X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২
পর্ব—দুই

কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন

মুহম্মদ মুহসিন
১৬ জুন ২০২২, ১৪:৫৩আপডেট : ১৬ জুন ২০২২, ১৪:৫৩

পূর্ব প্রকাশের পর

ইতিহাসের এই সব অধ্যায় ভাবতে ভাবতে আর পাশে বসা লুসির কনুইয়ের খোঁচা খেয়ে খেয়ে রাতের ইস্তাম্বুলের আলোঝলমল কিছু স্থাপনা দেখতে দেখতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশের একেবারে পূর্ব-দক্ষিণের কোণে অবস্থিত শহরের সবচেয়ে প্রাচীন অংশে। নামলাম আকসারাই। বাইরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। তা সত্ত্বেও দশ মিনিটের হাঁটা পথে ট্যাক্সি না নিয়ে হেঁটেই রওয়ানা হলাম লালেলিতে অবস্থিত আমাদের হোটেল পোলানিনের উদ্দেশে। গুগল ম্যাপে হোটেল পোলানিন খুঁজলে নামের সাথে পাঁচটি তারকা দেখায়। ফলে একটা পাঁচতারকা হোটেলে আছি বলে এক ধরনের ভাব নেওয়া যায়। তবে আসলে সেটিকে টেনেটুনে তিন তারকার স্ট্যাটাসে ঢোকানোও কঠিন হয়ে যায়। তারপরও আমাদের জন্য ওটাই যথেষ্ট ছিল। হোটেল থেকে বের হয়ে বিশ-পঁচিশ কদম বামে গেলেই ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ভৌগোলিক গুরুত্বেও মনে হলো বেশ দামি জায়গায় আছি।

দামি জায়গায় একখানা লম্বা দামি ঘুম দিয়ে পরের দিন হোটেলের সর্বোচ্চ তলায় ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট করছি আর দেখছি পাশেই বসফরাস থেকে উঠে আসা গোল্ডেন হর্ন নামক নদীটি। ভিডিয়ো কলে ছোট মেয়েকে প্রথম দেখালাম এই নদী। ক্যামেরা ঘুরিয়ে আরো দেখালাম ইস্তাম্বুল শহরের চিত্র, যতটুকু জানালা থেকে দেখানো যাচ্ছিল। বুফে ব্রেকফাস্ট। হরেক পদের খাবার দাবার। ডিম, জেলি, মাখন, মধু, পাউরুটি ছাড়া আর কোনো পদই পরিচিত নয়। পাউরুটিও একেবারে ভিন্ন চেহারায়। পদগুলোর দুয়েকটির নাম জানতে চেষ্টা করলে প্রশ্নের আগেই সকলের মুখে এক কমন লফজ—‘নো ইংলিশ’। ফলে নাম আর জানার সুযোগ ছিল না। আমাদের দেশি মোগলাই পরোটার কাটা টুকরোর মতো আইটেমটা সসেজ আর চিকেন স্টু দিয়ে বেশ খেলাম। বরইর মতো কালো আর বাদামি ছোট ছোট ফল দেখে দুয়েকটা মুখে দিয় টক আর লবণের মিশ্র স্বাদে মনে হলো গালের মধ্যে কেউ এক থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছে। একটা কোনোমতে গিলে আর ফলমুখো হলাম না। পরে শুনলাম ওগুলোই নাকি জয়তুন। কোরআনে উল্লেখ করা ফলের অমন স্বাদ দেখে কেমন যেন মনটা একটু দমে গেল।

নাশতা সেরে হোটেল লবিতে আসতেই দেখি আমাদের পরদেশে পরমাত্মীয় জয়নাল আবেদীন হাজির। ইস্তাম্বুল দেখার নিয়তে প্রথম পা বাড়ালাম হোটেলের বাইরে। ইস্তাম্বুল ইউরোপের সবচেয়ে জনবহুল শহর এবং বিশ্বের ১৫তম বৃহত্তম শহর। এর আয়তন ৫৩৪৩ বর্গ কিলোমিটার যা আয়তনে পুরো সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের প্রায় ৭ গুণ। পুরো শহরটি ৩৯টি জেলা নিয়ে গঠিত। তবে জেলা বা ডিস্ট্রিক্ট সম্পর্কিত আমাদের দেশি ধারণা তুরস্কে প্রযোজ্য নয়। জেলাগুলো বেশ ছোট সাইজের। পুরো তুরস্কের এক-পঞ্চমাংশ মানুষ এই শহরে বাস করে।

সবচেয়ে মজার হলো এই শহরটির নামের সংখ্যা। অন্তত আটটি ভিন্ন নামের ইতিহাস এই শহরের রয়েছে। লাইগোস, ইস্তাম্বুল, বায়জান্টিয়াম, আউগুস্তা আন্তোনিনা, নোভা রোমা, কনস্টান্টিনোপল, দারে সাদাত ও কুসতুনতুনিয়া। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতকে এর পত্তন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইস্তাম্বুল নামটি এখানকার জনগণের মাঝে সর্বদাই জীবিত ছিল এবং আছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতকে গ্রিস থেকে আগত অভিবাসীরাই এই শহরের পত্তন করেছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে তখন তারা এর নাম দিয়েছিল বায়জান্টিয়াম। কারণ, তারা মনে করত এই শহর মূলত প্রতিষ্ঠা করেছে দেবতা পোসাইডন ও দেবী কেরোয়েসার পুত্র বাইজাস (Byzas)। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে শহরের নাম বাইজাসের নামানুসারে বায়জান্টিয়াম রাখা হলেও আশপাশের সাধারণ মানুষেরা এই শহরকে বোঝাতে এই নাম ব্যবহার করত না। তারা এই শহরকে বোঝাতে যে শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করত তা হলো—‘ইস তিম বোলিঁ’। এ শব্দগুচ্ছের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় ‘শহরের দিক’। যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হতো—‘কোথায় যাও’, উত্তর হতো—‘ইস তিম বোলিঁ’ অর্থাৎ টাউনের দিক বা শহরের দিক। অর্থাৎ, উত্তরদাতা লোকটি বোঝাত যে, সে বায়জান্টিয়াম শহরের দিকে যাচ্ছে। যদি জিজ্ঞেস করা হতো—‘কোথায় থাকো’, উত্তর হতো—‘ইস তিম বোলিঁ’, মানে শহরের দিকটায় থাকি। অনেকটা আমাদের চাটগাঁর পাশের হাটহাজারী, দোহাজারী, পটিয়ার লোকজনের মতো। তাদের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়—‘কোথায় যাও’, তারা বলবে না—‘চট্টগ্রাম যাচ্ছি’, বরং তারা বলবে—‘শহরত’, অর্থাৎ তারা চট্টগ্রাম শহরে দিকে যাচ্ছে। তবে পার্থক্য হলো হাটহাজারী, দোহাজারী, পটিয়ার হাজার হাজার লোক সারা জীবন ‘শহরত’, ‘শহরত’ বললেও চট্টগ্রামের নাম ‘শহরত’ হয়ে যায়নি। কিন্তু বায়জান্টিয়ামবাসীরা ‘ইস তিম বোলিঁ’ বলে বলে বায়জান্টিয়ামের নাম ‘ইস্তাম্বুল’ হিসেবে স্থায়ী করে দিয়েছে।

তবে আমজনতার দেওয়া এই ‘ইস্তাম্বুল’ নামকে পাশ কাটিয়ে শাসককুল বারবার এ শহরের নতুন নতুন নাম রেখেছেন এবং পুরনো নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করে গেছেন। সেই পরিবর্তনের প্রথম চেষ্টাটি করেন রোমান সম্রাট সেপ্টিমাস সেভেরাস ২১০ সালের দিকে। তিনি তার ছেলে আউগুস্তা আন্তোনিনার নামানুসারে এ শহরের নামকরণ করেন ‘আউগুস্তা আন্তোনিনা’। কিন্তু সে নাম লোকেরা খুব একটা মুখে নেয়নি। পরের কাজটি করেন রোমান সম্রাট প্রথম কনস্টানটাইন। তিনি পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের একটি উপযুক্ত স্থানে রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা করলেন এবং বায়জান্টিয়ামকে ৩২৪ সালে সেই শহর হিসেবে নির্বাচন করলেন। এই নতুন রাজধানীর নাম বায়জান্টিয়াম পরিবর্তন করে তিনি রাখলেন ‘নোভা রোমা’। পরে উজির-নাজিরদের বায়নায় সেই নাম পুনারায় পরিবর্তন করে ৩৩০ সালে নিজ নামের সাথে মিলিয়ে এর নাম রাখলেন ‘কনস্টান্টিনোপল’। সেই থেকে এই শহরের দুই নাম ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়েছে। একটি কনস্টান্টিনোপল, অন্যটি ইস্তাম্বুল। স্থানীয় সাধারণ মানুষেরা বলছে ইস্তাম্বুল, আর বাহির মুলুকের মানুষেরা বলছে কনস্টান্টিনোপল। আরবি উচ্চারণে একটু বিকৃত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রথমে কোস্তানতানিয়া এবং আরো পরে অপভ্রষ্ট হয়ে ‘কুসতুনতুনিয়া’। অবশ্য ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল ওসমানীয় সুলতানদের দখলে চলে আসার পরে তুরস্কের লোকেরা এই শহরের নাম রেখেছিল ‘দারে সাদাত’ অর্থাৎ ‘ভাগ্য খোলার দুয়ার’, কারণ তখন এই শহরে যারাই বসতি গড়তে পারত তারাই দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠত, অর্থাৎ তাদের ভাগ্য খুলে যেত। এই নামও তুরস্কবাসীদের মুখে অনেক উচ্চারিত হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি হারে এই শহরকে ইস্তাম্বুলই বলত। ১৯২৯ সালে এই সাধারণের বলা নামটি সরকারিভাবে গৃহীত হয়। আর তখন থেকে অপরিবর্তিতভাবে আমরা একে ইস্তাম্বুল হিসেবেই চিনে আসছি।

তবে শহরের এই সব নামের ইতিহাস ভাবতে ভাবতে আমাদের হোটেলের স্থান লালেলি থেকে পূর্বমুখো হাঁটছি আর চারপাশের শত শত হেঁটে চলা মানুষের দিকে তাকিয়ে ভাবছি পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এই শহরে আবার কোনো নতুন নাম গ্রহণের সম্ভাবনা যদি থাকে তবে সে নাম হওয়া উচিত ‘বিড়িনগর’, কারণ পাশে হেঁটে চলা মানুষগুলোর মধ্যে অন্তত পঞ্চাশভাগ নারী ও পুরুষের ঠোঁটে কিংবা দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলছিল বিড়ি, বা ইংরেজি শব্দে বললে সিগারেট। পৃথিবীতে আমার দেখা কোনো শহরে বিশেষ করে নারীদের ঠোঁটে এত সিগারেট জ্বলতে আর কখনো দেখিনি। দৈনিক গড়ে ৬০টি সিগারেট খাওয়া জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের দেশে অবশ্য নারীদের ঠোঁটে এমন সংখ্যক সিগারেট জ্বলে উঠবে তা হয়তো কামাল আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্কের পরিকল্পনায়ই ছিল। আমি জানি না, ৫৭ বছর বয়সে লিভার সিরোসিসে মৃত্যুবরণ কালে এই জাতির পিতা দেশের রাস্তাঘাটে, স্কয়ারে ময়দানে তাঁর দেশের নারী-পুরুষের মাঝে আধুনিকতার এই বিড়িমুখো উন্নয়ন তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন কিনা।

বিড়ি-ফোঁকা এই জনতার পাশে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম বায়জিদ ময়দানে। বায়জিদ ছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ৪র্থ সুলতান (১৩৮৯-১৪০২)। যুদ্ধের ময়দানে তাঁর অমিত শৌর্যের কারণে তাঁর নাম ছিল বায়জিদ ইলদিরম। ইলদিরম মানে বজ্র। তাঁর শৌর্যের গল্পে আমরা পরে আসব। আপাতত বায়জিদ স্কয়ারে আমাদের কাজ হলো ডলার ভাঙিয়ে লিরা সংগ্রহ। এখানে অনেকগুলো মানি চেঞ্জিং হাউজ। ইউএস ডলারের দর সর্বোচ্চ ১৪.৩৫ দেখা গেল। জয়নাল বলল এখন এসেছেন বলে এক এক ডলারে এতগুলো লিরা পেলেন, বছর দুই আগে এলে এর অর্ধেকও পেতেন না। তবে সেটি বছর দুই না হয়ে যদি বছর কুড়ি আগে হতো তাহলে এই ডলারে কোটি কোটি লিরা পাওয়া যেত। তুর্কি লিরাকে সেই অপমানসূচক মানের জাতীয় লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের শাসনকালে ২০০৩ সালে প্রতিটি তুর্কি নোটের ডান দিকের ছয়টি শূন্য একটানে কেটে ফেলা হয়। ফলে ১০,০০,০০০ (দশ লাখ) লিরার নোটটি এক ঝটকায় হয়ে যায় ১ লিরা। ভাবছিলাম ভাগ্যিস সেই যুগে অর্থাৎ ২০০৩ সালের আগে আসিনি, তাহলে আমি যে কয় ডলার ভাঙিয়েছিলাম তার হিসাবাদির জন্য রীতিমতো এক ক্লার্ক নিয়োগ দিতে হতো।

ডলার ভাঙিয়ে প্রথম কাজ হলো ট্রামে এবং ট্রেনে চড়ার জন্য ইলেকট্রিক কার্ড ক্রয় যার নাম ইস্তাম্বুল কার্ড। কার্ড নিয়ে ঢুকলাম বায়েজিদ ট্রাম স্টেশনে। ইস্তাম্বুলে ১৯৯২ সাল থেকে আধুনিক ট্রাম চালু হয়েছে। তিনটি কোচ মিলিয়ে ১৯৪ ফুট দীর্ঘ এক একটি ট্রাম। শহরে মোট ৪১ কিলোমিটার ট্রামলাইনে ১৬০টি ট্রামে দৈনিক প্রায় ৪ লাখ যাত্রী চলাচল করে। স্টেশনগুলো খুব কঠোর বেষ্টনীযুক্ত নয়। ফলে কেউ যদি সঠিক প্রবেশ পথে কার্ড পাঞ্চ না করে ঢুকে পড়ে তা লক্ষ করার বা তাকে বাঁধা দেওয়ার কেউ আছে বলে মনে হলো না। বিড়ি-ফোঁকার জাতি হলেও এক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট ইমান-আমান আছে বলে পাবলিকের ইমানের ওপর ভরসা করেই হয়তো মেট্রো কোম্পানি যাত্রীদের টিকেট পাঞ্চিং বিষয়ে কোনো কঠোর নজরদারি আরোপের চেষ্টা করেনি। আমরা উঠে দাঁড়ালাম ট্রামে। দাঁড়ালাম কারণ বসার জায়গা সচরাচর পাওয়া যায় না। আমাদের গন্তব্য তোপকাপি ট্রাম স্টেশন যার পাশেই অবস্থিত প্যানোরামা মিউজিয়াম। ট্রাম স্টেশনটির নাম তোপকাপি হলেও সেটি মূলত তুরস্কের তোপকাপি নামক বিখ্যাত স্থানটিতে অবস্থিত নয়। তোপকাপি ইস্তাম্বুলের এক অনন্য ঐতিহাসিক স্থান। সেই ঐতিহাসিকতাকে আরো গুরুত্বের সাথে উদযাপন করতে ট্রামস্টেশনটির নাককরণ করা হয়েছে তোপকাপি। আসল তোপকাপি যা বর্তমানে মূলত একটি মিউজিয়াম সেটি বায়েজিদ থেকে যেদিকে তোপকাপি ট্রাম স্টেশন তার উল্টোদিকে অবস্থিত। তোপকাপি ট্রাম স্টেশনে নেমে সেখানে প্যানোরামা মিউজিয়াম দেখে, পরে আবার ট্রামে উল্টো দিকে এসে সেই তোপকাপি মিউজিয়াম যেখানে অবস্থিত সেদিকে যাব বলে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। জয়নাল তার পরিকল্পনায় আমাদের জন্য প্রথমই রেখেছে প্যানোরামা মিউজিয়াম যাতে আমরা এই মিউজিয়ামে সুলতান মুহাম্মাদ কিভাবে এই শহরে ঢুকেছিলেন তা দেখে তা থেকে সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করে অনেকটা সুলতান মুহাম্মাদের সাথে আমরাও এই শহরে ঢুকলাম এমন ভাব নিয়ে আমাদের ভ্রমণের পরবর্তীতে সূচিতে প্রবেশ করতে পারি।

তোপকাপি স্টেশন থেকে বের হয়ে একটু হেঁটেই প্যানোরামা মিউজিয়ামের চত্বর। চত্বরে ঢোকার পূর্বেই চোখে পড়ল ঘাসের উপরে একটা তাগড়া কুকুর শুয়ে আছে, সামনে টুকরো টুকরো কেজিখানেক মাংস। জয়নাল বলল বেওয়ারিশ কুকুর বিড়ালও এখানে মানুষদের এমন আদরে বেঁচে থাকে। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের সামনে মাংস পড়ে থাকবে, আর সে পেট বোঝাই হয়ে যাওয়ায় আর খেতে পারছে না বলে খাওয়ার ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বে—এমন দৃশ্য আমার মতো বাঙালের চোখে অভূতপূর্বই বটে। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য চোখে নিয়েই ঢুকলাম প্যানোরামা মিউজিয়ামের চত্বরে। দেখা গেল দেড়তলার মতো উঁচু একটি গোলাকার মাঝারি সাইজের ভবন। দেখতে খুবই আনইম্প্রেসিভ লাগল। আর একটা খটকা ভিতরে লাগছিল এই চিন্তায় যে, তুর্কিরা তো এক অক্ষর ইংরেজি পারতপক্ষে কখনো বলে না, তো তারা এই মিউজিয়ামটার নাম ইংরেজিতে কেন রাখতে গেল।

যাক, এই খটকার উত্তর না খুঁজেই ৫০ লিরা দরে আমার আর লুসির দুটো টিকেট কিনে ঢুকলাম প্যানোরামা মিউজিয়ামে। জয়নালের টিকেট লাগে না। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তার কী এক বিশেষ পাস আছে যা দেখালেই তুরস্কের বেশিরভাগ মিউজিয়ামের গেট তার জন্য অটোমেটিক খুলে যায়। মিউজিয়ামে ঢোকার পরে প্রথম প্রশস্ত কক্ষেই রয়েছে সুলতান মুহাম্মাদের এক প্রতিমূর্তি। মহানবী মুহম্মদ (সঃ) ৭ম শতাব্দীতে কুসতুনতুনিয়া (কনস্টান্টিলোপল) জয়ের যে স্বপ্ন মুসলমানদের মনেমগজে এঁটে দিয়েছিলেন এবং সেই স্বপ্নের বিজয়ী বীরের জন্য যে প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর ৮০০ বছর পরে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন এই দুনিয়া কাঁপানো বীর। দুনিয়ার এই মহান বাদশাহ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ কনস্টান্টিনোপল জয়ের এই গৌরব অর্জন করেও মাথায় মুকুট না পরে পাগড়ি পরতেন। আমরা দুই নিরীহ বরিশাইল্যা বাঙাল এই বীরের দুই পাশে দাঁড়িয়ে মন ভরে ছবি তুললাম। সুলতান মুহাম্মাদের সাথে ছবি তুলে মিউজিয়ামের দর্শকদেরকে পথ দেখানোর জন্য দেয়ালে খচিত তিরচিহ্ন অনুসরণ করে আমরা অন্যান্য প্রদর্শনী দেখতে অগ্রসর হলাম। সামনেই সিঁড়ি। পথ দেখানো তিরচিহ্ন বলছে সিঁড়ি দিয়ে খালি নিচে নামতে। নামতে নামতে অন্তত চার-পাঁচ তলা পরিমাণ তো নামলাম। এবার বুঝলাম বাইরে থেকে দেড় তলা মনে হলেও, এটি মোটেও দেড় তলা কোনো ভবন নয়। অন্য ভবনের তলা থাকে থাকে উপরের দিকে, আর এর তলা সব নিচের দিকে—এই হলো পার্থক্য। চার পাঁচতলা পর্যন্ত নামার পরে এবার তিরচিহ্ন দিলো অপর এক সিঁড়ি ধরে উপরে ওঠার নির্দেশনা। সেই সিঁড়ি ধরে দুই তলা উঠে টের পাচ্ছিলাম মাথার উপরে যুদ্ধের গর্জন চলছে।

বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। মনে হয়েছিল হয়তো মিউজিয়ামের বাইরে বড় কোনো গন্ডগোল ও ভারী যানবাহনের আওয়াজ হচ্ছে। কিন্তু আরেক তলা উপরে উঠেই আমার চক্ষু ছানাবড়া। মনে হলো আমরা ছাদে উঠে গেছি, এবং ছাদের উপরে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি সুলতান মুহাম্মাদ আর তাঁর বাহিনী অমিত বিক্রমে মুহুর্মুহু কামানের গোলা নিক্ষেপ করে যাচ্ছে রোম সম্রাট কনস্টানটাইনের দুর্গের প্রাচীর ভেদ করার জন্য। দুর্গের প্রাচীরের একটি জায়গা কামানের গোলায় কেবল ভেঙে গেল এবং ৪০ ফুট উঁচু সেই দেয়ালের ওপর থেকে কয়েকজন সৈন্য চিৎকাররত অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে। পুরো বিষয়টি এতই জীবন্ত যে, ১৪৫৩ সালের ২৯ মে তারিখে সংঘটিত ফাতিহ মুহাম্মাদ বনাম কনস্টান্টাইনের যুদ্ধের মাঝে দর্শক হিসেবে আমি দাঁড়িয়ে নই—এমনটা ভাবা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। প্যানোরামা মিউজিয়াম ঐতিহাসিক ঘটনার চলমানতার মধ্যে দর্শককে এমন জীবন্ত ঢুকিয়ে দিতে পারে তা আমার এর আগে জানাই ছিল না। চলবে


পর্ব—এক

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৫)
হাসপাতালের বারান্দায় দুই প্রসূতির সন্তান প্রসব, এক নবজাতকের মৃত্যু
হাসপাতালের বারান্দায় দুই প্রসূতির সন্তান প্রসব, এক নবজাতকের মৃত্যু
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
পাবনায় দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
পাবনায় দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি