X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংগ্রাম

বেলায়েত হোসেন
১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:১৮আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:১৮

আলী মিয়া এখন বসে আছে কোঁচ হাতে। ছোট একটি পুকুরের পাড়ে। পুকুরটি কচুরিতে ভরা। গতকাল সন্ধ্যায় বড় একটি ডাব দিয়েছে বড় কোনো মাছে, সেটা শিকারের জন্যই এক ধ্যানে চেয়ে আছে নিষ্কম্প পানির দিকে। এ নদীটি কত বড়ই না ছিল! আলী মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেই নদীর মধ্যে কাটা পুকুরের পাড়েই বসে আছে সে মাছ ধরার অবিরাম প্রতীক্ষায়। কচুরির মধ্যে ঐ যে কী যেন নড়ে উঠল। আলী মিয়া দাঁড়াল। নিশানা করা হাতে একভাবে তাকিয়ে রইল। না, আবার থেমে গেল নড়াচড়া। অপেক্ষা। অপেক্ষা। দীর্ঘ অপেক্ষা। মাছ ধরায় ধৈর্য লাগে বাপ—এ কথা বলেছিল তার বাবা নিয়ামত মিয়া। সে কথা সে আজও মনে রাখে প্রতিক্ষণ। ভোলে না। বউ বলেছিল কাল, ঘরে তো চাউল-নুন-ত্যাল কিছুই নাই। রানমু কী! এ্যামনে বইসা থাইক্কা খালি বিড়ি টানলেই অইবে? যা করার কিছু করো বাপু। মাইনষে আর ধার দিতে চায় না।

আলী মিয়া কি বসে আছে? সে তো রোজ ভোরেই কোঁচ-জাল হাতে বেরিয়ে পড়ে মাছ ধরার আশায়—এ ডোবা থেকে আরেক ডোবায়, এ নদী থেকে অন্য নদীতে। কোনোদিন কিছু মেলে, কোনোদিন ফেরে খালি হাতে। গত কয়েকদিন ধরে কিছুই মিলছে না। এটা কি তার দোষ? মাছ ধরা ছাড়া সে তো আর কোনো কিছু জানে না। ধান কাটা, মজুর খাটা, এসব তো আর সে পারে না। মাছ ধরা তার পূর্বপুরুষের কাজ। পুরুষানুক্রমে তারা মাঝ ধরেই বেঁচে আছে। এছাড়া উপায় নেই।

একসময় এই নদীতে মাছ ধরে কত সুখেই না ছিল তারা! দিনে মাছ, রাতে মাছ। বউকে তো কোনো এক বছর রুপার গয়নাও গড়িয়ে দিয়েছিল সে। আজ সে নদীও নাই, সেই দিনও নাই। সবই নিয়েছে কালে। এ নদীতে লঞ্চ, স্টিমার, বড় বড় জাহাজ চলত। সেই খরস্রোতা নদী এখন শ্যাওলা ধরা মরা নদী। বর্ষার দিনে অজস্র শাপলা ফুটে থাকে এ নদীর বাঁকে বাঁকে। পৌষ-মাঘ মাসে পানি শুকিয়ে মরা খালের মতো হয়ে যায়। জায়গায় জায়গায় একটু পানি, কোথাও আবার শুকনা। ফাল্গুন-চৈত্রে নদীর তলদেশ শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়, চাষিরা বোরো ধান লাগায় কোথাও কোথাও। এমন নদীর বুকে মাছ ধরে জীবন চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে আলী মিয়ার।

বয়স এখন ষাটের কাছাকাছি। হাঁটেন কুঁজো হয়ে—হাঁটেন কী—বেশিরভাগ সময় নৌকায় বা নদীর পারে বসেই থাকতে হয় তাকে। নদীর বুকে যার জীবন। আলী মিয়ার কোনো ছেলেপুলে নেই। দুজনের সংসার। তাই নিয়ে টানাটানি।

এখন চৈত্রের মাঝামাঝি। কাঠফাটা রৌদ্রে চৌচির মাঠ-ঘাট—নদীর তলা পর্যন্ত। খাঁ-খাঁ রোদ্দুরে ধু-ধু প্রান্তর। দু-একটা ডোবা বা পুকুরই এখন আলী মিয়ার ভরসা। অনেক ভাগ্যে দেখা এ বড় মাছের ডাবটিই এখন তার মূল লক্ষ্য। মাছটিকে তার ধরতেই হবে। না হলে আজও উপোস থাকতে হবে তাদের। এ মাছটি পাওয়া না গেলে তাকে ছুটতে হবে অন্য কোনো ডোবা বা দূরের কোনো নদীর দিকে। অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে, নতুন জীবনের খোঁজে—তীব্র ক্ষুধার দহনে দহনে। আলী মিয়া শৈশবের এই নদীকে, এই মাটিকে আঁকড়ে থাকতে চায়। তার সময়কার আর যারা মাছ ধরে জীবন কাটিয়েছে এই নদীর বুকে, তারা এক এক করে চলে গেছে দূরের কোনো জনপদে। এবার আলী মিয়ার পালা।

পরেরদিন শীর্ণ শুকিয়ে যাওয়া নদীটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলী মিয়া। শৈশবে সে দেখেছে এ নদীর স্রোত ঢেউ আর বিপুল জলরাশি। তার বাবার সঙ্গে জাল ফেলে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরেছে। তার যৌবনেও বর্ষার সময় ফুলে ফেঁপে উঠত নদী। তখনও মাছ ছিল, আনন্দ-হাসি ছিল। পানি কমতে থাকলে শত শত খ্যাপলা জাল ফেলে মানুষেরা মাছ ধরত। শীতের সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পলো নিয়ে নেমে পড়ত চার গাঁয়ের মানুষ। সে কী দিন ছিল, আহা! আজ নদীর সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গেছে তার যৌবন, জীবন।

আলী মিয়া ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়ে পুকুরটির দিকে—বিশাল ডাব দেওয়া বড় মাছটিকে তার ধরতেই হবে। ঘন কচুরিতে ছাওয়া পুকুরটির মাঝে মাঝে এক আধটু ফাঁকা—যেখানে গভীর কালো জল। সকালের সোনালি রোদে চিকচিক করছে কচুরির সবুুজ পাতা। আলী মিয়া চুপচাপ বসে যায় পুকুরটির পাড়ে। থেমে যায় সময়—মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে দুলে ওঠে কচুরিপানা। ঐ তো কচুরির মাঝে ফাঁকামতো জায়গাটিতে কালো ছায়া ভেসে ওঠে—পানিতে বড় একটা বলক তুলেই আবার চলে গেল পানির নিচে। আলী মিয়া একটু নড়েচড়ে বসে। আবার অপেক্ষা। দীর্ঘ অপেক্ষা। গত কয়েকটি দিন ধরে মাছটি তার সঙ্গে কী খেলাই না খেলছে! তবে কী...? না, আলী মিয়া আর ভাবতে পারে না। অপেক্ষা তাকে করতেই হবে। ধৈর্য হারালে চলবে না।
ধীরে ধীরে সূর্য মধ্য আকাশে যায়। রোদ উঠে চড়ে, দরদর করে ঘাম ঝরে তার শরীরে। জ্বলে ওঠে সূর্য, জ্বলে ওঠে তার জঠরের আগুন। আলী মিয়ার চোখ ঘুরে ফেরে পুকুরের চারদিকে, জলের বিন্দুতে বিন্দুতে। না, কোথাও মাছটির দেখা নেই। সাড়া নেই।
পাশের ডোবা থেকে হঠাৎই একটা বাজপাখি ছোঁ মেরে মাঝারি আকারের একটি শোল নিয়ে উড়ে গেল নদীর পারের বড় বটগাছটির দিকে। আলী মিয়া সেদিকে তাকাল। বাজপাখির তীব্র চিৎকারে প্রকম্পিত হয়ে উঠল নদী-গ্রাম-চরাচর।

আলী মিয়া আবার মনোযোগ দেয় পুকুরটির দিকে—মাছটি ধরার অদম্য বাসনায়। সময় গড়িয়ে যায়—সূর্য ক্রমশ ঢলে পড়ে পশ্চিম আকাশে। শেষ বিকেলের সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। একঝাঁক বেলেহাঁস উড়ে যায় নদীর ওপারে দিগন্তের আড়ালে। নদীচর পাখিরা ডেকে ওঠে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে নদীর পাড়ের ছোট্ট গ্রামটিতে। অন্ধকার নেমে আসে নদীর বুকে। ক্লান্ত দুর্ভর ক্ষুধার্ত দেহে ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরে আলী মিয়া। পথেই বিশাল একটা জঙ্গল—পরিত্যক্ত ভিটা। এরপর একটু ফসলের মাঠ পেরিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে আলী মিয়ার বাড়ি। জঙ্গলের আবছায়া অন্ধকারের পথ পেরিয়ে মাঠের কাছে যেতেই চৈতালি বাতাসের শীতল শিহরন খেলে গেল তার গায়, মর্মরিত হয়ে উঠল সমস্ত জঙ্গল—গাছের পাতারা। তার চোখ পড়ল নদীর ওপারে দূরের দিগন্ত রেখার দিকে। সেখানে পুব আকাশ আলোকিত করে ঝলমল করে উঠেছে মস্ত বড় এক চাঁদ। এক অদ্ভুত সুন্দর জোছনায় ছেয়ে গেল পৃথিবী। ছেয়ে গেল তার শরীর-মন। তারই মায়াবী ম্লান অপার্থিব আলোয় এগিয়ে চলল আলী মিয়া।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ