X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
পথে নেমে পথ খোঁজা

বিপন্ন পণ্যের বেসাতি ও লেখকের দায়।। পর্ব—এগারো

মঞ্জু সরকার
২৮ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২২, ১০:১৩

বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে দেশের উন্নয়ন ও আরও-বেশি-উন্নয়নের স্বপ্ন এখন নানা তথ্য-পরিসংখ্যানে ক্ষমতাসীনদের কণ্ঠে হরহামেশাই গর্জে উঠছে। উন্নয়নের এই ডামাডোলে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের স্বক্ষেত্রে নিজের অবস্থানটা বুঝতে চাওয়া স্বাভাবিক। আমিও একজন লেখক, পাঠক ও গ্রন্থকর্মী হিসেবে গ্রন্থজগতের উন্নয়ন বুঝতে চাইছি। পঞ্চাশ বছরে দেশের সৃজনশীল প্রকাশনা উন্নত দেশের প্রকাশনা শিল্পের মতো হয়েছে কতখানি? সতের কোটি মানুষের জন্য উন্নয়নশীল এ দেশটায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাংস্কৃতিক তথা গ্রন্থজগতের উন্নয়ন কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে শুরুতে দেড় যুগ আগের একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

২০০৬ সালে আমেরিকার আইওয়ায় তিন মাসের আন্তর্জাতিক আবাসিক লেখক প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম। সেই সময়ে একদিন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যানুরাগী ও ক্রিয়েটিভ রাইটিং ওয়ার্কশপের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের হালফিল দশা নিয়ে বক্তৃতা করতে হয়। কাজটা আমার জন্য কঠিন ছিল সন্দেহ নেই। প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল আগেভাগে। তারপরও প্রশ্নোত্তর পর্বে এক ছাত্রীর প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। ওয়েব পেজে আমার লেখক পরিচিতি ও লেখার নমুনার স্বাদ ওরা তো আগেই পেয়েছিল। সেখানে সত্য বলার অভ্যাসে নিজের বইয়ের নাম-তালিকা (ইংরেজি অনুবাদসহ) আগেই জানিয়েছিলাম। সবে পঞ্চাশ উত্তীর্ণ তরুণ লেখকের বইয়ের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। তারওপর গল্প-উপন্যাস লেখাই একমাত্র কাজ নয়, তখন পেশায় ছিলাম সাংবাদিকও। ছাত্রীটি জানতে চেয়েছিল, কী করে তুমি এত বই প্রকাশ করলে?
প্রশ্নকারীর বিস্ময়ের কারণটা বুঝে গর্ব নয়, ভিতরে লজ্জা ও অস্বস্তি ছলকে উঠেছিল। কারণ আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও সারাজীবনে রচিত উপন্যাসের সংখ্যা এক ডজনের অধিক- এমন বিখ্যাত বড় উপন্যাসিক খুব কম আছেন। সার্বক্ষণিক তথা পেশাদার লেখকরা সাধারণত একটি উপন্যাস লিখতে দু’তিন বছর কিংবা তারও বেশি সময় ব্যয় করেন। আইওয়ার প্রোগ্রামে সেবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ভাষার আরও ছত্রিশজন লেখক এসেছিলেন। তাদের সকলের চেয়ে আমার বইয়ের সংখ্যা বেশি। কাজেই বইয়ের সংখ্যাধিক্য আমার সম্পর্কে সস্তা, ফালতু কিংবা জনপ্রিয় প্রতিভাবান লেখকের ধারণার জন্ম দিতেও পারে।

ছাত্রীর সরল প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে উদারনৈতিক সহজ ব্যবস্থার কথা বলেছিলাম। জনপ্রিয় হলে বইয়ের সংখ্যা দুই শত ছাড়িয়ে যাওয়া যে কোনও ব্যাপার নয়, সেটার জ্বলজ্যন্ত উদাহরণ হিসেবে ওই প্রোগ্রামে অতীতে অংশগ্রহণকারী বাংলা গ্রন্থজগতের দুই দিকপাল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও হুমায়ূন আহমেদের দৃষ্টান্ত তো ছিলই, আমার সমসাময়িক জনপ্রিয়রাও প্রতিবছরই একাধিক প্রসব করেন এবং প্রকাশকরা সেসব নিয়ে মহাসমারোহে একুশের বইমেলা হয়। এমন আগড়ম-বাগড়ম উত্তর শুনে আমাকেও দেশের এক জনপ্রিয় লেখক ভেবেই হয়তো-বা প্রথম সংস্করণে বই কত কপি ছাপা হয়, একেকটি বইয়ে কী রকম রয়্যালটি লাভ করেছি- এরকম প্রশ্নও উঠেছিল।

নিজের লেখক-সত্তার সম্মান ও সততা বজায় রাখার প্রয়াসে আমেরিকান ছাত্রদের কোনওরকম জবাব দিয়ে দায়িত্ব সেরেছি। তবে দেখেশুনে নিশ্চিত হয়েছি, বিশ্বায়নের প্রভাবে পুঁজিবাদী বিশ্বে দেশে উন্নয়নের গতি-প্রকৃতি অভিন্ন হলেও, ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশের প্রকাশনা-শিল্প আর আমাদের দেশের সৃজনশীল গ্রন্থ-প্রকাশনা এক জিনিস নয়। স্বরচিত ‘লেখক’ উপন্যাসটিতে একজন লেখকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে লেখক হওয়ার বিড়ম্বনা ও প্রকাশনা জগতের বাস্তবতা বয়ান করেছি কিছুটা। এ নিবন্ধে গ্রন্থজগতের একজন কর্মী ও লেখক হিসেবে শুরু থেকে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের হালচাল, উন্নতি ও অবক্ষয় যা দেখছি, তার প্রাসঙ্গিক স্মৃতিচারণ ও ব্যক্তিগত ভাবনা উল্লেখ করতে চাই। তাতে বইজগতের বর্তমান অবস্থাটাও উপলব্ধি করা সহজ হবে আশা করি।

লেখক হবার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার লাভের পর পরই ঢাকায় এসে ১৯৭৩-এ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। কারণ সরকারি অর্থে পরিচালিত সংস্থাটির মূল লক্ষ্যই হলো দেশের সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশনা তথা গ্রন্থজগতের উন্নয়ন ঘটানো। গ্রন্থজগতের মূল স্তম্ভ যেহেতু তিনটি- লেখক, প্রকাশক ও পাঠক; এই তিনের সমন্বয় বা সম্পর্কের উন্নয়ন এবং বিস্তার ঘটলেই হবে গ্রন্থজগতের উন্নয়ন। অবশ্য তিনটি স্তম্ভ ছাড়াও বই ছাপার জন্য প্রেস, কাগজ আর বিক্রির জন্য দেশব্যাপী বইয়ের দোকান ও পড়ার জন্য গণপাঠাগার গ্রন্থজগতের অপরিহার্য অবকাঠামো। খুঁটিনাটি উপাদান এবং গ্রন্থজগতে পেশাজীবী আরও আছে। পত্র-পত্রিকার ক্ষেত্রে যেমন লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে সম্পাদক নামে গুরুত্বপূর্ণ এক পেশাজীবীর অস্তিত্ব থাকে, উন্নত দেশের প্রকাশনা শিল্পেও অনুরূপভাবে প্রকাশক ও লেখকদের মধ্যে বৃহত্তর পাঠকসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে থাকেন অভিজ্ঞ সম্পাদক। সম্পাদকের মতামতকে গুরুত্ব দেন লেখক-প্রকাশক উভয়েই। কাজেই প্রকাশনা শিল্পের উন্নয়ন মানে লেখক-প্রকাশ-পাঠকসহ গ্রন্থজগতের অবকাঠামো, ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদেরও উন্নয়ন। এখন দেখা যাক কোথায় এবং কীভাবে এই উন্নয়ন কী পরিমাণে ঘটেছে। প্রথমে তাকানো যাক সৃজনশীল প্রকাশকের দিকে।

বাংলাবাজার যে প্রকাশকদের ঘাঁটি, দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকেই তথ্যটি জানতাম। পাঠ্য তথা নোটবই-গাইড বইয়ের প্রকাশকরা ছিলেন বড় প্রকাশক ও বড় বই-ব্যবসায়ী। এরকম একজন বড় বই-ব্যবসায়ী ছিলেন পুঁথিঘরের স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তধারা নামে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খুলে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃজনশীল বই প্রকাশ শুরু করেন। বই ব্যবসায় যে একটি মহৎ ব্যবসা, সেটা প্রমাণের জন্য সৃজনশীল প্রকাশক হিসেবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তধারার উদ্যোগ ও ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। সাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, সেই সময়ে মুক্তাধারা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে সপ্তাহব্যাপী নিজেদের প্রকাশিত কিছু বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করেছিল। দেশের বিখ্যাত ও বিশিষ্ট লেখক বুদ্ধিজীবীগণ অতিথি আলোচক হয়ে প্রতিদিনের বই-উৎসবে আলোচনা করেছেন। ক্যাসেট-রেকর্ডে ধারণকৃত এসব বক্তৃতা সংকলিত করে বইয়ের খবর নামে একটি সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল মুক্তধারা। বাংলা শর্টহ্যান্ড জানতাম বলে ক্যাসেটের বক্তৃতাগুলিকে লিখিতরূপ দেয়ার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর। বাড়তি রোজগারের আশায় কাজটি করার জন্য রোজ বিকেলে যেতাম ৭৪ ফরাশগঞ্জ মুক্তধারা অফিসে। পুরোনো আমলের কাঠের পাটাতনের দোতলায় মুক্তধারা অফিস। একটা কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে যেতে হতো চিত্ত বাবুর বাসগৃহে। কাজটি করতে গিয়ে নিঃসন্তান চিত্তরঞ্জন সাহার পরিবার মুক্তধারার কর্মী ও কর্মকাণ্ড ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ ঘটে। দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী-লেখক-শিল্পী মুক্তধারার উপদেষ্টা ও সম্পদক মণ্ডলীতে ছিলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিল্পী হাশেম খান, আব্দুল হাফিজ ছাড়াও চিত্তবাবু প্রয়োজন মতো অভিজ্ঞ লেখক-শিল্পী-শিক্ষাবিদের পরামর্শ নিতেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সম্পাদনায় একটি সাহিত্য পত্রিকাও মুক্তধারা থেকে নিয়মিত বেরিয়েছে কিছুকাল। এ ছাড়াও বের হতো বইয়ের খবর। নিজের প্রকাশিত প্রতিটি বইকে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য জ্ঞান করে তার প্রচারণার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিত মুক্তধারা। বই প্রকাশের পর প্রকাশনা উৎসব, প্রতিটি বইকে আলোচনার জন্য পত্র-পত্রিকায় পাঠানো, বিজ্ঞাপন ও লিফলেট প্রকাশ এবং নানা উপলক্ষে স্থানীয়ভাবে বই মেলার আয়োজন করত নিয়মিত। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের ভিড়ে বাংলা একাডেমিতে বই বিছিয়ে মুক্তধারা কর্তৃক একুশে বইমেলার গোড়াপত্তন হওয়ার তথ্যটি এখন অনেকেই জানে।

মুক্তধারা ছাড়াও বই প্রকাশনায় আন্তর্জাতিক মানের পেশাদরিত্ব আনার ক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান আমলে যেহেতু অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-এর দেশীয় শাখা ছিল এটি। উক্ত সংস্থার কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ ইউপিএল-এর মালিক হওয়ার পরও ইংরেজি ভাষায় একাডেমিক ও গবেষণামূলক বই প্রকাশকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ক্রমে বাংলা বই প্রকাশও শুরু করে তারা। প্রতিটি বইকে পৃথক পণ্য ভেবে সম্পাদক কর্তৃক পড়িয়ে তার প্রকাশযোগ্যতা বা বাজার যাচাই, লেখকের সঙ্গে চুক্তিপত্র সম্পাদন ও চুক্তি অনুযায়ী রয়্যালটি প্রদান, নানাভাবে বইয়ের প্রচারকে গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো মুক্তধারা ও ইউপিএল পেশাদারি দায়িত্বের সঙ্গে পালন করেছে। বইকে শুধু তারা মৌসুমি ফলের মতো হরেদরে একাকার ও একুশে মেলাকেন্দ্রিক ভাবেনি। সারাবছর ধরে প্রাকশ ও বিপণন প্রক্রিয়াকেও গুরুত্ব দিয়েছে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশে সৃজনশীল প্রকাশক ও প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা যে বেড়েছে, সেটা একুশের বইমেলার দিকে তাকালেও স্পষ্ট হবে। কিন্তু ব্যতিক্রমী দু-চারটি দৃষ্টান্ত বাদে প্রকাশনা-ব্যবসায় পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি। দেশে প্রতি বছর যত বই প্রকাশিত হয়, তার সিংহভাগই প্রকাশিত হয় একুশের বইমেলায়। পাকিস্তান আমল ও স্বাধীনতার পরও সৃজনশীল বইয়ের প্রথম সংস্করণ মুদ্রণসংখ্যা ছিল কমপক্ষে এক হাজার কপি। এখন ছাপা হয় তিনশত থেকে পাঁচশত কপি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ হয় কদাচিত। প্রতিবছর একুশে বইমেলায় যে প্রায় চার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়, সেগুলো দেশব্যাপী বইয়ের দোকানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর কারণ যেমন এসব বইয়ের চাহিদার অভাব, তেমনি দেশে গ্রন্থপণ্যের বিক্রয় নেটওয়ার্কের দুর্বলতাও। পাঠক চাহিদা ও সম্পাদনার তোয়াক্কা ছাড়াই তাড়াহুড়া করে একুশে বইমেলায় নিম্নমানের বইয়ের সংখ্যা বাড়াচ্ছেন লেখক-প্রকাশরা। পাণ্ডুলিপি যাচাইয়ের জন্য অধিকাংশ প্রকাশকের নিজস্ব সম্পাদক নেই। উপরন্তু অভিযোগ উঠছে, চটজলদি লেখক হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির নগদ অর্থসাহায্য প্রদান কিংবা রয়্যালিটি তোয়াক্কা করেন না, এমন লেখকদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা-ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে বই প্রকাশ করেন তারা। নতুন বই প্রকাশের জন্য পরিচিত লেখক, কম্পিউটারে কম্পোজ পাণ্ডুলিপি, প্রুফ রিডার ও ছাপার প্রেস তাদের কাছে যথেষ্ট। বই বিপণনের জন্য একুশের বইমেলায় অংশগ্রহণ ও সরকারি কেনাকাটার তালিকায় থাকার চেষ্টা-তদবির করাটাই যেন অধিকাংশ প্রকাশকের মূল কাজ।

লেখক, প্রকাশক, একুশের বইমেলা ও বই বিক্রয় নেটওয়ার্ক ছাড়াও গ্রন্থজগতের আরও একটি অপরিহার্য কাঠামো গণপাঠাগার। পাকিস্তান আমলে ও স্বাধীনতার পরেও সরকারি-বেসরকারি পাঠাগারগুলোতে পাঠকের উপস্থিতি এবং বাসায় বই নিয়ে পড়ার সদস্যসংখ্যা নেহায়েত কম ছিল না। বইজগতের উন্নয়ন হলে তো দেশে পাঠাগার ও পাঠক বৃদ্ধি হবার কথা। কিন্তু আগের অবস্থার সঙ্গে বর্তমানের চিত্র মেলালে পাঠকের হ্রাস ও পাঠকশূন্যতার চিত্র স্পষ্ট হবে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে থাকার সময় অনেক বেসরকারি পাঠাগার পরিদর্শন করে আমি দেখেছি, সরকারি অনুদান লাভই ছিল নামকাওয়াস্তে পাঠাগারগুলোর মূখ্য উদ্দেশ্য। অনেক পাঠাগারে পাঠকের বদলে ইঁদুর-তেলাপোকা পড়ে বই। আবার অনুদানপ্রাপ্ত বই কোথায় কীভাবে আছে, স্বয়ং লাইব্রেরিয়ানও জানেন না। এভাবে অচলাবস্থার কবলে পড়ে বহু পুরোনো পাঠাগারের মৃত্যু ঘটেছে। অন্যদিকে বাড়িতে ব্যক্তিগত পাঠাগার বা বইসংগ্রহ আছে অনেকেরই। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাড়ির সদস্যদের হাতে স্মার্ট ফোন আছে প্রায় সারাক্ষণই। কিন্তু হাতে বই থাকার বিরল মুহূর্ত সারা মাসেও চোখে পড়বে কি না সন্দেহ। দেশে জনসংখ্যা হারের সঙ্গে শিক্ষার হারও বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পাঠাভ্যাস বাড়েনি, বরং কমছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পাঠ্যসূচির বাইরে পাঠ্যবহির্ভূত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যমূলক বইয়ের পাঠক না বাড়লে দেশের সৃজনশীল প্রকাশনার উন্নয়ন বা পোশাদারিত্ব আসবে কী করে?

ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিবিধ আন্দোলন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে যেটুকু সাহিত্যানুরাগ ও গ্রন্থচাহিদা সৃষ্টি করেছিল, তার ক্রমবিকাশ গোটা জাতীয় জীবনকে প্রভাবিত ও বইমুখী করতে পারেনি। এর কারণ যেমন দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি নীতির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে, তেমনি পাঠক সংকটের দায় পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারা ও বিশ্বায়নে তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লববের উপরেও চাপানো যেতে পারে অনেকটা। বর্তমানের ডিজিটাল বিশ্ব যেমন রেডিও, ল্যান্ড ফোন, টেলিগ্রাম ও ডাক-ব্যবস্থার চিঠির আদান-প্রদানের ব্যবহার প্রায় শূন্যের কোঠায় এনেছে, একইভাবে হাতের স্মার্টফোনে ও ইন্টারনেটের তথ্যসমুদ্রে অবগাহনের নেশা মুদ্রিত সংবাদপত্র ও বই পাঠের অভ্যাস শূন্যের কোঠায় নামাবে বলে অনেকের আশঙ্কা। বইয়ের মাধ্যমে মানুষ আগে যে জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাত, এখন গুগল সার্চ দিয়ে তা নিমেষেই মেটাতে চায়। আগে বই পড়ে মানুষ যে বিনোদন পেত, এখন ফেসবুক পড়ে বা ইউটিউব দেখে তার চেয়ে বেশি আনন্দ লাভ করে। শিক্ষিত মানুষ বা একটি জাতির গ্রন্থবিমুখ হয়ে ওঠার কারণগুলো বিশেষজ্ঞগণ ভালোভাবে ব্যাখা-বিশ্লেষণ করতে পারবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস, মানবসভ্যতায় যত রূপান্তর আসুক, পাঠকের হ্রাস বা মুদ্রিত বইপত্রের সঙ্গে সম্পর্কের জগত সংকুচিত হোক, বইয়ের সঙ্গে মানব-সভ্যতার বিকাশ ও ব্যক্তিমানুষের বিকাশের গভীর সম্পর্কটি কখনোই বিলুপ্ত হবার মতো নয়।

দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার হারও বেড়েছে। আপতদৃষ্টিতে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের ফলে গ্রন্থজগতে উন্নয়নের দিকটিও স্পষ্ট। বই উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। একুশে বইমেলার প্রভাবে নতুন লেখক ও প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। অনলাইন-ব্যবস্থায় বইয়ের প্রচার ও সরবরাহ ব্যবস্থাও সহজ হয়েছে। একুশে বইমেলারও প্রসার-প্রচার ও সামগ্রিকভাবে বই বেচাকেনাও বাড়ছে। এই উন্নয়ন সামগ্রিক জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক হয়ে না উঠলেও, গ্রন্থজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু সুবিধাভোগীর স্বার্থে যাচ্ছে অবশ্যই। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সুফল যেভাবে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি লুটেপুটে খেতে তৎপর থাকে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। এ সত্য সরকারি বই কেনা, একুশের বইমেলা ও অন্যান্য গ্রন্থোন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে প্রায় তিন দশকের চাকরির অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একুশের বইমেলা আয়োজনের দায়িত্ব থেকে সরে গেলেও সংস্থাটি সরকারি টাকায় গ্রন্থোন্নয়নমূলক নানারকম কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। কোটি টাকার গ্রন্থোন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। গুলিস্তানের গ্রন্থকেন্দ্রের নিজস্ব ভবন হয়েছে। কেন্দ্রের বই বিক্রয় বিভাগের মাধ্যমে বেসরকারি পাঠাগারের জন্য সরকারি অনুদান, কর্মকর্তাদের ডলারে টিএ/ডিএ দেয়ার মাধ্যমে প্রতি বছর বিদেশি বইমেলায় অংশগ্রহণ, গ্রন্থনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ, ইত্যাদি গ্রন্থকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারি অর্থের অপচয় এবং অনিয়ম-দুর্নীতি যত হয়, সে তুলনায় প্রকৃত গ্রন্থোন্নয়ন ঘটে কতটুকু? এ প্রশ্ন নিজেকে করতাম বলে সংস্থাটির সঙ্গে এমন দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত টিকতে পারিনি। সরকার দলীয় আধিপত্য ও আমলাতন্ত্র শাসিত গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরি ত্যাগের পর, গত দুই দশকে সংস্থাটি কতোটা গতিশীল না কি অথর্ব ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছে, সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী কিংবা সুবিধাবঞ্চিতরা ভালো বলতে পারবেন। অন্যদিকে সরকারি উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে বেসরকারি উদ্যোগে, বিশেষ করে লেখকের ভূমিকার কারণে দেশের সৃজনশীল প্রকাশনা কতোটা বিকশিত ও উন্নত হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব প্রত্যেক লেখক স্বীয় অভিজ্ঞতা অল্প-বিস্তর দিতে পারবেন। আমিও একজন লেখক হিসেবে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, তার প্রাসঙ্গিক স্মৃতিচারণ নিজেকে ব্যর্থ লেখক প্রমাণ করলেও, স্বাধীনতা-উত্তর প্রকাশনা শিল্পেরও উন্নতি ও অবক্ষয়ের দিকগুলো আরো কিছুটা স্পষ্ট হবে বলে আশা করি।

পুঁজিবাদী বিশ্বে মূলত পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা পূরণের নিরিখে বিবেচিত হয় উন্নয়ন। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মেশিনে বা হাতে তৈরি প্রতিটি দ্রব্য, যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় তা অবশ্যই পণ্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বই তো বটেই, মানুষের শ্রম, মানবিক সেবা, মেধা থেকে শুরু করে কখনো-বা আস্ত মানুষই পণ্য হয়ে যায়। কাজেই পুঁজিবাদী দুনিয়ায় গ্রন্থপণ্যের উৎপাদন ও কেনাবেচার নিরিখেও সৃজনশীল প্রকাশনার উন্নতি-অবনতির চিত্র বুঝতে চাওয়াটা দোষের কিছু নয়। আর একটি গ্রন্থপণ্য উৎপাদনে লেখকরা যেহেতু প্রাথমিক মূল কারিগর, বইজগতের উন্নয়নে লেখকের ভূমিকাও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর বইকে ব্যাপক সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ সেটা প্রমাণ করেছেন।

হুমায়ূন আহমেদের আগে দেশের বইবাজারে আধিপত্য ছিল গোয়েন্দাকাহিনীর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মাসুদ রানা, দস্যু মোহন ইত্যাদি সিরিজের বইয়ের। ভারতের জনপ্রিয় লেখকের পাইরেট পাবলিকেশন্স, যেমন নীহাররঞ্জন গুপ্ত, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর, যাযাবর, প্রমুখ লেখকের সস্তা নভেল এবং ধর্মীয় গ্রন্থের। বটতলার বইয়ের ধারাবাহিকতায় এসব বই জেলাশহরের পাঠ্য বইয়ের দোকানে, রেলস্টেশনের বুকস্টলে, এমনকি স্টিমার-ট্রেনে-ফুটপাতে ফেরিওয়ালাদের দোকানেও বিক্রি হতে দেখেছি। কৈশোরে ক্রেতা হিসেবে কিনে পড়েছিও অনেকগুলি।

বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, সমরেশ বসু প্রমুখ জনপ্রিয় পেশাদার লেখকের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রথম জনপ্রিয় ও পেশাদার লেখক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন হুমায়ূন আহমেদ। বই লিখেও যে বাড়ি-গাড়ি ও লক্ষ-কোটি টাকার সম্পদশালী মানুষ হওয়া যায়, হুমায়ূন আহমেদই তার ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর একটি পাণ্ডুলিপি পাওয়ার জন্য অনেক প্রকাশক নানা উপঢৌকন ও অগ্রিম চেক নিয়ে লেখকের কাছে ধর্ণা দিত। এক বইমেলাতেই তাঁর বই কয়েকটি সংস্করণ হতো। মেলার পরও তার উপন্যাস দেশের বইয়ের দোকানে কমবেশি পাওয়া যেত।

হুমায়ূনের এই অনন্য সাফল্যের কারণ নিয়ে নানারকম ব্যাখা-বিশ্লেষণ হয়েছে। তার লেখার সাহিত্যমান নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু ব্যাপক বাজার-কাটতির মূলে প্রচারণার ভূমিকা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। লেখক হিসেবে হুমায়ূনের সংবাদমাধ্যমের প্রচারণা, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের একমাত্র ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিটিভিতে লেখকের নাম ও নাটক প্রচার নিঃসন্দেহে তার জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ। হুমায়ূনের প্রভাব তার সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের উপর পড়াটা স্বাভাবিক। কারণ বিস্তর খ্যাতি ও বিত্তের লোভ নেই যাদের এবং নিজের বইটিকে নিছক বাজারি পণ্য ভাবতে চান না যে-লেখক, তারও আশা থাকে নিজের লেখা বইটি অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছাক, অন্তত এক শ্রেণির পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠুক।

হুমায়ূন আহমদের উত্থানপর্বে তার প্রচারণায় সহায়ক ছিল একমাত্র বিটিভি ও মুদ্রিত কিছু পত্র-পত্রিকা। এখন লেখক ও তার গ্রন্থপণ্যের প্রচারণা পাওয়ার জন্য রয়েছে কয়েক ডজন টিভি-চ্যানেল, মুদ্রিত ও অনলাইন মিলে কয়েক শত পত্র-পত্রিকা, তদুপরি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টগ্রাম ইত্যাদি। একুশে বইমেলায় সব টিভিচ্যানেল ও পত্রপত্রিকা নিয়মিত কভারেজ দেয়। আর বিনাপয়সায় বিশ্বসামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে লেখক-প্রকাশকরাও তাদের বইয়ের প্রচারণা দেয় বইমেলা এলেই। হুমায়ূন আহমেদ যেমন তার ভক্ত-পাঠককূলকে দর্শন ও অটোগ্রাফ দিতে সশরীরে মেলায় আসতেন মাঝে মাঝে, তেমন আশা নিয়ে পাঠক-ক্রেতা শিকারী বেশ কিছু লেখক একুশে মেলায় উপস্থিত থাকেন নিয়মিত। অখ্যাত নবীন লেখকরাও স্টলে সাজানো বইয়ের সঙ্গে থাকেন, গত কয়েকবার একুশে বইমেলায় গিয়ে এরকম তরুণ লেখকদের দেখেছি। নিজের বইটি কেনার জন্য বন্ধুবান্ধব ছাড়াও অচেনা ক্রেতাদর্শকদেরও অনুরোধ জাানান তারা।

প্রতিটি বই-ই যেহেতু একটি পৃথক এবং বিশেষ পণ্য, তার সম্ভাব্য বিশেষ ক্রেতা-ভোক্তা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু একটি বইকে বিশেষ পণ্য ভেবে তার বিশেষ প্রচারণা ও বিক্রয় বৃদ্ধির চেষ্টা করেন না কোনো প্রকাশকই। এ দায়টি আজকাল পালন করেন লেখকরা স্বয়ং। বইমেলা এলে ফেসবুকে ও সম্ভব হলে অন্যান্য পত্রিকায় নিজেদের বইয়ের ছবি ও বিজ্ঞাপন প্রচার করেন তারা। অনেক লেখককে লেখার কাজে যতটা না আত্মনিবিষ্ঠ, তার চেয়ে আত্মপ্রচারণা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ও ব্যস্ত মনে হয়। কিছু প্রকাশক ও তরুণ বন্ধুর অনুরোধে ফেসবুকে নতুন বই সম্পর্কে লিখেছি কয়েকবার নিজেও। কিন্তু আত্মপ্রচারণার কায়দাকৌশল দেখিয়ে ও নিজের ঢাকঢোল পিটিয়ে আমাদের গ্রন্থ-পণ্যের বাজার কতোটা বাড়ছে আসলে? মৃত্যুর পরও কিংবদন্তী লেখক হুমায়ূনের প্রচারণা ও জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী ঘটা করে প্রচার হচ্ছে দেখি। কিন্তু তার বই কি আগের মতো বিক্রি ও সংস্করণ হচ্ছে? এ প্রশ্নের সদুত্তর হুমায়ূনের প্রকাশকরা ভালো জানবেন। হুমায়ূনের দেখানো পথে খ্যতি-প্রতিষ্ঠার কাঙাল যেসব লেখক বেশি বেশি লিখছেন, তাদের বইয়ের বিক্রির হিসাবও সংশ্লিষ্ট লেখক-প্রকাশক ছাড়া সাধারণের জানার উপায় নেই। বিদেশি বেস্টসেলার গ্রন্থে সাধারণত কত মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে, কয়টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে- তার তথ্যটি বইয়ে উল্লেখ থাকে। কিন্তু আমাদের প্রকাশনার বেস্টসেলারের দৌড় ও দৌরাত্ম্য বইমেলাতেই সীমিত। সম্প্রতি জনপ্রিয় ধারার এক লেখকের একটি উপন্যাসের শততম সংস্করণ প্রকাশ আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপিত হয়েছে। কিন্তু শত সংস্করণে মোট বিক্রি ও লাভ-ক্ষতির পরিমাণ সংশ্লিষ্ট লেখক-প্রকাশক জানেন হয়তো, কিন্তু আমাদের জানার উপায় নেই।

প্রকাশনা শিল্পে পেশাদারিত্ব আনায় লেখকের ভূমিকার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূনের কৃতিত্ব সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্মের লেখকরা কে কীভাবে নিয়েছেন, বিশদ বলতে পারব না। তবে প্রকাশকদের কাছে প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী আদায়ের ক্ষেত্রে হুমায়ূনের সাফল্য সমসাময়িক লেখক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। কারণ আগেই বলেছি, যৌবনের শুরুতে একজন পেশাদার লেখক হওয়াটাকেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য স্থির করেছিলাম। লক্ষ্য অর্জনে ব্যক্তিগত ব্যর্থতার কিছু প্রাসঙ্গিক স্মৃতিচারণ করলেও গত পঞ্চাশ বছরে সৃজনশীল প্রকাশনার উন্নতি, অবনতি ও পেশাদারিত্বের চালচিত্র অধিকতর স্পষ্ট হবে।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কর্মী হিসেবে দেশের প্রবীণ-নবীন বহু প্রকাশকর সঙ্গে জানাশোনার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আমার মতো অখ্যাত নবীন লেখকের বই প্রকাশ করতে আগ্রহী হননি কেউ। আমিও অনুরোধ জানাতে পারিনি কাউকে। ফলে প্রথম বই দুটি প্রকাশ হয় অপেশাদার প্রকাশক কর্তৃক অনেকটা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জোরে। গল্পের বইটি করেছিলেন রূপম পত্রিকার সম্পাদক আনওয়ার আহমেদ। পত্রিকার নামেই প্রকশনা খুলে কিছু বই করেছিলেন তিনি। আর প্রথম উপন্যাস ‘তমস’ অগ্রজপ্রতিম বুদ্ধিজীবী-লেখক আহমদ ছফা নগদ পাঁচশত টাকা অগ্রিম সম্মানী দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে তাঁর সম্ভাবনা পত্রিকায় ছেপেছিলেন। কপোতাক্ষী নামে একটা প্রকাশনার ব্যানারে বেশ কিছু বইয়ের সঙ্গে আমার বইটিও করেছিলেন। প্রকাশক হিসেবে তারা কেউই বেশিদিন টিকে থাকেননি। লেখক হিসেবে প্রাপ্য রয়্যালটি পাইনি। তবে বই প্রকাশের জন্য নবীন লেখককে একটা টাকাও দিতে হয়নি। এটাও বা কম কীসে?

আমার পেশাদার লেখক হবার স্বপ্ন হালে পানি পেয়েছিল আসলে বিচিত্রা  ঈদসংখ্যায় দ্বিতীয় উপন্যাস নগ্ন আগন্তুক প্রকাশের পর। উপন্যাসটি ছাপার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা চিঠি লেখেন। আলোচনার পর চুক্তি হয়, দুই হাজার কপি ছাপবেন এবং সাড়ে বার পার্সেন্ট হারে রয়্যালিটি পাবেন লেখক। মুক্তধারা থেকে পরে প্রথম বই দুটি একইরকম শর্তে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বই তিনটি বাবদে অগ্রিম লেখক সম্মানীও আদায় করেছিলাম একবার। এসময় আন্তর্জাতিক মানের পেশাদারিত্ব নিয়ে ইউপিএল-ও বাংলা বই প্রকাশ শুরু করে। তারাও আমার কাছে গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি চাইলে চুক্তিপত্র হয় দুই হাজার কপি ছাপার। চুক্তি মোতাবেক বছর শেষে বই বিক্রির হিসাব ও রয়্যালটির চেক পাবো। পেয়েছিও কয়েক বছর নিয়মিত।

হুমায়ূন আহমেদ নন্দিত নরক-এর পর একই আয়তন ও মেজাজের বেশ কিছু উপন্যাস লিখে ততদিনে খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার রাজপথে উঠেছেন। ঈদসংখ্যা পত্রিকা ও প্রকশকদের মাঝে তাঁর উপন্যাস প্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল যেন। প্রকাশকদের মধ্যে যারা হুমায়ূনের বই করার সুযোগ পাননি, তারা সমসময়িক অন্য উপন্যাসিকদের দিকেও ঝুঁকেছিলেন। বাজার কাটতির সম্ভাবনা জাগিয়ে জনপ্রিয় ধারায় বেশ কিছু লেখকের আবির্ভাব ঘটে। যেমন ইমদাদুল হক মিলন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তসলিমা নাসরিন, প্রণব ভট্ট, আনিসুল হক এবং আরও কেউ কেউ, যাদের বই এক বইমেলাতেই একাধিক সংস্করণ হয়।

ঈদসংখ্যা পত্রিকার মতো পরিচিত প্রকাশকবৃন্দ আমার উপন্যাস প্রকাশেও বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। আমিও পেশাদার লেখক হবার স্বপ্নটি পূরণে প্রকাশকের কাছে ১৫% রয়্যালটিতে লিখিত চুক্তি এবং অগ্রিম দাবি করি। প্রকাশকদের কেউ-বা কিছু অগ্রিম দিয়ে পাণ্ডুলিপি নেন, বই বেরুনোর পর দেন কেউ কেউ। চুক্তি না করলেও আশ্বাস দেন সবাই, বিক্রি হতে থাকলে চুক্তি-রয়্যালটি কোনোটাই সমস্যা হবে না। এভাবে লিখিত চুক্তি ও মৌখিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে দেশের বড় ও ছোট, পুরোনো ও নবাগত প্রকাশক কর্তৃক এ পর্যন্ত আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় শতকের ঘরে পৌঁছে গেছে। কিন্তু পেশাদার লেখক তথা শুধু লেখার আয়ে জীবিকা নির্বাহের স্বপ্ন-চিন্তাটি আজো বাস্তবায়িত হয়নি। দু’একজন ব্যতিক্রম বাদে বই বিক্রির হিসাব ও রয়্যালিটি কারো কাছেই পাই না। সবারই একই অভিযোগ, আমার বই চলে না। লগ্নীকৃত বিনিয়োগের মূলটা উঠে না এলে কিংবা উঠে না আসার অনিশ্চয়তা দেখা দিলে তারা লেখকের প্রাপ্য শোধ করেন কোন যুক্তিতে? লিখিত কিংবা মৌখিক চুক্তির বরখেলাপ নয় শুধু, বেশিরভাগ প্রকাশকের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি এতটাই ঘটেছে যে, সশরীরে দূরে থাক ফোনেও আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি না। একুশে বইমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি স্টল বরাদ্দের নীতিতে লেখক-প্রকাশক চুক্তিকে গুরুত্ব দেয়ায় প্রকাশকরা এখন লেখকদের সঙ্গে চুক্তি করেন। কিন্তু আগে যেখানে প্রথম সংস্করণে ছাপা হতো ন্যূনতম দুই থেকে এক হাজার কপি, এখন সব প্রকাশকই পাঁচশত থেকে তিনশত কপি ছাপেন। তিন শত কিংবা পাঁচশত কপি কত বছরে বিক্রি হয়েছে, কিংবা হতে পারে, অধিকাংশ প্রকাশকের পক্ষ থেকে নিশ্চিতভাবে জানতে পারিনি কখনো। এমন পরিস্থিতিতে, বাজার-চালুর নিরিখে সফল লেখকদের পাশে নিজেকে ব্যর্থ লেখক হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় কী? শত গ্রন্থের লেখক হয়েও শুধু লেখালেখির অর্থে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব হয় না। জানি এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করি, জনপ্রিয়তা বা বেস্টসেলার হওয়াটা সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড নয়। জনপ্রিয় গ্রন্থ মহৎ সাহিত্য হতে পারে, আবার মহৎ সাহিত্য সমকালে অনাবিষ্কৃত ও উপেক্ষিত থাকতে পারে। দৃষ্টান্ত বিস্তর। প্রতিবছর একুশে বইমেলায় যত বই বেরুচ্ছে, তার মধ্যে বেস্টসেলার সন্ধান করা সহজ। কিন্তু মহৎ সাহিত্য বা ভালো বইটি খুঁজে বের করবে কে? মূল্যায়নের প্রয়াস যেটুকু আছে, তাও প্রায়স মনে হয় পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা নগদ লাভের ধান্ধায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

এই পরিস্থিতিতে একজন লেখক একনিষ্ঠ পেশাদারিত্ব নিয়ে তার সৃজনকর্মে আত্মনিবেদিত থাকবেন কিসের আশায়? যেহেতু নবীন যৌবনের সার্বক্ষণিক লেখক হওয়ার স্বপ্ন-সাধনাকে শেষ বয়সে এসেও আঁকড়ে ধরেছি আবারও, প্রশ্নটা প্রায়শ করি নিজেকে। এই আত্মজিজ্ঞাসার সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে শেষ করি এ লেখটা। ব্যর্থতার দীর্ঘ পটভূমিতে নতুন করে একটি সফল গ্রন্থ লেখালেখির কাজে একনিষ্ঠ ও আত্মসমর্পিত থাকতে চাই এ কারণে যে, লেখা আমার কাছে বাজারে বিপন্ন হওয়ার জন্য নিছক পণ্য সৃষ্টি নয়। লেখালেখি আমার কাছে নিজের যাপিত জীবনের মূলধন রাখার আঁধার। আমার মুক্তি সংগ্রামের অস্ত্র, বেঁচে থাকার আনন্দ, বেদনা এবং প্রেরণাও বটে। চলবে

 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা