X
শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
১৯ বৈশাখ ১৪৩২

চকোর

সরোজ মেহেদী
০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

বুকের ভেতরটা ব্যথায় টনটনায়। কী যেন একটা ধুকধুক ধুপধুপায়। শরীরটা মনে হয় দাবানলের আগুনে পুড়ছে পুড়ছে করে। সাগর-নদী সব গ্রীষ্মের দাবদাহে ফুটছে। কোথায় শীতল শান্তির পরশ, কী করলে মনে হবে দেহঘড়ি জ্বলছে না। প্রাণ বায়ু বের হবে হবে করছে না। এই যন্ত্রণার লাঘব কি তবে শেষ পর্যন্ত হার্টঅ্যাটাকে! তারপর বেঁচে থেকেও মরে যাওয়া! নাকি মরে গিয়ে বেঁচে যায় মানুষ? এ ব্যথা কি যখন দুঃখের কম্পন শুরু হয় শুধু সে সময়ের। গভীর দুঃখের তীব্র ও তীক্ষ্ণ ঝাঁকুনি। চোখের পানি যখন পাতা বেয়ে বের হতে পারে না তখন তা বুকের ভেতরে রক্ত ঝরায়! হৃদয়ের গহীনে বিষাদের বীণ হয়ে বাজে। সাজিদ সাহেব শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যেতে চান। মন বলে ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে অচেনায় হারাতে। ঘুমাতে ঘুমাতে অচিন দেশে নিজেকে আবিষ্কার করা গেলে বেশ হয়। এতো জ্বালা, এতো যাতনা আর ভালো লাগেনা। এতো ব্যথা এভাবে এর বেশি বয়ে নেয়া যায় না। প্রায়ই মনে হয় মুক্তি দরকার। প্রাণখুলে হাসার, সমাজহীন বাঁচার, বাঁধনহীন উড়ালপঙ্খী হওয়ার। একজীবন থেকে আরেক জীবনে যাওয়ার হাতছানিও হয়তো। আরেকটা পৃথিবী দেখার। নিজের মতো অন্যরকম এক জগৎ খুঁজে পাওয়ার। এই পচা-গলা, ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়া মনুষ্য সমাজে আর না। খুব নিবিড়, নীরব আর গহিন কোথাও একটি কুটির দরকার। যেখানে ভোর আসে মোয়াজ্জিনের দরাজ গলা আর পাখিদের কলকাকলির মুখরতায়।

নিজেকে বড় অসহায় লাগে তার। মনে হয় পুরো পৃথিবীর সব আলো নিভে যাওয়ার পর একাকী বেঁচে থাকা এক প্রাণী। চারপাশে কেউ নাই, কেউ না। এভাবে বেঁচে থাকা বড় কষ্টের। বড্ড যন্ত্রণার। একাকিত্ব মানুষকে বেঁচে থাকতেই তিলে তিলে মেরে ফেলে। মানুষের দেহটাও তার চেনা গলি ছেড়ে বহুদূর চলে যায়। নিজের শোয়ার বিছানাটাকেও বড্ড পর মনে হয়। নিজের ছায়াকে তখন নিজের কাছে অচেনা লাগে। নিজের সাথে কথা বলে নিজেকেই শনাক্ত করা যায় না। এসব ভাবতে ভাবতে, দুঃখের সাগরে ভাসতে ভাসতে আস্তে আস্তে অচিন কোনো এক দেশে হারিয়ে যান সাজিদ সাহেব। একেবারে অচেনা কোনো এক রূপকথার গল্পে তলিয়ে যাওয়া যেন। যেখানে আকাশে মেঘ উড়ছে। আর তিনি একটি পাটিতে শুয়ে চোখ বুজে আছেন। সে পাটি সাগরের ঢেউয়ের মতো দোল খেতে খেতে উড়ছে। চোখ মেলে নিচে তাকান। দেখেন বিশাল এক সাগরের ওপরে ভাসছেন। মাথার ওপরে সুনীল আকাশ, হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় দূরত্বে। কী ঠান্ডা হাওয়া। পাটিটা যেন আরও বেশি দুলছে। সাগরের ঢেউ আছড়ে পরে তার দেহে। পেঁজা তুলোর মতো উড়ে বেড়ানো মেঘগুলো ধরবেন বলে তিনি হাত বাড়ান। তার হৃদয় এক নিমিষে শীতল হয়ে যায়। মুখে হাসি ফোটে। আবার বাঁচতে ইচ্ছে করে সাজিদ সাহেবের। এ জীবন মন্দ না। এভাবে হাজার বছর বেঁচে থাকা যায়। পথ থেকে পথে হাঁটা যায়।

২.
এই ২০২১ এ এসে কতইবা বয়স হবে মি. সাজিদের? একচল্লিশ কি বিয়াল্লিশ। সার্টিফিকেট অনুযায়ী জন্ম ১৯৮১ সালের তিন অক্টোবর। আসলটা হয়তো আরও বছর দেড়েক আগে। কোন দিন, কোন সময় তিনি জানেন না। জানত না তার আপাও। একদিন স্কুলে হাজিরা খাতায় সবার নামের আগে একটা জন্মসন লিখে দিয়েছিলেন হোসেন স্যার। কেরানি এসে সেটা টুকে নিয়েছিল। সেই থেকে সেই দিনকে ঘিরে যত কাণ্ড। দিনান্তে জন্মদিন পালন, জন্মদিনকে কেন্দ্র করে উৎসব আয়োজন। চোখ বন্ধ করলে যেন এখানো চোখের সামনে সব ভাসে। আর সাজিদ সাহেব মনে মনে হাসেন। সত্যি সত্যিই তিনি এক অচেনা অচিন দেশে আছেন। যে দেশে শীত নেই, গরমও নেই। কষ্ট নেই, দুঃখ নেই। খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা নেই। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব নেই। হুজুরে-হুজুরে ‘তুই কাফের/তোর বাপেও কাফের’ ফতুয়া নেই। হিন্দু-মুসলমানে ঘৃণা নেই। সেই দেশে যত্রতত্র ময়লার ভাগাড় বা ফ্লাইওভার কোনোটাই নেই। টাক মাথায় কলপ দেওয়া অসভ্য রাজনীতিবিদ নেই। পাঁচ হাজার টাকায় একটা কলা কিনুয়া সৎ ও সজ্জন আমলা নেই। নীচ তলা থেকে পাঁচ তলায় একটা বালিশ তুলে দশ লাখ টাকা বিল দেখানো দেশপ্রেমিক নেই। সেই অচেনা দেশটা তাই খুব সুন্দর। আর শান্তির। কামড়া-কামড়ির ফুরসত নেই। মশাঙ্গীতের বালাই নেই। গভীর রাতে কুকুরের ঘুম ভাঙানিয়া ঘেউঘেউও নেই। গাড়ি বা উটকো মানুষ, ঢোল বা মাইক-কোনো অনাচার নেই। আচারশিষ্ট মানুষের সমাজ।

৩.
সাজিদ সাহেব মেঘের ভেলায় করে ঘুরছেনই কেবল। মেঘের ভেলাই হবে বোধহয়। নইলে পাটি থেকে এতো সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগার কথা না। পাটি কখনো ছাদ খোলা গাড়ির মতো হয় না। এটা ঠিক এমনই কিছু একটা। সে যাইহোক, এসব নিয়ে কথা বলার কোনো মানে হয় না। তার বুকের ব্যথাটা আর নেই সেটা হলো কথা। বুক থেকে পাথরটা নেমে গেছে—এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হয় না। তিনি বিস্ময় নিয়ে চারপাশ দেখছেন। ঠিক ছোট্টবেলাকার মতো করে। উড়তে উড়তে মেঘের ভেলাটি একটি জায়গায় এসে আটকে যায়। তিনি চোখে মেলে তাকান। মস্ত পাহাড়! বিশাল থেকেও বিশাল। বিস্তীর্ণ। পাহাড়ের উপরে হাজার রকমের গাছ। সেসব গাছে বাসা বেঁধে কতো শান্তিতে পাখিরা বসবাস করছে। তারা সাজিদকে দেখে খুব খুশি হয়। নতুন মেহমানকে গানে গানে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। পাখিদের সর্দার আসে ফুলের মালা আর মিষ্টি পানের বাটা নিয়ে। ছোট্ট সাজিদের গলায় মালা পরিয়ে মিষ্টি পান মুখে পুরে দেয়া হয়। এরপর মেয়ে পাখিরা সবাই মিলে ছড়া কাটে—

মনারে মনা কোথায় যাস?
বিলের ধারে কাটব ঘাস।
ঘাস কি হবে?
বেচব কাল,
চিকন সুতোর কিনব জাল।
জাল কি হবে?
নদীর বাঁকে
মাছ ধরব ঝাঁকে ঝাঁকে।
মাছ কি হবে?
বেচব হাটে,
কিনব শাড়ি পাটে পাটে।
বোনকে দেব পাটের শাড়ি,
মাকে দেব রঙিন হাঁড়ি।

৪.
ছড়া শুনতে শুনতে সাজিদ কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে তার সে খেয়াল থাকে না। ঘুমের মধ্যে বহুদিন পর মাকে স্বপ্ন দেখে। সে নিজের শৈশবের ঘরে, সেই চকিতে শোয়ে আছে। সেই ছোট্ট সাজিদ। মা রঙিন শাড়ি পরে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মায়ের মুখপানের রঙে লাল। মাকে দেখে সাজিদ সম্বিত ফিরে পায়। সে ডাকে— ও মা, মা।

তুই কি ভয় পাইছিস নাকিরে সাজু। এভাবে মা মা করস ক্যান।
–মা বাইরে যাব, মুতে ধরছে।
–যা। আকাশ ভরা জোনাকী। দিনের মতো সব ফকফকা সাদা। দেখস না। কী চান রাইত। যেন দুপুর বেলা।
–তুমি উঠ মা। যদি আমারে জ্বিনেরা ধরে নিয়ে যায়। ডর লাগে।
মা এই রাতে সাজুর কথা শুনে হাসে। বলে, তুই বড় অইছস না। কত্তরা বেডা অইছছ। এহনো একা একা বাইরে যাইতে পারস না। হা হা। আবার মুতে বিছানা ভিজাই ফেলিস না। হা হা। দামড়া বেডা। লাজ-শরম নাই।

সাজিদের মায়ের কথা শুনে শরম শরম লাগে। লাজে লাল হয়। তারপর একা একা বাইরে যাবে বলে দরজার খুলে সিঁড়িতে টিপটিপ পা ফেলে। জোনাকির আলোয় আলোকিত উঠান। উঠান জুড়ে যেন ঝিঁঝিঁ পোকার মিছিল। আজ পোকা বা পাখিদের কারো বিয়ে কি না কে জানে। পোকামাকড়দের লগ্ন কি রাতে হয়? সেই সময়টায় যখন মানুষের উৎপাত কম। ঝিঁঝিঁ পোকাদের দেখে মনে হয় তাদের মনে আজ বড় আনন্দ। জোছনারা যেন আপন খুশিতে সেজেছে। তারাদের ঠোঁট লাল। চাঁদের পরনে কি সুন্দর শাড়ি! যা লাগছে না দেখতে। নয়া পানিতে খলিশার বৌ সেজে বৌ মাছ হওয়ার মতো ব্যাপার স্যাপার। লালী যারে বলে। চরকা কাটা চাঁদের বুড়িও কি আজ শাড়ি পরেছে?

এসব ভাবতে ভাবতে সাজিদকে আঁতকে উঠতে হয়। কার কান্নার শব্দ কানে ভেসে আসে! পুব ঘরের সামনে বড়ই গাছটায় কে যেন বসে বসে কাঁদছে। কে কান্দে এখানে এই রাতে, সাজিদ বুকে থুতু দেয়। দোয়া দুরুদ পড়ে—লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা...খুব ভয়ে চমকে তাকায় সে। এই কান্দুনি কি সেই বুড়ি মহিলা। সুরটা যেন চেনা চেনা। যে দাদি সেজে ছোটবেলায় তার কাছে আসত। হাতে একটা লাঠি আর কোমরের কাছে মস্তবড় ঝোলা ঝুলত কুঁজো বুড়ির। ঝোলা থেকে সাজিদকে মুড়ির মোয়া বের করে দিত। কদমা খেতে সাধাসাধি করতো। এরপর তাকে নিয়ে পুরান-পুকুর পাড়ের জংলা ধরে সোজা হাঁটা দিত। এক সাজবেলায় আপা এসে দৌড়ে না ধরলেতো সে বুড়ির সাথে চলেই গেছিল। ঘোমটা দেওয়া সে বুড়ির কথা মনে করে সাজিদ খুব ভয় পায়। বুড়ি আরও জোরে কাঁদছে। চারদিকে সাজসাজ রব। বিয়ের লগ্ন লগ্ন উদ্দীপনা। এতো আনন্দের মাঝেও বুড়ির মনে কিসের এতো দুঃখ। এবার যেন সে বুড়ির সেই ঝোলাটা দেখতে পায়, সেই লাঠি। বুড়ি যেন হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে আসবে। সাজিদ ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে যাবে বলে দৌড় দেয়। রসুই ঘরের দরজার সামনে এসে আর আগাতে পারে না। কে যেন পেছন থেকে তার হাত টান দিয়ে ধরে। কে কে? সাজিদ ফিরে তাকায়। তার আপা। চামেলী আপা। এই পৃথিবীতে যে তার একমাত্র আপনজন। এতো বছর পর আপাকে দেখে সে অবাক হয়। বুবু বলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর আবার বলে, বুবু তুই! বুবু!

৫.
চামেলী বুবু হাসে। এই জোছনায় যেন তার কোঁকড়া চুলগুলোকে খুব সুন্দর লাগে। সাজিদের মন চায় ছোটবেলার মতো বুবুর কোঁকড়া চুল ধরে টানে। টেনেটুনে কয়টা চুল ছিঁড়ে দেয়। বুবু বলে, ভয় পাইলে একা একা ঘরে যাওনের দরকার নাই। আমার লগে থাক। আমরা এক জায়গায় যামুগা।
–ঘরে আম্মা আছে বুবু। চল আম্মারেও সাথে নিয়া যাই।
চামেলী আপা আবার হাসে। আম্মা আইব কইত্থেইকা। আম্মা তোর জন্মের সময় মইরা গেছে। তারপর আব্বা আরেক বিয়া কইরা দেশান্তরী অইছে। আমরার কোনো মা-বাপ নাই। আমার কেউ নাই। আর আমি হইলাম গিয়া তোর বাপও, মাও। বুচ্ছস?
—আব্বা এহন কই বুবু?
কেউ জানে না সে কোথায়। মানুষ বলে, বউ লইয়া চিটাগাং চইলা গেছে।
–চিটাং কোথায় বুবু? চল আমরা আব্বারে খুইজ্জা বাইর করি।
–এতবড় শহরে মানুষ খুঁইজ্জ্বা পাওন যায়। কই কে জানে।
–কিন্তু বুবু আম্মায়। এইমাত্র আমার সাথে কথা কইল।
তোর সাথে কেউ কথা কয় নাই। তুই ছোটবেলায় আম্মা আম্মা বলে চিৎকার করে ঘুম থেইকা জাইগা যাইতি। মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে আম্মারে খুঁজতি আর কানতি। ভুইলা গেছছ সেইসব কতা। আম্মা আসব কইত্থেইকা? মরা মানুষ কি কোনোদিনও ফিরা আসে। তুই আর বড় অইতি না। এহনো শিশুই রইয়া গেলি।

সাজিদ আর কথা বাড়ায় না। আপার হাতটা ধরে লক্ষ্মী বাবুর মতো হাঁটতে শুরু করে। যেভাবে সে খুব ছোটবেলায় হাঁটত। হাঁটতে হাঁটতে বড়ই গাছটার নিচে আসে দু’জন। সেই বুড়িটার কান্দার আওয়াজ এখন আর শোনা যায় না। সাজিদ আশপাশে তাকায়, ঝোলাটাও দেখা যায় না।

সাজিদ আপার সাথে আবার হাঁটতে শুরু করে।

জানতে চায়— আমরা কই যামু বুবু?

যেদিকে দুই চোখ যায় হেই দিকে যামু। এই গাওয়ে আর থাকমু না। এইখানকার মানুষ বালানা। অসইব্ব এলাকা।
–বুবু আমরা মামার বাড়ি চইলা যাই?
আমাদের কোনো মামা নাই। তারা আমরার কেউ না। হুদা কথা কইবি না। আমার হাতটা শক্ত কইরা ধর।
–চল না, মামার বাড়িতো কাছে
—আবার কস। কইলাম না। তারা আমরার কেউ না। মায় মরনের একদিন আইয়া জিগায় নাই আমরা কি খায়। তারা থাকলে আজকে আমরা এই দশা অয়। চুপচাপ আমার সাথে চল।

সাজিদ তার চামেলী বুবুর হাত ধরে হাঁটতে থাকে। গ্রাম ছেড়ে গ্রামে, পথ থেকে পথে, বনেবাঁদারে হাঁটতেই থাকে তারা। হাঁটতে হাঁটতে মরুভূমির মতো নির্জন কোথায় যেন এসে থামে।

বড্ড ক্লান্ত হয়ে যায় সাজিদ। বুবুর কাছে পানি চায়।

কিন্তু পানি নাই।

সে পানি খাবে বলে বসে। বুবু তাক কোলে তুলে নেয়ার চেষ্টা করে।

পারে না। ‘দামড়া পুলা কুলে নেওন যায়’, বুবু বিড়বিড় করে। উট, আরেকটু আটলেই আইয়া পড়ছি।

সাজিদ মিহিসুরে তার বুবুকে ডাকে— বুবু ও বুবু।

হু।
–কোথায় যামু আমরা? 

এই মাঠ পেরুলেই বিশাল বন। সে বনে কোনো মানুষ নাই। আমরা সেখানে গিয়া ঘর বাইন্দা থাকমু। অসইব্ব মানুষের লগে আমাদের কোনো কারবারই নাই।
–আচ্ছা বুবু। মরা মানুষ কি সত্যি সত্যিই আর ফিরে আসে না?

ইা, না। আসে না। সেতো মইরাই গেছে। কেমনে আইব?
—তাহলে তুই আমারে কই নিয়া যাস? তুই না মইরা গেছছ?
বুবু কিছু বলে না। তবে কারো কান্নার আওয়াজ শোনা যায় বোধহয়।
–কথা ক’ বুবু। ৯৮’র বন্যায় পানিতে ডুবে তোর মৃত্যু হইছিল। তুই মরছিলি নাকি পাশের বাড়ির আলিমে তোরে ডুবাইয়া মারছিল? বুবু ও বুবু। কথা ক’।
চামেলি আপা কোনো উত্তর দেয় না।
সাজিদ জুড়ে জুড়ে চিল্লায়। বুবু ও বুবু। বুউবু...
সাজিদ আর কান্না ধরে রাখতে পারে না। সে চিৎকার করে-বুবু তুই ডুবে মরছিলি না তোরে নষ্ট করার পর ডুবাইয়া মারছিল, এই কথাডা কইয়া যা। আমারে কইয়া যা বুবু। বুবু তোর আল্লার দোহাই লাগে, এই কথাডা খালি কইয়া যা। তুই ছাড়া এই দুনিয়ায় আমার আর কেউ আছিল না বুবু। তরে হারাইয়া আজ আমি ঘরহীন, পথের বিবাগী। তুই সত্যটা কইয়া যা খালি বুবু। ও বুবু। 

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে সাজিদ। কান্নার তীব্রতায় যেন গলার দম আটকে যায়। নিজেকে মনে হয় এক খণ্ড আগুনের কুণ্ডলির মধ্যে। চোখ মুছতে মুছতে, গোঙাতে গোঙাতে ঘুম ভাঙে সাজিদের। সারা শরীর ঘেমে গেছে। পানির তেয়াসাটা নাই। পুরো শরীরটা যেন এখনো গোস্বায় জ্বলছে। ভীষণ অবাক হয় সাজিদ। আবার চোখ মুছে। আশপাশে তাকায়। ছোট্টবেলার সাজিদ কোথায় হারিয়ে গেল? সে না এতক্ষণ আপার সাথে ছিল, আপার সাথে কথা বলছিল? কিন্তু এখন। আবার চারপাশে তাকায়। দেখে কেউ নেই, কিচ্ছু না। সে শুধু একা। যেমনটা আছে গত দুই দশক ধরে। সাজিদ তারা চেনা ঘরে, চেনা শহরে। চিরচেনা জীবনে। সে আবার আশপাশে তাকায়। কী হচ্ছে এসব।

৬.
কোথায় আপা, কোথায় আম্মা? কোথায় সে অচিন দেশ। কোথায় গেল সে মেঘের ভেলা, রঙিন পাখির মেলা। সাজিদ সাহেব বুঝে উঠতে পারেন না। খানিকটা আনমনা হয়ে যান। তিনি শুয়ে আছেন তার রুমে। যেভাবে শুয়ে থাকেন প্রতিদিন। ছ’মাস হলো, চাকরি ছেড়ে দেবার পর আর বাসা থেকে বের হন না। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে এমন পলিটিক্স, শেষ পর্যন্ত নারী লেলিয়ে দেয়া। মানুষে তার ঘেন্না ধরে গেছে। কারো সাথে তেমন যোগাযোগও নেই। ভবিষ্যতে কী করবেন তাও ভবনাতে নেই। প্রতিদিন সকালে মিলি এসে রান্না করে দিয়ে যায়। সেই রান্না ফ্রিজে রেখে তিন বেলা খান। মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার পর মিলি আসে। তাকে বাইরে নিয়ে যেতে টানাটানি করে। সাজিদ যায় না। ভাগ্যিস মিলির সাথে তার পরিচয়টা হয়েছিল। মেয়েটা কেন এতো ভালোবাসে সাজিদকে। এমন কী আছে তার মধ্যে? সাজিদ সাহেবের নিজের কাছেও এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ওর দিকে তাকিয়ে এখনো বিয়ে করেনি মিলি। সাজিদকে ছাড়া আর কোনো পুরুষে নাকি তার রুচেনা। মিলির জন্য এই প্রভাতে সাজিদ সাহেবের বড্ড মায়া হয়। ওর চুলে বিলি কাটতে ইচ্ছে করে।

সাজিদ সাহেব কি এখন সজাগ? নাকি আরেকটা স্বপ্নের মধ্যে আছেন? সে স্বপ্নে আপা বা মা নেই, মিলি আছে। নাকি মৃত্যুর পর মানুষ যেমন ঘোরের মধ্যে চলে যায় তেমন কোনো জগতে। তিনি কি মারা গেছেন নাকি জীবিত? নিজের হাতে নিজে চিমটি কাটেন। ব্যথা লাগে বোধহয়। ঠিক বুঝতে পারেন না। বুকের সে ব্যথাটা আবার ফিরে আসবে আসবে করছে বোধহয়। ব্যথার আগমনের কথা মনে করে সাজিদ সাহেব তটস্থ হন। তার আগে দরজা ঠেলে মিলিকে রুমে ঢুকতে দেখে চমকে উঠতে হয়।

৭.
মিলি জানালার পর্দা সরাতে সরাতে সহাস্যে শুধায়-উঠেন জনাব। আপনি মরেন নাই। গতকাল রাতে ঘুমের ওষুধ ভেবে যে ট্যাবলেটগুলো খেয়েছেন সেগুলো আমার বানানো গোলগোলা বাতাসা। আপনাকে ট্যাবলেট জমাতে দেখে বানিয়ে রেখেছিলাম। সাজিদ অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকায়। তার ঘোর যেন কাটে না। মিলি শুনিয়ে যায়, আপনার মনে এতো দুঃখ, আপনি এতো একা, আপনার এই দুনিয়ায় সত্যি সত্যি কেউ নেই তাতো আমার জানা ছিল না। আমি এতটা বছর কার সাথে কাটালাম তাও বুঝতে পারতেছি না। কারে পাগলের মতো ভালোবাসলাম, এই প্রশ্নের উত্তরইবা কার কাছে খুঁজব! যাইহোক, উঠেন, উঠেন। সাজিদ আড়মোড়া ভাঙে, হামাগুড়ি দেয়। মিলি দরজা-জানালা সব খুলে দিয়েছে। বাহির থেকে রোদের ছটা এসে বারান্দায় পড়ছে। জানালা দিয়ে সরু ও বক্রাকার হয়ে রুমের ভেতরে ঢুকছে। গুড়ের গন্ধে পিঁপড়ার লাইন ধরার মতো। সাজিদ মিলির দিকে তাকায়। মিলে লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরেছে। ঠোঁটে লিপস্টিক। খোঁপা ছাড়া চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। মিলি যে এত সুন্দর আগে খেয়াল করেনি সে। গত দশ বছরে কখনো তার চোখে পড়েনি। সাজিদ এক নাগারে মিলির দিকে তাকিয়ে থাকে। পলক যেন পড়ে না। দুঃখী দুঃখী ভাবটা মিলির সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বৈকি।

মিলি সাজিদের হাত ধরে, টেনে তুলবে বলে। তারপর তার দিকে ঝুঁকে গিয়ে বলে, আজ আপনার জন্মদিন। আর আপনি কাল ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরে যাচ্ছেন ভেবে কী কাহিনীটাই না সারা রাত ধরে করলেন। আমি পাশে আছি সে হুশও আপনার ছিল না। উঠেন উঠেন জন্মদিনের কেক কাটবেন। সাজিদ মিলির হাত ধরে উঠে বসে। মিলি সাজিদের মাথায় বিলি কাটে। মিলির মতো মায়ার আঁধার ‘কোন রূপসি’ পাশে থাকলে জীবন সত্যি সত্যিই সুন্দর ভেবে হাসে সাজিদ।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পুকুরে গোসল করাকে কেন্দ্র করে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ২০
পুকুরে গোসল করাকে কেন্দ্র করে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ২০
১৪ বছর পর নিয়াজ-ফাহাদদের নিয়ে তিতাস চ্যাম্পিয়ন
১৪ বছর পর নিয়াজ-ফাহাদদের নিয়ে তিতাস চ্যাম্পিয়ন
ভারতের সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা মডেলের গুলি পাওয়া গেলো বাংলাদেশের সীমান্তে
ভারতের সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা মডেলের গুলি পাওয়া গেলো বাংলাদেশের সীমান্তে
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
সর্বাধিক পঠিত
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীর বুকে-পেটে প্রকাশ্যে গুলি
নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীর বুকে-পেটে প্রকাশ্যে গুলি
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’