X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

সর্বহারা

সানাউল্লাহ সাগর
১৪ মার্চ ২০২৪, ১৭:২২আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৪, ১৭:২২

আমাকে প্রথম দেখল ছোহরাফ মৃধা। পাশের বাড়ির বড় ভাই। সে নিয়ম মতো সান্ধ্য আড্ডা শেষ করে বাড়ি ফিরছিল। হাতে তিন ব্যাটারির টর্চ লাইট। মুখে আকিজ বিড়ি। আর গলায় ঝোলানো থ্রি ব্যান্ডের রেডিও। যা তার নিত্য সঙ্গী। সে গান শোনে। বিজ্ঞাপন তরঙ্গের গাল গল্প শোনে। হয়ত শোনে না। তবে একটি থ্রি ব্যান্ডের রেডিও আছে সেটা মানুষকে দেখানোর লোভ কাজ করে তার মধ্যে। শ্বশুর বাড়ি থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া এই রেডিওর প্রতি তার মায়ার শেষ নেই। যেন শ্বশুরের দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার বউয়ের চেয়েও রেডিওটি মহা মূল্যবান। বরাবরের মতোই সর্বোচ্চ ভলিউমে গান বাজছিল। রেডিওর সাথে তাল মিলিয়ে ছোহরাফও গেয়ে ওঠে ‘সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি রে দেওয়ানা...’

আরামদায়ক দখিনা বাতাসের সাথে তার মন যেন উড়ে উড়ে অজানা বন্ধুর ঠিকানায় রওয়ানা দিচ্ছে। এরকম সুখী মুহূর্তে সে বীভৎস কিছু দেখবে কল্পনাও করতে পারেনি। আটত্রিশ বছরের জীবনে কখনো এরকম কিছু দেখেনি সে। তিন সন্তানের জনক হলেও মৃত মানুষ দেখার ব্যাপারে এখনো তার ভয় কাটেনি। সে জন্য নিকট আত্মীয় ছাড়া কারো মৃত দেহ পারত পক্ষে দেখে না। জানাজার আগে যখন সবাইকে বলা হয়, লাশ জানাজা হয়ে গেলে আর কেউ দেখতে পারবেন না। আসেন... আসেন যারা দেখতে চান দেইখা লন। তখন ছোহরাফ আড়ালে-আবডালে বসে থাকে। কিংবা মানুষের ভিড় এড়িয়ে লুঙ্গির কোচরে প্যাঁচানো আকিজ বিড়ির প্যাকেট থেকে বিড়ি ধরায়। বিড়ি টানতে যেমন সুখ সুখ অনুভূতি হয় তেমন ভয়-রাগ-ক্ষোভ দূর করতে বিড়ি খুব উপকারী বলে সে মনে করে।

কিন্তু রক্তাক্ত আমাকে দেখার পর তার হাত থেকে বিড়ি পড়ে গেল। টর্চ লাইটও। হয়ত সেও পড়ে গেল। অথবা পড়লো না। তবে খুব জোরে চিৎকার দিলো। এই চিৎকার মোটামুটি আট-দশ বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার কথা। হয়ত সে আরো জোরে চিৎকার দিতে চেয়েছিল। তবে ভড়কে যাওয়া শরীর থেকে ইচ্ছার সমান চিৎকার প্রকাশিত হয়নি। আমি তার ভয়ার্ত মুখটি দেখতে চেষ্টা করলাম। মুখ দেখতে গিয়ে মনে হলো হয়ত সে আমাকে চিনতে পারেনি। লাইটের আলোয় কোনো রকম একবার দেখেছে মাত্র। এই এক দেখাতেই তার অবস্থা খারাপ। পড়ে থাকা দেহটা যে আমি সেটা না বুঝলেও সে এটা বুঝলো—কিছুক্ষণ আগেই এখানে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

আমার পৈত্রিক নিবাস দক্ষিণ ভূতের দিয়া। গ্রামটা উপজেলা সদর থেকে একটু দূরে। আবার বেশি দূরেও নয়। সুগন্ধা নদী পার হয়ে কয়েক কিলোমিটার সোজা রাস্তায় চলে গেছে। রাস্তার পশ্চিম পাড়ে পশ্চিম ভূতের দিয়া। আর পূর্ব পাশে দক্ষিণ ভূতের দিয়া। মাঝে একটি সরু খাল। গ্রামে যেটাকে মানুষ হোতা খাল বলে। হোতা খালের দুই পাশে রাস্তা। রাস্তার দুপাশে সাজানো বাড়ি। একেক বাড়িতে তিনটি-চারটি কিংবা ছয়-সাতটি ঘর। হোতা খালের নাম নেয়ামতউল্ল্যা। এই খালের নাম যে নেয়ামতউল্ল্যা এটা জেনেছিলাম ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়। যখন আওয়ার ভিলেজ রচনা পড়িয়েছিলেন ইংরেজির শিক্ষক মতিউর রহমান। যাইহোক পশ্চিম পাড়ে থাকা গ্রামকে পশ্চিম ভূতের দিয়া নাম দিলেও পূর্ব পাড়ে থাকা গ্রামকে কেন যে দক্ষিণ ভূতের দিয়া নাম দিয়েছিল সেটার উত্তর আমার এখনো জানা হয়নি। যদিও পূর্ব ভূতের দিয়া নামে এই ইউনিয়নে অন্য একটি গ্রাম আছে। তবে এখানে আরো ভূতের দিয়া আছে। যেমন- চর উত্তর ভূতের দিয়া, মধ্য ভূতের দিয়া, ভূতের দিয়া। কেদারপুর ইউনিয়নে মোট পাঁচটি ভূতের দিয়া আছে। মানে পাঁচটি গ্রাম। এই পাঁচ ভূতের দিয়ার এক ভূতের দিয়া দক্ষিণ ভূতের দিয়ার রাস্তার পাশে আমি পড়ে আছি। পাশে ছোহরাফ আলী। আমি সদ্য খুন হওয়া রক্তাক্ত। আর ছোহরাফ বেহুঁশ। তার হুঁশ ফেরার আগে যদি কেউ না আসে তাহলে আমাকে এভাবেই পড়ে থাকতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে কখন তার হুঁশ ফেরে। সে কখন জাগবে বুঝতে পারছি না।

আমি ছোহরাফের উপর বিরক্ত হই। সে ভয় পাক সমস্যা নাই। কিন্তু বেহুঁশ হওয়ার কী দরকার ছিল। তার উচিত ছিল মানুষজন ডাকা। পুলিশ ডেকে নিয়া আসা। কিন্তু সে নিজেই ভয় পেয়ে বেহুঁশ হয়ে আছে। আমি নিজের এই চিন্তা করা কিংবা ছোহরাফের প্রতি আমার গবেষণা দেখে অবাক হই। ভাবি এইসব কাজ যে আমি করছি তা কি আমিই করছি? না আমার আত্মা করছে? আমি তো শুয়ে আছি। মৃত। অবশেষে এই ডিসিশানে পৌঁছাই যে এখন আমার কোনো দেহ বা শরীর নেই। এখন আমি বলতে একটি আত্মা। যে শরীরহীন। তবে চিন্তা করছে। গবেষণা করছে। আমার ভালোই লাগে। জীবিত থাকতে ইচ্ছা হলেই সব কাজ করতে পারতাম না। চলতে হলে শরীর নিয়ে যেতে হতো। এখন আর সে সমস্যা নাই।

একবার মনে হলো মানুষজন আসতে আসতে করিম ঢালীর মুখটা একটু দেখে আসি। আমার হত্যাকাণ্ড সে সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি। তবে তার হুকুমেই যে আমাকে হত্যা করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি চাইলাম আর যেন তার সামনে হাজির হয়ে গেলাম। করিম ঢালী তার বাড়ির বৈঠকখানায় বসে আছে। সামনে সদ্য শেষ করা চায়ের কাপ। পাশেই পিচে অবশিষ্ট বিস্কুটের টুকরা। সামনে ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে বসে আছে আলতাফ। করিম ঢালী তার স্বভাব সুলভ কথা বলছে। তবে এই মুহূর্তে তার উদ্দেশ্য আমাকে হত্যার মিশনে অংশগ্রহণ করা আলতাফকে মোটিভেটেড করা। আলতাফের চেহারা দেখে সে বুঝতে পারছে, আবেগে নেতার নির্দেশ পালন করেছে ঠিক কিন্তু সে এখন ভেতরে ভেতরে অনেক বিধ্বস্ত। আর এই বিধ্বস্ত আলতাফকে আদর্শের দোহাই দিয়ে আবার আবেগি করাই করিমের কাজ। আলতাফ বলতে থাকে, শোন আলতাফ আমি আদর্শ বিসর্জন দেয়া পছন্দ করি না। আমি নিজেও কখনো যদি আদর্শচ্যুত হই তাহলে আমাকেও কিন্তু কেউ ছাড়বে না।

আলতাফ কিছু বলে না। মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে আছে। তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আমার রক্তের ছাঁট লেগে আছে।
করিম ঢালী তার মতো বলে যাচ্ছে, আমার বিপ্লব শুধু শ্রেণি শাসনের বিরুদ্ধে না। যারা আদর্শচ্যুত হয়েছে তাদের নির্মূল করাও আমাদের কাজ। তা না হলে এই আদর্শচ্যুতরাই আবার পুঁজিবাদের দোসর হয়ে উঠবে।
করিম ঢালী বুঝতে পারে তার কথা আলতাফকে প্রভাবিত করতে পারছে না। সে মনে মনে বিরক্ত হয়। তবে সেটা প্রকাশ করে না। নিজেকে তৈরি করে আবার মাঠে নেমে পড়ে। একটু থেমে আলতাফকে আদুরে ধমকের সুরে বলে, কিরে থম মেরে বসে আছিস কেন? এটাই তো তোর প্রথম না। আগেও তো করছো।
তারপর সামনের বারান্দার খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে হাক দিল, কই রে কুলসুম আলতাফরে চা দে তো।
যেন কিছু হয়নি। আলতাফ গুরুর কাছে এসেছে তালিম নিতে। আর গুরু প্রতিদিনের মতন তাকে চা খাইয়ে আপ্যায়ন করছে। আলতাফ এখনো কোনো কথা বলেনি। সে আসার পর থেকেই চুপ মেরে বসে আছে।

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম আমার মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর করিম চাচার একটু হলেও খারাপ লাগবে। যদিও তার হুকুমেই সবকিছু হয়েছে। সে আর আব্বা তো জানের দোস্ত ছিল। আব্বার কাছে করিম চাচার অনেক গল্প শুনেছি ছোটবেলায়। সেই চাচাই তার দোস্তের সন্তানকে হত্যা করালো আজ। নিজের ভেতরে প্রশ্নরা গোল পাকাচ্ছে। আমি কি হত্যা হওয়ার মতন কোনো দোষ করেছিলাম? কেন আমাকে হত্যা করা হলো?

ছোহরাফ বেহুঁশ হয়েছে চার-পাঁচ মিনিট হবে। সে যত জোরে চিৎকার দিয়েছে তাতে এতাক্ষণে কেউ না কেউ আসার কথা। কিন্তু এখনো কেউ আসেনি দেখে অবাক হলাম। অন্যান্য জিনিসের মতো চিৎকারও যে এখন দুনিয়ায় মূল্যহীন জিনিসে পরিণত হচ্ছে তা বুঝতে পারলাম।

ছয়মাস আগেও আমি ভাবতে পারিনি আমার এই অবস্থা হবে। ছয় মাস কেন! গতকালও কি ভেবেছিলাম এই অবস্থায় আমি পড়ে থাকবো? আমাকে নিয়ে কান্না করে পাড়া সজাগ করার মতন কেউ জীবিত নেই। আমিই বিশ্বাস বংশের হজরত আলী পরিবারের শেষ আলো ছিলাম। সেই আলো একটু আগে নিভে গেল। আমার বাবা হজরত আলী যখন সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন তখনো তার বিয়ে হয়নি। তরতাজা যুবক। বিয়ের কথা চলছে। দু-একটা মেয়েও দেখো হয়েছে। তবে ফাইনাল হয়নি কিছু। শরীর ও মনে উচ্ছ্বাস। এমন বর্ষাস্নাত এক বিকেলে তার বাল্যবন্ধু আলম বেপারীর সাথে গিয়েছিলেন সিরাজ সিকদারের পাঠশালায়। যে পাঠশালায় তার নতুন জীবনের পাঠ শুরু হয়। আর তখনো বাবা জানতেন না এই পাঠের শুরু আছে কিন্তু কোনো শেষ নেই। সেটি ছিল সর্বহারা পার্টির গোপন বৈঠক। বাবা ছিলেন সে বৈঠকের নতুন মুখ। বাবার বয়স তখন চব্বিশ পার করে পঁচিশে পড়েছে। বয়সের দূরত্ব কম হলেও জ্ঞানের দূরত্ব যে অনেক সেটি বাবা সিরাজ সিকদারের বক্তব্য শুনে বুঝতে পারেন। তিনি সিরাজ সিকদারের বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেদিনই মনে মনে নিজেকে একজন যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করে নিয়েছিলেন।

বৈঠক শেষে বাবার কাঁধে হাত রেখে সিরাজ সিকদার বলেছিলেন, কি পারবা না? পারবা। আমরাই পারবো।

সেই থেকে বাবা মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা নিয়ে তাদের দলে একত্রিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে যেন গুরু শিষ্যের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। এক বছর পার না হতেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে বাবা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশব্যাপী সর্বহারা পার্টিও কাজ সম্প্রসারিত হতে থাকে। বাবাও দ্বিগুণ উৎসাহে আদর্শিক লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। হঠাৎই সরকারি বাহিনীর হাতে সিরাজ সিকদারের মৃত্যু ঘটে। পার্টির মধ্যে নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়। একাধিক উপদলে ভাগ হয়ে যায় সর্বহারা পার্টি। নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে বাবার মত যারা আদর্শিক চিন্তা করছিলেন তারা পড়লেন বিপদে। নিজের মধ্যেই শত্রুতা শুরু হলো। আত্মকোন্দোলে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে উঠলো। তারপরও এই অঞ্চলে সাত-আট বছর তেমন কোনো গ্রুপিং ছিল না।

৮৬ সালের শেষের দিকে নিজেদের মধ্যে কোন্দল তৈরি হলো। দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেল সবাই। এখানে ওখানে লাশ পড়তে লাগলো। যার মামলা পর্যন্ত হতো না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ভালোবাসার জায়গা তৈরি করেছিল সর্বহারা গং তা ভীতিতে পর্যবসিত হতে থাকলো। আর সর্বহারা নামে তারাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকলো। তবে এসবের মধ্যেও বাবা মৃত্যু অবধি তার বিশ্বাসে, চিন্তায় স্থির ছিলেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু বছর পর আমি কেন বিপ্লবী হয়ে উঠলাম? আমি কোনো বিশ্বাসে মুগ্ধ হয়ে কিংবা বিপ্লবী চিন্তা থেকে সর্বহারা পার্টিতে জয়েন করিনি। আমি বাবার মতন সাহসী কেউ নই। আমি বাবাকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে সর্বহারায় যোগ দিয়েছিলাম। ঠিক প্রতিশোধও নয়। টিকে থাকার জন্য। নিজের প্রয়োজনে যোগ দিয়েছিলাম। যোগ না দিলেও হয়ত আমার বেঁচে থাকা হতো না। কারণ পৈত্রিকসূত্রে বাবার কাছ থেকে অন্য গ্রুপের শত্রুতা যে পেয়েছিলাম আমি তা অবশ্যই আমাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতো। তারা ভাবতো গোপনে গোপনে আমি বাবাকে হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভাবলাম গোপন শত্রু হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে প্রকাশ্য শত্রু হয়ে লড়ে যাবো।

আমার আর টিকে থাকা হলো না। এটা মতাদার্শিক কোনো লড়াই নয়। কেবল নেতৃত্বের কলহ আমাকে শেষ করে দিল। আমি কোনো নেতা কিংবা অতি বিপ্লবী কর্মী ছিলাম না। তবুও আমি খুন হলাম। বাবাকে ছাড়া আমি দুই বছরও টিকতে পারলাম না। অথচ বাবা জীবিত থাকতে আমাকে এসব থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। পাশের উপজেলায় নানা বাড়িতে রেখে পড়ালেখা করিয়েছেন। সেখান থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে যখন জগন্নাথ কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম তখন বাবা এক রকম হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। ভেবেছিলেন আমাকে তার যাপিত জীবনের গোলকধাঁধা থেকে বের করতে পেরেছেন।

এটা ঠিক আমিও নিয়ত করেছিলাম। কোনো ক্রমেই বাবার পথে পা বাড়াবো না। অন্যসব সাধারণ মানুষের মতই একটা জীবন কাটিয়ে দিবো। ডিগ্রি পাশ করে সরকারি চাকুরির চেষ্টা করবো। মানুষের সব শুভ চিন্তায় যে আল্লাহ তায়ালা সহায় হয় না—তার বাস্তবায়ন ঘটলো আমার জীবনে। ডিগ্রির ফল বের হওয়ার দুই মাসের মাথাই বাবার হত্যাকাণ্ড ঘটলো। বাবা সারা জীবন তেমন কোনো চাকরিবাকরি করেননি। দাদার জমিজমা ছিল। হালের বলদ ছিল। মানুষজন নিয়ে সেগুলো চাষ করেই তার কেটে যেত।

তবে ফুফুদের মধ্যে জমিজমা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যাওয়ায় তার চাষের জমি কমে গেল। আমিও ভাবতে ছিলাম একটা চাকুরি হলে সংসারের উপকার হবে। আমি পরিবারের একমাত্র ছেলে। ছোট বোন রিমার বিয়ে হয়েছে ছয় বছর আগে। পাশের গ্রামে। তবে সে জমাইয়ের সাথে এখন প্রবাসে আছে। মাও মারা গেছেন বছর তিনেক হল। এখন বাবা আর আমি। দূর থেকে বাবার পাশে থাকার তীব্র ইচ্ছে ছিল। মাঝে মাঝে মনে হতো একটা চাকুরি হলে বাবাকে ঢাকা নিয়ে আসবো। যদিও জানতাম এটা কোনো সহজ কাজ হবে না। তবুও ভাবতাম। ভালোবাসার জোরে।

অনেক লোক জড়ো হয়েছে। কারো হাতে হারিকেন। কারো হাতে টর্চ লাইট। আর আমার সতীর্থরাও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখছে। তাদের কোমরে লুকানো চাইনিজ পিস্তল। কারো হাতে লাঠি। সবাই বলাবলি করছে এই তো একটু পরই পুলিশ চলে আসবে।

আমি জানি পুলিশ আরও অন্তত দুই ঘণ্টার আগে আসবে না। সকালও হয়ে যেতে পারে। রাত আটটার পর নদী পার হওয়া একটা বড় ঝামেলার নাম। যদিও পুলিশের নিজস্ব নৌকা আছে। তারা জানে রাতে এই এলাকায় আসাটা খুব একটা নিরাপদ নয়। এবং সেটা পুলিশের জন্যও প্রযোজ্য। তারা এসব ঝামেলা এড়াতে চায়। সে কারণে তারা পরিবেশ বুঝে আসবে। ততক্ষণ এভাবে আমার রক্তাক্ত শরীর নিয়ে উবু হয়ে পরে থাকতে হবে।

আমার শরীরের কাটা জায়গা থেকে আর রক্ত বেরুচ্ছে না। যে-সব জায়গায় রামদার কোপ পড়েছে তার চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। পিঠের উপরের দিকে পরপর দুইটা আঘাতে গভীর ক্ষত হয়েছে। বাঁ কাঁধের একপাশ প্রায় আলাদা হয়ে গেছে। কানের অর্ধেক কোথাও হয়ত ছিটকে পড়ে আছে। ডান বুকের নিচের দিকে পরপর তিনটা আঘাত। এই আঘাতের কারণে ভুড়ির কিছু অংশ বের হয়ে এসেছে। মাটিতে রক্ত গড়িয়ে পড়ে জমাট বেঁধে আছে। কোথাও হয়ত পিঁপড়াদল অপেক্ষায় ছিল আমার এই রক্ত স্রোতের। তাই তারা ঘ্রাণ পেয়ে আর দেরি করেনি। লাইন ধরে এগিয়ে এসেছে। ওহ বলা হয়নি মাথার উপর একটা মোক্ষক আঘাত আছে। থেতলে গেছে মাথার অবয়ব। এ আঘাতটাই মূলত আমার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। আড়াই ঘণ্টা আগেও যে মানুষটি ফজলুর দোকানে চায়ের আড্ডায় ছিল সে এখন চুপচাপ শুয়ে আছে। নিথর। নামহীন। লাশ হয়ে।

বাবার রক্তাক্ত মলিন মুখটি আমার সামনে ভেসে উঠলো। বাবা বলছেন—কি দরকার ছিল এসব করার?
মনে হচ্ছে বাবা আমার পাশে শুয়ে আছেন। আমরা খুব কাছাকাছি। এখন আর আমাদের কোনো দূরত্ব নেই।
আমিও নিজেকে প্রশ্ন করি, কী দরকার ছিল এসবের? কার জন্য এই লড়াই?  কীসের জন্য এই আত্মাহুতি?
নিজেকে আবার প্রশ্ন করি, এটা কি আত্মাহুতি?
আমার চারপাশে জড়ো হওয়া মানুষের অধিকাংশের মুখেই ভীতি। যারাই আসছে বেশি সময় কেউ থাকছে না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে নানা গল্প তৈরি করছে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম মানুষের সারিতে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোহরাফ মৃধা। হাতে আধপোড়া বিড়ি। তার ভয়ার্ত মুখ দেখে আমার হাসি পায়। আবার মায়াও লাগে।

রাত যত বাড়তে লাগলো লোকসমাগম ততই কমতে লাগলো। সোয়া দশটার পার আমি একা হয়ে গেলাম। এবং এও বুঝতে পারলাম সকালের আগে পুলিশ আসবে না। তবে বাবা এলেন। অবিকল সেই হাসি। যে হাসি নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, বড় হয়ে কী হবি মনা?
আমি বলতাম, পুলিশ।
তবে কী কারণে যে পুলিশ বলতাম তা এখনো বুঝতে পারি না। একটু বয়স হওয়ার পর বলতাম, শিক্ষক। সেটার একটা কারণ ছিল। বড় মামা শিক্ষক ছিল। নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলে দেখতাম সবাই তাকে অনেক সম্মান করে। সে জন্য শিক্ষক হতে চাইতাম।
মুহূর্তেই বাবার মুখের হাসি মিইয়ে গেল। তিনি আমার পাশে বসলেন। নীরব রাতের আঁচলে দাঁড়িয়ে বাবা আর আমি কথা বলতে থাকলাম। তিনি ছেলে বেলায় ঘুম পড়ানোর মত করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি গত হওয়া ছেলে বেলার সরু আল পথ ধারে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে হয়ত ঘুমিয়ে পড়লাম!

হাজী বাড়ি জামে মসজিদ থেকে দাদা কলিমউদ্দিন বিশ্বাসের কণ্ঠে ভেসে এলো, আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম, আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম...আমি কি এবার জেগে উঠবো?

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ