X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
উপন্যাস

বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার

সাজেদুল ইসলাম
৩০ মার্চ ২০২৪, ১৪:৪১আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৪, ১৪:৪১

নাম-যশ খুইয়ে নিঃস্ব হওয়ার কালে হায়দার মোড়লের ঘরে দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে আম্বালার আগমন ঘটায় সংসারে ভাটির টান ছাড়া আম্বালা আর কিছু দেখতে পেল না। আম্বালা না পেল স্বামীর যৌবন, না দেখল আর্থিক ঐশ্বর্য। নদীতে যখন ভাটির টান আসে তখন চোখের পলকে পানি নেমে যায়। নদীতে তখনও ছলাৎ-ছলাৎ ঢেউ থাকলেও সেই ঢেউ কেবল সবকিছু টেনে নেয়, ভাসায় না কিছুই। জল নেমে গেলে নদীর দুইকূলে শুধু পলিমাটি জেগে ওঠে। নদীগর্ভে থাকা জলজ সম্পদ তখন জলের সঙ্গে কর্পূরের মত অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। পুবকালের সুখের খবর কানে এলেও আম্বালার চোখে তা আর ধৃত হল না। শুনল শুধু ডাক-নাম।

আম্বালার বিয়ের রাতে হায়দার মোড়লের বিছানায় যাওয়ার আগে শাড়ি-গয়না খসানোর সময় মোড়লের চাচি শাফিয়া বেগম আম্বালাকে নাকের উভয়পাশে ছিদ্র করে দুটি নাকফুল পড়তে বললো। গয়না খসাতে খসাতে আম্বালা বললো, চাচি আম্মা, আমার তো এক নাহে ছিদ্র। দুই নাকফুল পড়মু কেমনে? শাফিয়া বেগম বললো, স্বামীর মঙ্গল-অমঙ্গল বৌয়ে না বুঝলে বুঝবো কেডা। কিশোরী আম্বালা তখনও বৌ হয়ে ওঠেনি। কেমন স্বামীর বাড়িতে সদ্য পা রেখেছে। সে শাফিয়া বেগমের কথা শুনে হা করে চেয়ে রইল। আম্বালাকে বেকুবের মত চেয়ে থাকতে দেখে পাশের বাড়ির রিক্তার মা বললো, বৌ, হোনো, তুমি অইলা হায়দার মোড়লের ছোট পরিবার। হের আগের পরিবার বেহেশতবাসী হইছে। তুমি দুই নাম্বার পরিবার বইলা দুই নাহে সোনার দুই ফুল পিনবা। রিক্তার মা আম্বালাকে বুঝিয়ে দেওয়ায় আম্বালার চাচি শাশুড়ি শাফিয়া বেগমের ক্রোধ যেন আরো উতলে উঠল। নতুন বৌ দেখতে আসা অভ্যাগতদের সামনে সে বললো, খালি শইলের রং কতহানি ফ্যাটকা সাদা অইলে কেমনে অইব? মাতায় তো বুদ্ধি-বিবেক কিছু থাহা লাগব। দুই-চারটি কটু কথা বলে নিজের ক্রোধকে দমন করে সে ফের বললো, তোমারে একটা কতা কই, মেয়ে লোকের নিঃশ্বাসে বিষ থাকে বৌ। হেই নিঃশ্বাস যদি সোনার নাকফুলের লগে মিশা পুরুষের নাহে যায় তাইলে কোনো অমঙ্গল আর কাছে আইতে পারে না। নইলে ক্ষতির শ্যাষ নাই। আর স্বামীর ক্ষতি মানে সংসারের ক্ষতি, বৌয়ের ক্ষতি। তুমি যেহেতু দুই নাম্বার বৌ তাই তোমার দুই নাহে সোনার নাকফুল নেওন-ই ভালো। এতক্ষণ পরে শাফিয়া বেগমের কথা পুরোপুরি আম্বালার মগজে ঢুকল। বিয়ে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সাত বছর বয়সে আম্বালার মা তার মেয়ের বাম নাকে ছিদ্র করে দিয়েছিল। নাকের বাম ছিদ্রে আম্বালা হায়দার মোড়লের দেওয়া সোনার নাকফুলের ডাট ঢুকিয়ে রেখেছে। নাকফুলের ওপর ছোট পাথর বসান। আলো পড়লে যেন জ্বলে ওঠে সে পাথর। আম্বালাকে ফের নাকের ডান পাশে ছিদ্র করে নতুন ফুল পরতে হবে। আম্বালা এতদিন জেনেছে—নাকফুল হল পতির স্মৃতিচিহ্ন। যার পতি আছে সে কেবল নাকফুল পরে। পতিবিয়োগ হলে সঙ্গে সঙ্গে নাকফুলও খুলে ফেলতে হয়। আম্বালা এখন বুঝতে পারছে না—কেউ নাকের উভয়পাশে দুই নাকফুল দেখে আম্বালাকে যদি দুই পতিধারী মেয়েলোক মনে করে—তখন তো লজ্জায় মাথা কাটা যাবে।

সেই রাতে নাকে নতুন ছিদ্র না হলেও কয়েকদিনের মধ্যে ডান পাশে নতুন নাকফুল পরতে হল আম্বালাকে। কেউ কেউ অবশ্য তাকে নাকের মধ্যখানের পার্টিশনের নরম মাংসের সঙ্গে নথ পরার পরামর্শ দিল। কিন্তু নাকের সঙ্গে ঝুলে থাকে বলে শরমে আম্বালা তার নাকে নথ ঝুলায়নি। এখন স্বামীর মঙ্গল কামনায় নাকের ডান পাশে অতিরিক্ত একটি ছিদ্র করা তেমন কি কঠিন কাজ। এ তো শুধু মঙ্গল কামনা নয় বরং অকল্যাণ থেকে রক্ষায় পতির জন্য বর্ম তৈরি। নিজের নিঃশ্বাসের বিষ যেন স্বামীর ভাগ্যে অকল্যাণ ডেকে না আনে সে জন্য আম্বালা নাক ছিদ্র করার চেয়েও কঠিন কাজ করতে পারে। স্বামীর জন্য নাক ছিদ্র তুচ্ছ বিষয়, আম্বালা নিজের কলিজাও ছিদ্র করতে রাজি। পতি প্রেমের কঠিন পরীক্ষার বাইরেও আম্বালা প্রতিদিন ওযু-গোসল মিলিয়ে স্বামীর জন্য কয়েকবার পানি গরম করে। বড় বড় হাড়ি-পাতিলে রান্না করে দিনে দুই-তিনবেলা স্বামী-সন্তানদের মুখের সামনে আহার পরিবেশন করে। আম্বালার প্রতিদিনের রুটিনে ঘরদোর ঝাড়া, কাপড় কাচা, পাতা কুড়ানো, পুকুর ঘাটে ফেলে বাসন মাজার কাজ সাধারণ ঘটনা।

বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে রোজা সমাগত হলে প্রতিদিন গভীর রাতে উঠে শুকনো ডালপালা ও পাতা দিয়ে গরম ভাত রান্না করে পরিবারের জন্য সেহরি সাজায় আম্বালা। হায়দার মোড়ল ঠান্ডা ভাত খেতে পারেন না বলে সেহরিতে তার গরম খাবার প্রয়োজন হয়। রোজার শুরুতে মেয়েরা তাদের নতুন মাকে বাবার নির্দেশক্রমে এই তথ্য জানিয়ে দিল। রোজার রাত খুব ছোট হওয়ায় তারাবির নামাজ পড়ে আম্বালা ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেয়। এরপর দুই পাকের চুলার একটিতে ভাত তুলে দেয়। অন্যটিতে আগের দিন বিকেলে রান্না হওয়া তরকারি গরম করে। আগুনে ভারসাম্য রাখতে চুলার মুখের ভিতরে খড়ি দেওয়ার পর একটি বড় লাঠি দিয়ে জলন্ত আগুনকে সে দুইভাগ করে দেয়। তরকারি গরম হয়ে গেলে চুলায় গরম জল তুলে দেয় আম্বালা। গরম জলে নিজে প্রথমে গোসল করে নেয়। সেহরির সময় ঘনিয়ে এলে হায়দার মোড়লকে ডেকে ঘুম ভাঙায়। পরে মোড়লও গোসল শেষে নামাজে বসে। যে রাতে গোসলের প্রয়োজন থাকেনা সে রাতেও মোড়লের জন্য ওযুর পানি বসাতে হয়। একপর্যায়ে মোড়লের ছেলেমেয়েরা একে একে ঘুম থেকে উঠে পড়লে সকলে মিলে সেহরি খায়। গভীর রাত থেকে শুরু হওয়া এই কর্মযজ্ঞে আম্বালার কোনো সঙ্গীসাথি নেই। আম্বালা কেবল হায়দার মোড়লের শয্যাসঙ্গী। ছেলেমেয়েরা কিশোরী সৎ মাকে সঙ্গ দেওয়ারও তেমন যুক্তি নেই। বাড়ির জা যারা রয়েছে তাদের প্রত্যেকে আম্বালার মায়ের বয়সী। শীতের রাতে উঠে আম্বালা যখন ঘরের পিছন দিকে থাকা চুলার কাছাকাছি যায় তখন তার শরীর ভয়ে ছমছম করে। দূর থেকে দৃশ্যমান মাঝারি কলাকাছের পাতাগুলো দুলতে থাকে। হঠাৎ চোখ পড়লে মনে হয় কাফনে আবৃত মুর্দা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বাঁশঝাড়ে একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে কর্কশ শব্দ করে। মনে হয় বিষণ্ন কেউ দাঁতে দাঁত কাটছে। ভয় পেলেও আম্বালা নিজেকে সংবরণ করে প্রবোধ দেয়—ভয় করলে ভয়, ভয় না করলে কোন যমের ভয়। মরতে তো একদিন হবেই। ভয়ভীতির মধ্যে চুলায় আগুন জ্বলে উঠলে আম্বালা ভাবে—আগুনের কাছে ভূত-প্রেত আসে না। আম্বালা আগুনের কাছাকাছি গা ঘেঁষে থাকে। চুলায় থাকা ভাত-তরকারির দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে আগুনের তাপে তার শীতার্ত শরীরও আরাম পায়, ভয়ও কাটে। এই ভয়-ডরের মধ্যে মসজিদের মাইকে ঠকঠক শব্দ শুরু হয়। আম্বালা চিন্তা করে এখন তো আজান হওয়ার কথা না। কিছুক্ষণ পর মোয়াজ্জিন মাইকে সুর করে শিকলি গায়। পাড়ার মানুষকে সেহরির জন্য ডাকাডাকির উদ্দেশ্যে গাইতে থাকে—ওঠো ওঠো খোদায় পেয়ারা, ঘুমাইয়ো না আর, পশুপাখি জিকির করে, জিকিরও মওলার। সুর করে শিকলি গাইবার পরে জোরে হাঁক ছেড়ে বলে, সম্মানিত মুসুল্লিয়ানে কেরাম, ঘুম থেইকা ওঠেন, সেহরির সময় হইছে। ফের গান ধরে, নবী মোর নূরে খোদা, তার তরে সকল পয়দা, আদমের কলবেতে তার নূরের রওশানী, নবী নাম জপে যে জন সেই তো দোজাহানের ধনী। মোয়াজ্জেনের ডাকাডাকিতে আম্বালা মনে মনে ভরসা পায়। ভাবে, যাক, আলোহীন অন্ধকারে, তীব্র শীতের রাতে কেউ অন্তত জেগে আছে।

হায়দার মোড়লের টিনের সেই চৌচালা ঘরের কাঠামোটি আছে এখন। যে ঘরে হায়দার মোড়ল, মোড়লের প্রথম স্ত্রী সারাবান তহুরা ও দ্বিতীয় স্ত্রী আম্বালা বেগম জীবন-যৌবন কাটিয়েছে সেই ঘরের বেড়ায় ব্যবহৃত সেইসব কাঠ, রং ও পুরোনো অবয়ব অবশিষ্ট নেই। হায়দারপুত্র রেয়াসত মোড়ল কয়েক দফা সংস্কার করে উইপোকার আক্রমণ থেকে ঘররক্ষায় বেড়ার পুরোনো কাঠ-টিন বদলে দিয়েছে। এখন রেয়াসত মোড়লের পুত্র রিহিল পৈত্রিক বাড়িতে পৌঁছে পূর্বপিতার স্মৃতির তত্ত্বতালাশ করছে। সেদিনের সেই চিরকুটের মর্ম অনুধাবনে শুরুতে তাকে বেগ পেতে হলেও পরে বুঝতে পারে প্রভূত ভূ-সম্পত্তির অধিকারী হায়দার মোড়ল ব্যবসায়িক কারবার, রাজনীতি ও পারস্পরিক স্বার্থ-সম্পর্ক রক্ষায় কৌশলী ছিলেন। ফলে এমন চিরকুট তিনি সিন্ধুকে সংরক্ষণ করার ফুরসত পেয়েছিলেন। বাড়ির সম্পর্কে চাচা নেয়ামদ্দি মোড়লের সঙ্গে কথায় কথায় পরেরদিন চিরকুটের মর্ম জানতে পারে রিহিল। চিরকুট নিয়ে এমনিতে রিহিল উৎসুক হলেও নেয়ামদ্দি মোড়লকে তা বুঝতে দেয়নি। শানের দুইপাশে দুজন বসে গল্পে গল্পে নেয়ামদ্দি মোড়ল বললো, বাপ-দাদার গল্প বাপের কাছে হুনছো নিশ্চয়ই। রিহিল বলে, জি চাচা, কিছুটা শুনেছি। কিছু হুনলে তো অইব না, বংশে গৌরবের কতাবার্তা জানা দরকার। তোমাগোই তো আগামী দিনে হাল ধরতে অইব এই ঘর-সংসারের। একথা শেষ হতে না হতেই নেয়ামদ্দি মোড়ল স্বভাবসুলভ সুরে ফের জিজ্ঞেস করে, কও দিহি, তোমার দাদার কথা কী কী হুনছো? রিহিল নিজের এলেমের পরীক্ষা দিতে পছন্দ করে না। অন্য কেউ হলে সে হয়তো তাকে উপেক্ষা করতো। কিন্তু নেয়ামদ্দি মোড়লকে সে যদ্দুর বুঝেছে তাতে তাকে সরল মানুষের সারিতে ফেলা যায়। তিনি কথা বেশি বলেন বটে, তবে মানুষ ভাল। রিহিল তাকে বলে, দাদার বড় ব্যবসায় ছিল। অনেক ভালো যোগাযোগ ছিল। মানুষকে তিনি কনভিন্স—আই মিন তিনি মানুষকে কোনোকিছু ভালোভাবে বুঝাতে পারতেন। একথা শুনে নেয়ামদ্দি মোড়ল হো হো করে হেসে ওঠে। তার পান খাওয়া লাল মুখে কালো দাঁতগুলো সব একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। নেয়ামদ্দি মোড়ল বলে, তুমি ঠিক শুনছো বাবা। তোমার দাদা তো কারবারিগো বুঝাইতে পারতেন, লগে ডাকাইতও বুঝ মানতো তার কতায়। রিহিল বিস্মিত হয়। বলে, ডাকাত! নেয়ামদ্দি মোড়ল বলে, হ। তোমার দাদায় একবার ডাকাত দলরে বাড়িত আইনা, ভাল-মন্দ খাওয়াইয়া, কতার মাইর-প্যাচে ফেইলা বিদায় করছিল। যাওনের কালে তারে বরং সালাম-কালাম কইরা বিদায় অইছে ডাকাইত দল। রিহিল বলে, কি বলছেন চাচা, ডাকাতদল বাড়িতে এসে দাদাকে সালাম করে গেছে? রিহিলে উদ্বেগ দেখে নেয়ামদ্দি মোড়ল বলে, হ, হ্যাগো খাওনের লেইগা তোমার দাদায় পঞ্চাশ মণ চাউলের ব্যবস্থাও কইরা দিছিল।

চলবে

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ