X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের অপেক্ষা করছি না

এনামুল রেজা
২০ জুলাই ২০২১, ১১:৪৭আপডেট : ২০ জুলাই ২০২১, ১১:৪৭

বাবা যেদিন মারা গেলেন, ঠিক তার আঠারো ঘণ্টা পরে আমি কেঁদেছিলাম। না, সময়ের হিসাবে কোনো গন্ডগোল নেই। সকাল ৯টা থেকে দিন রাত পার হয়ে ঘড়ির কাঁটা তিনের ঘর ছুঁলে, মাঝখানে ক’ঘণ্টা পার হয়? আঠারো ঘণ্টাই তো।

ওদিন মঙ্গলবার ছিল। রোজকার মতো বাবা সকালের নাশতা করলেন। আলুভাজিতে বিষের মতো লবণ হয়েছে বলে মায়ের সাথে ঝগড়া করলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অন্য আরও অনেক দিনের মতো আমি ভেবেছি, বাবা কি কখনো বিষ খেয়ে দেখেছেন? আলুভাজায় লবণ বেশি হলে সেটার স্বাদ বিষের মতো লাগত কেন তার কাছে?

আমার সামনে দিয়েই তিনি বাজার করতে বের হলেন। পৈতৃক সূত্রে ব্যবসায়ী হবার কারণে ৯টা ৫টা অফিসের চাপ তাকে কোনো দিনই সামলাতে হয়নি। সেজন্যেই হয়তো দীর্ঘসময় লাগিয়ে তিনি প্রতি সকালে বাজার করতেন। তিনবেলা খাওয়ার মতো নিত্যদিনের এই কাজটিও হয়তো তার কাছে বাধ্যতামূলক ছিল। হয়তো কেন বলছি? বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এর ব্যতিক্রম কিছু তো আমি দেখিনি। নাহ, আমার ছোটভাই মঞ্জুরুলও দেখেনি। বড়বোন বিলকিসও নয়।

পর্বত সমান ধৈর্যর অধিকারী মা বাড়ির মূল গেট পর্যন্ত তার পিছে পিছে যেতেন সব সময়। সেদিনও গিয়েছিলেন। এসময়টায় কিনে আনতে হবে এমন বহু দরকারি জিনিস মায়ের মনে পড়ে। যেটা লিস্ট করার সময় তার খেয়াল থাকে না। আমরা ভাইবোনেরা কেউই কোনো দিন বুঝতে পারিনি, প্রতিদিন বাজারের সময় এত কী জিনিস তিনি বাবাকে কিনতে বলতেন। সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটি, চুলচেরা নাড়িনক্ষত্রের হিসাব মা একক দ্বায়িত্বে রাখার কারণে আমাদের খুব একটা ইচ্ছেও করত না মূল ব্যপারটি খতিয়ে দেখি। আর হয়তো কোনো দিন দেখাও হবে না, কারণ বাবা তো আর কোনো সকালে নাশতা সেরে চেঁচিয়ে বলবেন না, ‘আলমের আম্মা! বাজারের ব্যাগখান নিয়ে আসোদিন, জলদি জলদি!’

বাবা মারা গেলেন ওই বাজার করতে করতেই। পরিচিত মাছ বিক্রেতা টুকুমিয়া শুনিয়েছিলো আমাদের ঘটনাটা, ‘পোতিদিনের মতো জয়নাল কাকু আসিছিলেন সকালে। উনি তো সব সুমা আমার পোথম কাস্টমার। সুয়া দুই কেজি ওজনের রুইডা তার ব্যাগে ভইরে দিছি। দাম হইছে সাশশ’। পকেটেত্থে টাহা বাইর করার সুমায় কাকু ধুপ কইরে মাটিতি পইড়ে গেলেন। সেই পড়লেন, আমার জয়নাল কাকু আর ওটলেন না ভাই!’

মাছবিক্রেতা টুকু মিয়ার কণ্ঠে একটা সত্যিকার সমবেদনাই টের পেয়েছিলাম আমরা, তার বর্ণনা শুনতে শুনতে উঠোনের মাঝবরাবর রাখা বাবার মৃতদেহটার দিকেও তাকাচ্ছিলাম। তিনি তখন কাছের দূরের স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তারা এসে না পৌঁছলে শেষদেখাটা হতো কেমনে? এ ছাড়া, মানুষের মৃত্যু হলে বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে দেখা হওয়াটা তো জরুরি বলেই আমরা মনে করে থাকি।

আমার দাদি বলতেন, ‘জন্ম-মৃত্যু-বিয়া এই তিনডে দিন হচ্ছে উৎসবের। পোথম আর শ্যাষেরডা আনন্দের, মাঝেরডা দুঃখের।’

‘কী বলেন দাদি, মৃত্যুরও আবার উৎসব?’

‘হাঁ, উৎসব না তো ফিরে কী? দুঃখুরও অনুষ্টান হই, বুঝিছিস? আমি মরলি দেকপি কত মানুষ আসপেনে। তাইগে আবার অনেকেই খাওয়া দাওয়া করবে। মিলাদ দিবি তুরা পরদিন, চল্লিশ দিন পার হলি মাইনষিরে ঘরে ডাইকে খাওয়াবি। ওইসব কি উৎসব না?’ 

বাজারে বহু লোকের ভিড়ে বাবা মারা গেলেন, তাকে ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে আসা হলো, আমরা দিশাহারা হয়ে গেলাম। এতকিছুর মাঝে দুঃখের ব্যাপারটা যে কি, বুঝতে পারলাম না। বাবা আর নেই, এটা কেমন কথা হতে পারে? সারা বাড়ি কয়েক ঘণ্টার মাঝেই লোকারণ্য হয়ে উঠল। উঠোনের মাঝখানে একটা কাঠের চৌকিতে সাদা কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় ঐ তো বাবা পড়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন, অথচ আমরা সবাই বলতে লাগলাম তিনি নেই। হ্যাঁ, কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন, তার মুখ অস্বাভাবিক রকমের কালো হয়ে গিয়েছিল। নিশ্বাস নিতে না পারার অক্ষমতা বড় অক্ষমতা, একটা বিশালাকার দেহ নিয়েও বাবা সে অক্ষমতায় কাবু হয়ে পড়ে ছিলেন। হ্যাঁ, আমাদের বাবা বিশালাকারই ছিলেন, ঝাড়া ছ’ফুট কিংবা তার চেয়েও হয়তো একটু বেশি। সুসাস্থ্যবান দীর্ঘ বাবার পাশে ছোটখাটো আকৃতির মাকে চিরদিন মৃয়মাণই দেখে এসেছি আমরা, চারপাশের সকল মানুষকেও। সেদিন যার অপেক্ষা ছিলো দুরান্তের স্বজনদের জন্য, কখন তাকে আমরা কবরে নিয়ে যাব, অপেক্ষা ছিলো সেজন্যেও।

প্রথম যে অনুভূতিটা আমাকে গ্রাস করল, তা হলো দিশাহীন সমুদ্রে পাল ছেঁড়া জাহাজ নিয়ে নাবিক যেমন দিশাহারা হয়ে যায়, সেরকম। আমি ঠিক কি করব, বা কি করতে হবে বুঝতে পারলাম না। কেউ মরে গেলে কী করতে হয়?

দাদি যখন মারা গেলেন, আমি বাসায় ছিলাম না। পড়ালেখার সুবাদে কিংবা দুর্বাদে ঢাকায় বাস করছি সেসব দিনে। রাতের প্রথম প্রহরে ছোটভাইয়ের থেকে মৃত্যু সংবাদটি যখন শুনেছিলাম, মনে আছে চিৎকার করেই কেঁদে উঠেছিলাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয় হলের অনেক ছাত্র জড়ো হয়ে গিয়েছিল রুমে। দাদি মারা গেলে এমন চিৎকার করে কাঁদতে হয় কিনা আমি জানতাম না, কিন্তু ওদিন কেঁদেছিলাম। মনে হচ্ছিল কিছু একটা আমার জীবন থেকে নেই হয়ে গেল। তারা জ্বলা লোডশেডিংয়ের রাতে কেউ আর বিদ্যুৎহীন যুগের সেইসব ভুতুড়ে গল্পগুলো আমার সাথে করবে না কিংবা সেই দর্জির গল্পটা শোনা হবে না, গভীর রাতে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার সময় যাকে পিছন থেকে নাকি সুরে ডাকবে গোরস্তানে বসবাসকারী জিন যার বয়স এক হাজার বছর। নামাজের ওয়াক্ত হলে চাপকল থেকে অজুর পাত্রে পানি ভরে দেওয়ার জন্য কেউ আকুতি করবে না আর। এইসবের পুনরাবৃত্তি না হওয়ার নিশ্চয়তাতেই কি মুষড়ে পড়েছিলাম? অমন কান্না সেদিনের আগে আমি কখনো কাঁদিনি। প্রভোস্ট স্যারও রুমে চলে এসেছিলেন। পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘খুব ভোরে রওনা দিয়ে দাও। প্রথম বাসে উঠে যাবে, দুটার ভিতর পৌঁছে যাবে বাসায়। এভাবে কাঁদতে নেই পাগল ছেলে।’

নাহ, দাদি মারা যাবার পর কিছুই আমাকে করতে হয়নি। কারণ কিছু করার মানুষের অভাব তো ছিল না। আমার তিন ফুফু আর তাদের স্বামীরা ছিল, আমিসহ ছিলো আর সকল নাতি-পুতি। ছেলে, ছেলের বউয়েরা। আমার কারণে তার দাফনে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে যখন সূর্যের তেজ কমে এসেছিল, বাসায় ফিরেছিলাম। দাদিকে শেষবার দেখা হয়নি, ততক্ষণে মাটি হয়ে গেছে। বরং এক ধরনের আনন্দই আমাকে গ্রাস করেছিল সেদিন বিকেলে। দাদিকে চিরদিন তো আমি জীবিতই দেখেছিলাম, মরে গেলে তিনি কেমন দেখতে, সেদৃশ্য আমাকে সহ্য করতে হয়নি। তাই হয়তো আজও একেকদিন ভরসন্ধ্যায় দাদির সাথে আমার দেখা হয়ে যায় পুকুরপাড়ে, কিংবা ছাদের কার্নিশে বসে থাকলে একেক ভরদুপুরে দেখি পেয়ারাগাছের তলা দিয়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন ভারি পায়ে, থপথপ আওয়াজও যেন কানে আসছে, নায়লনের ঢিলে একটা চপ্পল পরে তিনি হাঁটতেন।

অতীত অভিজ্ঞতাহীনতার কারণেই বাবা মারা গেলে আমি দিশাহারা হয়ে গেলাম। আমার অতি নাটুকে মা বারান্দার এক কোনায় এলাকার মহিলা পরিবেষ্টিত হয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বিশেষণটা কি খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেল? এমন কোনো ভালোবাসার পাত্র কি বাবা ছিলেন যার জন্য অমন বারবার মূর্ছা যেতে হবে? তাছাড়া মূর্ছা যাওয়াটা এক ধরনের সামাজিক আচার হয়ে দাঁড়িয়েছে বহু বছর ধরে, এই কদিন আগে যখন পাশের বাড়ির সুলতানা আপার বাবা মারা গেলেন, তার আম্মাও ঠিক এভাবে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। ঠিক একই ভাবে আমার মাও কেন অমন করছিলেন? কে জানে, হয়তো আমার বিশেষণ ভুল। হ্যাঁ, ভুলই হবে। কারণ ওসব ঘটনার আঠারো ঘণ্টা পরে তো আমি নিজেও কেঁদেছিলাম। না কেঁদে কিভাবে পারতাম আমি?

এ মুহূর্তে ঘটনাগুলো মনে করে অবাক না হয়ে পারছি না। বাবার লাশটা সবাই ধরাধরি করে আনল, আমি তখন কলেজে যাবার জন্য রওনা হচ্ছি। সাড়ে ১১টায় এডভান্সড একাউন্টিংয়ের একটা ক্লাস ছিলো। ক্লাস বলতে ছাত্রদের মান্থলি অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেওয়া। মঙ্গলবারগুলোতে আমি ধীরে-সুস্থে ক্যাম্পাসে যাই, একটা বা দুটা ক্লাস থাকে। সেসব সেরে ৩টার মধ্যেই ফিরে আসি। তার পরের সময়টুকু চলে যায় গল্পের বই বা উপন্যাস পড়ে। হ্যাঁ, ব্যবসায়ের মতো নিরস একটা বিষয় আমি ছাত্রজীবনে পড়েছিলাম, কর্মজীবনে আমার ছাত্রদেরও তাই পড়িয়ে যাচ্ছি অর্থহীনভাবেই, অথচ চিরটাকাল আমার আগ্রহ তো সাহিত্যেই ছিলো। 

বাবা সাহিত্য পছন্দ করতেন না কোনো দিন। বলতেন, ‘যিডা সবাই করতি পারে তা করার কোনো মানে আছে নাকি?’ 

‘সবাই সাহিত্য করতি পারে?’

‘অবশ্যই পারে। এই আমারে ধর। ছাত্রজীবনে কবিতা লিখিছি বন্ধুগের সাথে বাজি ধইরে, কলেজের সাময়িকিতি ওইসব ছাপাও হইছে।’

‘ও।’

‘ও আবার কি? আমাইগে মদ্যি সবচেয়ে ভালো কবিতা লেখতো কবির। ওইগে এখ্যান সাহিত্যিক আড্ডাই ছেলো। লিটল ম্যাগফ্যাগ বাইর করত। এহনে কোনো দৈনিক পত্রিকার সাব-এডিটর নাকি হইছে, ওইডে কোনো ক্যারিয়ার হলো? পরতি বছর একের পর এক কবিতার বই বাইর করতিছে ছাগলের বাচ্চার মতো, দশ কপিও বিক্কিরি হই না।’

এর পর আসলে কথা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যেত আমার পক্ষে। কী আর বলার থাকে এমন মানুষের সাথে? বাবা কিন্তু বলে চলতেন। ‘আমারেই দেখ। কলেজ শেষ না কইরেই তোর দাদার কাজে হাত লাগাইছিলাম। এখ্যান থান কাপড়ের দুকান ছেলো আব্বার তহন। আইজকে নিউমার্কেটে আমার চাইরখান পাইকারি থানের দুকান। এই ব্যবসার উপরে আমাইগে পুরো গুষ্ঠিই দাঁড়ায়ে রইছে, রইছে না?’  

বাবা ভুল কিছু অবশ্য বলতেন না। আমার চাচারা সকলেই বেশ ভালো ধরনের চাকরিজীবী। বাবার অবস্থাই তবু সবচেয়ে জাঁকালো ছিলো। কারবারটা এমন পর্যায়েই তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাদের পরিবারের স্ট্যাটাস হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেটা। আমি ওসব জটিল আর্থনৈতিক বিষয় আসয়ে আগ্রহ পেতাম না তখন। কিন্তু অস্বীকার কিভাবে করি, ওসব ব্যাপার ছাড়া বাবার সঙ্গে খুব একটা বিরোধ তো আমার ছিল না কখনো। 

সারা গ্রাম ভেঙে লোক জড়ো হয়েছিলো আমাদের বাসায়। মসজিদে ঘোষণা করা হলো, ‘এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব শেখ জয়নাল হক মৃত্যুবরণ করেছেন। বাদ আছর তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।’

আমার চাচারা সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। জোহরের আগে ভাগে ছোটচাচা ছাড়া সকলেই পৌঁছে গেলেন। ফুফুরা পৌঁছলেন আছরের খানিক আগে। আমি ফোনের পর ফোন করতে লাগলাম নানান জায়গায়। আমাদের পারিবারিক গোরস্তানের এক কোণে, ঠিক দাদার কবরের পাশে নতুন একটা কবর খুঁড়তে লাগল মনি আর গণি মিয়া। এ দুভাই গোরখোদক হিসেবে গোটা এলাকায় বিখ্যাত। আমার বহুদিন ইচ্ছে হয়েছে তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করি, যে এ পর্যন্ত কতগুলো কবর তারা খুঁড়েছে? কে জানে কেন, জিজ্ঞেস করা হয়নি।

মৃত বাড়িতে রান্নাবান্নার নিয়ম নেই। সুতরাং, এলাকায় আমাদের অসংখ্য মঙ্গলকামীদের মাঝে একটা শীতল যুদ্ধই হয়তো শুরু হয়ে গিয়েছিল। শেখ বাড়িতে খাবার পাঠানো যে সে ব্যাপার তো না। গ্রামবাসী বিশ্বাস করত, আমাদের বাড়ির সাথে সুসম্পর্ক রাখাটাও আসলে সামাজিকভাবে বড় সম্মানজনক। এই সম্মান কোথা থেকে সৃষ্টি হয়? অর্থবিত্ত থেকে? এই যে কদিন আগে সুলতানা আপার বাবা মারা গেলেন, কই তখন তো কারও মাঝে তেমন তাড়া দেখিনি এমন। বাসা ভেঙে খুব একটা লোকজন জড়ো হয়েছিল এমনও মনে পড়ে না।

স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে হবু আলেমরা এসে সুর করে কুরআন পড়ছিল। বাড়ির মহিলাদের কান্নাকাটির সাথে সেই সুর মিলেমিশে অদ্ভুত এক আবেশ তৈরি হল চারপাশে। মঞ্জুরুলও দৌড়চ্ছিলো নানান কাজে। আমিও। সেসময় বাবাকে নিয়ে ভাবনার সময় কোথায়? সবাই এলেও আসতে পারল না বিলকিস। একে সে জামাইয়ের সঙ্গে আমেরিকায় থাকে, তার উপরে প্রেগন্যান্ট। কিছু সময় পর পরই সে ফোন করছিল, ফোন কানে রেখে আমি শুনছিলাম ওর ফোঁপানি, ‘শেষ দেখাডা দেকতি পাল্লাম না রে আলম, আব্বারে শেষ দেখাডা...’

গোরস্তানে পৌঁছবার পর সকলেই আমার নাম ধরে ডাকতে লাগল, ‘এই আলম কোথায় গেল, আলম, এই এদিকি আসো।’ আমি একটু দূরে, একটা জটলার পিছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কী করতে হবে যেন বুঝে ওঠা কঠিন। ওরা আমাকে ডাকছিল বড় ছেলের দায়িত্ব পালন করার জন্য। তা করতে আমি কবরে নেমে গেলাম। গ্রীষ্মের আকাশের নিচে সাড়ে তিন হাত এক চৌকো গর্ত। চারপাশ ও খালিপায়ের তলায় আশ্চর্য শীতলতা। তীব্র আতরের গন্ধের সঙ্গে ভেজা মাটির গন্ধ মিশেছে। কেমন ঘুম ঘুম লাগছিল। একজন চিৎকার করে বলল, ‘মাথার দিকে দাঁড়াও, মাথার দিকে। তুমি বড় ছুয়াল, মাথা ধরো।’ পায়ের দিকে ধরল মঞ্জুরুল। আমি এক হাত দিলাম বাবার পিঠের দিকে। অন্য হাত মাথায়। এত বিরাট একটা লাশ। অথচ, শোলার মতো হালকা মনে হচ্ছিল। অবাক হয়ে একবার মঞ্জুরুলের দিকে তাকালাম। সে যেন কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। ওকে সবচেয়ে বেশি আদর করত বাবা। ইচ্ছে হলো একবার ওকে জিজ্ঞেস করি, ‘বাবার লাশ এত হালকা কেন রে?’

রাত গভীর হবার সাথে তাল মিলিয়ে সব চুপচাপ হয়ে গেল। সারাদিন মানুষের হইচই ছিল, নৈঃশব্দ্য এ কারণে আরও বেশি চেপে বসেছিল তখন পরিবেশে। ক্লান্তও ছিল সবাই। কিছুক্ষণ পর পর শুধু আম্মাকে শোনা যাচ্ছিল। কাঁদছেন। থেমে থেমে। বাবা আসলে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন। এতগুলো বছর একসাথে কাটিয়েছেন। কেমন একা হয়ে গেলেন। এই জগতে সঙ্গীহীনতার যন্ত্রণা হয়তো মৃত্যুশোকের চেয়েও অধিক শোকের, অমনটাই মনে হয়েছিল আমার। আমরাও তো বাবার সঙ্গে কাটালাম কতগুলো বছর। আর তিনি অকস্মাৎ নেই হয়ে গিয়েছিলেন আমাদের মাঝখান থেকে।

আমাদের পুরনো আমলের টানাবারান্দার দোতলা বাড়ি। ষাট ওয়াটের একটা হলদে বাল্ব জ্বলছে। বাবার ইজিচেয়ারটা টেনে এনে বসেছিলাম। কেমন বাতাস দিচ্ছে। আর শোঁ শোঁ আওয়াজ। মনে পড়ছিল সেই দিনটার কথা। ঢাকায় থাকি তখন। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। ঠিক এই চেয়ারটায় বাবা বসে ছিলেন। বারান্দার সিমেন্ট বাঁধানো রেলিংয়ে পিঠ দিয়ে তার মুখোমুখি আমি।

‘কী, পড়ালিখা হচ্ছে তো ঠিকমতো?’

‘জি, আব্বা, হচ্ছে।’

‘একা থাকো, খারাপ লাগে না শহরে?’

‘জি, লাগে।’

‘লাগে? কই ফোন টোন তো দেও না আমারে দেহি। শুধু ঐ তুমার আম্মার সাতে মাঝেমদ্যে কথা বইলে রাইখে দেও। আমারও তো এখ্যান মুবাইল নাম্বার আছে, নাকি?’

‘খবর নি তো আব্বা, মানে আম্মারেও তো জিগোই আপনার কথা।’

বাবা মুচকি হেসেছিলেন। এরপর গভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তুমার দাদা যখনে মরল, আমি কিন্তু বেনাপোল রইছি। থানের চালান আসপে ইন্ডিয়াত্থে। বর্ডারে আটকায়ে গেল কী কারণে। তখনে তো মুবাইলির কারবার নেই। টেলিফোনও নেই আমাইগে। সুমায় মতো খবর পালাম না। আমি দুইদিন পর বাসায় আইসে দেখলাম সব শেষ হইছে। এই দেখো, এই বারান্দায় গড়াগড়ি কইরে কী কান্না কান্দিছিলাম জানো! মনে পড়লি এখনেও বুকখান ভার হইয়ে আসে। বাপ যে কী জিনিস, বাপ না থাকলি বুঝবা, এর আগে না।’

ঠিক এই দৃশ্যটা মনে পড়ার পর আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। ভিতর থেকে চেপে চেপে আসতে শুরু করেছিল কান্নার দমক। হলদেটে ভুতুড়ে আলোয় কেউ দেখে ফেলে কিনা সেই আশঙ্কা চাপা দিতে পারছিলাম না। বাড়ির বড়ছেলে আমি। কিন্তু বাবার ইজিচেয়ারটা ছেড়ে বারান্দার রেলিংয়ে ভর দিয়ে হয়তো শব্দ করেই কাঁদছিলাম। ওপাশে অন্ধকার। ঐ রাতে কৃষ্ণপক্ষ ছিল। অনবরত ঝিঁঝির পাল ডাকছিল অদূরের ঝোপের আড়াল থেকে।

তখন টের পেলাম কেমন এক আশ্চর্য ভার আমার দুই কাঁধে চেপে বসছে ধীরে ধীরে। যেন-বা ওজনদার দুটি হাতে কেউ ঠেসে ধরতে চাইছে আমাকে নিচের দিকে। ভার হয়ে আসছে মাথা। দৃষ্টি ঘোলাটে। অথচ, সারা দিন এমন ভার বোধ করিনি। বাবার লাশটাও কেমন হালকা ছিল, মঞ্জুরুলকেও কথাটা বলব ভেবেছিলাম। তারপর কী ভেবে পেছন ঘুরে দেখেছিলাম কিছুক্ষণ আগের ফাঁকা বারান্দা আর ফাঁকা নেই। সবকটা দরজাই খোলা। বাড়ির সমস্ত লোক একটু দূরে দাঁড়িয়ে একসাথে জড়ো হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা