X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
ব্রেইল সংস্করণের প্রাক্-কথন

পিস এন্ড হারমোনি

অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:৩০আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:৩০

ব্রেইল এক বিশেষ ধরনের লিখন ব্যবস্থা। দুই হাতের সাহায্যে এ লিপির পাঠ গ্রহণ করতে হয়। দুর্বল দৃষ্টিশক্তি বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিদের পাঠদানের জন্য এ লিখন প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয়েছে।

মানুষ নিরক্ষর বা দৃষ্টিহীন হলে যে জ্ঞানী হবেন না—এ কথা মানা যায় না। প্রবাদ আছে, ইলিয়ড মহাকাব্য ‘অন্ধকবি’ হোমারের রচনা। এ মহাগ্রন্থ পাঠ করলে এ তথ্য স্বীকারে আমার মতো অনেকেই দ্বিধাপন্ন হবেন। আমাদের বাউল সাধক ফকির লালন শাহ্র গানের অন্তর্গত তত্ত্ব ও লালন দর্শন আমাদের যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। আমরা জানি না, কোন বিদ্যালয়ে লালন শাহ্ পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। ‘অন্ধজনে দেহ আলো’—এ কথা বহু উচ্চারিত, গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ও আমাদের তা মানবিক দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানায়। কিন্তু আমরা খুব কমই এ আহ্বানে সাড়া দেই। বস্তুত দেশের দৃষ্টিহীন ও নিরক্ষরদের শিক্ষিত ও স্বাক্ষর করে তোলার এবং তাদের প্রতিভার বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব আমাদের সবার। এতকাল সে সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন তো সে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি (devise) আমরা পেয়েছি। কয়েকটি শিক্ষাকেন্দ্রের ওপর নির্ভর করে তাই দায়মুক্তির সুযোগ নেই। এ মানবিক দায়িত্ব আমাদের সবার। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই এক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনতে পারে।

বর্তমান গ্রন্থ ‘পিস অ্যান্ড হারমোনি’ (২০২০) ব্রেইল পদ্ধতিতে মুদ্রিত বঙ্গবন্ধুর আত্মজা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎসর্গীকৃত। গ্রন্থটির ব্রেইল সংস্করণের পরিকল্পক, সংকলক, ইংরেজি অনুবাদক, সম্পাদক আনিস মুহম্মদ।  প্রচ্ছদ শিল্পী মাসুক হেলাল। গ্রন্থবদ্ধ কবিতার সংখ্যা একাত্তর।

ইতিহাসে একটি কথা আছে : ইতিহাসের শিক্ষা সবাই গ্রহণ করতে পারেন না। যাঁরা পারেন তাঁরা সৃষ্টি করেন নতুন ইতিহাস। জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই চেতনায় পুনর্জাত ও প্রতিজ্ঞাদীপ্ত হয়েছিলেন। সবার মধ্যে অবস্থান করেও তিনি চেতনায় ছিলেন ব্যতিক্রমী ও নিজের প্রতিজ্ঞায় সুস্থির। সমকালীন রাজনৈতিক ধারা তাঁকে টানেনি। অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন যে, দ্বিজাতিতত্ত্বে মানুষে মানুষে বিরোধের প্রাচীর ক্রমান্বয়ে প্রসারিত ও দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে উঠবে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের পরিচয়কে প্রাধান্য দিলে এদেশের মানুষ হবে আরো নিঃসঙ্গ ও পরস্পর দূরবর্তী। ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে মানুষ, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। ভাষা-সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য তো থাকতেই পারে। এ ভূখণ্ডে সুদীর্ঘকাল ধরে যে মানুষ জনগোষ্ঠী বংশপরম্পরায় বাস করে আসছে, এদেশের প্রকৃতি ও জল-হাওয়ায় যারা লালিত ও পুষ্ট হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও অচ্ছেদ্য আত্মীয়তার বন্ধন। তারা কখনোই পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। তারা একে অন্যের সহমর্মী, সমব্যথী ও আনন্দ-বেদনার সঙ্গী। তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার প্রাধিকার এদেশের মাটি ও মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর থাকতে পারে না। জল-জলা-জঙ্গল অধ্যুষিত বাংলার সন্তান বঙ্গবন্ধুরই কেবল সে অধিকার রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বেই আমাদের দেশবাসীর স্বপ্ন ও অধিকার বাস্তবনিষ্ঠ রূপ পেয়েছে। এজন্য তাঁকে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে জেল ও জুলুমসহ অশেষ নিগ্রহ। পাকিস্তানি শাসকচক্র তাঁকে শুধু বন্দি ও কারারুদ্ধই করেনি; তাঁকে হত্যার যড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু কুচক্রীদের সকল অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। তিনি ফিরে আসেন তাঁর সোনার বাংলায়, তাঁর বাংলার মানুষের কাছে। তিনি শুরু করেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে; কিন্তু আরাধ্য সকল কর্মসম্পাদনের সুযোগ পাননি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের চক্রান্তে ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট তিনি সপরিবারে শহিদ হন। ব্যতিক্রম কেবল তাঁর দুই কন্যা—শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বিদেশে অবস্থানের কারণে এই জিঘাংসা তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি।

ব্যক্তিমাত্রেরই জন্ম-মৃত্যু রয়েছে। কিন্তু যেসব মানুষ ব্যক্তি ঊর্ধ্ব তাৎপর্য বিশিষ্ট ও মহিমান্বিত তাঁদের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যায় না। বঙ্গবন্ধু সেই বিরল মহিমায় গৌরবান্বিত। তিনি শুধু আমাদের জাতিসত্তার স্থপতি, জাতিরাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা নন, সকল নিপীড়িত ও স্বাধীনতাহীন জাতি ও মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা, শক্তি ও সাহসের অফুরন্ত উৎস।

বঙ্গবন্ধু যে প্রতিজ্ঞায় ও প্রত্যয়ে সোনার বাংলা গড়ার চেষ্টায় রত হয়েছিলেন পনেরোই আগস্টের পর তা শুধু পরিত্যক্ত হয়নি বরং ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তির নখদন্ত বিস্তারে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে এ দেশ। সচেতন মানুষ নীরবে অশ্রুপাত করেছে—বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে একদা যাঁরা মৃত্যুচিন্তাকে ছিন্নবস্ত্রের মতো পরিত্যাগ করে মরণপণ সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার উদ্দীপনাদীপ্ত জনতা। অতপর দেশের মানুষের আহ্বানে জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা, হাল ধরেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। তিনি জাতির পিতার চেতনায় উজ্জীবিত এবং সেই একই সংকল্পে ও প্রত্যয়ে সুদৃঢ়। বাংলার মানুষের মুক্তি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলাই তাঁর লক্ষ্য। সেই আরাধ্য কর্মসম্পাদনে তিনি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। তিনি স্বাস্থ্য, শিল্প, বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, গঙ্গার পানি ও স্থল সীমানা চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেছেন। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে তাঁর সরকারের অবদান বিশ্ববাসীকে অভিভূত করেছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পরিচয়ে উন্নীত হয়েছে। তিনি লাভ করেছেন জাতিসংঘের চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ পুরস্কার। তাঁর মানবিকতাবোধ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা অসাধারণ। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিতাড়িত অসহায় ও উন্মূল মানুষদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শেখ হাসিনা প্রকৃতই হয়ে উঠেছেন মানবতার জননী।

মোট একাত্তরটি কবিতা এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে দেশবাসীর সঙ্গে কবিসমাজ হয়ে পড়েছিল বেদনাজারিত; এদেশের ষড়ঋতু পরিবর্তনের মতো ‘সেইসব পরাজিত মুখ দেখে দেখে ক্লান্ত ও ব্যথিত’। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনে দেশবাসীর সঙ্গে আমাদের কবি সমাজ স্বস্তিবোধ করেছেন; প্রেরণাদীপ্ত হয়েছেন। জার্মান নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট কেবলই গোডোর প্রতীক্ষা করেছেন কিন্তু তাঁর প্রার্থিত গোডো অধরাই থেকে গেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার আগমনের ফলে এদেশের মানুষের সঙ্গে কবি সমাজের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তাঁরা নতুনভাবে উদ্দীপিত হয়েছেন। তাঁদের কলমে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও তাঁর সরকারের সাফল্যের ইতিবৃত্ত। তাঁরা ভোলেননি সেইসব ব্যর্থ চেষ্টাকে তুলে ধরতে যেগুলি পরিকল্পিত হয়েছিল শেখ হাসিনাকে স্তব্ধ করার জন্য। কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে কবিদের সঙ্গে আমরা একাত্মতা বোধ করি। সংকলনবদ্ধ কবিতাগুলি ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশিত হওয়ায় এগুলির পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রেইল স্বাক্ষর শিশু-কিশোরসহ সকল পাঠক বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আদর্শে উজ্জীবিত হবে; জাতির পিতার দুহিতাকে অন্তরে অনুভব করবে এবং তাঁর সংকল্প ও সাফল্য তাদেরকে উজ্জীবিত ও পুনর্জাত করবে। সংশ্লিষ্ট পাঠক শ্রেণির কাছে এ সংকলন দ্রুত পৌঁছানোর উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এ গ্রন্থ প্রস্তুত ও প্রকাশে যাঁরা নিয়োজিত হয়েছেন তাঁদের প্রচেষ্টা ও প্রেরণা অবশ্যই প্রশংসনীয়। বিশেষ করে এ গ্রন্থের পরিকল্পক, সংকলক ও অনুবাদক কবি আনিস মুহম্মদকে বিশেষভাবে সাধুবাদ জানাই।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!