X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ ।। পর্ব-১

মাইনুল ইসলাম মানিক
৩০ মার্চ ২০২৩, ১৮:৪৩আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৩, ১৮:৪৩

চৈতন্যে ধরা দেয়া অনুভূতিকে সুনিপুণ শব্দজালে বন্দী করার প্রয়াসে ব্রত থাকাই লেখকের পরম ধর্ম। তিনি সচেতন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে স্থান, কাল ও ঘটনার নিরিখে তুলে আনেন লেখার অনুষঙ্গ। তাই প্রতিটি সাহিত্যকর্মই রচিত সময়ের সাথে স্থানিক সাক্ষ্য বহন করে। কালের আবর্তে ঘটে যাওয়া এমন কিছু ঘটনাপ্রবাহ থাকে যা সমকালীন এমনকি পরবর্তী লেখকগণের মানসভূমিতে ছায়াপাত করে, ফিরে ফিরে এসে প্রবল কশাঘাত করে মনোদরজায়। কালের পরিক্রমায় এই জনপদে ঘটে যাওয়া তেমনই একটি ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গপথ পেরিয়ে এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা পেয়েছি উদিত সূর্যের দেশ। সুদীর্ঘ নয় মাস যে রক্তের উষ্ণ স্রোতে বয়ে গেছে এই জনপদে, যে আর্তনাদে ভারী হয়েছে এই আকাশ; শব্দের ক্যানভাসে তার স্বরূপ তুলে ধরে অনুরূপ দৃশ্যের ভেতর পাঠককে প্রোথিত করার চেষ্টা যেকোনো শক্তিমান লেখকের জন্যে শুধুমাত্র দুরূহই নয়, অসম্ভবও বলা চলে। স্বল্প পরিসরের সাহিত্যকর্মে বিশেষ করে কবিতা বা ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সেটি একেবারেই অকল্পনীয়। ছোটগল্পমাত্রই স্বল্প পরিসরের ক্যানভাস যেখানে, রবীন্দ্রনাথের মতে, বর্ণনার ছটা থাকে না, ঘটনার ঘনঘটা থাকে না, তত্ত্ব থাকে না, উপদেশ থাকে না, হঠাৎ শুরু হয়ে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধকাল থেকে শুরু করে বিগত পাঁচ দশকে বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ গল্পকারই তাদের লেখায় অনুষঙ্গ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে এনেছেন, ছোটগল্পের ক্যানভাসে শব্দের শৈলীতে সপ্রাণ করে তুলতে চেয়েছেন যুদ্ধকালীন সময় ও ঘটনাকে। প্রায় অধিকাংশ গল্পের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন টুকরো ঘটনাকে উপজীব্য করে সেগুলো লেখা হয়েছে। মূলত ছোটগল্পের ক্যানভাসে মুক্তিযুদ্ধের বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপট তুলে ধরা সম্ভবও নয়। তবে যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধপরবর্তী প্রেক্ষাপটে লেখা গল্পগুলোর পাঠান্তে যেকোনো পাঠকই সে সময় সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পারেন। মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরুর লগ্ন থেকেই এদেশের লেখকগণের কলম সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়ে এখনও লেখা হচ্ছে। অনেক লেখক সরাসরি যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে অনুষঙ্গ তুলে নিয়েছেন। আবার অনেকেই পরোক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ সংবেদের আশ্রয়ে গল্পকে ঘটিত বাস্তব সত্যের উচ্চতায় কিংবা ঘটিত বাস্তবতাকে গল্পমানে উন্নীত করার প্রয়াস দেখিয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ গল্পের ক্ষেত্রেই একটি বিষয় লক্ষণীয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগকেই এসব গল্পের উপজীব্য বিষয় হিসেবে তুলে আনা হয়েছে। এই লেখায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গল্পসমূহের বিষয়-আশয়কে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে বেশকিছু গল্প লিখেছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘নামহীন গোত্রহীন’ গল্পগ্রন্থটি। এই গ্রন্থের সাতটি গল্পের সবকটি গল্পই মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে রচিত। যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে রচিত এই গ্রন্থের গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভূষণের একদিন, নামহীন গোত্রহীন ও কৃষ্ণপক্ষের একদিন। তিনটি গল্পেই মূলত উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের বর্ণনা। উঠে এসেছে বাঙালি জাতির প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের গল্প। ভূষণের একদিন গল্পে রাষ্ট্র ও রাজনীতির মারপ্যাঁচ না-বোঝা গ্রাম্য চাষাভূষার ওপর পাকিস্তানিদের বর্বর নির্যাতনের চিত্র দেখা যায়। এই গল্পের মূল চরিত্র ভূষণ একজন গ্রাম্য চাষা। সে যুদ্ধের সাত-পাঁচ নিয়ে ধার ধারে না। কিন্তু এই যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে তার রেহাই মেলে না। রেহাই মেলে না তার মতো রাষ্ট্রের সাত-পাঁচ না-ভাবা অপরাপর চাষাভূষারও। একদিন পুত্র হরিদাসকে খুঁজতে সে হাজির হয় দোকানে জড়ো হওয়া মানুষের ভিড়ে। হঠাৎ সেখানে পাকিস্তানি হানাদাররা উপস্থিত হয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়। পাখির মতো গুলি করতে থাকে মানুষকে। হাসান আজিজুল হকের বর্ণনায়- ‘চিৎকার করতে করতে মানুষজন তীব্রবেগে দৌড়াতে দৌড়াতে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, কেউ মুখ ফিরিয়ে একবার নদীর দিকে তাকায়, তারপর তলপেট চেপে মাটিতে বসে পড়ে আর রক্ত ছোটে কলকল ঝনঝন শব্দে।’ তেঁতুলগাছের দিকে এগিয়ে আসা এক চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের তরুণীর কোলের শিশুর মাথায় গুলি লাগে। রক্ত ও মগজ বেরিয়ে আসে। তরুণীটি হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে। কিন্তু তার হাত বেয়ে রক্ত আর সাদা মগজ গড়িয়ে পড়ে। স্থির হয়ে যায় শিশুটির শরীর। তরুণীটি এই দৃশ্যে উন্মাদপ্রায় হয়ে ওঠে। সে বুকের ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলে। বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দুধেভরা ফুলে ওঠা স্তন। সে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘মার হারামির পুত, খানকির পুত- এইখানে মার। পরমুহূর্তেই পরিপক্ব শিমুল ফলের মতো একটি স্তন ফেটে চৌচির হয়ে গেল। ছিটকে এসে সে পড়ল তেঁতুলতলায়। আক্রোশপূর্ণ ভয়শূন্য চাউনি নিয়েই সে মরে রইল।’ শেষ বাক্যটিতে হানাদারের প্রতি বাঙালি জাতির ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ইঙ্গিত মেলে। একটা নারী যে আক্রোশে বুকের ব্লাউজ খুলে বুক চিতিয়ে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়েছিল, মৃত্যুর পরও সেই আক্রোশ তার নির্ভীক চেহারায় ফুটে উঠেছিল। কৃষ্ণপক্ষের একদিন গল্পটিতে উঠে এসেছে পাঁচ তরুণের প্রতিরোধের গল্প। রাজাকারের রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে তারা শত্রু মুখোমুখি দাঁড়ায়। অনাধুনিক অস্ত্র দিয়ে শত্রু মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা বুঝতে পারে মেশিনগানের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তারা পিছু হটে। কিন্তু তাদের একজন শত্রু গুলিতে মারা যায়। অবশিষ্ট চারজন খাল সাঁতরে ওপারে নিরাপদে পৌঁছে ঝোঁপের মধ্যে বিশ্রাম নেয়ার সময় পাকহিনীর একটি দল তাদেরকে ঘিরে ফেলে। তাদের তিনজন শত্রুর হাতে শহিদ হলেও একজন পাকসেনাকে কষে লাথি মেরে খালের পানিতে লাফিয়ে পড়ে। সাথে সাথে বৃষ্টির মতো গুলি ঝরতে থাকে খালের পানিতে। যুদ্ধকালীন সময়কে ধারণ করে হাসান আজিজুল হকের আরেকটি গল্প ‘নামহীন গোত্রহীন’। এই গল্পটির বর্ণনায় উঠে এসেছে যুদ্ধকালীন রাতের বিভীষিকাময় এক বাংলাদেশের চিত্র। জনমানবশূন্য পথঘাট, পাকসেনাদের গাড়ি ছাড়া রাস্তায় কোথাও কিছু নেই, দরজা বন্ধ করে দমবন্ধ এক সময় পাড়ি দিচ্ছে মানুষ। সর্বত্র আতঙ্ক আর উদ্বেগ। এই গল্পটির সাথে কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায় বিপ্রদাশ বড়–যার সাদা কফিন গল্পের রাতের ঢাকা শহরের। পুরো শহরের রাস্তায় কোথাও কেউ নেই। গল্পকথকের কাছে এক অঘোষিত কারফিউ মনে হয়। এই দুটি গল্পের মূল দুটি চরিত্র রাতের ভয়াল সময়ের সাক্ষী। তারা পাকসেনাদের ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে। তারা ঘরে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন নিজের মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ করে আর অপরজনের সাক্ষাৎ ঘটে প্রিয়জনদের দেহাবশেষের সাথে। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে সে তুলে আনে স্ত্রী ও সন্তানের পায়ের পাতা, হাড়গোড়, চুলের গোছা। সে পুনরায় কোদাল চালাতে থাকে যেন পৃথিবীর নাড়িভুঁড়িসুদ্ধ বের করে আনবে। দারুণ মুন্সিয়ানার সাথে গল্পের শেষ লাইনটিতে একটি প্রবল মোচড় দিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। যুদ্ধকালীন সময়ের আরেকটি গল্প রফি। এই গল্পের মূল চরিত্র রফি কৃষিকাজ করে। সে একদিন যুদ্ধে যোগ দেয় এবং হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তারা রফিকে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। রফি হত্যার রোমহর্ষক বয়ানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় গল্পটি। যুদ্ধের শেষদিকে যখন একের পর এক বিভিন্ন এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসতে থাকে, যখন হানাদার বাহিনী হতোদ্যম হয়ে পড়ে এবং আটক হতে থাকে, সে সময়ের চিত্র উঠে আসে হাসান আজিজুল হকের ‘আটক’ গল্পে। তার ‘কেউ আসেনি’ নামক গল্পে দেখা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবাই আনন্দ-উল্লাস করতে থাকলেও হাসপাতালে পড়ে থাকা মুমূর্ষু আর মৃতদেহের খোঁজ নিতে কেউ আসে না। হাসান আজিজুল হকের ঝড়, নবজাতক ও নিশীথ ঘোটকী নামে আরও তিনটি গল্প আছে যে গল্পগুলোতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ত্রস্ত মানুষের পলায়ন, আতঙ্ক ও শঙ্কার চিত্র ফুটে ওঠে।

যুদ্ধপরবর্তী প্রেক্ষাপটেও অনেকগুলো গল্প লিখেছেন হাসান আজিজুল হক। যুদ্ধ শেষে ঘরে ফেরে আলেফ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। এই আলেফের ঘরে ফিরে যাবার পর যা ঘটে তা পাঠককে চমকে দেয়। আলেফের ভাগ্য নগুগি ওয়া থিয়োঙের ‘দ্য চেইঞ্জ’ গল্পের নায়ক কাম্যুর ভাগ্যের মতো মন্দ নয়। কাম্যু বাড়ি ফিরে দেখেছিল, তার স্ত্রীকে আরেক প্রতিবেশী যুবক তার মৃত্যুর গুজব শুনিয়ে নিজের করে নেয়। এরিক নেলসনেরও এমন একটা গল্প আছে ব্লেক‘স গার্ল নামে। ব্লেকের বন্ধু ডেভ তার মৃত্যু সংবাদ শুনিয়ে স্ত্রী অ্যামিকে দখলে নেয়। এরপর ডেভের নিজের ভেতর একটা দহন চলতে থাকে। অবশ্য সে যুদ্ধে ব্লেক নিহত হয়েছিলেন। যুদ্ধে কিংবা যুদ্ধের গল্পে মা-স্ত্রী-পরিবার-পরিজন হারানোর বা চলে যাওয়ার ঘটনা নৈমিত্তিক। ঘরে ফিরে কাউকে না পাওয়ার গল্প অগুনতি। কিন্তু আমাদের ‘ফেরা’ গল্পের নায়ক আলেফের ক্ষেত্রে কথাকার হাসান আজিজুল হক দেখিয়েছেন একেবারেই ভিন্ন কিছু। আলেফ ঘরে ফিরে দেখে তার স্ত্রী ফিরে এসেছে। যুদ্ধে যাওয়ার আগে খাবার না পেয়ে সে আলেফের ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এখন সে আবার ফিরে এসেছে। ঘরে তার বৃদ্ধা মা আর স্ত্রী দুজনেই আছেন। আলেফ জানে, যুদ্ধোত্তর দেশে অভাব কতটা প্রকট হয়ে ওঠে। তাই সে স্ত্রীর দিকে অস্ত্র তাক করে জানতে চায়, খাবার না পেলে আবার ছেড়ে যাবে কি-না। কান্নায় ভেঙে পড়ে স্ত্রী এবং প্রতিজ্ঞা করে, যত কষ্টই হোক আর ফিরে যাবে না। এরই মধ্যে সরকারি ঘোষণা আসে তিনদিনের মধ্যে সকল অস্ত্র সমর্পণের জন্যে। কিন্তু আলেফ ভবিষ্যতের বিষয়ে সন্দিহান। সে ভাবে, হয়ত আবার যেকোনো সময় অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হতে পারে। তাই সে অস্ত্র জমা না দিয়ে পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। হাসান আজিজল হক তার ‘ঘরগেরস্থি’ গল্পে তুলে এনেছেন যুদ্ধপরবর্তী সময়ের কঠিন সমাজবাস্তবতা। আশ্রয়ের সন্ধানে ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া পরিবারগুলো দেশে ফেরার পর কতটা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তা দেখাতে চেষ্টা করেছেন তিনি এই গল্পে। শাসক বদল হলেও দুর্বলের ভাগ্য সহজে বদল হয় না, এই সত্যটিকে গল্পে তুলে এনেছেন কথাকার হাসান আজিজুল হক। তার গল্পগুলোর পাঠে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক একটি পরিস্থিতি অনুধাবন করা যায়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে তিনটি গল্প লিখেছেন কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনটি গল্পেই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। নাগরিকের মনোস্থিত দেশপ্রেমের সুপ্ত চেতনাকে উসকে দেওয়া। এই চেতনা উসকে দেওয়ার কাজটি করতে গিয়ে তিনি কোথাও কোথাও বর্ণনার দীর্ঘসূত্রিতা টেনেছেন। অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে এই বর্ণনা শৈলীকে কিছুটা স্থূলতা মনে হলেও এর পেছনে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। তিনি তার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা ও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে সরাসরি উপস্থাপন করতে চাননি। তিনি তার বক্তব্যকে ব্যঞ্জনাময় করে তোলার ক্ষেত্রে চরিত্রগুলোর আশ্রয় নিয়েছেন। তার ‘অপঘাত’ গল্পটির দিকে লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই, তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বুলু বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তারই বন্ধু চেয়ারম্যানপুত্র সাজাহান নিজের বাড়িতে অসুখে মারা যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শহিদ বুলুর মৃত্যু নিয়ে দীর্ঘ ন্যারেটিভের আশ্রয় নেননি। তিনি সাজাহানের মৃত্যুর বর্ণনাকে দীর্ঘায়িত করেছেন। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লেখক বারবার ফিরে গেছেন বুলুর বীরত্বের কাছে। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি উসকে দিয়েছেন বুলুর পিতার ভেতরের দেশপ্রেমের চেতনা। গল্পের শুরুতে আমরা দেখতে পাই, বুলুর পিতা মোবারক আলী এবং তার স্ত্রী অত্যন্ত ভীরু প্রকৃতির। সন্তানের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে মৃত্যুর পরও তারা দুজন শব্দ করে কাঁদতে পারেন না। তাদের মধ্যে এই ভয় কাজ করে যে, উচ্চ শব্দে কান্না করলে পাক হানাদাররা টের পেয়ে যাবে এবং তাদের দুর্গতি নেমে আসবে। এক রাতে উচ্চশব্দে কান্নার শব্দে চমকে উঠেন মোবারক আলী। তিনি ভেবেছিলেন, সন্তানের জন্যে স্ত্রী কাঁদছেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি টের পান, চেয়ারম্যানবাড়ি থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। চেয়ারম্যানের পুত্র সাজাহান মারা গেছে। চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশেই পাকবাহিনীর ক্যাম্প। তাদের সাথে চেয়ারম্যানের সখ্যও আছে। কিন্তু বাসায় যুবতী কন্যা থাকায় ভয়ে তিনি তাদের সাহায্য চাননি। সাজাহানের মৃত্যু হয় বর্ষাকালে। সেনা ক্যাম্পের সামনের একমাত্র পথ দিয়ে লাশ নিয়ে যেতে বারণ করে পাকবাহিনী। তাই কাদাজলের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রমের পর চেয়ারম্যান পুত্রের লাশ সমাধিস্থ করতে সক্ষম হয়। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জেগে উঠে মোবারকের ভেতরের দেশপ্রেমের চেতনা। সে নিজের সন্তানের মৃত্যু নিয়ে গর্ব করতে থাকে। জুমার নামাজে দাঁড়িয়েও তার মনোচক্ষুতে খোদার বদলে পুত্রের চেহারা ভাসতে থাকে। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে তার স্ত্রীর দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। মোবারক ভেবে পায় না, সন্তানের এমন বীরত্বপূর্ণ মৃত্যুর পর একজন মা কীভাবে অন্য বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সময় পায়, তার তো চিৎকার করে কান্নাকাটি করার কথা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আরেকটি বিখ্যাত গল্প ‘রেইনকোর্ট’। এই গল্পটিতেও আমরা ‘অপঘাত’ গল্পের মোবারক আলীকে রসায়নের অধ্যাপক নুরুল হুদার ভেতর দেখতে পাই। গল্পের শুরুতে আমরা এক ভীরু নুরুল হুদাকে দেখতে পাই যিনি তার শ্যালক মিন্টুর মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার তথ্য গোপন করার জন্যে চারবার বাসা বদল করেন। কিন্তু একদিন মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর রেইনকোর্টটি গায়ে দেওয়ার পর তিনি অন্যরকম এক চেতনা অনুভব করেন। পাক সেনাদের নির্মম অত্যাচারের পরও তার এই চেতনায়, এই মনোবলে বিন্দুমাত্র চিড় ধরে না। ‘মিলির হাতে স্টেনগান’ নামে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প লিখেছেন কথাকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এই গল্পটিতে আমরা সমাজের একটি শ্রেণিকে যুদ্ধের সময় আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখি। বিপথগামী রানার হাতের স্টেনগানটি পেতে চায় আব্বাস পাগলা। সে দেখতে পায়, দখলদার বাহিনী চাঁদের দখল নিয়ে নিচ্ছে। তাই শত্রু তাড়াবার জন্যে এই স্টেনগানটি তার দরকার। সবাই আব্বাসকে পাগল ভাবলেও মিলি তার কথার অর্থ বুঝতে পারে। তাই সবাই যখন আব্বাসকে ধরে হাসপাতালে রেখে আসে চিকিৎসার জন্যে, মিলি তাকে গোপনে দেখতে যায়। আব্বাস মূলত মিলির ভেতরে দেশপ্রেমের লুকানো বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আব্বাস সুস্থ হয়ে ফিরে এলে মিলি তার হাতে স্টেনগানটি তুলে দিতে চাইলে, সে তা ফিরিয়ে দেয়। তার সুস্থ মস্তিষ্ক আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর হয়ে ওঠে। তাই চেতনায় ঘোরগ্রস্ত মিলি হাতে তুলে নেয় স্টেনগান। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তিনটি গল্পেই মূলত আমরা এমন এক দেয়াশলাইয়ের কাঠি দেখতে পাই যা মানুষের ভেতরের আগুনকে জ্বালিয়ে দেয়, অন্ধকারকে তাড়াতে প্ররোচিত করে।

মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। তাঁর গল্পে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে আলোচনার নামে পাকিস্তানি শাসকদের কালক্ষেপণ, রণপ্রস্তুতি, যুদ্ধকালীন পাকবাহিনীর হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণ, বাঙালির তীব্র প্রতিবাদ এবং যুদ্ধপরবর্তী নিদারুণ সমাজবাস্তবতা। তার ‘বিস্ফোরণ’ নামক একটি ছোটগল্পে আমরা দেখতে পাই, ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রাক্কালে আলোচনার নামে ভাওতাবাজি করে কীভাবে কালক্ষেপণ করা হয় এবং বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে কীভাবে রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। পাকিস্তানি শাসক বাহিনী মানুষের মনে যে ঘৃণার বারুদ ছড়িয়ে দিয়েছিল তা মূলত বিস্ফোরন্মুখ হয়ে অপেক্ষমাণ ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং একটি সংঘাত অনিবার্য করে তোলা পাকবাহিনী কি বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ২৬শে মার্চ কালরাতে, তার নিখুঁত বয়ান উঠে এসেছে আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘যুদ্ধ নয়’ গল্পটিতে। এই গল্পটিতে একটি ব্যতিক্রম বর্ণনা শৈলীর আশ্রয় নিয়েছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। গল্পের কথক হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন জন নামের একটি কুকুরকে। মার্চের কালরাতে কী বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকবাহিনী তার বর্ণনা উঠে এসেছে এই গল্পটিতে। লেখকের বর্ণনায় সে রাতের একটি মুহূর্তের পাঠ নেয়া যাক, ‘একটি ক্রুদ্ধস্বরের সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলোর দৌড়াদৌড়ি আর্তচিৎকার, কিন্তু পালাবে কোথায়? পেট্রোল ছড়িয়ে মারছে ধুমসে আগুনের গোলা, অল্পক্ষণেই দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল সারাগলি।’ আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সবচেয়ে মর্মস্পর্শী গল্পটি হচ্ছে ‘নীরবতা’। এই গল্পটিতে হানাদার বাহিনীর নারী নির্যাতনের ভয়ংকর চিত্র ফুটে ওঠে। গল্পটির মূল চরিত্র তুফানী। তার ভাই মুক্তিফৌজের সদস্য। নুরা নামের এক রাজাকার এসে তাকে খবর দেয়, তার ভাইকে পাকিস্তানি বাহিনী আটক করেছে এবং তাকে উদ্ধার করতে হলে তুফানীকে মেজরের নৌকায় যেতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা ভাইকে বাঁচাতে তুফানী মেজরের নৌকায় যায় এবং নিপীড়ক মেজরকে নিয়ে খর¯স্রোতা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সন্ধান মেলে না তুফানীর কিংবা মেজরের, সন্ধান মেলে না তুফানীর এই অসম সাহসিকতার গল্পের। কোনো খবরের কাগজের পাতায় কিংবা জনসশ্রুতিতে তুফানীর গল্প প্রাধান্য পায় না। যুদ্ধের পর অসম সাহসিকতা নিয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে মানুষ ভুলে যায় তার দৃশ্যপট নিয়ে ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ নামক একটি গল্প লিখেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। যুদ্ধ করতে করতে হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে এক যোদ্ধার। তার সঙ্গীরা তাকে মৃত ভেবে রেখে চলে যায়। ঠিক সে সময় একটি গাড়ি তাকে উদ্ধার করে ভারতের হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। যুদ্ধের কয়েক বছর পর সুস্থ হয়ে নিজের গ্রামে ফিরে আসা সেই মুক্তিযোদ্ধাকে চিনতে পারে না তার পরিবারের সদস্যরা। তার ঘরের স্ত্রীটাও হয়ে যায় অন্য কারও। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরও বেশকিছু গল্প লিখেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। গল্পগুলোর মধ্যে ‘রূপান্তর’, ‘দূরযাত্রা’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ‘সংক্ষিপ্ত রূপ’, ‘আগন্তুক’, ‘আমার রক্ত’, ‘জ্বলনাঙ্ক’, ‘কাক’ প্রভৃতি গল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা