X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাটক স্তালিন প্রসঙ্গে

চঞ্চল আশরাফ
১৯ আগস্ট ২০১৯, ১২:০৫আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০১৯, ১২:২০

নাটক স্তালিন প্রসঙ্গে
সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের সাম্প্রতিক প্রযোজনা স্তালিন । নাটকটির নির্মাতা ও নির্দেশক কামালউদ্দীন নীলু। বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক পরিস্থিতির রূপক হিসেবে এর মঞ্চায়ন, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র জোসেফ স্তালিন। অত্যন্ত নির্মোহ ও পক্ষপাতহীনভাবে স্তালিনের জীবন রূপায়নের মধ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতাকেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ চিত্র। তাতে এই বার্তা দৃশ্যশ্রাব্য হয়ে উঠেছে যে, ব্যক্তির সর্বময় কর্তৃত্ব কোনো আদর্শ বা মতবাদের জন্য নিরাপদ হতে পারে না। পরোক্ষে এই পাঠ তৈরি হয়েছে—কোনো আদর্শের নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির একচ্ছত্র ক্ষমতাচর্চা পরিত্যাজ্য। কিংবা তা উহ্য বা সামলে রাখতে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ইতিহাসের দিকে তাকালে স্তালিন  নাটকটিতে বিধৃত এই সত্যের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়।

নাটকটির অভিপ্রায় প্রকাশের ক্ষেত্রে কামালউদ্দীন নীলু বেছে নিয়েছেন এমন এক আঙ্গিক যা বাংলা নাটকের প্রথা ও প্রচলনকে নস্যাৎ ও অতিক্রম করে। বিষয়বস্তুর দিকে সঙ্গতি রেখেই তিনি প্রণয়ন করেছেন এর নকশা, অভিনয়রীতি, ফিউশনের ধারা, সঙ্গীত এবং অন্যান্য উপাদান। শুরু থেকেই এটি স্পষ্ট; যেমন—নাটকটির সূচনা তিনি ঘটিয়েছেন মঞ্চের বাইরে, এমনকি মিলনায়তনের প্রবেশস্থল থেকে, সেখানেও তিনি একটি সেট তৈরি করেছেন। অর্থাৎ একটি ননফর্মাল স্পেস থেকে নাটকটি এক্সট্রাফরমাল স্পেস হয়ে ফর্মাল স্পেসে প্রবেশ করেছে। উল্লেখ বাহুল্য নয়, মঞ্চায়ন সম্পর্কিত পূর্বানুমান নিয়ে হাজির হওয়া দর্শকদের নতুন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন নির্দেশক। তাদের তিনি নাটকের অংশ করে তুলেছেন, ফলে পলিটব্যুরো সদস্যদের ক্যাপ দর্শকদের পরতে হয়েছে। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক হয়ে স্তালিন এবং স্তালিনোত্তর সেই সময়প্রবাহকে প্রত্যক্ষ করেছেন। পরবর্তীকালের প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে স্তালিনকন্যা সাভেৎলানার চোখে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা অতি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের বাস্তবতা ও পরিণতি দেখানো হয়েছে। সময়পরিসরকে এখানে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সাভেৎলানার পোশাকেই সেটা দৃশ্যমান। এমনকি, সেখানকার দৃশ্য-পরিকল্পনায় সফোক্লিসপূর্ব গ্রিক নাটকের রীতিও অনুসৃত। একদিকে সাভেৎলানার পোশাকে গ্রিক এবং সমকালীন প্যাটার্নের সমন্বয়, অন্যদিকে প্রাচীন গ্রিক নাটকের কোরাসের আদলে এর দৃশ্যায়ন—যাতে সৃষ্টি হয়েছে সময়ের ভেতর সময়ের স্পন্দন, স্পেসের ভেতর স্পেসের প্রতীয়মানতা। এটি মিশেল ফুকোর হেট্রোটোপিয়ান ধারণার প্রতিভাস ঘটায়, যার ফলে এক স্পেসের মধ্যে অসংখ্য স্পেসের উপস্থিতি প্রামাণ্য হয়ে ওঠে। ফর্মেশন এবং ডিফর্মেশনের মধ্যে নাটকটির আসা-যাওয়া। স্তালিনের জীবন-প্যাটার্নও তাই। উদাহরণ হিসেবে আরও বলা যায়, স্তালিন এবং সাভেৎলানা কেউই আগের মতো থাকছে না—তারা ভ্রমণ করছে একটি মর্মান্তিক পরিবর্তনশীলতার ভেতর দিয়ে। তাদের সংলাপ, অভিব্যক্তি, ভঙ্গিমা সবকিছুর মধ্যে ফরর্মেশন এবং ডিফর্মেশনের নিরন্তর একটা খেলা নির্দেশক দেখিয়েছেন। তাতে রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ইশারাটিও দুর্লক্ষ্য থাকে না। সেদিক থেকে এটি একটি সিম্বলিক নাটক—তবে নাট্যকলার পরিভাষায় একে ব্ল্যাকড্রামা বা ব্ল্যাক কমেডি বলাই সঙ্গত। কারণ নানা ক্যারিকেচারের মধ্য দিয়ে হাস্যরসের উদ্রেক হলেও দর্শকদের স্নায়ুতে তা সৃষ্টি করে এমন এক চাপ ও প্রতিত্রিয়া, যাতে তারা শেষ পর্যন্ত বিনোদিত হতে পারে না—একই সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সমকালীন বাস্তবতা এবং সে সম্পর্কিত বার্তা নিয়েই তারা মুহ্যমান হয়ে পড়ে। নির্দেশকের অভিপ্রায় সম্ভবত সেটাই। অন্যদিকে সারা পৃথিবীতে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, তার আড়ালের বাস্তবতাও দৃশ্যমান হয়েছে নানা প্রতীকের সমবায়ে। এমনটি করতে গিয়ে নির্দেশক বিশ শতক ও সামকালীন শিল্পপ্রকরণ ও মতবাদের একেকটি প্রান্তকে নাটকসৃষ্ট স্পেসে এনে জড়ো করেছেন। যেমন—মিনিম্যালিজম, অভিব্যক্তিবাদ, রুশ প্রকরণবাদ, উত্তর কাঠামোবাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদের বিভিন্ন অংশ ও উপাদান। অভিব্যক্তিবাদী শিল্পরীতি অবলম্বন করেছেন নাটকের পাত্রপাত্রীর অভ্যন্তর ও আচরণকে প্রতীকায়িত করার জন্যে। ফলে, অভিনয় হয়ে উঠেছে সাইকোফিজিক্যাল। মঞ্চসজ্জা, সঙ্গীত, আলো ও রঙের ব্যবহার ইত্যাদি মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে এক ধরনের ইলিউশন বা প্রপঞ্চের জগত যা রুশ প্রকরণবাদী শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য বা পদ্ধতি। পাত্রপাত্রীর মাস্ক মেকাপও এর অন্তর্ভুক্ত। সবই প্রতিপাদ্যের সঙ্গে ঐক্য রক্ষা করেছে বলে মনে হয়।

বলা দরকার, আসনের বাইরে দর্শকদের দাঁড় করিয়ে নাটক দেখানোর টেকনিকটি নির্দেশকের উত্তরকাঠামোবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিভাত করেছে। যা হোক, স্তালিনকন্যা সাভেৎলানার ভূমিকা দিয়েই হলের বাইরে নাটকের শুরু। মনে হতে পারে, একটি একাঙ্কিকা শুরু হয়েছে, এবং আরও লক্ষযোগ্য যে ওই চরিত্র নাটকটির সময়, স্থান, কুশীলবদের নিয়েও কথা বলছে। এই ইন্টারাপশনও উত্তরকাঠামোবাদী চেতনার পরিচয়বাহী । যদিও তাতে উঠে এসেছে ব্যক্তি এবং সে সম্পর্কিত বয়ান। ব্যক্তি এই মঞ্চের অধিকর্তা, তা দেখানোর জন্য সাভেৎলানা দর্শকদের হলের ভেতর মূল মঞ্চের সামনে নিয়ে যায়। সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘আইভান দ্যা টেরিবল’ ছবির একটি ক্লিপ দিয়ে হলের ভেতরকার নাট্যাংশ শুরু হয়। ক্লিপ শেষ হতেই দেখা যায় আইজেনস্টাইন দাঁড়িয়ে আছে সোভিয়েত পুলিশের বন্দুকের সামনে এবং স্তালিনের স্বর ভেসে আসে—‘বন্ধ করেন এই ছবি!’ সংশ্লেষণটি ইঙ্গিতবহ। স্তলিনের রাজত্বকালে সৃষ্টিশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তি কতটা বিপন্ন ছিল, তা বোঝাতে এরচেয়ে বেশিকিছুর প্রয়োজন নেই। এরকম বহু ইঙ্গিত রয়েছে নাটকটিতে। এর মঞ্চ ও চরিত্রসজ্জা দ্বিমাত্রিক, বিষেশত রঙের ব্যবহারের দিক থেকে। ইউরোপীয় চিত্রকলার ছাপ একদিকে যেমন পরিস্ফুট অন্যদিকে অভিব্যক্তিবাদী শিল্পমতবাদের স্পন্দনও এতে টের পাওয়া যায়। যেমন, স্তালিন ছাড়া বাকি পাত্রপাত্রীর মেকাপ মুখোশের আদলে করা হয়েছে। এমনটি হয়েছে ব্যক্তি হিসেবে স্তালিনের আধিপত্য দেখানোর জন্য এবং এর সামনে অন্যদের ভূমিকা ও স্বরূপ তুলে ধরার অভিপ্রায় থেকে। দেখা যায়, লাল রঙের পটভূমিতে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর আঁকা দি লস্ট সাপারের টেবিলে যিশুরূপী স্তালিন তার অনুসারীদের সঙ্গে নানা বিষয়ে বিচিত্র আলাপে মত্ত। তাতে স্থান পাচ্ছে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, কুটনীতি, যুদ্ধ, দমন-ছাটাই, গুপ্তপুলিশের কর্মকাণ্ড, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, জনগণ ইত্যাদি। বোঝা যায় এক ক্ষমতাবান ব্যক্তির সামনে পলিটব্যুরোর সদস্যরা আসলে চাটুকারের একটা দল, ষড়যন্ত্র এবং তোষামোদ ছাড়া তাদের কোনো কর্তব্য নেই। লক্ষণীয়, ক্ষমতার অধিকারী ও সেই দলের বাইরে আর কাউকে মঞ্চে দেখা যায় না, মানে জনগণের কোনো উপন্থিতি এই নাটকে নেই। তাতে এটা প্রতীয়মান, একনায়কতন্ত্রে জনগণের কোনো স্থান নেই, নাটকের এক জায়গায় বলা হয়েছে—তারা ‘সংখ্যা’মাত্র। দৃশ্য পরিকল্পনায়ও নির্দেশক বজায় রেখেছেন প্রতীক-ইঙ্গিতের প্রাধান্য। ফলে দেখা যায় সেট বদলের সময় উর্দি পরা লোকজনই সক্রিয়।

কামালউদ্দীন নীলুর এই স্তালিন  নাটকটির তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা কী? শুধু কি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের ইতিহাস ও কারণ বোঝার জন্য? এমন-কি গণতন্ত্রের মোড়কে বিশ্বব্যাপী একনায়কতন্ত্রের যে উপদ্রব চলছে, কেবল সেই অভিজ্ঞতা মঞ্চ থেকে গ্রহণ করার জন্য? এসব তো এ নাটকে রয়েইছে প্রতিপাদ্যগত অনিবার্যতা নিয়ে; এবং এতেই যদি নাটকটির মর্ম নিঃশেষিত হতো, আমাদের আপত্তির কিছু থাকতো না। কেননা শিল্পকর্ম হিসেবেও নানাভাবে এর উত্তরণ ঘটেছে। তাহলে স্তালিন  মঞ্চে এবং এর বাইরে কী বিশিষ্টতা নিয়ে হাজির হয়েছে? জবাব : এটি সৃষ্টি করেছে এক প্রসারণশীল রূপক, যার অর্থ অনেকান্ত, ভাষ্য বহুমুখী, ব্যাখ্যা অনিঃশেষ। তবে ঘুরেফিরে এই মর্মে আমরা উপনীত হই : ব্যক্তির সর্বময় কর্তৃত্বের মধ্যে আদর্শ টিকে থাকতে পারে না।

 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বাধিক পঠিত
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি