[সাংঘাতিক অসুখ। ভাংগাতিক শরীর।]
অসুখ। অসুখ মানে সুখ নেই, এমন নয়। অসুখ মানে রোগ। রোগের ফলে অসুখও, মানে সুখ নেই। সে দেহে অসুখে, সে মনে অসুখী।
কী রোগ সে জানে না। ডাক্তারেরা হয়তো জানে। কিন্তু শ্রীদাম নামের কোনো এক লোকের যে পৃথিবীর ভেতর রোগ হয়েছে সে কথা পাশ করা কোনো ডাক্তার জানে না। পাশ করা কোনো ডাক্তার তাকে দেখবে এমন আশাও তার নেই। তার আর্থিক দুরবস্থার কাছে ডাক্তার একটা বিলাস। ডাক্তারবিলাস করার কথা চিন্তাতেও আনে না সে। লাশ পড়ে যাক সমস্যা নেই, বিলাস করা যাবে না।
প্রায় বছর হতে গেল শ্রীদাম বিছানায় পড়ে আছে। সময় স্থির উঠোন। সময়ের উঠোন দিয়ে সূর্য হাঁটে, চাঁদ হাঁটে। তার কাছে দিন রাত সমান প্রায়। প্রহর বলে কিছু নেই শুধু প্রহার আছে দুর্গতির। কাতর হয়ে পড়ে থাকে শ্রীদাম। নিয়ম করে সূর্য এসে শ্রীদামের কার্যত দেখে যায়, চাঁদ এসে দেখে যায় তার দশার দুরবস্থা। সূর্যের মুখে নির্মম গাম্ভীর্য, চন্দ্রের চোখে অমম হাসি। শ্রীদামের মরণব্যথা আছে—দীর্ঘতমমৃত্যুহীনমরণামমব্যথা—কিন্তু মরণ নেই।
[মৌচাকের মধু। বৌচাকের বিষ।]
শ্রীদামের রোগের কথা কয়েকমাস থেকে একটা গেঁয়ো ডাক্তার জানে। কিন্তু সে রোগ বিষয়ে কিছু জানে বলে মনে হয় না। আসে-যায়, ওষুধ দেয়, ভালো হয় না।
ভালো হলে ভালো হতো। খারাপ হলেও খারাপ হতো না; খারাপ হলেও ভালো হতো। কিন্তু নতুন কিছুই হয় না পুরাতন অবস্থাটাই একেবারে নতুন হয়ে আছে, অসুখটা স্থির হয়ে আছে ছাপা অক্ষরের মতো। রোগটা স্থির হয়ে আছে, শ্রীদামকেও স্থির করে দিয়েছে। একই শরীরে যুগপৎ মরন্তভাব আর জীবন্তভাব নিয়ে থেকে থেকে শ্রীদাম অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।
সাংঘাতিক অসুখ আর ভাংগাতিক শরীর নিয়ে শ্রীদাম শুয়েই থাকে সবসময়। যখন ঘুম আসে ঘুমায়। তখন তার বিছানা হয়তো জেগে গিয়ে বাইরে চলে গেছে। বিছানাটিও ক্লান্ত তার শুয়ে থাকার ভার, ঘুমের ভার আর জেগে থাকার ভার বয়ে বয়ে। কোনো কোনো সময় শ্রীদাম জেগে থাকে। ক্লান্ত বিছানা ঘুমায়।
[মাধ্যাকর্ষণশক্তি পাতালগামী স্রোতে। পৃথিবীর সবকিছুই বাধ্যতামূলকভাবে পাতালগামী।]
শ্রীদাম অনেকসময় নিজের ঘুম বা জেগে থাকা নিজেই বুঝতে পারে না।
আরতি সামনে থাকলে প্রশ্ন করে— ‘আমি জেগে আছি না ঘুমুচ্ছি গো।’
আরতি কিছুই বলে না, বাঁকা চোখে তাকিয়ে চলে যায়। আগেও তার চোখ বাঁকানি ছিল কিন্তু সে বাঁকা ছিল মধুর; আঁচল ধরে টান দিলেই বাঁকা চোখে তাকাত; দূরে সরে যাওয়ার ছলে আরো কাছে চলে আসত। কত মধু ঝরত সেই বাঁকানো চোখ-চাক দিয়ে। আহা, এখনের বাঁকা চোখ, তখনের বাঁকা চোখ; কত পার্থক্য। মৌচাক থেকে মধু ঝরে; কখনো বিষ ঝরে কি? বৌচাক দিয়েও মধু ঝরে, সময়ের ফেরে সেই চাক দিয়েই ঝরে বিষ।
শুয়ে থাকতে থাকতে শ্রীদাম একা একা কথা বলে— ‘আমি ঈশ্বরের গু, মানুষ যেমন মলত্যাগের পর তার গুয়ের দিকে তাকায় না, মনে রাখে না তেমন ঈশ্বরও আমার দিকে তাকিয়ে দেখে না।’
একথা বলার পর তার মনে সন্দেহ জাগে— ‘কথাটা সে মনে মনে বলল, না উচ্চারণে বলল।’
শ্রীদামের রোগের সাথে সাথে এও এক রোগ ধরেছে তাকে; সন্দিহান-রোগ— সে জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে?
কোনো কথা বলার পর নিজেরই প্রশ্ন জাগে, কথাটা সে মনে মনে বলল না উচ্চারণে বলল?
এমনকি আরতিকে মাঝে মাঝে এমন প্রশ্নও করে— ‘আমি রেগে আছি না শান্ত আছি গো?’
একটা টিকটিকি আর একটা টিকটিকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। যে টিকটিকি এগিয়ে যাচ্ছিল সেটা ছিল পশ্চিমের দেয়ালে আর যে টিকটিকি এগিয়ে আসছিল সেটা ছিল পূর্বের দেয়ালে। শ্রীদাম দেখল।
শ্রীদামের একটু কাত হবার ইচ্ছে হয়। কাত হতে পারে না। মনে মনে কাত হয় ডান দিকে। ডান দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ কাটে। ডান কাতে তাকাতে তাকাতে ক্লান্ত হলে মনে মনে বাম কাতে ঘুরে। এভাবে একভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে বেডসোর হবার মতো অবস্থা হয়েছে। মাধবী মাঝে মাঝে উলট-পালট করে দেয় বলে এখনো পুরোপুরি বেডসোর হয়নি।
পিঠে জ্বলুনি ধরে, সুড়সুড় করে। পিঠে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে, চুলকাতে ইচ্ছে করে, যদি পিঠটাকে খুলে কিছুক্ষণের জন্য বুকের ওপর আনা যেত বড়ো ভালো হতো; নিজের পিঠে হাত বুলিয়ে খুব আদর করত; ভালো করে চুলকিয়ে চুলকানোর স্বাদ নিত। তার উপায় নেই।
শরীরের যেখানে পিঠ বাস করে আর হাত-পা বাস করে; শরীরের যেখানে পেট বাস করে আর মাথা বাস করে; শরীরের যেখানে যে অঙ্গ বাস করে সেই অঙ্গ সেখানেই বাস করছিল, বাস করে, বাস করবে; এতটুকু নড়চড় হয়নি, হবে না। মরে গেলে ভিন্ন কথা; যে মরে মৃতদেহ তখন তারও নয় আর কারুরও নয়। ফলে মরে যাবার পরে পা আর হাত যেতে পারে এক কুকুরের পেটে; নাক আর ফুসফুস যেতে পারে আলাদা আলাদা শেয়ালের পেটে।
অভিযোগ করার থাকবে না— নাক যে শেয়ালের পেটে গেল ফুসফুসও সেই শেয়ালের পেটে গেল না কেন?
তার মনে পড়ে, বিরাট এক মাঠের ভেতর পড়ে থাকা একটা হাতের কথা। শুধু একটা হাত পড়েছিল। হাতটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, এ বুঝি মাটিরই হাত, এ মাঠেরই হাত। মাঠটা হাত মেলে শুয়ে আছে, তার আরেক হাত হয়তো আরেক প্রান্তে রয়েছে; দেখা যাচ্ছে না শুধু। মাঠটা হাত মেলে শুয়ে আছে যেমনভাবে শুয়ে থাকে দুদিকে হাত মেলে ক্লান্ত কৃষাণ।
কিন্তু হাত শুধু পড়ে ছিল না। আর এক জায়গাতে পড়েছিল একটা কান; দেখে মনে হচ্ছিল কানটা বুঝি এ মাঠের মাটিরই, আকাশ থেকে কোনো বাণী আসছে কি না তাই উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করছে।
আর একটু দূরে পড়ে ছিল নাক; এ যেন মাটিরই নাক; মাঠ শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে, মাঠের বুক শ্বাসে শ্বাসে ওঠা নামা করছে যেমনভাবে মানুষের বুক করে।
আরেকটু দূরে একটা ইঁদুর বা ঝিঁঝির খালে সামান্য ঢুকে ওপর দিকে মুখ করেছিল শিশ্ন; মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবীর শিশ্ন এটা। মনে হচ্ছিল, যেন এখনি পুরো আকাশ তার যোনি মেলে নেমে এসে তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হবে।
এ কথা বহুদিনের। তবু লোকটার জন্য তার মন বেদনায় ভরে উঠল। ঐ লোকটার লাশের বাকি অংশও ছিন্নভিন্ন হয়ে পুরো মাঠে ছড়ানো ছিল।লোকটার কথা ভাবতে ভাবতেই আবার তার পিঠ সুড়সুড় করে ওঠে। শ্রীদাম মনে মনে পিঠ চুলকায়, মনে মনে পিঠে হাত বুলায়। তার চোখ ভরে জল চলে আসে— চোখের জল মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মানে না নাকি?
সে চিত হয়ে শুয়ে আছে তবু ঠেলে বের হয়ে আসছে। মাধ্যকর্ষণ শক্তি মানলে বা মাধ্যকর্ষণ শক্তি বেশি শক্তিশালী হলে অশ্রুর ফোটা চোখ দিয়ে বের না হয়ে মাথার পিছন দিয়ে বের হয়ে বালিশ ভেদ করে, খাটের কাঠ ভেদ করে, মাটি ভেদ করে পাতালে চলে যেত; কেউ দেখতে পেত না। কিন্তু তা হলো না, তার ভেতরের বেদনাশক্তি অশ্রুজলকে ঠেলে পাঠাল মাধ্যকর্ষণ শক্তিকে হারিয়ে। কিন্তু মাধ্যকর্ষণ শক্তি তো পৃথিবীর মৌলিক নিয়তি, মৌলিক নীতি। এই মৌলিক নিয়তিকে, নীতিকে কি হারানো যায়? জোরজবরদস্তি করে হয়তো কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যায় কিন্তু পুরো পরাস্ত করা যায় না কখনোই। চোখের জল ভেতর থেকে ঠেলে বের হয় বটে কিন্তু শেষে ঠিকই কপালের দুপাশ বেয়ে গড়িয়ে মাটিতে মিশে যায়। পাখি উড়ে বেড়ায় বটে কিন্তু একদিন ঠিকই মাটি ভেদ করে ঢুকে যায় মাটির গভীরে, ঢুকে যায় মাধ্যকর্ষণের হৃৎপিণ্ড। মাধ্যকর্ষণ তো একটা প্রবল স্রোতে; নদীর প্রবল স্রোতে যেমন একদিক থেকে আরেকদিকে নিয়ে যায় মাধ্যকর্ষণের স্রোতে তেমন ওপর থেকে পাতালের দিকে নিয়ে যায়। পৃথিবীর সবকিছুই বাধ্যতামূলকভাবে পাতালগামী এই মাধ্যকর্ষণের টানে।
শ্রীদাম, কিছুক্ষণ আগে নিজের সাথে ঈশ্বরের গুয়ের তুলনা সম্পর্কিত বলা বাক্যটি সম্পর্কে সন্দেহ মুক্ত হবার জন্য সরাসরি ঈশ্বরের দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে মারে— ‘হে ঈশ্বর আমি কি তোমার গু?’
কোনো উত্তর না পেয়ে তার মেয়েকে ডাকে— ‘মাধবী; মাধবী মা রে এদিকে একটু আয় তো।’
মাধবী আসে না। মাধবীর না আসাতে তার মনে আবার সন্দেহ জাগে, সে, মাধবীকে মনে মনে ডেকেছে না, উচ্চারণে ডেকেছে?
এই সেই সমস্যা যে সমস্যায়, মনে মনে বলা কথাকে কোনো কোনো সময় মনে করছে ‘মুখে বলেছে’, কখনো মুখে বলা কথাকে মনে করে, ‘বুঝি মনে মনে বললাম, নইলে কেউ শুনলো না কেন, সাড়া দিল না কেন?’
সে এবার আবার ডাকল, সচেতন হয়ে ডাকল— ‘মা রে, মাধবী।’
‘বাবা আসি’— মাধবীর কণ্ঠ শুনেও তার সন্দেহ দূর হয় না।
মাধবী এলে জিজ্ঞাসা করে— ‘মা তোকে কবার ডেকেছিনু বলত?’
মাধবী বলল— ‘বাবা, এসব বাদ দাও। কেন ডেকেছ বলো?’
শ্রীদাম বলল— ‘এমনিতেই রে মা। তুই যা।’
মাধবীর সাথে কথা বলেও তার মনের গোল গেল না।
মানুষের মনের গোল যায় কি?
গোলটা আসলে কী?
কী নিয়ে গোল-মানুষের গোল; লম্বা-মানুষের গোল?
কেন এত গোল?
একেকটা মানুষ একেকটা গোলের গোডাউন। একেকটা মানুষ একেকটা গোলের গোলা, বোমা, বন্দুক। সুযোগ পেলেই মানুষ ফেটে যায় সুখে, দুর্যোগ পেলেই মানুষ ফেটে যায় বেদনায়, মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে হরেক রকমের গোল। গোলের ঘূর্ণিতে ঘুরছে জগৎ। গোলে গোলে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ, গোলে গোলে কেটে যাচ্ছে মানুষ।
[একজন মানুষ অজস্র সহস্র সংগমের ফল]
শ্রীদাম ঘরের দেয়ালের দিকে তাকাল— মাট-দেয়াল। আগে গোলাদ বা কাঠের গুঁড়া বা ধানের গুঁড়া দিয়ে পরিস্কার করে লেপা থাকত। পিটুলি দিয়ে সুন্দর আলপনা আঁকা থাকত। এখন আর সেসব নেই। দেয়ালের চটা উঠে গেছে। কোথাও কোথাও দাঁত বের হয়েছে দেয়ালের। দেয়ালের এসব আলপনার ওপর— মঙ্গলচিত্রের ওপর অযত্নের লাঙল চলছে।
শ্রীদামের অসুখের সাথে সাথে যেন ঘরদোরেরও অসুখ হয়ে গেছে। একটা অব্যবস্থা অবস্থা আর অসুখকর আবহ ভয়াল ময়ালের মতো প্যাঁচিয়ে রেখেছে সবকিছুকে। ঘরজোড়া শুধু অসুখ আর অসুখ।
দেয়াল লেপাপুছা করত, মঙ্গলচিত্র আঁকত আরতি নিজেই। এখন আর সময় পায় না।
কোথায় গেছে তার সময়?
কোথায় বেড়াতে গেছে তার সময়?
তার সময়ের গায়েও আগুন লেগে গেছে?
তার সময় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে?
পোড়া সময়ের ছাইয়ের গাদায় নতুন সময় গজিয়েছে আরতির?
নতুন সময়ের চারায় ফাগুন লেগে গেছে?
শ্রীদাম দেখল, দেয়াল বেয়ে টিকটিকি দুটো এগুচ্ছে। একজন পূর্ব থেকে পশ্চিমে, একজন পশ্চিম থেকে পূর্বে। তারা তাদের কাছে পৌঁছে গেল বলে। টিকটিকিদের চোখ কী ঠান্ডা!
কোনো চোখ কি আসলেই ঠান্ডা হয়?
তা হোক টিকটিকির বা বাঘের বা ছাগের চোখ; ঠান্ডা হয় কি?
ছোটোকালে কালীমন্দিরে বলি দেওয়া পাঁঠার চোখ হাতে মুঠি করে ধরেছিল একবার। কী গরম! যেন হাতে গর্ত করে ঢুকে যাবে। পাঁঠার চোখ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি শ্রীদাম।
মানুষের চোখও তো নিশ্চয় মানুষ হাতে নিয়ে দেখেছে। খুন করার পর খুনি লাশের সাথে মেলাকিছুই করে। কেউ রক্ত পান করে, কেউ হৃৎপিণ্ড বুক খুঁড়ে বের করে হাতে ধরে থাকে, কেউ মাথা নিয়ে ফুটবলের মতো দুচারবার পা দিয়ে গড়ায়।
কেউ কি চোখ উপড়ে নিয়ে হাতের তেলোতে ধরে সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেনি?
মনে করেনি, তার হাতের তালুতেও চোখ গজিয়েছে নতুন; মনে করেনি ব্যাসের গুরু গৌতম যেমন অক্ষপাদ ছিল তেমন আমি একজন অক্ষহস্ত?
চোখের গরম সহ্য করতে না পেরে ফেলে দেয়নি কি সেই চোখ সেই খুনি?
খুনির পায়ের তলে পড়ে সেই চোখ গলে যায়নি কি টাটকা লিচুর মতো?
অসুস্থ শ্রীদামের মনের ভেতর প্রচুর সুস্থ প্রশ্নের জন্ম হয়।
তার মনে প্রশ্ন জাগে— ‘আমি পৃথিবীর কে?
আমি এই বিছানাটার কে?
মাধবীর কে?
খাদ্য-খাবার আমার কে হয়?
শরীরের অসুস্থতার সাথে আমার সম্পর্ক কী?
আমি আমার কে?
যাদেরকে চিনি তাদের কে?
আমি যাদেরকে চিনি না তাদের কে?
আমি মাধবীর মায়ের কে?
কে গেঁয়ো ডাক্তারের?’
কে কার কে হয়?
তার প্রশ্ন উথলে ওঠে— ‘টিকটিকিগুলো পৃথিবীর কে?
দেয়ালগুলো ঘরের কে?
আমি আমার দেহটার কে?
দেহ অসুস্থ আছে তবে আমাকে কেন শুয়ে থাকতে হবে?
দেহ অসুস্থ, দেহ শুয়ে থাকবে; আমি কেন দেহ আর অসুখবিসুখের ফাঁকে পড়ে বেদনা পাচ্ছি?
এই ফাঁকে পড়ে আর ফাঁদে জুড়ে থেকেই জীবন পার করতে হবে?’
আচ্ছা, জীবন তাহলে পারাপারের ব্যাপার?
জীবন পার হতে হয় মানুষকে? যেমনভাবে নদী পার হয়?
নদীর এপারে গ্রাম, ওপারে জঙ্গল। জীবনের পরে মরণ তাহলে জীবনের আগে কী?
সজস্র কোটি সংগমের, তারও বেশি সংগমের ফল একটা মানুষ। একজন তার বাবামায়ের সংগমের ফল শুধু নয় তারও আগে তার পিতামহপিতামহীর, তারও আগে তার প্রপিতামহপ্রপিতামহীর... তারও আগে আরো... আরও আগে আরও আরও পূর্বপুরুষের সংগমের ফল।
শ্রীদাম মনে মনে হাহারবে হেসে ওঠে— ‘শিশ্ন আর যোনির ঘর্ষণে মানুষের জন্ম। জঘন্য! ছিঃ ছিঃ!’ তার থুথু ফেলার ইচ্ছে হয় নিজের শিশ্নের ওপর। সে মনে মনে তার শিশ্নের ওপর থুথু ফেলে।
তার ইচ্ছে করে আরতির যোনির ওপর থুথু ফেলতে। সে মনে মনে থুথু ফেলে সেখানেও।
থুথু ফেলতে ফেলতে তার জিভ শুকিয়ে আসে, গলা শুকিয়ে আসে। পৃথিবীতে শুকিয়ে যাওয়া গলা ভেজানোর কোনো শরবত নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ তবু সে থুথু ফেলতে থাকে। থুথু বাইরের দিকে পড়ে না, পড়ে গিয়ে তার নিজেরই ভেতরে। তার থুথু ফেলা আসলে থুথু গেলা।
তার ভেতরটা তারই থুথুতে ভরে ওঠে। থুথুতে থুথুতে ফুসফুস ভরে ওঠে, হৃদয় ভরে ওঠে, পেট ভরে ওঠে। সে যদি এখন প্রসাব করে মুতের বদলে ফেনার মতো থুথু বেরুবে। যদি পায়খানা করে থুথু বেরুবে। যদি কাঁদে চোখ দিয়ে থুথু বেরুবে। যদি গা কাটে রক্তের বদলে থুথু বেরুবে।
সারা জীবনে যত ভাত খেয়েছে, যত জল খেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি থুথু খেয়েছে সে। নিজের থুথু, পরের থুথু, প্রকৃতির থুথু, ঈশ্বরের থুথু। শ্রীদাম একটা থুথুজীবী। থুথুজীবী শ্রীদাম শুয়ে থাকে শরীরজ ব্যথা নিয়ে, মনোজ ব্যথা নিয়ে। চলবে