X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরে মা, বোন-ভাই ও ভাবির লাশ, চারদিকে রক্ত আর রক্ত : এস এম মহসিন

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মো. আল আমিন ও বাশার খান
২৬ এপ্রিল ২০১৯, ০৬:০০আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০১৯, ০৬:০০

এস এম মহসিন এস এম মহসিন বর্তমানে রোকেয়া হলে সিনিয়র বার্তাবাহক হিসেবে কর্মরত। তার বাবা মনিরুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সময় রোকেয়া হলের দারোয়ান ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহসিন ছিলেন ১২ বছরের কিশোর। বাবার চাকরিসূত্রে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন হলের স্টাফ কোয়ার্টারে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন পুরান ঢাকার নবকুমার হাইস্কুলে। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে পাশের বাসায় অবস্থান করায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান কিশোর মহসিন। কিন্তু সেই রাতে মহসিনের মা জিন্নাতুন নেছা, বোন সুরাইয়া বেগম এবং বড় ভাইয়ের স্ত্রী রাশিদা বেগম শহিদ হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত ৮ বছর বয়সী ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী মারা যান ২৬ মার্চ। সবার ছোট ভাই ১০ মাস বয়সী মহিউদ্দিনের পায়েও গুলি লাগে। ভাগ্যক্রমে শিশু মহিউদ্দিন বেঁচে যান। সেই রাতে মহসিনের বড় বোন সুরাইয়া বেগমের বুকে ছিল ৪০ দিন বয়সী তার শিশুপুত্র মোহাম্মদ মামুন। মা সুরাইয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হলেও সৌভাগ্যক্রমের এই নিষ্পাপ শিশুটির শরীরে গুলি লাগেনি। তাই বেঁচে যান মামুন। ঘরে রক্তের নদী, পড়ে আছে মা, ভাই, বোন ও ভাবির লাশ। এদিকে মায়ের বুকের দুধ খেতে অনবরত কাঁদছে দুই শিশু। ১০ মাস বয়সী গুলিবিদ্ধ ছোট ভাই ও ৪০ দিন বয়সী ভাগিনাকে নিয়ে কীভাবে কেটেছিল কিশোর মহসিনের লোমহর্ষক সেই ভয়াল সময়—মহসিনের সাক্ষাৎকারের পরতে পরতে পাওয়া সেই করুণ ইতিহাস। [প্রথম সাক্ষাৎকার : ১৩ অক্টোবর ২০১৬, সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা। দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার (মুঠোফোনে) : ৬ এপ্রিল ২০১৯, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা।]

 

১৯৭১ সালে আপনার বয়স ছিল কত ?

—১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ১২ বছর। তখন আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি।

 

কোথায় লেখাপড়া করতেন ?

—পুরান ঢাকার বকশিবাজারের নবকুমার হাইস্কুলে পড়তাম।

 

রোকেয়া হলের কাছেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন ?

—আমি সৌভাগ্যবান, ৭ মার্চের ভাষণের সময় আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে উপস্থিত ছিলাম। লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে আমিও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণ শুনি।

 

এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত রোকেয়া হলের অবস্থা কেমন ছিল ?

—বর্তমান যে শামসুন্নাহার হলের অফিস, সেখানেই রোকেয়া হলের স্টাফদের জন্য কোয়ার্টার ছিল। ১৪টি বাসা ছিল সেখানে। আমি আমার পরিবারসহ সেখানেই থাকতাম। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর তো অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো। রোকেয়া হলের ছাত্রীর সংখ্যাও কমতে থাকে তখন। পরিস্থিতি থমথমে হওয়ার ছাত্রীরা বাসায় চলে যেতে শুরু করেন। কম ছাত্রীই হলে থাকতো তখন। তবে ছাত্রীদের অনেককে মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী পালন করতে দেখেছি। জগন্নাথ হলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারিদেরকে ট্রেনিং দেয়া হতো। তখনকার ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ট্রেনিং দেয়া হত। ২৫ মার্চ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে এ অবস্থাই চলছিল। জহুরুল হক হলের মাঠে রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও ট্রেনিং নিতো।

 

২৫ মার্চ দিনের বেলায় আপনি কোথায় ছিলেন ? রাতে আক্রমণ হতে পারেএরকম কোনো আভাস কি পেয়েছিলেন ?

—সেদিন আমি রোকেয়া  হলের কোয়ার্টারে আমাদের বাসায়ই ছিলাম। দিনের বেলাই একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। কিছু একটা হয়তো ঘটবে—এমনটা বুঝতে পারছিলাম। আমাদের বাড়ি তো ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার মাতুয়াইল। অবস্থা খারাপ দেখে ঐদিন আমার মামা ও আমার ভাই আসলেন আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার মা আমাদেরকে নিয়ে চলে যেতে কাপড়-চোপড় গোছাইছিলেন। তখন আমার বাবা এসে বললেন, না থাক, কিচ্ছু হবে না। যাওয়ার দরকার নেই। আমরা আর গেলাম না। লোকে বলাবলি করছিল, যে কোনো সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করতে পারে। সন্ধার দিকে অবশ্য অবস্থা স্বাভাবিকই মনে হলো। তখন পর্যন্ত কোথাও কোনো খারাপ খবর শোনা যায়নি।

 

সন্ধ্যার পর ?

—রাতে অন্যান্য সময়ের মতই আমরা স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সবাই খাওয়া-দাওয়া করি। হামলা হবে—এমনটা তখনো বুঝতে পারি নি। তখন চৈত্র মাস ছিল। আবহাওয়া খুব গরম। এখনকার মত আর বিদ্যুতের ফ্যান ছিল না। ঘরের ভিতরে ঘুমানোটা কষ্টকর ছিল। আমাদের পাশের বাসায়ই থাকতেন রোকেয়া হলের আরেকজন স্টাফ গিয়াস উদ্দিন কাকা। খুব গরমের কারণে রাতে তার বাসার বারান্দায় আমরা ঘুমাতে যাই প্রায়ই। বারান্দায় একটা খাট ছিল। গিয়াস উদ্দিন সাবের আত্মীয় থাকতো তাঁর বাসায়। উনি কমার্শিয়াল ব্যাংকের নিউমার্কেট শাখায় চাকরি করতেন। উনি আর আমি রাতে বারান্দার খাটে ঘুমাতাম। ২৫ মার্চ রাতেও উনি আর আমি বারান্দার খাটে ঘুমায় পড়ি। সাড়ে ১১টার দিকে আমার মা এসে আমাকে ডাকে। মা বলল, বাবারে আমার তো খুব খারাপ লাগতেছে। বাইরে ঘুমানোটা কেমন ভয় ভয় মনে হয়। তোমরা বাসার ভিতরে গিয়া শোও। আল্লাহর কি হুকুম যে মা আগেই টের পেলেন যে ভয়াবহ বিপদ আসন্ন।

 

তারপর ?

—এরপর আমরা বিছনা গুটাইয়া বাসার ভিতরে গিয়া শুই। গিয়াস উদ্দিন, আমি আর ওই লোক এই তিনজন ছিলাম একরুমে। আমরা খালি ভিতরে গিয়া শুইছি, ওই লোকটা মাঝখানে আমি একপাশে আর গিয়াস উদ্দিন কাকা আরেক পাশে। ঘুমাইতে বাতি খালি বন্ধ করছি, ঠিক এই মুহূর্তে বাসার বাইরে গুলির শব্দ। কিছু বুঝার আগেই পাকিস্তানি আর্মি আমাদের রুমের দরজা লাথি মাইরা ভাইঙ্গা ফালায়। এরপর গুলি আর গুলি। ঘরের বাতি বন্ধ ছিল। গুলির লগেই আমাদের মাঝ খানে থাকা লোকটা পইড়া গেল। আমরা দুইজন দুই সাইডে সইরা গেলাম। আর্মি আর বাসার ভিতরে ঢুকে নাই।

 

আপনাদের দুজনের শরীরে সৌভাগ্যক্রমে গুলি লাগেনি। বুঝাই যাচ্ছেভয়ে কোনো শব্দও করেননি। আশপাশের কারো কান্না শুনতে পেয়েছিলেন ?

—এরপর অন্যান্য রুমেও খালি গুলির আওয়াজ শোনা যাইতেছে। মানুষের চিৎকার আর চিৎকার। কিছুক্ষণ পর আমাদের রুমে লোকটা খালি পানি চাইতে লাগলেন। খালি বলেন, পানি! পানি! গিয়াস উদ্দিন সাবের পাশেই পানি ছিল। উনি ইচ্ছা করলে পানি দিতে পারতেন। কিন্তু শব্দ হবে বলে উনি ভয়ে নড়েই না। ঘণ্টাখানেক পরেও লোকটা পানির জন্য ছটফট করছিলেন। পরে আমি আস্তে আস্তে সইরা পানি আইনা খাওয়াইলাম। কিছুক্ষণ পরেই উনি মারা যান। আরও ঘণ্টাখানেক পরে গিয়াস উদ্দিন কাকা রুমের ভিতরের ড্রামে লুকালেন। আমি ঢুকলাম খাটের নিচে। সারা রাইত খাটের নিচে রইলাম। ভোরের দিকে দেখি আর গুলির শব্দ নাই। তখন গিয়াস কাকাকে বললাম, কাকা আমগো ঘরের কি অবস্থা একটু দেইখা আসি।

 

—গিয়াস উদ্দিন সাবের বাসা থেকে আপনাদের ঘর কত দূর ছিল ?

এইতো পাশাপাশি। গেলাম আমাদের ঘরে। গিয়া দেখি সবাই গুলি খাইয়া পইড়া রইছে। আমার মা, বোন এবং ভাবি মইরা গেছে।  আমার ছোটো ভাই মোহাম্মদ আলী দেখি তখনো জীবিত, অরও গুলি লাগছে। বয়স ছিল ৮ অথবা ৯ বছর। সবার ছোটো ভাই ছিল মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিনের বয়স ছিল মাত্র দশ মাস। মহিউদ্দিনের পায়েও গুলি লাগে। আর আমার বোনের একটা ছেলে ছিল ৪০ দিন বয়সী। অর শরীরে গুলি লাগে নাই। এরা ৩ জন সমানে কাঁদতেছে। আমি দৌড়াইয়া গেলাম গিয়াস উদ্দিন কাকার কাছে। কইলাম, কাকা সবাইরে মাইরা ফালাইছে। ছোটো দুই ভাই আর ভাগিনাটা বাঁইচা রইছে। অরা কানতেছে। কাকা কইল, তুই তাইলে তগো ঘরে অদের কাছে থাক। এরপর আমি আমাদের ঘরে আসলাম। অরা অনেক কান্নাকাটি করতেছে। সবই শিশু। ৪০ দিন বয়সী ভাগিনাটারে কোলে নিলাম। আমি বুঝদা পারতেছি না এই ছোডো বাচ্চাগুলা নিয়া কী করমু, কই যামু ? তহন ছোহো ফিডারে পানি ঢুকাইলাম। বাসায় চিনি আছিল। ফিডারের পানিতে চিনি দিয়া অদের খাওয়াইলাম।

সকাল ১০টা কি সাড়ে ১০টার দিকে পাকিস্তানি আর্মি আবার আসলো। আমাদের ঘরের দরজা তো রাতেই ভাইঙ্গ ফালাইছে। দরজা খোলাই ছিল। আইসা আবার বন্দুক তাক করছে। আর ছোট ভাইটা আর ভাগিনা আবার হাউমাই কইরা কান্না শুরু করছে। আমি ভয়ে বোবার মত হইয়া গেছি। কান্না রেরুয় না আমার। তারা তো কানতেছেই। তহন কি মনে কইরা একটা অফিসার আইসা ইশারা দিল। তখন আর আমাকে গুলি করলো না। দরজার বাহির দিয়া রশি বাইন্ধা রাইখা আর্মি চইলা গেল। আসরের নামাজের সময় আমার ছোটো ভাই গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ আলী কয়, ভাই পানি খাওয়া। অরে পানি খাওয়াইলাম। কিছুক্ষণ পর মোহাম্মদ আলী মারা গেল। ঘরে তখন চারটা লাশ। চারদিকে রক্ত আর রক্ত।

 

অর্থ্যাৎ ২৬ মার্চ, শুক্রবার বিকেলে ?

—হ্যাঁ, ২৬ মার্চ বিকেল চারটা কি সাড়ে ৪টা দিকে মোহাম্মদ আলী মারা যায়। শুক্রবার রাইতটাও এমনেই গেল। ২৭ মার্চ সকালে রোকেয়া হলের স্টাফ হাবুল মিয়া আইসা আমারে ডাকলো। দরজা খুললাম। শুনলাম যে, কারফিউ সারছে। আমার আব্বা তো হলে গেইটে ডিউটিতেই ছিলেন। জানের ভয়ে ২৫ মার্চ রাত ও ২৬ মার্চ ওখান থেকে আর আসতে পারেন নাই। আব্বার কাছে গেলাম। এরপর আব্বাসহ আহত একবছরের ভাই ও ৪০ দিন বয়সী ভাগিনারে নিয়া আমাদের গ্রামের বাড়ি ঢাকার মাতুয়াইলে চইলা যাই। পরনে যা ছিল তাই নিয়া চইলা যাই। ঘর থেকে কিছুই নিতে পারি নাই।

 

আচ্ছা, ২৬ মার্চ যে আর্মি আবার আসলো, তখন বাসায় লুটপাট করেছিল। কারো বাসায় আগুন দিয়েছিল ?

—না।

 

রোকেয়া হলের স্টাফ কোয়ার্টারে আপনাদের পাশের বাসার তো অনেককেই হত্যা করা হয়, তাদের কী অবস্থা জানতে পেরেছিলেন ?

—ভয়ের কারণে কারো খবর নিতে পারি নাই।

 

আপনার বাবা সেদিন বেঁচে গেলেন কী করে ?

—আমার বাবা রাতে হলে ডিউটিতে ছিলেন। এজন্য বাঁইচা গেছে। আক্রমণ তো করছে স্টাফ কোয়ার্টারে। আমার সবার বড় ভাই গোলাম মোস্তফা কার্জন হলের নাইট ডিউটিতে ছিলেন। সেও বাঁইচা গেছে। ওনার স্ত্রী অর্থ্যাৎ আমার ভাবি মারা গেছে। ভাবি তো পরিবারের সঙ্গে বাসায় ছিল।

 

ভয়াল সেই কাল রাতে তৎকালীন রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ আক্তার ইমামের ভূমিকা কী ছিল ?

—পুরা বিশ্ববিদ্যালয়েই তো একই অবস্থা। খালি লাশ আর লাশ। কে কি করবো? কাকে কে বাঁচাবে।

 

আপনার বাবা তো হলের গেটে ডিউটিতে ছিলেন। উনিও পরে আপনাকে বলেনি যে, এই হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে হলের প্রভোস্ট আখতার ইমাম কোনো চেষ্টা করেছিল কিনা ?

—না। এটা তাদের আয়াত্বের বাইরে ছিল। প্রভোস্টের কথা তো আর্মি শুনেই নাই।

 

শহীদদের লাশের কি কোনো দাফন-কাফন হলেছিল ?

—এখন যে শামসুন্নাহার হলে গেট। ওখানে একটা গর্ত কইরা সবার লাশ মাটিচাপা দিছিল। এইটা করছে ২৭ তারিখে কারফিউ সিথিল করার পর। ঐ দিন বাসা ছাইড়া যখন যাই, দেখি আর্মি লোক ডেকে এনে গর্ত করাচ্ছে। আমার এক আত্মীয় আইসা লাশ নিতে চাইছিল। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি দেয় নাই। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ এই গর্ত খুড়ে শহীদদের হাড়-গোড় বাইর করছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে নিয়া কবর দেই।

 

হলের স্টাফদের মা-বোনেরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ? ছাত্রীরাদেরকে কি ধর্ষণ করেছিল ?

—না। কাউকে নির্যাতনের কথা আমরা জানতে পারি নাই।

 

হলের ছাত্রীদের কী অবস্থা ছিল বলে আপনি জানেন বা দেখেছেন ? রোকেয়া হলে কতজন ছাত্রী ছিল সেই কাল রাতে ? বিভিন্ন জন বিভিন্ন বইয়ে লিখেছেন, ৬ জন ছাত্রীর উলঙ্গ লাশ পাওয়া গিয়েছিল ?

—এগুলি মিথ্যা কথা। যে ক’জন ছাত্রী ছিল—তারা আক্রমণের আগমুহূর্তে হলের হাউজ টিউটরের বাসায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।

 

আপনার বাবার কাছে কি কখনো জেনেছেন যে, রোকেয়া হলে ২৫ মার্চ রাতে কতজন ছাত্রী ছিল  সেদিন ?

—আমার বয়স তো কম। এতো খবর আর রাখি নাই। তবে খুব সম্ভব ৫/৬ ছাত্রী ছিল হলে। উনারা হাউজ টিউটরদের বাসায় আশ্রয় নিছিল।

 

মা, বোন, ভাই ও ভাবিকে হারিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়া আগ পর্যন্ত সময়টুকু কীভাবে পার করলেন ?

—পরে আমার বাবাকে চিঠি দেয়া হয় যে, ডিউটিতে যোগ দিতে হবে। নইলে চাকরি থাকবে না। এরপর বাবা হলের ডিউটিতে যোগ দেন। উনি তো মাসে মাসে বেতন পাইতেন। এই টাকা দিয়েই কোনো রকম চলতাম।

 

লাখো শহীদের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। আপনার মা- বোন ভাইসহ ৪ জন শহীদ হলেন। স্বাধীনতার পর কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলেন ?

—বঙ্গবন্ধুর চিঠিসহ আমার বাবা ২ হাজার টাকা পাইছিলেন। এছাড়া আর কোনো কিছু পাই নাই। অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের একগ্লাস পানি খাওয়াইয়া মুক্তিযোদ্ধা হইছে। এহন কত সুযোগ-সুবিধা পাইতাছে। কিন্তু শহীদ পরিবারের কোনো মূল্য নাই। আমারা পাই নি কিছুই।

 

শহিদদের স্মৃতি রক্ষার্থে আপনার কোনো দাবি আছে ?

—রোকেয়া হলের শহিদদের প্রথম গণকবরটি ছিল বর্তমান শামসুন্নাহার হলের গেটে। ভিসি আরেফিন সিদ্দিক স্যারের সময়ে আমরা সেখানে ইট-বালু দিয়া জায়গাটি চিহ্নিত করে রাখছি। কিন্তু কোনো স্মৃতিস্তম্ভ হয় নাই। শহিদদের নামের তালিকাও নেই। রোকেয়া হলের সামনে একটা বোর্ডে যে কর্মচারির পরিবারের লোকজন শহিদ হইছে তাদের তালিকা আছে। কিন্তু যে ৪৫ জন শহীদ হলেন তাদের কোনো নাম-তালিকা নাই।

প্রতিবছর ২৫ মার্চ আসলে রোকেয়া হলে আমরা দোয়ামাহফিল করতাম। এখন আর এটাও হয় না। ভিসি স্যারের [সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক] কাছে কৃতজ্ঞ যে ভিসি বাসভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শহিদদের জন্য একটা নামফলক করছে।

 

সেখানে তো রোকেয়া হলের সকল শহিদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। নেই সবার নাম ও পরিচয়।

—হ্যাঁ, ওখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফদের মধ্যে যাদের পরিবারে শহিদ হইছে, তাদের নাম আছে। রোকেয়া হলের জন্য আলাদা করে পরিস্কার তালিকা নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে শহিদদের যে গণকবর, সেখানে শুধু শহিদ শিক্ষকদের নাম দেয়া হয়। পরে শহিদ কর্মচারি পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা গিয়ে ভিসি স্যারকে জানাই। এরপর শহিদ কর্মচারিদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

আচ্ছা, রোকেয়া হলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ এবং শহিদদের পূর্ণাঙ্গ নাম ও পরিচয়সহ নামফলক হলে কেমন হয় ?

—এটা হোক, আমাদেরও দাবি। তাহলে যারা এই হলে নতুন চাকরি করতে আসবে, যে ছাত্রীরা হলের আসবে—তারা জানতে পারবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এই হলে কী নির্মম গণহত্যা হয়েছিল।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা