X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
সাক্ষাৎকার

শাহীন আখতারের মুখোমুখি আফসানা বেগম  

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : আফসানা বেগম
১২ মে ২০২২, ১৮:৩৪আপডেট : ১২ মে ২০২২, ১৮:৪২

কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতারের জন্ম ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, কুমিল্লায়। তার গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ‘শ্রীমতির জীবন দর্শন’, ‘বোনের সঙ্গে অমরলোকে’, ‘আবারো প্রেম আসছে’ প্রভৃতি। উপন্যাস : ‘তালাশ’, ‘সখী রঙ্গমালা’, ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘অসুখী দিন’ প্রভৃতি। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে ‘সতী ও স্বতন্তরা’ তিন খণ্ডে বাংলা সাহিত্যে নারীকথনের নির্বাচিত সংকলন। তিনি বাংলা একাডেমি, জেমকন সাহিত্য পুরস্কার সহ দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।
তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক আফসানা বেগম। আফসানা বেগমের জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৭২। প্রকাশিত বই : ঝাঁপ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ), রোমান সাম্রাজ্য (অনুবাদ), জীবন যখন থমকে দাঁড়ায় (নভেলা), দশটি প্রতিবিম্বের পাশে (ছোটোগল্প), লেখালেখি তাদের ভাবনা (অনুবাদ)। ‘দশটি প্রতিবিম্বের পাশে’ পাণ্ডুলিপির জন্য জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি।
তাদের আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সমসাময়িক জীবন, মুক্তিযুদ্ধ এবং লেখালিখি বিষয়ক নানা কথা।


প্রশ্ন : আপনার বাড়িতে পড়ার আবহ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে গল্প শুনে রচনার অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা আমরা অনেকেই জানি। তখন কি আপনি ভেবেছিলেন যে ভবিষ্যতে সাহিত্য রচনা করবেন? কবে প্রথম এরকম চিন্তা এল?
উত্তর : লেখালিখি করব ছোটবেলাতেই সেই ইচ্ছাটা তৈরি হয়। তখন সাহিত্যের আবহে থাকার কারণে সম্ভবত। তারপর মাঝখানে চলে যায়, ইউনির্ভাসিটিতে অর্থনীতিতে ভর্তি হওয়ার পর। সেই অব্দি আমার লিখতে চাওয়া, না-চাওয়া পরিপার্শ্বের ওপর নির্ভর করছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে আমি ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করি। ততদিনে আমি কিছু অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে গিয়েছিলাম, চারপাশের জীবনপ্রবাহ নিয়েও বেশ স্পর্শকাতর হয়ে পড়ি। আমি নিজের নিরাময় খুঁজতে তখন লেখালিখিকে আশ্রয় করি, যা প্রায় এক দশক আগে ছেড়ে দিয়েছিলাম।


প্রশ্ন : আপনার শিক্ষা এবং ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তার ভিত্তিতে আশা করি জানতে চাইতে পারি, আপনি তখন চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে যেতে পারতেন, তা না করে সাহিত্য রচনায় মনোযোগী হলেন কি বিশেষ কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতির কারণে?
উত্তর : হ্যাঁ, ততদিনে প্রামাণ্য-চলচ্চিত্রে প্রশিক্ষণ, টুকিটাকি নির্মাণের কাজ করছিলাম চাকরির সূত্রে। ফিল্মও দেখতাম খুব। ছোট ছোট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে অ্যাটেন্ড করা এসব। কিন্তু তখন আমার যা মানসিক অবস্থা, মনে হয় চলচ্চিত্র নয়, ফিকশন—গল্প-উপন্যাসই আমি লিখতে চাই। তখনকার আমার লেখাপত্র কিছুটা আত্মজৈবনিক, নিজের সঙ্গে কথা বলা বা ডায়েরি লেখার মতো।


প্রশ্ন : আপনি কি লিখতে লিখতে কাহিনির পরবর্তী অগ্রগতি বা পরিণতি নিয়ে ভাবেন নাকি সম্পূর্ণ ভেবে নিয়ে তারপরে লিখতে বসেন?
উত্তর : লিখতে বসার আগে পুরো প্লটটা মোটামুটি মাথায় থাকে, যদিও লিখতে লিখতে তার অনেকটাই বদলে যায়। কখনো কখনো ফার্স্ট ড্রাফট ফিরে পড়তে গিয়ে অবাক হই—ওটা আমি লিখেছিলাম! আবার কখনো কখনো বাক্য, বাক্যাংশ ওখানে থেকে ছেঁকেও আনি। মানে ওই প্রথম দিকের ড্রাফট থেকে।


প্রশ্ন : প্রাথমিকভাবে আপনি সাধারণ মানুষের মানসিক টানাপড়েন নিয়ে লিখতে শুরু করেও পরে একসময় ইতিহাসভিত্তিক বা ইতিহাসআশ্রয়ী গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন। কখন বা কী কারণে মনে হলো যে আপনার ইতিহাসআশ্রয়ী রচনা লেখা দরকার? এরপর কোন অনুপ্রেরণা বা তাড়নায় একের পর এক ইতিহাসআশ্রয়ী লেখা লিখতে আগ্রহী হলেন?
উত্তর : ইতিহাসআশ্রয়ী ছোটগল্প কি লিখেছি? অতীতের কোনো ঘটনার উল্লেখ আছে হয়তো কয়েকটি গল্পে। উপন্যাসের বেলায় বলব, হ্যাঁ সখী রঙ্গমালা, ময়ূর সিংহাসন এ দুটি পুরাই ঐতিহাসিক উপন্যাস। সখী রঙ্গমালা কোনো ‘দরকার’ থেকে লিখতে শুরু করিনি। ‘চৌধুরীর লড়াই’ পালাগান পড়ে সখী রঙ্গমালা লেখার ভাবনাটা মনে আসে। রঙ্গমালার দুর্ভাগ্যই মনে হয় আমাকে টেনেছে বেশি। সামান্য বারবনিতা—গীতিকারদের দয়ামায়াও পায়নি। ফিল্ড ভিজিটে গিয়ে দেখলাম, মানুষ অন্যভাবে তাকে মনে রেখেছে। রঙ্গমালার ভিটেয় এখন যারা থাকেন, তারা তাকে মহিয়সী নারী ভাবেন। তার জন্য গর্ববোধ করেন। যাই হোক, যারা ‘সখী রঙ্গমালা’ পড়েছেন, তারা জানেন উপন্যাসে সে কেমন। ওর মৃত্যুদৃশ্য লিখে আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম—এত গ্রেসফুল, মর্যাদাসম্পন্ন! হাড়িকাঠের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দৃপ্তপায়ে। আমি ওকে এভাবেই কল্পনা করেছি। আরেকটা বিষয়—‘চৌধুরীর লড়াই’ পড়তে পড়তে আমার দাদির মুখের কিছু শব্দ মনে পড়ছিল। শব্দগুলো তাঁর সঙ্গেই যেন হারিয়ে গেছে। আর কোথাও শুনিনি। দাদির জন্ম-মৃত্যু কুমিল্লায়। কুমিল্লার পাশের জেলা নোয়াখালি। সেই অঞ্চলের অনামা এক প্রাচীন গীতিকার আমার শৈশবে হারিয়ে যাওয়া আপন মানুষটিকে যেন ফিরিয়ে আনলেন—খুব কৃতজ্ঞবোধ করছিলাম। ভালোবাসাও জন্মাল তখন। খুব তুচ্ছ বিষয়, তবু সখী রঙ্গমালা লেখার অনুপ্রেরণা এটিও হতে পারে।

তারপর ময়ূর সিংহাসন কেন লিখলাম? সখী রঙ্গমালার পর ময়ূর সিংহাসন লেখার ছোট্ট একটা কারণ সম্ভবত আমার অতীতমুখি জার্নিটা আমি অব্যাহত রাখতে চেয়েছি। চট করে বর্তমানে ফিরতে চাইনি। তাছাড়া সখী রঙ্গমালা লিখে হয়তো মন ভরেনি। কোথাও একটা অপূর্ণতার স্বাদ থেকে গেছিল। পূর্ণতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় ময়ূর সিংহাসন লিখতে বসেছি, তাও হতে পারে। এখানে কাহিনি সাজানোর ব্যাপারে খুব উদ্যোগী ছিলাম। উপন্যাসের দূর অতীতের মানুষ—রাজকুমার, রাজকুমারী, বাঁদি সবাই নিজেকে বা অন্যকে নিয়ে বা সেই সময়টা নিয়ে কথা বলে, সংলাপ আকারে নয়, খানিকটা বর্ণনাত্মক নাটকের আদলে।


প্রশ্ন : ভবিষ্যতে কি ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাস ছাড়া মানুষের সাধারণ মনস্তত্ত্ব কিংবা সাম্প্রতিক বিষয় বা অন্যকিছু নিয়ে লেখার পরিকল্পনা আছে?
উত্তর : ভবিষ্যতে কেন, ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘অসুখী দিন’ উপন্যাসই তো অতীত-বর্তমান মেশানো। আর ‘মানুষের সাধারণ মনস্তত্ত্ব?’ ঐতিহাসিক উপন্যাসের সঙ্গে এর বিরোধ কোথায়, যদি ওখানে সাধারণ মানুষ থাকে? ‘সখী রঙ্গমালা’ উপন্যাসে কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই সাধারণ এবং প্রান্তিক মানুষ। দূর-অতীতের হলেও তারা আমাদের মতো মানুষ ছিলেন। তাদের আমাদের মতো মন ছিল। মনের কারবার ছিল।


প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তালাশ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধকে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে। মুক্তিযুদ্ধকে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে থেকে দেখার অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন?
উত্তর : ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লাভের অনুপ্রেরণা কোথায় পেলাম? আমার কাছে বিষয়টা অস্পষ্ট, একটু উল্টোও মনে হয়। দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলি। ‘ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’র কিছুটা হয়তো ইনবিল্ট—মজ্জাগত। ঘাড়-ত্যাড়া লোকদের থাকে। তাছাড়া অভিজ্ঞতা, চর্চার মাধ্যমেও তা অর্জিত হতে পারে বা বদলাতে পারে। বয়সেও বদলায় অনেকের। তো একজন কোন বিষয়ে অনুপ্রেরণা পাবেন, সেটাও মনে হয় এই দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করে দেয়। ‘দেশ স্বাধীন হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা বীরের বেশে ফিরছেন, ধর্ষণের শিকার মেয়েরা গা-ঢাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন’ এমন একটি দৃশ্য আমার তালাশ লেখার প্রেরণা। আমার দৃষ্টিভঙ্গিই হয়তো সঙ্কেত দিচ্ছিল—বীর ভাইদের বদলে বীরাঙ্গনা বোনদের উপন্যাসের কেন্দ্রে রাখতে এবং শুধু তাদের নয় মাসের জীবন নয়, যুদ্ধ-পরবর্তী জীবনের কাহিনি লিখতে।


প্রশ্ন : একসময় সম্মুখ যুদ্ধ বা ধর্ষণের শিকার নারীর কাহিনিই কেবল মুক্তিযুদ্ধের গল্প-উপন্যাস-চলচ্চিত্রে স্থান পেয়েছে। পরবর্তী কালে এই যে যুদ্ধকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার বিষয়টি এল, আপনার কি মনে হয় মুক্তিযুদ্ধকে এখনো আরো অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্প-সাহিত্যে ধরা বাকি আছে? থাকলে কীরকম হতে পারে সেটা?
উত্তর : মুক্তিযুদ্ধের শিল্প-সাহিত্য এমন ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছে কি না বা এভাবে এর বিবর্তন ঘটেছে কি না, আমি জানি না। সাহিত্যের কোনো জনরায় এ রকম বিভাজন রেখা টানা যায় বলেও আমার ধারণা নেই। ভবিষ্যতের দিকে তাই অব্যর্থ তির ছুড়তে পারছি না। তবে নয় মাসের যুদ্ধ আর যুদ্ধ-পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস আমাদের সামনে। তার মানে ক্ষেত্রটা আরো বিস্তৃত হয়েছে। যুদ্ধের সরাসরি অভিজ্ঞতাগুলি বিলীন হয়ে যাচ্ছে, সেসময়কার মানুষজনের সঙ্গে সঙ্গে। এদিকে আবার বিগত কিছু বছরের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তে মহাফেজখানার দেরাজগুলো ভারী হচ্ছে। সেখানে ডুব দিতে পারেন, যারা এখন লিখতে চান।


প্রশ্ন : আপনার কি ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড়ো ক্যানভাসে আরো কাজ করার পরিকল্পনা আছে? থাকলে সে বিষয়ে যদি বলতেন।
উত্তর : তালাশ-এর ক্যানভাসই তো বড়। না, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড়ো ক্যানভাসে আরো কাজ করার পরিকল্পনা নেই। তালাশ লেখার পর আমি এমনকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো ছোটগল্পও লিখিনি। ওখানেই থেমে গেছি।


প্রশ্ন : আমরা জানি যে মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের নিয়ে কোনো এক গবেষণা কাজের মধ্যদিয়ে আপনি তালাশ উপন্যাসের বীজ বা অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। বাস্তবে অনেক আগে থেকেই কি আপনি সমাজে বীরাঙ্গনাদের প্রবঞ্চিত হওয়ার কথা ভাবতেন? আর আজকে মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু বদলেছে মনে করেন?
উত্তর : এই গবেষণা কাজের সূত্রেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ২৫ বছর পর, ১৯৯৬ সালে। সে সাক্ষাৎটা আমাকে ওলট-পালট করে দেয়। তাঁদের স্বাধীনতা-উত্তর জীবন-যাপন আমার কাছে ছিল অজানা। শুধু আমার কাছে নয়, অনেকের কাছেই। স্বাধীনতার অনেক বছর পর এ বিষয়টা নতুন করে উঠে আসে। নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বই সবে বেরিয়েছে। তারপর ১৯৯৫-এর বেইজিং কনফারেন্স। ওখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কজন রেইপ সারভাইভার জবানবন্দি দিয়েছিলেন। অডিটোরিয়াম ছিল দর্শক উপচানো। আমরা বাইরের মাঠে, রঙিন ছাতার নিচে বসে কথার ফাঁকে তাঁদের কান্না শুনেছিলাম। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এ গবেষণা প্রকল্পের পেছনে বেইজিং কনফারেন্স একটা প্রেরণা ছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথাও তখন ভাবা হচ্ছিল। যেখানে মেয়েরা তাঁদের যুদ্ধের কথা বলবে। তারপর তো সাক্ষাৎকার গ্রহণ শুরু হলো।

রাষ্ট্রীয়ভাবে শুরুতে ভালো উদ্যোগ ছিল। পুনর্বাসন, স্বীকৃতি। গত এক-দুই দশকে বীরাঙ্গনাদের ভাতা, সংবর্ধনা ইত্যাদি জুটেছে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। তাঁরা সংখ্যায় নিঃসন্দেহে নগন্য। তবু যাকে বলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, তা তাঁরা পেয়েছেন। সবশেষে রাষ্ট্রের তরফ থেকে পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা-স্বীকৃতি।

এখন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু বদলেছে, তা আর দশজনের চেয়ে আমি ভালো বলতে পারব না। এটা মাপা কঠিন। তবে বর্তমানের ধর্ষণের শিকার মেয়েদের অবস্থা দেখে, তার একটা আন্দাজ করা যায়। যখন সমাজের মাথারা এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানান, সালিশ-এজলাসে কথা বলেন, টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছে মহীয়ান বিষয় হলেও, ’৭১-এর রেপসারভাইভারদের কখনো মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়নি। আমি তাঁদের প্রতি সমাজ-পরিবার সবাইর আচরণের কথা বলছি।


প্রশ্ন : আপনার অসুখী দিন উপন্যাসে দেশভাগ প্রধান বিষয় হিসেবে এসেছে। দেশভাগ এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলেও তা আমাদের সাহিত্যে তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি যতটা কি না পশ্চিমবঙ্গের একাধিক প্রধান রচনায় তা হয়েছে। আপনি কি এরকম কোনো কারণেই দেশভাগকে উপন্যাসের বিষয় হিসেবে তুলে আনতে চেয়েছেন? এই প্রসঙ্গে জানতে ইচ্ছে করছে, আমাদের দেশের সাহিত্যে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় দেশভাগ নিয়ে কম লেখালিখির কারণ কী বলে মনে করেন?
উত্তর : অনেকগুলি প্রশ্ন এখানে। আমি খেই হারালে কিছু মনে করো না।

একটা উপন্যাসের বিষয় নির্বাচনের বেলায় বিচিত্র সব ভাবনা কাজ করে। শুরুতে সেসব চিন্তা খুব এলোমেলো বা আবছাভাবেই মাথায় আসে। আমি আমার কথাই বলছি। যেমন অসুখী দিন লিখতে বসার আগে পঞ্চাশের মন্বন্তর, আজাদ হিন্দ ফৌজ, অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টি আর বিভিন্ন সময়ের টুকরা-টুকরা কিছু স্মৃতি—এসব নিয়ে ভাবছিলাম। আগেও বিভিন্ন জায়গায় বলেছি—আমার এ উপন্যাসের বীজ সম্ভবত রোপিত হয়েছে দিল্লির চিত্তরঞ্জনপার্কে, ৮৯-৯০ সালে। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের কোর্সে আমি একজন উদ্বাস্তু ভদ্রলোককে নিয়ে ছবি বানাচ্ছিলাম। তিনি পদ্মাপাড়ের এক গ্রামের সুন্দর বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তাঁর মায়াময় সব স্মৃতির। বাবরি মসজিদের পর সেসব গল্পকে আমি আবার বদলে যেতেও দেখেছি। তাছাড়া ছোটবেলায় কিছু অদৃশ্য প্রতিবেশীর গল্প শুনেছি। তারা ছিলেন, এখন নেই। ’৭১ সালের যুদ্ধের প্রবল ঝড় সেসব গল্পকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আমি জানি না, এসব মুছে যাওয়া গল্প, বদলে যাওয়া আখ্যান আমার ‘অসুখী দিন’ লেখার অনুপ্রেরণা কি না।

আমাদের এখানে দেশভাগ নিয়ে লেখা কম হয় বলে আমাকে লিখতে হবে, এমন কোনো গুরুদায়িত্ব নিয়ে আমি লিখতে বসিনি। আমি আমাদের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক অবস্থান থেকে ‘অসুখী দিন’ লিখতে চেয়েছি। আমাদের দেশভাগের ইতিহাস আর বর্তমান বাস্তবতা পাকিস্তান, ভারত থেকে আলাদা। দেশভাগ নিয়ে আমাদের কোনো সরল গল্প নেই। তা উদ্বাস্তু হওয়ার বেদনা বা নতুন দেশ অর্জন, যে অর্থেই বলি না কেন। মাঝখানে অবধারিতভাবে ’৭১-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে আসে। এ জটিল প্রেক্ষাপট আমাদের এখানে দেশভাগ নিয়ে কম লেখালিখির কারণ হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশভাগ নিয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস কিন্তু এখানে লেখা হয়েছে। হাসান আজিজুল হকের আগুন পাখি


প্রশ্ন : আপনার গল্প-উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র প্রায়ই একা, অন্তত মানসিকভাবে। আমাদের সমাজের মেয়েদের বাস্তবতা কি আপনি এভাবেই দেখেন?
উত্তর : কোনো বিষয়ে গোটা সমাজের চেহারা সামনে নিয়ে কেউ লিখতে বসেন বলে আমার জানা নেই। একজন ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হতে পারে, সম্ভবত এসবই তার লেখায় প্রতিফলিত হয়। তার লেখার পেছনের তাড়না হিসেবে কাজ করে।


প্রশ্ন : আমাদের সমাজে মূলত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রাধান্য পায়। নারী হওয়ার কারণে সাহিত্য অঙ্গনে কিংবা প্রকাশিত হওয়ার পথে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাই। নারী সাহিত্যিক হিসেবে কখনো কি আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে গেছেন?
উত্তর : লেখা প্রকাশ করা তেমন কঠিন কিছু নয়। কিন্তু নারীদের লেখার ব্যাপারে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রকটভাবে ধরা দেয় সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে। মেয়েরা ভালো লিখতে পারে—এ বিশ্বাসটাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেশিরভাগের নেই। মেয়েদের লেখার প্রশংসা করার সংস্কৃতি তো গড়েই ওঠেনি। বরং ইগনোর করার সমবেত একটা প্রচেষ্টা জারি আছে।


প্রশ্ন : আমাদের দেশের সাহিত্যজগৎ কি নারীবান্ধব বলে মনে করেন? অন্যদিকে, পরিবার বা সমাজ শিল্পসাহিত্যে জড়িত নারীকে কীভাবে মূল্যায়ন করে বলে মনে করেন?
উত্তর : সাহিত্যজগৎ যদি এক্ষেত্রে সাহিত্যিকদের জগৎ বোঝানো হয়ে থাকে, এটা এখন কেমন, নারীবান্ধব কি না—সত্যি আমার ধারণা নেই।

‘পরিবার বা সমাজ শিল্পসাহিত্যে জড়িত নারীকে কীভাবে মূল্যায়ন করে?’ এ রকম প্রশ্নের জবাবে কী বলা যায়, আমি সত্যিই বুঝতে পারি না। হয়তো শত-সহস্রভাবে মূল্যায়ন করে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মূল্যায়নও মেলে না। শিল্পসাহিত্যে জড়িত সব নারীকে একই মানদণ্ডে মাপাও হয় না। শিল্পে পরিমনি, সাহিত্যে সেলিনা হোসেন—সমাজ কি তাদের একইভাবে মূল্যায়ন করে, না সমান দৃষ্টিতে দেখে? উদাহরণ হিসেবে বললাম। আসলে সবকিছুকে গড়পরতা হিসেবে ভাবার সুযোগ নেই। পরিবারের ভূমিকাও এক্ষেত্রে বিচিত্র। পরিবারের ভেতরেও একেক সদস্যের এ ব্যাপারে মূল্যায়ন একেক রকম। বিষয়টা এত বড় আর নানা স্তরবিশিষ্ট ও জটিল সাক্ষাৎকারে দু-চার কথায় বলা সম্ভব নয়।


প্রশ্ন : একসময়ের সমাজে কোনো নারী সাহিত্য রচনা ও প্রকাশ করছে, এটুকুই হয়তো বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। সময়ের স্রোতে আজ এতদিন পরে আমাদের সমাজে নারী সাহিত্যিক কি পুরুষ সাহিত্যিকদের সঙ্গে লিঙ্গ নির্বিশেষে সমানভাবে উল্লেখযোগ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বলে মনে করেন?
উত্তর : পৃথিবীজুড়ে যেমন, আমাদের এখানেও পুরুষদের চেয়ে নারী সাহিত্যিকেরা ভালো লিখছে। বিশেষ করে কথাসাহিত্যে এগিয়ে আছে।


প্রশ্ন : জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিশেষ সাহিত্যপাঠ ও বিশেষ চলচ্চিত্র দর্শন নিশ্চয় আপনাকে ভাবনার জগৎ তৈরিতে ও সাহিত্য নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এরকম কিছু উদাহরণ জানতে পারি কি?
উত্তর : সাহিত্যপাঠ, চলচ্চিত্র দর্শন, জীবন-অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আমার সাহিত্য-ভাবনার জগৎ তৈরি করেছে। তা দীর্ঘ সময় ধরে এমন সূক্ষ্মভাবে যে, আমি দুঃখিত—কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারব না।


প্রশ্ন : সামান্য দেরি করে সাহিত্য রচনায় এলেও আপনার বই দেশে-বিদেশে নানাভাবে সমাদৃত হয়েছে। আপনার বই আমাদের সাহিত্যজগতের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিও এনেছে। কিন্তু সাহিত্য নিয়ে এমন কোনো স্বপ্ন ছিল কি যা পূরণ হয়নি বা হওয়া কঠিন কিংবা যে সফলতার জন্য আপনি পরিশ্রম করে চলেছেন?
উত্তর : হ্যাঁ, অপ্রত্যাশিত কিছু প্রাপ্তি নিশ্চয় ঘটেছে।

স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বা অপূরণীয় আছে—সেরকম না। এখন এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আছি, প্রতিনিয়ত ভয় হয়—আপনজনদের মৃত্যু, অসুস্থতার জন্য না আমার লেখালিখি বন্ধ হয়ে যায়।


প্রশ্ন : স্বাধীনতা পাবার পঞ্চাশ বছর পরে লেখার টেবিলে বসে আপনার কি নিজেকে মুক্ত-স্বাধীন বলে মনে হয়? অর্থাৎ, যে বিষয় নিয়ে লিখতে চান বা ঠিক যে শব্দ-বাক্যে তাকে উপস্থাপন করতে চান, অবলীলায় তাই করতে পারেন? না পারলে, তার জন্য কি আপনার আফসোস বা অনুশোচনা হয়?
উত্তর : মুক্ত-স্বাধীন ব্যাপারটা আমাদের স্বপ্ন। তা হয়তো বাস্তবে কখনই ছিল না। এখন জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, আকাশে ড্রোন—ত্রিশঙ্কু অবস্থা। লেখার টেবিলেও সেই ভাবনা থেকে রেহাই পাওয়ার জো নেই।


প্রশ্ন : সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ‘লেখকের দায়’ বলে কি কিছু কখনো আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে? লেখক কি নিজের খুশিমতো লিখবেন নাকি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে লেখার বিষয় ও উপস্থাপনার কৌশলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে?
উত্তর : ‘দায়’ নিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে লিখতে বসাটা মারাত্মক। ইচ্ছাটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে বলি—একজন লেখক কীভাবে লিখবে, সেটা আরেকজনের লেখকের বলে দেওয়ার জিনিস নয়।


প্রশ্ন : লেখক যে সময়টাতে বিচরণ করে সেই সময়টা তার সাহিত্যে উঠে আসা দরকার বলে মনে করেন কি? বর্তমানে যারা লিখছে তাদের সাহিত্যে কি বর্তমানের বাস্তবতা সূক্ষ্ম বা মোটাদাগে উঠে আসছে বলে আপনার ধারণা? তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে উঠে আসছে না মনে করলে, কোন কোন বিষয় নিয়ে লিখলে তাদের রচনা বর্তমানের চালচিত্র হতে পারত?
উত্তর : কোন সময়, কোন বিষয়ে লিখবেন, সেটা লেখকের পছন্দ। এ ব্যাপারে তার কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার বা তাকে পথ বাতলে দেওয়ার আসলে আমরা কেউ না। তার লেখার ভালো-মন্দ দিক নিয়ে আমরা শুধু কথা বলতে পারি।

বর্তমানের সব লেখকের লেখাপাঠ বা চর্চা করিনি বলে এ ব্যাপারে মতামত বা উপদেশও দিতে পারছি না। কারো কারো ভাষার খেলায় আমি মুগ্ধ। বর্তমানের কিছু পাগলামিও পরিলক্ষিত হয় কখনো কখনো।


প্রশ্ন : সাহিত্যে রাজনৈতিক বা সামাজিক ইতিবাচক ও নেতিবাচক পরিবর্তনের কথা, ধর্মবিশ্বাস নিয়ে অন্ধত্ব বা মৌলবাদের কথা কি আসা উচিত বলে মনে করেন? সাহিত্যে এইসমস্ত বিষয়ের খোলাখুলি আলাপ কি মানুষের মননশীলতায় প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন?
উত্তর : একজন লেখক যে বিষয়ে লিখতে চান, তা নিয়ে যেন লিখতে পারেন, সে অবস্থাটা সর্বদাই কাম্য। লেখকের তরফ থেকেও তার ইচ্ছার পথের বাধাটা জগদ্দল পাথর মনে হলেও তাতে তিনি ঠ্যালা দিতে পারেন, তার ইচ্ছাটা কায়েম করার জন্য। না হলে তো পাথর নড়বে না। সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা এক জায়গায় থমকে থাকবে।


প্রশ্ন : বর্তমানে যে সাহিত্য রচনা হচ্ছে তার মধ্যে কোনো কোনো রচনা কি অনূদিত হয়ে অন্য ভাষাভাষী পাঠকের কাছে উন্মুক্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
উত্তর : নির্দিষ্টভাবে কোনো রচনার কথা বলতে না পারলেও, আমাদের সাহিত্য ভালো অনুবাদের মাধ্যমে অন্য ভাষাভাষী পাঠকের কাছে উন্মুক্ত হওয়া দরকার বলে মনে করি।


প্রশ্ন : আপনার বর্তমান কাজ ও লেখালিখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে পারলে কৃতার্থ হই।
উত্তর : একটু আগে আমার বর্তমান অবস্থার কথা বলেছি। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করার সাহস নেই। দীর্ঘসময় ধরে একটা উপন্যাস লিখছি। অনেক বিরতি দিয়ে দিয়ে লিখতে হয়েছে। এ বছর এপ্রিল-মে মাসে সেটা বেরোবে আশা করি। এখনো প্রকাশক ঠিক হয়নি। এই মুহূর্তে নামটাই শুধু বলতে পারি—‘একশ এক রাতের গল্প’।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা