X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১
শান্তিতে নোবেলজয়ী নাদিয়া মুরাদের আত্মজীবনী

দ্য লাস্ট গার্ল ।। পর্ব-০৬

অনুবাদ : সালমা বাণী
০২ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:৪২আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:৪৬

দ্য লাস্ট গার্ল ।। পর্ব-০৬ কোচোর অবস্থান ছিল মূলত পর্বতের পাদদেশ থেকে বহু দূরে, যেখানে প্রায় একেবারেই বিচ্ছিন্ন পরিবেশে আমাদের বসত গড়ে উঠেছিল। আমাদের গ্রামের নতুন ইয়াজিদিরা বহু পুরাতন ইয়াজিদি ঐতিহ্য আচার ও রীতিনীতি ভক্তির সাথে পালন করতো।  নারীরা দাদী-নানীদের মতো স্কার্ফ মাথায় বাঁধতো, আর পায়ের পাতা অবধি লম্বা সাদা মসৃণ পোশাক পরতো। ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান ছিল বিবাহ এবং অন্যান্য সামাজিক আনন্দ অনুষ্ঠানের অংশ। অগণিত ইয়াজিদি যখন এইসব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রীতিনীতি ও ঐতিহ্যবাহী আচার অনুষ্ঠান ত্যাগ করতে শুরু করেছিলো আমরা তখন সেই পাপ মোচনের জন্য দীর্ঘ উপবাস করেছি। কিন্তু আমরা কখনোই আমাদের মানুষদের ওপর অসন্তুষ্ট হইনি, কারণ আমাদের সম্পর্ক ছিল গভীর বন্ধনে আবদ্ধ। সম্পত্তি অথবা বিবাহ বিষয়ক দ্বন্দ্বে আমরা কখনো কখনো জড়িয়ে যেতাম বটে তবে সেটা ছিল নেহায়েত সাময়িক। এইসব বিষয় আমাদের গভীর ভালবাসা আর বন্ধনের নিকট অতি তুচ্ছ ব্যাপার ছিল মাত্র।  গ্রামবাসীরা গভীর রাত পর্যন্ত একে অপরের বাড়ীতে অনায়াসে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে যেত এবং গ্রামের পথে নির্ভয়ে চলাফেরা করতো। গ্রামে বেড়াতে আসা পর্যটক অথবা পথিকরা বলতো অন্ধকারেও কোচোর দ্যূতি বিচ্ছুরিত হয়, আর তার ঝলক নজরে আসে সেই সুদূর আফার থেকেও। একদিন এক পর্যটক নাকি বলেছিলেন— কোচো হচ্ছে দ্যা প্যারিস অফ সিনজার।

মূলত কোচো ছিল শিশু-কিশোরে মুখরিত যৌবনের ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ এক গ্রাম। খুব স্বল্প সংখ্যক বয়োবৃদ্ধ মানুষ ছিল যারা প্রথম সারির কৃষি কাজের সাক্ষ্য বহন করছিলো। ফলস্বরূপ আমাদের অধিকাংশ অধিবাসীরই বদ্ধ ধারণা ছিল পৃথিবী এখন সভ্যতার সেই শিখরে পৌছে গেছে, আধুনিকতার সেই চুড়ান্ত রূপ অর্জন করেছে যেখানে ধর্মের জন্য আর হত্যাকান্ডের মতো নির্মমতা ঘটবে না। এটা তাদের কল্পনারও অতীত ছিল। শুধুমাত্র ধর্মের আক্রোশে একটা সম্পূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে এভাবে হত্যা করা যেতে পারে। অন্তত এই ভাবনা আমাকে গ্রাস করে রাখে। অতীতে ধর্মের জন্য বর্বর হত্যাকান্ডের ইতিহাস রূপকাহিনীর মতো শুনে আমরা বড় হয়েছি। আর এই ইতিহাস আমাদের একত্রিত করেছে সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধনে। তুর্কিতে বসবাসরত ইয়াজিদিরা অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিভাবে পালিয়েছিল সেই গল্প আমরা শুনেছি আমাদের এক বন্ধুর মায়ের কাছে থেকে। আমার সেই বন্ধুর মা তুর্কি থেকে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা পেয়েছিলেন। ভয়াবহ লোমহর্ষক ছিল মা আর বোনের সাথে পলায়নের সেই গল্প। কোন রকম খাদ্য আর পানীয় ছাড়া দিনের পর দিন লুকিয়ে ছিল পাহাড়ের গুহায়।

তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শেষপর্যন্ত মা তার চামড়া সেদ্ধ করে খেতে দেয়। এই গল্প যখনই শুনতাম, আমার পেটের ভেতর যন্ত্রণায় মোচড়াতো। আমি তখন ভাবতাম, না খেতে খেতে মরে গেলেও আমি কখনো চামড়া সেদ্ধ খেতে পারবো না। আমার মনে হয় এটা শুধুমাত্র গল্পই ছিল।

তবে এটা স্বীকৃত যে, কোচোর জীবনযাত্রা ছিল খুব কঠিন। আর বলতেও দ্বিধা নাই, কোচোর শিশুরা, তা সে যত আদরেরই হক না কেন, তারা ছিল পিতামাতার নিকট বোঝা স্বরূপ। কারণ এই সন্তানদের মুখে আহার্য তুলে দেয়ার জন্য পিতামাতাদের দিবারাত্রি কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। যখন কোচোর শিশুরা অসুস্থ হতো,এবং আয়ুবেদিক চিকিৎসাতে নিরাময় হতো না, তখন তাদেরকে ডাক্তার দেখানোর জন্য নিয়ে যেতে হতো সিনজার শহরে অথবা মোজালে। আমাদের পোশাক পরিচ্ছেদের অধিকাংশ আমার মা নিজ হাতে সেলাই করে বানাতো। পরবর্তী সময়ে যখন আমাদের হাতে কিছু টাকা আসে, বছরে শুধুমাত্র একবার মার্কেটে গিয়ে শপিং করার সুযোগ হতো। সাদ্দামকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য যখন ইউনাইটেড ন্যাশনস নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তখন আমরা সর্বপ্রথম চিনি ক্রয় করতে সক্ষম হই। আর সেই আনন্দে আমরা সবাই কোরাসের মতো চিৎকার দিয়ে কেঁদেছিলাম।

দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমাদের গ্রামে সর্বপ্রথম প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং তারও বহু বছর পরে প্রতিষ্ঠিত হয় মাধ্যমিক স্কুল। গৃহকর্ম, কৃষিকাজে সহযোগীতার পরিবর্তে সন্তানদের স্কুলে পাঠালে কী সুফল বয়ে আনবে সে সম্পর্কে মাতাপিতারা অবহিত ছিল না। সন্তানদের শিক্ষাপ্রদানের ব্যাপারে ইয়াজিদি জনসাধারণ দীর্ঘ সময় ধরে বিরোধীতা করেছে। এই বিরোধীতা শুধুমাত্র রাষ্ট্র নয়, ধর্মীয় নেতারাও এর বিরোধীতা করেছেন। এর অন্যতম কারণ ছিল রাষ্ট্রের অন্তসম্পর্কীয় বিবাহ-রীতিতে বিশ্বাস। সুতরাং ইয়াজিদি ধর্মীয় নেতারা ভীত ছিল যে— এরকম আন্ত:বিবাহের ফলে ইয়াজিদিদের ধর্ম এবং জাতিস্বত্তা নষ্ট হতে পারে ভেবে। এদিকে মাতাপিতার জন্য পারিশ্রমিকবিহীন শ্রমিক হারাবার ভয় ছিলো। এছাড়াও মাতাপিতা নিশ্চিত ছিল না যে, এই শিক্ষা অর্জনের ফলে তাদের সন্তানরা কোথায়, কোন পেশার চাকুরি নিশ্চিত করবে। কারণ কোচোতে কোন রকম চাকুরির বাজার ছিল না। আর কোচোর বাইরে ইয়াজিদি সমাজ থেকে বহু দূরে চাকরি করতে তারাই যেত যারা ছিল খুব সাহসী এবং উচ্চাকাঙ্খী।

কিন্তু প্রায়শই মা বাবার  ভালবাসা দ্রুত যন্ত্রণা-বেদনায় বদলে যেত। ক্ষেতখামারী জীবন ছিল সব সময়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং দূর্ঘটনা ছিল নিত্য সঙ্গী।

আমার মা সব সময়ই তার জীবনের ভয়ংকর স্মৃতির ভেতরে বসবাস করেছে। সে আমাদের বহুদিন শুনিয়েছে তার কিশোরী বয়সের লোমহর্ষক এক দূর্ঘটনার গল্প। তখন সে সবেমাত্র কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে উঠছে।  সেই সময়টায় তার বড় বোনকে পারিবারিক গমের ক্ষেতের মাঝখান  থেকে ট্রাক্টরে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। বোনের মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে হত্যাকারীরা পলায়ন করেনি বরং সদর্পে বীরের মতো  ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে ট্রাক্টর চালিয়ে মহড়া দিয়েছিলো। 

অসুস্থতা হলো আরেকটা ব্যয়বহুল যন্ত্রণা। কখনো কখনো অসুস্থতার চিকিৎসা হলো অত্যান্ত ব্যয়বহুল কর্মকান্ড। এরমধ্যে আমার ভাই জোলো এবং তার স্ত্রী জীনানের এর একের পর এক সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এবং জন্মের পরেই তারা মারা করে। জীনানের রক্তে কোন সমস্যার কারণে মায়ের গর্ভ হতে বিভিন্ন অসুখ নিয়ে শিশুগুলো জন্মগ্রহণ করতো। এই রোগের চিকিৎসা ছিল অত্যান্ত ব্যয়বহুল। তাদের দুজনার আট সন্তানের মধ্যে চারজন জন্মের পরপরই এই অসুখে মৃত্যু বরণ করে।

বিবাহ বিচ্ছেদ ছিল অন্যতম আরেকটি সামাজিক যন্ত্রণা। ইয়াজিদি সমাজে শুধু নয়, সমগ্র ইরাকের একই চিত্র। ডিভোর্স আমার বোন দিমিল’র বুক থেকে কেড়ে নেয় তার তিনটা সন্তানকে। কী কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ সংঘটিত হচ্ছে সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। যেকোন বিবাহ বিচ্ছেদের পরিণাম হলো নারী তার নুন্যতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়।  

আমি জন্মগ্রহণ করেছি প্রথম গালফ যুদ্ধের ঠিক দুই বছর পর। আর ইরাক-ইরান যুদ্ধের ঠিক পাঁচ বছরের শেষ সময়ে। আমি শুনেছি আট বছরের বিরোধের ফল ইরান-ইরাক যুদ্ধের অযৌক্তিক পরিণতি। এবং সেই সাথে সাদ্দামের নিজের দেশের জনগণকে ইচ্ছা মতো নির্যাতন করার বাহানা। যুদ্ধে যে সব সন্তানেরা প্রাণ দিয়েছে তাদের স্মৃতি সারা বাড়িতে প্রেতাত্মার মতো ঘুরে বেড়াত। যুদ্ধে প্রথম পুত্রকে হারানোর পর আমার বাবা তার মাথার বেনী কেটে ফেলে। আর আমার আরেক ভাই মৃত ভাইয়ের নাম ধারণ করে। কিন্তু আমার বাবা তাকে ‘হেনজি’ নামেই ডাকতো। হেনজি নামের অর্থ ”স্যাডনেস”।

আমরা আমাদের জীবনকে পরিমাপ করতাম ফসলের উৎপাদন আর কতগুলো ছুটির দিন কপালে জুটলো, তার সাথে। কখনো কখনো ঋতু হতো নিষ্ঠুর। বিশেষ করে শীতের সময় মাটি জমাট বাঁধা সিমেন্টের মতো শক্ত হতো। আর সেই মাটিতে সহজেই ক্ষয়ে যেত পায়ের জুতা। আর গ্রীস্মের সময় এত বেশি উষ্ণ হতো যে সূর্যের তাপে জ্ঞান হারাবার ভয়ে আমরা সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত ক্ষেতের ভেতর অপেক্ষা করতাম।   অতিরিক্ত গরমে কখনো কখনো শস্য একেবারেই নষ্ট হয়ে যেত। যখন এই রকম দুর্যোগ নেমে আসতো তার পরিণাম ভোগ করতে হতো মাসের পর মাস। পরবর্তী বীজ বপনের পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকতো এই দশা। তবে কি পরিমাণ বীজ বপন করলাম সেটার ওপর আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের কিছুই নির্ভর করতো না।  কারণ কখনোই আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারতাম না। আমরা কঠিন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে সব রকমের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ক্ষেতের ফসল মাঠ থেকে বোঝা বেঁধে বাজারে নিয়ে আসতে হতো। ইচ্ছামতো ক্রেতারা সেসব নাড়াচাড়া করে কখনো ক্রয় করতো, কখনো উল্টেপাল্টে ফেলে রেখে চলে যেত। তার থেকে কিছু ফসল বিক্রি হতো, কিছু হয়তো হতো না। বার্লি আর যবে মুনাফা আসতো সব চাইতে বেশি। পেয়াজ বিক্রি হতো, তবে তার পরিমাণ খুব সামান্য। যে বছর টমেটোর ফলন অধিক হতো সে বছর সবজি পচন রক্ষা করার জন্য কৃষি পশুদের অতিরিকক্ত ফসল খাইয়ে দিতে হতো।

কিন্তু জীবন যত কঠিন হক না কেন, আমি কখনো কোচো ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনি। শীতের মৌসুমে পায়ে চলা পথ কঠিন কাদা মাটিতে হয়ত হাঁটার অযোগ্য হয়ে যেত, কিন্তু ভালবাসার মানুষদের সাথে, আপনজনদের সাথে সাক্ষাতের জন্য কখনো আমাদেরকে দূরে যেতে হতো না। গ্রীষ্মে যখন গরম হাওয়ার দাপটে শ্বাসরোধ হয়ে আসতো, তার অর্থ আমাদের কাছে ছিল ভিন্ন। এই কঠিন সময় আমাদের জন্য নিয়ে আসতো ভিন্ন আমেজ। আমরা প্রতিবেশিরা সব ছাদের ওপর পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হয়ে সময় অতিবাহিত করতাম। শুয়ে বসে হাসি-গল্প-ঠাট্টা আনন্দে সময় কাটাতাম। প্রতিটি বাড়ির ছাদের ওপরে এই দৃশ্য ছিল গ্রীষ্মের দুপুরের সাধারণ চিত্র। ক্ষেত-খামারে কৃষিকাজ ছিল প্রকৃত অর্থেই কঠিন। কিন্তু আমাদের যা উৎপাদন হতো তাই দিয়ে আমরা আমাদের সাধারন স্বচ্ছল সুখী জীবনের আনন্দ উপভোগ করতাম। সেই শৈশব থেকেই আমি আমার গ্রামকে ভীষণ ভালবাসতাম। কোচোর ঘরগুলো সারা দিনভর কাঠ দিয়ে আমাদের হাতের তৈরি পুতুলে ভরে উঠতো। বড়, মাঝারি, ছোট নানা বয়সী পুতুল আমরা বানাতাম। ক্যাথরিন আর আমি কোচোর খেলাঘর ভরিয়ে তুলতাম নানা আকারের, নানা রকমের পুতুল দিয়ে। তারপর সেই পুতুলদের বিয়ে দিয়ে এক একটা ঘরে তুলে দিতাম। শুধু তাই নয় পুতুলদের চাষাবাদের জন্যও জমি বরাদ্দ করা হতো। বিয়ের আগে কনে পুতুলদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হতো তাদের ঘরদোর আর কৃষিকাজের জন্য বরাদ্দ জমিজমা। 

কোচো হলো সেই ভূমি যেখানে আমার মাতাপিতা পরিবারের সবার বসত। প্রাণের এই কোচো ছেড়ে দূরে কোথাও বসত করতে যাওয়া আমি কল্পনাও করিনি কখনো। আমার পরিবারের সবাই মিলেই যেন আমরা ছিলাম ছোট্ট সুখী একটি গ্রাম। আট ভাইয়ের ভেতরে ইলিয়াস ছিল সবার বড়। যেন ভাই না, একজন পিতা। আর খায়েরি, বর্ডার গার্ডের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিয়ে সে আমাদের সবাইকে স্বচ্ছল জীবনের স্বাদ দিতে চেয়েছিলো। পিসে ছিল খুব জেদি, একগুয়ে এবং পরিবারের প্রতি একান্ত অনুগত।  আমাদের ওপর যেন কোন বিপদ নেমে না আসে, সদা জাগ্রত এক প্রহরীর মতো সে পাহারা দিয়ে রাখতো সারাবেলা। আর ছিল মাসউদ ছিলো, কোচোর সেরা ফুটবল খেলয়াড়দের মধ্যে অন্যতম। তার জমজ সাউদ, গ্রামের ভেতরে পসার সাজিয়ে বসেছিলো কনভিনিয়েন ষ্টোর। জালো, গ্রামের প্রতিটি মানুষের হৃদয় উজাড় করে দেয়ার জন্য যেন বসে থাকতো। এমন কী অচেনা আগন্তকের জন্যও ওর হৃদয়ের দুয়ার খোলা থাকতো। সুখে দুখে, বিপদে আপদে গ্রামের প্রতিটা মানুষ প্রথমেই স্মরণ করতো জালোকে। প্রাণের ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ ছিল সাইদ। সারাক্ষণ একজন নায়ক হবার স্বপ্নে বিভোর থেকেছে সে। আর স্বপ্নচারী হেনজি যার স্নেহ ভালবাসা পাওয়ার জন্য আমাদের ভেতরে প্রতিযোগীতা লেগেই থাকতো। ছিল আমার দুই বোন, শান্ত-ধীর-স্থির, দিমাল ও আদেকি,  যেন চিরন্তম মমতাময়ী এক মায়ের প্রতিরূপ—আজও মনে পড়ে সেই দিনের কথা, একজন অচেনা মহিলাকে পিকআপ ট্রাক চালাতে দেয়ার জন্য আমার দুই ভাইয়ের সাথে সে কী বাক-বিতন্ডা। আর সেই দিনের কথা—আমাদের  ভেড়া মারা গেলে উঠানে গড়িয়ে গড়িয়ে অবুঝ শিশুর মতো কেঁদেছিল। আর কাঁদতে কাঁদতে একেবারে বেহুশ হয়ে পড়েছিল। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তানেরা খালেদ, ওয়ালিদ, হাজ্জি ও নাওয়াফ। আমার সৎ ভাইয়েরা, হালাম ও হাইয়াম আমার দুই সৎ বোন সকলেই আমাদের কাছেই বসত করতো। সৎ হলেও আমাদের ভেতরে ছিল নিবিড় অন্তরঙ্গ সহবস্থান।

কোচোতে আমার মা ছিল যেন সকলের জন্য মমতাময়ী এক মা। শুধু আমাদের পরিবারের ভরন পোষণ নয়, গ্রামের প্রতিটা মানুষের মঙ্গল কামনায় তার প্রাণ ছিলো উৎসর্গ করা। গ্রামের একটি বাড়ির উঠানে নয়, বরং তাকে দেখা যেত গ্রামের যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই। আর এমন নয় আমি তাকে শেষ দেখে এসেছি সেই গ্রামের বাড়িতে। বরং আমি যেখানেই যাই, সেখানেই তাকে কাছে পাই, সারাক্ষণ সে আমার সাথেই বসত করে। ইরাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সেই ভয়াল দিন গুলোতে তাকে দেখিছি ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটাছুটি করতে যেন আমাদের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় কোন কিছুর অভাব না হয়।  যখন তার হাতে আর কোন অর্থ অবশিষ্ট ছিল না তখন তাকে দেখেছি বার্লি দিয়ে বিনিময় করে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিতে। সেই দূর্দিনে পোশাক কেনার মতো অর্থ মায়ের কাছে অবশিষ্ট থাকতো না। বণিকরা যখন মাথায় করে পোশাকের বোঝা নিয়ে আসতো, মা তখন অনুনয়-বিনয় করে আমাদের বাকীতে  পোশাক কিনে দিতো। মাকে এভাবে ফেরিয়ালাদের বাকী দেয়ার ব্যাপারটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। শুধু তাই নয়, ফেরিয়ালারা গ্রামে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হতো। যদি আমার কোন ভাই দেনার ব্যাপারে সাবধান করতো, মা তখন তাদের সাথে ঠাট্টা করে ব্যাপারটা  অগ্রহ্য করতো।

গরীবের ঘরে অভাব অনটনে বেড়ে ওঠার কারণে মা চাইতো না তার সন্তানেরা একই কষ্টের ভেতর বেড়ে  উঠুক। অথবা অভাবের তাড়নায় অন্যের নিকট হাত পাতুক। কিন্তু গ্রামবাসী সব সময়ই সাহায্যের জন্য এগিয়ে থেকেছে। প্রায়ই তারা আমাদের ময়দা, কুছকুছ এসব দিয়ে সাহায্য করতো। আজও মনে পড়ে একদিন আমি আমার মায়ের সাথে বাড়ি ফিরছি। মায়ের হাতে একটা ব্যাগের ভেতরে সামান্য কিছু ময়দা। সেটা দুলিয়ে দুলিয়ে হাটছিল। ফেরার পথে মা তার চাচার সাথে দেখা করার জন্য সামান্য বিরতি নেয়। মায়ের চাচা তখন বলে—আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, তোমার সময় ভাল যাচ্ছে না, তুমি আমার কাছে আসতে পারো না সাহায্য নেয়ার জন্য? মা প্রথমে তার মাথা ঝাঁকায় মাত্র, তারপর উত্তর দেয়—আমাদের সবই আছে, কোন কিছুরতো অভাব নাই।

কিন্তু সোলাইমান চাচা ছিলেন বিজ্ঞ ব্যক্তি—তিনি বললেন, প্রচুর গম আমার মজুতে আছে, আমার এত গমের প্রয়োজন নাই, তুমি কিছু নিয়ে যেয়ে আমাকে ভারমুক্ত হতে সাহায্য করো। তেলের চারটা বড় খালি  কন্টেইনারে গম ভর্তি  করে আমাদের  বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সেই গমের আটা দিয়ে দুই মাস রুটি বানানো হয়েছিল। সেই দুঃসময়ে আমাদের কত বড় উপকার হয়েছিল সে গল্প বলতে গিয়ে সব সময়ই  মায়ের দুই চোখ উপচে গেছে অশ্রুতে। সেই দিনগুলোতে মা সব সময়ই প্রতিজ্ঞা করে বলতো—আমি তোমাদের জীবনকে এই সব কষ্ট থেকে রেহাই দেবো। এবং সে তার কথা রেখেছিল। ক্রমশ অভাবমুক্ত হাসি আনন্দে ভরা সুখী জীবনের দিকে আমরা হাটছিলাম। এমন কী যখন টেররিষ্টরা আমাদের সন্নিকটে তখন সে তার কথা রেখে চলেছিল। প্রতিদিন সে আমাদের অভয় দিয়ে বলতো—ঈশ্বর ইয়াজিদিদের রক্ষা করবে ।

অগণিত ঘটনা প্রতিটা মূহুর্তে মাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সাদা রং। এটাই সম্ভবত সব চাইতে প্রযোজ্য আর ভাল। ময়ূর—ইয়াজিদি মানুষদের নিকট পবিত্রতার নিদর্শন, আর সকাল বেলার সেই প্রার্থনা—কোন পাখির ছবি দেখলেই আমার মনে পড়ে যায়। একুশটি বছর আমার মাকে কেন্দ্র করে দিন এভাবেই আবর্তিত হয়েছে। রুটি বানানোর জন্য সে সবার আগে বিছানা ছেড়ে উঠতো, আমাদের বাড়ির উঠোনে পাতা তান্দুরি চুলার সামনে নিচু টুলের ওপর বসে সে একের পর এক রুটি বানিয়ে তান্দুরি চুলার গায়ে সেটে দিতো। রুটিটা ফুলে ফেপে উঠার পর সেটাকে সোনালী রংয়ের তরল মাখনে চুবিয়ে উঠাতো। একুশ বছর জুড়ে প্রতিটা সকালে তান্দুরি রুটি বানানোর সেই মধুর ছন্দের সাথে ভেড়ার মাখনের মদির ঘ্রাণে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে। আর আমাকে মায়ের বুকের নিরাপদ আশ্রয়ে আশ্বস্ত করেছে। কখনো কখনো ঘুম জড়ানো চোখে মায়ের কোল ঘেষে বসেছি। শীতের সকালে ঠান্ডায় জমে যাওয়া দুহাতের তালু তান্দুরি চুলার গায়ে চেপে চেপে ধরে উষ্ণ করার সময় মায়ের সাথে গল্পে বিভোর হয়েছি। এমন কোন বিষয় ছিল না যা, মার সাথে আলাপের সময় বাদ পড়তো— যেমন স্কুল, স্কুলের বন্ধুরা, বিবাহ অনুষ্ঠান অথবা ভাইবোনরা। বহু বছর যাবৎ আমার অন্ধ বিশ্বাস ছিল যে, সাপ আমাদের টিনের চালে ডিম পেড়ে তা দিচ্ছে বাচ্চা ফুটবার জন্য। আমি সাপদের শব্দ শুনেছি। আমি মাকে হিসহিস শব্দ করার জন্য কাকুতি মিনতি করতাম। আমার কথা শুনে মা কোন উত্তর দিত না। তার সর্বকনিষ্ট সন্তানের মুখের ওপর চোখ দুটো আটকে রেখে শুধু ঠোঁট চেপে হাসতো। ‘নাদিয়া সাপের ভয়ে একা গোসল পর্যন্ত করতে যায় না’—এসব বলে আমার সহদোর ভাই ও বোনেরা হাসি ঠাট্টা করতো। তবে একদিন যখন সত্যিই একখানা সাপের বাচ্চা আমার মাথার ওপরে গড়িয়ে পড়লো তখন তড়িঘড়ি করে আমাদের গোসলখানা মেরামত করা হলো। আমার ভাইবোনেরা সঠিক ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল— আমি সত্যিকার অর্থেই কখনো একা হতে চাইনি।

টাটকা রুটি থেকে পোড়া অংশ খুটে খুটে তোলার সময় মাকে নিয়ে  আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানাতাম।  সেলুনে কাজ করার পরিকল্পনা ত্যাগ করে বাড়িতে সেলুন ব্যবসা চালু করার পরিকল্পনা মাকে জানাই।  কোচোর বাইরের শহরগুলোতে যে সব খোল এবং আই স্যাডো জনপ্রিয় সে সব কেনার মতো সক্ষমতা তখন আমাদের পরিবারে এসেছে। সেসব দিয়ে আমিও তখন মেকআপ করতে শিখেছি। মাধ্যমিক স্কুলে ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষকতার চাকুরি নিয়েছিলাম। কাজের শেষে সারাদিন পর যখন বাড়ি ফিরে আসতাম মায়ের চোখে মুখে ফুটে উঠতো সম্মতি আর অহংকার।  গরম রুটি কাপড়ের ভেতর জড়াতে জড়াতে মা যখন বলতো—”আমাকে কখনো ছেড়ে যাসনে নাদিয়া”। আমিও সাথে সাথে উত্তর দিতাম—নিশ্চয় না, কখনো না, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।” (চলবে)

আরো পড়তে ক্লিক করুন: দ্য লাস্ট গার্ল ।। পর্ব-০৫

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্রাজিলে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ রবিউল-শায়েরাদের
ব্রাজিলে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ রবিউল-শায়েরাদের
ঢাকায় গ্রিসের দূতাবাস স্থাপন ও জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা
হাছান মাহমুদের সঙ্গে গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকঢাকায় গ্রিসের দূতাবাস স্থাপন ও জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই ধাপে কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ পালনের নির্দেশ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই ধাপে কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ পালনের নির্দেশ
তামিমের ফেরা প্রসঙ্গে শান্ত, ‘সবার আগে উনার চাইতে হবে’
তামিমের ফেরা প্রসঙ্গে শান্ত, ‘সবার আগে উনার চাইতে হবে’
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা