X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তামসী

হোসনে আরা মণি
০৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:২২আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:২২

গুগলির স্বাদ যে এত উপাদেয় তা আমার জানা ছিল না। মাত্র একটাই আমি খেলাম, মানে খাওয়ার জন্য মুখের নাগালে পেলাম। আর তার পরেই আমি উন্মাদ হয়ে গেলাম আরো গুগলি মুখে পুরে নেয়ার জন্য। কী চমৎকার মিষ্টি মিষ্টি লোনা লোনা স্বাদ! কী নরম আর পিছল—চিবানো-টিবানোর ঝামেলা না করলেও চলে। তুলতুলে জিনিসটাকে খালি মুখে পুরে নেও, তারপর মুখের মধ্যে দুয়েক বার নাড়া চাড়া করে সুড়ুৎ করে গিলে খাও। নাড়াচাড়া না করে সরাসরিও গেলা যায়। কিন্তু অমন অমৃতবৎ (কে জানে অমৃতের স্বাদ কেমন, গুগলির চেয়ে বেশি নয় নিশ্চয়।) স্বাদ মুখে ধরে রাখতে কার না ইচ্ছে হয়! তবে খাবার যতই স্বাদু হোক, না গিলে মুখে বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না। মুখের সুস্বাদু বস্তু পেটে চালান করতেই হয়। আমিও তাই করেছিলাম। কিন্তু এবার আরেকটা পেলে...।

সমস্যা হচ্ছে আমার হাত দুটো বাঁধা—পেছন থেকে মুড়ে বাঁধা। তাই হাঁসের মতো মুখ-গলা ডুবিয়ে পা আকাশে তুলে গুগলি খোঁজা ছাড়া আপাতত অন্য গতি নেই। কিন্তু এ পুকুরটা মজে আসলে কী হয়, আয়তনের বিশালতার দরুণ পানি এখনো বেশ। তাই গুগলি খুঁজতে আমাকে খুব কসরৎ করতে হচ্ছে। সাঁতারে আমি কোনোকালেই খুব ভালো ছিলাম না; ডুবসাঁতারে তো নয়ই। তবু এখন কিভাবে যেন ঠিকই ডুব দিয়ে পা খাড়া উপরে তুলে ঠোঁট দিয়ে গুগলি খুঁজে চলছি। আমার সহগুগলিখোর শামীমা কিন্তু দারুণ পাকা গুগলি শিকারি। কেমন টপাটপ ডুব দিয়ে দেহটাকে পাক মেরে পা দুটোকে উপরে তুলে পানির তলায় পাঁকে ঝিমাতে থাকা গুগলিগুলোকে মুখে পুরে নিচ্ছে! একেক ডুবে সে একাধিক গুগলি পাচ্ছে। তারপর মুখ ভাসিয়ে তুলে গুগলিগুলোকে একটু আয়েস ভরে গিলে নিয়ে ফের ডুব।

শামীমার গুগলি ভোজনের বাহার দেখে আমার বড় হিংসে হয়। ইচ্ছে করে ওর মুখ থেকে সাধের গুগলিগুলোকে কোনো কায়দায় বের করে নেই। কিন্তু একে তো শামীমা আমার চেয়ে তাগড়াদেহী, তার ওপর ওর হাত দুটো দিব্যি মুক্ত। মুক্ত দুটো হাত থাকা সত্ত্বেও কেন যে শামীমা মুখ দিয়ে গুগলি তুলছে! শামীমাকে সে কথা বলতেই বলল, অ্যাডভেঞ্চার, বুঝলি? ভিন্ন কিছু ভিন্নভাবে করার ইচ্ছে।

তাতে লাভ? কষ্ট হচ্ছে না তোর?

আরে নাহ্। তোর তুলনায় আমি লম্বা তো, আমাকে পানির নিচে অত হাতড়ে ফিরতে হয় না।

কথাটা হাতড়ানো হবে না রে শামীমা। আমরা তো কেউ হাত দিয়ে গুগলি খুঁজছি না। মুখ দিয়ে কাজটা করছি। কথাটা তাই হতে পারে ‘মুখড়ানো’।

যাহ্! তুই পারিসও বটে! এখানেও নতুন শব্দ তৈরির খেলা।

কী করব। মাথায় সারাক্ষণ এগুলোই থাকে। তোর মতো প্রেম প্রেম খেলার সুযোগ নেই। তাই শব্দ খেলা খেলি।

তা আমার প্রেম নিয়ে না তোর গল্প লেখার কথা ছিল?

আমি কিছু না বলে ডুব দেই। পায়ের কাছে নরম কিছুর অস্তিত্ব টের পেয়েছি। ঝট করে ধরে ফেলতে না পারলে ঠিক সরে যাবে। ইদানীংকার গুগলিগুলোও হয়েছে মানুষের মতোই চালাক-চতুর এবং বেশ দ্রুতগামী জীব। এদের দেহের বাইরে আগেকার দিনের গুগলির মতো কোনো খোলশ নেই। তুলতুলে নরম পিছল অথচ রবারের মতোই স্থিতিস্থাপক শরীর। খপ করে মুখে পুরতে না পারলে ঠিক সটকে যাবে।

নাহ্, ধরা গেল না। এটাও পগারপার। মাঝখান থেকে মুখ ঘষটাঘষটি করে বারোটা বেজে তেরোটা। এভাবে হবে না। ইস্! হাত দুটো যে কেন বাঁধা! কে বেঁধেছে?

আমার অবস্থা দেখে শামীমা দয়াপরবশ হয়ে দুটো গুগলি তার মুখ থেকে আমার মুখে ঢেলে দিলো। তারপর বেশ ভাব নিয়ে বলল, আমার গল্পটা লিখে ফ্যাল, গুগলির ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না।

দূরো জ্বালা! গল্প লিখতে গুগলি ঘুষ! ওর প্রেম নিয়ে গল্প লেখার কী আছে? করে তো একখানা পরকীয়া, আকাশ সংস্কৃতি-অন্তর্জালের যুগে ও তো এখন ঘরে ঘরে ঘটমান। ছেলেরা এখন বন্ধুমহলে বৌয়ের চেয়ে জিএফের গ্ল্যামার নিয়ে বেশি গর্ব করে। আর মেয়েদের স্বামীর রূপ-যৌবন যেমন-তেমন হলেও চলে যদি পদ-পদবি আর ওয়ালেটখানা বেশ ভারী থাকে। কিন্তু বিএফের বেলায় মেয়েরা ঠিকই পৌরুষের দীপ্তি খোঁজে (টাকাওয়ালা বুড়ো-হাবড়ার বগলদাবা নারী সাধারণত রক্ষিতা, প্রেমিকা নয়; তাই তারা এই সাধারণীকরণের আওতাবহির্ভূত)। নারীও এখন ফ্রেন্ডস্ সার্কেলে স্বামীদের পকেটের স্বাস্থ্য জাহিরের পাশাপাশি আপনাপন দয়িতের প্রেম ও পুরুষকারের বড়াই করে থাকে—বড়ই বিনম্র লাজুক ভঙ্গিতে। কথা হলো—এ জাতীয় গল্পের নাটক-সিরিয়ালে এমনিতেই চ্যানেল ঠাসা। রিমোট হাতে যে ঘাটেই দৃষ্টি ভিড়াও সিরিয়ালের বিষয়-আশয় মোটামুটি এক। তো এমন কমন বিষয় নিয়ে মগজ খাটিয়ে আরেকখানা কমন গল্পের জন্ম দেয়ার কী বাহাদুরি আছে তা আমি কিছুতেই ভেবে পাইনে। কিন্তু শামীমা আমাকে ছাড়তে নারাজ। আমাকে দিয়ে তার প্রেমের গল্প লিখিয়েই ছাড়বে। কষ্টে আহরিত গুগলি ঘুষ দিয়ে হলেও।

কী হলো? ভ্যাবলাকান্তের মতো হা করে কী ভাবছিস? লিখবি না আমার গল্প?

অ্যাঁ! হ্যাঁ, মানে... না, ঠিক...

কী হ্যাঁ-না করছিস? গুগলি খাবি অথচ গল্প লিখবি না, মাংনা পাইছিস?

শামীমা প্রায় তেড়ে আসে। আমি গলা জলে দাঁড়িয়ে ওর হাত থেকে পরিত্রাণের কথা ভাবি। এমন সময় একটা বাজ এসে ছোঁ মেরে আমাকে তুলে নেয়। আমি তার নখরের খোঁচায় ছটফটাতে থাকা কালেই দেখি বাজটা আর কেউ নয়, খোদ আমার পতিধন।

আরে, আরে, লাগছে তো! ছাড়, ছাড়...

ছাড়লেই তো ছুটবে গুগলি খেতে। গুগলি খুব মজা, না?

না, তেমন... ঐ আছে আরকি। তা তোমার ঘরে বসেই বা খাব কি শুনি? সেই তো ‘থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়’ রান্না।

ঘরে রান্না খাদ্যে অরুচি! আর কাঁচা গুঁয়ে খুব মজা, তাই না?

গুঁ নয়, গুগলি।

ঐ হলো। তা এসব খাওয়া কে শেখাচ্ছে—ঐ বান্ধবী?

শামীমা কেন শেখাবে? আমি নিজেই...

হুম। ভালোটা গুরু ধরেও শেখা হয় না, মন্দ শিখতে মন্দ লোকের ওস্তাদের দরকার পড়ে না। আমি এক যুগ চেষ্টা করেও তোকে ঘাস খাওয়া শেখাতে পারলাম না। আর তুই এমনিতেই গুগলি খাওয়া শিখে গেলি?

তুই-তোকারি কোরো না। ঘাস আবার মানুষে খায় নাকি? ও তো খায় গরু-ছাগল-ভেড়ায়।

আর গুগলি? ও তো খায় হাঁসে।

মানুষেও খায়। তুমি জানো না, তাই।

কাঁচা খায় বুঝি? হাঁসের মতো গলা ডুবিয়ে?

কী করব? হাত যে বাঁধা।

হাত বাঁধা, তাই এত! খোলা থাকলে কী করতি? সাপ-খোপ, বাঘ-ভাল্লুক সব খেয়ে নিতি?

বাজরূপী স্বামী কিংবা স্বামীরূপী শকুনটা আমাকে নখের আঘাতে ফালাফালা করতে থাকল। আমি চিৎকার করতে করতে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তিরতিরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে অসংখ্য তেলাপোকা হয়ে ফরফরিয়ে উড়তে থাকলাম।

শামীমা, কাল রাতে একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

কী দেখলি? মারা গেছিস?

আরে না, মরলে তো জ্বালা জুড়োত।

স্বপ্নে মরলে জ্বালা জুড়োয়?

অন্তত বুঝতাম যে মরার স্বাদ কেমন।

হুম। তা কী দেখলি?

তুই আর আমি হাঁসের মতো গলা ডুবিয়ে গুগলি খাচ্ছি।

অ্যা! ওয়াক থুঃ! তুই কি বেছে বেছে রাজ্যের যত কুৎসিৎ স্বপ্ন দেখিস? তাও আবার আমাকে সহ! সেদিন দেখলি গর্তভরা পায়খানার পোকা থকবক করছে। তার মাঝে আমি-তুই দাঁড়ায়ে।

কী করব বল? স্বপ্নের পরে তো কারো হাত নেই।

আছে। সুচিন্তা কর। তাহলে সুন্দর স্বপ্ন দেখবি।

যে জীবন যাপন করি আর চারপাশে যা দেখি-শুনি তাতে সুচিন্তা আর আসে কই?

দুশ্চিন্তা করারই-বা অত কী আছে? তোর মতো সমস্যাগ্রস্ত মানুষ কি জগতে আর নেই?

অগণিত। তারা হয়তো তাদের সমস্যাকে সমস্যা বলে ভাবেই না।

এই তো বেশ বুঝিস। তাহলে?

তাহলে আর কী। একজন মানুষ কি আর আরেকজনের মতো হয়? মানুষ আলাদা বলে সমস্যার ধরন এক হলেও তা  আলাদা হয়ে ধরা পড়ে।

তুই আসলে সবকিছু নিয়ে একটু বেশিই ভাবিস। কী দরকার ছিল স্রেফ সন্দেহের বশে সেপারেশনে যাওয়ার? আরিফ ভাই আর কনা ভাবির শারীরিক মিলন তুই কি নিজ চোখে দেখেছিলি?

ওসব কি নিজ চোখে দেখার সুযোগ কারো হয়?

হয়। আর হওয়ার পরও সংসার টিকে থাকে।

বলিস কী!

তুই বড্ড ক্ল্যামজি আছিস এখনো। একালের মেয়ে হয়েও তোর ইমোশন-সেন্টিমেন্ট সব সেকালের মতো রয়ে গেল।

শামীমা, আমি লেখক। আর লেখকের নিজস্ব কিছু ধ্যান-ধারণা, মতাদর্শ থাকতে হয়।

হুঁ, মতাদর্শ! তোর মতাদর্শ তোকে একা করে দিয়েছে, নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। জগতে এত সেক্সি-ক্রেজি প্রেমিক পুরুষের ভিড় থেকে একটা ‘ইয়াম্মি’ পুরুষ তুই বেছে নিতে পারছিস না।

ইয়াম্মি ‘পুরুষ’! ভালোই বলেছিস। পুরুষও তাহলে খাবার?

নয় কেন? ‘খাওয়াখাওয়ি’র খেলায় দুজনই তো দুজনকে খায়। খালি মেয়েদের নাম খাদ্য তালিকায় থাকবে কেন? এখন মেয়েরাই বরং বড় খাদক।

কী যে বলিস না তুই! নিজেদের সম্পর্কে কী সব অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করছিস!

আরে ইয়ার! ওরা এসব কথা উঠতে-বসতে বলে। কই, ওদের তো এতে ইজ্জত যায় না। মেয়েরা সব ব্যাপারে এত স্পর্শকাতর আর ক্ষণভঙ্গুর কতকাল থাকবে, বল তো? পুরুষের কাছে যেসব কথা ডালভাত তার সামান্য তাপেই মেয়েদের ইজ্জতের গায়ে ফোস্কা পড়ে। এত নাজুক হলে ওরা তো আমাদের পেয়ে বসবেই। দুর্বলকে পীড়নই তো সবলের কুধর্ম।

হুঁ, পুরুষের সাথে অশ্লীলতায়ও টেক্কা দেয়ার চেষ্টা! এ কাজে মেয়েরা কখনো সফল হবে না। এ প্রতিযোগিতায় ওদেরকে পেছনে ফেলা নানা বাস্তব কারণে অসম্ভব।

যেমন?

যেমন ধর যৌন হয়রানি। ওরা আমাদেরকে পাবলিক প্লেসেও কতভাবে টিজ করে থাকে। তুই পারবি ওদের কাউকে তেমন করে টিজ করতে? ওরা টিজ্ড্ হবে, নাকি মজা পাবে?

মজা পাবে। চাই কি আনন্দে বিগলিত হয়ে পিছন পিছন হাঁটা লাগাবে। দেখা যাবে, তুই ফান করতে চোখ টিপ দিয়েছিস কি সে এসে তোর বিছানায় বসে আছে। তুই ওদের শরীরের কোথাও আলতো হাত বুলিয়েছিস কি ওরা তোকে ধরে সেই পাবলিক প্লেসেই ফুল প্লে...

আরিফ এমনই বলেছিল। তার কথা সত্যি বলে ধরলে কনাই তাকে...

সে তো হতেই পারে। তোর বর তো আর দেখতে খারাপ না। মাথায় চুল একটু কম হলেও... আর চুল কমওয়ালা পুরুষেরা নাকি...

থাম। বুঝলাম কনাই যত নষ্টের মূল; কিন্তু আমার বারো বছরী কাজের মেয়েটা? সেও কি ওকে প্রোভোক করেছিল?

তেঁতুল হুজুরের বাণী শুনিসনি? মেয়েদের দেখলেই নাকি ওদের লালা গড়ায়?

স্টুপিড হুজুর। ওদের দেখলে আমাদের কী হয় তা এতটা বয়সেও জানে না।

জানবে না কেন? সেই যে হাদিসটাতে আছে না—মহানবী একদিন বিবিদের সাথে অবস্থানকালে এক অন্ধ লোক দেখা করতে এলে তিনি তাদেরকে সরে যেতে বললেন। বিবিরা আপত্তি জানিয়ে বললেন যে তিনি তো অন্ধ। তখন মহানবী বললেন যে তোমরা তো আর অন্ধ নও। নারীর অনুভূতির স্বীকৃতি তো এই হাদিসেই আছে। এসব হাদিস না পড়ে কি আর কেউ হুজুর হয়?

হুজুরের কথা রাখ। আমার স্বপ্নের কথায় আয়। রাতে আমি ঠিকমত ঘুমাতে পারি নারে শামু, খালি আজেবাজে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়।

ঘুম ভালো হয় না বলেই স্বপ্ন দেখিস। ফ্রয়েড বলেছেন,...

ফ্রয়েড রাখ। কোন জ্ঞানের কথা আর ভালো লাগছে না। কী যেন বলছিলি, সব চোখে দেখার পরও সংসার টিকে থাকার ব্যাপারে?

বলছিলাম এমন এখন অনেক ঘটছে। বহু সংসার এখন আমরা-আমরা, তোমরা-তোমরা ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

সেটা কী রকম?

ইস্! তুই সত্যি এখনো খুকি আছিস। আমরা-আমরা, তোমরা-তোমরা— মানে বুঝলি না? মানেটা হচ্ছে...

হুম, মনে হয় বুঝলাম। তাহলে ঐসব দম্পতিদের পারস্পরিক সম্পর্কের নাম কী দেয়া যায়? বন্ধু? রুমমেট? পার্সিয়াল লাইফ পার্টনার?

এটা নিয়ে পণ্ডিত সমাজ এখনো কিছু ভেবে ওঠেননি। এটার চর্চা খুব কঠোর সিক্রেসি মেনে চলে কিনা, তাই।

তুই এটাকে এলাউ করিস?

আমার এলাউ-ডিসএলাউ এ কিছু যায় আসে না। আমি আমজনতার কাতারের মানুষ। তোদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি যদি...

তুই ভুল বলছিস শামীমা। সামাজিক প্রপঞ্চে আমমানুষের চিন্তা-চেতনা, আচরণ ও অভ্যাসের ভূমিকাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এখনো কোনো আলাদা সমাজ গড়ে তুলতে পারেনি।

কোন দেশেই-বা তারা তা পারে? আমজনতার কাছে বুদ্ধি বেচে যাদের খেতে হয়...

বুদ্ধিজীবীদের কথা থাক দোস্ত। আর আমাকে শুধু শুধু বুদ্ধিজীবী বলে খোঁটা দিস না। এ দেশের লেখক জাতের মাথায় যদি বুদ্ধিই থাকত তাহলে তারা লেখা ছেড়ে অন্য কোনো পেশায় ভাগ্য ফেরাতে চেষ্টা করত।

বুঝিস যদি তো তা করলেই পারিস। কে বলে ওসব ছাই-পাঁশ লিখতে? এসব ছেড়ে বরং আরেকটা বিয়ে-থা করে সংসারী হ।

আমি এখন সংসারী না?

একা মানুষের সংসার!

একা কেন? আমার মেয়েটা আছে।

তা আছে। তবু এটাকে ঠিক সংসার মনে হয় না। নারী-পুরুষের জোড়া ছাড়া কি আর সংসার হয় রে!

তা হবে কেন! দৃষ্টিকে প্রসারিত করে জগৎময় ছড়িয়ে দে। দেখবি কত রকম সংসার দুনিয়ায় আছে।

সে যাই থাক, আমি বলি তোর সুখ চিন্তা করে। আমাদের দেশে সিঙ্গেল মাদার হয়ে টিকে থাকা কঠিন। ঘরেবাইরে লড়তে লড়তে তোর ভেতরটা ধসে মনোবিকার শুরু হবে, যার আলামত এরই মাঝে দেখা যাচ্ছে।

আমার স্বপ্ন তাহলে মনোবিকার?

আমার তাই ধারণা। নইলে কেউ নিত্য রাতে এত কুৎসিত স্বপ্ন দেখে!

তুই বোধহয় ঠিকই বলছিস শামীমা। লড়তে লড়তে আমার বোধহয় মনোবিকারই হয়েছে। শুধু ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই যে আমি কুৎসিত স্বপ্ন দেখি তা না। জেগে থেকে আরো বীভৎস্য সব দৃশ্য মনশ্চক্ষে দেখি।

যেমন?

যেমন ধর, তুই একটা পরকীয়া করিস। কত আনন্দে তুই মেতে আছিস। তোর স্বামীর থেকে প্রাপ্তিতে যেটুকু অপূর্ণতা তা সব পূর্ণ করে দিচ্ছে তোর চ্যাংড়া প্রেমিক। তোর স্বামী এটা বুঝেও বুঝছে না কারণ বুঝতে গেলেই যত ঝামেলা। তবু আমার মনে হয় তোর স্বামী এটা বেশিদিন এভাবে সহ্য করবে না। তোকে কোনো সাংঘাতিক শাস্তি ও দেবে।

কী করবে ও? তোর কি মনে হয় যে ও আমাকে মেরে ফেলবে?

তার চেয়েও খারাপ কিছু।

মরণের চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে জীবনে?

মৃত্যুর চেয়ে বীভৎস্য অনেক কিছু আমাদের জীবনে ঘটতে পারে, ঘটে থাকে। মৃত্যু আমাদের জীবনের চূড়ান্ত পরিণতি কিন্তু কষ্টের চূড়ান্ত না। মৃত্যুর অধিক কষ্টের বহু ব্যাপার আমাদের জীবনে থাকে।

তুই কি মানসিক কষ্টের কথা বলছিস?

মানসিক ও শারীরিক উভয়ই। তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলা মনের কষ্টের অসহনীয়তায় মৃত্যু কাম্য বোধ হয়। আবার দুঃসহ শারীরিক কষ্ট, যার ভয়াবহতার তীব্রতম কল্পনা দিয়ে আমরা নরক সাজিয়েছি, তাতেও মৃত্যু আকাঙ্ক্ষিত মনে হয়। তবে যদি এমন হয় যে ভয়ংকর কোনো শারীরিক কষ্ট, অথচ তা ঝটপট মৃত্য ডেকে আনছে না, যে কষ্টের মৃত্যু নেই কিন্তু যা তোকে মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে দিয়ে এমন করে লটকে রাখছে যে তুই শুধুই ভেতরে উঁকি দিচ্ছিস, প্রবেশ করতে পারছিস না, ফিরে আসাও যাচ্ছে না, তা কি মৃত্যুর চেয়েও বীভৎস্য নয়?

হু, কিন্তু ওটা ওপারের আজাবের বর্ণনা ও বিশ্বাস। ইহকালে এমন কোনো কষ্ট আমাদের নেই যা অনিঃশেষ। পার্থিব জীবনে সব কষ্টই একদিন শেষ হয় রুনু, কারণ মৃত্যু একদিন সব শেষ করে। এ জীবনের কোন কষ্ট নিয়ে তাই অত ভয় করার হেতু নেই।

ভয় না করলে চালিয়ে যা। কিন্তু...

কোনো কিন্তু নেই রুনু। কাদের আমার দিনগুলোকে কারাগার আর রাতগুলোকে ধু-ধু প্রান্তরময় মরুভূমি বানিয়ে দিয়েছে। আমার জীবনের সব দৃশ্যমান দিন-রাত কেবল এক লাখ এক টাকার বিনিময়ে পনেরো বছর আগে সে কিনে নিয়েছে। কিন্তু আমার অদৃশ্য দিন-রাত তো ও কিনতে পারে না। যা আমার একান্ত রচনা তাতে ওর কী দাবি থাকতে পারে? আর আমার একটু সুখের খবর যদি সে জেনেই ফেলে, আমার একটা দখিনা জানালা যদি তার চোখে পড়েই যায় তবে তাতে এত হিংসা জাগার কী আছে?

বিবাহিত জীবনে কাবিননামায় লেখা স্থূল চুক্তির বাইরে আর কি কিছু চুক্তি থাকে না রে? যা মুখে বলা হয় বা লেখা হয়, তাই কি সব? কোন নীতি নৈতিকতার দায় কি এখানে নেই?

নীতি-নৈতিকতা তো সব সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপার। আমার সমাজ আমাকে বলছে স্বামীর অনুগত থাকতে, তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে। এ বিশ্বস্ততা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক। কাবিননামার কোথাও এই আনুগত্যের বাণী লেখা নেই।

তা হয়তো নেই। কিন্তু লেখা না থাকলেই কি যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার থাকে?

অলিখিত শর্ত তখনই প্রতিপালন সম্ভব যখন মনের সাথে মনের সুসংযোগ থাকে। সংযোগ কেটে গেলে কী লিখিত, কি অলিখিত, সব চুক্তিই ব্যর্থ হয়, হতে বাধ্য হয়।

তোর কথা ঠিক ধরলে আরিফের যথেচ্ছাচারকে দোষ দেয়া চলে না। আমাদের তো কোনোকালেই সেরকম কোনো মানসিক সংযোগ গড়ে ওঠেনি।

আমি তো এজন্যই আরিফ ভাইকে কোনো দোষ দেই না। স্বভাবে-ভাবনায় তোরা দুজন দুই মেরুর মানুষ। কেন যে ওভাবে হুট করে ঘর বাঁধতে গিয়েছিলি!

তুই তো হুট করে ঘর বাঁধিসনি। শাকে পোকা বাছার মতো বাছাই করে তোর পাত্র দেখা হয়েছিল। ভালো ঘর, ভালো বর দেখেই তোর বিয়ে হয়েছিল। তোর এমন হলো কেন রে?

কেন যে এমন হয় তা আসলে কেউই ঠিকমত বলতে পারে না। সম্পর্ক নষ্টের কারণ কেউই ঠিকঠাক জানে না রে। শুধু একটু একটু করে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে হঠাৎ একদিন অনুভব করা যায় যে মাঝখানের শূন্যতায় কখন যেন একটা নোংরা জলবাহী এবড়ো-খেবড়ো খাল গজিয়ে গিয়েছে। সে খালের প্রশস্ততা এমন যা এক লাফে পার হওয়া যায় না। আবার সে খাল পেরোবার কোনো উপযুক্ত বাহনও মেলে না। গায়ে নোংরা মাখামাখির ভয়ে কোনো পক্ষই আর সে খালে নামার ভরসা করে না। তারচেয়ে যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলতে থাকে, মানে দূরত্ব আরো বেড়ে চলে।

এই দূরত্বের শেষ তাহলে বিচ্ছিন্নতায়?

স্বার্থপর চরমপন্থি হলে তাই। কিন্তু একটু উদার ও সহনশীল হলে, মানে সমাজ-সংসার-সন্তান—এদের ভাবনা ভাবলে...

তোর ঐ আমরা-আমরা, তোমরা-তোমরা তো? ছিঃ!

ছিঃ কেন রে? তুই না লেখক? লেখকদের অত ট্যাবু, অত রক্ষণশীলতা কি মানায়?

লেখক হওয়া মানেই বুঝি বেলেল্লাপনার সাপোর্টার হওয়া?

কাকে তুই বেলেল্লাপনা বলছিস? মানুষের শরীর-মনের মৌলিক দাবি মেটানো বেলেল্লাপনা? অসুখী জীবনে কিছু গোপন সুখের ব্যবস্থা করা বেলেল্লাপনা? তুই সাহিত্যিক হয়ে এ কথা বলছিস!

তোদের কি ধারণা কবি-সাহিত্যিক মানে ফ্রিসেক্সে বিশ্বাসী একদল নির্লজ্জ্ব আত্মম্ভরী?

তা কেন? আর ফ্রি সেক্সের কথাই-বা এখানে কেন? একজন একান্ত মনের মানুষ থাকা আর ফ্রি সেক্স কি এক হলো?

তা হয়তো নয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন এই ‘একান্ত মনের মানুষ’টাকে নিয়ে। নিজের সংসার বজায় রেখে অন্যকে সুখী যারা করতে পারে তাদের নিজের ঘরে সুখ বজায় থাকে না কেন? আর যাকে খুশি করা যায়, যার মাঝে নিজের সুখ আবিষ্কার করা যায় তাকে নিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধতে সামাজিক বাঁধাটা কোথায়? সমাজ তো অপরিবর্তনশীল নয়। আর আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনেও এতে কোনো বাঁধা নেই, তাহলে?

তাহলেটা তুইও জানিস। আইনের সব পথই কানাগলিতে ভরা। এসব পথ ধরে সোজা হাঁটতে গেলে ঠিকই কোথাও আটকাতে হয়। তখন আইনকে পাশ কাটানো ছাড়া অন্য গতি থাকে না। খুব তো বলছিস নতুন করে ঘর বাঁধার কথা—এক কাপড়ের ফকিন্নি হলে কাজটা হয়তো সহজ, তাই হয়তো নিম্নবিত্তের মাঝে সংসার ভাঙ্গা-গড়া অনেকটা ডালভাত টাইপ ব্যাপার; কিন্তু আমাদের এই ছিঁচকাঁদুনে উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্তের পক্ষে ও কাজ এত সহজ না। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভাবনা তো আছেই, তারচেয়ে বেশি আছে সন্তানের স্বার্থ ও মঙ্গলভাবনা।

আমার কী মনে হয় জানিস? এসবের চেয়েও বেশি আছে অবিশ্বাস আর ভয়। যতই ‘মনের মানুষ’ বলিস, ততক্ষণই সে মনের মতো যতক্ষণ তার সাথে জাগতিক স্বার্থের গাঁটছড়া প্রকাশ্যে কষে বাঁধা না হচ্ছে। যখনই কষাকষি, আঁটাআঁটি, তখনই সম্পর্কের নীরব মৃত্যুর সূচনা।

এটা কিন্তু তুই মন্দ বলিসনি। তবে আরেকটা ব্যাপারও আছে। সম্পর্কগুলো কেচে যায় আসলে একঘেঁয়েমির দরুণ। ধনীরা তাই পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাঝেই স্বাদ বদল করে নেয় মাঝেসাজে। আমরা ভন্ড তো, তাই ঢাকা ক্লাবে গাড়ির চাবি বদলাবদলির গল্পে হাসাহাসি করি।

তার মানে তুই বহুগামিতাকে সাপোর্ট করিস!

আকাশ থেকে পড়লি মনে হয়! অধিকাংশ জীবই জন্মগতভাবে বহুগামী। মানুষের মাঝে এ ইন্সটিংক্ট অন্য প্রাণীদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং বেশি। পার্থক্য হচ্ছে মানুষ আবার জন্মগতভাবে পরশ্রীকাতর হওয়ায় অন্যের বহুগামিতাকে সহ্য করতে পারে না। ফলে অন্যের উপভোগের সুযোগকে নানা কানুনের ছকে ফেলে সঙ্কুচিত করে আত্মপ্রসাদ লাভ করে এই ভেবে, যাক, মানবজাতির মঙ্গলের জন্য সঙ্গত ও সুসংহত জীবনবিধান প্রণয়ন করা গেল। কিন্তু নিজের বেলায় উপভোগের দ্বার যে কত অবারিত মহাপুরুষদের জীবনী অনুসন্ধান করলেই তা জানতে পারবি।

জানি ওসব। তোর কি ধারণা যে আমি ঘাসখাওয়া গোত্রের লেখক? বাপের নাম লিখতে শিখেই লেখক হতে উঠে পড়ে লেগেছি?

না রে। তোর যে বেশ পড়াশুনার অভ্যাস আছে তা কি আর আমি জানি না? তবে তোর লেখা পড়ে আমার মনে হয় যে তুই খুব প্রগতিতাড়িত অথচ রক্ষণশীল মনোভাবের। লেখক তার মনোভঙ্গির খুব বেশি উপরে কিন্তু উঠতে পারে না। আমি তাই বলি কী, লেখালেখির বিষয়ে তুই আমার থেকে কিছু টিপস নিতে পারিস।

যেমন?

যেমন ধর তুই মনে রাখবি যে তুই একজন লেখক। জমিজমার দলিল লেখক নয়, তবে কালের দলিল লেখক তো বটেই। আর কালকে নির্মোহভাবে লেখা মানে ফোটোগ্রাফির মতো করে অঙ্কন করাই তোর কাজ। শৈল্পিক ফোটোগ্রাফিতে যতটুকু আলোছায়ার কাজ চলে, সাহিত্যে শিল্প সৃষ্টির জন্য তোর রঙ মাখানোর স্বাধীনতা ততটুকুই। এখানে কোনো মতাদর্শ বা ভাবের আবেগ না থাকাই ভালো। মনে রাখবি, তুই সাহিত্যিক, কোনো ধর্ম বা মতের প্রচারক নস।

তার মানে কোনো মতাদর্শী মানুষ সার্থক সাহিত্যিক হয় না?

হয়তো হয়। তবে তা ঐ মত যতদিন জগতে টিকে থাকে তত দিনের জন্য।

মত ছাড়া কোনো মানুষ হয়?

হবে না কেন? দলিল লেখককে তো তাই হতে হয়।

দলিল তো সাংবাদিকরা রোজই লিখছে। পত্রিকার পাতা খুললেই কতগুলো খুন, ধর্ষণ, রাজনৈতিক অনাচার, দুর্নীতি... আর শুধু কাগুজে পত্রিকায় নয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও খবর ও তথ্যের ছড়াছড়ি।

সেসব ড্রয়িং রে রুনু, আর্ট নয়। সাহিত্যিকের কাজ সাদামাটা উপাদানে সৌন্দর্যের মসলা মেখে শিল্প সৃষ্টি।

মনে মনে বলি, ঐ মসলাটাই মতো শামু। সাহিত্য রচনায় প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে কোনো না কোনো মত মিশে থাকেই। কিন্তু তুই তা বুঝবি না।

আমি আর শামীমার সাথে কোনো তর্কে জড়াই না। তার উপদেশে আমার লেখালিখির মানে কোনো তারতম্য হয় কি না জানি না, দুঃস্বপ্ন দেখায় কোনই তারতম্য ঘটে না। আমি আগের মতো বা আগের চেয়েও বেশি কুৎসিত স্বপ্ন দেখতে থাকি।

তাবিজ-কবজে ভরসা নেই, তাই ভাবলাম একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই।

মনোচিকিৎসক ডা. নাসিমুল গণি আমার কেসটা শুনতে শুনতে ভাবলেশহীন মুখে তার ঠিকানা-ঠিকুজি ছাপানো প্যাডে দুর্বোধ্য ইংরেজি নাকি ল্যাটিনে কী সব নোট নিলেন। একে বোধ হয় কেস হিস্ট্রি বলে। আমার বলা শেষ হলে আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম তার প্রতিক্রিয়ার। কিন্তু ঝাড়া দেড় মিনিট পেরিয়ে গেলেও তিনি মুখ তুললেন না, এমন কি মুখ খুললেনও না। কাগজটাতে আরো কত কী লিখে কলিং বেলের রিমোট টিপলেন। সুইং ডোর ঠেলে তার এটেনডেন্ট প্রবেশ করলো। তার হাতে কাগজটা ধরিয়ে মি. মনোচিকিৎসক বললেন, নেক্সট্। অমনি মায়াবতী মুখের অধিকারিনী এটেনডেন্ট তার বাঁ হাতের তিনটি আঙুলের তীক্ষ্ণ নখের অগ্রভাগ আমার বাহুতে আলতো ঠেকিয়ে বলল, চলুন। বিস্মিত আমি সম্মোহিতের মতো তার পিছুপিছু নাসিমুল গণির শীতল ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। ভাঁজপত্রের মতো একটি ফাইলে মনোচিকিৎসকের লেখা কাগজটি ঢুকিয়ে সুন্দরী আমার দিকে না তাকিয়েই বলে, ভিজিট প্লিজ।

আমি তার মুখে আমার বিস্মিত দৃষ্টি রেখে বলি, কিসের ভিজিট?

সুন্দরী ভ্রু কুঁচকে, চোখ বড় করে, মুখে কী এক ভাবের ঢেউ খেলিয়ে আমার চোখে সোজা চেয়ে বলে, ওয়ান থাউ ফর ফার্স্ট টাইম।

আমি বলি, জানি, কিন্তু আমি তো এখনো কোনো চিকিৎসা পাইনি।

আপনার চিকিৎসা সব এই ফাইলে আছে। ওষুধ যা সব লেখা হয়েছে তা ঠিকমতো খাবেন। অনিয়ম করবেন না।

আমার কী রোগ হয়েছে?

তেমন কিছু না। ওষুধগুলো খেলে আশা করি সেরে যাবে।

যদি না সারে?

অপরূপাদের ধৈর্য প্রেমীষুদের উমেদারি সামলাতে যত আর পাঁচ রকম সাধারণ কাজে তত নয় (আমি নিজে অপরূপা গোত্রীয় বলে আমার ধারণা। অগণিতসংখ্যক ইভটিজিং ও ডজন দেড়েক প্রেমীষুর কান্নাকাটি থেকে আমার এ ধারণার জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটেছে। যাহোক, ধৈর্য বিষয়ে আমি নিজেকে দিয়েই এখানে আর পাঁচজন অপরূপাকে বিচার করে বসেছি। এটা যদি অবিচার হয় তবে অপরূপাগণ ক্ষমা করবেন।) কাজেই এত অল্পেই তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, দয়া করে ভিজিটটা দেন। পাগলের ভান করবেন না। আপনি এখনো ফুল পাগল হননি।

আমার বিস্ময় এবার ভীতিতে রূপান্তরিত হয়। আমি বলি, ওষুধ খেলে কি তবে ফুল পাগল হব?

আগুনরঙা রূপবতী আমার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে কার দিকে চেয়ে কী ইঙ্গিত করে। অমনি দুজন ব্যায়ামবীর ডন দুপাশ থেকে এসে আমাকে চেপে দাঁড়ায়। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আমার হাতব্যাগ খুলে ভেতর থেকে ছোট্ট পার্সটা বের করে দুটো পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে ব্যাগটা আমাকে ফেরত দিয়ে বলে, সোজা সিঁড়ি বেয়ে নিচে যান। পাশের ফার্মেসিটা থেকে এই ওষুধগুলো কিনে নিয়ে বাসায় যেয়ে এক ডোজ খেয়ে ঘুম পাড়েন।

পাশের ফার্মেসি থেকে ওষুধ না কিনে আমি পাশের নর্দমায় প্রেসক্রিপশনটা ফেলে দেই।

এর পর আমি যাই সব মুশকিল আসানকারী মা হালিমা বরকতির ডেরায়।

মা হালিমা বরকতি খোরাশানপুরি চিতোরের রানির মতো তাকিয়া ঠেসান হয়ে বসেছিলেন। তার স্মিত হাসিমাখা মুখ আমাকে অনেকটা আশ্বস্ত করল। সামান্য বাংলার সাথে খানিকটা হিন্দি, অনেকটা উর্দু ও কিছু আরবি-ফারসি শব্দ মিশিয়ে তিনি যা বললেন তার বাংলা তরজমা মোটামুটি এরকম—

বেটি, তুমি আমাকে এতক্ষণ যা বললে তার সবটাই আমি মন দিয়ে শুনলাম। শুধু শুনলাম তাই না, তোমার এতক্ষণের কথা সব রেকর্ডও করা হলো। অবসর সময়ে আমি তোমাদের এসব রেকর্ড শুনি। কত মানুষের কত আশা, কত রকম নিরাশা। কত সামান্য কারণে তোমরা হতাশ, আবার কত অল্পেই না তুষ্ট! সমস্ত পৃথিবীকে শাসন করার খোয়াব দেখে যে যুদ্ধবাজ শাসক সেও একটা শিশুর আধো আধো বোলে মোহিত হয়। একরাতে সাতখুন করে ভরপেট বিরানি খেয়ে ঘুমাতে পারে যে খুনি সেও একটা ছোট্ট পাখির ডানা ভাঙ্গা দেখে কষ্ট বোধ করতে পারে। পুত্রের প্রেমিকাকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করাতে পারে যে বাদশাহ পিতা তিনিও কাঁদতেন শীতের সকালে স্নাত ঐরাবতের দেহে কম্পন দেখে। কত বৈচিত্র্যময় এ পৃথিবী! কত বিচিত্র এর মানুষেরা! আর কত অদ্ভুত তাদের চরিত্র! কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মাঝে একটি সাধারণ প্রবণতা থাকে, তা হলো—গড্ডলস্বভাব। জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে, কোনো মতে বা বিশ্বাসে তাদের এ স্বভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু এ গড্ডলিকা প্রবাহের মধ্যেই হঠাৎ ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে যায় এমন কোন সত্ত্বা যার থাকে নিজস্ব মত ও বিশ্বাস। বেটি, চেয়ে দেখ তোমার চোখের সমুখে কত কত মত ও পথের ছড়াছড়ি। সেসব মত-পথের যারা উদ্ভাবক তারা তা প্রকাশের অসীম তাড়নায় তাড়িত হয়ে সমসাময়িক কিছু মানুষকে তো বটেই, ভবিষ্যতের অগণিত মানবকূলকেও তাদের রচিত পথে তাড়িয়ে ফিরেছেন। তোমার মধ্যেও আমি এক তাড়নাকে দেখতে পাচ্ছি বেটি। কিন্তু আত্মপ্রকাশে কেন এত দোলাচল?

আপনি ভুল বুঝছেন মা, আমি কোন নতুন ধর্ম বা রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার করার তাড়নায় ভুগছি না। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি, দুর্নীতি-অনীতি-কুনীতি কিছু নিয়েই আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি শুধু...

বুঝেছি বেটি। তোর চোখ দেখেই আমি সব বুঝেছি। তোর চোখে আমি যে ঘন হতাশার ছায়া দেখতে পাচ্ছি তার তলায় চাপা পড়ে আছে অসীম আশাবাদ। বেটি, তুই শুধু ঐ ছায়াটাকে সরিয়ে ফেল।

কায়াকে না সরালে ছায়া কী করে সরবে মা? হতাশার কায়া যে আমার অন্তরকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে রেখেছে।

আলোতে উন্মুক্ত হ বেটি, আলোতে স্নান কর। একমাত্র আলোই পারে ছায়াকে তাড়িয়ে দিতে।

সেই আলো আমি কোথায় পাবো মা? চারিধারে যে অন্ধকার কেবলই বেড়ে চলছে।

আলো যে নিজেই জ্বালতে হয় বেটি। আপন অন্তরের আলো কি আর কেউ জ্বালতে পারে?

আমার একার আলোতে কী হবে? আঁধারবাসী জীবেরা কি আমার আলো জ্বলতে দেবে?

আন্ধার কখনো আলো খেতে পারে না, আলোই আন্ধার গিলে ফেলে। তোমার আলো যেমন তোমার চারপাশকে আলোকিত করতে পারে, তেমনি পারে অপরে আলো জ্বালিয়ে দিতে।

কী দিয়ে আমি জ্বালবো আলো? কোথায় সে চকমকি?

খোঁজ কর বেটি, খোঁজ কর। অন্তরের মাঝেই তারে খুঁজে ফের।

আমি চকমকি খুঁজি। পাই না। মনে হয় আমার চকমকি হারিয়ে গেছে। আমি কাঁদতে থাকি। কাঁদতে কাঁদতে আঁধারে হাতড়ে হাতড়ে পথ চলি। চলতে চলতে আমি একসময় আর কার যেন কান্না শুনতে পাই। কান্নাটা আমার নিকটবর্তী হতে থাকে আর তার বেগও বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে আরো অনেক কণ্ঠের কান্নার ধ্বনি যুক্ত হয়। আমরা তখন কোরাসে কাঁদি। আমরা কাঁদি আমাদের চকমকির জন্য। যে চকমকিটা জন্মসূত্রে আমাদের অন্তরের কুঠুরিতে ছিলো, কিন্তু কখন যে তা হারিয়ে গেছে বা চুরি হয়েছে তা আমরা নিজেরাই জানি না।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সর্বাধিক পঠিত
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন