X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১
সাদত হাসান মান্টোর ‘শিকারি আওরত’ থেকে

সাড়ে তিন আনা

অনুবাদ : দিলওয়ার হাসান
২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৫:১৬আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৫:১৬

খুনটা কেন করলাম? রক্তে কেন হাত রাঙাতে হলো? সে এক দীর্ঘ গল্প। ব্যাপারটা খোলাসা করে না বললে আপনি বুঝবেন না। এই কাজ না করা পর্যন্ত আলোচনাটা অপরাধ ও শাস্তির পর্যায়েই থেকে যাবে। মানুষ থাকলে কারাগারও থাকবে। কারণ আমি নিজেই কারাগারে বাস করি। আমার কথা ভুল হতে পারে না।

মান্টো সাহেবের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত—কারাগার কোনো মানুষকে সংশোধন করতে পারে না। এই সত্যি কথাটা এত বেশি বলা হয়েছে যে, এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করাটা এখন ক্লান্তিকর ঠাট্টার মতো শোনাবে—সহস্রবার বলা হয়েছে এসব কথা। আর এসব কোনো ঠাট্টাও নয় আসলে, যদিও আমরা এর ভেতরকার বাস্তবতাটাকে উপলব্ধি করতে পারি, এখনো হাজার হাজার কারাগারের অস্তিত্ব রয়েছে। হাতকড়া, শেকল—এ সবই আইনের বন্ধন।

রিজভি হাসল আমার দিকে তাকিয়ে। তার মোটা, কালো ঠোঁট অদ্ভুতভাবে কেঁপে কেঁপে উঠল। খুনির চোখের মতো ঝলক দিয়ে উঠল তার ছোট ছোট দুটি চোখ। সে যখন হঠাৎ আমাদের আলোচনায় সামিল হলো চমকে উঠলাম আমরা। আমাদের পাশেই একটা চেয়ারে বসে সে ক্রিম দেওয়া কফি পান করছিল। সে যখন নিজের পরিচয় দিচ্ছিল তার সব অপরাধ ও বিচারের কথা মনে পড়ে গেল আমাদের। স্মরণ করতে পারলাম রাজসাক্ষী হয়ে সে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে নিজেকে ও তার বন্ধুদের বাঁচিয়েছে। আর এখন বসে আছে আমাদের সামনে। আজই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। খুব কোমল স্বরে সে আমাকে বলল, ‘মাফ করবেন মান্টো সাহেব, আপনারা নিজেদের মধ্যে যে-কথাবার্তা বলছিলেন তা শোনার খুব আগ্রহ আমার। আমি লেখক নই, তবে আমার ভাঙা ভাঙা ভাষায় এই বিষয়ে কিছু বলতে পারব।’ তারপর যোগ করল, ‘আমার নাম সিদ্দিক রিজভি। লিন্ডা বাজারে যে-খুনের ঘটনাটি ঘটেছিল তার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।’

খুনের ওই ঘটনার খোঁজ খবর রাখছিলাম না আমি। রিজভি নিজের পরিচয় দিলে খবরের কাগজের শিরোনামগুলো মনে পড়ে গেল।

রিজভি আমাদের কথার মাঝখানে যখন ঢুকে পড়েছিল তখন আমরা আলোচনা করছিলাম—কারাগার কি কোনো অপরাধীকে সংশাধন করতে পারে? আমার ভেতর তখন এমন এক অনুভব কাজ করছিল মনে হচ্ছিল টক হয়ে যাওয়া বাসি রুটি চিবুচ্ছি। রিজভি যখন বলল, এই বাস্তবতা প্রায়শই উচ্চারিত হয়, একটা ক্লান্ত ঠাট্টার মনে আলোকপাত করা হয়—তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলাম। আমার মনে যা ছিল ঠিক তা-ই সে বলেছে।

এক চুমুকে ক্রিম-কফি শেষ করে কুতকুতে চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল রিজভি। বলল, ‘মান্টো সাহেব আমাকে বলতে পারেন কেন একজন মানুষ অপরাধ করে?... অপরাধ ব্যাপারটা আসলে কী?... শাস্তি জিনিসটা কী? —বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার ধারণা প্রতিটি অপরাধের পেছনেই একটা ইতিহাস থাকে—একজন মানুষের অভিজ্ঞতার একটা বড় অংশ, হতে পারে তা; খুব ভালো, কিংবা প্যাঁচানো। মনোবিজ্ঞানে আমার কোনো ডিগ্রি নেই, তার একথা আমি নিশ্চিতভাবেই জানি কোনো মানুষ নিজে নিজে কোনো অপরাধ করে না, পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে।’

নাসির বলল, ‘একেবারে ঠিক কথা বলেছ তুমি।’ আর এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে রিজভি নাসিরকে বলল, ‘এসবের আমি কী-ইবা জানি, যা বললাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বললাম। খুবই পুরনো একটা বিষয়। ধারণা করি ভিক্টোর হুগো... ফরাসি দেশের লেখক, ঔপন্যাসিক, অন্য দেশেরও হতে পারে, নিশ্চয়ই জানা আছে আপনার—অপরাধ ও শাস্তি বিষয়ে অনেক লেখা আছে তাঁর। একটা বইয়ের কটা বাক্য মনে পড়ছে আমার।’ কথার এই পর্যায়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মান্টো সাহেব, ওটা তো আপনারই করা অনুবাদ। তাই না? মই সরিয়ে দেওয়া হলে একজন মানুষ অপরাধ ও দুর্ভাগ্যের কবলে পড়ে যায়।’ তখনই আমি ভাবলাম, কোন মই ছিল ওটা? কতগুলো ধাপ ছিল তাতে?

‘বিষয়টা যা-ই হোক না কেন, এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত করেই বলা যায় : এই মইয়ের অস্তিত্ব নিশ্চয়ই আছে, আছে ধাপগুলোও। যতদূর বলা যায় অনেকগুলো ধাপ সেখানে আছে। এসব গণনা করা এর সংখ্যা বের করাটা বড় এক কৃতিত্ব। মান্টো সাহেব, সরকার মানুষের মতামতের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে, সংখ্যার হিসাব রাখে, সবকিছু নথিবদ্ধ করে। কিন্তু তারা কেন ওই মইয়ের ধাপ গণনা করে না? এটাও কি তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? আমি খুন করেছি... কিন্তু একজন খুনি হতে ওই মইয়ের কটা ধাপ আমাকে পেরুতে হয়েছে? সরকার আমাকে অব্যাহতি দিয়ে রাজসাক্ষী করেছে... এটা করা হয়েছে কারণ ওই ঘটনার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে : আমার পাপের জন্যে কার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব? যে পরিস্থিতি আমাকে খুনের পথে ঠেলে দিয়েছে তা এখন অনেক আগের ঘটনা, একটা পুরো বছর আমি সবকিছু থেকে দূরে। এখন কি আমি ওই অতিক্রান্ত সময়ের দোহাই পারব আর আমার পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করব, কিংবা ওই পরিস্থিতি যা আমার সামনে দণ্ডায়মান—ঠাট্টায় ফেটে পড়ছে?’

আমরা সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে রিজভির কথা শুনছিলাম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার নেই বলেই মনে হলো, কিন্তু তার কথাবার্তা থেকে বোঝা যায় পড়াশোনা তার ভালো আর সবকিছু গুছিয়ে সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে পারে। আমার তরফ থেকে কিছু বলতে পারতাম; কিন্তু চাইছিলাম সে তার কথা ভালো মতো বলুক। ফলে তার কথার মধ্যে কথা বললাম না।

তরতাজা আর গরম আর এক কাপ কফি পরিবেশিত হলো। কয়েক চুমুক খেয়ে সে বলতে লাগল, ‘আল্লাহ জানেন কী আবোল তাবোল আমি বকে চলেছি। তবে একজনের কথা জীবনেও ভুলতে পারব না... একজন ভাঙ্গি (অচ্ছ্যুত সুইপার শ্রেণির মানুষ) জেলে ছিল আমাদের সঙ্গে। মাত্র সাড়ে তিন আনা পয়সা চুরির দায়ে এক বছরের কারদণ্ড হয়েছিল তার।’

নাসির অবাক হয়ে বলল, ‘মাত্র সাড়ে তিন আনা?’

‘জি জনাব, মাত্র সাড়ে তিন আনা।’ রিজভি বলল। কণ্ঠ তার বরফ-শীতল। ‘তার দুর্ভাগ্য, ধরা পড়ে গিয়েছিল সে। তবে ওই সামান্য পয়সা সরকারের কোষাগারে নিরাপদে থাকলেও ফাগগু ভাঙ্গি কিন্তু নিরাপদে নেই। হয়তো আবার ধরা পড়বে সে। তার ক্ষুধা তাকে আবার চুরি করতে বাধ্য করবে। হয়তো যারা তাকে দিয়ে তাদের গু-মুত সাফ করায় তারা তাকে তার ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করবে। হয়তো ওই লোকগুলি তাদের নিজেদের রুটিরুজির ব্যবস্থা করতে পারবে না। হয়তো-বা এই বৃত্তগুলো অদ্ভুত মান্টো সাহেব। বিশ্বাস করুন এই দুনিয়াতে কী-না-ঘটতে পারে... রিজভি স্বয়ং খুন করতে পারে।’

থামল সে। নাসির জিজ্ঞেস করল, ‘ফাগগু ভাঙ্গির কথা বলছ, তাই না?’

নিজের সরু গোঁফে লেগে থাকা কফি রুমাল দিয়ে মুছে রিজভি বলল, “জি, হ্যাঁ। আইনের চোখে সে চোর হলেও আমার কাছে সে একজন সৎ লোক। আল্লাহর কসম করে বলছি তার মতো সৎলোক আমি জীবনেও দেখিনি। এ কথা সত্যি সে সাড়ে তিন আনা পয়সা চুরি করেছে। সে আদালত কে পরিষ্কার জানিয়েছে: ‘হ্যাঁ আমি চুরি করেছি। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাই না। আমি গত দুদিনে খাইনি। ক্ষুধা আমাকে করিম খলিফার পকেটে হাত ঢোকাতে বাধ্য করেছে। তার কাছে দুমাসের বেতন বাবদ আমার পাঁচ টাকা পাওনা। কিন্তু তাকে দোষ দেবো না। হয়তো তার খদ্দেররা তার পাওনা মেটায়নি। হুজুর, এর আগেও চুরি করেছি আমি। একবার এক মেম সাহেবের ব্যাগ থেকে দশ টাকা গাপ করে দিয়েছিলাম। তখন এক মাসের জেল হয়েছিল। হুজুর, একদিন এক ডেপুটি সাহেবের বাসা থেকে একটা রুপোর খেলনা চুরি করেছিলাম, কারণ? আমার ছেলের নিউমোনিয়া হয়েছিল। ডাক্তার খুব বড় অংকের ফি চেয়েছিল। মিথ্যা বলছি না হুজুর। আমি চোর না। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল—চুরি না-করে কোনো উপায় ছিল না। ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। আমার চেয়েও অনেক বড় বড় চোর আছে হুজুর। আমার কোনো সন্তান সন্ততি নেই। আমার বউটাও মারা গেছে। তবে দুর্ভাগ্যবশত হুজুর আমার একটা পেট আছে। এই পেটটার মরণ হলে আমার সব দুঃখ-দুর্দশা ঘুঁচে যাবে। আমাকে ক্ষমা করবেন জনাব।’ কিন্তু হুজুর তাকে ক্ষমা করেননি, চোর সাব্যস্ত করে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল।”

ঘরোয়া পরিবেশে লোকে যেমন করে কথা বলে রিজভিও তা-ই করছিল। তার কথাবার্তায় ভান ছিল না। খুব স্বচ্ছন্দে কথাগুলো বেরিয়ে আসছিল তার মুখ থেকে। আমি সিগারেট খেতে খেতে খুব নীরবে তার কথা শুনছিলাম। নাসির আবার তাকে জিজ্ঞেস করল ‘ফাগগুর সততার কথা বলছিলে না তুমি?’ পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরিয়ে সে বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘আমি জানি না আইনের চোখে সততা কথাটার কী মানে। তবে আমি যা জানি তাহলো আমি সততার সঙ্গে খুন করেছি... আমার ধারণা ফাগগু পরিপূর্ণ সততার সঙ্গেই সাড়ে তিন আনা পয়সা চুরি করেছে।

আমি বুঝি না লোকে কেন সততার সঙ্গে দয়া ও মহত্ত্বকে জড়িয়ে ফেলে। সত্যি কথা বলতে কী আমি এখন প্রশ্ন তুলতে চাই—ভালো জিনিসটা আসলে কী, মন্দই-বা কী? কোন্ জিনিস আপনার জন্যে ভালো হতে পারে কোন্ জিনিস মন্দ। কোন্ জিনিস একটা সমাজের জন্য ভালো হতে পারে আর খারাপ হতে পারে অন্য এক সমাজের জন্য—আমাদের মুসলমানরা বগলে লোম গজাতে দেওয়াটাকে বড় একটা পাপ বলে গণ্য করে, শিখরা এটাকে কিছুই মনে করে না। এই লোম গজানোর ব্যাপারটা যদি এতই পাপকর্ম হয় তাহলে আল্লাহ্ কেন তাদের শাস্তি দেন না? আর যদি আল্লাহ্ বলে কেউ থেকে থাকেন তাকে অনুরোধ করব আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষের তৈরি ওইসব আইন ভেঙে ফেলুন। ভেঙে ফেলুন মনুষ্য তৈরি সব কারাগার।... আসমানে তিনি তাঁর নিজস্ব কারাগার নির্মাণ করতে পারেন। আল্লাহতালাহ্ তাঁর আদালতে মানুষকে শাস্তি দিন... কিছুই যদি না করা যায়, বিচারটা যেন তাঁর উপস্থিতিতে হয়।’

রিজভির বক্তব্যে আমি গভীরভাবে প্রভাবিত হলাম। তার দ্বিধাহীন ও স্পষ্ট ভাষণ আমার অন্তরে গেঁথে গেল। তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, আমাদের উদ্দেশে কিছু বলছে না, কথা বলছে নিজের সঙ্গে। তার বিড়িটা নিভে গেছে। মনে হচ্ছে তামাকের ফাঁস তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। পাঁচ-ছ বার চেষ্টা করল বিড়িটা ধরাতে। পারল না। ফেলে দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মান্টো সাহেব, ফাগগুকে আমি সারা জীবন মনে রাখব। আপনি ভাবতে পারেন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি আমি। আল্লাহর কসম আবেগের কোনো স্থান এখানে নেই। আমার বন্ধু ছিল না সে না। সে ছিলো...। বারবার সে তা প্রমাণ করেছে।’

রিজভি আরও একটা বিড়ি বের করল পকেট থেকে, কিন্তু বিড়িটা ভেঙে গিয়েছিল। তাকে একটা সিগারেট দিলে সে বলল, ‘ধন্যবাদ, মান্টো সাহেব। আমি সারাক্ষণ বকবক করে চলেছি। আমার উচিত হচ্ছে না। তারপরও আপনি মাশাল্লা মন দিয়ে—’

কথা সংক্ষেপ করতে আমি বললাম, ‘রিজভি সাহেব, এখন আমি মান্টো নই... শুধু সাদত হাসান। আপনি বলে যান, আগ্রহের সঙ্গে শুনছি আপনার কথা।’

রিজভি মুচকি হাসল একটুখানি। তার ঢুলুঢুলু চোখে আলোর ঝলকানি। বলল, ‘আপনি খুব উদার মান্টো সাহেব।’ তারপর নাসিরের দিকে ফিরে বলল, ‘কী যেন বলছিলাম?’

আমি তাকে মনে করিয়ে দিতে বললাম, ‘ফাগগুর সততা সম্পর্কে কিছু একটা বলতে চাইছিলেন।’

‘ও, হ্যাঁ’ আমি যে সিগারেটটা দিয়েছিলাম সেটা ধরিয়ে বলল সে, “আইনের চোখে সে ছিল একজন অভ্যস্ত চোর। একবার বিড়ি কেনার জন্য আটআনা পয়সা চুরি করেছিল। দেয়াল টপকে পালানোর সময় গোড়ালি ভেঙে গিয়েছিল তার। এক বছর ধরে তার পায়ের চিকিৎসা হয়েছিল। তবে স্যার, জেলে থাকার সময় জারজি প্রতিবার গোটা বিশেক করে বিড়ি সবার মধ্যে বিলিয়ে দিত পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে। আমিও একটা পেতাম। যদিও কারাগারের সব বন্দিদের ওপর কড়া নজর রাখা হতো বিশেষ করে যারা রাজসাক্ষী ছিল, আমার রাজসাক্ষী জারজি ফাগগুর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল আর তাকে নিজেদের আস্থার ভেতরে নিতে পেরেছিল। সে ভাঙ্গি হলেও তার চরিত্র ছিল মাধুর্যমণ্ডিত। প্রথম দিকে সে যখন জারজির কাছ থেকে বিড়ি আনত, আমি ভেবেছিলাম এই বেজন্মা চোরটা নিশ্চয়ই কাওকে কুন্নি-টুন্নি মেরেছিল। কিন্তু পরে আমি আবিষ্কার করেছিলাম সে ছিল খুবই সৎ একজন মানুষ। বিড়ি কেনার জন্য আনা আষ্টেক পয়সা চুরি করতে গিয়ে পা ভেঙেছিল তার, আর জেলে তার তামাকটামাক জোগাড়ের কোনো উপায় না থাকা সত্ত্বেও জারজির পাঠানো বিড়ি সে নিয়ে এসেছিলো। মনে হয়েছিল, ওগুলো যেন আমার হিরে-জহরত। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলেছিল, ‘বাবুজি আমারে অন্তত একটা বিড়ি দিয়েন।’ আর আমি তাকে কেবল একটা বিড়িই দিয়েছিলাম... মানুষ এমনই বজ্জাত, পাজি আর হারামজাদা।”

রিজভি এমনভাবে মাথা ঝাঁকাল, মনে হলো নিজের ওপর সে মহাবিরক্ত।

“আগেই বলেছি আপনাদেরকে—নানা রকমের বাধ্যবাধকতা ছিল আমার ওপর। রাজসাক্ষীদের বেলায় সাধারণত এমনই হয়। আমার তুলনায় জারজি বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত। জীবনে অনেক ছাড় দিতে গিয়ে ঘুষের পথ বেছে নিতে হয়েছিল তাকে, ফলে সে চনমন ও উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। সে কাপড়-চোপড়, তেল-সাবান, বিড়ি এমনকি জেলের ভেতরে ঘুষ দেওয়ার জন্য নগদ টাকা পর্যন্ত পেত। ফাগ্লুর জেল খাটার মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র কটা দিন আগে শেষ বারের মতো সে আমার কাছে বিড়ি পাঠিয়েছিল। সে ধন্যবাদ জানিয়েছিল আমাকে। নিজের মুক্তির ব্যাপারে সুখি ছিল না লোকটা। তাকে অভিনন্দন জানালে বলেছিল, ‘বাবুজি, খুব শিগগিরই এখানে ফিরে আসব আমি। ক্ষুধার্ত একজন মানুষের জন্য আর কোনো পথ খোলা নেই। ঠিক ক্ষুধার অন্নের মতো। বাবুজি, খুব ভালো একজন মানুষ আপনি। আমাকে অনেক বিড়ি দিয়েছিলেন। দোয়া করি আপনি ও আমার সব বন্ধু যে ছাড়া পান।”

‘আর মাত্র সাড়ে তিন আনা পয়সা চুরি করার দায়ে কারারুদ্ধ হয়েছিল সে।’ নাসির আপন মনে বলল।

রিজভি গরম কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, মাত্র সাড়ে তিন আনা পয়সা চুরির জন্য। আর ওই পয়সা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমাও দেওয়া হয়েছে। কেবল আল্লাহ্ তালাই জানেন কোন্ খিদের আগুন তা নির্বাপিত করতে পারে...’

সে আর এক চুমুক কফি পান করে বলল, “মান্টো সাহেব, তার ছাড়া পাওয়ার আর মাত্র একদিন বাকি। আমার দশটা টাকার খুব প্রয়োজন... জেলের একজন সেন্ট্রিকে ঘুষ দেওয়ার জন্য টাকাটা লাগবে। বিস্তারিত বলতে চাইনে। অনেক কষ্ট করে কাগজ আর পেন্সিল জোগাড় করে জারজিকে একটা চিঠি লিখে দশটা টাকা চেয়েছি। ফাগগুর মাধ্যমে পাঠিয়েছি চিঠিটা। ফাগগু লোখাপড়া জানে না। আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করে জারজির লেখা চিঠিটা আমাকে পৌঁছে দিয়েছে। এর ভেতরে ঢোকানো ছিল চকচকে পাকিস্তানি একটা দশ টাকার নোট। চিঠিটাতে লেখা ছিল :

‘প্রিয় বন্ধু রিজভি,

একজন চোরের মাধ্যমে তোমাকে দশ টাকা পাঠাচ্ছি। আশা করি শিগগিরই হাতে পাবে, কারণ কালই ছাড়া পাচ্ছে সে।...’

চিঠিটা পড়ে ফাগগুর দিকে তাকিয়ে একটুখানি হেসেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম: মাত্র সাড়ে তিন আনা চুরি করার জন্যে তার এক বছরের সাজা হয়েছিল। দশ টাকা চুরি করলে কতো বছরের কারাদণ্ড হতো তার?”

রিজভি কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কোনো কথা না বলে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
জাহাজেই দেশে ফিরবেন এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক
জাহাজেই দেশে ফিরবেন এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা, টানা ৪ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা, টানা ৪ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট