মারুফা মিতা তার কবিতার পাণ্ডুলিপি ‘বোতামঘর’-এর জন্য জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার ২০২১ পেলেন। আজ সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে তাকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। মারুফা মিতার জন্ম ১৯৮৭, রংপুর জেলার হারাগাছ (সারাই)। পেশায় অনুবাদক। বসবাস করছেন রাজশাহী শহরে।
সমুদ্র দেখা
সমুদ্র দেখার মতো কিছু একটা হবে হয়তো
অথচ এই সব সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত খেলায় শরীর খারাপ হয়ে ওঠে, ব্যারামের মতন করে।
তবু সমুদ্র দেখতে আসা...
অন্ধ পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে যত অকল্যাণ
ফেনিয়ে ওঠা মুহূর্ত ফুরিয়ে যাবার আগেই অর্থহীনতা... মগজে, মননে।
একটা সমুদ্রের সামনে মানুষ কেন আসে?
বোধে?
কেউ কি গভীর হয়ে ওঠে?
অথচ ‘গভীর হওয়া’ মানে তো বিপন্ন বোধ, কোনো পাঠলুপ্ত গ্রন্থ।
(এই সব আজাইরা প্যাঁচপ্যাঁচানি একজন নামিবিয়ান দার্শনিকের কথা মনে করিয়ে দেয়। যার এপিটাফে একগ্লাস অন্ধকার ঢেলে দিতে ইচ্ছে করে সবসময়।)
সমুদ্র দেখতে আসা লোকটি রাতের বেলা একা জেগে থাকল লাল মদের দক্ষতায় অথচ এখনও তার পর্যাপ্ত বয়স হয়নি মাতাল হবার। যে টিকিটিকি হোটেল কক্ষের দেয়ালে দেয়ালে চক্কর দিচ্ছিল, তার লেজ খসে পড়ল ফজরের আজানের আগেই। ঘুমন্ত বউটির মুখে টিকটিকি বাসি ছায়া ফেলে রেখেছে।
‘বেসিকেলি সমুদ্র একটা গৃহপালিত প্রস্রাবখানা’
এই বলে লোকটি বিকৃত মুখ করে বসে রইল দুপুর অবধি।
একটু দূরে আট বছরের মেয়েটি অরিগামি পেপারে পাখি বানাচ্ছিল, উড়াবার সংকল্পসমেত।
যে দৃশ্যগুলো নিয়ে পালিয়েছে পাখিবেলা
কড়াই কাঠের ঘ্রাণ নিয়ে রেহেলের নিচে গূঢ়লিপির অন্ধকার
ও ছায়া ছায়া সম্পর্কগুলো।
কেউ কি ডাকে?
হেমন্তের নদী পিপাসার কাছে এলে
জৈবচারণে ক্রমশ ভেঙে যায় দীর্ঘ মৌনতাকাল
এসবেই যেন—শূন্য ও অনন্তে সহজ পাঠ।
স্বল্পদৈর্ঘ্য রোদের দিনে
ভাতমাখা ঠোঁটে পাখিরা ফিরে আসবে
মরা ডালের মতো তাদের কাঁদাপায়ের ছাপ উঠোনে স্পষ্ট হবে
এরকম কোনো কথা ছিল না
তবু আমরা শুকিয়ে যাচ্ছিলাম সহজ প্রেমে,
আর অবাক হয়ে দেখতাম—
মায়ের কানপাশায় নদীজাত রুহু দুলছে!
অজ্ঞাত শামুকের গান
ব্যক্তিগত উচ্চারণে হারিয়ে যাচ্ছে খয়েরি উৎসবের দিন
শীতপ্রধান ট্রেনে রোদ জিরিয়ে নিচ্ছে যতিচিহ্নের আয়ুতে।
কয়েকজন চেনা বন্ধুর নদীর কাছে যাওয়ার দাবি...
পৌঁছে গেছে অসুখের বিকেল। পকেটে ধূসর টিকিট।
কেউ ভাবছে, কারও প্রার্থনার ভিতর ধৈর্যশালী হয়ে উঠুক কফিনের শেষ পেরেকটি।
নগরের ফায়ারওয়ার্কসে অন্ধতা পুড়ছে
ঐ পাড়ে মোহর আকাশ... নিখুত ঘুমের ভঙ্গিমা
আর আমরা তাঁবুর ভিতর আড়াইদিন
ফের ডুবোপাহাড়... কারখানার নিচু গলি
ফের ঘুমন্ত ফুসফুসের মার্কেটিং
আমাদের গান স্পষ্টত ক্লোরোফিলের গর্ভে জড়াচ্ছে।
একটা আপেল, একটা শুশুক, ও একটা টবের দামে
বস্তুত, কতগুলো স্যাঁতস্যাঁতে দুরবিন জন্ম নেয়।
ঝুপঝাপ সন্ধ্যা নামলেই তরমুজের আড়তে ফালা ফালা তরমুজ কাটি কেউ কেউ। তরমুজের লাল হাতে লেগে যায়, জামায় ছিটকে আসে, আসতেই থাকে। আর ওই দিকে একটা বিড়াল ঘুমায় খালি, ওর স্বপ্নে বুড়াকালের আমরা হাঁটাহাঁটি করি। এরকম একটা চুতিয়া অসুখ করেছে আমাদের।
অথচ আমরা আঙুলে সারস অক্ষর সাজাতে চেয়েছিলাম
নিরিবিলি হাতে বর্ষাগাঢ় পালংখেত।
পাখিদের বাড়িতে কোনো জুতার র্যাক নেই
আমরা কয়েকদিন থেকে পাখিদের বাসায় আছি, পেয়িং গেস্ট হিসেবে। প্রথম প্রথম ঘুলঘুলির ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকতে অসুবিধা হতো, এখন সয়ে গেছে, যেমন করে রিকশা গাড়ির ভিতর দিয়ে গা বাঁকিয়ে, গা বাঁচিয়ে রাস্তা পার হতে হয়, অনেকটা তেমনই। এখানে আমরা খাইদাই, বিকেলে ভাতঘুম... সন্ধ্যায় সাপলুডু।
পরশু কী মনে করে, আমরা সদলবলে বালুতে স্নান করলাম। কেউ কেউ ডুমুরে মুখ লাগাচ্ছি, কেউ-বা নখ কাটা ছেড়েছি আগেই।
১২ই জুন আমাদের পাখিবাড়িত্যাগ দিবস।
এইখানে পাখির মতো মিছেমিছি যাপন নিয়ে ভাবি, উড়বার কলাকৌশল রপ্ত হতো যদি!
নেপথ্যের
স্টেশনের ছায়া ভেঙে ভেঙে
সমস্ত চমৎকার তুলে নিয়ে যায় রানঅ্যাওয়ে ট্রেন।
হেমন্তে হারিয়ে যাওয়া তুমি
সেবছর আমাদের স্কুলড্রেস কাঞ্চন ফুলের শরীর পেয়েছিল,
অথচ তোমার ওড়নার ভিতর শ্যাওলা ঘনিষ্ঠ আচরণ, এসবই
পেসিমিস্টিক ধারণাকে আরও রগড়ে দেয়।
সন্ধ্যার পাঠ্যবই খুললে—
দ্বিপদ সমীকরণ মেলানোর আগেই
পূর্বপরিচিত টিকটিকি বেরিয়ে আসে,
হলুদ দেয়ালের আলো গিলে খায়, সমস্তটাই।
আর আমি এই তল্লাটের বাতিল পাতকুয়োর ভাষা পড়তে চাই, যেখানে
জাপানি সেক্সটয়ের মুখ ভেসে ওঠে,
অর্গাজমের সময় মনে হতে থাকে—
জুলাইয়ের বাতাসে অসংখ্য ঘুম নিয়ে
একটা পলিথিন ব্যাগ সামান্য ঊর্ধ্বে উড়ে পাক খায়।