X
শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫
১৯ বৈশাখ ১৪৩২

হেজিমনি

অমি আক্তার
১০ মার্চ ২০২৫, ১৮:২৭আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৫, ১৮:৪৮

হেজিমনি শব্দটি গ্রিক শব্দ 'হেজিমোনিয়া' থেকে উদ্ভূত—এর অর্থ নেতৃত্ব বা আধিপত্য। প্রাচীন গ্রিসের শহর ও রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নেতৃত্ব বা আধিপত্য বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার হতো। পরবর্তীতে মার্কসবাদে হেজিমনি বিষয়টি আসে কিন্তু তা এতটা স্পষ্ট ছিল না। মার্কসের 'এইটিন্থ বুর্জোয়া অব লুই বোনাপার্ট' এবং 'দ্যা ক্লাস স্ট্রাগল ইন ফ্রান্স' গ্রন্থ দুটিতে হেজিমনি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। ১৮৮০ সালে রাশিয়ান মার্কসবাদীরা বিশেষ করে প্লেখানভ ১৮৮৩-৮৪ সালের দিকে হেজিমনির ধারণা সর্বপ্রথম প্রদান করেন। ১৯০২ সালে রুশ বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন তার 'হোয়াট ইজ টু ডান' গ্রন্থে হেজিমনিকে তাত্ত্বিক নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। তবে হেজিমনি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করেন ইতালীয় মার্কসবাদী দার্শনিক আন্তনিও গ্রামসি। কারারুদ্ধ অবস্থায় লেখা 'সিলেকশন ফ্রম দ্যা পিসনস্ নোট বুকস্'-এর কেন্দ্রীয় ও মৌলিক বিষয় ছিল হেজিমনির ধারণা।

কাল মার্কসের ধারণা অনুয়ায়ী ইউরোপের অ্যাডভ্যান্সড পুঁজিবাদী অর্থনীতিগুলো বিশেষ করে ব্রিটেন সোশ্যালিজম এবং কমিউনিজমের জন্য সবচেয়ে উর্বর ভূমি। তার মতে, খুব শীঘ্রই সর্বহারা শ্রেণি তার দাসত্বের বাস্তবতা অনুধাবন করে বিদ্রোহে জেগে উঠবে। কিন্তু গত শতাব্দীর শুরুর দিকে নব্য মার্কসবাদীরা দেখেন মার্কসের ভবিষ্যৎবাণী মিলছে না। ইউরোপের পুঁজিবাদী সমাজগুলোতে সর্বহারাদের টনক নড়ছে না। এই বিষয় নিয়ে বিস্তর ভাবনা শুরু করেছিলেন নব্য মার্কসবাদীরা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আন্তেনিও গ্রামসি। তিনি হেজিমনির ধারণা সামনে আনেন বিস্তরভাবে। তার মতে, জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ কেবল সংসদ বা ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে আসে না, সত্যিকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রায় অবধারিতভাবে চালিত হয় সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ দ্বারা। গ্রামসির মতে, সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করলে, রাজনীতি আপনা-আপনিই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় গৃহপালিত পশুর মতো। সাংস্কৃতিক আধিপত্য যাদের থাকে, তারা জনগণের সামনে তাদের (জনগণের) বন্দিত্বকে তাদের মুক্তি হিসাবে প্রদর্শন করতে পারে। তারা জনগণকে গোলাম বানাবার সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহকে হাজির করে প্রগতিশীল বানাবার মন্ত্র হিসাবে। যেমন পশ্চিমারা বলত তারা আমাদের চেয়ে সভ্য ও উন্নত। তোমরা আমাদের মতো হও। গ্রামসির মতে, বুর্জোয়াগণ ফরাসি বিপ্লবের পর হেজিমনিকে সফলভাবে ব্যবহার করেন।

যে ক্ষমতার মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর মন জয় করে তাদের চিন্তায় ও চর্চায় আধিপত্য বিস্তার করতে পারে তাকে আদর্শগত দিক থেকে হেজিমনি বলেছেন গ্রামসি। হেজিমনি কখনো চিরস্থায়ী নয়, বরং সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। গ্রামসি বিশেষভাবে নজর দিয়েছেন শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে সৃষ্ট এক সার্বিক কর্তৃত্ব বা হেজিমনির উপর। সংস্কৃতি এবং একে ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট ভাবাদর্শের মাধ্যমে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে ও বজায় রাখে হেজিমনিক নেতা। এখানে বলতে পারি হেজিমনি হচ্ছে নেতৃত্ব ও আধিপত্যের একটি ধারণা, যা তৈরি করে সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী ও প্রভাবশালী শ্রেণী। সাধারণ সত্য, সাধারণ জ্ঞান ও সাধারণ আচার হিসাবে নিজেদের পছন্দকে সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়, যাকে সাধারণ জনগন নিজ থেকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। অর্থাৎ হেজিমনি নির্দেশ করে এমন এক সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী অবস্থাকে, যেখানে দমন-নিপীড়ন থাকা সত্ত্বেও আধিপত্যবাদীরা রাষ্ট্র বা জনগণের সম্মতি আদায় করতে পারে, যা মূলত প্রতারণামূলক সমঝোতার মাধ্যমে ঘটায়।

এই প্রতারণামূলক সমঝোতার মাধ্যমে আধিপত্য শ্রেণি তাদের সৃষ্ট মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির উপাদান শোষিতদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এখানে হেজিমনির সাথে আইডিওলজির বিষয়টা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হেজিমনাইজড করার জন্য কর্তৃপক্ষকে সর্বপ্রথম কৃত্রিমভাবে তাদের স্বার্থের অনুকূল সংস্কৃতি দিয়ে আইডিওলজির সৃষ্টি করতে হয়। তারপর আইডিওলজিকে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে আধিপত্যবাদীরা মানুষকে হেজিমনাইজড করে। লুই আলথুসার আইডিওলজি ধারণাটি বিশদ আলোচনা করেন। তিনি তার 'Ideology and ideological State Apparatuses" প্রবন্ধে আধিপত্যবাদীদের ক্ষমতা বজায় রাখার কারণ হিসাবে দুটি রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা বলেছেন—

১. দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (RSA)
২. ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (ISA)

আলথুসারের বর্ণিত দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (RSA) হলো গ্রামসির বর্ণিত রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (ISA) হলো গ্রামসির বর্ণিত সুশীল সমাজ। গ্রামসির মতে, রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। উভয়ের উপস্থিতি ছাড়া ক্ষমতা বজায় রাখা যায় না।

মার্কসবাদে যেখানে বলা হয়েছিল সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে রূপান্তর ঘটবে, সেখানে গ্রামসি চিন্তা করেছিলেন কাউন্টার হেজিমনির কথা। অর্থাৎ তিনি কেন্দ্রীয় অভ্যুত্থানের পরিবর্তে একটা দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের কথা বলেছিলেন; যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষস্তরে নয়, বরং সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেতরে শ্রমিকশ্রেণি তাদের বিকল্প সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। ক্ষমতার কার্যকর প্রয়োগ রাষ্ট্রের পুলিশ, সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল নয়, বরং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক স্থিতিশীলতা তৈরি করে নিজের স্বার্থকে তাদের অজান্তে আদায় করার মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগ হয়—যা মূলত পরিবার, স্কুল-কলেজ, ডাক্তার, হাসপাতাল, পৌরসভা, সংবাদপত্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে করে থাকে আধিপত্যবাদীরা। এখানে মিশেল ফুকোর ক্ষমতার ভাবনা প্রাসঙ্গিক।

ফুকো ক্ষমতার তিনটি পৃথক মাত্রা দিয়েছেন—
১. সার্বভৌমত্ব
২. অনুশাসন ও
৩. প্রশাসনিকতা।

সার্বভৌমত্বে আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠিন শারীরিক শাস্তি দেওয়া হতো। কিন্তু শারীরিক শাস্তির পরিবর্তে আরো একটি প্রক্রিয়া রয়েছে অর্থাৎ 'অনুশাসন'। ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসাবে শাস্তির বদলে জেলখানা, পাগলাগারদ, হাসপাতাল কিংবা স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে ব্যক্তিকে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ফুকোর ক্ষমতা তত্ত্ব মতে, ক্ষমতা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়না, বরং এমনভাবে চর্চা করা হয় যাতে ব্যক্তির কাছ থেকে নির্দিষ্ট আচরণ করার সম্মতি আদায় করা হয়, যা মূলত গ্রামসির হেজিমনির বিকল্প রূপ। অর্থাৎ হেজিমনি ক্ষমতার ক্ষেত্রে একই অর্থ প্রকাশ করে, তা বলা যেতে পারে।

পেরি এহারসুন 'প্রিসনস্ নোট বুকস' বিশ্লেষণ করে হেজিমনি সম্পর্কিত ৩টি মডেল শনাক্ত করে। প্রথম মডেলটি সাংস্কৃতিক দিক যা সুশীল সমাজে অনুশীলিত হয়। দ্বিতীয় মডেল হলো হেজিমনি সুশীল সমাজের মতো রাষ্ট্রেও অনুশীলিত হয়। শিক্ষা, আইন, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদির মাধমে রাষ্ট্র তার ক্ষমতা এবং আধিপত্য বজায় রাখে। ৩য় মডেলে দেখিয়েছেন, রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য নেই। আধুনিক রাষ্ট্র এবং নাগরিক সমাজের মধ্যকার পার্থক্য ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র নাগরিক সমাজের সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক ক্ষেত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সেগুলোকে তার শাসন কাঠামোর অংশ করে তুলেছে। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন শিক্ষা, গণমাধ্যম, ধর্ম) রাষ্ট্রের আদর্শিক যন্ত্র হিসাবে কাজ করছে।

গ্রামসি দেখিয়েছেন আধিপত্যকারীদের হাতে থাকে আধিপত্য বিস্তারের যন্ত্র বা  Apparatus of hegemony। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জনমতকে প্রভাবিত করতে সক্ষম সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন: গণমাধ্যম, সাহিত্য, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ইতিহাসের বিকৃতি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও সাংস্কৃতিক প্রযোজনার ক্ষেত্র, ভাষা ও যোগাযোগ  এবং প্রযুক্তি ও তথ্য নেটওয়ার্ক।

সাহিত্য ও হেজিমনি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সাহিত্যের মাধ্যমে আধিপত্যবাদীরা তাদের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করে এবং বজায় রাখে। যেমন,  রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর 'দ্য হোয়াইট ম্যানস বারডেন' ঔপনিবেশিক শাসনকে সভ্যতার প্রয়োজনীয় হিসেবে তুলে ধরে। সাহিত্য কখনও কখনও ইতিহাসকে আধিপত্যবাদীদের স্বার্থের অনুকূলে প্রতিষ্ঠা করে। অনেক টেক্সট আধিপত্যবাদীদের আদর্শকে বৈধতা দিতে সাহায্য করে, তাদের মূল্যবোধ ও চাহিদাকে সাধারণ হিসাবে উপস্থাপন করে। আবার অনেক টেক্সট বা লেখক তাদের রচনায় শাসক শ্রেণির আদর্শের সমালোচনা করেন এবং বিকল্প চিন্তাভাবনা প্রচার করেছেন। সাহিত্যে পক্ষে-বিপক্ষে উভয়ভাবেই হেজিমনি প্রতিষ্ঠিত হয়। 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার হাতের রগ ও কান কেটে দিলো দুর্বৃত্তরা
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার হাতের রগ ও কান কেটে দিলো দুর্বৃত্তরা
পাকিস্তান সিরিজের আগে আমিরাতে বাংলাদেশের দুই টি-টোয়েন্টি
পাকিস্তান সিরিজের আগে আমিরাতে বাংলাদেশের দুই টি-টোয়েন্টি
শৃঙ্খলা ফেরাতে রাস্তায় নামলেন ওসি
শৃঙ্খলা ফেরাতে রাস্তায় নামলেন ওসি
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
সর্বাধিক পঠিত
অস্ত্র নিয়ে সাবেক এমপির ওপর হামলা, অল্পের জন্য রক্ষা
অস্ত্র নিয়ে সাবেক এমপির ওপর হামলা, অল্পের জন্য রক্ষা
টেকনাফে সরকারি বরাদ্দের মালামাল মিয়ানমারে পাচার
টেকনাফে সরকারি বরাদ্দের মালামাল মিয়ানমারে পাচার
সাপের কারণে জাপানে বুলেট ট্রেন চলাচল বন্ধ
সাপের কারণে জাপানে বুলেট ট্রেন চলাচল বন্ধ
চিন্ময়ের জামিন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, ইন্টেরিম সাবধান: হাসনাত আব্দুল্লাহ
চিন্ময়ের জামিন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, ইন্টেরিম সাবধান: হাসনাত আব্দুল্লাহ
কূটনীতিক সুফিউর রহমানের নিয়োগ নিয়ে হচ্ছে কী
কূটনীতিক সুফিউর রহমানের নিয়োগ নিয়ে হচ্ছে কী