বারো বছর ও অন্যান্য
বারো বছর পর পর আমার জীবন পাল্টে যায়
বারো বছর পর পর পাল্টে যায় পাশের মানুষ
বারো বছর পর হটাৎ একটা দিন আসেই
যেই দিন দীর্ঘায়িত হয় সূর্যাস্ত
ঠিক তখন আশ্চর্য রকম ভাবে
আমি দাঁড়িয়ে থাকি
অনেকটা উঁচু কোথাও— ফুল ডুৎরির মাথায় বা
পুরানো বন্ধুর চিলেকোঠার ছাদে
শহর ছড়িয়ে থাকে পায়ের নিচে,
বানারিটোলার অচেনা প্রান্তর হয়ে।
শেষ লালটুকু যত মিলিয়ে যায়
আমি ততই তার পথ আঁটকে দাঁড়াই—
আজ না হয় নাই বা এলো অন্ধকার!
বারো বছর পর পর আচমকা একদিন
বাসায় ফিরে যাওয়ার সময়েও
পাখিরা শান্ত ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকে
এ শহরের কার্নিশে কার্নিশে, জলট্যাঙ্কির ওপর
এত যে চেনা আকাশ
তার দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে,
বারো বছর পর
ওদের দুচোখ ছাপিয়ে জল আসে।
এই শহর
আমার শহরে সিগারেটের ধোঁওয়ারা মাঝে মাঝে মেঘ হয়ে যায়
তোমার চুলের ফাঁকে ফোকরে ঢুকে পড়ে
আঙুলরা ভিজে যায় তাই,
চোখের পাপড়ি এমন কি নাকছবিটাও।
আমার শহরে পাগলিরা পোয়াতি হয় বছর বছর,
হুবহু মানুষের বাচ্চার মতো সেই বিটকেলে ছানাগুল জন্মায়
আস্তাকুঁড়ে, ব্রীজের নিচে, বাজারের পেছনে।
এ শহরের হাইরাইস আর বস্তির মাঝখানে শান্ত গলিতে
চোরাগোপ্তা দুপুরে ঢুকে পড়ে প্রেমিক-প্রেমিকা
কাকেরা হাঁ করে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে আর দেখে...
কুকুরেরা গলি আগলে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে।
সন্ধ্যে হলে এখনো শাখ বাজে এ শহরে
টিভিতে শুরু হয় একটা ছেলে
আর তার চারটে বউ-এর মারকাটারি কেচ্ছা
দেখতে দেখতে কখন কে জানে লালা গড়িয়ে পড়ে,
ভিজে চটচটে হয়ে যায় জামা, জামা তলায় ছোটজামা,
তারও তলায় যদি কিছু থাকে, তাই
কান খুঁচিয়ে ময়লা বের করে আনার মতো
আনন্দ খুঁজে নিতে নিতে
আমার শহর বড় বড় দুটো স্বপ্নের চোখ মেলে,
পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে হয়ে উঠে বলে
“কোলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তলা, স্যরি, তিলোত্তমা হবে”
কাদা প্যাচপ্যাচে গড়িয়াহাটায় হটাৎ পাগলা হাওয়া ঘোরে
পাতার বৃষ্টি নামে।
বাবার সঙ্গে কাউন্টার
যতবার প্লেন-এ চাপি দেখা হয় বাবার সঙ্গে
একটা লাট্টুর মতো মেঘের উপর বসে
সিগারেট খেতে খেতে বাবা হাসে, ঠিক যেভাবে
রাগ দেখাতে গিয়ে বারবার হেসে ফেলত।
আমি বুঝতে পারি বাবা জানে কাল রাতে
আমি খাইনি, কদিন আগে বন্ধ বাথরুমের
শাওয়ারের তলায় জামা, জুতো সমেত বসেছিলাম
দু-ঘন্টা, ছেলেগুলো যখন মাথা থেকে পা এবং
তার মধ্যিখানের সবটুকু চোখ দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে
চেখে দেখছিল তখন কিস্তি দিতে দিতে শুধু বাবার
পাশে পাশেই হেঁটে যেতে চাইছিলাম...
আমি জানি বাবা বুঝতে পারে...
আমারো একটা মেঘ চাই বাবা। একটা লম্বা
ঘাসের শিষের মতো, মেঘের মতো মেঘ।
আমিও ওভাবে মেঘের ওপর বসে
ভাসতে চাই আর হাসতে চাই।
আমি তো জানি না কি খেয়ে আছো তুমি!
তোমার চটি আবার ফেটে গেছে কি না!
আমি জানি না তোমার ভালোবাসা, ঘৃণা,
অসহায়তা, অপারগতা... আমি তো বুঝি না কিছু,
খালি মনে হয়, তুমি ভালো আছ তো?
ভালো থাকা মানে কি কে জানে! তবু সেই
এক বস্তাপচা ভালো থাকার কথাই সবাই বলে।
সত্যি বলছি, আমার প্লেন-এ চাপতে ভালো
লাগে খুব শুধু লাট্টুর মত ওই মেঘটার জন্য।
আজকার বাজার খারাপ, রোজগার পাতি কম।
সিনেমা দেখা থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন
সবেরই বাজেট ছাঁটতে ইচ্ছে হরবখত।
ক্লাসিক এখন শুধু রাজাগজারা খায়।
আমার সস্তার ব্র্যান্ড চলবে তো তোমার?
পাঠ-প্রতিক্রিয়া
উপরোক্ত তিনটি কবিতা পাঠের পর পাঠকের মনে যে ভালোলাগা ছড়িয়ে যাবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমারও ভালো লেগেছে। কিন্তু কবিতাগুলো নিয়ে গর্ব করার মতো অনেক কিছুরই অভাব বোধ করেছি। তিনটি কবিতা কবি বিন্যস্ত করেছেন সুনিপুণভাবে অর্থাৎ পরিবেশনের দক্ষতা কবির কব্জাগত কিন্তু পাঠক হিসেবে আমি চেয়েছিলাম এমন কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লেখা হোক, যা নিয়ে আজও কেউ লেখেনি বা সচরাচর লেখা হয় না।
নস্টালজিক বা ইমোশনাল কিছু শব্দকে পুঁজি করে নতুন বিষয়বস্তু পাশ কাটিয়েই কবিতাগুলি এগিয়ে গেছে। হয়তো কবি বলবেন, নতুন বিষয়বস্তু কি তবে মঙ্গলগ্রহ থেকে আনবো! পাঠক হিসেবে তো আমি তা বলতে পারবো না। আমি বলবো, কেউ নতুন কিছু চায় আর কেউবা ভালো কিছু চায়। আমি চেয়েছি দুটোর সমন্বয়। কবির আঙুলে কবিতা যেহেতু নাচছে ধ্রুপদী ঢঙে, তাই নতুন বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা ভালো কবিতার পাঠক হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি। কবিকে শুভেচ্ছা।
[আমরা গল্প ও কবিতার সঙ্গে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জুড়ে দেবার সীদ্ধান্ত নিয়েছি। যিনি পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখবেন তাকে শুরুতে জানতে দেয়া হয় না লেখকের নাম। আবার লেখক কখনোই জানতে পারবেন না পাঠ-প্রতিক্রিয়া কে লিখেছেন।–বি.স.]