X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
হারুকি মুরাকামির গল্প

শূন্য কামরায় একাকী একটি ইস্ত্রির চিত্র

অনুবাদ : সাজিদ উল হক আবির
১৮ নভেম্বর ২০২২, ১৪:০৩আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২২, ১৮:৫০

ফোনটা যখন বেজে উঠলো, জুনকো তখন টিভি দেখছিল। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। কেউসুকে কানে হেডফোন লাগিয়ে বসেছিল রুমের এক কোণায়, তার লম্বা আঙ্গুলগুলো ছুটে বেড়াচ্ছিল ইলেকট্রিক গিটারের ফ্রেডবোর্ড জুড়ে, মাথা দুলছিল ডানেবামে - গিটার বাদনের ছন্দে ছন্দে। খুব দ্রুতগতির এক গিটার পিস সে তোলার চেষ্টা করছিল নিজের গিটারে, কাজেই টেলিফোনের ক্রমাগত বেজে চলা নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না তার। ফলে জুনকো উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল।  

"ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম নাকি?" ওসাকার আঞ্চলিক টানমিশ্রিত মিয়াকোর পরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসে ফোনের ওপাশ থেকে।

"নাহ," জুনকো উত্তর দেয়। "জেগে আছি আমরা এখনো।"

"আমি এ মুহূর্তে সমুদ্রের তীরে। বসে বসে এতো পরিমাণে ভেসে আসা লাকড়ি জমিয়েছি যে দেখলে অবাক হয়ে যাবেন! এবার কাজটা অনেক বড় পরিসরে করা সম্ভব। একবার নেমে আসবেন?"

প্রথমে টাইটসের ফাঁকে পা গলিয়ে তার উপরে জিনসের প্যান্ট চাপিয়ে নেয় জুনকো। ওপরে একটা টারটল নেক সোয়েটার পরে তার উলের পকেটে এক প্যাকেট সিগারেট ঠেসে ভরে সে। পার্স, দেশলাইয়ের বাক্স, চাবির রিং-সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার পর পা দিয়ে মৃদু ঠ্যালা দেয় কেইসুকের পিঠে। ঠ্যালা খেয়ে কেইসুকে তার হেডফোন নামিয়ে রাখে।

"সমুদ্রের তীরে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলন দেখতে যাচ্ছি," সে বলে।

"আবারো মিয়াকি?" কেইসুকে বিরক্ত লাগে। "মজা করছো নিশ্চয়ই! এটা ফেব্রুয়ারি মাস, আর এখন ঘড়িতে রাত বারোটা। এই সময়ে তুমি যাবে সমুদ্রের তীরে লাকড়ি পুড়িয়ে আগুন জ্বালাতে!"

"তোমাকে আসতে বলিনি আমার সাথে, কেইসুকে। আমি একাই যাবো।"

কেইসুকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "আচ্ছা, ঠিক আছে। আমাকে একটা মিনিট সময় দাও পোশাক পাল্টানোর জন্য।"

সে গিটারের অ্যাম্পের সুইচ বন্ধ করে, বাসার পায়জামার ওপরেই ট্রাউজার পরে নেয়। শরীরের ওপরে একটা সোয়েটার, সোয়েটারের ওপর একটা ডাউন জ্যাকেট, যার চেইন সে একদম তার থুতনি পর্যন্ত টেনে উঠিয়ে দেয়। জুনকো এই ফাঁকে গলা একটা স্কার্ফ জড়িয়ে মাথায় 'হাতে বোনা' উলের টুপি চাপায়।

"তোমরা দু'জনই পাগল হয়ে গেছো," অ্যাপার্টমেন্ট হতে নেমে সমুদ্র তীরের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কেইসুকে বলে। "চ্যালাকাঠ পুড়িয়ে এরকম বড় করে আগুন জ্বালানোর মধ্যে লাভটা কি?"

রাতটা ছিল খুবই শীতল, কিন্তু বাতাসের উপস্থিতি ছিল একদম শূন্য। কেইসুকের মুখ নিঃসৃত শব্দগুলো চারপাশের ভারী বাতাসে ঝুলে থাকে।

"পার্ল জেম নামে যে মিউজিকটা তুমি সারাদিন বসে বসে তোমার গিটারে বাজাতে থাকো, ওটাই বা অমন মহৎ কোনো কাজ?" জুনাকো পাল্টা প্রশ্ন করে। "আমার কাছে তো ওটা শব্দদূষণ লাগে।"

"পার্ল জেম নামের ঐ টুকরো মিউজিকটার সারা দুনিয়ায় কমসে কম দশ লাখ ফ্যান আছে।"

"এভাবে ধরতে গেলে আগুন জ্বালানো কাজটা মানুষ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে করছে অন্তত পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে," জুনাকো বলে।

"বাপরে, এতো দেখছি আমাকে একদম ক্লিন বোল্ড করে দিলে," কেইসুকে অবাক হয়।            

"আর তোমার পার্ল জেম যেদিন মানুষ আর পৌঁছেও দেখবে না ভবিষ্যতে, আগুন জ্বালানোর কাজটা মানুষের জন্য তখনও প্রাসঙ্গিক হয়ে রবে।"

"ওরে বাপরে বাপ! তুমি তো দেখি আজ একটা কথাও মাটিতে পড়তে দিচ্ছ না।" কেইসুকে তার ডানহাত পকেটের ভেতর থেকে বের করে জুনাকোকে কাঁধের কাছটাতে জড়িয়ে ধরে। "এখন ঝামেলা হল এই যে, আমার আজ হতে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে, বা পঞ্চাশ হাজার বছর পরের সময়কালের সঙ্গে কোন লেনদেন নেই। কিছুই না। শূন্য একদম। আমার কাছে এই মুহূর্তটা গুরুত্বপূর্ণ, যে মুহূর্তটা আমার হাতের মুঠোয় আছে। পৃথিবীর শেষ কিভাবে হবে তা কে জানে? ভবিষ্যতে কি হবে, তাও আমাদের জানার উপায় নেই। আমার চিন্তা কেবল দুটো ব্যাপারে, এই মুহূর্তে খিদে পেলে আমার পেট ভরার জন্য পর্যাপ্ত খাবার আছে কিনা, আর নাভির নীচের এই জিনিসটা দাঁড়িয়ে গেলে ওর ক্ষুধা নিবারণের বন্দোবস্ত আছে কিনা।"

তারা একপা দু'পা করে সিঁড়ি বেয়ে সমুদ্রতীরের বাঁধের ওপর উঠে গেলো। দূরে, ওপাশে দেখা গেলো, মিয়াকি তার নিয়মিত জায়গাটাতেই বসে আছে। ওর সামনে ছোট-বড়, হালকা-ভারী নানা গড়নের কাঠের টুকরো। এদেরকে এই পর্যন্ত টেনে এনে জড়ো করতে নিঃসন্দেহে ওর অনেক কষ্ট করা লেগেছে।

সমুদ্র দিয়ে বৃত্তাকারে আবিষ্ট তটকে চাঁদের আলোয় তরবারির ধারালো পাশের মতো ঝকঝকে আর মসৃণ মনে হচ্ছিল। শীতের রাতের ঢেউগুলোও ছিল কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে। জনমানব শূন্য সমুদ্রতীরে মিয়াকি ছিল একমাত্র মানুষ।

"দারুণ না?" মিয়াকির প্রশ্নের সঙ্গে মুখ থেকে শীতের রাতের একরাশ সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা বেরিয়ে আসে।

"অসাধারণ!" জুনকো বলে।

"এরকম ঘটনা কালেভদ্রে ঘটে। যেমন ঝোড়ো দিনগুলোতে, যখন সমুদ্রের ঢেউ বড় বড় থাকে। পরে, আমি শব্দ শুনেই বলে দিতে পারি যে, আজ সমুদ্রের তীরে একগাদা লাকড়ি এসে জমা হবে।"

"ঠিক আছে, ঠিক আছে ভাই। আমরা জানি এ কাজে আপনার অনেক দক্ষতা," দু'হাত জোরে জোরে ঘষতে ঘষতে কেইসুকে বলে। "এবার একটু শরীর গরম করার ব্যবস্থা করা যাক। এতো ঠাণ্ডা এখানে! আমার বিচি জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে।"

"উঁহু, তাড়াহুড়ো করা যাবে না। এ কাজ করার সঠিক পদ্ধতি আছে। একদম প্রথম ধাপ হচ্ছে কাজটা ঠিকঠাক মতন পরিকল্পনা করা। পরিকল্পনাটা যদি সঠিক হয়, তবে কোনরকম সমস্যা ছাড়াই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠবে। তবে জ্বালানোর কাজটা শুরু করতে হবে একটু ধীরগতিতে। তাড়াহুড়ো করার উপায় নেই। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে না, 'এ পেশেন্ট বেগার আর্নস হিস কিপ', সেরকম আর কি। ধৈর্য ধরতে হবে।"

"বটে," কেইসুকের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। "শুধু ধৈর্যশীল ভিখারি নয়, ধৈর্যধারী বেশ্যাও তো খদ্দের জুটিয়ে ফেলে।"

মিয়াকি কেইসুকের কথা শুনে বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়ে। "রসিকতার চেষ্টা করছেন? এসব সস্তা রসিকতার বয়স আছে এখনো আপনার?"

মিয়াকি যত্নের সঙ্গে বড় - ছোট কাঠের আকৃতি মিলিয়ে-ঝিলিয়ে উত্তর আধুনিক "আভা-গ্রাদ" স্থাপত্যশৈলীর মতো সুবিশাল একটা আকৃতি নির্মাণ করেছে লাকড়ি আর গাছের গুঁড়ি দিয়ে। জিনিসটা থেকে কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিল কাঠের পুরো বিন্যাসটা। দুটো - একটা লাকড়ি টেনেটুনে আবারো গুছিয়ে রাখছিল তাদের জায়গামতো। তারপর আবার ঘুরে এসে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে ঐ ধারের কাঠগুলো পরখ করে দেখছিল পুনরায়। আবারো কিছু লাকড়ি এধার ওধার করলো সে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা বেশ কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করলো সে কাষ্ঠখণ্ডের এ বিশাল জমায়েতকে ঘিরে। একজন ভাস্কর যেমন একখণ্ড পাথরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভাস্কর্য, বা মূর্তির কাঠামোটা অন্তঃচক্ষু দিয়ে দেখতে পায়, ঠিক সেভাবেই মিয়াকি ঘুরে ঘুরে লাকড়ির স্তূপের আকৃতিটা দেখছিল-যেন আগুন ধরানো মাত্র সে যেভাবে পরিকল্পনা করেছে, ঠিক সেভাবে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে আকাশকে স্পর্শ করে।

মিয়াকি বেশ সময় নিলো পুরো কাজটায়। অবশেষে, যখন সে নিজে মনে মনে নিশ্চিত হল যে লাকড়ির বিন্যাসটা তার মনমতো হয়েছে, সে আপনমনেই মাথা নেড়ে বলে উঠলো - ব্যাস, একদম নিখুঁত। এরপর সে সঙ্গে করে নিয়ে আসা সংবাদপত্র দলা পাকিয়ে নিলো, ঢুকিয়ে দিলো লাকড়ির স্তূপের একদম নীচে। একটা প্লাস্টিকের সিগারেট লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো কাগজে। জুনকো তার পকেট থেকে সিগারেট বের করে দেশলাই ঠুকে তাতে আগুন ধরালো। চোখ সরু করে তাকালো মিয়াকির কুঁজো হয়ে থাকা পিঠ, আর টেকো মাথার দিকে। এই সে মাহেন্দ্রক্ষণ, এই সে দম আটকে অপেক্ষা করবার মুহূর্তঃ আগুন ধরবে? দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন কি গিলে ফেলবে আকাশকে শীঘ্রই?

তারা তিনজন দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকলো পর্বতসম স্তূপীকৃত লাকড়িগুলোর দিকে। সংবাদপত্রগুলি জ্বলে উঠলো, আগুনের শিখা মুহূর্তকালের জন্য নেচে উঠলো তাদের শরীর থেকে, তারপর হঠাৎ কেঁপে উঠে সে শিখা নিভে গেলো ধোঁয়া ছড়িয়ে। তারপর কেবল শূন্যতা আর নীরবতা। কাজ করলো না জিনিসটা, ভাবল জুনকো। ভেসে আসা লাকড়িগুলো দেখতে যতটুকু ভেজা লাগছিল, তারা তারচেয়েও বেশী ভিজে আছে হয়তো।

জুনকো প্রায় আশাহত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তখনি লাকড়ির স্তূপের একদম শীর্ষদেশ থেকে সাদা ধোঁয়ার এক সরু, সর্পিল রেখা বেরিয়ে এলো। নির্বাপিত করবার জন্য কোন বাতাস না থাকায় সে ধোঁয়া ক্রমশ বেড়েই চলল, বেড়েই চলল। বোঝা যাচ্ছে যে লাকড়ির স্তূপের কোন এক জায়গায় আগুন লেগেছে, কিন্তু আগুনটা দেখা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে।

সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। এমনকি সারাক্ষণ পটর পটর করে চলে কেইসুকে পর্যন্ত কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।  মিয়াকি হাঁটু গেড়ে ঝুঁকে বসলো বেলাভূমিতে। জুনকো হাতদুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো পাশে। দু' আঙ্গুলের ফাঁকে যে একটা সিগারেট গুঁজে রাখা, এটা মনে পড়লে কালেভদ্রে তাতে দু' একটা টান দিচ্ছিল সে।

এমনসময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জুনকো জ্যাক লন্ডনের লেখা "টু বিল্ড এ ফায়ার" গল্পটার কথা স্মরণে এলো। গল্পটা ছিল আলাস্কার তুষারাচ্ছন্ন বুনোপথ ধরে একাকী হেঁটে চলা এক মানুষ, এবং পথিমধ্যে তার আগুন জ্বালানোর সংগ্রাম ঘিরে। সূর্য ছিল অস্তগামী। যদি সে আগুন ধরাতে না পারে শীঘ্রই, তবে ঠাণ্ডায় জমে মারা যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। জুনকোর খুব একটা পড়ার অভ্যেস নেই, কিন্তু জ্যাক লন্ডনের এই ছোটগল্পটা তার হাইস্কুলের প্রথমবর্ষে শিক্ষক গ্রীষ্মকালীন অবকাশে ছুটির পড়া হিসেবে দেয়ার পর থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সে বহুবার পড়েছে। গল্পটার ওপর একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখে আনা ছিল স্কুল থেকে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব। গল্পটা পড়া আরম্ভ করা মাত্রই প্রতিটি দৃশ্য যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো তার কল্পনায়। তীব্র শীতে পৃথিবীর বিরানতম এক প্রদেশে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে লিপ্ত লোকটির সমস্ত ভয়, আশা, হতাশাকে যেন নিজের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি হিসেবে অনুভব করতে পারছিল জুনকো। মৃত্যুর উপকূলে দাঁড়িয়ে ঢাকের বাড়ির মতো তার হৃদপিণ্ডের ভয়াবহ ওঠানামার অনুরণন ঘটছিল জুনকোর বক্ষপিঞ্জরেও। জুনকোর জন্য সবচে কৌতূহল উদ্দীপক আবিষ্কার ছিল এই ব্যাপারটা যে, লোকটা সম্ভবত নিজের মৃত্যুকেই কামনা করছিল। সরাসরি এমন কোন ইঙ্গিত গল্পে না থাকলেও জুনকো ভেতরে ভেতরে নিশ্চিত ছিল এটা। কিভাবে সে গল্পটা থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, তা তাকে জিজ্ঞেস করলে সে গ্রহণযোগ্য কোন ব্যাখ্যা দিতে পারতো না। কিন্তু এ নিয়ে তার কোন সন্দেহ ছিল না যে লোকটা মৃত্যুই কামনা করছিল মনে মনে। মৃত্যুই এ কঠিনতম যাত্রার সবচে নিখুঁত পরিসমাপ্তি হত তার জন্য। এটা জেনেও সে নিজের পুরো শক্তি দিয়ে লড়ে গেছে বেঁচে থাকাতে। একজন মানুষের ভেতর এই গভীর বৈপরীত্য জুনকোকে নাড়া দিয়েছিল সবচে শক্তভাবে।

জুনকোর হাইস্কুল শিক্ষকের কাছে অবশ্য তার এই দৃষ্টিভঙ্গি হাস্যকর মনে হয়। "সে মূলত মৃত্যুই কামনা করছিল নিজের জন্য? আরে বাহ! এতো এক দারুণ আবিষ্কার তোমার জুনকো। খুব অরিজিন্যাল, আবার একদম ভুতুড়ে!" শিক্ষক জুনকোর পাঠপ্রতিক্রিয়ার শেষাংশটুকু ক্লাসে জোরে জোরে পড়ে শোনালে তার সঙ্গে বাকি ছাত্রছাত্রীরাও হাসির হুল্লোড়ে যোগ দেয়।

কিন্তু জুনকোর কোন সন্দেহ ছিল না। সে জানতো, যারা এই মুহূর্তে হাসছে - তারা সবাই ভুল। যদি লোকটা সত্যই মৃত্যু কামনা না করে থাকে মনে মনে, তবে গল্পটির সমাপ্তি এতো প্রশান্তিদায়ক, এতো সুন্দর কেনো?   

"আহ, মিঃ মিয়াকি," অবশেষে কেইসুকে মুখ খুলল, "আগুনটা বোধয় নিভে গেছে, তাই না?"

"চিন্তার কিছু নেই, স্তূপের ভেতরে আগুন ধরে গেছে। এখন কেবল প্রস্তুতি নিচ্ছে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠার। ধোঁয়া দেখে টের পাচ্ছেন না? আবারো একটা প্রবাদ মনে পড়লোঃ যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে আগুনও আছে।"

"এই প্রবাদের মতো আরও একটা প্রবাদ মনে পড়লো আমার, 'বিছানায় রক্ত পড়ে থাকলে তার পিছে একখানা উত্থিত লিঙ্গের ভূমিকা আছে।"

"আপনি কি সারাদিন এসব আবোল-তাবোলই বকতে থাকেন?"

"তা বকি না, কিন্তু আপনার কথা শুনলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে এসব। তার আগে আপনি আমাকে বোঝান, আপনি এতোটা নিশ্চিত হয়ে কিভাবে বলতে পারেন যে - আগুন নিভে যায় নাই?"        

"নিশ্চিতভাবে বলছি, কারণ আমি নিশ্চিতভাবে জানি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে।"

"এই শিল্প আপনি কিভাবে রপ্ত করলেন, মিয়াকি?"

"'শিল্প'? আমি এটাকে শিল্প বলতে রাজি নই। আমি বয়স্কাউটের সদস্য থাকা অবস্থায় এটা শিখেছিলাম। বয়স্কাউটের প্রত্যেক সদস্যের ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক এই আগুন জ্বালানোর ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু শেখা লাগে।"

"ওহ হো, এই ব্যাপার তাহলে?" কেইসুকে বলে। "বয় স্কাউট করে শিখেছেন এই সব..."

"এটাই গল্পের পুরোটা না। আগুন জ্বালানোর ব্যাপারে আমার বিশেষ দক্ষতা আছে। আমি অহংকার করছি না। কিন্তু এই জ্বালানী কাঠ কুড়িয়ে অগ্নিকুণ্ড তৈরির ব্যাপারে আমার যে মেধা আছে, তা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষেরই নাই।

"বোঝা যাচ্ছে এই কাজে খুব আনন্দ পান আপনি। তবে পয়সাকড়ি বোধয় মেলে না কিছু, এই কাজ করে।"

"তা ঠিক," মিয়াকি হাসিমুখে বলে। "টাকাপয়সার সঙ্গে এই কাজের কোনো যোগসূত্র নাই।"

মিয়াকির অনুমান অনুযায়ীই লাকড়ির স্তূপের এখান ওখান থেকে মৃদু মড়মড় আওয়াজ করে অল্প আগুন জ্বলে উঠলো।  জুনকো দীর্ঘসময় ধরে চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল প্রশান্তির সঙ্গে। এখন আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সমুদ্রের তীরে বসে শীতের রাতে আরাম করে আগুন পোহানো যাবে। নতুন উদ্দীপনা নিয়ে জ্বলে ওঠা অগ্নিকুণ্ডের দিকে মুখ করে তারা তিনজন নানাভাবে শরীর আঁকিয়েবাঁকিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গতে থাকলো। পরবর্তী মুহূর্তগুলোতে তাদের কাজ একটাই, আস্তে আস্তে এই পুরো স্তূপের এক প্রলয়ঙ্করী অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হতে দেখা। জুনকোর মনে হল, আজ হতে পঞ্চাশ হাজার বছর আগেও মানুষ প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে, তাদের মন একইরকম পুলকে ভরে উঠতো।

"আপনি তো কোবে প্রদেশের মানুষ, তাই না?" যেন হুট করেই কথাটা মনে পড়লো, এরকম মিষ্টি সুরে কেইসুকে প্রশ্ন করে। "আপনার কোন আত্মীয়স্বজন গতমাসে কোবের কানসাইয়ের ভূমিকম্পে আক্রান্ত হয় নি তো?"

"জানি না," মিয়াকি বলে। "কোবের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ নেই আজ অনেক বছর ধরে।"

"তাই নাকি? তা আপনার কথায় তো এখনো কানসাই অঞ্চলের টান।"

"তাই? এটা আমার পক্ষে নিজে নিজে উপলব্ধি করা মুশকিল।"

"নিজে উপলব্ধি করা মুশকিল! মিয়া মশকরা করতেছেন নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে!" কেইসুকে তার কণ্ঠে অতিরিক্ত কানসাই আঞ্চলিকতা মিশ্রিত করে ব্যঙ্গ করে মিয়াকিকে।

"হয়েছে, থামেন এবার। আইবারাগি এলাকার মাথামোটা লোকগুলো যে কেন কানসাই অঞ্চলের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে! পূব দেশের খেতেখামারে বড় হওয়া তাদের চেংড়াকালের দিনগুলোর মতো ঐ অঞ্চলেই ঘুরে ফিরে হুন্ডা চালায়ে দিন গুজরান করলেই পারে।"

"আমার কথা বোঝেন নাই আপনি। যা হোক, দেখতে তো আপনি বেশ শান্তশিষ্ট একজন ভদ্রলোক, কিন্তু মুখের ভাষা এতো খারাপ কেনো আপনার? প্রথম কথা হল, জায়গাটার নাম 'আইবারাগি' না, 'আইবারাকি'। আর আপনারা কানসাই প্রদেশের লোকজন কিছু হলেই আমাদের খেতেখামারে বড় হওয়া চাষাভুষা বলেন কেন? এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে আর কথা বলার রুচি নাই আমার," কেইসুকে বলে। আবার একটু পর যোগ করে, "যাই হোক, কেউ আহত হয় নাই তো আপনার পরিবারের, সেই ভূমিকম্পে? কোবে থেকে খবর দেয়ার মতো কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আছে আপনার। টেলিভিশনের সংবাদে দেখেন নাই?"

"এই বিষয়টা বাদ দেয়া যাক," মিয়াকি বলে। "হুইস্কি?"

"এই না হলে প্রস্তাবের মতো প্রস্তাব!"                   

"জুন?"

"সামান্য" জুনকো উত্তর দেয়।

মিয়াকি তার চামড়ার জ্যাকেটের জেব থেকে পাতলা একটা ধাতব ফ্লাক্স বের করে কেইসুকের হাতে তুলে দেয়। কেইসুকে এক মোচড়ে তার ছিপি খুলে মুখ না লাগিয়ে ঢকঢক করে খানিকটা হুইস্কি ঢালে তার গলায়। গিলে সেটা পেটে চালান করে দেবার পর লম্বা করে শ্বাস নেয় একবার।

"এতো জোস একটা মাল এটা!" সে বলে। "এটা নিশ্চয়ই অন্তত ২১ বছরের পুরনো সিঙ্গেল মল্ট! অসাধারণ এক জিনিস। গ্যাঁজানোর সময় ওকগাছের কাঠ ব্যবহার করা হয়। গলায় ঢালার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের গর্জন কানে এসে ধাক্কা মারে আর স্কটল্যান্ডের পরীদের গরম গরম শ্বাস ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে।"

"কাকে খুশী করবার জন্য এতো তেল দিচ্ছেন, কেইসুকে? এটা একদম সস্তা সান্তোরি ব্র্যান্ডের কেরু। যেকোনো জায়গায় পাওয়া যায়।"

এবার জুনকোর পালা। সে কেইসুকের হাত থেকে ফ্লাক্সটা নিয়ে তার ছিপিতে অল্প একটু হুইস্কি ঢালে, তারপর ছোট ছোট চুমুকে সেটা শেষ করে। চুমুকের সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ কুঁচকে এলেও কণ্ঠনালী হয়ে পাকস্থলী পর্যন্ত যে একটা উষ্ণ হলকার মতো আভা ছড়িয়ে পড়ে পানীয়র সাথে, সেটাও তার ভালো লাগে। তার শরীরটা আগের চে' একটু উষ্ণ হয়ে ওঠে। তারপর হাতঘুরে বোতলটা মিয়াকির কাছে পৌঁছালে মিয়াকি তাতে একটা চুমুক দেয়। পড়ে কেইসুকে মিয়াকিকে অনুসরণ করে। এইভাবে বোতলটা হাতে হাতে ঘোরার ফাঁকে ফাঁকে অগ্নিকুণ্ড আকারে বড় আর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। একসাথে একবারে নয়, ধীরে ধীরে। মিয়াকির হাতে জ্বালানো আগুনের এই এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আগুনের ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা ছিল খুবই নরম, এবং কোমল, যেন পরিপক্ক হাতের আলতো স্পর্শের মতো। তাতে কোনো হন্তদন্তভাব, কিংবা তাড়াহুড়ার ব্যাপার ছিল না। তাদের জ্বলে ওঠা মানুষের হৃদয়কে জয় করবার উদ্দেশ্যে।

অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে জুনকো কখনোই বেশী একটা কথা বলতো না। এমনকি নড়াচড়াও কমিয়ে দিতো। আগুন যেমন করে সমস্তকিছু নীরবভাবে গ্রহণ করে নেয়, পান করে, বোঝে, এবং ক্ষমা করে। একটা পরিবার, একটা সত্যিকারের পরিবারের বৈশিষ্ট্য এমনই হয়, জুনকোর মতে।

জুনকো যখন এই আইবারাকি শহরে এসে হাজির হয়, সেটা ছিল মে মাস, আর জুনকো ছিল হাইস্কুলের তৃতীয়বর্ষে। সঙ্গে ছিল তার বাবার পাসবই, আর সিল, ব্যাংক থেকে তোলা ৩০০,০০০ ইয়েন, একটা বোস্টন ব্যাগে করে যে পরিমাণ কাপড়চোপড় নেয়া যায় তার সব, তারপর সে বাড়ি থেকে পালায়। সে ক্রমাগত ট্রেন বদলে বদলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা হয়ে তোকোরোজাওয়া হতে আইবারাকির এই সমুদ্র তীরবর্তী ছোট্ট মফস্বল শহরে এসে পড়ে। এই শহরে এসে পা রাখার আগে সে জীবনেও এই শহরের নাম শোনেনি। রেলওয়ে স্টেশনে এসে নেমেই তার উল্টোপাশে সে ছোট একটা এক কক্ষের এপার্টমেন্ট ভাড়া নেয়। পরবর্তী সপ্তাহে সে সমুদ্রের তীরবর্তী সড়কপথের ধারে এক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দোকানে চাকরিও জুটিয়ে ফেলে। তারপর মায়ের কাছে সে চিঠি লিখতে বসেঃ আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, আর আমাকে খোঁজার চেষ্টাও করো না। আমি ভালো আছি।

তার স্কুলের পড়াশোনা জঘন্য লাগতো, এছাড়াও তার বাবার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করতো না তার। ছোটবেলায় যদিও তার বাবার সঙ্গে সম্পর্ক মোটের ওপর ভালোই ছিল। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে সে তার বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো সব জায়গায়। রাস্তাঘাটে বাবার হাতে হাত রেখে হাঁটতে তার গর্ববোধ হতো, মনের ভেতরে জোর পেতো। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ হতে না হতেই যখন তার রজঃস্রাব শুরু হয়, যৌনকেশ জন্মানো শুরু করে, বুক উঁচু হয়ে ওঠে, সে সময় থেকেই বাবা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকানো শুরু করে।  তারপর, জুনিয়র স্কুলের তৃতীয়বর্ষে পড়া অবস্থায়ই সে যখন পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতা পার করে যায়, তখন থেকে তার বাবা তার সঙ্গে  কথাবার্তা একদম কমিয়ে দেয়।

তাছাড়া জুনকোর পড়াশোনার ফলাফলও অমন আহামরি কিছু ছিলনা। মিডলস্কুলে ভর্তি হবার সময় তার ক্রমিক নং ছিল একদম উপরের দিকে। গ্রাজুয়েশন শেষ করতে করতে দেখা গেলো একদম নীচ থেকে খোঁজা শুরু করলে জুনকোর নামের খোঁজ মেলে দ্রুত। মিডলস্কুল থেকে সে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হল। তার অর্থ কোনভাবেই এটা না যে সে বেকুব ছিলঃ তার কোনো কাজে মনঃসংযোগ হতো না। কোন কিছু শুরু করে শেষ করতে পারতো না সে। মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলেই মাথার ভেতরে ব্যাথা শুরু করতো। শ্বাস নিতে কষ্ট হত, হৃদস্পন্দন উল্টোপাল্টা হয়ে যেতো। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া ছিল তার জন্য বিষম অত্যাচার।

এই শহরে এসে থিতু হতে না হতেই তার কেইসুকের সঙ্গে দেখা। তার চে' দু'বছরের বড় কেইসুকে সমুদ্রে সার্ফিং করে দুর্দান্ত। বেশ লম্বা, পুরো চুল বাদামী বর্ণে রাঙ্গানো, দাঁতগুলো একদম ইঁদুরের দাঁতের মতো সরু, সাদা, আর সোজা। তার আইবারাকিতে এসে ভিড়বার কারণ হল এখানে সমুদ্রে সার্ফিং করবার অবারিত সুযোগ, আর এখানকার ছেলেপেলেদের নিয়েই সে একফাঁকে একটা রক ব্যান্ডও বানিয়ে ফেলেছে। একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রাইভেট কলেজে তার নাম নিবন্ধন করা আছে, কিন্তু সে শেষ কবে তার ক্যাম্পাসে গিয়েছে তা তার নিজেরও মনে নেই। গ্রাজুয়েশন শেষ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার ভেতরে আছে বলে মনে হয় না। মিটো শহরে তার বাবা মায়ের এক পুরনো চালু মিষ্টির দোকান আছে, আর কিছু না হলে সে সেই দোকানে গিয়ে বসতে পারবে একটা বয়সে, যদিও আদতে তার মিষ্টির দোকানের ক্যাশবাক্স সামলানোর কোনো ইচ্ছে নেই। তার সমস্ত আগ্রহ হচ্ছে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে জীপগাড়িতে ঘুরে বেড়ানো, সমুদ্রে সার্ফিং করা, আর একটা স্থানীয় শখের ব্যান্ডের সঙ্গে গিটার বাজানোকে কেন্দ্র করে। এমন এক ঢিলেঢালা জীবন সেটা, যা বেশীদিন টেকার কথা না।

কেইসুকের সঙ্গে জুনকো লিভ টুগেদার করা শুরু করবার পর মিয়াকোর সঙ্গে জুনকোর পরিচয় হয়। মিয়াকি বেঁটেখাটো, লিকলিকে গড়নের চশমা চোখে এক লোক। তার চেহারার গড়ন সরু, চুল খাটো করে ছাঁটা, সে এখন তার মধ্য চল্লিশে আছে। যদিও প্রতিদিন সকালে সে যত্ন করে দাঁড়ি কামাই করে, কিন্তু তার দাঁড়ি এতো ঘন যে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়বার আগেই তার গালজুড়ে অল্পবিস্তর চাপদাঁড়ির ছায়াসন্নিপাত ঘটে। তার শরীরে সবসময়ই একটা রংচটা আলোহা শার্ট দেখা যায়, যা সে তার ঢিলেঢালা প্যান্টের ওপর পরে। কোনদিন শার্ট-প্যান্ট ইন করা অবস্থায় তাকে দেখা যায় নি। পায়ে থাকে বহু ব্যবহারে রং হারানো সাদা স্পোর্টস কেডস। শীতকালে কখনো কখনো তাকে দেখা যায় জায়গায় জায়গায় চামড়া ওঠা লেদার জ্যাকেট গায়ে চাপানো অবস্থায়, মাথায় হয়তো একটা বেসবল ক্যাপও থাকে সেসময়। এর বাইরে অন্য কোন পোশাকে কখনো জুনকো দেখে নি তাকে। তবে মিয়াকি যাই পরতো, সেগুলো পুরনো হলেও একদম সাফসুতোর থাকতো সবসময়।

কানসাই অঞ্চলের আঞ্চলিকতা মিশ্রিত ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না এখানে, কাজেই মিয়াকি মুখ খোলা মাত্রই সে সবার চোখে পড়তো। "লোকটা পাশেই এক ভাড়াবাড়িতে একা থাকে," দোকানের এক সহকর্মী মেয়ে জুনকোকে একদিন জানায়। "লোকটা ছবি আঁকে। তবে মনে হয় না সে বিখ্যাত-টিখ্যাত, ওর আঁকা ছবিও আমি কখনো দেখি নি। কিন্তু এরমধ্যেই বেশ চলে যাচ্ছে ওর জীবন। টেনেটুনে সামলে নিচ্ছে কোনভাবে। সে মাঝেমাঝে টোকিও যায় ওর রং-তুলী- ব্রাশ এসব কিনতে, কেনাকাটা শেষ করে আবার বেলাবেলি ফিরেও আসে। কতদিন ধরে সে আমাদের এই শহরে আছে? কে জানে, পাঁচ বছর হবে হয়তো সবমিলিয়ে। তবে ব্যাটাকে প্রায় সবসময়ই সমুদ্রের তীরে বসে আগুন জ্বালাতে দেখা যায়। ওর খুব ঝোঁক আছে এটা নিয়ে। মানে, যখনই ও আগুন জ্বালায়, ওর চোখ একদম গনগন করে জ্বলতে থাকে উৎসাহে। বেশী কথা বলে না, বেশখানিকটা অদ্ভুতও সে, তবে খারাপ লোক নয়।"

মিয়াকি দিনে অন্তত তিনবার করে তাদের দোকানে এসে হাজির হতো। সকালবেলা সে দুধ, রুটি, আর সংবাদপত্র কিনতো। দুপুরে সে প্যাকেটজাত খাবার কিনে নিয়ে যেতো খাবার জন্য। আর সন্ধ্যায় এসে সে একটা বিয়ারের ক্যান আর হালকা কিছু খাবার কিনত। এই ছিল তার রুটিন দিনের পর দিন ধরে। যদিও তার সঙ্গে একদম ন্যূনতম সামাজিকতামূলক সৌহার্দ্যবিনিময় ছাড়া আর কোন আলাপই হয় নি জুনকোর, কিন্তু ধীরে ধীরে সে আকর্ষিত হয় মিয়াকির প্রতি।

একদিন সকালে যখন দোকানে সে আর মিয়াকি ছাড়া আর কেউ ছিল না, সে সুযোগে জুনকো তার ব্যাপারে আরও জানতে চায়। তাকে বারবার কেন আসা লাগে দোকানে, একসঙ্গে বেশী করে রুটি আর দুধ কিনে রেফ্রিজারেটরে ভরে রাখে না কেন সে? এটা আরও সহজ হত না? যদিও এতে দোকানের মালিকপক্ষের লাভক্ষতির বিষয় জড়িত না, তবুও ...           

"তা আপনি ঠিক বলেছেন," মিয়াকি বলেছিল। "জিনিসপত্র কিনে জমিয়ে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হত, তবে কাজটা আমার পক্ষে সম্ভব না।"

"কেন?" জুনকো প্রশ্ন করেছিল।

"বুঝিয়ে বলা মুশকিল। তবে সম্ভব না আমার পক্ষে, এই যা ..."

"আমি আপনার ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করতে চাইনি মোটেই কিন্তু," জুনকো বলে। "প্লিজ আমার প্রশ্নে কষ্ট পাবেন না। আমি অনেকটা এরকমই। যদি কোন বিষয় না জানি বা বুঝি, তবে সেটা নিয়ে আলপটকা প্রশ্ন করে ফেলি সবসময়। কোনো ক্ষতিসাধন করবার উদ্দেশ্য থাকে না আমার এতে করে।"

মিয়াকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তার মাথা চুলকায়, তাকে দেখে মনে হয় যে সে কিছু একটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে। একটু পর সে আমতা আমতা করে বলে - "সত্যি বলতে আমার কোন রেফ্রিজারেটর নেই বাসায়। আমি রেফ্রিজারেটর পছন্দ করি না।"

জুনকো হেসে বলে, "রেফ্রিজারেটর আমি নিজেও পছন্দ করি না, তাও আমার বাসায় আছে একটা। রেফ্রিজারেটর ছাড়া জীবন কাটানো মুশকিল না?"

"তা ঠিক বলেছেন, কিন্তু আমি জিনিসটা খুব অপছন্দ করি। কাজেই আমার কিছু করার নেই এক্ষেত্রে। রাতে ঘুমানোর সময় আশেপাশে রেফ্রিজারেটর থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না।"

কি অদ্ভুত এক মানুষ, জুনকো ভাবে। কিন্তু এতে করে তার ওর ব্যাপারে আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।

এর কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় সমুদ্রের তীরে হাঁটতে গিয়ে জুনকো মিয়াকিকে খেয়াল করে। লোকটা সমুদ্রের তীরে একা একা বসে আগুন জ্বালাচ্ছে লাকড়ি দিয়ে। সমুদ্রে ভেসে আসা অল্পকিছু লাকড়ি কুড়িয়ে তৈরি করা অগ্নিকুণ্ডটা খুব বেশী বড় ছিল না। জুনকো মিয়াকির সঙ্গে সম্ভাষণ বিনিময় শেষে দাঁড়িয়ে যায় অগ্নিকুণ্ডের পাশে। লোকটার চে' জুনকো ইঞ্চিখানেক লম্বা ছিল। টুকটাক কথাবার্তা শেষে তারা দুজনেই নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে প্রজ্জলিত অগ্নির দিকে।

সেই প্রথম জুনকো আগুন দেখতে দেখতে তার ভেতরে "বিশেষ" এক অনুভূতি টের পায়। সেই "বিশেষ" অনুভূতি তার গভীরে কাজ করা শুরু করে খুব ধীরে, দলাপাকানো "বিশেষ" সে অনুভূতি ছিল খুবই চাঁছাছোলা, ভারী, এবং বাস্তব; ফলে ওটাকে ঠিক বিমূর্ত অনুভূতির কাতারে ফেলা যাচ্ছিল না। ধীরস্থিরভাবে অনুভূতিটা তার ভেতরে প্রবেশ করে পুরো শরীরজুড়ে ভ্রমণ করে আবার হাওয়ায় মিশে যায়। পেছনে ফেলে রেখে যায় হৃদপিণ্ড খামচে ধরা এক মিষ্টি, এবং মিষ্টত্ব মিশ্রিত ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি। জুনকো টের পায়, তার হাতের অনাবৃত অংশ জুড়ে রোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে।

"আমাকে বলুন তো মিঃ মিয়াকি, যখন আপনি এই অগ্নিকুণ্ড যে আকৃতিগুলো তৈরি করে তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন, আপনার ভেতরে কি ব্যাখ্যাতীত কোন অনুভূতি তৈরি হয়?"

"মানে?"

"ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা মুশকিল। ধরুন, দৈনন্দিন জীবনের যে সব খুঁটিনাটি বিষয় সাধারণভাবে আমাদের নজর এড়িয়ে যায়, তারা একদম হুট করে স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে এসে ধরা দিলে ব্যাপারটা যেমন লাগার কথা, তেমন। আমি জানি যে আমি বিষয়টা গুছিয়ে বলতে পারছি না, আমি অতোটা মেধাবী নই, কিন্তু এই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন দেখে আমার ভেতর খুব গভীর, কিন্তু প্রশান্তিদায়ক অনুভূতি কাজ করছে এই মুহূর্তে।"

মিয়াকি জুনকোর কথাটা নিয়ে ভাবল একমুহূর্ত। "জানেন জুন," সে বলল, "আগুন যেকোনো আকৃতি ধারণ করতে পারে। এটার সে স্বাধীনতা আছে। যেহেতু এটা যেকোনো আকৃতি ধারণ করতে পারে, যে আগুনটা দেখছে সে তার মনের ভেতর ক্রিয়াশীল অনুভূতির আঙ্গিকে আগুনের আকৃতি কল্পনা করবার সুযোগ পায়। যদি আপনি আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকলে আপনার ভেতর খুব গভীর এবং প্রশান্তিদায়ক এক অনুভূতি জাগ্রত হয়, তবে আমার বিবেচনায় তার অর্থ হল - আপনি ব্যক্তিগতভাবে মানুষটা ওরকম। আমি কি বোঝাতে পেরেছি, যা বলতে চাইছি?"

"মোটামুটি।"

"কিন্তু এটা যেকোনো আগুনের ক্ষেত্রে ঘটবে না। এরকম অন্তঃমুখীনতার জন্য আগুনকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া লাগবে। গ্যাস স্টোভের চুলার আগুন, কিংবা সিগারেটের লাইটারের ক্ষেত্রে তা ঘটবে না। এমনকি ছোটখাটো সাধারণ অগ্নিকুণ্ডেও আপনি এই অনুভূতির দেখা পাবেন না। এই ধরনের অন্তঃমুখীন অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করার জন্য আপনার আগুন জ্বালানোর সঠিক জায়গাও খুঁজে বের করা লাগবে। কাজটা সহজ নয়। সবাই পারেও না।"

"কিন্তু আপনি পারেন, তাই তো, মিঃ মিয়াকি?"

"কখনো কখনো পারি, আবার কখনো কখনো পারি না। তবে বেশীরভাগ সময়ই পারি। যদি ঠিকমতো মনোযোগ দিই, তাহলে সাধারণ কাজটা হয় আমাকে দিয়ে।"

"আপনি আগুন পছন্দ করেন খুব, তাই না?"

মিয়াকি মাথা নাড়ায়। "এটা প্রায় অসুস্থতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে আমার জন্য। আপনি জানেন আমি এই বাপে খ্যাদানো-মায়ে তাড়ানো বিরানভূমিতে এসে কেনো বসবাস করছি? কারণ এই সমুদ্রতীরে যে পরিমাণ জ্বালানীকাঠ ভেসে আসে বছরজুড়ে, তা আমার পরিচিত অন্যসব সমুদ্রতীর হতে পরিমাণে কয়েকগুণ বেশী। এটাই একমাত্র কারণ, আমার এই এলাকায় বসবাস করবার। আমি সারা দুনিয়া ঘুরে এইখানে এসে বাস করছি, শুধুমাত্র অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করতে। শুনে একদম অনর্থক মনে হয় না?"

এরপর থেকে জুনকো সুযোগ পেলেই মিয়াকির সঙ্গে এসে এই কার্যক্রমে যুক্ত হত। মিয়াকি বছরজুড়ে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলন করে বেড়াতো, শুধুমাত্র মাঝ-গ্রীষ্মকালীন সময়টুকু বাদ দিয়ে। কারণ বছরের ঐ সময়টাতে সারাদিন, এমনকি প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত মানুষ সমুদ্রের তীরে ঘুরে বেড়াতো। কখনো কখনো সে এক সপ্তাহে দু'বার অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করতো, কখনো কখনো পুরো একটা মাস অতিবাহিত হয়ে যেতো আগুন জ্বালানো ছাড়াই। তার গতি নির্ধারিত হত সমুদ্রের স্রোতে ভেসে আসা লাকড়ির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। আর যখনই সে আগুন জ্বালানোর জন্য প্রস্তুত হত, সে জুনকোকে ফোন করতো। কেইসুকে প্রেমিক হিসেবে এমনিতে খুব হিংসুটে, কিন্তু মিয়াকির ব্যাপারে তার তেমন গা ছিল না। সে মাঝেমাঝে জুনকোকে খোঁচা মেরে তার "আগুন জ্বালানো দোস্ত"-র খবরাখবর জানতে চাইতো।

অগ্নিকুণ্ড অবশেষে সবচে বিশাল আকৃতি ধারণ করেছে এই মুহূর্তে, এখন থেকে তা নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্বলতে থাকবে দীর্ঘ সময় ধরে। জুনকো বালুময় তটে পা মুড়ে বসে প্রায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাকিয়ে রইলো আগুনের দিকে। হাতের একটা লম্বা লাঠি দিয়ে জ্বলতে থাকা কাঠের চ্যালাদের এদিক ওদিক করার মাধ্যমে মিয়াকি অত্যন্ত যত্ন সহকারে আগুনের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলো, যাতে তা সহসা নিভে না যায়। তার পাশে জমিয়ে রাখা ছোট ছোট লাকড়ির খণ্ডকে সে কিছুসময় পরপর ছুঁড়ে মারতে লাগলো অগ্নিকুণ্ডের এখানে ওখানে, যেখানে প্রয়োজন।

কেইসুকে একটু পর বলল, তার পেটব্যাথা করছেঃ "অতিরিক্ত ঠাণ্ডাতেই মনে হয় এই অবস্থা হয়েছে। আমার পেট খালি করা প্রয়োজন।"

"বাসায় ফিরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও," জুনকো বলল।

"হ্যাঁ, এটাই করা দরকার," কেইসুকে দুঃখী দুঃখী চেহারা করে বলল। "তুমি কি করবে?"

"জুন কে নিয়ে চিন্তা করবেন না," মিয়াকি বলে। "আমি তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো। কোনো সমস্যা হবে না।"

"ঠিক আছে তাহলে, ধন্যবাদ।" কেইসুকে সমুদ্র তীর ছেড়ে চলে যায়।

"গাধা একটা," মাথা নাড়তে নাড়তে জুনকো বলে। "বেহিসাবি ড্রিংকস করে আর তাল রাখতে পারে না পরে।"

"আমি আপনার চিন্তার কারণ বুঝতে পারি, জুন, কিন্তু এই ভরা যৌবনে এতোটা হিসেব নিকেশ করে চলেই বা কি লাভ? বয়সের মজাটা নষ্ট করে ফেলে এই সিরিয়াসনেস। কেইসুকে যাই করুক, তার নিজস্ব কিছু যুক্তি আছে নিশ্চয়ই।"

"তাই কি? আমার তো মনে হয় না যে ও কোনো কাজ ব্রেইন খাটিয়ে করে।"

"সবক্ষেত্রে কিন্তু মস্তিষ্কের সাহায্য নেয়া উচিতও নয়। যৌবনের ভার সহ্য করা সহজ কাজ না।"

কিছুক্ষণ পর তারা দু'জনেই নিজ নিজ চিন্তায় মগ্ন হয়ে চুপ করে গেলো। সময় বয়ে চলল তার একাকী-ভিন্ন পথে।

তারপর জুনকো বলল, "জানেন মিঃ মিয়াকি, একটা ব্যাপার আমাকে থেকে থেকে খুব বিরক্ত করছে। এ সংক্রান্ত একটা প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে?"

"কিন্তু ব্যাপারটা কি?"

"একটা ব্যক্তিগত বিষয়।"

মিয়াকি তার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে পূর্ণ গাল চুলকে বলল, "আমি আমার প্রতিক্রিয়া কি হবে, সে ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত নই, তবুও, বলুন কি জানতে চান।"

"ভাবছিলাম, আপনার স্ত্রী আছেন কিনা, দেশে বা অন্য কোথাও।"

মিয়াকি তার চামড়ার জ্যাকেটের পকেট থেকে পুনরায় ফ্লাস্কটা বের করে মুখ খোলে, তারপর সময় নিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে পান করে ওটা থেকে। তারপর  ছিপি আটকে পুনরায় সেটা তার পকেটে চালান করে দিয়ে তাকায় মিয়াকির দিকে।

"হঠাৎ এ প্রশ্ন?"

"হঠাৎ না আসলে। কেইসুকে যখন ভূমিকম্প নিয়ে কথা বলছিল, আমার তখনই কেমন কেমন বোধ হচ্ছিল। আপনার চোখেমুখে ভিন্ন এক অনুভূতির আভাস আমি দেখতে পেয়েছিলাম। আপনিই তো একদিন বলেছিলেন যে, মানুষ যখন অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, তখন তার চোখে এক ধরনের সততা ফুটে ওঠে।" 

"বলেছিলাম নাকি?"

" আপনার বাচ্চাও আছে, তাই না?"

"হ্যাঁ, দু'জন।"

"কোবেতেই তো?"

"ওখানেই ওদের বাড়ি। হয়তো সে বাড়িতেই থাকে এখনো ওরা।"

"কোবের কোথায়?"

"হিগাশি-নাদা অঞ্চলে। পাহাড়ের দিকে জায়গাটা। ওখানে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।"

মিয়াকি মুখ তুলে চোখ সরু করে তাকাল অন্ধকার সমুদ্রের দিকে। তারপর সে তার দৃষ্টি পুনরায় ফিরিয়ে আনল অগ্নিকুণ্ডের দিকে।

"জানেন, ঠিক এ কারনেই আমি কেইসুকেকে দোষ দিতে পারি না," মিয়াকি বলে। "ওকে মূর্খ বলার কোনো অধিকার নেই আমার। আমি নিজেও তো আমার ব্রেইন ওর চে' খুব বেশী ব্যবহার করছি না। আমি তো মূর্খদের বাদশাহ। মনে হয় বুঝতে পারছেন, আমি কি বলতে চাইছি।"

"আরও কিছু বলতে চান এ ব্যাপারে?" 

"না," মিয়াকি বলে। "আর কিছুই না।"

"ঠিক আছে, আমিও তবে এখানেই ইতি টানছি। কিন্তু মিয়াকি, আমার মতে আপনি একজন ভালো মানুষ। "

"ওটা সমস্যা না," মিয়াকি মাথা নাড়িয়ে বলে আবার। সে বালিয়াড়িতে তার হাতের কাঠের ডাল দিয়ে নকশামতোন কিছু একটা আঁকে। "এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করি জুন। আপনি কিভাবে মারা যাবেন-এ চিন্তা আপনার মাথায় এসেছে কখনো?"

জুনকো কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন থেকে ডানে বামে মাথা নাড়ে।

"আমি প্রায় সময়ই এটা নিয়ে ভাবি," মিয়াকি বলে।

"আপনার কি মনে হয়, আপনি কিভাবে মারা যাবেন?"

"একটা রেফ্রিজারেটরের ভেতরে আটকা পড়ে," সে বলে। "এটা কিন্তু খুব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। বাচ্চারা কখনো সখনো কিন্তু ফেলে দেয়া রেফ্রিজারেটরের ভেতরে খেলাচ্ছলে ঢুকে পড়ে, তারপর সেখানেই আটকা পড়ে মারা যায়। এমন কিছুই একটা ঘটবে হয়তো আমার সাথেও।"

জ্বলন্ত কাঠের বড় একটা চাঁই আস্তে একপাশে খসে পড়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। মিয়াকি সেটা দেখেও চুপ করে বসে থাকে। আগুন তার মুখের ওপর খুব অদ্ভুত এক ছায়া সন্নিপাত ঘটায় মুহূর্তকালের জন্য।

"খুব আঁটসাঁট একটা জায়গায় আটকা পড়েছি, চারিদিকে কেবল অন্ধকার, আমি মারা যাচ্ছি একটু একটু করে। সোজা সাপটা দম আটকে মারা যাওয়া কিন্তু খুব একটা খারাপ ব্যাপার না। কিন্তু ফ্রিজের ভেতর মৃত্যুটা অমন হবে না। কোন এক ছিদ্র দিয়ে খুব অল্প পরিমাণে বাতাস একটু একটু করে প্রবেশ করতে থাকবে ভেতরে, ওভাবে মারা যেতে সময় লাগবে অনেক। আমি চিৎকার করি, কিন্তু কেউ আমার চিৎকার শুনতে পায় না। এবং আমি যে হারিয়ে গিয়েছি-এটাও কেউ খেয়াল করে না। এতোটা কম জায়গা ভেতরে যে আমি নড়তে চড়তে পারি না। আমি ঠেলতে থাকি, ঠেলতেই থাকি কিন্তু দরজা আর খোলে না।"

জুনকো চুপ করে বসে মিয়াকির কথা শোনে।

"এই একই স্বপ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসে আমার ঘুমে। আমি মাঝরাতে ঘামে ভিজে নেয়ে উঠে যাই ঘুম ভেঙ্গে। আমি নিকষ কালো অন্ধকারে আটকা পড়ে একটু একটু করে মারা যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম, কিন্তু আমার ঘুম ভাঙ্গার পরেও দেখি-স্বপ্ন শেষ হয় নি। এটাই হচ্ছে স্বপ্নের সবচে ভয়াবহ অংশ। আমি মুখ খুলে দেখি আমার কণ্ঠ এবং তালু শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রান্নাঘরে গিয়ে রেফ্রিজারেটরের দরোজা খুলি, এবং এই পর্যায়ে এসে আমি উপলব্ধি করি যে এখনো আমি স্বপ্নই দেখছি। কেননা, প্রকৃতপক্ষে আমার বাসায় কোন রেফ্রিজারেটর নেই। তবুও আমি থামি না। বুঝতে পারি, অদ্ভুত কিছু একটা ঘটতে চলেছে, তবুও ফ্রিজের দরোজা খুলি। ভেতরে কুচকুচে কালো আঁধার। বাতি বন্ধ। আমি কিছুটা অবাক হয়ে ভাবি, ভেতরে বিদ্যুৎ সংযোগে বিঘ্ন ঘটছে কিনা কোথাও, সেটা পরীক্ষা করে দেখতেই আমি মাথা ঢুকিয়ে দিই ফ্রিজের ভেতরে। ঠিক তখনি ভেতর থেকে একজোড়া হাত বেরিয়ে এসে খিমচে ধরে আমার গলা। ভয়াবহ ঠাণ্ডা সে হাতজোড়া। যেন মরা মানুষের হাত। কিন্তু খুব শক্তিশালী। হাতদুটো আমাকে ঘাড়ে ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমি কানফাটানো একটা চিৎকার দিয়ে এবারে সত্যি সত্যি ঘুম থেকে জেগে উঠি। এটাই আমার স্বপ্ন। প্রতিবার হুবহু একই রকম লাগে। সবসময়। প্রতিটা খুঁটিনাটি বর্ণনা একই রকম থাকে। প্রতিবারই তা একই রকম রোমহর্ষক অনুভূতি এনে দেয়।"

মিয়াকি সেই পড়ে যাওয়া বড় কাঠের টুকরো তার হাতের চ্যালাকাঠ দিয়ে ঠেলে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনে।

"স্বপ্নটা এতো বাস্তব, যে এই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই ঘুমের মধ্যে আমি প্রায় শতবার মারা গেছি।"

"কবে থেকে এই স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন আপনি?"

"অনেক অনেক আগে থেকে। এতো আগে, যে আমি ঠিকঠাক মনে করতে পারছি না।" মিয়াকি বলে। "কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে বছর - দু'বছরের জন্য আমার এ স্বপ্ন আর ফিরে আসে নি। তখন আমি ভেবে নিয়েছিলাম যে - সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে বোধয়। কিন্তু না। সে স্বপ্ন ফিরে এসেছে। যখনি আমি ধরে নিয়েছি যে, আমি ঠিক আছি এখন, হয়তো বেঁচে গেছি এযাত্রা, ঠিক তখনি এটা আবারো ফিরে এসেছে। আর যখন তা ফিরে আসে, আমার ওটাকে থামানোর মতো কিছু করার থাকে না।"

মিয়াকি মাথা নাড়ে।

"দুঃখিত, জুন। আপনাকে আমার জীবনের এসব অন্ধকার গল্প বলা উচিৎ হয় নি।"

"না, আপনি ঠিক করেছেন আমার সঙ্গে এটা শেয়ার করে।" জুনকো বলে। তারপর সে তার ঠোঁটের ফাঁকে আরও একটা সিগারেট রেখে তাতে দেশলাই দিয়ে আগুন ধরায়। ফুসফুস ভর্তি ধোঁয়া টেনে নিয়ে তারপর আবার তা ছেড়ে দিয়ে বলে, "আপনি বলতে থাকুন প্লিজ।"

অগ্নিকুণ্ড নিভু নিভু হয়ে এসেছিল প্রায়। জমিয়ে রাখা ডালপালার বড় স্তূপটাও ততক্ষণে শেষ হয়ে এসেছে। সবই ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে অগ্নিকুণ্ডে। জুনকোকে কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে অদূর সমুদ্রের গর্জন।

"অ্যামেরিকান একজন লেখক আছে জ্যাক লন্ডন নামে," মিয়াকি শুরু করে।

"হ্যাঁ, ঐ ভদ্রলোকও তো বোধয় আগুন নিয়ে লিখেছেন কিছু একটা।"

"হ্যাঁ, তিনিই। দীর্ঘদিন যাবত তার ধারণা ছিল, তিনি সমুদ্রে ডুবে মারা যাবেন। আসলে ধারণা না, তিনি প্রায় অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেন ব্যাপারটা। রাতের অন্ধকারে তিনি কোনভাবে পিছলে সমুদ্রে পড়ে যাবেন, কেউ দেখবে না যে তিনি ডুবে যাচ্ছেন।"

"তিনি আসলেই মারা গিয়েছিলেন ওভাবে?"

মিয়াকি ডানে - বামে মাথা নাড়ে। "না। মরফিনের ওভারডোজে মারা যান শেষে।"

"তবে তো তার আন্দাজ ঠিক হল না। আবার এটাও হতে পারে যে, যাতে তার আন্দাজ সত্যিতে পরিণত না হয় - তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই ওভাবে মারা যান।"

"হ্যাঁ, ওপরে ওপরে ব্যাপারটা অমন মনে হতেই পারে," একমুহূর্ত বিরতি নিয়ে মিয়াকি বলে। "আবার আরেক বিবেচনায় তিনি ঠিকই ছিলেন। তিনি আসলেই অন্ধকার সমুদ্রে ডুবে মারা যান। মদের নেশায় চূর থাকতেন বেশীরভাগ মুহূর্ত। হতাশায় আদ্যপান্ত ডুবে থাকতেন তিনি। মারাও যান প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে। আন্দাজ কখনো কখনো ভিন্নভাবেও খেটে যায়। আর যে ব্যাপারগুলো তখন আমাদের কল্পিত বাস্তবতাকে প্রতিস্থাপন করে, তা আমাদের কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ হয়। এই আন্দাজ, বা পূর্বশঙ্কা বিষয়টার এটাই সবচে ভয়াবহ দিক। আমি কি আমার কথা বোঝাতে পারছি?"

জুনকো মুহূর্তখানেক সময় চিন্তা করলো মিয়াকির কথা। সে আসলে তার যুক্তিটা ধরতে পারছে না।

"আমি পুরো জীবনে একবারের জন্যও ভাবি নি যে আমি কিভাবে মারা যাবো," সে বলে। "আমার পক্ষে এটা চিন্তা করাই সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে আমি বাঁচবো কিভাবে - এটা নিয়েই তো আমার কো্নো চিন্তাভাবনা নেই।"

মিয়াকি মাথা নাড়ে। "আপনি যা বলতে চাইছেন আমি বুঝেছি সেটা। কিন্তু দুনিয়াতে একটা ব্যাপার আছে, আপনি শুনেছেন কিনা জানি না, মৃত্যু যে উপায়ে হবে তাকে অনুসরণ করে বেঁচে থাকা।"

"আপনিও কি ঐভাবেই দিন গুজার করছেন, মানে আগতপ্রায় মৃত্যুর পদরেখা অনুসরণ করে?"                             

"এখনো নিশ্চিত না, তবে কখনো কখনো সেটাই মনে হয়।"

মিয়াকি জুনকোর পাশে গিয়ে বসলো। আজ তাকে আরও বেশী বয়স্ক, এবং বিধ্বস্ত লাগছিল। কানের ওপরের চুলগুলো বড় হয়ে ঠেলেঠুলে বেরিয়ে এসেছিল বেশ খানিকটা।   
"কি ধরনের ছবি আঁকছেন ইদানীং?" জুনকো প্রশ্ন করে।

"ব্যাখ্যা করা মুশকিল।"

"আচ্ছা, তবে এটা বলুন যে সবশেষ কি আঁকলেন?"

"আমি ওটার নাম দিয়েছি 'ল্যান্ডস্কেপ উইথ ফ্ল্যাটআয়রন'। তিনদিন আগে মাত্র ওটা একে শেষ করলাম। শূন্য এক কামরায় স্রেফ একটা ধোয়া কাপড় ইস্ত্রি করবার যন্ত্র, মানে 'ফ্ল্যাটআয়রন' যেটাকে বলে।"

"তো এটার মানে ব্যাখ্যা করা এতো কঠিন কেন আপনার জন্য?"

"কারণ ওটা আসলে একটা ইস্ত্রি নয়।"

জুনকো মিয়াকির দিকে তাকায়, "ইস্ত্রিটা আসলে একটা ইস্ত্রি নয়?"

"না।"

"অর্থাৎ এটার ভিন্ন কোন অর্থ আছে?"

"সম্ভবত।"

"বা, প্রতীক হিসেবে বস্তুটিকে ব্যবহার করেছেন বলেই কেবলমাত্র আপনার পক্ষে ওটা আঁকা সম্ভব হয়েছে?"

মিয়াকি চুপচাপ মাথা নাড়ে।

জুনকো আকাশে তাকিয়ে দেখে সেখানে আজ তারার সংখ্যা বেহিসাবি ধরনের বেশী। চাঁদও ততক্ষণে অনেকটা হেলে প্রায় অস্তমিত হয়ে পড়েছে আকাশে। মিয়াকি এ যাত্রা তার হাতে ধরে রাখা লম্বা কাঠের টুকরাটাও ছুঁড়ে দেয় আগুনে। জুনকো কিছুটা তার কাছে সরে এসে বসে, যাতে তাদের কাঁধ ছুঁয়ে থাকে একে অপরের সাথে। মিয়াকির জ্যাকেট থেকে শক্ত কাঠপোড়া ঘ্রাণ আসছে। জুনকো লম্বা এক শ্বাসে তার সবটুকু ভেতরে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে।

"একটা কথা বলি?" জুনকো প্রশ্ন করে।

"কি?"

"আমার ভেতরটা না একদম খালি, শূন্য।"

"তাই?"

"হ্যাঁ।"

জুনকো চোখ বোজা মাত্রই হুহু করে তার দু'চোখের কোল ভেসে যায় পানিতে। সে তার ডান হাত দিয়ে মিয়াকির হাঁটু তার প্যান্টের ওপর দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখে। ঠাণ্ডায় থেমে থেমে কেঁপে ওঠে সে। মিয়াকি তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে রাখে কাঁধের ওপর দিয়ে, কিন্তু জুনকোর কান্না থামে না।

"সত্যি সত্যিই আমার ভেতরে কিছু নেই," সে ভাঙ্গা গলায় বলে ওঠে বেশ খানিকটা পর। "আমি পুরো শূন্য, আমার ভেতর কেবলমাত্র শূন্যতার হাহাকার।"

"আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা," মিয়াকি বলে।

"সত্যিই?"

"হ্যাঁ। আমি এই অবস্থার বিশেষজ্ঞ বলা চলে।"

"তবে বলুন আমি এ অবস্থায় কি করতে পারি?"

"ভালো একটা ঘুম এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।"

"কিন্তু আমার ভেতরের অবস্থা এতো সহজে সারাই হবার নয়।"

"হতে পারে আপনার কথাই সত্য, জুন। হতে পারে কাজটা অতো সোজা নয়।"

এইফাঁকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের কোন এক টুকরো কাঠে জমে থাকা খানিকটা পানি আগুনের আঁচে বাষ্পীভূত হবার আওয়াজ সহ ধোঁয়া ছ্যাঁত করে ওঠে। মিয়াকি চোখ সরু করে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে সেই অগ্নিকুণ্ডের দিকে।

"আমার কি করার আছে এখন?" জুনকো প্রশ্ন করে।

"জানি না আমি। আমরা একসাথে মারা যেতে পারি। আপনার ... মানে তোমার কি মত?"

"সুন্দর পরিকল্পনা। ভালো লেগেছে আমার।"

"তুমি সিরিয়াস?"

"একদম!"

ঘাড়ের ওপর দিয়ে জুনকোকে জড়িয়ে ধরে মিয়াকি চুপচাপ বসে থাকে। জুনকো তার মুখ মিয়াকির বহু ব্যবহারে পুরনো হয়ে আসা জ্যাকেটের চামড়ায় গুঁজে রাখে।

"যা হোক, এসো আমরা আগুন পুরোপুরি নিভে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি," মিয়াকি বলে। "আমরাই জ্বালিয়েছি ওটা, কাজেই ওটা পুরো নিভে যাওয়া পর্যন্ত আমাদের ওকে সঙ্গ দেয়া উচিৎ। যখন ওটা নিভে যাবে, যখন পুরো দুনিয়া কালো আঁধারে ছেয়ে যাবে, তখন আমরা মারা যাবো।" 

"ঠিক আছে," জুনকো বলে। "কিন্তু কিভাবে?"

"সে একটা রাস্তা ভেবে বের করা যাবে।"

"ঠিক আছে।"

আগুনের গন্ধে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে জুনকো চোখ বোজে। মিয়াকির যে হাত তাকে ঘিরে ধরে আছে, তা একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের অনুপাতে বেশ খানিকটা ছোট, এবং অদ্ভুতরকমের হাড্ডিসার। এই মানুষটার সঙ্গে আমি একসঙ্গে বসবাস করতে পারতাম না কখনো, জুনকো ভাবে। আমি তার হৃদয়ের ভেতরেও প্রবেশ করতে পারতাম বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু এই লোকটার সঙ্গে আমি মরতে পারি। এ কাজটা করাই যায়।

জুনকোর হঠাৎ চোখ ভেঙ্গে ঘুম এলো। নিশ্চয়ই হুইস্কি পানের ফল, ভাবে সে। বেশীর ভাগ কাঠ এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের এক বড় অংশ জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো কমলা রঙের আভা নিয়ে জ্বলছে। জুনকো তার ত্বকের ওপর সে অঙ্গারখণ্ড গুলোর উষ্ণ, হালকা ছোঁয়া অনুভব করতে পারছিল যেন সে মুহূর্তে।  ওদের পুরো পুড়ে নিঃশেষ হতে আরও বেশ খানিকটা সময় লাগবে।

"আমি যদি অল্প করে একটু ঘুমিয়ে নিই, কিছু মনে করবে?" জুনকো প্রশ্ন করে।

"কোনো সমস্যা নেই, তুমি ঘুমাও।"

"আগুন নিভে গেলে আমাকে উঠিয়ে দেবে তো?"

"ও নিয়ে চিন্তা কোরো না। আগুন নিভে গেলে তোমার ঠাণ্ডা লাগবে। তখন চাও বা না চাও নিজে থেকেই তোমার জেগে উঠতে হবে।"  

জুনকো মিয়াকির কথাগুলো মনে মনে আবার একবার স্মরণ করেঃ আগুন নিভে গেলে তোমার ঠাণ্ডা লাগবে। তখন চাও বা না চাও নিজে থেকেই তোমার জেগে উঠতে হবে। এরপর সে গুটিসুটি পাকিয়ে শুয়ে পড়ে মিয়াকির কোল ঘেঁষে, এবং দ্রুত গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

(হারুকি মুরাকামির 'আফটার দা কোয়েক' বইয়ের ভিন্টেজ পাবলিকেশন্সের অধীনে, জে রুবিনের করা ইংরেজিতে অনূদিত সংস্করন হতে গল্পটি  অনুবাদ করা হয়েছে ) 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়