X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

মেঘমল্লার ।। শাশ্বত নিপ্পন

.
৩০ মে ২০১৮, ১১:৪৭আপডেট : ৩০ মে ২০১৮, ১২:০১


মেঘমল্লার ।।  শাশ্বত নিপ্পন

ওরা সমবয়সী হলেও সঠিক বয়স ওদের অজানা। ওরা লালমাটিয়া, ওদের ভাষায় ‘লালমাইট্টা’ ও সংসদ ভবন এলাকায় একসঙ্গে ঘোরে; মানে ভিক্ষা করে, শুধু ভিক্ষা না, পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট খাবার কুড়িয়ে খায়, ফুচকার দোকানে পানি এনে দেয়; লোডেড রিক্সা ভ্যানের পিছনে টেলে চালককে সাহায্যও করে। বিনিময়ে ওরা সামান্য খেতে পায়। যখন ভিক্ষা করে তখন টাকা পায়। সে টাকা মাকে দেয়। সারাদিন শেষে ক্লান্ত হয়ে ওরা যখন মার কাছে যায় একটু আদর, একটু স্নেহের জন্য তখন মা ব্যস্ত থাকে। প্রায়ই মায়ের কাছে মেহমান আসে। বিভিন্ন ধরনের মেহমান। লম্বা, খাঁটো, মোটা, পাতলা, গোঁফওয়ালা ও গোঁফহীন। সে সময়টা ওরা মায়ের কাছে থাকলে মা খুব কায়দা করে বাইরে যেতে বলে। মেহমান যিনি থাকেন এক সময় তিনি ওদের হাতে দশ টাকার একটা ‘চকচক্কা’ নোট ধরিয়ে দেয়। টাকা পেয়ে ওরা আর বস্তির ঝুপড়ির ঘর নামক বদ্ধ জায়গায় আর দাঁড়ায় না, পান আর সিগারেট এনে দিয়ে বকশিশ হিসাবে দুটো লজেন্সের একটা মুখে দিয়ে অন্যটা বন্ধুদের জন্য নিয়ে দে ছুট। জসিম, মুমিন, সুফিয়া, কামাল এই ‘চকচক্কা’ দশ টাকা একলা খায় না। সবাই ভাগাভাগি করে খায়। কারো হাতে টাকা দেখলেই অন্যজন জিজ্ঞাসা করে—

“মেহমান আইছে না রে জসিম্যা?”

“দ্যাখতে কিমুন? কাইল্যা না ধলা?” জসিমের আর উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। মানিক মিয়া এভিন্যুর পাশের ফুটপাতের বকুল তলায় বসে লাল নীল পিঁপড়ের সারির মতো গাড়ি দেখতে দেখতে ঘাসের শিষ দাঁত দিয়ে কাটতে থাকে। উত্তরটা দেয় কামাল। “ কাইল্যা হউক আর ধলা আমাগো চ্যাঁট। দে টাহাটা দে পাউরুটি কিন্যা আনি গা।” এ প্রস্তাবে ওদের মধ্যে গুমোট ভাবটা কেটে যায় মুহূর্তে। সকলের মুখ শরতের আকাশের মতো ঝরঝরে হয়ে ওঠে। মুমিন ও সুফিয়া ময়লা-হলুদ দাঁত বের করে হাসতে থাকে। সে হাসিতে জসিমও যোগ দেয়। ওদের এই হাসি মাখা মুখ দেখলেই বোঝা যায় ‘কাইল্যা হউক আর ধলা, ওগো চ্যাঁট’—পাউরুটিই আসল।

আজও ওদের মায়েদের ঘরে মেহমান এসেছে অথবা আসবে। জসিম, কামাল, মুমিন, সুফিয়ারা আজও ঘর ছেড়ে যথারীতি রাস্তায়, তবে আজ যেকোনো কারণে মুমিনকে “হ্যার মায়ে পিডাইছে”। মুমিনের ঠোঁটের নিচটা ফোলা। সে কিছুটা কেঁদেছেও। মুমিনদের কান্না দীর্ঘস্থায়ী হয় না। খিদের তাড়না ওদের দীর্ঘক্ষণ কাঁদতে দেয় না। মুমিন এসব তুচ্ছ কথা কাউকে বলেও না। কেউ বাপের নাম জিজ্ঞেস করলে যে ছেলে নির্বাক বিষণ্ন হয়ে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে অপলক, তার কাছে মার খেয়ে ঠোঁট কেটে যাওয়ার কারণ অন্যকে ব্যাখ্যা করা নিতান্তই ফালতু বিষয়। তারপরও বন্ধুরা ধরেই ফেলে। কারণও জানতে চায়; জসিম বলে, “কি রে মুমিন? মাইর খাইছস ক্যাল্য? পিডাইছে কেডা?”

তর মায়ে নাকি মেহমান?

মায়ে;

ক্যান?

ভাত চাইছিলাম, খিদা লাগছিল বেজায়।

বন্ধুরা সকলেই হেসে ওঠে গলা ছেড়ে। এবার জসিম বলে, “এই খানকির পোলা, কাইল রাইতে খাইস নাই” —সাথে সাথেই মনে পড়ে গতকাল মুমিন আসেনি। বস্তিতেই ছিল। বিষয়টা মনে হতেই ওরা লজ্জিত হয়। তবে সে লজ্জা স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ। তারপর ওরা সবাই দগদগে দুপুরের রোদ দেখতে থাকে। ওদের দূর দৃষ্টিতে কেমন যেন টলমলে জলের আভাস চিকচিক করে কাঁপতে থাকে। মুহূর্তে ওরা ভুলে যায় ওদের বয়স, বস্তিঘরের গুমোট যাপিত জীবন, ঠোঁটের নিচে জমে থাকা নীল যন্ত্রণা, আর মায়ের ঘরে বিভিন্ন ধরনের মেহমান—মোটা, চিকন, লম্বা, বেটে গোঁফওয়ালা অথবা গোঁফহীন। দূর থেকে সুফিয়া চিৎকার দেয় “অ...ই জসিম্যা”—সম্বিত ফিরে পেয়ে মুহূর্তে ওরা মানিক মিঞা এভিন্যুর পাশের বকুল তলায় ফিরে আসে। সংসদ ভবনের উল্টো দিক থেকে সুফিয়া দৌড়াচ্ছে। হাতে তার একটা পলিথিন প্যাকেট। দৌড়াচ্ছে সুফিয়া; খালি পায়ে তার অযত্নে বিন্যস্ত রুক্ষ নোংরা চুলগুলো দুলছে। অপূর্ব এই দৃশ্য জসিম, মুমিন আর কামালকে মোহিত করে। এরূপ একটা দৃশ্য ওরা দেখেছিল আড়ং এর বাইরে টাঙানো বড় টেলিভিশনের পর্দায়। বড় লোকের আদুরে ফুটফুটে মেয়ে সবুজ ঘাসের গালিচার উপর দিয়ে দৌড়ে আসছিল—তার মায়ের দিকে। সুফিয়ার মা তাকে দেখে না। সে দৌড়ে আসছে তার সাথীদের দিকে, যাদের সাথে সে ভিক্ষা করে, রাস্তায় পড়ে থাকা নোংরা খাবার খায়। ওরা মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে সুফিয়ার দিকে। সুফিয়া কোথা থেকে যোগাড় করেছে এক পলিথিন বিরিয়ানি। হালকা হলুদ ভাতের মাঝ থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা ডিমের কিয়দংশ আর একটা মাংসের দলা। যদিও একটু গন্ধ হয়েছে তাতে কী? বিরিয়ানি তো। বিত্তবানদের খাবার। আনন্দে ওরা ভাসতে থাকে। সুফিয়া ক্ষুধার্ত মুখগুলোর সামনে পলিথিনটা মেলে ধরে। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “ল আমি খাইছি; তেজতুরী পাড়ার থন আনছি।” হামলে পড়ে বুভুক্ষু শিশুগুলো। গোগ্রাসে খেতে শুরু করে। যেমনটা খায় ক্ষুধার্ত কুকুর। তারপরও বেশির ভাগটা মুমিনকে দিয়ে জসিম বলে, “দোস তুই খা, আমার বিরিয়ানি ভাল্লাগে না।” আনন্দে ডগমগ হয়ে চেটেপুটে শেষ করে মুমিন, পচা বিরিয়ানির প্যাকেট। তারপর জসিম তার নোংরা ছেঁড়া প্যান্টের পকেট থেকে কুড়িয়ে পাওয়া আধপোড়া সিগারেট বের করে ফুটপাতের বকুল গাছে হেলান দিয়ে ফিল্মি স্টাইলে টানতে থাকে। অন্যদিকে মুমিন ও কামাল লোভী দৃষ্টি নিয়ে তার জ্বলন্ত সিগারেটের দিকে তাকিয়ে থাকে স্থির। ঠিক তখনই সুফিয়া বেসুরো গলায় গান ধরে,“খায়রুন লো তুমার লম্বা মাথার কেশ, চিড়ল দাঁতের হাসি দিয়া পাগল করলি দ্যাশ।” হাত পা ছুড়ে নাচতে থাকে সে। বাংলা সিনেমা নায়িকাদের অনুকরণে তার সমতল বুক প্রাণপণে আন্দোলিত করার চেষ্টা করে। সুফিয়ার এই কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি অন্যদের প্রাণে হিল্লোল বইয়ে দেয়। এক পর্যায়ে জসিম, মুমিন, কামাল যোগ দেয় এই ওপেন এয়ার কনসার্টে। ওদের মনে হয় সব মিথ্যা, সত্য এই বকুলতলা; এই ফুটপাত আর বাসি দুর্গন্ধের বিরিয়ানি! মনে হয় থাক না মার ঘরে মেহমান, তবুও জীবন কত আনন্দের। এভাবেই রৌদ্রদগ্ধ দিন দুপুর গড়ায়। ওদের পাকস্থলির পচা বিরিয়ানিও ক্রমেই তলানিতে পৌঁছে যায়। অবশিষ্ট থাকে মাঝে মাঝে ওঠে আসা টক স্বাদের দু’একটা ঢেঁকুর। জ্যাম! চারদিকেই জ্যাম। আসাদগেট থেকে নিউমার্কেট, গ্রিন রোড, এলিফ্যান্ট রোড, কাকরাইল, মগবাজার, কিংবা মিরপুর কোন খানে সামান্যতম গতি নেই। থেমে আছে সব। ফুটওভার ব্রিজ অথবা উঁচুতলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কফিশপ থেকে নিচের থেমে থাকা গাড়ির সারিগুলো ভারি চমৎকার দেখায়। মানিক মিঞা এভিন্যু থেকে কিছু যাত্রীবাহী বিপুল উৎসাহে গোঁ গোঁ করে জেদী দৈত্যের মতো কিছু পথ এগিয়ে এসে স্থির হতে বাধ্য হচ্ছে। তারপর স্টার্ট চালু রেখে দাঁড়িয়ে থাকে অসহায়, শুধু তার এডজাস্ট পাইপ থেকে কালো নীলচে ধোঁয়া বের হতে থাকে ধিক ধিক করে। পাবলিক গাড়ির মধ্যে অসংখ্য মানুষ হাসফাঁস করছে। দম বন্ধ করা ভাদ্দুরে গরম। আকাশে মেঘ থাকলেও থমকে আছে প্রকৃতি। কোথাও এক চিলতে বাতাস নেই। এর মাঝেও যাত্রীরা নির্বিকার। কেউ সস্তা খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে নিবিড়ভাবে। কাগজে ভালো খবর নেই। “শীতলক্ষ্যা ট্রলারডুবি”,  “নীলফামারিতে মা মাছকাটা বটি দিয়ে ফালাফালা করে কেটেছে তার নিজের দুসন্তানকে”, “পর্ণ ছবি নির্মাতা গ্রেফতার”, “বিরোধী দলের চরম হুশিয়ারী”, “শহরে বাড়ছে উলঙ্গ পাগলের সংখ্যা”, “বাজারে এল নতুন কনডম” প্রভৃতি। এরপরও সে কাগজে হাতবদল হচ্ছে। কেউ বা ঝিমুচ্ছে। বাইরে রোদের প্রখরতা যেন বেড়েই চলেছে বিরামহীন। হকাররাও ক্লান্ত। তারপরও বিক্রি হচ্ছে বরিশালের আমড়া, হাত পাখা, নামাজ শিক্ষার বই। ড্রাইভার ঝিমুনি কাটাতে সিগারেটের সঙ্গে পান চিবুচ্ছে বাধ্য হয়ে।

প্রাইভেট গাড়িতে নগর সয়লাব। দামি গাড়ি, মাঝারি দামি গাড়ি, লালনীল পিঁপড়ের সারি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব গাড়ির যাত্রীরা কিছুটা স্বাভাবিক, শুধু এই গাড়ির ড্রাইভারের চোখে মুখে বিরক্তি।

আমড়া বিক্রেতাও এসব গাড়ির দিকে ছুটছে কম। ওদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির কাচের বাইরে দাঁড়াচ্ছে ফুল বিক্রেতা, শিশু-মহিলা ভিখারি, পপকর্নওয়ালা। মহিলা ভিক্ষুকগুলো অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকে গাড়ি ভিতরের মহিলার দুধসাদা বাহু, কাজল টানা চোখ, কচি ঢেঁড়সের মতো মায়াময় আঙ্গুল, মসৃণ চুল আর নিটোল বুক। মনে মনে ভিখিরিটা ভাবে, তার মতোই তো; এক সময় তার বুকও .... পরক্ষণে মনে হয় কিন্তু গায়ের রঙ? কি সুন্দর! যেন ঘন দুধে আম গুলে দিয়েছে কেউ। ইশ! হুরপরি! যদিও সে কোনোদিন ফেরেশতা কিংবা হুর দ্যাখেনি—তারপরও তার মনে হয় ওরা নিশ্চয় এদের মতোই। ঢাকা শহরের এই বিত্তবান হুর দেখতে দেখতে সে ভুলে যায় ভ্যাপসা গরম, আগুন রোদ আর গলে যাওয়া পিচের সাথে লেপটে যাওয়া তার বাঁ পায়ের ফোসকার কথা। গাড়ির যাত্রীরা এদিকে ভ্রুক্ষেপও করে না; শুধু দামি গাড়ির কাচের বাইরে জলবিন্দু জমে ওঠে। ভিখিরি মহিলার বৃষ্টি শুরু হয়েছে বলে ভ্রম হয়।

সুফিয়া, মুমিনসহ জসিম, কামালও খিদে তাড়াতে অথবা অভ্যাসের বসে কাজে নেমে পড়েছে। কাজটা সহজ নয় মোটেও, অভিনয় করতে হয় নিখুঁত। বেশিরভাগ মানুষ ভিক্ষা দেয় না। করুণা নয় ঘৃণার চোখে তাকায় দুর্ব্যবহার করে। অনেকের কাছে হাত পাতলে একজন দেয়। তবে এ পেশায় হতাশ হতে নেই মোটেও। মাথা গরম করলে চলবে না। এরাও হতাশ হয় না। এক জায়গায় তাড়া খেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে অন্য গাড়ির দিকে এগোয় দ্রুত। আরো নিখুঁত অভিনয় করার চেষ্টা করে। কাতর গলায় বলে “একডা টাহা দ্যান না, একডা টাহা... বাত খামু।”

আজ ভিক্ষা পাওয়ার জন্য একেবারেই উপযুক্ত দিন নয়। প্রচণ্ড গরমের সাথে যোগ হয়েছে অসহনীয় জ্যাম। মানুষ ক্লান্ত ও বিরক্ত। এই মানুষগুলো নিজ গন্তব্যে পৌছানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। তারা ভিখারি দেখলে রেগে যাচ্ছে। তবে এসবের মাঝেও অপার সম্ভবনাময় জায়গাগুলো আর মুখগুলো সুফিয়ারা আলাদা করতে পারে। এয়ারপোর্টগামী গাড়ি বা ক্যাব দেখলেই ওরা চারজন এক সাথে সেদিকে ছুটে যায়। গাড়ির মধ্যে যাত্রী সবাই গম্ভীর থাকে; এদের মধ্যে যার মাথায় টুপি আর চোখের কোণে ভেজা সেই হলো বিদেশগামী যাত্রী। তবে তিনি টাকা পয়সা দেন না—দেয় ক্যাবের মুরুব্বি যাত্রী; বিশেষ করে মহিলা মুরুব্বি। আর ভিক্ষা দেয়, লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স। জ্যামের মধ্যে আটকে থাকা লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্সে প্রিয়জনের কফিন সাথে নিয়ে গাড়ির মধ্যে থাকা মানুষেরা ঘামতে থাকে আর মোবাইলে কথা বলে, কখনো কাঁদে আবার কখনো বা ঝগড়া করে—জমির জায়গা দলিল টাকা আর জানাজার সময় নির্ধারণ নিয়ে। মানুষের জীবন কি বিচিত্র! এ সব এই শিশুগুলো দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে।

রোগীর এ্যাম্বুলেন্স টাকা দেয় না, লাশবাহী গাড়ির দেখা আজ এখনো পর্যন্ত নেই। জসিম কামালারা ক্ষিপ্রতার সাথে এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়ি ঘুরছে। হাত পাতছে; অভিনয় করছে; একই কথা একঘেয়ে সুরে বারবার বলে যাত্রীদের মাথা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। “একডা টাহা দ্যান—বাত খামু; একডা টাহা দ্যান বাত খামু...”  যাত্রীবাহী গাড়ির হেলপার খেকিয়ে ওঠে, “অই খানকির পোলা, একডা লাত্থি দিমু—হালার পো হালা।” এবার সত্যিই এরা হতাশ হয়। আজ কপালটা সাথে যাচ্ছে না একজনেরও বউনি হয়নি।

হঠাৎ ওরা প্রধান রাস্তা ছেড়ে আড়ং ভবনের দিকে দৌড় দেয়। প্রথমে এর কারণ বুঝতে না পেরে জসিম জিজ্ঞেস করে “অই ওদিক যাস ক্যান?” সুফিয়া উত্তর দেয় “এই দ্যাখ মুরগী, কাবাব বানামু।”

আড়ং বিল্ডিং এর পাশের গলি পথেও জ্যাম। প্রাইভেট আর রিক্সায় একবারে খিচুড়ি অবস্থা। তারমধ্যে এক দশাসই মহিলা বড় একজোড়া রোদচশমা চোখে, পুরো রিক্সাজুড়ে বসে ঘামছেন। পায়ের নিচে ছোট বড় নানা রকমের প্যাকেট। শিশু ভিখারিগুলোর দৌড় ওই মহিলাকে লক্ষ্য করেই। মহিলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিশু ভিখারিগুলো রিক্সাটি ঘিরে ফেলল। তারপর শুরু করল সেই মাথা ধরানো বিরক্তিকর একঘেয়ে সুর। “আম্মা, আম্মা গো—একডা টাহা দ্যান না বাত খামু।” এই কথা বলতে বলতে ওরা মহিলার পায়ের কাছে রাখা ব্যাগগুলোকে ছোট ছোট টান দিতে থাকে। উদ্দেশ্য যদি একটা ব্যাগ কে সাবড়ানো যায়—তাহলে আর লাগে না! মহিলা ওদের প্রশ্রয়ের চোখে দেখতে থাকে। এক পর্যায়ে সে সুফিয়াকে জিজ্ঞেস করেই বসল, “এই মেয়ে কি নাম তোমার?” সুফিয়া কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রিক্সার বডিটা ছেড়ে দ্যায়। কামাল উত্তর দ্যায়, “ছুপিয়া, হ্যার নাম ছুপিয়া।” এবার সুফিয়া ফিক হয়ে হেসে দেয়। কামাল ও মুমিন ও সে হাসিতে যোগ দেয়। শুধু জসিম দু’চোখে সন্দেহ নিয়ে স্থির তাকিয়ে থাকে মহিলার দিকে। “তোমরা কি ভাই বোন?”, “নাহ, দোস” উত্তর করে সুফিয়া। মহিলা আর ঝামেলা না বাড়িয়ে হাতের পার্সটা খোলেন। মুহূর্তে খুশির চমকে ঝিলিক খেলে যায় শিশুগুলোর চোখে। বউনি হতে চলেছে। এই লম্বা দিনটার শেষ প্রান্তে। খিদেয় ওদের নাড়িটাও হঠাৎ কিলবিল করে ওঠে। ইতিমধ্যে চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। গুরুগুরু মেঘ ডাকছে। চিকন একটা হাওয়াও বইছে। স্থবির চারপাশে যেন হঠাৎ প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। বৃষ্টি আসল বলে...

বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। জ্যাম ছেড়েছে আবার বেঁধেছে হয়তো, বৃষ্টির গতি বাড়ার সাথে রাস্তা ফাঁকা হচ্ছে। গাড়িগুলো সামনের দিকে ছুটছে বিপুল গতিতে; আর চাকার ধাক্কায় রাস্তার পাশে জমে থাকা জল ছড়িয়ে পড়ছে দারুণ উচ্ছ্বাসে। রিক্সায় বিশাল দর্শন মহিলা শিশুদের পাঁচ টাকার একটা ঝকঝকে কয়েন দিয়েছেন। ওরা আনন্দে অভিভূত। সুফিয়ার ছেঁড়া প্যান্টের পকেট ওরা এই সাত রাজার ধনটা রেখে যত্নে রেখে আর প্রতি মুহূর্তে পরিকল্পনা এটে চলেছে কি খাওয়া যায় এই অর্জিত সম্পদ দিয়ে। ওরা বৃষ্টি দেখছে আড়ং—বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে। আকাশ ভাঙা বৃষ্টি ওদেরকে মোহাবিষ্ট করে। ওরা বৃষ্টি ডানায় ভর করে, ক্ষুধার্ত পাকস্থলি নিয়ে উড়ে যায় কখনো চিকেন বার্গারের চারপাশে, কখনো টাটকা বিরিয়ানির থালায়, ভাত-রুটি, চকোলেট আর কত কিছুর চারপাশে। আড়ং-বিল্ডিং এর নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্বপ্নের নাগরদোলায় ভাসতে ভাসতে ওরা দেখতে থাকে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। মুহূর্তেই মহানগরীর বড় রাস্তায় জল থৈ থৈ হয়ে যায়। সুফিয়া দৌড় দিয়ে নেমে আসে বৃষ্টিতে। সুফিয়ার দেখাদেখি অন্যরা নেমে আসে বৃষ্টিঝরা অকৃপণ খোলা আকাশের নিচে। মহানন্দে শিশুগুলো ভিজছে। ওদের কেউ খেয়াল করছে না—এতে ওদের আনন্দে সামান্য ভাটা পড়ছে না। আকাশ ভাঙা বৃষ্টি আর রাস্তায় জমে ওঠা জল ওদের ছন্দহীন নিরানন্দ জীবনকে ভরিয়ে দিয়েছে।

কেউ লাফাচ্ছে কেউ উল্লাস করছে কেউ বা অযথা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। জ্যামমুক্ত গাড়িগুলো হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে; গাড়ি চাকার ধাক্কায় রাস্তার জল ওদেরকে নতুন করে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর ওরাও লাভ করছে নব-জীবন। খেলা যখন তুঙ্গে ঠিক তখন ঘটল বিপত্তিটা। কীভাবে যেন সুফিয়ার খোট থেকে পাঁচ টাকার কয়েনটা টুপ করে জলে পড়ে গেল। জসিম, মুমিন, কামাল থমকে দাঁড়ায়, ওরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে কয়েনটাকে আরো চকচকে দেখাচ্ছে—আর কয়েনটা জমে থাকা জলের বিপুল তোড়ে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাচ্ছে ম্যানহোলের দিকে। শেষ বিকেলের সামান্য আলো প্রতিবিম্বিত হচ্ছে সেই কয়েন থেকে। ভেসে যাচ্ছে ওদের সাত রাজার ধন, চিকেন বার্গার, টাটকা বিরিয়ানি, চকোলেট আরো কত কিছু ওরা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েন ভেসে যাওয়ার মধ্যে ওরা অসীম আনন্দ খুঁজে পায় যেন। এক সময়ে কয়েনটা ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যায় ম্যানহোলের গহিন গহ্বরে। ওরা একে অপরের দিকে চায়, সাত রাজার ধন হারিয়ে যায়। আবার প্রাণ ফিরে পায় ওদের খেলায়। ঠিক তখনি চারপাশ কাঁপিয়ে আকাশটা ডেকে ওঠে। নীলচে আলো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ভিখারি শিশুগুলো আতঙ্কিত হয়ে “মা গো”—বলে চিৎকার করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার