X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা কবিতার বাঘিনীরা || পর্ব-এক

শেলী নাজ
১৩ জুলাই ২০১৬, ১৪:৪৪আপডেট : ১৩ জুলাই ২০১৬, ১৫:৪২


বাংলা কবিতার বাঘিনীরা || পর্ব-এক ছিদ্রান্বেষী পুরুষ সাহিত্যিক ও কবিগণ নারী রচিত কবিতা ও সাহিত্যকে দেখেছেন পুরুষের চোখে, ফলে নারীর লেখা বইয়ের বিশ্লেষণ বা ব্যবচ্ছেদ লিঙ্গনিরপেক্ষ না হয়ে তা হয়ে উঠেছে লৈঙ্গিক রাজনীতির শিকার। মেরি এলমান তার ‘থিংকিং অ্যাবাউট উইমেন : নারীদের সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা (১৯৬৮)’ গ্রন্থে যাকে অভিহিত করেছেন ‘ফ্যালিক ক্রিটিসিজম’ বা ‘শৈশ্নিক সমালোচনা’ হিসেবে। তাঁর মতে পুরুষ সমালোচকের কাছে নারীর লেখা বইও নারী, সম্ভোগের সামগ্রী; ওই বই সমালোচনার নামে তারা মাপামাপি করেন বইয়ের বক্ষ ও নিতম্ব


পুরুষের বিশ্বে কবিতা কি লিঙ্গ দ্বারা বিভাজিত? কবিতা কি পিতৃতান্ত্রিক নন্দনতত্ত্বের অলঙ্কার ও ভূষণে উপস্থাপিত এমন এক শিল্প যেখানে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে নারীর জন্য নির্ধারিত পুংলিঙ্গের প্রিয় শব্দাবলী? নিম্নলিঙ্গ নারীর কবিতাও কি নিম্নলিঙ্গ কবিতা? বাংলা কবিতায় পুরুষ জাগরণ নিয়ে কেউ ভাবিত নয়, ভাবিত নারী জাগরণ নিয়ে? তার কারণ কি এই যে, পুরুষ চিরকাল জাগ্রতই ছিল তাই প্রশ্ন আসছে নারীকে তথা নারীর কবিতাকে জাগানোর, যা আজ অব্দি সুপ্ত রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক গুহায়! তাহলে নারী কি? সিমন দ্য বোভোয়ার তার ‘দ্বিতীয় লিঙ্গে’ আমাদের জানাচ্ছেন, এক ধরনের পুরুষ বলে ‘নারী হচ্ছে গর্ভ।’ লিঙ্গবাাদী চেতনার ধারক ও বাহক পুরুষ সবসময় প্রমাণ করতে চেয়েছে, নারী পুরুষের পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত এক মেধাহীন গর্ত, ছিদ্রময় একতাল মাংসপিণ্ড, যা কেবল ধারণ করতে পারে পুং-পৃথিবীর বীর্য ও বর্জ্য। নারী এক বীর্যব্যাংক।

এই ছিদ্রময় প্রাণিটি তার ছোট্ট ছিদ্রপথে পৃথিবীর সেরা, বাঘা-বাঘা বীরপুঙ্গব সাহিত্যিক ও কবিদের জন্ম দিলেও আজ পর্যন্ত পুরুষের চোখে সে নিজে হয়ে উঠতে পারেনি ছোট মাপের কোনো কবি বা সাহিত্যিক। দৌর্দণ্ডপ্রতাপ পুরুষের বিশ্বে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত প্রাণি নারী যখন কবিতা লিখে, সাহিত্য রচনা করে, হায় দুঃখজনকভাবে তাও হয়ে ওঠে শোচনীয়রূপে মেয়েলি, কামোদ্রেককারী শব্দপুঞ্জের সমাহার, হয়ে ওঠে কামাধার। আজন্ম বুভুক্ষুু, দ্বিপদী পুরুষ এর ভেতরে খোঁজে নিতম্বের উদ্ভাস, স্তনের গরিমা, নারী নামক এক অনাস্বাদিত মাংসল পৃথিবীর রহস্য উদ্যানের ফল পেকে ওঠার সুষমা। নারী চির মায়াবনবিহারিণী হরিণী, বাঘিনী নয়, নারী কি করে কবিতার মতো মহৎ দুরূহ শিল্পের স্রষ্টা হতে পারে! কেননা নারী নিজেই এক কবিতা, পুরুষ যাকে ছুঁয়ে, ছেনে, ভোগ ও উপভোগের বস্তু হিসেবে পরীক্ষা ও নীরিক্ষা করে, পুরুষতান্ত্রিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট করে তার ভেতর থেকে বের করে আনে সেই নির্যাস যা পান করে তারা হয়ে ওঠে কবি! নারীকে কেন্দ্র করে এমন কি নারীর সাহিত্যকে কেন্দ্র করেও পুরুষের তাবৎ চিন্তা চিরকালই থেকেছে নারীর দেহকারাগারেই বন্দি, দেহের সীমা ছাড়িয়ে নারীর ভাবপৃথিবীর সিংহদরজায় তা কখনই পৌঁছাতে পারেনি।

দেরিদা কলমকে শিশ্নের সাথে আর যোনিচ্ছদকে কাগজের সাথে অভিন্ন করে দেখেছেন। কলম-শিশ্ন লিখে চলে কুমারী পৃষ্ঠার ওপর, এ বোধের ঐতিহ্য বেশ দীর্ঘ। এ বোধ অনুসারে লেখক পুরুষ ও প্রধান : নারী তার অক্রিয় সৃষ্টি। শেক্সপিয়রের ওথেলো দেসদিমোনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে : এই শুভ্র কাগজ, এই উৎকৃষ্টতম বইটি কি তৈরি হয়েছিল এতে ‘বেশ্যা’ লেখার জন্য?’ নারী লেখে না, লিখিত হয়, নারী কবিতাকল্পনালতা; নারী আঁকে না, অঙ্কিত হয়; নারী ভাস্কর হয় না, ভাস্কর্য হয়। নারীর লেখা বড়জোর গর্ভনিসৃত অশুদ্ধ রক্তধারা অথবা এক তুলতুলে, নরোম গর্ভফুল, যেন নারী লিখে মস্তিষ্ক দিয়ে নয়, গর্ভ দিয়ে! যেন তার শিল্পসৃষ্টির কারখানা তার জরায়ু। তবু মহৎ সাহিত্যরাজ্যে ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরি’ এই নিয়তি আত্মধ্বংসী বোমার মতো শরীরে নিয়ে যারা যারা পাড়ি দিয়েছিল গভীর পুরুষালী জঙ্গল...তাদের বলা হয়েছে ‘পেটিকোট পরা হায়েনা’। কেননা ছিদ্রান্বেষী পুরুষ সাহিত্যিক ও কবিগণ নারী রচিত কবিতা ও সাহিত্যকে দেখেছেন পুরুষের চোখে, ফলে নারীর লেখা বইয়ের বিশ্লেষণ বা ব্যবচ্ছেদ লিঙ্গনিরপেক্ষ না হয়ে তা হয়ে উঠেছে লৈঙ্গিক রাজনীতির শিকার। মেরি এলমান তার ‘থিংকিং অ্যাবাউট উইমেন : নারীদের সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা (১৯৬৮)’ গ্রন্থে যাকে অভিহিত করেছেন ‘ফ্যালিক ক্রিটিসিজম’ বা ‘শৈশ্নিক সমালোচনা’ হিসেবে। তাঁর মতে পুরুষ সমালোচকের কাছে নারীর লেখা বইও নারী, সম্ভোগের সামগ্রী; ওই বই সমালোচনার নামে তারা মাপামাপি করেন বইয়ের বক্ষ ও নিতম্ব। সবসময়ই নারীর জন্য বৈরি, প্রতারণাপূর্ণ ও খল ছিল সাহিত্যের প্রতিবেশ, বাংলা কবিতার ইতিহাসও পুরুষাধিপাত্যবাদেরই ইতিহাস, তবু এরই মধ্যে জন্মেছিল কতিপয় বাঘিনী!

ড. সুনীতিকুমার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এ পদকর্তার লিঙ্গ বিষয়ে। তাঁর মতে এটি কখনই পুরুষের কলম যা শিশ্নের প্রতীক তা থেকে সৃষ্ট নয়, নারীর কলম (অথবা জরায়ু বা গর্ভ বা ছিদ্র) থেকে সৃষ্ট আবর্জনা

কুক্কুরীপা, কৃষ্ণরাত্রির প্রথম জাগ্রত দীপশিখা

দিবসহি বহূড়ি কাউহি ডর ভাই।

রাতি ভইলে কামরু জাই।।
আধুনিক বাংলা : ‘দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয়/ (কিন্তু) রাত হলেই সে কামরূপ যায়।’
(কুক্কুরীপা, চর্যার ২ নং পদ)
চর্যার প্রধান কবিগণ হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ। খুব গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা না হলেও চর্যার আরও একজন কবি ছিলেন, যার নাম কুক্কুরীপা। ওপরে উদ্ধৃত পদটি চর্যাপদের দ্বিতীয় পদ, কুক্কুরীপা রচিত। তিনি নারী না পুরুষ এ বিষয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। বিস্মিত হই যখন ইতিহাসবিদরা বলেন, ‘তিনি নারী এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই’- প্রশ্ন জাগে যদি চর্যার অন্য কবিগণ যে নারী নন, পুরুষ, এ বিষয়ে তাদের কোনো প্রমাণ হাজির করতে না হয় তাহলে শুধু কুক্কুরীপাকেই কেনো প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নারী? তাঁর লেখা ‘মহামায়া সাধন’ নামে সংস্কৃত ভাষায় একটি গ্রন্থ পাওয়া গেছে। চর্যাপদের ২ ও ২০ নং পদ কুক্কুরীপা রচিত এবং খুঁজে না পাওয়া ৪৮ নং পদটিও তার রচিত বলে ধরা হয়। এই গ্রন্থ ও পদযুগলের ভাষা বিশ্লেষণ করে, ভাষায় মেয়েলি সংকোচ প্রকট দেখে অনুমান করা হয় তিনি নারীই ছিলেন।
ভাষারও লিঙ্গ রয়েছে। আবশ্যিকভাবেই রয়েছে, আর তা আবিষ্কার করেছেন আমাদের মহান ভাষাবিদগণ। চর্যাপদের কবিদের মধ্যে তাঁরা শুধু একজন কবিকেই খুঁজে পান যার সৃষ্ট পদ ঘেঁটে আবিষ্কার করতে পারেন পদযুগল ‘গ্রাম্য ও ইতর’ ভাষার। তাই ড. সুনীতিকুমার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এ পদকর্তার লিঙ্গ বিষয়ে। তাঁর মতে এটি কখনই পুরুষের কলম যা শিশ্নের প্রতীক তা থেকে সৃষ্ট নয়, নারীর কলম (অথবা জরায়ু বা গর্ভ বা ছিদ্র) থেকে সৃষ্ট আবর্জনা। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে জাজ্জ্বল্যমান এই আদি শিখা সন্দেহ নেই গ্রাম্য ও ইতর ভাষা নিয়ে জ্বলে উঠেছিল রাত্রিতে, দিবসে কাকভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকলেও, আর তাই সে জ্বেলে দিতে পেরেছিল তার বোধের, কামনার, বাসনার সলতে যা নিশ্চিতভাবেই প্রথা ও ট্যাবুর অন্ধকার কোণে নারী কবির স্বতন্ত্র অস্তিত্বের উজ্জ্বল শিখা।
নারী কখনই ছিল না আত্মপ্রবঞ্চক এবং অজাগ্রত, যদিও সমাজ চেয়েছে সে শিখুক আত্মপ্রবঞ্চনা, ভান, ছলনা ও রহস্যমেদুর হাসি। পুংলিঙ্গের পীড়নে বা আদরে নারী গর্ভবতী হয়ে, ফুলে-ফেঁপে যেমন কিম্ভুতকিমাকার ধারণ করে তেমনি নারীর কবিতাও আরোপিত আকারে বেড়ে ওঠে। মালার্মের ভাষায়, ‘আত্মার একটি অবস্থার নাম কবিতা।’ নারীর ক্ষেত্রে তার আত্মার জরায়ু অথবা বোধের গর্ভ যে বীজ ও বিষে স্ফীত হয় তার নাম পুংলিঙ্গবাদী সমাজ। ফলে তার কবিতায় ফিরে ফিরে আসে পুরুষভীতি তথা সমাজপতিদের রক্তচক্ষুর শাসনের নিচে শোষিত মন ও মাংসের আর্তনাদ। তার প্রেম পল্লবিত হতে হতে মরে যায় কিন্তু তার কাম ও শরীর একঝাঁক রঙিন ময়ূর হয়ে জেগে থাকে। সান্ড্রা গিলবার্ট ও সুজান গুবারের ‘দ্য ম্যাড ওমেন ইন দ্যা এটিক : চিলেকোঠার পাগলী(১৯৭৯)’ গ্রন্থে শনাক্ত বরা হয় নারী ঐতিহ্যের পৃথক ধারা। দেখানো হয় নারীর লিঙ্গ নয়, সমাজই স্থির করে দেয় নারীর বিশ্বসৃষ্টি ও সাহিত্যে তাঁর উপস্থাপন। এ ক্ষেত্রে কুক্কুরীপা এক ভিন্ন কন্ঠস্বর, তার রচিত চর্যাপদের দ্বিতীয় পদে যে বউটির কথা বলা হয়েছে সে আত্মপ্রবঞ্চনাকারী নয়, রাত হলে সে কামরূপ যায়। নারীর পদে নির্লজ্জ কামনা প্রকাশ পেয়েছে বলেই কি পুরুষ ভাষাবিদ ও ক্রিটিকের কাছে তা ‘গ্রাম্য ও ইতর’ শ্রেণির? নতুন করে তা বিশ্লেষণ করা জরুরি।

পুরুষতন্ত্র নারীর জন্য প্রেমকে মহান করে তুললেও উত্তেজনা ফুরালে পুরুষের কাছে প্রেমিকা দাসী হয়ে ওঠে! আর এই মন্দিরের সেবাদাসী রজকিনির অনির্ণেয় স্থানটি কোথায় বাংলা সাহিত্যে, কবিতায়? কবির আসন থেকে উৎখাত হয়ে তিনি চণ্ডীদাসের প্রেমিকার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।

বাঘিনীদের শিরোমণি, কবি রামমণি

বাংলা সাহিত্যে চণ্ডদাসের অভাব নেই। আমাদের রয়েছে বহু বহু চণ্ডীদাস, বড়ু, দ্বিজ, দীন, এদের ভীড়ে রজকিনী আছে একজনই। তিনি রজকিনী রামী বা রামমণি। বাংলা সাহিত্যে প্রথম নারী কবি কে? এ প্রশ্নের উত্তরে চন্দ্রাবতীর নাম উচ্চারিত হয়েছে সবসময়ই হয়ত এজন্য যে, তার অনেক কাজ প্রমাণিক হিসেবে আমাদের হাতে রয়েছে। রামী রয়েছেন আমাদের ঔদাসিন্যের ভেতর, আমাদের জ্ঞানের আড়ালে। কবি রামীকে আমরা চিনি না, চিনি ধোপানি রামীকে, চণ্ডীদাসের প্রেমিকা রজকিনি হিসেবে। তিনি ছিলেন মূলত কবি কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাস তাঁকে করে তুলেছে শুধুমাত্র প্রেমিকা, দয়িতা। কবি হিসেবে সে পূজনীয় নয়, প্রেমিকারূপে সে এক পূজারিণী। বলাবাহুল্য, নারীর জন্য প্রেম এক আস্তাকুড়, পুরুষের দুনিয়ায়, যেখানে নারীর মেধা, মন, মাংস, প্রতিভা, সমুদয় অনুভূতি কেন্দ্রীভূত হয়ে পচে গলে নিঃশেষিত হয়। পুরুষতন্ত্র নারীর জন্য প্রেমকে মহান করে তুললেও উত্তেজনা ফুরালে পুরুষের কাছে প্রেমিকা দাসী হয়ে ওঠে! আর এই মন্দিরের সেবাদাসী রজকিনির অনির্ণেয় স্থানটি কোথায় বাংলা সাহিত্যে, কবিতায়? কবির আসন থেকে উৎখাত হয়ে তিনি চণ্ডীদাসের প্রেমিকার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।

পিতার মৃত্যুর পর চণ্ডীদাস বাশুলী দেবীর পূজক নিযুক্ত হয়েছিলেন। দেবী মন্দিরে পূজা শেষে তিনি ভোগ রাঁধতেন এবং গ্রামের প্রান্তভাগে এক নির্জন স্থানে পর্ণকুটিরে থেকে ভজন করতেন। একই গ্রামের বাসিন্দা রামমণি শৈশবে আহার অন্বেষণে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন দেখে গ্রামের মানুষ তাঁকে বাশুলী দেবীর মন্দিরে সেবিকা নিযুক্ত করে। মন্দিরে দেবীর প্রসাদান্নে তার শরীর শশীকলার মতো বিকশিত হতে থাকল আর অনিবার্যভাবে তার হৃদয় চণ্ডীদাসের প্রেমের প্রসাদে হয়ে উঠল পরিপূর্ণ। এ ছিল এক আশ্চর্য নিষ্কাম প্রেম। রামী কবি, তবু তিনি পারেননি পুরুষ নির্ধারিত নরীনিয়তির সীমা অতিক্রম করতে, সনাতনী নারীর মতো তাঁর দেহ হয়ে উঠল তাঁর শেকল। অদৃশ্য এই শেকলের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে শুদ্ধমতি রামী মনে মনে দেহ সঁপেছেন চণ্ডীদাসকে আর বাস্তব দুনিয়ার নিষ্কাম প্রেমিকা নিজের শরীর পোড়ানো আগুনকে অবদমন করে দেবীপ্রেমের আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। তবু কামগন্ধহীন অশরীরী প্রেমের কলঙ্ককাহিনী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল, এর শাস্তি তাঁকে মাথা পেতে নিতে হয়েছে, তিনি প্রসাদান্নে বঞ্চিত হলেন, চণ্ডীদাস হলেন সমাজচ্যুত। কলঙ্ক ও চন্দন শরীরে মেখে রামী লিখলেন...

কি কহিব বঁধু হে বলিতে না জুয়ায়
কাঁদিয়া কহিতে পোড়ামুখে হাসি পায়
অনামুখ মিনসেগুলোর কিবা বুকের পাটা
দেবীপূজা বন্ধ করে কুলে দেয় কাঁটা
দুঃখের কথা কইতে গেলে প্রাণ কাঁদি ওঠে
মুখ ফুটে না বলতে পারি মরি বুক ফেটে
ঢাক পিটিয়ে সহজবাদ গ্রামে গ্রামে দেয় হে
চক্ষে না দেখিয়ে মিছে কলঙ্ক রটায় হে
..........................................
আপনার নাক কাটি পরে বলে বোঁচা
সে ভয় করে না রামী নিজে আছে সাঁচা

‘অনামুখ মিনসে’ বলে যারা কলঙ্ক রটিয়েছে তাদে ভর্ৎসনা করতে পিছপা হন না তিনি, যদিও চিরকালীন নারীর মতো মুখ ফুটে বলতে না পেরে বুক ফেটে মরার কথা উল্লেখ করেছেন। এতে প্রকাশ পেয়েছে নারীর সেই ভাবমূর্তি, যা ভঙ্গুর, অধীন, পরাজিত। নারীর এই মিথ্যে মর্মরমূর্তির ভেতর প্রাচীন, মধ্য বা আধুনিক সব যুগেই ক্রন্দন করেছে তার বুক ফাটা অপ্রকাশ্য অনুভূতিগুলি। কখনও সামান্য ফাটল পেলে যা আবার উৎসারিত হয়েছে ক্রোধান্বিত অগ্নি ঝর্ণারূপে, একই কলম তখন লিখতে পারে ‘অবিচারী পুরী দেশে আর না রহিব, যে দেশে পাষণ্ড নাই সে দেশে যাব’। নারী ভাবমূর্তির এ স্বরূপ পুরুষ সৃষ্ট, পুরুষের লিঙ্গবাদী চেতনা প্রকাশ পেয়েছে নারীর কলমে। রামীও ব্যতিক্রম নন। যদিও শেষ লাইনে ‘সে ভয় করে না রামী, নিজে আছে সাঁচা’ বলে নির্ভীক এক সত্ত্বাকে আবিষ্কার করেছেন তার ভঙ্গুর মূর্তির ভেতর।

রামী রচিত চণ্ডীদাসের মৃত্যু বিষয়ক একটি শোকগীতিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্বন্ধে প্রায় দুইশত বৎসরের প্রাচীন হস্তলিপি সম্বলিত একটি প্রমাণ বসন্তবাবু আবিষ্কার করেছেন। এ গীতিকা থেকে জানা যায়, গৌড়ের নবাবের রাজসভায় গান গাইতে গিয়ে বহুচারী পলাতক পুরুষের মতো চণ্ডীদাসও সেবাদাসী রামীর প্রেমের শেকল ছিন্ন করে পুনঃপ্রেমে পড়েন বেগমের। পুরস্কারস্বরূপ পান মৃত্যুদণ্ড, সহ্য করতে না পেরে বেগম মূর্চ্ছা যান চিরদিনের জন্য। প্রেমে প্রতারিত রামী নৈর্ব্যক্তিক সাধারণ নারীর আবরণ ভেদ করে হয়ে ওঠেন সৃজনশীল ব্যক্তি, তিনি তখন আর নারী নন, তিনি কবি, শোকে মূহ্যমান, শোকে শোভিত ও জাগ্রত। আসুন, পড়া যাক তার অপূর্ব শোক গীতিকা-

কোঁথা যাও ওহে, প্রাণ বঁধু মোর, দাসীরে উপেক্ষা করি।
না দেখিয়া মুখ, ফাটে মোর বুক ধৈরয ধরিতে নারি।।
বাল্যকাল হতে, এ দেহ সঁপিনু, মনে আন নাহি জানি।
কি দোষ পাইয়া, মথুরা যাইবে, বল হে সে কথা শুনি।।
তোমার এ সারথি, ক্রুর অতিশয়, বোধ বিচার নাই।
বোধ থাকিলে, দুঃখ সিন্ধু-নীরে, অবলা ভাসাইতে নাই।।
পিরীতি জ্বালিয়া, যদি বা যাইবা, কবে বা আসিবা নাথ।
রামীর বচন, করহ শ্রবণ, দাসীরে করহ সাথ।।

উদ্ধৃত চরণসমূহের সীমাহীন আহাজারি নারীর অসহায়ত্বকে প্রকাশ করে, আদি অন্তহীন শূন্যতার ভেতরে ‘কোঁথা যাও ওহে, প্রাণ বঁধু মোর, দাসীরে উপেক্ষা করি’ এই বাক্য তার নিয়তিকে কষাঘাত করে। আমরা জানতে পারি নারী উন্মূল, পরিত্যাক্ত, পুরুষ তাকে ছেড়ে চিরকাল অন্য নারীতে ধাবমান। ‘তুমি দিবাভাগে লীলা অনুরাগে, ভ্রম সদা বনে বনে’-এক নারীমণ্ডল ছেড়ে আরেক নারীমণ্ডলে ভ্রমণের কালে পুরুষ পায় সৌরজগতের বহুবর্ণিল আলোর মধ্যে নিজেকে মুক্ত করার স্বাদ, আর যুগপৎভাবে নারী সেই এক ও নির্দিষ্ট পুরুষটিকে বিনা জগৎকে দেখে আঁধার। কবি রামীর আর্তনাদ-

তুমি সে আমার, আমি সে তোমার, সুহৃৎ কে আছে আর
কেঁদে রামী কয়, চণ্ডীদাস বিনা জগৎ দেখি আঁধার

চতুর্দশ শতকের রামীর কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে অভাগী, অবলা, অনাথ শব্দসমূহ, অশ্রু ও রুধিরে রঞ্জিত পঙক্তিসমূহে বর্ণিত হয়েছে নারীর চিরায়ত ভাগ্যলিপি যা তাকে দাসী করে তুলেছে-
১. বৈরি কাটে তোমা গায়
তুমি সে আনন্দ বাস তায়
মোর অঙ্গ সব দ্যেতি হেল
রুধিরে বসন ভিজিয়া গেল
২. আমার বচন না শোনে রাজন
বুঝিল কৃষ্ণের লীলা
মুগ্ধ কলেবর, হইল জর্জর
দারুণ সঞ্জান হাতে
এ দুঙ্ঘ দেখিয়া, বিদরএ হিয়া
অভাগীরে লেহ সাথে
৩. তুমি অবলার বচন রাখ
রসিক মণ্ডল দেখ
৪. আমি অনাথিনী নারী, মাধবির ভালে ধরি
উচ্চস্বরে ডাকি প্রাণনাথ
হস্তি চলে অতি জোরে, ভালস্তে না দেখি তোরে
মাথা এ পড়িল বাজ

বাংলা কবিতায় নারীরা দীর্ঘ অন্ধকার রচনা করেছিল মূলত যা ছিল পুরুষশাসিত সমসমাজেরই অন্ধকার, নারীরা পুরুষ্ট অমাবস্যা পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোরের বিষাণে পৌঁছে গেছে। তার আগে অভাগীদের সম্মিলিত অন্ধকার ভিজে গেছে অশ্রু ও রুধিরে!

প্রত্যাখ্যাত, প্রতারিত চন্দ্রাবতী রামায়ণ নামে আসলে লিখেছেন দুখিনী সীতারই কাহিনি, যাতে বীররস নেই, আছে করুণ রস। তার শাণিত কলম অপমানিত ঊষর ভূমি খুঁড়ে জাগিয়ে তুলেছিল নারীর প্রজ্ঞা ও বোধনের অকৃত্রিম অনুভূতিসমূহ, জাগ্রত হয়েছিল এমন এক সীতাকাহিনি যা রামের চরিত্রকে ম্লান ও ম্রিয়মাণ করে তুলেছিল। এই সীতা ভিন্ন বাল্মিকী বা কৃত্তিবাসের সীতার চেয়ে

প্রেমে পীড়িত ও সাহিত্যে উপেক্ষিত কবি চন্দ্রাবতী

চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের এক ট্রাজিক নায়িকা, যিনি জন্মেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের মতে ১৫৫০ সালে , খরস্রোতা ফুলেশ্বরী নদীর তীরে কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে। এক বিদ্যুৎশিখা, বিস্ময়কর কবি প্রতিভা নিয়ে জ্বলে উঠেছিল একাই সহস্র শিখা হয়ে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে। মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা ও পণ্ডিত দ্বিজ বংশীদাস আর সুলোচনার কন্যা চন্দ্রাবতীর জন্মকথা শ্রী নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতীর পালা’য় বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

খরস্রোতা ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়
ভট্টাচার্য ঘরে জন্ম অঞ্জনা ঘরনী
বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনি

চন্দ্রাবতীর হাতে রচিত হয়েছে ‘মৈমনসিংহ গীতিকার’ উজ্জ্বল চরিত্র মালুয়ার কাহিনি ‘মালুয়া পালা’, ‘কেনারামের পালা’ এবং রামায়ণ। নয়ান চাঁদের ‘চন্দ্রবতীর পালা’ থেকে আরও জানা যায় বাল্যসখা জয়ানন্দের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর অপূর্ণ প্রেম ও প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে, যা চন্দ্রাবতী নামের এই বাঘিনীর জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিল, তার তেজ ও গরিমাকে সাময়িক স্তব্ধতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন শিবপূজায়। প্রেমে ব্যর্থ এই পুজারিণীকে আমরা বাঘিনীরূপেই পাই তার অনবদ্য সৃষ্টি রামায়ণে, যেখানে বীরপুঙ্গব রামায়ণকে তিনি প্রায় বধ করেছেন তার কলমের আঘাতে! যা প্রকারান্তরে ‘সীতায়ন’। নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ পিতৃতন্ত্রের মূলে এক আশ্চর্য কুঠারাঘাত যেখানে সীতাই হয়ে উঠেছে প্রধান চরিত্র। পাতক পুরুষের বীররসে বিরক্ত চন্দ্রাবতী রামের বীরত্বগাঁথার চেয়ে সীতার দুঃখগাঁথাকে বড় করে তুলেছেন। রামায়ণের সীতার বারমাসী থেকে উদ্ধৃত করছি...

১. কি করিবে রাজ্যসুখ গো রাজ সিংহাসনে
শত রাজ্যপাট আমার গো সীতার প্রভুর চরণে
ভোরেতে উঠিয়া মালা গো গাঁথি বনফুলে
আনন্দে পরাই মালা গো প্রভু রামের গলে
২. মরণে বাসনা নাই গো চরণ পাইবার আশে
সীতার চক্ষের জলে গো অশোক-বন ভাসে
৩. মেঘে তত নাইকো পানি সীতার চক্ষে যত জল
কান্দিয়া ভিজাই আমি গো অশোকের তল
৪. সীতার বারমাসী কথা গো দুঃখের ভরতী
বারমাসের দুঃখের কথা গো ভনে চন্দ্রাবতী

প্রত্যাখ্যাত, প্রতারিত চন্দ্রাবতী রামায়ণ নামে আসলে লিখেছেন দুখিনী সীতারই কাহিনি, যাতে বীররস নেই, আছে করুণ রস। তার শাণিত কলম অপমানিত ঊষর ভূমি খুঁড়ে জাগিয়ে তুলেছিল নারীর প্রজ্ঞা ও বোধনের অকৃত্রিম অনুভূতিসমূহ, জাগ্রত হয়েছিল এমন এক সীতাকাহিনি যা রামের চরিত্রকে ম্লান ও ম্রিয়মাণ করে তুলেছিল। এই সীতা ভিন্ন বাল্মিকী বা কৃত্তিবাসের সীতার চেয়ে। চন্দ্রাবতী তার পূর্ববর্তী কবি রামীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিজেকে অভাগী হিসেবে দাঁড় করাননি নিজের বাস্তব জীবনাখ্যানের নায়ক জয়ানন্দের কাছে বরং জয়ানন্দ ফিরে এলে মন্দির দ্বার খোলেননি তিনি। র্ব্যথ-মনোরথ জয়ানন্দ, লাল রঙের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দরোজায় ৪ ছত্রের একটি পদ লিখে সে স্থান ত্যাগ করেন-

শৈশবকালরে সঙ্গী তুমি যৌবনকালের সাথী
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী
পাপিষ্ঠ জানিয়ো মোরে না হইলে সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো।

ড. দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ সম্পর্কে বলেছেন, ‘বায়রন এর সুপ্রসিদ্ধ ড্রিম নামক কবিতায় বর্ণিত ঘটনাগুলোর ন্যায় সীতার পূর্ব জীবনের স্মৃতিসম্পৃক্ত এই বিবরণীটি করুণ-মধুর রসে সিক্ত।’ উপরন্তু তিনি এই বলে মত প্রকাশ করেছেন যে, ‘রামায়ণের অনেকাংশের সঙ্গে মেঘনাদবধ কাব্যের আশ্চর্য রকমের ঐক্য দৃষ্ট হয়। আমার ধারণা মাইকেল নিশ্চয়ই চন্দ্রাবতীর রামায়ণী গান শুনেছিলেন। এ গান পূর্ববঙ্গের বহু স্থানে প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে।’
(ক্রমশ)

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মে থেকে  বাংলাদেশে ফ্লাইট শুরু করবে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স
মে থেকে বাংলাদেশে ফ্লাইট শুরু করবে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স
ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় কী? কখন খাবেন?
ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় কী? কখন খাবেন?
‘উপজেলা নির্বাচনে এমপিদের প্রভাব খাটানোর প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা’
‘উপজেলা নির্বাচনে এমপিদের প্রভাব খাটানোর প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা’
দেবিদ্বারে পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
দেবিদ্বারে পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: এখনও অপেক্ষায় স্বজনরা
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: এখনও অপেক্ষায় স্বজনরা