X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরজোনের অধিপতির পতন

জিয়া হাশান
১০ জুলাই ২০২৩, ১৬:৫০আপডেট : ১০ জুলাই ২০২৩, ১৬:৫০

—আমার টেবিলে কারা? তার দুই চেয়ারে মুখোমুখিতে বসা কে কে?

তাদের দেখেই ভার্সিটির উত্তরজোনের অধিপতি, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রুবেলভাই হলের ক্যান্টিনের দরজায় থমকে দাঁড়ান। তার দেখাদেখি আমরা, মানে তার সাথে থাকা জনচারেক তার সাঙ্গপাঙ্গ, পুরাদস্তুর শিষ্য-সাগরেদ, একইসঙ্গে দাঁড়াই। সামনে আর পা বাড়াই না।

ভার্সিটির ফরিদউদ্দিন হলের ক্যান্টিনের ওই টেবিলটা একেবারে যুৎসই জায়গায়। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণায় তার আসন। তাতে বসে পুরো ক্যান্টিনে চোখ ফালানো, সবাইরে নজরের আগায় রাখা সম্ভব হয়। তাই টেবিলটা রুবেলভাই ও আমাদের জন্য সার্বক্ষণিক বুকড করা, পুরাদস্তুর রিজার্ভে রাখা। তার আগামাথাজুড়ে যেন সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের অদৃশ্য নোটিশ আঁটা—এখানে সাধারণ ছাত্রদের বসা নিষেধ।

কিন্তু এই কঠোর, আপাদমস্তক ইস্পাতে মোড়া বিধিবিধান, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিরে বুড়া আঙুল দেখায়ে, পুরোপুরি উপেক্ষায় থিতু করে, তাতে ওদিকে মুখ ফিরায়ে বসা, দূর থেকে চেনা-জানার বাইরে এরা কারা?

তাদের দেখে নিতে যেন রুবেলভাই শেষে পা বাড়ান। দরজা থেকে ক্যান্টিনের ভেতরে আগান। সাথে সাথে আমরা, আজকাল যাদের ‘সহমতভাই’ও বলা হয়, তারা সবাই রুবেলভাইয়ের সাথ নেই। পিছু পিছু আগাই।

বেশি দূরের তো পথ না, গোটা সাতেক টেবিল আর তাদের ঘিরে ধরা ডজনদেড়েক অনুজ, পিছনে দাঁড়াঅলা চেয়ারের বগলতলা ধরে আগায়ে কাছে, একেবারে হাতের নাগালে পৌঁছেও রুবেলভাই তার জন্য নির্ধারিত টেবিল আঁকড়ে বসা দুই বান্দারে চিনতে পারেন না। তাই চড়া গলা তোলেন—তোরা কারা, অ্যাঁ?

চোরে চোরে যেমন মাসতুতোভাই, একজন আরেকজনরে এক নজরেই চিনতে পারে, তেমনি আমরা, মানে রুবেলভাইর সাঙ্গপাঙ্গরা, আমাগো জাতভাই—ক্যাম্পাসের দক্ষিণজোনের অধিপতি হিরুভাইর দুই সাঙ্গপাঙ্গরে কাছে গিয়া একবার দেখেই চিনে ফেলি—আরে এতো আবির আর জামিল।

তবে বুঝতে পারি যে, এরা দুজনই হিরুভাইর ছোটোজাতের মানে নমশুদ্র লেবেলের সাগরেদ। একেবারে সদ্য নিয়োগ দেয়া ক্যাডার বলা যায়। তাই এখনো রুবেলভাইর চেনাজানার একেবারে বাইরে রয়ে গেছে।

কিন্তু এমনিতে ক্যাম্পাসের এক জোন থেকে আরেক জোনে সাঙ্গপাঙ্গদের যাতায়াত নেই বললেই চলে। তারপর উত্তর ও দক্ষিণ জোনের দুই অধিপতি—রুবেলভাই ও হিরুভাইর মধ্যে আজকাল বিরোধ-বিসংবাদের যে জমজমাট আসর, একেবারে পাথরে পরিণত হওয়া দ্বন্দ্ব, তাতে তো হিরুভাইয়ের সাঙ্গপাঙ্গদের কারো উত্তরজোনে আসা, তারপর তার ক্যান্টিনের সবচেয়ে যুৎসই টেবিলে গ্যাট হয়ে বসা তো রীতিমতো দুঃসাহসের কাজ, জ্বলন্ত আগুনে ঝাপ দিয়া আত্মাহুতি দেবার মতো কারবার। তাই আমরা প্রায় সবাই সমস্বরে বলে উঠি—তোরা এহানে কী করোস?   —আমাগো হিরুভাই পাডাইছে।

ব্যস, হিরুভাইর নাম উচ্চারণের সাথে সাথে রুবেলভাইর রক্তে যেন জ্বলন্ত কাঠি পড়ে, মুহূর্তে তা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে—জেনেশুনে থাবা বাড়ায়ে ধরা বাঘের খাঁচার ভেতরে রুবলভাইর কর্তৃত্বাধীন জোনের সেন্টার পয়েন্টে, ক্যান্টিনের টেবিলে আগে পাঠানোর কারণ কী? তাই রুবেলভাই একেবারে গর্জে ওঠেন—ক্যান পাডাইছে?

—হিরুভাই আমাগো ক্যান্টিনের এ্যাই টেবিলে আইসা বইতে কইছে।

হিরুভাইয়ের প্ল্যানটা কী? শুরুতে টেবিলটা দখলে নেয়া, তারপর একটু একটু করে সাততলায় খাড়া পুরা এই হলটারে হাতের মুঠোয় পোরা? শেষে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে লোভনীয় এই জোন, রুবেলভাইর কর্তৃত্বে থাকা উত্তরাংশটা একেবারে কব্জায় নেয়া?

হিরুভাইর সে প্ল্যানরে একেবারে অঙ্কুরেই, গাছ গজাবার, মাথাচাড়া দিয়া উঠবার আগেভাগেই, তার দুই সাগরেদের রিজার্ভ টেবিলে যুৎসই হয়ে বসামাত্রই তাগো ঘায়েল করার জন্য আমাগো পানে হুকুম দেবারও তর সয় না রুবেলভাইয়ের। বরং সে নিজেই তার হাতের একেবারে কাছে থাকা আবিরের জামার কলার চেপে ধরেন—‘হারামজাদা, আমার এরিয়ায় আমার হুকুম চলবে। এহানে তোর বস হিরুর গুষ্টিমারি।’

তারপর আবিররে আর কিছু বলার ফুরসত না দিয়া মুহূর্তের মধ্যে তার তলপেট বরাবর পরপর গোটাচারেক ঘুষি চালান। একেবারে আচমকা আক্রমণের কবলে পড়ে আবির অচিরেই নেতায়ে যায়। দুচারটা গোঙানির মাথায় একেবারে ঠান্ডা মেঝেতে আশ্রয় নেয়। তার উপর রীতিমতো উপুড় হয়ে পড়ে। 

তারে কুপোকাত করার পর শুরু হয় তার সাথি জামিলের পালা। তবে দুচার ঘুষি হজম করেও সে খাড়ায়ে থাকে। কেবল ধনুকের মতো পুরো শরীরটা বেঁকে যায়। ঘায়ে ঘায়ে একেবারে পর্যুদস্ত হওয়া পেটটারে দুহাতে চেপে ধরে সে গোঙানিতে পা দেয়। অনেকটা অবিরাম তা চালায়ে যায়।

আজ বাঘ খেপেছে, নিজের হাতেই শিকার ধরায়, মারামারিতে নেমেছে। সুতরাং কারোরই আজ আর রক্ষা নাই। সব তছনছ করে একেবারে হেস্তনেস্তে নিয়া তবেই ছাড়বে। তাই ক্যান্টিনের আর সবাই, খাওয়া-দাওয়ারে আধাআধিতে রেখেই পাত্তারি গুটায়। ছোটাছুটিতে গিয়া মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যায়। ফলে পুরো ক্যান্টিন, আমরা ছাড়া বাকিটা একেবারে ফাঁকায় রূপ নেয়।

ক্যান্টিনজুড়ে তখন শুরু হয় কেবল আমাগো দাপট। তাই ইচ্ছে করলে এই দুটোরে, হিরুভাইর দুই নবীন ক্যাডাররে আরো দুচার ঘায়ে ঘায়েল করে কিংবা কোমরে গুঁজে রাখা তবে হাতের মুঠোয় পোরা সম্ভব এমন ছোটোখাটো হাতিয়ারের হাওলায় ফেলে একেবারে খতমের ঘরে নিয়া ক্যাম্পাসের উত্তরজোনের ওপারের জঙ্গল এলাকায় ছুড়ে ফেলে দিলেও কারো কিছু করার নাই।

যেন তার প্রস্তুতি নিতেই রুবেলভাই ঘায়েল হওয়া হিরুভাইর দুই ক্যাডাররে সার্চ করতে বলেন—দ্যাখ, গ্যাঞ্জাম পাকানোর মতো কোনো হাতিয়ার-বাটল, বোমা-ককটেল কিংবা ছুরি-কাঁচি অগো লগে আছে নাকি।  

সাথে সাথে আমরা হাত চালাই। আহত আবির ও জামিলের দেহ তল্লাশিতে নামি। তাগো দেহ হাতড়াই। আগাগোড়া সায়ের শেষে রেজাল্ট জানাই—না বস, লগে কিছু নাই। একেবারে ফকফকা।

তাহলে তো খতমের ঘরে ফেলা একেবারে সহজ। অগো বাদ-প্রতিবাদ করার কিংবা এতোটুকু গ্যাঞ্জাম পাকানোর আর কোনো সুযোগ নাই। বরং হাতের নাগালে রেখেই অগো উপর মুঠোয় পোরা সম্ভব এমন হাতিয়ার বার দুই চালালেই কাজ হায়ে যাবে। একেবারে জনমের তরে উত্তরজোনে পা দেবার, তার সেন্টার পয়েন্টে এসে বসার সাধ মিটবে।

রুবেলভাই যেন সে প্ল্যান ফাইনালে নিতে চারদিকে তাকান—না, আশেপাশে এখন কাউরেই আর দেখা যাচ্ছে না। এমনকি উঁকিঝুঁকিতেও কেউ নাই।

সরকারি দলের ছানা-পোনা, মানে কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ুয়াদের সংগঠনের হাতের মুঠায় পোরা এ ভার্সিটির ক্যাম্পাস এলাকা এখন মোটামুটি চারটা ভাগে ভাগ। দিকের নামের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তাদের নামকরণ। পূর্ব ও পশ্চিম জোনের অধিপতি, মানে একেবারে চূড়ার লিডার—আনোয়ার ও মান্নানভাইয়ের সাথে রুবেলভাইয়ের অনেকটা সখ্যভাব। তারা যেমন নিজ নিজ জোনটুকুতেই কেবল আধিপত্য করে বেড়ান, রুবেলভাইর এরিয়া নিয়া এতটুকু মাথা ঘামান না, রুবেলভাইও তেমনি তা-ই করেন। তাদের কোনো ব্যাপারে নাক গলানো তো দূরের কথা অনেকটা যেন ফিরেও তাকান না।

কিন্তু তার জোনের মুখোমুখিতে খাড়া দক্ষিণের অধিপতি হিরুভাইরে নিয়া যত মুশকিল। সে যেমন পুরো ক্যাম্পাস বিশেষ করে উত্তরজোনরে হাতের মুঠায় নিতে, নিজের বগলতলায় ঢুকাতে সদাতৎপর, রুবেলভাইও তেমনি তার, মানে হিরুভাইরে ঘায়েল করতে সর্বক্ষণ সচল। তাই তার দুই সাগরেদরে আগাগোড়া নবীন ক্যাডাররে বাগে, রীতিমতো হাতের মুঠায় পেয়ে রুবেলভাই যেন জবরদস্ত জোসে মাতেন—‘আমার এরিয়া আইসা আমার লগে মাস্তানি আইজ ছুটাইয়া দিমু। বান্ধ! দুই শালারে হাত-পা বাইন্ধ্যা কচ্ছপের নাহান চিৎ কইরা রাখ।’ 

ক্যান্টিনের পিছনে খালি কিন্তু চারদিক বন্ধ, জানালা-ভেন্টিলেটরবিহিন একটা রুম আগে থেকেই আমাদের দখলে নেয়া। যারা সংগঠনের মিছিল-মিটিংয়ে যেতে অনিচ্ছুক, নানা টালবাহানায় এড়ায়, আবার যারা ফেসবুকে আমাদের দলের নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস, যারে আমরা কটুক্তি বলি, তা হাঁকায়, বড়ো বড়ো করে দেয়, তাদের শায়েস্তা করা, হাত-পা বেঁধে উচিতশিক্ষা দেবার ষোলোআনা আয়োজন সে রুমে হাজির। তাই তার গুদামে দড়ি-দড়া, লাঠি-সোটা থেকে শুরু করে হাতুড়ি-বাটল সবসময় মজুদ থাকে।

আমরা সে গুদামঘর থেকে মোটাসোটা দেখে দু-গাছি দড়ি এনে এইমাত্র হয়ে ওঠা রুবেলভাইর বউয়ের দুইভাই, আগাগোড়া শালা—আবির ও জামিলরে আচ্ছামতো বাঁধি। তা একেবারে পিছমোড়ায় মজবুত হয়ে ওঠে। ফলে সবকিছু আগাপাশতলা রেডি হয়ে যায়। কেবল রুবেলভাইর অ্যাকশন, হাতের মুঠায় পোরা সম্ভব এমন হাতিয়ারটা চালানোটুকু বাকি থাকে।

আমরা জানি, হিরুভাইয়ের সাথে রুবেলভাইয়ের বিরোধের সূত্রপাত্র একটা নতুন হল, দশতলা ছাত্রাবাস বানানোর কারবার নিয়া। হলটার আসন ক্যাম্পাসের উত্তরজোনের ভেতর। আগাগোড়া তার হাতের বেস্টনির মধ্যে। সুতরাং তার কমিশনটা জোনপ্রধানদের অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী রুবেলভাইর পাওয়ার কথা। সে প্রায় কোটি টাকার মামলা। কিন্তু হল বানানোর, তারে গড়ে-গেঁথে তোলার কন্ট্রাক্টটা পান আবার আতাহারভাই। তিনি সদ্য ক্যাম্পাস থেকে বার হওয়া আমাদের সংগঠনের বড়ভাই। একেবারে নতুন, মাত্র মাসতিনেক আগে গজানো কন্ট্রাক্টর হওয়ার পরও তারে এতবড়ো কাম, দশতলাভবন বানানোর কন্ট্রাক্টটা পাইয়ে দেবার পথে ভিসিরে চাপা দেয়া, সিন্ডিকেটরে ম্যানেজ করা—এসব যাবতীয় কাহিনি-কারবার সেরে দেন আবার হিরুভাই। সে তাই কমিশনের এতবড় অঙ্কটা ছাড়বেন কেন? বরং রীতিমতো তা বাগায়ে নেন। একেবারে নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়া তোলেন।

তবে নতুন হল বানানোর কাজ শুরু, পাইলিংটার পা ফেলার পর রুবেলভাই বাগড়া বসান। তারে আর বাড়তে, তলার পর তলা গেঁথে মাথা উঁচুতে উঠাতে দেন না। ফলে সে নির্মাণাধীন হল এখন, প্রায় বছরখানেক ধরে কয়েকটা পিলার নিয়া খাড়া হয়ে আকাশপানে মুখ তুলে দিয়া নিয়মিত, হয়তো মুসল্লিতের মতো দিনে বারপাঁচেক মুনাজাত তোলে—হে প্রভু পরোয়ারদেগার! উত্তরজোনের অধিপতি, আমারে অনুমতি দাও, একতলা দোতলা করে একটু একটু করে বাড়ি, দশতলায় গিয়া সোজা হইয়া খাড়াই।

কিন্তু উত্তরজোনের মহারাজা, সাম্রাজ্যের সম্রাট, যার হুকুম ছাড়া এ এলাকার একটা পাতাও নড়ে না, সে-ই রুবলেভাই কেন মোটাতাজা দেখে নগদ নারায়ণ ছাড়া, যথাযথ ভ্যাট-ট্যাক্সবিহিন এত বড়ো ভবনের মানে দশতলার ছাত্রাবাসখানারে মাথা তুলতে দেবেন?

তাহলে এখন উপায়? তারে কীভাবে বাড়তে দেয়া যায়, আতাহারভাইর চাপটা মিটানো সম্ভব হয়, আবার তার কাছে থেকে বাগানো কমিশনটারে হালালে রূপ দেয়া যায়—এসব হিসাব করতে গিয়াই হিরুভাই হয়তো আজকাল দেখেন উত্তরজোনটারে বগলতলায়, পুরোপুরি হাতের মুঠায় নিতে পারলেই এক ঢিলে কেবল দুই নয় বরং সবগুলো পাখি মারা, মানে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তিনি তাই এ জোনটার দিকে ঘন ঘন লোলুপ চোখে তাকান, দখলে নেবার চেষ্টা চালান।

অপরদিকে এখন হাতের মুঠায় পাওয়া হিরুভাইর দুই সাগরেদের চোখ উপড়ে ফেলে কিংবা তাগো খরচের খাতায় তুলে দিয়া সে তাকানোর পথ চিরতরে বন্ধ করে দেবার হিসাবে পা দিয়াই হয়তবা রুবেলভাই হাতের কাছে থাকা একটা চেয়ারে যুৎসই হয়ে বসেন। পিছমোড়ায় মোড়ানো দুই বান্দার পানে সহিংস চোখে তাকান—‘আইজ তোগো জীবনের শেষ দিন, আমার কব্জা থাইকা দেখি কোন বাপে আইসা তোগো বাঁচায়।’

তাগো মানে আবির আর জামিলের এখনকার, ক্যাম্পাসের দিনগুলোর বাপ ও মা দুই-ই তো হিরুভাই। সে-ই তো তাগো এখানে পাঠাইছে। তাহলে তারে কল দিয়া বললেই হয়—হিরু! তোমার দুই সাগরেদের জান সমেত ফেরত চাইলে আতাহারভাইর কাছ থেকে বাগানো কমিশনের মোটা অঙ্কটা নিয়া আসো। কড়া-গণ্ডায় নগদে নগদে বুঝাইয়া দাও।

কিন্তু রুবেলভাই সে পথ ধরেন না। বরং বছরখানেক আগে তার ডাইন হাত হিসাবে খ্যাত, আমাগো সমাগোত্রীয় কাদিররে কায়দা মতো পেয়ে, গভীর রাতে একা একা শহর থেকে ফিরতে দেখে, তারে হিরুভাই কব্জায় নিয়া যেভাবে বিনাশের খাতায় তোলেন, তার চওড়া বুকখানরে ঝাঁঝরা কইরা দেন, তার প্রতিশোধে একজনের বদলে দুইজনরে একেবারে খরচের খাতায় তোলার আয়োজনেই যেন রুবেলভাই তার কোমরে গুঁজে রাখা ছোটোখাটো, হাতের মুঠায়ে মুড়ে ধরা সম্ভব এমন আগ্নেয় হাতিয়ারটা প্রকাশ্যে আনেন। প্যান্টের বেল্টের কাছ থেকে টেনে তুলে ডান হাতের মুঠায় নেন। তারপর তারে একটা ঘুরন্তি দেন। তাতে করে সে হাতের আশ্রয়ে থেকেই বাতাসে একটা চক্কর খেয়ে আবার মুহূর্তেই সুস্থির হয়।

হিরুভাইর হাত অনেক লম্বা। মাদার অর্গানাইজেশনের একেবারে সেন্ট্রাল অবধি ছড়ানো। তাই তার সে হাতের মুঠায় পোরা দুইজন বড় বড় নেতা। তারা এখন রীতিমতো মন্ত্রীর সিংহাসনে সমাসীন। আর রুবেলভাইর দৌড় তো আমাগো চেষ্টা-তদবিরের জোরে, ইলেকশনের দিন ব্যালটবাক্স ম্যানেজমেন্টর আগায় বিজয়ী হইয়া আসা লোকাল এমপি ও শহরের মেয়র।

তাই খুঁটির হিসাবে দেখা যায় হিরুভাইয়েরটা বেশ উঁচা-লম্বা, কেন্দ্রের বলবীর্যে বলীয়ান। আর তার তুলনায় রুবেলভাইয়েরটা একে তো খাটো, কেবল এমপি-মেয়র, তারপর আবার সোজাও নয়, মানে সরাসরি সরকারি পদপদবীবিহীন, তাই অনেক ব্যাঁকাত্যারাও বটে।

রুবেলভাই কি তাই একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েন? ভাবনায় ভর দেন? সে কারণেই বোধহয় তার হাতে ধরা হাতিয়ার থতমত খায়। ইতস্ততায় কেবল হাতের ভেতরেই থির হয়ে থাকে। হাত-পা বেঁধে ক্যান্টিনের মেঝেয় শুয়ে রাখা হিরুভাইয়ের দুই সাগরেদ পানে আর তাক হয় না।

তবে কাদিররে যে ওরা বিনাশের পথে নিছে, কবরের গহ্বরে পৌঁছে দিছে তাতে ওদের, মানে হিরু কিংবা তার বাহিনির কার কী হইছে? বরং দুই মন্ত্রীর ফোনের আগাতে সে মামলার তো এখন একেবারে ট্রেসলেস হওয়া, পুলিশের খাতাপত্র থেকে পুরাদস্তুর গায়েব হয়ে যাওয়া সারা।

তাহলে এই দুজনরে কবরের পথ ধরায়ে দিলে কী-ইবা হবে? আগামী ইলেকশনে ব্যালটবাক্স ম্যানেজ করার প্রয়োজনে নিশ্চয়ই এমপি ও মেয়র সাহেবরা সব সামলাবেন। যাবতীয় মামলা-মোকাদ্দমা খারিজের খাতায় তোলার ব্যবস্থা নেবেন।

সে ভরসাকে ভর দিয়াই হয়তবা রুবেলভাই হাতের হাতিয়ারটারে দৃঢ়তায় নেন। মুঠোর ভেতরে শক্তপোক্তে ধরেন। তারপর আবির ও জামিলের পানে তাক করে তার নলরে তাগো বুক বরাবরে মুখোমুখিতে আনেন।

তবে ট্রিগারে চাপ কিংবা তাতে এতটুকু কারসাজি করার আগেই, আগে থেকে এতটুকু বলা-কওয়াবিহীন হয়ে, আভাস-ইঙ্গিত দেয়া ছাড়াই একটা বুলেট, ইস্পাত-লোহায় গড়া ছোট্ট একটা শলাকা উড়ে এসে আমাগো, মানে শিষ্য-সাগরেদদের বাদ দিয়া খোদ রুবেলভাইর বুকটারে খুঁজে নেয়। তারপর হৃদপিণ্ড বরাবর পা বাড়ায়। শেষে গিয়া হয়তবা একেবারে পিঠে গিয়া থিতু হয়। ফলে দেশের অন্যতম সেরা উচ্চশিক্ষাগারের উত্তরজোনোর অধিপতির মেঝেতে পতন ঘটা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

আর আমরা, উপস্থিত তার সাঙ্গপাঙ্গরা চারদিকে তাকাই—জাদুযন্ত্রের তোপ, লৌহশলাকার আগমন, তারপর একেবারে মোক্ষম জায়গায়, রুবেলভাইয়ের বুকে পদার্পণ কোন পথে? ক্যান্টিনের খোলা দরজা, কাচেমোড়া জানালা নাকি একেবারে উপরের ফাঁক-ফোকর, জালিকাটা ভেন্টিলেটর দিয়া?

তা নিশ্চিত হতে না পারলেও তার, মানে শলাকার ছুট লাগানোর পরপরই ভেসে আসা একটা কণ্ঠস্বর আমরা যথাযথভাবেই চিনতে পারি। কেননা তা আমাদের বহুদিনের চেনা খোদ হিরুভাইয়ের—

—তোমার ভরপুর দিঘির জলে, মানে উত্তরজোনের জমিদারিতে আমার ছুড়ে দেয়া জলজ্যান্ত একজোড়া টোপ আবির আর জামিল। জানি এমন লোভনীয়, হাতিয়ার-বাটলবিহিন, নিরীহ দুই সাগরেদ, একেবারে তোমার নাকের ডগায়, মুখের মোহনায় মানে তোমার জোনের সেন্টার পয়েন্টে, এই হলের ক্যান্টিনে তোমার রিজার্ভ টেবিলে হাজির পেলে তুমি আর সুস্থির থাকতে পারবে না। বরং এক লহমায় তাগো গলধঃকরণ করতে চাইবে। তাগো বুক বরাবরে তোমার হাতের মুঠোয় ধরা ছোটোখাটো হাতিয়ারখানারে তাক করবে। সবটাই আমাগো গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা আছে। ফলে এখন তোমারে অ্যাটেম টু মার্ডারের কারবারে ফেলে একেবারে মেঝেয় শুইয়ে দেয়া এবং উত্তরজোনটা হাতের মুঠায় পোরা ছাড়া আমার আর কী করার আছে, অ্যাঁ।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার