X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দ্যুতিময় তাসমিমা হোসেন

মৌলি আজাদ
১১ জানুয়ারি ২০২৪, ২২:৪৪আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ২২:৪৪

তাসমিমা হোসেন, জন্ম ১২ জানুয়ারি, দৈনিক ইত্তেফাক ও অনন্যা (ম্যাগাজিন)-এর সম্পাদক। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহের মধ্যে তিনিই প্রথম নারী সম্পাদক। ১৯৫১ সালে তিনি পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পিরোজপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।


আমার বাবার কাছে তাসমিমা হোসেনের কথা শুনতাম। কথা একটাই। তাসমিমা হোসেনের দাঁতগুলো খুব সুন্দর। কোনো এক পার্টিতে তার সাথে নাকি বাবার দেখা হয়েছিল। বাবা অন্যকিছু আর বলেননি। শুধু সেই দাঁতের প্রশংসা। এত বছর শুধু তার কথা শুনেছি। পত্রিকায় তার লেখা পড়েছি। পত্রিকার পাতায় ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। হয়ত প্রকৃতির ইচ্ছে ছিল আমাদের দুজনের দেখা হওয়ার। কাকতালীয়ভাবে ঢাকার লিট ফেস্টে তার সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি আমার সামনের সাড়িতে বসেছিলেন। সুতির অনাড়ম্বর শাড়ির ওপর গায়ে হালকা চাদর জড়ানো ছিল। প্রথম সাড়িতে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলেন। আমি ঠিক তার পেছনের চেয়ারে ছিলাম। বারবার তার দিকে তাকিয়ে ছবিতে দেখা তাসমিমা হোসেনকে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু কথা বলতে ইতস্তত করছিলাম। এমন অসাধারণ নারী, চাইলেই কি আমার মতো সাধারণ একজনের সাথে কথা বলতে পারেন? হঠাৎ হল কী! বক্তৃতা খুব বেশি দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। ওদিকে ওপাশে গানের অনুষ্ঠান শুরু হবে। উনি বোধহয় ওঠার জন্য উশখুশ করছিলেন, কিন্তু ভরা অনুষ্ঠানের মাঝে ওঠা তো একটু বিড়ম্বনাই। হঠাৎ পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালেন। মুখোমুখি হলাম। আমি নিজে থেকেই পরিচয় দিলাম। উনি সুন্দর করে হাসলেন। সেই ফাঁকে ওনার মুক্তোর মতো ছোটো ছোটো  ঝকঝকে দাঁতগুলো দেখে ফেললাম। বললাম, ‘ঐপাশে গান শুনতে যাবেন না?’ উনি বললেন, ‘তুমি যাবে?’ আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। এরপর দুজন একপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। গান শুনছিলাম আমরা। গানের তালে তালে তিনি মাথা নাড়াচ্ছিলেন। বুঝলাম উনি গানের বড্ড সমঝদার। এরপর মেলা থেকে চা আর জিলাপি কিনে খেলাম। আবার কখন ওনার দেখা পাই? তাই বাবার প্রসঙ্গ টেনে এনে ওনার দাঁতের কথা বললাম। দেখলাম সেকথা ওনার এখনও মনে আছে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার বাবা এক অনুষ্ঠানে সবার সামনেই এ কথা  বলেছিলেন।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, বাবা যা বলতেন তা তিনি সামনাসামনিই বলতেন।’

ওনাকে প্রথম দেখায় এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে, জিজ্ঞেস করলাম, এখনো কীভাবে এতো সুন্দর আছেন? উনি হাসতে হাসতে বললেন, চল্লিশের আগে নিজের খুব বেশি যত্ন নেইনি, চল্লিশের পর থেকে নিয়মিত ব্যায়াম, ইয়োগা, খাদ্যাভাস পরিবর্তন ও প্রকৃতির সাথে মিশে নিজেকে ভালো রেখেছি।’ এবয়সেও তিনি যেন কিশোরীর মতো উড়ে বেড়াচ্ছেন।

এত ভালো লাগছিল কথা বলতে, কিন্তু সময় শেষ! ফোন নম্বর আদান-প্রদান করেই সেদিনকার মতো বিদায় নিলাম। বাসায় ফিরেও তার সাথে স্বল্প পরিচয়ের স্মৃতিগুলো মাথায় বারবার ঘুরছিল। হঠাৎই একদিন তার খুদে বার্তা পেলাম। ‘তুমি কি একদিন আমার সাথে লাঞ্চ করতে পার?’ সময় করে খুদে বার্তায় সাড়া দিয়ে একদিন তার ধানমন্ডির জমকালো ধবধবে সাদা বাড়িতে হাজির হলাম। এটি তার শ্বশুর বাড়ি। দৈনিক ইত্তেফাকের স্বনামধন্য সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বাড়ি। বাড়ি চিনতে তাই বেগ পেতে হয়নি। বিশাল বাগান পেরিয়ে লম্বা বারান্দা। সেখানে বসে চা খেতে খেতে অনেক কথা হলো। আলাপের প্রসঙ্গ বর্তমান নারী, তাদের সময়ের নারী, তার কাজ, বর্তমান অস্থির সময় ইত্যাদি। এতো ধীরে ধীরে গুছিয়ে কথা বলেন, কথা শুনতেই ইচ্ছে হয় যেন! তাকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম দৈনিক ইত্তেফাকের মতো একটা বিশাল পত্রিকার হাল ধরে পত্রিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তা কী খুব সহজ ছিল তার জন্য? বিখ্যাত পরিবারের ছেলের বউ বা মন্ত্রীর বউ বলেই কি তিনি এই পদ পেয়েছিলেন? কথা হল, স্বামীর সূত্র ধরে বড় পদ পেয়ে তা কি চালিয়ে নেয়া যায়? এরকম তো দেশে আরো অনেকে নারীই আছেন। তাহলে তাসমিমা হোসেন কেন অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম?

চলুন তার কাজগুলোতে চোখ বোলাই:

২০১৪ সাল থেকে দৈনিক ইত্তেফাকের হাল ধরেন তিনি। তাসমিমা হোসেন ১৯৮৮ সাল থেকে জনপ্রিয় পাক্ষিক ম্যাগাজিন ‘অনন্যা’র প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২৮ বছর ধরে নারীদের জন্য পত্রিকা পাক্ষিক ‘অনন্যা’ চালানো সামান্য কথা নয়। এছাড়া তিনি ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামের বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বর্তমানে চেয়ারপার্সন।

নিজেকে কখনো সাংবাদিক মনে করেন না। নিজেকে উল্লেখ করেন একজন ‘ম্যানেজমেন্ট পারসন’ হিসেবে। তিনি বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রথম যখন তিনি পত্রিকা করতে চান তার স্বামী বলেছিলেন ‘পয়সা নষ্ট করো না’। আহা! নারীরা কোনো বড় কিছু করতে গেলেই পুরুষেরা মনে করে তাতে পয়সা নষ্ট হয়। তাসমিমা হোসেন এমনি একজন, যিনি পয়সা তো নষ্ট করেননি উলটো তার কাজ দিয়ে পত্রিকার পরিবর্ধন করেছেন।

তাসমিমা হোসেন তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা দেখেছি সবসময় নারীরাই নারীদের কথা বলে। খুব কম পুরুষ পাওয়া যায়, যারা নারীর অধিকার নিয়ে একটু উৎসুক হয়। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে নারীর যে কষ্ট, নারীর যে অধিকার সেই জিনিসগুলো সম্পর্কে পুরুষেরা অতটা বুঝতে পারে না বা জানে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাইরে বের হলেই নারীদের উপর আঘাত আসছে, ধর্মের নামে নারীদের পুনরায় ঘরে ফিরে  যেতে বলা হচ্ছে। এই সমস্ত জিনিস নিয়ে আমাদের নারী-পুরুষকে চিন্তা করতে হবে। সেই চিন্তাধারা থেকে নারীদের নিয়ে যারা কাজ করে আমি তাদের সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক এবং করতে চেষ্টা করি।’

তিনি আরেক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নারীরা মানবসম্পদ। গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী। তারা আয় করছে, অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। নারী সংসার সামলে আয়ও করছে। সেই আয়টাকে জিডিপিতে ধরতে হবে। কারণ এই আয় দেশের দারিদ্র্য দূর করতে সাহায্য করছে। এ জন্য নারীদের উৎসাহ দিতে হবে।’

‘অনন্যা’ পত্রিকাটি যেন বাংলাদেশের ‘সানন্দা’। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই পত্রিকাটি নারীর সমস্যা উত্তরণে নানা পদক্ষেপ, নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মজীবন ও জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে লিখে আসছে। এখন পর্যন্ত  অসংখ্য নারীকে ‘অনন্যা শীর্ষ ১০’ সম্মাননা দেয়া হয়েছে (বর্তমানে ১৫ জনকে দেয়া হয়)। আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে নারীরা নারীর শত্রু। উচ্চ পর্যায়ের অনেক নারীই মেধাবী-নারীকে প্রমোট না-করে নিজের সুবিধার্থে ক্ষমতাবান পুরুষের সাথে লিয়াজোঁ করার চেষ্টা করে। এতে হয়ত দুই পক্ষেরই লাভ হয়। তাসমিমা হোসেন এখানে ব্যতিক্রম। তিনি যোগ্য নারীকে সম্মাননা দিয়ে তার আত্মবিশ্বাসী^াস বৃদ্ধি করেন। তিনি নারীকে বুঝিয়েছেন, সে ইচ্ছে করলেই অনেক কিছু করতে  পারে।

‘অনন্যা শীর্ষ ১০’ মানে হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী কাজ করছে, সেটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মানুষ জানতে পারছে। এ কাজটি যখন তিনি শুরু করেন, নিশ্চয় তা করা সহজ ছিল না। তিনি কঠিনকে ভালোবাসলেন।

তিনি সম্মাননাপ্রাপ্ত নারীর ড্রাইভিং ফোর্স। তিনি যদি এভাবে নারীদের তুলে না ধরতেন তাহলে হয়ত অনেক গুণী নারীর কথাই আমরা জানতাম না।

তাসমিমা হোসেন এটাও প্রমাণ করেছেন যে, রক্তের সূত্র ধরেই সাংবাদিকতা করা যায় না। সাংবাদিকতার জন্য প্রতিভা থাকতে হয়। আমি নিশ্চিত আজ তার শ্বশুর তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া যদি বেঁচে থাকতেন তবে পুত্রবধূ তাসমিমা হোসেনকে নিয়ে যারপরনাই গর্ব করতেন।

তাসমিমা হোসেন ধনী পরিবারের বউ। এক সময় সংসদ সদস্য ছিলেন। চার কন্যার মা। ধনী পরিবারের সদস্য  বলেই আরামে গা ভাসাননি তিনি। বরং কাজ শিখেছেন, পরিশ্রম করেছেন এবং নিজের আইডেনটিটি দাঁড় করিয়েছেন।

তাসমিমা হোসেনের নাম বললে তাই অন্যকোনো পরিচয়ের দরকার হয় না। আমাদের দেশের নারীদের জন্য তিনি এক রোল মডেল। তাকে অনুসরণ করে আরো অনেক মেধাবী ও সচ্ছল নারী এমন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারেন। যদিও তার লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। এর কারণ হতে পারে তাদের উদ্যোমের অভাব বা যোগ্য নারীদের তুলে ধরতে দ্বিধা।

তিনি নিজের একান্ত সময় নষ্ট না করে তিনি চোখ রাখেন বইয়ের পাতায়, সিনেমার পর্দায় আর ভ্রমণে। জীবনমুখী শিক্ষা নিয়ে তিনি চলছেন। তার বাবার কাছে জীবনের নানা দিক তিনি শিখেছেন। পরিবার তার কাছে শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রধান। তিন কোনো অবস্থাতেই হাল ছাড়েন না। তাই নানা ঝড়-ঝঞ্ঝা জীবনের ওপর দিয়ে গেলেও তিনি তার গড়া পত্রিকা ‘অনন্যা’কে নিয়ে যেতে পেরেছেন অনন্য উচ্চতায়। 

অর্থ ও পারিবারিক পরিচয় কোনো নারীর এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় নয়। নারী এগিয়ে যেতে পারে শুধু তার নিজের ইচ্ছাশক্তির বলেই। তাসমিমা হোসেন যা সফল করতে পেরেছেন। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। তাকে বহুদূর যেতে হবে, তিনি মা দুর্গার মতো বাংলাদেশের নারীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, যা শিগগিরই শেষ হওয়ার নয়। তিনি অনন্য, দ্যুতিময়।

জেড-এস
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু