[জলহারা নদী নদী নয়। বলহারা মানুষ মানুষ নয়।]
ঠোঁট সেলাই করে বিছানায় পড়ে থাকে শ্রীদাম। তেমন কোনো কথা বলে না কাউকে। নিজের অসুবিধে নিজে গিলে ফেলার চেষ্টা করে বেশিরভাগ সময়। অসুবিধা যদি একান্ত গিলতে না পারে তখন অনুরোধের ভঙ্গিতে তাকায় আরতি বা মাধবীর দিকে অথবা মুখ ফুটে কিছু বলে।
এখন সে মনে মনে অনেককিছু করা শিখে নিয়েছে, যতদিন যাচ্ছে শিখে নিচ্ছে আরো বেশিকিছু। সে শুয়ে থাকে। শুয়ে শুয়ে হেঁটে বেড়ায়, শুয়ে শুয়ে বসে থাকে, শুয়ে শুয়ে শুয়ে থাকে। মনে মনে প্রেসের বুকে বুকে লোহার অক্ষর বসায়। অক্ষর মেলে না। আবার সাজাতে চেষ্টা করে। আবার মেলে না অক্ষর; তবু শত শত দিস্তা কাগজে, শত শত রিম কাগজে ছাপতে থাকে ভুল বানানের শব্দ, ভুল মানানের বাক্য। মনে মনে অক্ষর সাজাতে সাজাতে, ছাপতে ছাপতে সে ক্লান্ত হয়ে যায়।
টিকটিকিদের পরস্পরের প্রতি হাঁটার গতি মিলছে, তাল মিলছে।
ঘরের ফাটা দেয়াল ভালো, না মসৃণ দেয়াল ভালো টিকটিকিদের হাঁটার জন্য?
দেয়ালের দিকে তাকাতে তাকাতে, টিকটিকিদের দিকে তাকাতে তাকাতে এই হিসাবও কষার চেষ্টা করে সে।
শ্রীদাম আরতিকে ডাকে— ‘মাধবীর মা শোনো।’
মাধবীর মা মাধবীকে বলে— ‘মাধবী, দেখ তো তোর বাবা কী বলছে।’
মাধবী ঘরে ঢুকলে মাধবীকে দেখে তার মায়া লাগে।
আহা কেন একে জন্ম দিয়েছিলাম কষ্ট পাবার জন্য?
তার জন্ম না দিলে সে যেখানে ছিল, সেখানেই থেকে যেত। তাকে আর পৃথিবীতে কষ্ট পেতে হতো না, পৃথিবীতে পিষ্ট হতে হতো না। জীবনের আগে মানুষ যেখানে থাকত সেখানে থাকত সে।
মাধবী বলে— ‘বাবা কেন ডেকেছ, কী বলছ?’
শ্রীদাম বলে— ‘তোর মাকে ডাকলাম তুই এলি কেন? তোর মা কী করছে?’ মাধবী বলল— ‘মা, ডাক্তার কাকার সাথে কথা বলছে তোমার রোগ নিয়ে।’
এসময় ডাক্তার বেশ জোর শব্দে হাসে। তার হাসির শব্দ এ ঘরে উড়ে আসে। একেবারে গরম হাসি, হাসির গরমে শ্রীদামের কান ফেটে যায়, মগজ গলে যায়, হৃদয় পুড়ে যায়। তার হৃদয়ের জায়গায় হৃদয় নেই, আছে হৃদয়ের কয়লা, মগজের জায়গায় মগজ নেই আছে তাপে গলে যাওয়া তরল মগজ।
একই হাসি একজনের কাছে গরম সীসা আরেকজনের কাছে শান্তির শরবত। একই হাসি কারো কাছে আনন্দের হাওয়া, কারও কাছে গরম তাওয়া। একই হাসিতে কেউ তাজা হচ্ছে, কেউ ভাজা ভাজা হচ্ছে।
শ্রীদাম মনে মনে ভাবে— ‘রমজান ডাক্তার রোজ আসে, তাকে না দেখে স্ত্রীর সাথে রোগ নিয়ে আলাপ করে চলে যায়। এটা কেমন কথা?’
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘আমার হয়েছে রোগ, আরতির হয়েছে রাগ। আমার ওপর রাগ করে, ডাক্তারের প্রতি রাগ দেখায় আরতি। আচ্ছা, যখন আমার সাথে আরতির রাগ-অনুরাগ ছিল ঠিক তখনের মতোই আনন্দ পাচ্ছে কি আরতি?’
শ্রীদামের ভেতর বিষিয়ে ওঠে।
মাধবীর দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে— ‘ডাক তোর মাকে।’
মাধবী চলে যায়। মাধবীর হাঁটার দিকে শ্রীদাম চেয়ে থাকে। তার মায়া লাগে। মাধবীও যেন অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। তার খ্যাঁকানোতেও মুখের ভাব এতটুকু পরিবর্তন করল না, হেঁটে চলে গেল।
মাধবীকেও ব্যথা পুরোই দখল করে নিয়েছে?
যাদেরকে ব্যথাতে পুরো দখল করে নেয় তাদের মুখের ভঙ্গির রঙ বদলানোর দরকার পড়ে না। আহা মাধবী একটুকরো মানিক আমার। শ্রীদাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
মনে মনে প্রার্থনা করে— ‘মা দুর্গতিনাশিনী দুর্গতি দূর করো।’
টিকটিকি দুটো এগিয়ে যাচ্ছে পরস্পরের দিকে। দুটো টিকটিকি এগিয়ে যাচ্ছে দুটো টিকটিকির দিকে। একটা টিকটিকি আছে পশ্চিমের দেয়ালে, একটা পূর্বে। কেন তারা এগিয়ে যাচ্ছে পরস্পরের দিকে এটা বোঝা যাচ্ছে না।
বোঝা যাচ্ছে নাকি?
বোঝা যাচ্ছে না কি?
না কি তারা পরস্পরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না; একজন শুধুই চলে যাচ্ছে পূর্বে, অন্যজন চলে যাচ্ছে শুধুই পশ্চিমে?
ডাক্তার চলে যাবার শব্দ ঘরের ভেতর হেঁটে এলো আরতির শাড়ির সাথে লেগে। ডাক্তারের কথাগুলো, হাসিগুলো লেগে আছে আরতির শাড়িতে। বাড়ি যেমন বাড়ি তেমন শাড়ি-শার্টও বাড়ি।
দেয়াল দাঁড় করানো মানুষের স্বভাব। মানুষের দেয়াল দাঁড় করিয়ে যেন সাধ মেটে না। দেয়ালের পর দেয়াল। এমনিতেই মজ্জার দেয়াল হাড়, হাড়ের দেয়াল মাংস আর পুরো শরীরের দেয়াল চামড়া। এতো দেওয়ালেও হলো না মানুষের। পোশাকদেয়াল বানাল। বাড়িদেয়াল বানাল। নগরদেয়াল বানাল। দেশের সাথে দেশের সীমান্তদেয়াল বানাল।
শাড়িতে লেগে থাকা কথা-হাসি দরজার কাছে এসে ঝেড়ে ফেলে ভেতরে ঢুকল আরতি। এ শাড়িবাড়ির ভেতর থাকা আরতিকে অন্যরকম লাগে।
আরতি ঘরে ঢুকেই বলল— ‘কী হয়েছে, কী বলছ?’
আরতির গলার স্বরে, কথা বলার ভঙ্গির শরে শ্রীদাম চুপসে যায়— ‘ডাক্তার কী বলল আরতি?’
‘কী আর বলবে, বলল ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কবে ঠিক হবে আরতি?’ এ প্রশ্ন ছিল শ্রীদামের নিজের কাছেই যদিও সে নিজে আরতি নয়।
সে আরতি নয় কিন্তু আরতির নাম ব্যবহার করে নিজেকে প্রশ্ন করল কেন? এ প্রশ্নও তার ভেতর তৈরি হয়।
ঠিক হবে কি?
ঠিক হয় কি কিছুই কোনোদিন?’
এ প্রশ্নগুলোও মনে মনেও ছিল না, উচ্চারণেও ছিল না, এগুলো ছিল বিড়বিড় মাত্র।
এসময় মাধবী এসে বলল— ‘মা চাল তো নেই।’
‘তো, একটু আগে বলতে পারলি নে। তোর ডাক্তার কাকা থাকতে থাকতে।’
মাধবী মাথা নিচু করে আছে।
আরতি আগুনে কণ্ঠে বলে— ‘এখন মাথা নিনু করে আছিস কেন?’
শ্রীদাম অবাক হয়, আরতির ফাগুনে কণ্ঠ আগুনে কণ্ঠ হয়ে গেল কখন কখন, কীভাবে। আরতি তো আগে এভাবে কথা বলত না তার সাথে বা মাধবীর সাথে। শ্রীদাম স্থির চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘কেন ডাক্তার চাল দিত?’ শ্রীদাম জিজ্ঞাসা করে আরতিকে।
সম্ভবত সে এটা মনে মনে জিজ্ঞাসা করেছে, এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই আরতির চলে যেতে যাচ্ছে দেখে তার মনে হলো। অভ্যাসের বশে প্রশ্ন করে বটে তবে প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে পাবার আশা করে না। উত্তরপাবার অভ্যাস বিলুপ্ত করে উত্তর না-পাবার-অভ্যাস রপ্ত করার চেষ্টা করছে, উত্তর-পাবার অভ্যাসকে উপোসে রাখার চেষ্টা করছে। কতদিন ধরে তার কান উত্তর শোনার বাসনা চেপে রেখেছে। তার মনে হয়, প্রশ্ন হলো চুলকানি আর উত্তর হলো চুলকিয়ে দেওয়া। যে প্রশ্ন করে সে সেবা-গ্রাহী, যে উত্তর দেয় সে সেবাদানকারী। আরতি সে সেবা দেয় না আর। ফলে শ্রীদাম মনের ভেতর উপ্ত হওয়া প্রশ্নকে সুপ্ত রাখে, গুপ্ত রাখে, চুপ্ত। কখনো প্রশ্ন করলেও উত্তর পাবার আশা করে না। আশা করলেও উত্তর না পেলে রাগ করে না। রাগ করলেও প্রকাশ করে না। প্রকাশ করলেও কারো কিছুই যায় আসে না। এভাবেই প্রশ্ন জন্মের পথ বন্ধ হয়ে যায়। শ্রীদামের ভেতরেও নিশ্চয়ই এমন একদিন আসবে যেদিন আর কোনো প্রশ্ন জন্মিবে না। সে প্রশ্নবন্ধ্যা হয়ে যাবে।
প্রশ্ন করার ইচ্ছেকে এতো দমিয়ে রেখেও খুব একটা কাজ হয় না। মনের ভেতর চলেই আসে দানবের মতো শক্তিশালী প্রশ্ন।
‘ডাক্তার প্রতিদিন রোগীর ঘরে না এসে রোগীর বউয়ের সাথে কথা বলে চলে যায়, এটা কেমন? রোগীর গায়ে হাত না দিয়ে রোগীর বউয়ের গায়ে হাত দিয়ে চলে যায়, এটা কেমন?’
মনে মনে শ্রীদাম কথাটা বলে।
আরতি দরজার বাইরে চলে গেছিল প্রায়।
আবার ঘুরে ঘরে ঢুকে বলে— ‘কী বলতে চাইছ তুমি? মুখ সামলে কথা বলবে। ভাঁড়ে মা ভবানী আর দেখ তার আঁতের লব-লবানি।’
উত্তর শুনে শ্রীদাম চমকে ওঠে। সে বুঝতে পারল, যে কথাটা মনে মনে বলেছে বলে তার মনে হয়েছে, সেটা আসলে উচ্চারণেই বলা হয়ে গেছে। সে আরতির দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।
এক পলক তাকানোতেই শ্রীদামের চোখ পুড়ে গেল, ভেতর পুড়ে গেল। আবার তাকানোর সাহস হয় না তার। আবার তাকিয়ে যদি তার মনে হওয়াটাকে আরো বেশি সত্যি মনে হয়। মনে হওয়াটা একটু কম মনে হওয়া করে রাখার জন্যই তার সাহস হয় না। সাহস করে না।
আরতির সিঁদুরের দিকে তার চোখ পড়েছিল। আরতির মাথার সিঁদুর কেমন আউলানো যেন। আরতির মাথার ওপর সিঁদুর এমনভাবে আউলে আছে যাতে মনে হতে পারে পিচের রোডে ট্রাকের চাকায় একটা হৃৎপিণ্ড চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে পিষে আছে। চ্যাপটানো হৃৎপিণ্ডের কিছু রক্ত আর লাল মাংস আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
শ্রীদামের বাসররাতের কথা মনে পড়ে, বাসরঘরে আরতিকে বলেছিল— ‘তোমার মাথায় সিঁদুর কেন? আগে তো ছিল না। গতকালও তো ছিল না।’
আরতির মুখে লজ্জার আভা।
লজ্জাপীড়িত— ব্রীড়িত আরতি বলেছিল— ‘আমি তোমার ঘরে এসেছি যে তাই।’
শ্রীদাম আরতির আরো কাছে ভিড়ে বলেছিল— ‘তোমার মাথার এই রাঙা সিঁদুর, এই মেদুর সিঁদুর এই আমিই। আমিই টকটকে লাল হয়ে, লম্বা হয়ে শুয়ে আছি তোমার সিঁথির ফাঁকে।’
এসব বলতেই বলতেই তারা উষ্ণ হয়ে উঠছিল। শাড়িবাড়ি থেকে বের করে এনেছিল আরতিকে। ধুতিবাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল সে নিজে। বাসরের স্মৃতি এখনো কতো টাটকা অথচ শ্রীদাম কতো বাসি এখন।
গজগজ করতে করতে আরতি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ঘর তাকে টেনে ধরে রাখতে পারল না, শ্রীদাম তাকে টেনে ধরে রাখতে পারল না। শ্রীদাম পাশ ফিরে শোয়। তার পাশ ফেরা মানে শুধু একপাশ থেকে আরেকপাশে চোখ অথবা শুধুই চোখের মণি ফিরিয়ে নেওয়া।
চোখ ফেরানোও তার সীমাবদ্ধ খুব, সবদিকে চোখ ফেরাতে পারে না। চোখ ফেরাতে পারে শুধু সামনে আর পাশে, পিছনে কি হচ্ছে তা থেকেই যাচ্ছে তার অগোচরে। কিন্তু সামনে দিক আর পাশের দিক দেখেও তো পিছনের দিক সম্পর্কে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। এই আঁচে পুড়ে যায় শ্রীদাম। মরণাকাঙ্খা জেগে ওঠে তার। আত্মঘ্ন হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আত্মহত্যা করার যোগ্যতা তার নেই। যার রোগ্যতা থাকে তার আর কোনো যোগ্যতা থাকে না অপেক্ষা করার যোগ্যতা ছাড়া। সে এখন আর মানুষ নয়, সে রোগী। সে বলহারা। জলহারা নদী নদী নয়; বলহারা মানুষ মানুষ নয়।
[মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক একটা বিষম বাহু ত্রিভুজ]
শ্রীদামের বিছানাতে সবসময় বই থাকে। জ্যামিতি বইও থাকে। জ্যামিতি তার ভালো লাগে বেশি। অন্য বইও থাকে। জ্যামিতি কেন ভালো লাগে তার কোনো কারণ সে নিজেও জানে না। থাকে এমনকিছু কিছু মানুষের অস্বাভাবিক ব্যাপার, অভাবাবিক ব্যাপার। যেমন, সে নিজেই ছোটোকালে একজন নারীকে চিনত যে কেরোসিনের গন্ধ খুব পছন্দ করত, প্রতিদিন একবার করে কেরোসিনে আঙুল চুবিয়ে গন্ধ শুঁকত।
সেই নারী কি বলতে পারবে কেরোসিনের গন্ধ কেন তার প্রিয়?
কোন ফুলের গন্ধের সাথে কি মিলে যায় কেরোসিনের গন্ধ তার ভেতরে যাবার পর?
এমন কোনো ফুল কি যে ফুল পৃথিবীতেই নেই?
কেরোসিন কি তরল ফুল?
যখন জ্বলে তখন তো ফুলের মতোই জ্বলে লণ্ঠনের কাঁচের ভেতর বা টেমির মুখের ওপর।
জ্যামিতি নিয়ে ভাবতে তার বেশি ভালো লাগত। জ্যামিতির সাথে কতকিছু মিলিয়ে দিতে পারত সে। এখনো রোগার্ত শ্রীদাম মাঝে মাঝে এই বিছানা ভুঁয়ে শুয়ে শুয়ে জ্যামিতির সাথে জনমিতির, জীবনমিতির রেখার সংযোগ ঘটায়, সংবিয়োগ ঘটায়।
এখন ভাবছে, ‘আমি-তুমি-সে’ বা ‘আমরা-তোমরা-তারা’ একটা বিষমবাহু ত্রিভুজ। বিষমবাহু ত্রিভুজে সবসময়ই একটা বাহু বেশি বড়ো, একটা বাহু কম বড়ো, আরেকটা বাহু ছোটো। ত্রিভুজের বাইরেও কিছু আছে। এগুলো হচ্ছে ত্রিভুজের তিনপাশে থাকা ফাঁকা স্থান। ফাঁকাস্থান আসলে ফাঁকা নেই; অনেক অদৃশ্য বিন্দু গিজগিজ করছে। ফাঁক পেলেই এসব বিন্দু যে কোনো সময় দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে, বিষমবাহু ত্রিভুজের রেখাতে মিলে যেতে পারে; ত্রিভুজের যে কোনো রেখা বা রেখার বিন্দু ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারে ফাঁকা স্থানে। ত্রিভুজ থাকবে ঠিকই কিন্তু ত্রিভুজের বাহুর বাহুত্ব ঠিক থাকবে না। এই ত্রিভুজে বিন্দু থাকবে কিন্তু সেসব বিন্দু ‘অন্যবিন্দু’। এসব অন্যবিন্দু বেড়ে গেলে ত্রিভুজের বাহুর মান ঠিক থাকে না। বন্যবিন্দু বেড়ে গৃহবিন্দু কমে যেতে পারে। স্নেহবিন্দুর চেয়ে দেহবন্দিুর ডালপালা বেড়ে যেতে পারে।
এ বিষমবাহু ত্রিভুজে যে যখন ‘আমি’ ভাবগতভাবে সে তখন বড়ো বাহু, তখন ‘তুমি’ দ্বিতীয় বৃহত্তম বাহু আর ‘সে’ ক্ষুদ্রতম বাহু। আর এই ত্রিভুজে বাহুর সংখ্যার দিক থেকে ‘অন্যরা’ বড়ো ‘আমি’ ছোটো। সংখ্যা কখন ভাবকে ছাড়িয়ে উঠবে, ভাব কখন সংখ্যার কাছে পরাজিত হবে এর হিসাব বের করা বড়োই জটিল। কোনো একটা রেখা ছাড়া ত্রিভুজ টিকে না, একটা বা দুটো রেখা দিয়ে কখনো ত্রিভুজ গড়া যায় না; কোনো ক্ষেত্রই দাঁড় হতে পারে না। মানুষকে কোনো না কোনোভাবে ত্রিভুজের ভেতর থাকতেই হয় অথবা তার অধিক ভুজে নইলে মানুষই টিকে না।
যদিও কিছু মানুষকে দেখে মনে হয় একা এক সরলরেখা চলে বেড়াচ্ছে জগতের ভেতরে তবু সে মনে হওয়া সত্য নয়। পৃথিবীতে মানুষহীন কোনো মানুষ নেই। বন্ধু মানুষ না হোক অন্তত একটা শত্রুমানুষ থাকেই সব মানুষের আর থাকে অপরিচিত মানুষ।
মানুষহীন কোনো মানুষ নেই একথা সত্য বলেই মানুষে মানুষে বিষমবাহু ত্রিভুজ; মানুষে মানুষে অবশ্যই বিষমবাহু ত্রিভুজ; সমবাহু এমনকি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ মানুষে সম্ভব নয়। মানুষে মানুষে বিষম বাহু ত্রিভুজ এজন্যে যে, ‘মানুষ=মানুষ’ এমনটা নয়। মানুষ ও মানুষ পরস্পর অসমান। মানুষ ও মানুষ ও মানুষ ও মানুষ ও মানুষ পরস্পর অসমান প্রাকৃতিক কারণে, আকৃতিক কারণে, বিকৃতিক কারণে।
শ্রীদাম বিছানাখাতায় একটা ঋজুরেখার মতো পড়ে আছে। পড়ে আছে একটা সলতেহীন মোমবাতির মতো।
তার মনে পড়ে জনমেজয় স্যারের কথা, জ্যামিতির ক্লাসে তিনি বলতেন— ‘সরলরেখা সবলরেখা নয়, বক্ররেখাই সবলরেখা। বক্ররেখার গতি আছে, মতি আছে, জ্যোতি আছে। বক্ররেখার চলনে নৃত্য আছে, বদনে বলন আছে। বক্ররেখা ছাড়া কোনো ছবি আঁকা সম্ভব নয়, কোনো লেখা লেখা সম্ভব না। বক্ররেখা ছাড়া না নিত্যানন্দের ছবি আঁকতে পারবে, না জগাই-মাধাইয়ের ছবি আঁকতে পারবে। আসলে সরলরেখা বলে কিছু নেই, সরলরেখা বলে কোনো রেখা তৈরি করেননি ঈশ্বর।’
স্যারের কথার জ্যামিতি আর তার ব্যথার জ্যামিতি মিলিয়ে দেখে মনে মনে ভাবে, সরলরেখা যেহেতু প্রভু তৈরিই করেননি তাহলে সরল জীবন হবে কী করে?
সরল মানুষ হবে কি করে?
কোনোকিছুই সহজসরল হবে কী করে?
[ক্ষুধা একটা জীব। এ ক্ষুধাজীবের খাদ্য তালিকায় সবার ওপরে লেখা থাকে যার ক্ষুধা তার নাম]
রোজকার প্রয়োজন মেটানোর জন্য রোজগার প্রয়োজন। কিন্তু শ্রীদাম অসুস্থ হবার পর একটাকা ঘরখরচও ঘরে আসেনি। জমানো টাকা শেষ হয়ে যাবার পর, অতিরিক্ত হাঁড়িকুড়ি, তুলে রাখা শখের কাঁসা-পিতলের কলস-থালি, এমনকি চরুস্থালী পর্যন্ত বিক্রি হবার জোগাড়। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থাও নয়; নুনই নেই যেন।
ধীরে ধীরে সংসারে চালের-ডালের-নুনের অভাব অনটন আরো বেড়ে গেলে বেড়ে ধরলে ডাক্তার শ্রীদামের সামনেই আরতিকে প্রস্তাব দেয় তার চেম্বারে কাজ করার জন্য। শ্রীদাম ডাক্তারের দিকে তাকায় না, ডাক্তারও শ্রীদামের দিকে তাকিয়ে নেই। ডাক্তার আর রোগীর এমন সম্পর্ক জগতে আর আছে কি না সন্দেহ।
প্রস্তাবের সময়েই আরতি শ্রীদামের দিকে তাকায়, শ্রীদাম সংশয়ালু দৃষ্টিতে আহতের মতো আরতির দিকে তাকায়। বেশিক্ষণ তাকায় না, আরতির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিয়েও সে বেশ বিপদে পড়ে, ফেরানো চোখ কোথায় রাখবে?
সে ডানদিকের দেয়ালে রাখে চোখ। সেখানে রেখেও আরাম পায় না। সে বামদিকের দেয়ালে চোখকে বসায়। ডানদিকের দেয়ালে বসেও চোখ আরাম পায় না। তার চোখ ঘরের ভেতর ভুল করে ঢোকা ফড়িং; একবার এদিকে একবার ওদিকে উড়ে বেড়ায় কোথাও বসেই শান্তি পায় না।
সে সবদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিজের বুকের দিকে তাকায়। অস্থিরতার শ্বাসপ্রশ্বাসের বাতাসে বুকের কালো কালো ঘাসের মতো চুল নড়ে যেন বুক ছেড়ে উড়ে পালাবে। বুক উঠানামা করে। নিজের বুকের দিকে চোখ ফেরানোতেও তার আরাম হয় না। তার মনে হলো, সবচে বড়ো চোখ ফেরানো হলো চোখ বন্ধ করা। সে চোখ বন্ধ করে। চোখ বন্ধ করেও আরাম পায় না, তবু তার মনে হয়, তবু এই চোখ ফেরানোটা ভালো। সে চুপচাপ শুয়ে থাকে।
তার বিশ্বাস এসব সাজানো প্রস্তাব।
কার সাজানো?
আরতি আর গেঁয়ো ডাক্তার রমজানের?
না কি ঈশ্বরেরই?
ঈশ্বর কি এতো নিষ্ঠুর?
ঈশ্বর নয়?
তবে অন্য কেউ কি এসব প্রস্তাব প্রস্তুত করে রেখেছে?
অন্য কেউ এসব অবস্থা তৈরি করে রেখেছে যে ঈশ্বরের চেয়ে শক্তিশালী?
ঈশ্বর তো দয়ালু তিনি এসব করবেন না।
তাহলে কি ঈশ্বরের চেয়েও শক্তিধর কেউ আছে?
ঈশ্বরের সৃষ্টি করারই শুধু ক্ষমতা আর সকল ধকল আর ধস্তাধস্তি, নকল আর নাকালের, সাজা আর সাজশের ব্যবস্থা অন্য কারো হাতে যে ঈশ্বরের চেয়ে কোটি কোটি গুণ শক্তিমত্তার, বলবত্তার?
তার কাজই মানুষকে অসহায় করে তোলা, বেহায়া করে তোলা, নির্বিচারে মারধর করা?
মানুষে মানুষে খেয়োখেয়ি, ধাওয়াধাওয়ি, ঠকাঠকির চাকা চালু রাখা? তাহলে কে সেই প্রহর্তা যে প্রহার করে চলেছে অবিশ্রাম?
ঈশ্বরের চেয়ে বড়ো আরেক ঈশ্বর? যার খোঁজ মানুষ এখনো জানে না। মানুষের চিন্তার ভেতরেও আসেনি?
যে চিন্তা পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মগজে ধরা দেয়নি তা-ই কি ধরা দিল শ্রীদামের মাথাতে? এও কি সম্ভব?
স্রষ্টা ঈশ্বর আর তারচেয়ে শক্তিমান সত্তার ভাবনার ভাঁজ সে খুলতে পারে না। এসব ভাবনার প্যাঁচ থেকে বের হবার জন্য চোখের তারাকে সে তার বুকের ওপর টেনে আনে। কারো প্রতি নয় তার নিজের ওপর নিজের ঘৃণা হয়। আসলে কারো প্রতিই ঘৃণা করার অধিকার কারো নেই।
ক্ষুধা তো একটা জীব; নির্যাতক জীব। প্রত্যেক জীবন্ত দেহঘরে ঢুকে আছে একটা করে বাঘের মতো ক্ষুধাজীব। বাঘের মতো এই ক্ষুধাজীব বাঘের দেহেও থাকে, খরগোশের দেহেও থাকে, কেঁচোর দেহেও থাকে, গাছের দেহেও থাকে, থাকে আরো বড়ো হয়ে মানুষের শরীরেমনে।
এই নির্যাতনকারী খুনি-ক্ষুধার খাতাতে লেখা থাকে যার যার ক্ষুধা তার তার নাম।
কারো নাম যদি দেবেন্দ্র হয় তবে সেই দেবেন্দ্রের ক্ষুধার খুন্য-খাতাতে প্রথমেই লেখা থাকে দেবেন্দ্রের নাম। ঠিক তেমনভাবে শ্রীদামের ক্ষুধা খুন করার জন্য যে তালিকা তৈরি করে রেখেছে তার প্রথমেই লেখা আছে শ্রীদামের নাম তারপর লেখা আছে ভাত, শাক, মাছ, মাংস প্রভৃতির নাম। শ্রীদামের-ক্ষুধা জেগে উঠে প্রথমেই শ্রীদামকেই খেতে শুরু করে ফলে শ্রীদাম নিজে খুন হবার বদলে ক্ষুধার সামনে ধরে থালা ভরা ভাত, মাছ, মাংস; যখনই সে আর এই ভাত-ছাতু দিতে পারবে না তখনই ক্ষুধা খেতে শুরু করবে শ্রীদামকে।
আরতির-ক্ষুধার খুন করার তালিকাতে একমাত্র নাম লেখা আছে ‘আরতি’। আরতি নিজেকে ক্ষুধার ছুরির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ক্ষুধার সামনে তুলে ধরে থালা ভরা ভাত, মাছ, মাংস।
মাধবীর ক্ষুধার খাতাতে লেখা আছে মাধবীর নাম। এভাবে সকল মানুষের ক্ষুধার খাতাতে সবার নিজ নিজ নাম লেখা থাকে। তখন সবাই ক্ষুধার সামনে তুলে ধরে বিভিন্নরকম খাবার, যখনই কেউ খাবার তুলে দিতে পারে না তখনই ক্ষুধা তাকে খেয়ে নেয়।
ক্ষুধার কথা ভেবে শ্রীদাম হয়তো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই রাজি হয় অথবা তার নিমরাজিভাব বড়ো হয়, নিমরাজি বড়ো হতে হতে ডিমরাজি হয়, ডিমরাজির ‘ডিম’ ফেটে ‘রাজি’ বের হয়। অথবা তার চুপ করে থাকাকেই সম্মতি বলে ধরে নেয় ডাক্তার আর আরতি। অথবা তার রাজি-নারাজিরাজির কোনো মূল্য তাদের কাছে ছিল না।
[মানুষের শেকড় কচুরিপানার মতো]
মানুষের নাকি শেকড় থাকে। হয়ত থাকে। কিন্তু সে শেকড় অবশ্যই আমগাছ বা জামগাছের মতো নয়। মানুষের শেকড় আছে তবে তা কচুরিপানার শেকড়ের মতো।
খুব সকালে উঠে আরতি সুন্দর করে কুঁচি মেরে একটা সাদা জলচুড়ি শাড়ি পরে। কী সুন্দর লাগে আরতিকে; একটা শ্বেতপদ্ম। মোহিত হয়ে, পলক রোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে শ্রীদাম। আরতি চলে গেলে বুকের ভেতর পুড়ে তার। এ রূপ কোথায় আলো দিতে চলে যায় ঘরের বাইরে প্রতিদিন।
প্রেসে ছাপতে আসা এক কবির একটা পংক্তি তার মনে পড়ে—
‘কুমুদে চক্ষু মুদে শুয়ে আছে সাপ
এখুনি উঠিবে জেগে
দাঁতের দাগ গায়ে দেবে দেগে...’।
মনে খচখচে প্রশ্ন জাগে শ্রীদামের, এই হংসলাজ জলচুড়ি শাড়ি কোথা থেকে পেল আরতি?
তার গলা জড়িয়ে থাকা, বুকে ঝুলে থাকা সীতাহার কোথা পেল আরতি?
রামায়নের সীতা কি রাবনকে ভালোবেসে ফেলেছিল?
সেই কি রাবনকে সোনার হরিণ সাজতে বলেছিল যাতে তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে রাম?
তারপর পুষ্পকরথে চলে গেছিল লংকায়?
আরতি সকালে যায় রমজান ডাক্তারের চেম্বারে। রোগীদের ঔষধীয় কাগজ বুঝিয়ে দেয়া, কবে আসবে সেসব বলে দেওয়া, ডিসপেনসারির ঔষধপত্র সারি করে গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি কাজ করে। সন্ধ্যায় ফিরে। কখনো কখনো রাতে। কখনো কখনো রাতেও ফেরে না। ফেরে পরদিন সন্ধ্যায়।