X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

গিরিশ কারনাড এবং তার ঘোড়ামুখো হয়বদন

ইরা সামন্ত
১৩ জুন ২০১৯, ১৭:৪৭আপডেট : ১৩ জুন ২০১৯, ১৮:২৯

গিরিশ কারনাড এবং তার ঘোড়ামুখো হয়বদন ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় গিরিশ কারনাডের নাটক হয়বদন  বা হায়াবাদানা । নাটকটি টমাস মানের উপন্যাসিকা দ্য ট্রান্সপোজড হেডসর মূলভাবের পুনঃনির্মাণ, যেটাকে তিনি এগারো শতকের কথাসরিৎসাগরের অনুসরণে ভারতীয় করে তোলেন।

হয়বদন নাটকের সর্বত্রই একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় : ‘আত্মা’ ‘আমিত্ব’ ‘স্বয়ং’ ব্যাপারটি কোথায় থাকে? শরীরে নাকি মনে?

নাটকের প্রথম অঙ্কে মানুষের দেহকে বিবেচনা করা হয়। হয়বদন এমন ব্যক্তি যিনি ঘোড়ার মাথাওয়ালা একজন মানুষ। যিনি খুঁজে চলেছেন কীভাবে নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষরূপে সম্পূর্ণ করা যায়, কারণ তিনি পুরোপুরি ঘোড়াও না, আবার পুরোপুরি মানুষও না। তিনি স্বর্গীয় রাজকুমারীর সন্তান, যে তাকে জন্মের পর থেকেই ঘৃণা করে। কারণ হয়বদনের পূর্ণাঙ্গ কোনো পরিচয় নেই, আজকের দুনিয়ায় যা প্রাসঙ্গিক। যেন কারনাড একটি কাজের খণ্ডিত অংশের ভেতর দিয়ে একটি অপূর্ণ মোটিফের মাধ্যমে অস্তিত্ববাদ অনুসন্ধান করেছেন। শূন্য থেকে তাকালে হয়বদনকে মনে হবে অসম্পূর্ণতার প্রতিমূর্তি। তার এই সমস্যা সমাধানে নাটকের কথক তাকে চিত্রকূট পাহাড়ে গিয়ে দেবীর কাছে প্রার্থনা করতে বলেন।

গিরিশ কারনাড এবং তার ঘোড়ামুখো হয়বদন নাটকে কাহিনির স্থান ধর্মপুর। গোটা নাটকটি এগিয়ে চলেছে কথক অধিকারী মশাইয়ের বয়ানে।
দ্বিতীয় অঙ্কে দেখা যায় দেবদত্ত ও কপিলা যাথাক্রমে তাদের বিদ্যা ও শারীরিক সৌষ্ঠবের জন্য ধর্মপুরে বিখ্যাত—তারা একে অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু হঠাৎ পদ্মিনী নামে এক সুন্দরী নারীকে কেন্দ্র করে শুরু হয় দু’জনের টানাপোড়েন।
দেবদত্ত শিক্ষিত ব্রাহ্মণ—কবিতা লেখে, শারীরিকভাবে চলাফেরায় অক্ষম, কপিলা ক্ষত্রিয়—পালোয়ানের মতো শক্তিশালী এবং সুন্দরী। প্রথম পরিচয়ে পদ্মিনীও কপিলার শক্তিমত্তায় আকৃষ্ট হয়। শেষমেশ দেবদত্ত ও কপিলার প্রণয় ভেঙে দেওয়া হয়, দেবদত্তের সাথে বিয়ে হয় পদ্মিনীর, কারণ জাতে সে ব্রাহ্মণ। সমাজের নিয়মে কপিলাকে সে বিয়ে করতে পারবে না। এদিকে, বিয়ের পর দেবদত্তের শারীরিক অক্ষমতা পদ্মিনীকে হতাশ করে, আর দেবদত্ত ও কপিলা একে অপরকে না পেয়ে কালক্রমে দু’জনেই আত্মহত্যা করে। পরে যদিও মা কালীর আশীর্বাদে প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু পদ্মিনীর ‘স্বেচ্ছাকৃত ভুলে’ দেবদত্ত ও কপিলের শরীর ও মাথার অদলবদল হয়ে যায়। পদ্মিনী বেছে নেয় কপিলার শরীর ও দেবদত্তের মাথা। কারণ প্রথম পরিচয়ে দেবদত্তের স্ত্রী পদ্মিনী প্রবলভাবেই কামনা করেছিল কপিলার শরীর।
নতুনভাবে জীবন ফিরে পাওয়ার পর দুটি জীবন দু’রকম আচরণ করে।
শরীর যে চিন্তার জন্য অপেক্ষা করে না এবং শুধু কাজ করে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাটকের এই অঙ্কে। আমরা দেখি পদ্মিনী শারীরিক সক্ষমতার ব্যাপারে বেশি তৎপর, যা আজকের যুগের মতোই।
অবশেষে তাকে দেখি কপিলার শরীর এবং দেবদত্ত’র মাথার সমন্বয়ে গড়া মানুষটি তাকে শারীরিকভাবে সুখি করেছে—এজন্য সে অতিমাত্রায় উচ্ছ্বসিত।
এই নাটকে অনেক মজাদার শিক্ষা আছে, হাস্যরসের মধ্য দিয়ে আপনাকে গাঢ় একটি ঘুম থেকে জাগিয়ে হালকা করে দেবে। একই সাথে সহজ এবং চিন্তাশীল একটি সময় উপহার দেবে।

কারনাড নাটকে ভারতীয় মিথ, লোককথা এবং মহাভারত-রামায়ণ সহ যাবতীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে আধুনিক রীতিতে উপস্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি স্থানিক প্রেম, পরিণয় ও যৌনতাকে মিশ্রিত করেছেন। সব মিলিয়ে নাটকটি একটি উপভোগ্য পঠন।

ভারতীয় থিয়েটারের আত্মীয় এবং আধুনিক নাট্যকলার অন্যতম চিন্তক, নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ কারনাড হয়বদন ছাড়াও বিশের অধিক নাটক লিখেছেন ইংরেজি ও কন্নড় দুই ভাষাতেই। ভারতীয় নাট্যাঙ্গনে বাদল সরকার, মোহন রাকেশ এবং বিজয় টেন্ডুলকারের মতো রথী-মহারথী নাট্যকারদের পাশে তার নাম উচ্চারিত হয়। তিনি ভারতীয় নাটককে দিয়েছেন এক অনন্য মাত্রা।

যখন তিনি নাটকে ইতিহাস উপস্থাপন করেন, তখন তিনি সমসাময়িকতাকেও স্পর্শ করেন। ১৫৬৫ সালে বিজয়নগর সাম্রাজ্য এবং চার সুলতানের মিলিত বাহিনীর যুদ্ধের কাহিনী অবলম্বনে রচিত রক্ষা টানগাডি নাটকটি এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

১৯৩৮ সালের ১৯ মে বর্তমান মুম্বাইয়ে গিরিশ কারনাড জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন কর্নাটকে। পরে অঙ্ক এবং সংখ্যাতত্ত্বে স্নাতক হয়ে রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেন। কাজ করেছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে। পরে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি অভিনয় ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।

চার দশকের বেশি সময় ধরে নাট্য চর্চার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন কারনাড। ১৯৬১ সালে তার বিখ্যাত নাটক যাত্রী রাতারাতি তাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। এরপর একে একে মঞ্চস্থ হয় তুঘলক, হয়বদন-এর মতো বিখ্যাত নাটক। হিন্দি ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ভাষার নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন কারনাড। ছিলেন একাধিক সিনেমার পরিচালকও, যার মধ্যে রয়েছে কন্নড় ও মরাঠি ছবি।

১৯৬০ থেকে কন্নড় ভাষার লেখক হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেন গিরিশ। ১৯৯৮ সালে জ্ঞানপীঠে ভূষিত হন। পরিচালক হিসেব ১৯৭৪ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী, ১৯৯২ সালে ভূষিত হয়েছেন পদ্মবিভুষণ সম্মানে। পেয়েছেন চারটি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও।

১৯৭০-এ মুক্তিপ্রাপ্ত সংস্কার ছিল গিরিশের অভিনীত প্রথম সিনেমা।

তিনি জীবনে আলোচিত সমালোচিত দুটোই হয়েছেন। ২০১২ সালে রবীন্দ্রনাথকে "তিনি একজন মহান কবি, কিন্তু একজন মাঝারি মানের এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাট্যকার" বলে আলোচনায় এসেছিলেন, কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র তিনি নন। আত্মপক্ষ সমর্থনে গিরিশ কারনাড দু’একটি যুক্তি দিয়েছিলেন। যেমন, রবীন্দ্রনাথ গরিব মানুষকে চিনতেন না, তাই তার নাটকে গরিব মানুষদের বানানো, অর্থাৎ কৃত্রিম, অস্বাভাবিক এবং অবাস্তব চরিত্র বলে মনে হয়। কেবল নাটক নয়, রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, আখ্যান-কবিতা ইত্যাদি পড়তে গিয়েও অনেক সময়েই খটকা লাগে, সবাই কেমন যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই কথা বলছে, না? আমরা এই খটকাটুকুর কথাই বলতে পারি।

গিরিশ কারনাডের দ্বিতীয় যুক্তি, দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের নাটক দেশদুনিয়ায় বিশেষ অভিনীত হয়নি, তার সমকালের বাংলা মঞ্চেও খুব একটা নয়। এটা কোনও বিচারের প্রশ্ন নয়, তথ্যের প্রশ্ন, যাকে বলে ‘কোয়েশ্চেন অব ফ্যাক্ট’। 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
গ্রেনাডাতেও ওয়েবস্টার-ক্যারির ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ালো অস্ট্রেলিয়া
গ্রেনাডাতেও ওয়েবস্টার-ক্যারির ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ালো অস্ট্রেলিয়া
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি