আজ সকালে হঠাৎ ছুটি পেয়ে চলে এলাম পাখির ডাক শুনতে; পাখিদের জগৎ বড় বিস্ময়কর, চারিদিকে গাছপালা আর আকাশ। মাঝখান দিয়ে চিরে যাওয়া রাস্তা। নানান পাখির কথোপকথন মুখরিত করে রেখেছে আমাদের গ্রাম মফস্বলের বাগানগুলিকে। এখন 'বউ কথা কও' ডাকছে, টুইংক্লিং ডাকছে, হরবোলা ডাকছে; এই প্রথম আমি 'বউ কথা কও' পাখি দেখলাম, একটা শিমুল গাছের ছায়ার মগডালে সে ডেকে চলেছে বিচ্ছিন্ন মনে। তার ডাক শুনেই মূলত গাড়ি থামিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়ালাম। ওই শিমুল গাছ থেকেই একটা অজানা প্রাণের লার্ভা তার ঝুলন্ত জাল বিছিয়ে নামছে, হয়ত রাস্তায় পড়বে আর চটকে যাবে কোনো গাড়ির চাকায়, অথবা কোনো চালকের গায়ে করে সে চলে যাবে বহুদূর। খানিক বাদেই একটা ছোট্ট লুতিকা আমার ফোনে এসে পড়ল, হেঁটে চলে গেল আবার শূন্যে। সকলেই ছুটছে, দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে পাখির ডাক শোনবার ফুরসত নেই কারো; এমনটাই নাকি জীবন, এমনটাই যাপন হয়ে থাকে। কিন্তু তবুও পাশাপাশি এতো গাছ, এতো পালা, যন্ত্রমানবের দল তাদের যাপনে ক্রমান্বয় অনধিকার চর্চা করে চলেছে। জারুল গাছ বেগুনি ফুলে ভরে আছে। কিছু আমগাছ কচি পাতায়, কিছু ফলে ভরে আছে। পাশাপাশি দুটো অজানা বৃক্ষ, তাদের গায়ে ছাল পর্যন্ত নেই, ন্যাড়া-পোড়ার মতো অপেক্ষমাণ। যে গাছটায় 'বউ কথা কও' ডাকছিল, সেও পাতা আর শুকনো ফলে ভরা। এতো বৈচিত্র্য গাছেদের; তবুও আমার পক্ষে আর এখানে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এখানে সাক্ষর নীরবতা নেই, একের পর এক গাড়ি, একের পর এক পৃথিবীর বুকে মানসিকতা নাড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে হৃদ্যন্ত্র। এতো তাড়া মানুষের, অথচ ওই 'বউ কথা কও' পাখিটা এখনও ডাকছে। ওই তো একটা বসন্তবৌরি পুরোনো আমগাছের ডালে বসে আছে, তার নাম নিতেই উড়ে গেল সে, একেবারে চোখের আড়াল। আমারও ওড়ার সময় ঘনিয়ে এলো। উড়ে যেতে হবে, মানুষের সাম্রাজ্যে দু-দণ্ড নিশ্চুপ নীরবতা খুবই দুর্লভ এখন। একের পর এক লেদমেশিন, ট্রাক্টর, অটো আর অসংখ্য দুই চাকা আমার নীরব যাপনের ব্যবচ্ছেদ করে দিচ্ছে। অথচ আমি তাদের দোষ দিতে পারব না, রুখে দিতে পারব না। তাই আমাকেই স্থান সংকুলান করতে হবে অন্যত্র, পাখিদের ডাক শোনার জন্য, ডাকতে ডাকতে হারিয়ে যাওয়া হরবোলা পাখিটির জন্য। এখানে অনেকদিন পর হলুদ গাছের সমারোহ দেখলাম, আগে আমাদের বাড়িতেও এমন হলুদ গাছের বাগান ছিল, তারা ছড়িয়ে থাকত আমাদের আমতলা জুড়ে। এখন এই আমবাগানের নীচেও দেখছি ছোট-বড় ঘাসের মাঝে অসংখ্য হলুদগাছ আর কচুগাছ বিস্তার করে আছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে আরেকটু এগিয়ে গেলেই কুলাইচণ্ডীতলা, এখানে এলাকার প্রায় সমস্ত পুজো হয়ে যাওয়া ঠাকুরের মূর্তি দাঁড়িয়ে থাকে, বিসর্জনঘাটের বদলে মানুষ এখানে এসে রেখে যান মূর্তিগুলোকে। রোদ বৃষ্টি হাওয়ায় তাদের শরীর থেকে মাটি খসে পড়ে, খড়ের বাঁধন খেয়ে যায় গবাদি খিদের চোখ। দেহ চলে শূন্য পানে চেয়ে। চলতে চলতে এসে পৌঁছায় হরিপুরের মনসাতলা বাজারে, তার পাশেই রয়েছে কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের পৈতৃক ভিটের স্মৃতিফলক, যার সামনে সম্প্রতি কবির একটি নামধামহীন আবক্ষমূর্তি তৈরি করা হয়েছে স্থানীয় যুবকদের তৎপরতায়, টিন দিয়ে ঘেরা একটা ছোট্ট মন্দিরের পাশে। রাস্তার নামও 'কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সরণি'— নতুনহাট ফাঁড়ির সামনে কবির আবক্ষ মূর্তি থেকে এ রাস্তা সোজা চলে গেছে বাগআঁচড়া ছাড়িয়ে। যদিও তার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটির সম্মুখে স্কুলটির নাম কবির নামে নয়। হয়ত কবিরাই এমন অবহেলা পাওয়ার যোগ্য উত্তরসূরি। যাকগে, সেসব কাঁদুনি গেয়ে লাভ নেই। কবিদের এই স্বভাব খুব বাজে, সব সময় নিজেকে বঞ্চিত ভাবছেন; তার চেয়ে কবিতা নিয়ে ভাবলে বেশি কাজে দেয়। তাই সেসব ছাড়িয়ে আমি চলে এলাম—বাঁদিকে আমার কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণের নতুন রাস্তা, আজও নতুন, এখনও সেই পুকুরটি আছে, ওকে পদ্মপুকুরও বলা যায়—বেশিরভাগ সময়েই পদ্মফুল ফুটে থাকে, তাদের বড়ো বড়ো পাতায় জলাশয় ছেয়ে থাকে। যৌবনের প্রথম দিনগুলিতে আমরা খুব ভোরে উঠে সদলবলে এই পথেই দৌড়াতে আসতাম, মাঠঘাট বাগানের মধ্য দিয়ে চওড়া পিচের রাস্তাটি সেসময় ফাঁকাই থাকত, সকালের ঠান্ডা উষ্ণতায় কত শুয়ে থেকেছি এখানে, গল্প করেছি আশেপাশের মাঠে কাজে আসা কৃষকদের সঙ্গে। গ্রীষ্মকালের নিঝুম দুপুরগুলো এখানেই কেটে যেত আমার বন্ধু বুড়োর সাথে। জীববিজ্ঞান বইয়ে পড়া সবুজ অথবা খয়েরি ফাইটোপ্লাংটন এই পুকুরেই দেখতে আসতাম। এখন সেসব ভাবছি, আর দেখছি এখানেও সেই ট্রাক্টর, লেদগাড়ি সহ অন্যান্য যানবাহনের তীব্র ক্যাকোফোনে আমার চিন্তাপ্রবাহ বিচ্ছিন্ন হতে হতে রোদ্দুরে শুকিয়ে যাচ্ছে, মাটি ফেটে যাচ্ছে চিরবিড় করে, কোঁচবক উড়ে যাচ্ছে দূরে। চারিদিকে প্রাচীন সব আমগাছে শ্যাওলা জড়ানো, জড়িয়ে আছে নানান রকম আগাছা। সে-সবকে দূরে সরিয়ে রেখে, এতো যন্ত্রের কথার মধ্যেও ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে। ইশ! গাড়িগুলো না থাকলে কী অভূতপূর্ব শান্তির আক্রমণ ঘটত এখানে, ভাবলেই শান্ত হয়ে যায় আকাশ। বাঁশের খোয়াড় থেকে শেয়াল উঁকি দিয়ে যায় পুকুরের চারিধারে। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সীমানা, মাঝে মাঝে মনসাগাছ, জিবলি গাছ বা যে গাছগুলোকে আমরা কচাগাছ বলি, সেসব কিলবিল করে পাতা দুলিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। অথচ আমার অস্তিত্বের গিঁট অন্য জায়গায় বাঁধা, আমাকে ছুটতে হবে, সকালের ছুটি এখানেই শেষ। আজ আবার একটা নতুন টিউশন আছে, ভালো মাইনে। ধরে রাখতে হবে। বৃষ্টি যেন বাঁধ না সাধে। কতবার তো ভেবেছি, বর্ষাকাল এলেই আমি রবীন্দ্রনাথ। পুনশ্চ গৃহের ছোটো ছোটো কাচের জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখছি, মাঝে মাঝে বাজ পড়ার আওয়াজে শার্সি কেঁপে উঠছে, কিন্তু আমি নিশ্চল, অদ্ভুত রোমাঞ্চে স্থির হয়ে আছি। অথচ সে-সব সত্যি হয় না। সত্যি কেবল গগণে গরজে মেঘ, সত্যি কেবল ঘন বর্ষায়।