X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১
যখন যেখানে যাই

গল্প কথকের প্রথম আবাস : ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের জন্মস্থান

ফজল হাসান
২৮ জুন ২০১৬, ১৪:০৬আপডেট : ৩০ জুন ২০১৬, ১৭:৪৮

ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড বলা হয়, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের সঙ্গে ভার্জিনিয়া উলফের পরিচয় না হলে হয়তো ভার্জিনিয়া উলফ্ কখনই ‘মিসেস ড্যালোওয়ে’ লিখতে পারতেন না। শুধু ভার্জিনিয়া উলফ্ই নন, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড অনেক সাহিত্যিককে লেখার প্রেরণা দিয়েছেন, এমনকি তার বিভিন্ন গল্পের শব্দ এবং চরিত্র ধার করে অনেকে তাদের লেখায় ব্যবহার করেছেন। এদের মধ্যে অ্যাল্ডার্স হাক্সলী অন্যতম

সূচনা পর্ব

 

নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটন যাবো, অথচ সেদেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের জন্মস্থান দর্শনে যাবো না, তা কিছুতেই হতে পারে না। ২০১১ সালের শুরুতে মেহেরুন এবং আমার নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নিউজিল্যান্ডের ‘গার্ডেন সিটি’ হিসেবে খ্যাত ক্রাইস্টচার্চে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের যাওয়ার তার কিছুদিন আগে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে পুরো ক্রাইস্টচার্চ শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ফলে পরবর্তী ভূমিকম্পের আশঙ্কার সেখানে যেতে দ্য গ্রেট আলেকজান্ডার অথবা মঙ্গোলীয় বীরযোদ্ধা চেঙ্গিস খানের মতো সাহস দেখাইনি। তাই সাহসের খামতির জন্য ক্রাইস্টচার্চের বদলে ওয়েলিংটন এবং নেলসন হয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘অ্যাবেল তাসমান ন্যাচার রিজার্ভ’ পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিই।
লেখক হিসেবে বাংলাদেশের পাঠকমহলে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের নাম খুব বেশি পরিচিত নয়। তাই তার জন্মস্থান, অর্থাৎ শৈশবের বাড়ি নিয়ে কিছু বলার আগে লেখিকার জীবন এবং তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া আবশ্যক বলে মনে করি। উল্লেখ্য, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড তার ছদ্মনাম। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিল ক্যাথলিন ম্যান্সফিল্ড বিউকম্প। কথিত আছে, স্কুলে পড়ার সময় তিনি নিজেই নিজের নাম পরিবর্তন করেন।

ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের পরিচয় : জীবন ও সাহিত্য
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দশকে যে কয়জন কথাসাহিত্যিক ইংরেজি ছোটগল্পের প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিপরীত স্রোতে কলম ধরে গল্প বলার আঙ্গিক পরিবর্তন করেছেন এবং ঋদ্ধ করেছেন ইংরেজি গল্প-সাহিত্য, তাদের মধ্যে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড অন্যতম। তিনি পরম্পরা ঘটনাকে একের পর এক গতানুগতিকভাবে না সাজিয়ে একটা ঘটনা অথবা একটা সমস্যাকে তার কল্পনা শক্তিতে তুলে ধরেছেন। তার গল্পের বিষয়বস্তু সার্বজনীন এবং আশেপাশের খুবই পরিচিত ঘটনা বা চরিত্র নিয়ে রচিত। বিভিন্ন গল্পে তিনি নারী-পুরুষের জীবন ও ঐতিহ্যগত কর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। এছাড়া তার গল্পে সামাজিক অবকাঠামো এবং শ্রেণিবিন্যাস, আদর্শ ও বাস্তবতা, সুন্দর ও কুৎসিত, আনন্দ ও দুঃখ, প্রেম ও স্বপ্নভঙ্গের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিপুণভাবে উঠে এসেছে। তার সম্পর্কে ‘টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরী লিটারেরী ক্রিটিসিজম্’ ম্যাগাজিন উল্লেখ করেছে, ‘আধুনিক ছোটগল্পের বিকাশধারায় তিনি মধ্যমণি।’ তবে অনেক সমালোচক এবং বোদ্ধাদের মতে তিনি ছিলেন একজন ‘পলায়নবাদী কথাশিল্পী।’
ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের জন্ম ১৮৮৮ সালের ১৪ অক্টোবর ওয়েলিংটন শহরের থর্নডন এলাকার টিনাকরি সড়কের পৈত্রিক বাড়িতে। ইংরেজ বংশোদ্ভূত বাবা হ্যারল্ড বিউকম ছিলেন এক আমদানী সংস্থার কেরানী। তবে পরবর্তীতে তিনি তার বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা এবং একাগ্রতার জন্য সেই সংস্থার অংশীদার হয়েছিলেন। এক সময় তিনি ব্যাঙ্ক অফ নিউজিল্যান্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং বৃটিশ রাজার কাজ থেকে ‘নাইট’ উপাধি লাভ করেন।
জন্মের পর ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড টিনাকরির বাড়িতে বাবা-মা, তিন বোন এবং দুই ফুপুর সঙ্গে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত বসবাস করেন। পরে তারা ওয়েলিংটনের অদূরবর্তী সম্ভ্রান্ত কারোরি এলাকায় চলে যান এবং সেখানে তার একমাত্র ভাইয়ের জন্ম হয়। এই বাড়িতে তার শৈশবের উজ্জ্বল দিনগুলো অতিবাহিত হয়, যা তিনি বহুল আলোচিত ‘দ্য প্রিলিউড’ ছোটগল্পে তুলে ধরেছেন। এছাড়া কারোরির এই বাড়ি এবং স্থানীয় স্কুলকে কেন্দ্র করে তিনি ‘দ্য ডলস্ হাউজ’ ছোটগল্প রচনা করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৮ সালে তার পরিবার নতুন বাড়িতে বসতি স্থাপন করেন। এই নতুন বাড়ির পরিবেশের উপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করে তার অন্যতম বিখ্যাত গল্প ‘দ্য গার্ডেন পার্টি’। তার বাবা ১৯০৬ সালে আরেকটি হলিডে কটেজ ক্রয় করেন। সেখানে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড বেশ ফুরফুরে মেজাজে সময় কাটান এবং গল্প লেখায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। এই হলিডে কটেজকে কেন্দ্র করে তিনি ‘অ্যাট দ্য বে’ গল্প লেখেন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, মাত্র নয় বছর বয়সে স্কুলের ম্যাগাজিনে তার গল্প ‘এনা ব্লেইক’ প্রকাশিত হয়।

ছোট বোন জিয়্যান এবং ভাই লেসলির সঙ্গে ক্যাথারিন ছোটবেলা থেকে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের স্বভাব ছিল অস্থির এবং অগোছালো। পড়াশুনা করার জন্য তিনি ১৯০৩ সালে লন্ডনে গমন করেন এবং কুইন্স কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কোন এক কারণে তিনি ১৯০৬ সালে ওয়েলিংটনে ফিরে আসেন। তবে লন্ডনে থাকার সময় তিনি অনেক গুণীজনের সান্নিধ্য লাভ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বনামধন্য লেখিকা আইডা বেকার। ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ট এবং অটুট। যাহোক, দেশে ফিরে এসে ওয়েলিংটনের একঘেঁয়েমী জীবনের জন্য ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড পরিবার এবং দেশের প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেন। সেই সময় তার বাবা বছরে এক শত পাউন্ড ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি লেখক হওয়ার আশায় পুনরায় লন্ডনে গমন করেন। তবে লন্ডনে যাওয়ার আগে তিনি কিছুদিনের জন্য নিরিবিলি এক জায়গায় ক্যাম্পিং করেন। সেই ক্যাম্প জীবনের অভিজ্ঞতা এবং কাহিনির উপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করেন ‘মিলি’ এবং ‘দ্য ও্যইম্যান অ্যাট দ্য স্টোর’ গল্প।
লন্ডনে ফিরে আসার পর প্রথম বছর ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেননি। সেই হতাশা এবং মানসিক টানাপোড়েনের সময়ে তিনি একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, এমনকি এক সময় গর্ভবতী হন। কিন্তু যার সন্তান তিনি গর্ভে ধারণ করেছিলেন, তাকে বিয়ে না করে বরং নিজের চেয়ে বয়সে অনেক বড় গানের শিক্ষককে বিয়ে করেন। তবে সেই বিয়ে মাত্র কয়েকদিন টিকেছিল। তার জীবনে এসব উথাল-পাথাল ঘটনা মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে ঘটেছিল। মেয়ের এই সব ঘটনা জানতে পেরে ওয়েলিংটন থেকে তার মা তড়িঘড়ি করে লন্ডনের পথে পাড়ি জমান এবং চিকিৎসার জন্য মেয়েকে নিয়ে জার্মানীর ব্যারাভিয়া শহরে যান। সেখানে তার গর্ভপাত ঘটে। ব্যারাভিয়া শহরে অবস্থানের সময় পোলিশ লেখক ফ্লোবিয়ান সোবিয়েনোস্কির সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং তিনি ফ্লোবিয়ানের প্রেমে পড়েন। এই সম্পর্কের সময়ে ক্যাথারিনের লেখা সমস্ত ডাইরী এবং চিঠি খরিদ করে ফ্লোবিয়ান তাকে ব্লেকমেইল করার ফন্দি আঁটে। তখন ক্যাথারিন সবকিছু নষ্ট করে ফেলেন। এসব দগ্ধ দিনের টালমাটাল জীবন কাহিনির উপর ভিত্তি করে তিনি বেশ কিছু বিদ্রুপাত্বক গল্প লেখেন, যেগুলো ‘নিউ এজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এসব গল্প ‘ইন এ জার্মান ক্যাম্প’ ছোটগল্প সংকলনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় একাধিক বৃটিশ লেখক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক এবং চিন্তাবিদের সঙ্গে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের পরিচয় হয়। এদের মধ্যে ডি এইচ লরেন্স, ভার্জিনিয়া উলফ্, জেমস্ জয়েস, বার্ট্রান্ড রাসেল এবং লিটন স্ট্র্যাসি ছিলেন অন্যতম। ভার্জিনিয়া উলফের সঙ্গে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের সম্পর্ক ছিল দুর্বোধ্য এবং অনেক সময় সেই সম্পর্কের মধ্যে ছিল তুমুল উত্তেজনা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ভার্জিনিয়া উলফ্ এবং ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের মধ্যে যেটুকু সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাতে মেশানো ছিল হিংসা-বিদ্বেষ। ভার্জিনিয়া উলফ্ মনে করতেন ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড একজন সস্তা ধরনের লেখক। অন্যদিকে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড ভাবতেন কথাবার্তায় ভার্জিনিয়া উলফ্ চৌকষ এবং আচার-ব্যবহারে একজন রুচিশীল ভদ্রমহিলা। তাদের জীবনধারা ছিল বিপ্রতীপ, যা তাদের সুসম্পর্ক গড়ার জন্য ছিল অন্তরায়। তবে তাদের মধ্যে নিয়মিত দেখা হতো এবং পরস্পরের মধ্যে নিজেদের সাহিত্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। তাদের পরিচয়ের শুরু থেকে ক্যাথারিন ছিলেন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত। আরোগ্য লাভের জন্য তাকে প্রায়ই ইউরোপের বিভিন্ন শহরে থাকতে হয়েছে। এই সাময়িক বিচ্ছেদের সময়ে তাদের যেটুকুই সম্পর্ক ছিল, তাতে ভাটা পড়েনি।
যাহোক, সমালোচকেরা মনে করেন যে, ভার্জিনিয়া উলফের এ ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গত কারণ ছিল। সাহিত্য জগতে তিনি ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডকে প্রতিদ্বন্দ্বী এবং রীতিমত শত্রু ভাবতেন। ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের মৃত্যুর পর ভার্জিনিয়া উলফ্ লিখেছেন, ‘আর লেখার কোন মানে নেই– ক্যাথারিন কোনদিনও পড়বে না। এখন থেকে সে আমার শত্রু নয়।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আমার ধারণা সারাজীবন আমি তাকে স্বপ্নে দেখবো।’ সত্যি ১৯৩১ সালে তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি প্রায়ই ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডকে স্বপ্নে দেখেছেন। অথচ ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড তাকে বলেছিলেন, ‘আপনিই একমাত্র মহিলা যার সঙ্গে আমি দীর্ঘ সময় লেখালেখি নিয়ে আলাপ করতে পারি। আর কোন দ্বিতীয়জন নেই।’ ভার্জিনিয়া উলফের আত্মজীবনীতে লেখক জেমস্ কিং উল্লেখ করেছেন যে, ভার্জিনিয়া উলফের জীবনে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড ছিলেন ছায়ার মতো, যা তাকে লেখার প্রেরণা যুগিয়েছিল। বলা হয়, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের সঙ্গে ভার্জিনিয়া উলফের পরিচয় না হলে হয়তো ভার্জিনিয়া উলফ্ কখনই ‘মিসেস ড্যালোওয়ে’ লিখতে পারতেন না। শুধু ভার্জিনিয়া উলফ্ই নন, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড অনেক সাহিত্যিককে লেখার প্রেরণা দিয়েছেন, এমনকি তার বিভিন্ন গল্পের শব্দ এবং চরিত্র ধার করে অনেকে তাদের লেখায় ব্যবহার করেছেন। এদের মধ্যে অ্যাল্ডার্স হাক্সলী অন্যতম।
এক সময় ‘রিদম’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক জন মিডলটন মারীর সঙ্গে প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। বিয়ের পরে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড কিছুদিন ডি এইচ লরেন্স ও তার স্ত্রী ফ্রিডার পাশের বাড়িতে ভাড়া থেকেছেন। সেই স্বল্প সময়ে প্রতিবেশি হিসেবে তাদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু ডি এইচ লরেন্সের সঙ্গে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাদের সম্পর্ক এমন এক নাজুক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল যে, এক সময় ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডকে এক পোস্টকার্ডে ডি এইচ লরেন্স মৃত্যু কামনা করে লিখেছিলেন, ‘ইউ আর এ লোথসাম রেপটাইল। আই হোপ, ইউ উইল ডাই,’ অর্থাৎ ‘তুমি আত্মমর্যাদাহীন এক জঘন্য সরীসৃপ। আশা করি তোমার মরণ হোক।’ অথচ ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডকে ঘিরে ডি এইচ লরেন্স রচনা করেন তার বিখ্যাত ‘উইম্যান ইন লাভ’ উপন্যাসের ‘গুডরুন’ চরিত্র। ডি এইচ লরেন্সের মতো ফ্রিডাও তাকে দারুণ অপছন্দ করতেন। তবে ফ্রিডা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, অন্যদের তুলনায় ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড সত্যকে খুব ভালো করে জানতো।
ব্যবসায় সফলতা না পেয়ে জীবিকার তাগিদে এবং লেখালেখির জন্য সুন্দর পরিবেশের আশায় ১৯১৪ সালে জন মিডলটন মারী এবং ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গমন করেন। সেখানে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড মাত্র একটি ছোটগল্প (সামথিং চাইল্ডিশ বাট ভেরি ন্যাচারাল) লিখতে পেরেছিলেন। যাহোক, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড ১৯১৭ সালে মরণব্যাধি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। বেঁচে থাকার শত আকুলতা এবং আন্তরিক চেষ্টার পরও মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে ১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারী মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের ফলে ফ্রান্সের ফন্টেনব্লিউ শহরে তিনি দেহত্যাগ করেন। তাকে অ্যাঁভন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের মৃত্যুর পরে স্বামী জন মিডলটন মারী তার অসংখ্য অপ্রকাশিত সাহিত্য রচনা সংশোধন, পরিমার্জন এবং সম্পাদনা করে ১৯২৭ সালে প্রকাশ করেন ‘দ্য জার্নাল অফ ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড’। এছাড়া তার সম্পাদনায় দশ খণ্ডেরও বেশি প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে লেখিকার ব্যক্তিগত লেখা, অসমাপ্ত ছোটগল্প এবং কবিতা, যা জীবদ্দশায় তিনি জনসাধারণের সামনে কখনই প্রকাশ করতে চাননি।
ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের জন্মস্থান এবং জাদুঘর
ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড এবং স্বামী জন মিডলটন মারী আমরা যখন ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের জন্মস্থানে শৈশবের বাড়ি দেখতে যাই, তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টি দেখে হোটেল থেকে একটা ছাতা ধার করে ট্যাক্সিতে চেপে বসি। গন্তব্যের নাম বলতেই ট্যাক্সিচালক খানিকটা ট্যাঁরা চোখে তাকিয়ে ইশারায় আমাদের ভেতরে ঢুকতে বললো। স্বল্প দূরত্বের যাত্রী পেয়ে সে যে খুশি হয়নি, তার চোখমুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি। কেননা আমি আগেই ট্যুরিস্ট ম্যাপে দূরত্ব সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নিয়েছিলাম। যাহোক, মিনিট দশেকের মধ্যে ট্যাক্সিচালক আমাদের সঠিক গন্তব্যে নামিয়ে দেয়।
নিরিবিলি টিনাকরি সড়কের এক পাশে অবস্থিত ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের জন্মস্থান এবং শৈশবের বাড়ি সংসদ ভবন এবং পুরাতন সেইন্ট পল গির্জা থেকে মাত্র দশ মনিটের হাঁটা পথ। বাড়িটি দোতলা, চতুষ্কোণ, কাঠের তৈরি এবং রঙ করা লোহার ছাদ। রাস্তা থেকে বাড়িতে ঢোকার সময় ডান পাশে সবুজ ঘাসের উঠোন এবং পেছনের দিকে সীমানা পর্যন্ত সামান্য ঢালু উঠোন। দোতলা থেকে পেছনের দিকে তাকালে ওয়েলিংটন পোতাশ্রয় দেখা যায়। নিচের তলায় খাবার ঘরের চারপাশের দেওয়ালে চতুষ্কোণ কাঁচের জানালা– একটা হলুদ, একটা নীল এবং এভাবেই সাজানো। ‘দ্য প্রিলিউড’ গল্পে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড এই রঙিন জানালার কথা উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল এসোসিয়েশন এই বাড়িটিকে পুরাকৃতির নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায় বাড়িটির আসল মালিক ছিলেন স্যার চার্লস্ ক্লিফোর্ড। তিনি ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের বাবা হ্যারল্ড ম্যান্সফিল্ডের জন্য বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। সেই সময় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যাঙ্কিং খাতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে হ্যারল্ড ম্যান্সফিল্ডকে বাড়িটি প্রদান করা হয়েছিল। বর্তমানে এই বাড়িটি ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড জাদুঘর। বাড়িটির মূল কাঠামো অক্ষত রেখে আধুনিক সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি-কৌশল প্রয়োগ করে এমনভাবে পুনঃসংস্কার এবং পুনঃস্থাপন করা হয়েছে যে, সেই আমলের বিউকম পরিবারের ঐতিহ্য, আভিজাত্য এবং যুগের পরিবর্তনের কোন তারতম্য হয়নি। উল্লেখ্য, এই জাদুঘর হচ্ছে কোন বিখ্যাত মহিলাকে কেন্দ্র করে নিউজিল্যান্ডের প্রথম জাদুঘর। ১৯৮৭ সালে গঠিত ‘ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড বার্থপ্লেস সোসাইটি’ সরকারী অনুদান এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহ দিয়ে বাড়িটি খরিদ করে। অবশেষে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের এক শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১৯৮৮ সালের ১৪ অক্টোবর জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরী ভাষায় এই জাদুঘরের নাম ‘টি পুয়াকিট্যাংগা’, যা বাংলায় তরজমা করলে দাঁড়ায় ‘গল্প কথকের প্রথম আবাস’।
জাদুঘরের অভ্যন্তরে ঢোকার একপাশে টিকেট কাউন্টার এবং অফিস। কাউন্টারের ভেতর একজন মহিলা। এই মহিলার কাজ হলো টিকেট বিক্রি করা এবং বিনামূল্যে তথ্যবহুল পুস্তকাদি সরবরাহ করা। যেহেতু ভীড় কম, তাই তাকে গাইড হিসেবে নেওয়া যায়। আমরা সেই সুযোগ হারাইনি। আমাদের সঙ্গে মহিলা একতলা এবং দোতলার প্রতিটি কক্ষে ঢুকে বিভিন্ন প্রদর্শিত জিনিসের ইতিহাস বর্ণনা করেন।
ফ্রান্সের অ্যাঁভন কবরস্থানে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের সমাধি সোমবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছয় দিন পর্যটক এবং উৎসাহী দর্শকদের জন্য খোলা থাকে, সকল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। ‘ক্যাথারিন ম্যানসফিল্ড বার্থপ্লেস সোসাইটি’ সদস্যদের জন্য কোন প্রবেশ মূল্য লাগে না, কিন্তু পর্যটক এবং ভ্রমণ পিপাসুদের নামমাত্র খরচে টিকেট কিনতে হয়। যথারীতি আমরা টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করি। ঢোকার সময় নিচের তলায় বাম পাশে সাজানো-গুছানো মন হরণ করা একটা স্যুভেনির শপ্ আছে। সেখানে ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের বিভিন্ন গল্পের বই, তার জীবনী গ্রন্থ, ছবি, কার্ড, পোস্টকার্ড, বুক মার্ক, সিডি, টি-শার্ট এবং অন্য জিনিসপত্র পাওয়া যায়। বিভিন্ন সাইজের এবং রঙের টি-শার্টে তার বিভিন্ন গল্পের বিখ্যাত উক্তি কিংবা পঙক্তি লেখা আছে। পর্যটক এবং উৎসাহী দর্শকদের জন্য একটা ঘরে ফায়ার প্লেস সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, একটা কক্ষে টেবিলের ওপর ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ডের ব্যবহৃত টাইপরাইটার এখনো তার স্মৃতি বহন করে চলেছে।
ফেরার পথে ভাবনা
সবকিছুরই শেষ আছে। তাই আমাদের ফেরায় সময়ও ঘনিয়ে আসে। বৃষ্টি ভেজা নির্জন রাস্তায় ট্যাক্সি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ ভেবে একটা ট্যাক্সি ডেকে দেওয়ার জন্য কাউন্টারের মহিলাকে বিনীতভাবে অনুরোধ করি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্যাক্সি এসে হাজির। এই কয়েক মিনিটের ফাঁকে আমরা বাড়ির সামনের এবং পেছনের ছবি তুলি। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু চারপাশে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ার লুটোপুটি।
ট্যাক্সিতে বসার পরপরই বিভিন্ন সাইজের একপাল ভাবনা-চিন্তা কোন আগাম সংবাদ না দিয়ে কানের ফুটো গলিয়ে হুড়মুড় করে মাথার মগজে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তে আমি কিছুটা আনমনা হয়ে পড়ি। ভাবতে থাকি দেশের কথা। আমাদের দেশে হাতে গোণা অল্প কয়েকজন সাহিত্যিক এবং চিত্রশিল্পী ছাড়া বাদবাকি কবি-সাহিত্যিক এবং শিল্পীদের বসতবাড়ি অনাদরে এবং অবহেলায় পড়ে আছে। সেই সব বাড়িঘর পুনর্বাসন তো দূরের কথা, বরং বেদখলে চলে যাচ্ছে বা ইতিমধ্যে গেছে। সহৃদয় ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে এবং সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ও ক্ষমতা প্রয়োগে হয়তো অনেক বিখ্যাতদের জন্মভিটার বাড়িঘর পুনরুদ্ধার করে সংরক্ষণ করা সম্ভব। হঠাৎ মনের মধ্যে জিয়ল মাছের মতো একটা অমর বাণী মনে পড়ে। তবে কার বাণী, এ মুহূর্তে স্মরণে নেই। বাণীটা হলো: ‘যে জাতি ঐতিহ্য ধারণ করতে পারে না, তার উন্নতিও নেই।’
এক সময় মনের অজান্তে বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। উদাস মনে আমি জানালার বাইরে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বাইরে বৃষ্টি ভেজা রাস্তা-ঘাট, চলমান গাড়ি, দালানকোঠা, পথচারী ক্রমশ আমার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে।

...............................................................

ঈদ সংখ্যার সূচিপত্র দেখতে ক্লিক করুন :

বাংলা ট্রিবিউন ঈদ সংখ্যা ২০১৬

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গলা থেকে বরশি খুলে নিয়েছেন, কথা বলতে চেষ্টা করবো: সংসদে লতিফ সিদ্দিকী
গলা থেকে বরশি খুলে নিয়েছেন, কথা বলতে চেষ্টা করবো: সংসদে লতিফ সিদ্দিকী
কামরাঙ্গীরচর থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না: মেয়র তাপস
কামরাঙ্গীরচর থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না: মেয়র তাপস
সৌদি আরবের সড়কে আহত প্রবাসীর হাসপাতালে মৃত্যু
সৌদি আরবের সড়কে আহত প্রবাসীর হাসপাতালে মৃত্যু
সরিষাবাড়ীতে চেয়ারম্যান পদে রফিকুল ইসলামের প্রার্থিতা বাতিল
সরিষাবাড়ীতে চেয়ারম্যান পদে রফিকুল ইসলামের প্রার্থিতা বাতিল
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিতের দাবি ইউক্রেনের
রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিতের দাবি ইউক্রেনের