X
শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
১৯ বৈশাখ ১৪৩২
ধারাবাহিক উপন্যাস

লাবণ্য দাশের চিঠি—১৬

শাহনাজ নাসরীন
১৯ মার্চ ২০২৫, ১৪:৫০আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ১৪:৫৪

কিন্তু আমি তা বলব না শোভন। আমি মনে করি এও কোনো লেখার প্লট। আমার শাশুড়ি দিনলিপিতে দৈনন্দিন জীবনের কথাই লিখেছেন, তবে তার ডায়েরিতেও অনেক কবিতা ছিল। তোমার দাদার ডায়েরিতে আরও অদ্ভুত জিনিস ছিল। বিভিন্ন জিনিসের বিজ্ঞাপন, বিমান অ্যাক্সিডেন্ট, কুষ্ঠরোগীর অনুপুঙ্খ, বোধিসত্ত্বাবদান-কল্পলতা, বাইবেলের মিথ এরকম হাজার হাজার বিষয়ের বিবরণ। সবাই যা করে তোমার দাদা তা কখনই করেনি। তোমার দাদার ডায়েরিকে যে যতই আত্মজীবনী মনে করুক তোমার দাদা কিন্তু একে লিটারারি নোট বলেছে। আমিও মনে করি এ সরাসরি দিনলিপি নয়। আত্মজৈবনিক আর আত্মজীবনী কখনই তো এক না। তোমার দাদার গল্পগুলি যেমন এইসব লিটারারি নোটও তেমন। জীবন আছে জীবনের ঘোরও আছে। সে দুটি মিলিয়ে তিনি যা লিখবেন সেসব আইডিয়া সাংকেতিকভাবে লিখে রাখতেন ডায়েরিতে। পাশাপাশি সাংসারিক কথাও কিছু থাকত নোট হিসেবেই, সাহিত্যে ব্যবহারের জন্যই। এজন্যেই তার গল্প-উপন্যাসগুলো এমন আত্মজীবনীর মতো। আমাদের বাসর রাতের যে বর্ণনা ডায়েরির পাতায় আছে তা গল্পের সাথে যত মেলে জীবনের সাথে তত নয়। আমার তো মনে হয় বেঁচে থাকলে এই লিটারারি নোটগুলো থেকে খুব বড় কোনো কাজ সে করত। সেরকম পরিকল্পনা থেকেই এভাবে ডায়েরি লেখা হয়েছে।

এখন তুমি নিশ্চয়ই হাসছ আর ভাবছ তোমার দাদা আত্মহত্যা করেনি এ কথাই ইনিয়ে বিনিয়ে বলছি। না এও ঠিক নয়। আমি নিজেই নিশ্চিত নই আসলে কী ঘটেছে। বরং অনেক সময় সম্পূর্ণই বিশ্বাস করি—সে আত্মহত্যাই করেছে। পশ্চিমের অনেক প্রতিভাবান কবি সাহিত্যিকই তো তাই করেছিল। তোমার দাদার মতো অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন সাহিত্যিক যার ওপর পশ্চিমের প্রবল প্রভাব, কী করে বাঁচতে পারত এই পুঁতিগন্ধময় জঞ্জালের দেশে? অবশ্য এও ঠিক এই কারণেই আবার সে আত্মহত্যা করতে পারে না। এগুলো তার সাহিত্যের উপাদানও তো। এডগার এলেন পো এর কবিতা ‘টু হেলেন’ যেমন তোমার দাদার হাতে আরেকটি মৌলিক কবিতা ‘বনলতা সেন’ হয়ে যায়, তেমনি সাহিত্যই বল বা জীবন কোনটিতেই অনুকরণ না করে ঘটনাবলিকে মেখেছেনে তার নির্যাস আলাদা করে নিজের মতো ব্যবহার করার মুন্সিয়ানা তার ছিল। সাহিত্যে তার যে যত্ন ছিল প্রতিটি যতিচিহ্নের নিখুঁত ব্যবহারে, নিজস্ব উপমা খুঁজে নেয়ায়, শব্দবন্ধ তৈরিতে। জাগতিক আর কিছুতেই তার এমন মনোযোগ আমি অন্তত দেখিনি।

সারাটা জীবন সাহিত্যপাড়া থেকে নিজেকে আড়াল করেছে। রাস্তায় কারও সাথে দেখা হয়ে গেলে নাকি মুখোমুখি হবার আগেই পথ বদলে নিত। সেইসব মানুষরাই আমাদের ঘর-সংসার নিয়ে কত বিশ্লেষণ করে ফেলল! আমি সবই পড়েছি আর পড়ে ভাঙাচোরা এক জীবনানন্দকে পেয়েছি। এমন মেধাবী মানুষটাকে কী হাস্যকরই না করে ফেলেছে সবাই মিলে! তোমার দাদার চোখদুটি অন্যরা কতটা লক্ষ্য করেছে জানি না, সে বড় সাংঘাতিক! অতি শান্ত ওই চোখে কখনো কৌতুক কখনো অন্যমনস্কতা তার চেয়ে বেশি উন্মাদনা! তোমার তো লক্ষ করার কথা নাকি তা দেখেই ভয় পেয়েছ? এত নেবার সামর্থ্য তোমার ছিল না, ঠিক কিনা বল? স্তাবকেরা সবসময় তোমাকে প্রেমিকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সুতরাং তুমি হয়ে গেলে বনলতা সেন। আমি কিন্তু সুরঞ্জনাতেও তোমাকে দেখাতে পারি। যেখানে তোমার হৃদয় ঘাস হয়ে গেছে। ডিব্রুগড়ে তোমাকে পাখিনীর মতো পেয়েছে, বনলতা সেন দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছে কিন্তু যখন ‘আমাকে খোঁজনা তুমি বহুদিন— কতদিন আমিও তোমাকে খুঁজিনাকো’ লেখে সেখানে আর তোমার প্রতি প্রেম মরতে দেখে না কেউ। তুমিও কি দেখেছ? দেখনি, তাই মৃত্যুর পর ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রেমের তাজমহল গড়তে। তোমার দাদা তোমার এ আচরণ দেখলে বরিশালের ভাষায় বোধহয় বলত ছিনালপনা। সে খুব পছন্দ করত আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতে। ব্যাঙকে বলত ভাউয়া, কয়লাকে আংড়া, কুষ্ঠকে কুঠ, দেইজিপনা আরও অনেক শব্দ বুঝতামও না। মনে আছে স্তনকে চুঁচি বলায় আমি একবার খুব রেগে গিয়েছিলাম। অশ্লীল বলেছিলাম। কিন্তু তোমার দাদা আঞ্চলিক ভাষার সমাদর করত খুব। বলত এগুলো ভাষার সম্পদ। দেশভাগ হবার পর নিজেদের দুঃখের কথা যত না বলেছে উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলার কী হবে আর বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব কথ্য ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে কিনা এই চিন্তা বেশি করেছিল। খুশি হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের কথা জেনে। বরিশাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষটা দ্রুত ক্ষয় হয়ে গেল। নইলে পূর্ববাংলার স্বাধীনতাও তো দেখে যেতে পারত, ফিরতে পারত তার প্রিয় বরিশালে। কীভাবে তার রূপসী বাংলা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রেরণা হয়ে উঠেছিল তা দেখতে পেলে তার কেমন প্রতিক্রিয়া হতো সেই মুখটি আমি দেখতে চেষ্টা করি মানসচক্ষে। আমি বরিশালকে পছন্দ না করেও স্বাধীন বাংলাদেশে যেতে পারলাম আর সে বাংলার নদী মাঠ গাছ ভালোবেসে আমৃত্যু সেখানে থেকে যাবে সাধ করেও উন্মূল হয়ে গেল!

সারাটা জীবন দুজন সংসারের দু’প্রান্তে থেকে বোঝার মতো সংসার টেনেছি। মনের যোগ নেই শরীরের যোগ নেই, প্রায় বিধবার মতো কী একটা দুর্বিষহ জীবন! সবাই তার জন্য দুঃখ করে কিন্তু তার তো তবু পথ ছিল অনেক রকমের কিন্তু আমার? পুরুষরা পারে মনের যোগ না থাকলেও শরীরে যেতে। বেশ্যা বাড়ি যাওয়ার অভিজ্ঞতা তো তার ছিলই। ভাবতে আমার কেমন রুচিতে বাঁধত। একটা সময় পর্যন্ত ভেবেছিও তার পক্ষে এরকম অরুচিকর কিছু সম্ভব না—তাছাড়া টাকাই বা কোথায়। স্ত্রীর মতো সস্তা আর কী আছে!

কিন্তু মদ, মেয়ে আর জুয়ার টাকা নাকি ভূতে জোগায়। তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না পরে আরও গিয়েছে কিনা। তোমাকে তো বলেছি তাকে নিয়ে প্রচুর সংশয় অন্য সবার মতো আমারও আছে। অনেক রূপ তার দেখেছি শুনেছিও অনেক। রুচির কথা যে বললাম সে তো আসলে আমার রুচি। তার তো খুব বেশি সংস্কার, ছুঁতমার্গ ছিল না। বিয়ের আগে পরে যে দিনের পর দিন কলকাতায় একা থেকেছে, যেতেই তো পারে। শরীরের চাহিদা তো খুবই ছিল। এই যে বনলতা সেন হতেই তো পারে নাটোর থেকে আসা কোনো বেশ্যা। তখনও যার শরীর থেকে গ্রামের ঘ্রাণ মুছে যায়নি। কচি লাউ ডগার মতো সতেজ শরীর। তাকে তো বিশেষভাবে মনে ধরতেই পারে, দিতেই পারে তার নাম বনলতা। কত কী যে হতে পারে তার আর সীমা পরিসীমা নেই—‘জীবনের ঘাটে ঘাটে নারীরা তার জীবনকে অনন্ত কালের জন্য আটকে রাখবে বলে এসেছিল— অসীম কালের জন্য অধিকার করে রেখেছিল...’ তারই কথা। এই লোকটিকে নিয়ে ভাবতে গেলে স্থিরভাবে কিছুই বলতে পারি না আর, এত কথা এত জনে বলেছে যে মাথা গুলিয়ে যায়, আমার চেনা মানুষটাকে খুঁজে পাই না! কেন জান? ডায়েরির কথা তো বলেছি সেটা সাংসারিক জীবনানন্দ/স্বামী জীবনানন্দ, পিতা জীবনানন্দ/সন্তান জীবনানন্দ/ভাই জীবনানন্দের সাথে সামান্যও মিলবে না। প্রেমিক জীবনানন্দের সাথে মেলে কিনা তা তুমি বলতে পার। ডায়েরি তার লিটারারি নোটস তার সাহিত্যের জীবন, ঘোরের জীবন আর সচেতন জীবনের একটু একটু করে আমরা দেখেছি। তোমার দাদা মারা যাবার পর ভূমেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার দাদা বাংলা সাহিত্যের জন্যে তো অনেককিছু রেখে গেল আমাদের জন্য কী রেখে গেল বল তো? সে উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু এই বাস্তব প্রশ্ন নিয়ে ছিছিক্কার শুরু হলো! আজ তোমাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি তো কবি জীবনানন্দ দাসকে ছেড়ে গিয়ে সুন্দর সুপ্রতিষ্ঠিত স্বামী পেয়েছিলে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার সাজিয়েছ, দেশ-বিদেশ ঘুরেছ সেই সুবাদে নিজেকেও সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছ। আমি কী পেয়েছি বলত? দারিদ্র. অবহেলা, ঘৃণা, বদনাম। এ জীবন কি আমার হবার কথা ছিল?

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পুকুরে গোসল করাকে কেন্দ্র করে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ২০
পুকুরে গোসল করাকে কেন্দ্র করে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ২০
১৪ বছর পর নিয়াজ-ফাহাদদের নিয়ে তিতাস চ্যাম্পিয়ন
১৪ বছর পর নিয়াজ-ফাহাদদের নিয়ে তিতাস চ্যাম্পিয়ন
ভারতের সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা মডেলের গুলি পাওয়া গেলো বাংলাদেশের সীমান্তে
ভারতের সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা মডেলের গুলি পাওয়া গেলো বাংলাদেশের সীমান্তে
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
সর্বাধিক পঠিত
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীর বুকে-পেটে প্রকাশ্যে গুলি
নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীর বুকে-পেটে প্রকাশ্যে গুলি
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’