X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

খানদান

বিপাশা মন্ডল
৩১ মে ২০২৩, ২২:২২আপডেট : ৩১ মে ২০২৩, ২২:২২

রূপা আপা এখনো বাবার বাড়ি এলেই প্রতিদিন রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায়, মানুষ দেখে। এখনো!

রূপা আপার চোখের নিচে চাকতির মতো হালকা কালো দুটো গোল দাগ। এছাড়া সবকিছুই আগের মতোই আছে। শুধু আগের মতো বলি কেন আগের চেয়েও উজ্জ্বল। দামি শাড়ি, সোনার গহনা, মুখের মোহনীয় হাসিতে ঝলমল করছে পুরো শরীর। তিন মাস আগে বিয়ে হয়েছে রূপা আপার, শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছে চারদিন আগে। বিয়ের আগে যেমন ঘর থেকে বেরিয়ে সহপাঠী বা সমবয়সি বান্ধবীদের সাথে নিয়ে বড়ো রাস্তার পাশের গলির মুখটায় দাঁড়িয়ে গল্প করতো এখনো তেমনি দাঁড়িয়ে। বেলা এগারোটা। আজ অবশ্য শুধু রিক্তাবুড়ি সঙ্গে। ওনাদের বাড়ির গৃহকর্মী। আমি রিকশা থেকে নামলে গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

“তুই কেমন আছিস সীমা?” তার ভরাট বুকের চাপে আমার দমবন্ধ প্রায়। বিয়ের আগে আমাকে জড়িয়ে ধরতেন আলতো করে। এবার একেবারে সুতো গলে না এমন নিষ্পেষণ। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নেই। রূপা আপার শরীরে মন কেমন করা মিষ্টি গন্ধ। বোধহয় পারফিউম পাল্টেছে। আগে তো শুধু জেসমিন স্প্রে ব্যবহার করতো। তিনমাসে তার সারা শরীরে লাবণ্য ফেটে পড়ছে। আরেকটু মোটাও হয়েছে। আমি শীর্ণদেহ কৈশোরের ঘাটেই তরী লাগানো ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী, কেউ আমাকে হিসেবে ধরে না। আমি সিনেমার নায়িকার কুৎসিত বান্ধবীর মতো পাশে দাঁড়িয়ে তার লীলা দেখি। এরমধ্যেই গলিতে ঢোকে শাহান ভাই। এপাড়ার বাসিন্দা। রূপা আপার বড়ো ভাই শান্ত ভাইয়ার সহপাঠী ছিল। ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ অফিসার হিসেবে জয়েন করেছে সদ্য। আমাদের দেখে মোটরসাইকেল থামায়। কি সুন্দর জাফর ইকবালের মতো চেহারা শাহান ভাইয়ার! আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কিরে পুচকা ভালো আছিস? খালাম্মা, তাজুল ভালো আছে?’ মন দমে যায়। আমি আর বড়ো হবো না বোধহয়। হাড়গিলে চেহারার আমাকে কে-ই বা বড়ো বলবে। আমি সম্ভবত ভূমিকা। এবার পূর্ণ প্রশংসার চোখে তাকায় রূপা আপার দিকে। ‘রূপা কবে আসছো?’

কথার জবাব দিতে গিয়ে রূপা আপার গলা একটু কেঁপে যায়। চট করে আমার বামহাতটা খামচে ধরে। ‘চারদিন হয়ে গেল, আপনার তো দেখাই পাই না।’

‘নতুন চাকরি, একটা ট্রেনিং ছিল, কদিন থাকবা?

রূপা আবার কথার জবাব দেবার আগে আমার হাতটা চটকাতে থাকে কনুইয়ের উপর থেকে হাতের আঙুল পর্যন্ত।

আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন পাশাপাশি বাসায় ভাড়া থাকতাম। তখন অনেকদিন রূপা আপার মা বাসায় না থাকলে আমি তার খাটে শুতাম তার ভূতের ভয় কাটানোর জন্য। কিন্তু কখনো তিনি এমন অদ্ভুত আচরণ করেননি। উনি আমাকে পান্তাবুড়ির গল্প কিংবা গোপাল ভাঁড়ের গল্প বলতে বলতে নিজেই কখন ঘুমিয়ে পড়তেন। আজ তার কী হল! আমার শরীরের মধ্যে কেমন ঘিন ঘিন করতে থাকে।

‘আছি দশদিন, চারদিন তো হয়েই গেল।’

‘আচ্ছা আসবো একবার, শান্ত কেমন আছে? ঢাকা থেকে আসছে? তুমি আসছো খবর পাইছে?’

‘ভাইয়া তো আসে নাই, বলছে বৃহস্পতিবার লঞ্চে উঠবে।’

শাহান ভাই আর রূপা আপা আরো সব এদিক ওদিক নানাপদের কথা বলে, আমি মাঝখান থেকে তীব্র অস্বস্তিতে ভুগতে থাকি। আমি সামনের ছোট্ট শীর্ণ খালের দিকে তাকিয়ে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছি। খাল জোয়ারের পানিতে টইটুম্বুর, একঝাঁক কচুরিপানার দাম ভেসে যাচ্ছে, সঙ্গে মানুষের মল, মরা বেড়াল, প্লাস্টিকের বোতল। ওর মধ্যেই গাঢ় নীল ও সাদা কচুরিপানার ফুল ফুটে আছে মাথা উঁচিয়ে। নিচের নোংরা ছাড়িয়ে শুধু ফুলগুলোকেই মেঘ জড়ানো আকাশের মতো দেখাচ্ছে। আমি মনে মনে ফুল গুণতে থাকি। এক, দুই, তিন, .. .. দশ, এগারো। হঠাৎ কি মনে হতে রূপা আপার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে অন্যরকম ঘোরলাগা দৃষ্টি, তাকিয়ে আছে শাহান ভাইয়ের দিকে। এবার বোধহয় শাহান ভাইয়েরও অস্বস্তি হয়। আবার মোটরসাইকেল স্টার্ট দিতে দিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘যাই রে পুচকা, ঠিকমতো লেখাপড়া করিস, ছাত্রানাং অধ্যায়ানাং তপঃ।’ একটু থেমে বলে, ‘রূপা যাই, দুলাভাই আসলে খবর দিও, শান্ত শুক্রবার আসলে আমিও আসবো, চাচীআম্মারে বলবা আনতাসা পিঠা বানাইতে। অনেকদিন চাচীআম্মার হাতের পিঠা খাই না।’

শাহান ভাই চলে যায়, রূপা আপার হাতের গতিও থেমে যায়, হঠাৎ একঝলক চৈত্রের হাওয়া দাপাদাপি শুরু করে খালপাড়ের দীর্ঘ মাথা নারকেলগাছগুলোর মধ্যে। আমার কেমন শিরশির করে। আমি নিজেকে ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেই। দ্রুত দু-পা এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশা দাঁড় করাই। রিকশা কাছে এসে থামতে থামতে রূপা আপা জোর পায়ে আমার কাছে আসে, ‘এখনই চলে যাবি সীমা, আমাদের বাসায়ও তো ঢুকলি না!’ আমার মধ্যে কেমন অস্বস্তি, বিবমিশা, অনীহা বাড়তে থাকে, দ্রুত বলি, ‘আরেকদিন আসবো আপা, মায়েরে নিয়া আসবো।’ রিকশায় উঠি। এতক্ষণ রিক্তাবুড়ির দিকে খেয়াল করিনি। সে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

বাসায় ফিরে প্রথমেই ঢুকি সিমেন্টের মেঝে ও বাঁশের খাপরার বেড়া দেওয়া গোসলখানায়, মা আমাকে দেখে গেট থেকে দরজা খোলার পর থেকেই পিছু নেয়। বলে, ‘কিরে বড়ো, এতো তাড়াতাড়ি ফিরর‌্যা আইলি, দেখা হইল রূপার সাথে, ও সুখে শান্তিতে আছে তো?’ জবাব না পেয়ে গোসলখানার দরজা পর্যন্ত চলে আসে, আমাকে দ্রুত গোসলখানায় ঢুকতে দেখে দরজায় দাঁড়ায়, ‘কী হইছে তোর, কথার জবাব দেও না কেন?’ আমি পাকা ঝিঙ্গার শুকনো খোসায় লাক্স সাবান নিয়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে জোরে জোরে বাম হাত ঘসি, ঘষতে ঘষতে লাল বানিয়ে ফেলি, মা এবার দৌড়ে ভিতরে ঢোকে, ‘কী হইছে ছেমড়ি তোর? খারাপ কিছু লাগছে, কিসে ঘষা খাইছ, সীম গাছ না ঢোঁড় কলমি?’ আমি মায়ের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দৌড়ে নিজের খাটে আসি। এসে হু হু করে চোখের পানি ছেড়ে দেই। আমার কেন এরকম লাগছে কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। এমনিতেই আমি বুঝি কম। তাই আমার বান্ধবীরা বলে আমার গণ্ডারের চামড়া। একদিন কাতুকুতু দিলে আমি নাকি তিনদিন পরে হাসি।

দুপুরে খাবার পরে পড়ার টেবিলে বসে বসে ঝিমাচ্ছি। মন থেকে মনখারাপের ছায়াটা কিছুতেই সরছে না। আব্বা অফিসে। ছোটো ভাই স্কুলে। মেঝ ভাইটার কি একটা ক্রিকেট ম্যাচ আছে। আম্মা সদ্য বসতে শেখা ছোটো বোন নীনাকে পাশে বসিয়ে সুপারি কাটছেন। দরজা খোলার আওয়াজ টের পাই। এরপর গলা পাই পাশে বাড়ির আম্বিয়া খালার। চাপা গলায় বলে, “ও সুন্দার বউ, রূপা নাকি ফিরানিতে আইছে?”

মাও চাপা গলায় বলে, “আইছে তো। বড়োরে পাঠাইছিলাম। হারামজাদি কিছুই ঠিক কইরা কয় না। খাওয়ার সময় খালি কইল রূপা নাকি আরও সুন্দার হইছে, মোটাতাজা হইছে।”

“তাইলে তো ভালোই আছে মনে কয়! আমরা ভাবলাম কী না কী? মানাইতে পারে, না পারে? কবীরের মতো রাজপুত্তুর পোলার সঙ্গে যার পিরিত ছেলো। সে কী ঐ রকম লিকলিকা শিং মাছের মতো পোলার সঙ্গে ঘর করবে!”

আমার মা কথার জবাব দেয় না। আমি এমনিতে হাঁদারাম হলেও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বুঝতে পারি, এখনই মা আমাকে দেখতে আসবে, আমি ঘুমাচ্ছি নাকি জেগে আছি। খুব দ্রুত খাটে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আম্মা ঝট করে দরজা খুলে নাকের নিচে ঠোঁটের উপরে হাত রাখে। এটা তার পুরোনো কৌশল, আমি না ঘুমানো থাকলে জোরে জোরে শ্বাস পড়বে। কিন্তু আমিও এখন ছোটো কৌশল শিখে গেছি। বিশেষ করে ছোটো বোন নীনা ঘুমানোর সময় ওর ঘুম লক্ষ্য করে করে নিজে প্র্যাকটিস করেছি। আমাকে অনেক কিছু জানতে হবে, বুঝতে হবে। আমার সহপাঠীরা আমাকে নিয়ে প্রায়ই হাসি ঠাট্টা করে, আমি কম বুঝি। আমার মা-ও আশেপাশের প্রতিবেশিনীদের সঙ্গে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে। ‘ট’ ও ‘ই’ বর্ণ শব্দ তৈরি করে কথা বলে। যেমন, বিকাল পাঁচটায় কলতলায় আইসো। এই কথাটাকে তারা কী সুন্দর ‘ট’ বর্ণ ব্যবহার করে বলে ফেলে, ‘বিট্টিকাল পিট্টাচটায় কিট্টল তিট্টলায় ইট্টাইসো।’ কী ভয়াবহ ব্যাপার! আব্বা, নরেশ মেসো, জাফর চাচা, সালাম খালুর সবার সামনে বসেই এরা কোড ল্যাংগুয়েজে কথা বলে যাচ্ছে আর আমিও এইসব বাপ চাচাদের সামনে তাদের মতোই হা করে তাকিয়ে দুর্বোধ্য কথাগুলোর মানে জানার জন্য প্রাণ ফাটিয়ে ফেলছি। অথচ আমি পড়াশোনায় একেবারে উপরের দিকের ছাত্রী। কিন্তু বইপড়া বিদ্যা এসব নিজস্ব কথাবার্তার কোনো রহস্য ভেদ করতে পারে না। রহস্যভেদ শিখিয়ে দিয়েছিলো ইঁচড়ে পাকা গ্রামের মেয়ে রঞ্জিতা। রঞ্জিতা কলেজে ভর্তি হয়েছিলো গ্রামের স্কুল থেকে চারবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে। আমাদের সঙ্গে ইন্টারে ভর্তি হয়। আমরা কদিন ওকে দিদি বলে ডাকছিলাম, কিন্তু দিদি ডাকলেই ও পায়ের জুতো খুলে কমনরুমের এমাথা ওমাথা তাড়া করতো। তখন কমন রুমের পিওন আছিয়া খালা বললো, ‘ও যখন পছন্দ করে না, ওরে তোমরা নাম ধইর‌্যাই ডাকো।’ যাহোক, রঞ্জিতা ইট্টিমিট্টি কথার কোড ভাঙানো শেখালো। এসব কথা ও অনেক আগেই শিখেছে ক্লাস ফাইভে থাকতে। ইঁচড়ে পাকা রঞ্জিতা অবশ্য শর্ত দিয়েছিলো, একদিন শুক্রবার সকাল থেকে বিকাল অবধি ও যে চাচার বাসায় থেকে পড়াশোনা করে সেখানে আমাকে বেড়াতে হবে। ও একাই একটা বড়ো রুম নিয়ে থাকে। আমাদের মতো টিনশেড বিল্ডিং নয়। ছাদ পেটানো একতলা বাড়ি। ছাদে উঠে ছেলেদের দেখা যায়। আমিও রাজি হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম, যাই একদিন, বন্ধুর বাড়িতে বেরিয়ে আসি। এরপর আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড মেহেরুন রঞ্জিতা বিষয়ে যা বলেছিলো সে কথা শোনার পর আমি ওদের বাড়ি বেড়াবার শর্ত ভেঙে ওকে অবলীলায় এড়িয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, রঞ্জিতার মতোও নয় রূপা আপার বিষয়, আরো অন্য কিছু, আরো গভীর কিছু। কিন্তু আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

মা এবার চোখের তারার উপরে আঙুল রাখলেন। যদি চোখের তারা নড়ে তাহলে বোঝা যাবে আমি ঘুমাইনি। আমি হঠাৎ রাণীক্ষেত রোগে মরে যাওয়া আমার প্রিয় লালু মুরগিটার মতো চোখ স্থির রেখে শুয়ে থাকলাম। তবে চোখ খোলা রেখে নয়, বুজে। আমার মা নিশ্চিত হলেন, আমি ঘুমাচ্ছি। মা এবার পা টিপে টিপে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। এবার আরো পায়ের শব্দ পেলাম। রেবতী মাসি নিশ্চয়ই। এতখানি থপথপ শব্দ করে উনিই হাঁটেন। আমাদের বাড়ি অনেকদিন আগে তৈরি। দাদার আমলের। ঘরগুলোর দরজা বেশ চওড়া চওড়া। সফুরা ফুফুদের নতুন স্টিলের ফ্রেমের দরজার বাড়িতে রেবতী মাসিকে কাত হয়ে ঢুকতে হয়। এখন অন্তত একশ বিশ কেজি ওজন ওনার। আমাদের বাড়িতে তার জন্য ভারী একটা কাঠের চেয়ার নির্দিষ্ট করা আছে। হাল ফ্যাশানের প্লাস্টিকের টুল বা চেয়ারে বসলে নিশ্চিত ভেঙে পড়বে। এই সব আড্ডা হয় বাড়ির পিছনের দিকে চৌকি পাতা আমার মায়ের বিকালের বিশ্রাম ঘরে। মা পান খান আর আড্ডা মারেন বান্ধবীদের নিয়ে। বসার ঘরে বা বাবা-মায়ের শোয়ার ঘরে না। সৌভাগ্যবশত মায়ের বিকালের বিশ্রামের ঘরের পাশের ঘরটাই আমার শয়নঘর। যার জন্য আমি ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠছি। নয়তো আমি বোধহয় পিএইচডি ডিগ্রি করার পরেও আসলে বড়ো হতে পারতাম না।

মা বলেন, “পানটা মুখে দিয়া লও রেবতীদি।” আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন দুই পোন পান লাগে। একেক পৌনে আশিটা পান থাকে। বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে পান কিনে আনেন। ঢালের মতো একেকটা পান। আমি পানগুলো পুকুরের পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে ধোওয়ার সময় দুএকটার বোঁটা ছিড়ে দিই। কী সুন্দর পরিপূর্ণ একটা হার্ট হয়ে ভেসে থাকে পুকুরের জলে। কিন্তু হার্ট তো লাল রঙের! দেখেছি সায়েন্স পড়া মেয়েগুলোর খাতার বিবরণীতে।

মা গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করেন, “আম্বিয়া বু, কী কবো কও! ওরা যখন আমাগো পাড়া দিয়া বাসা বদলাইয়া গেলো, আমার পরাণটা ফাইট্যা গেছিলো। কইতে লজ্জা নাই, আমি আমার সীমার চাইতেও বেশি ভালোবাসতাম মাইয়াডারে। পরির নাহান সুন্দার মাইয়াডা। কেমন ডাগরডোগর চেহারা, ভাসা ভাসা দুইখান চোখ।”

আম্বিয়া বু ফোড়ন কাটে, “আমরা সক্কলে ওরে ভালোবাসতাম। এতো মিশুক এট্টা মাইয়া।”

মা কথার খেই ধরে, “একদিন গিয়া দেহি, পাশের বাড়ির মালিকের ছোডোপোলা কবীরের লগে একরুমে ফিসফিস করতেছে। অগো বাসায় কেউ নাই। এরপর আরো কিছু বোঝলাম। মাইয়ার আর দোষ কী কও। বাপে ক্লাস নাইন থিক্যা বিয়ার পাত্র খোঁজে। মাইয়া তো বিয়ার মানে আগেই বুঝছে। ডাক্তার না হইলে মাইয়া বিয়া দিবো না। কেনরে বেটা, কবীর কী দোষ করছিলো! রাজপুত্রের মতো চেহারা। বাজারে তিনটা দোকান আছে। তা না। এক গোঁ! মাইয়ারে বিয়া দিয়া ডাক্তার জামাই লাগবে! কসাই বাপটা! খালি খানদানি দেমাগ!”

রেবতী মাসি বলে ওঠে, “হুদাই, হুদাই। মাইয়াটার জীবনটা শেষ কইরা দিলো।”

আম্বিয়া খালা মিন মিন করে বলার চেষ্টা করে, “বিয়ার পানি গায়ে লাগার পরে যদি চেহারা খোলতাই হয়, তার মানে তো সে বিয়ায় সুখী হইছে। তার জীবন শেষ হয় নাই। তাইলে আমাগো আর চিন্তা কইরা দরকার নাই।”

আমার মা ধমকিয়ে ওঠে, “এইডা কী কইলা বু? বাইরের জেল্লাডাই দেখলা, পরাণের মধ্যো যে পুইর‌্যা ছারখার হইয়া যাইতেছে সোনার মূর্তি মাইয়াডার সেইটা দেখলা না! শিং মাছের মতো কালা কাসুন্দি একটা জামাই।”

রেবতী মাসি মায়ের কথার সুরে সুর মিলিয়ে গমগমে স্বরে বলে, “এক্কেরে আমার কপাল পাইছে মাইয়াডা।”

আমি বিছানায় শুয়ে মুখের মধ্যে কাঁথা গুঁজে হাসির দমক ফিরাই। রেবতী মাসির ওজন যদি একশ বিশ কেজি হয়, নরেশ মেসোর ওজন একশ দশ কেজির কম হবে না। এটা ঠিক রেবতী মাসি টকটকে ফরসা আর নরেশ মেসো ভাতের পাতিলের তলার মতো কুচকুচে কালো। কিন্তু তাকে কিছুতেই শিং মাছ বলা যাবে না, বড়োজোর হৃষ্টপুষ্ট কালিবাউস মাছ বলা যেতে পারে।

আম্বিয়া খালা যেন আমার চোখের সামনের আবছায়া পর্দাটা সরিয়ে দেবার জন্যই আবার পিছনে ফিরে যায়, “ঠিক কইছ গো সীমার মা, আমিও দুইদিন দেখছি রূপা আর কবীররে, রূপাগো ঘরেই, এক্কেরে জাপটাজাপটি অবস্থা।”

আমি খাটের উপরে সটান উঠে বসি, আমার সারা শরীরের রক্ত খুব দ্রুত প্রবাহিত হতে থাকে। পুরো শরীর আগুনের হলকার মতো গরম হয়ে ওঠে। নিজের কপালে নিজেই হাত দিই। জ্বর এলো নাকি! আমার নড়াচড়ায় খাটে মচমচ শব্দ হয়। কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো, মা তার সখীদের সঙ্গে গল্পে এতো মগ্ন যে আমার উঠে বসা টের পায় না। নয়তো লুকিয়ে বড়োদের কথা শোনার অপরাধে এতক্ষণে আমার হাত-পায়ের উপরে রুটি বেলুনি অথবা বড়ো মাছ ভাজার খুন্তির এলোপাথাড়ি আছড়ে পড়ায় আমার কালো ঘেঁষা শ্যামবর্ণ লাল লাল হয়ে দড়া দড়া ফুলে উঠতো। আবার সন্তর্পণে কাঁথাটা আঁকড়ে ধরে শুয়ে পড়ি।

রাত্রে আব্বা ভাত খাবার সময় যখন একেবারে সাধারণভাবে বলে ওঠে, “কবীরের বিয়া ঠিক হইছে জানো?”

মা আকাশ থেকে পড়ে, “কী কও? কোথায় শোনলা?”

“অফিস ফেরত পান কেনার পরে ভাবলাম, যাই ছেমড়াডারে দেইখ্যা আই, কেমন আছে। কী করতেছে। ওগো দোকানে দেখি ওর আব্বায় বসা। আমারে দেইখ্যা চা আনাইল। একটা লিস্ট দেখাইল, বিয়ায় মেহমানগো লিস্ট। প্রথমেই রূপাগো নাম, এরপর আমাগো নাম। কত সম্মান দেলো আমাগো বলো!”

আমি এক লহমায় বুঝে ফেললাম। রূপা আপা আর কবীর ভাইয়ের বিষয়টা বড়োদের কাছে ওপেন সিক্রেট। আমি আসলেই হাঁদারাম। নিজে যেমন দিনভর সহপাঠী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ক্যান্টিনে চা সিঙ্গাড়া খাই। কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য গলার ওড়না গাছ কোমর বেঁধে রিহার্সাল করি। ওদের সঙ্গে আড্ডা মারি। রূপা আপা কবীর ভাইরে ওদের বাসায় একসঙ্গে দেখে ভাবছিলাম আমার মতোই ঐরকম নির্দোষ আড্ডা দেয় ওরা। কিন্তু বিষয়টা গভীর ও আঁশটে। মা জবাব দেয়, “কবীররে দেখলা? ওর সঙ্গে কথা হইলো? কোথাকার মেয়ে?”

“মেয়েটারে তুমি চিনো সুন্দার বউ। রূপার বান্ধবী। তয় রূপার মতো গবেট মার্কা ছাত্রী না। রূপা তো মাত্র ইন্টার পাশ করলো খোড়াইতে খোড়াইতে। মাইয়াটা আমাগো সীমার মতো খুব মেধাবী। বিএ পাশ দিছে। এমএ পড়তেছে। সায়মা। ঐ যে মোক্তারপাড়ার শেষে পুকুরওয়ালা একতলা দালানের বাড়িটা। ঐ বাড়ির ছোটো মাইয়া।”

“কী কও? ওগো বড়ো মাইয়া আসমারই তো বিয়া হয় নাই!”

“আসমারও বিয়া ঠিক হইছে ঐ একদিনেই দুই বইনের বিয়া হইবে।”

“একদিনেই? কবীরের লগে বিয়ার সম্বন্ধের ঘটকালি কে করলো তাজুলের আব্বা?”

আমি অকারণে একগ্লাস পানি খেতে খাবার ঘরে ঢুকি। আব্বা আমাকে মেধাবী বলছে। যাক আব্বার চোখে তো আমি ভালো ছাত্রী, একটা অন্তত গুণ আছে। আব্বার দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাই। কিন্তু আব্বা আমার দিকে তাকায় না। কবীর ও সায়মার বিয়া নিয়া কথা বলতে ব্যস্ত। আব্বা খাওয়া শেষ করে থালায় পানি ঢেলে বলে, “এইটাই সবচাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার। কবীরের লগে বিয়া ঠিক করছে সায়মার প্রাণের বান্ধবী রূপা! কবীরের আব্বাও হতভম্ব হয়ে গেছে!”

আম্মা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়লেন। আমিও দ্রুত নিজের ঘরে পালালাম নীনাকে কোলে নিয়ে। কারণ কখন যে আমার মায়ের মতিগতি কেমন হয় কেউ গ্যারান্টি দিতে পারবে না। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ খুন্তি দিয়ে বাড়ি শুরু করে, বড়োদের কথা শুনছি কেন এই অপরাধে। কিন্তু নিজের ঘরে ঢুকেও কান খাড়া করে থাকলাম। এদিকে মনে মনে বুঝলাম, রূপা আপা শুধু সুন্দরী আর স্বাস্থ্যবতীই নয়। তার মধ্যে জগতসম্মোহনী একটা ক্ষমতা আছে। নয়তো নিজের প্রেমিকের সঙ্গে নিজেরই প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর বিয়ের দূতীয়ালী কীভাবে করে? আর সবগুলো পরিবার সেই ধরনের প্রস্তাবে রাজিই বা হয় কীভাবে? এমনকি আমিও তো আজ সকালের আগে পর্যন্ত রূপা আপার বিষয়ে কীরকম মোহগ্রস্ত ছিলাম!

কবীর ভাইয়ের বিয়ের দিন রূপা আপা তার বান্ধবী সায়মাকে নিজের হাতে সাজাবে বলে গোঁ ধরলো। এই বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য দশদিনের জন্য বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসার পর্বটাকে রূপা আপা তার স্বামী আকমল জাহানকে বলে কয়ে দেড়মাস করলো। কবীর ভাইরা তার পরিবারের নিকট প্রতিবেশী। এদিকে সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর সঙ্গে নিকট প্রতিবেশীর পরিবারের বিবাহ। কী করে রূপা এতবড়ো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ফেলে এখন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ঘরসংসারে মন বসাতে পারে? স্ত্রীকে আগেই এতো বেশি ভালোবেসে ফেলেছে যে, আকমল জাহান বউকে নিজের বাড়ি নিতে এসে একা একাই বাড়ি ফিরে গেলো। আবার বলে গেলো, তার চেম্বার শুক্রবার বন্ধ থাকবে তাই সে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকালের লঞ্চে উঠে রাত দশটার মধ্যে শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত থাকবে। আবার শনিবার দিন সকাল সাতটার লঞ্চে গিয়ে বারোটার মধ্যে ফিরে গিয়ে ডাক্তারখানা খুলবে। উঁচু দাঁত, মাথায় কম চুল গায়ের রং মিশমিশে কালো লোকটাকে আমার বিয়ের দিনও খারাপ মনে হয়নি, এবারেও খারাপ মনে হলো না। তবে আকমল দুলাভাইয়ের সঙ্গে মা, আম্বিয়া খালা, সফুরা ফুফু, রেবতী মাসি ও অজুফা আন্টির ব্যবহার আমাকে হতভম্ব করে দিলো। পিছনে তারা দুলাভাইকে কালাকুষ্টি শিং মাছ বলে, আর সামনে এসে তারা পারলে যেন গায়ের আঁচল দিয়ে ফ্লোর মুছে মুছে দুলাভাইকে পা ফেলার জায়গা করে দেয়। হরেক রকম পিঠা, পোলাও-বিরিয়ানি, ভাজি-ভর্তা, পাঁচরকম ডাল, কোফতা, বড়ি দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করলো তার আর শেষ নাই। দুলাভাই শ্বশুরবাড়ির এবং স্ত্রী ও শাশুড়ির শুভাকাঙ্ক্ষীদের আদরে আপ্যায়নে দম আটকে মরে যায় আরকি। আমার মন একেকবার বিদ্রোহ করে উঠতে চাইতো, বলে দিতে ইচ্ছা করতো, কী এদের প্রশংসায় গলে পড়ছেন? আসলে এরা কেউই আপনাকে পছন্দ করে না। পরে যেন রূপা আপাকে টর্চার না করেন সেজন্যই এই আদর-আপ্যায়নের ঢং!

কিন্তু চাইলেই কি এসব বলা যায়? না কেউ এসব বিশ্বাস করবে? আমি হাড়গিলে সীমা। আমার বিশ্বস্ততার সীমা শুধু বই পড়া আর ছোটো ভাইবোনদের সামলে রাখার মধ্যে।

বিয়ের দিন এসে পড়লো। আমাদের পাড়ার প্রায় সবগুলো পরিবার সপরিবারে কবীর ভাইদের বাড়ির অতিথি। রূপা আপাদের বাড়ির সবাইও কবীর ভাইদের বাড়িতে নানা কাজে ব্যস্ত। রূপা আপা সকাল সাতটার সময় তিন ঘণ্টা ধরে সায়মা আপাকে সাজিয়ে দিয়ে এসেছে তাদের বাড়ি গিয়ে। মাইক্রো আর বাস ভর্তি করে করে ছেলেরা সবাই কবীর ভাইয়ের বিয়ের বরযাত্রী যাচ্ছে সায়মা আপাদের বাড়ি। বর যাবে সব শেষে বিকেলবেলায়। এক জেলা শহরের এ মাথা ওমাথায় বর ও বউয়ের বাড়ি। প্রাইভেট কারে করে যেতে মাত্র দশ মিনিটের পথ। আমার একটু বরযাত্রী হতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু মা চোখ গরম করে তাকালো। এছাড়া ছোটো নীনা আমার দায়িত্বে। মা কাজে ব্যস্ত কবীর ভাইদের পাকঘরে। আমি আর কবীর ভাইয়ের ছোটো বোন ক্লাস টেনে পড়া নুসরাতের সঙ্গে তাদের বাড়ির উঠানে মেহেদি গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে গল্প করছি। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে রূপা আপা আমার হাত টেনে নিয়ে বললো, “তুই একটু আমাদের বাড়ি যা তো সীমা। তোর দুলাভাই একা পড়ে গেছে। তার সঙ্গে গল্প করার কেউ নেই।”

রূপা আপা আবার আমার হাত ধরাতে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। রূপা আপা সেটা খেয়াল করে ঝট করে হাত ছেড়ে দিলো। নুসরাতকে বিদায় জানিয়ে আমি নীনাকে কোলে নিয়েই রূপা আপাদের বাড়ি এলাম। দুলাভাই একা একা মুখ কালো করে বিটিভিতে খবর দেখছে। ১৯৯৭-৯৮ সাল। তখনও আমাদের জেলার সব বাড়িতে ডিশ এন্টেনার লাইন পৌঁছায়নি। আমার মনের মধ্যে অনেক কষ্ট হলো বেচারার জন্য। কিছুক্ষণ পরে রেবতী মাসি এসে আমাদের চা ও নাস্তা দিয়ে গেলেন। আমরা সেগুলো খেলাম। রেবতী মাসি খালি ডিসগুলো নিতে এসে বললো, “সীমা তোদের নতুন দুলাভাইরে কি আমাদের বাড়ি দেখাবি না? দুইটা রিকশা নিয়া সেবন্তী, তুই আর পিপলু আমাগো ঘরবাড়ি দেখাইয়া নিয়া আয়। তাইলে তো জামাই পরেও একা একা আমাদের বাড়ি বেড়াইতে যাইতে পারবে।” আমারও মনে হলো, এতো ভিড় হট্টগোলের মধ্যে না থেকে একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। আমার পোষা বিড়ালটা ও মুরগিগুলারে বিকালের খাবারও এই দুপুরেই দিয়ে আসি। রেবতী মাসি চট করে তার পুরোনো তেলচিটে পার্স ব্যাগটা থেকে বিশ টাকা বের করলো রিকশা ভাড়া হিসাবে। আমি খুব অবাক হলাম। কিপটা হিসাবে রেবতী মাসির যথেষ্ট দুর্নাম আছে। আকমল দুলাভাইয়ের কালো মুখ এবার হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আনন্দে। ঘর থেকে বের হতে পারবে বেচারা, ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারবে। ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই রেবতী মাসির মেয়ে ফাইভে পড়ুয়া সেবন্তী আর আম্বিয়া খালার ছোটো ছেলে এইটে পড়ুয়া পিপলু এসে হাজির। ওদেরও বোধ হয় খবর দিয়ে আনানো হয়েছে। নীনা তো টই টই করে ঘুরে বেড়াতেই খুশি। ও ছোট্টো ছোট্টো দুই হাতে হাত তালি দিয়ে উঠলো। আমি ওর মুখের লালা ওড়নার খুঁটে মুছে নিয়ে সেই রাস্তার মোড়ে গেলাম যেখানে দাঁড়িয়ে রূপা আপা আমার হাত ধরেছিলো। একটা রিকশা ঠিক করে পিপলু আর দুলাভাইকে তুলে দিলাম। আরেকটা রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি, সেবন্তী আর নীনাকে নিয়ে উঠব। হঠাৎ সেই দিনের মতো নারকেল পাতার মধ্যে সরসর হাওয়া উঠল আর আমার বুকের মধ্যেও কেমন করে উঠল। মনে হলো কী যেন একটা আছে, গোপন কিছু! কী যেন একটা ভুল হচ্ছে কোথাও! নীনাকে সেবন্তীর হাতে দিয়ে বললাম, “ওকে শক্ত করে ধরে রাখিস। আর কয়টা টাকা নিয়ে আসি মাসির কাছ থেকে। একটা কোকাকোলা কিনবো। একটা কেকও তো কেনা উচিত, বল! দুলাভাই প্রথমবার আমাদের বাড়িতে যাচ্ছেন।” সেবন্তী একবার জুলজুল করে আমার গলায় ঝোলানো ছোটো কাপড়ের ব্যাগটার দিকে তাকালো। আব্বা আমাকে যথেষ্ট হাত খরচ দেয়। ও জানে ওখানে পর্যাপ্ত টাকা আছে কেক ও কোক কেনার মতো। আমি কিপটেও নই। বাড়িতেই মুরগির ডিম আছে। ঘরে পাউরুটিও আছে। কিন্তু ও কেন যেন কিছু বলল না আজ। দুলাভাইদের রিকশা অনেকটা এগিয়ে গেছে। আমি সেবন্তীকে একটু ঠেলে গলির ভিতরে দাঁড় করিয়ে রেখে দ্রুত পায়ে প্রায় দৌড়ে গেলাম রূপা আপাদের বাড়ির কাছাকাছি। দাঁড়ালাম কিছুটা দূরে। একদম খালি বাড়িটার মধ্যে রূপা আপা ঢুকল হাতে অনেকগুলো শপিংব্যাগ নিয়ে। দরজা লাগালো না। আলগা দরজায় সঙ্গে সঙ্গে রেবতী মাসি বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিল। এরপর সে দ্রুত পায়ে রূপা আপাদের বাড়ির গলির মুখোমুখি দু-বাড়ি পরে কবীর ভাইদের বাড়ির পাশে গিয়ে কবীর ভাইয়ের রুমের জানালায় টোকা দিলো। রেবতী মাসির হাতে রূপা আপাদের বাড়ির চাবি। কবীর ভাই জানালা খুলল, চোখ দুটো জবাফুলের মতো রক্তলাল। বিয়ের আগে জানি মেয়েরা কাঁদে, ছেলেরাও কি কাঁদে! রেবতী মাসির হাত থেকে চাবি নিলো সে। আম্বিয়া খালা কবীর ভাইদের বাড়ির পেছনের গেটটা খুলে সন্তর্পণে এদিক ওদিক তাকালো। আমাকে দেখতে পেলো না। আমি বড়ো বড়ো পাতার থোকা টগর গাছটার পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখছি। কবীর ভাই চাবি হাতে রাস্তায় বেরিয়ে এল। রেবতী মাসি কবীর ভাইদের বাড়ি ঢুকে গেল। আম্বিয়া খালা এবার দ্রুত পিছনের গেট বন্ধ করে দিলো। কবীর ভাই রূপা আপাদের ঘরের দরজার সামনে। আর দাঁড়ালাম না আমি ওখান থেকেই আবার উলটা ঘুরে গলি ধরে ছুটতে ছুটতে বড়ো রাস্তার দিকে গেলাম। ওখানে সেবন্তীর কোলে দুবছরের ছোটোবোন নীনা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার