স্কুলছাত্রীকে স্বামী পরিচয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে যুবকের পলায়ন
‘ধর্ষণে’ অসুস্থ স্কুলছাত্রীকে স্বামী পরিচয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে যুবকের পলায়ন
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে