সেদিন ঘুম থেকে উঠেছি একটু দেরিতে। বিছানায় কাত হয়ে মুঠোফোনে ‘স্পীগেল’ পত্রিকার পাতা উল্টাতে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ে ইসমাইল কাদারের মৃত্যুর খবর। খবরটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো চারপাশে পাক খেয়ে ঘুরছে কিছু বই পড়ার স্মৃতি। একপাশে কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’, কুন্দেরার ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’, অন্যপাশে কাদারের ‘দ্য পিরামিড’ ও ‘দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’। মাথার উপরে অনবরত ঘুরছে ‘কী ভাবছে এই পাহাড়েরা’ সিরিজের কবিতাগুলো।
মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে কী সাংঘাতিক উপন্যাস লিখেছিলেন কাদারে! মুসোলিনির মুঠোর ভেতরে নিজের অস্তিত্ব খুঁজতে খুঁজতেই বোধহয় এমন উপন্যাস লেখা হয়ে গেছে। প্রথম উপন্যাসেই তার রাজনীতি-সচেতনতা প্রকট। কাহিনির প্রতি পরতে পরতে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন দিক নিয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইতালি থেকে মুসোলিনির একদল সেনা এসেছিল আলবানিয়ায়। যুদ্ধে মারা গিয়েছিল প্রায় সবাই। তাদের কবর দেওয়া হয়েছিল আলবেনিয়ার এক পাহাড়ের উপরে। এরপর ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে, এক তরুণ ইতালীয় জেনারেল একজন পুরোহিতের সঙ্গে আলবেনিয়ায় আসেন মৃত সেনাদের দেহাবশেষ খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ইতালি নিয়ে গিয়ে সরকারি মর্যাদায় নতুন করে দাফন করা তার মূল লক্ষ্য। যত কবর খোঁড়া হয় ততই বের হতে থাকে একের পর এক ইতালিয় সেনার কঙ্কাল। জেনারেল চোখ বড়ো করে কেবল তাকিয়ে থাকেন, যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আসলেই কি সবাই ইতালীয় সেনা, নাকি আলবেনিয়ারও কিছু আছে? তারপরও তারা ইতালীয় সেনা চিনতে পারে, কঙ্কাল আলাদা করার সময় আরও বিস্মিত হয়; ইতালির এতো সেনাও মরেছে? জেনারেলের কথায় যুদ্ধের অসারতা এবং উদ্যোগের অর্থহীনতা উঠে আসে। পুরোহিত বারবার মাথা নাড়েন। আলবেনিয়ান গ্রামাঞ্চলের ভেতরে যাওয়ার পর তারা দেখতে পায়, তাদের মতোই আরেকজন জেনারেল যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত জার্মান সৈন্যদের মৃতদেহ খুঁজছেন। তাদের দুজনের ভেতরেই যেন আত্মগ্লানি কুরে কুরে খাচ্ছে। খুনটা যেন তারাই করেছে। যেন কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’-এ ‘কুকুরের মতো’ মরে যাওয়া জোসেফের শেষ মুহূর্তের উদ্বেগ এবং হতাশার সঙ্গে এই গ্লানির কোনো পার্থক্য নেই। জোসেফ যেন নিজেকেই খুন করেছে। তাকে হত্যা করা সেই পরিত্যক্ত খনি যেন পাহাড়ের উপরে কাদারের রচনায় ইতালীয় সেনাদের গোরস্তান, যেখানে জেনারেল বারবার নিজের ভেতর ঢুকে পড়েন আর পীড়িত হন। যেন কাদারের উপন্যাসে ঢুকে দস্তয়েভস্কির ‘অপরাধ ও শাস্তি’র রাসকোলনিকভ খুন করার পর নিজের আত্মগ্লানিতে ভুগছে।
ইসমাইল কাদারের লেখায় রাষ্ট্র আর রাজনীতি আমাদের চোখে ধরা পড়ে ইউরোপীয় আলো আর প্রাচ্যের শরীরে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে বেড়ে ওঠা আর বারবার দেশান্তরিত হাওয়ার ভেতরে নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে কাদারে তৈরি হয়েছেন। ‘দ্য পিরামিড’ কেবল পিরামিড প্রকল্পের অপরিসীম দুর্ভোগ এবং অযৌক্তিকতাকে তুলে ধরে না, একই সঙ্গে সাধারণকে নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে আমাদের সামনে রূপক হয়ে দাঁড়ায়। শাসকের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও স্বৈরাচারের প্রতীক হিসেবে স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে মানুষের প্রচেষ্টার অসারতা দেখায়। এসব কথা ভাবতে গেলে কুন্দেরা প্রাংশু হাসি নিক্ষেপ করেন। তাকে তো নির্বাসিতই হতে হয়েছিল। ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’-এ সোভিয়েত আক্রমণসহ চেকোস্লোভাকিয়ার রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার ভেতরে টমাস এবং তেরসার জুরিখে পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে স্বৈরাচারী সরকারের হুমকিতে কিংবা আশঙ্কায় বা গ্রেপ্তারের ভয়ে; কাদারের ফ্রান্সে চলে যাওয়ার সঙ্গে আপতিক সরলরেখা আঁকা না গেলেও দুটোর ভেতরকার অস্তিরতাকে একটি বৃত্তের ভেতরে যেন ফেলা যায়।
সাহিত্যকর্ম আর তার পেছনে কাদারের ভাবনা ও দর্শন সরলীকরণ করে দেখার সুযোগ নেই। অপরিমিত পাঠ এবং এই ছোট্ট লেখায় মহান কাদারেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা আমার অপারগতাকেই কেবল চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে। এ কারণে আর দুটো কথা বলে শেষ করা যাক।
কাদারের সাহিত্যজীবন শুরু হয়েছিল কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। কবিতা লিখে স্বদেশে ব্যাপক পরিচিতিও পেয়েছিলেন, কবিতার কারণেই প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলেন, যিনি পরে তার স্ত্রী হন। কিন্তু সে কবিতা কেবল সৌন্দর্য নির্মাণের জন্য নয়, তার কবিতা সবসময়ই আলবেনিয়া ও বলকান অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটকে গভীরভাবে প্রতিফলিত করেছে। উপন্যাস কিংবা কবিতা, সবখানেই সেই আলবেনিয়া। পাহাড়ে ঘেরা দেশ হাওয়ার কারণেই হয়ত তার সাহিত্যে পাহাড় এসেছে হাজারভাবে। উপন্যাসের মতোই কাদারের কবিতাও তার রাজনৈতিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।
অন্য রচনার মতো কাদারের কবিতা ব্যাপকভাবে ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি। সে কারণে তার ইংরেজিতে অনূদিত কবিতা পড়তে বিভিন্ন সংকলনের দারস্থ হতে হয়। বিভিন্ন কবিতার মধ্যে কাদারের ‘কী ভাবছে এই পাহাড়েরা?’ সিরিজের কবিতাগুলো সবচেয়ে বেশি স্পন্দিত করেছে। এই সিরিজের কবিতায় আলবেনিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির ভেতরে তিনি সে দেশের মানুষের সংগ্রাম এঁকেছেন, প্রতীকী ভাষায় আলবেনিয়ার ইতিহাস এবং তার জনগণের দৃঢ়তার কথা বলেছেন। বিভিন্ন সময় করা অনুবাদ থেকে সম্পাদনা করে কয়েকটি প্রকাশ করা হলো।
কী ভাবছে এই পাহাড়েরা?
১
হাইওয়ে থেকে কিছু দূরে যখন রোদ্দুর পড়ে আসে
কী ভাবে তখন এই উঁচু পাহাড়েরা?
মাটিতে লম্বা রাইফেলের একশ মাইল বিশাল ছায়া ফেলে
কোনো এক পর্বতারোহী রাতের আড়ালে যাত্রা শুরু করে।
পাহাড়, সমতল গ্রাম জুড়ে
ছায়ারা তাড়াহুড়ো করে আর
আবছায়ার ভেতরে কেবল পিছলে যায়।
পাহাড়ের ধার ধরে আমিও রওনা করি
মনের ভেতরে কোথাও ভাবনা নিয়ে।
ভাবনাগুলো আর রাইফেলের ছায়া
গোধূলিতে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়
আর টক্কর লাগে।
২
এইতো এভাবেই তুমি তুমি বের হও আলবেনিয়া,
দীর্ঘ পায়ে
লম্বা রাইফেল হাতে করে।
কোথায় যেতে হবে না জেনে তুমি শুধু হেঁটে গেছো
মেঘ আর কুয়াশাভরা
অনুজ্জ্বল গম্ভীর সকালের দিকে
যদিও ততক্ষণে রাত নেমে গেছে
৬
তোমার অরণ্য খুলে আনা
হাতের-খোদাই আসবাবে
থির হয়ে বসে ছিল কবিরা
আর তোমারই কথামতো লিখেছিল
বার্নিশ লাগানো উজ্জ্বল কাঠের কথা
আর তাদের পিতামহ বৃক্ষরাজির কথা,
যাদের ভেতর ঘুরে ঘুরে
পাপিয়া পাখিরা একদিন গান করে ফিরে গেছে।
তারা ভুলে গিয়েছিল
তোমার অরণ্যে
অনেক নেকড়ে ছিল
কেবল পাখিরা ছিল কতিপয়।
৭
হিংস্র শত্রুরা সীমান্তের গায়ে থাবা মারে,
থাবা মারে জন্মভূমির পাণ্ডুর অনাবৃত কাঁধে
টলটলে উঠে দাঁড়ায় দেশ,
তার চোখে ভুখ আর জ্বর জ্বলজ্বল করে।
তবুও সে ক্ষুধা ভুলে যায়,
সীমানার বিস্তৃতি জানতে রাত্রিতে এগিয়ে যায়।
ফুট মেপে মেপে?
গজ-লাঠি হাতে?
না,
লম্বা রাইফেল নিয়ে।
১১
যদি পাহাড়ের ধারে কাউকে কুপিয়ে মারা হয়
আর কারও জন্ম হয় অন্য কোথাও,
যেন সে পৃথিবীর আড়ালে
বিশীর্ণ আলবেনিয়ান।
মজবুত হাতের মতো
তার গায়ের উপরে
লম্বা রাইফেল
কালো গোলাপ হয়ে ফুটে থাকে।
সেই রাইফেল হাতে করে
পাহাড় কিংবা সমতল
সবখানে চরে বেড়ায় সে-
রাইফেল তাকে দীর্ঘকায় করে তোলে
যদিও কখনো সময় ফুরিয়ে আসে দ্রুত।
[দ্রষ্টব্য : ‘কী ভাবছে এই পাহাড়েরা?’ সিরিজের কবিতাগুলো আলবেনীয় ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। আলবেনিয়ান থেকে রবার্ট এলসির অনুবাদে ১৯৯৩ সালে লন্ডনের ফরেস্ট বুকস থেকে An elusive eagle soars, anthology of modern Albanian poetry সংকলনে প্রথম ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা ৮৮-৯৬। কাদারে তার কবিতায় অন্তমিল রক্ষা করলেও ইংরেজি অনুবাদে তা রক্ষিত হয়নি।]