X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

প্রলাপ

সুব্রত দত্ত
২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬:১৮আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬:১৮

মোহাম্মদ সাজ্জাদুল ইসলামের চাকরির প্রথম দিন আজ। গত বিসিএস পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বেশ কিছু দিন প্রশিক্ষণের পর আজ চাকরিতে যোগ দিলেন। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন পুলিশ হবেন। একদম নিরেট ভালো মানুষী স্বপ্ন ছিল তার—পুলিশ হবেন, অপরাধীকে শাস্তি দেবেন, দেশের নিরাপত্তা-শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ধীরে ধীরে বড় হতে হতে তিনি বাস্তবতার ভিন্ন সংজ্ঞা জানতে পারলেন। যে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিটি একবেলা খাওয়ার জন্য সামান্য কিছু জিনিস চুরি করল তাকে কোন ল’ দিয়ে চোর প্রমাণ করবেন তিনি! তার কাছে তাজ্জব লাগতে শুরু করে সব কিছু। ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা জানতে তিনি পড়েন দর্শন, নীতিশাস্ত্র, ধর্মগ্রন্থ, আইনি বইপত্র; কিন্তু তবু তিনি বর্তমান রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং ন্যায়-নীতির যথার্থ সংজ্ঞা দিতে পারেননি। সাজ্জাদ সাহেব আশাবাদী মানুষ। তাই মন দিয়ে পড়াশুনা করে একদম খাঁটি পথে এসেছেন পুলিশের অফিসার হয়ে। 
সকাল ৭টায় বাসা থেকে বের হয়ে থানায় আসতে লাগে মাত্র তিরিশ মিনিট। হাবিলদার থেকে শুরু করে অনেকেই আসেনি তখন। একা একা নিজের টেবিলের সামনে বসে কাগজপত্র দেখছিলেন। হঠাৎ একজন লোক তার কাছে এসে বললেন—
‘একটা মামলা দায়ের করতে হবে।’
সাজ্জাদুল ইসলাম ব্যাপারটাতে অবাক হয়ে গেলেন। এভাবে থানায় উদ্ধতভাবে মানুষ সাধারণত আসে না। তাও আবার এত সকালে মামলা নিয়ে এসে কাকে কী বলছে না বুঝেই কথা শুরু করছে! তবু রাগলেন না সাজ্জাদ সাহেব। বললেন— 
‘আপনি বসেন এবং বলুন কীসের মামলা।’
লোকটি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন, ‘মামলাটা একটু আন্তর্জাতিক। খুবই স্পর্শকাতর ব্যাপার। আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।’
‘হ্যাঁ বলুন। আমি শুনছি।’
‘মামলাটার আসামি আমি। ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যার দায়ে আমাকে গ্রেপ্তার করতে হবে।’
সাজ্জাদ সাহেব বিস্মিত হয়ে গেলেন। বড় বড় চোখে চেয়ে রইলেন লোকটির দিকে। মুহূর্ত কয়েক। তারপর বললেন—
‘আপনি কি কোনো ইসরাইলি সংগঠনের সদস্য?’
‘না। মোটেই না। আমি একজন বাংলাদেশি। বাংলাদেশের বাইরে কোথাও কোনো দিন যাইনি। কোনো সংগঠন করি না।’
‘তাহলে আপনি এই মামলার আসামি কীভাবে?’
‘সেটাই তো বিস্তারিত বলতে হবে। এই ধরুন দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনিদের ওপরে আঘাত হানছে। গণহত্যা চালাচ্ছে। বোমা ফেলছে। ছোট ছোট শিশুরা মরছে, বৃদ্ধ নারী-পুরুষ মরছে, মা মরছে, মেয়ে মরছে, ছেলে-বাবা-ভাই মরছে। শুধু লাশের পর লাশ পড়ছে। আর আমি কেবল টিভিটা অন করে বিনোদন নিচ্ছি। টিভিতে খবর শুনতে শুনতে পোলাও খাচ্ছি, মাংস খাচ্ছি। আমি কি অপরাধী নই!’
‘এ ছাড়া আপনার কী বা করার আছে?’
‘অবশ্যই আছে। আমার অনেক কিছু করার আছে। আপনারও আছে। এই রাষ্ট্রেরও আছে। আমরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি।’
‘আমাদের পারমাণবিক শক্তি নেই, আমাদের অস্ত্র নেই। আমরা ইসরাইল-ফিলিস্তিনির থেকে অনেক দূরে। তবে যুদ্ধ করব কীভাবে? তা ছাড়া আমরা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। আমেরিকা-ভারত-চীন-রাশিয়াকে মেনে চলতে হয় আমাদের। চাইলেই কি যুদ্ধ করা যায়!’
‘আসলে আমাদের অন্তর ছোট। আমাদের সাহস ছোট। আমাদের দূরত্ব মানবতা থেকে। আমরা অসত্য, অন্যায় আর শয়তানের নিকট বাঁধা।’
হঠাৎ থানায় অফিসারদের আগমন শুরু হলো। একে একে অফিসার থেকে শুরু করে হাবিলদাররা আসতে শুরু করল। একজন হাবিলদার এসেই চিৎকার করে উঠল—
‘তুই! ত্ইু আবার এসেছিস!’
লোকটাকে টানতে টানতে থানার বাইরে নিয়ে গেল। সাজ্জাদ সাহেব তার সম্পর্কে জানতে চাইতেই হাবিলদার বলল, ‘আর বইলেন না স্যার, এই ব্যাটার নাম কান্তি চন্দ্র ঘোষ। এই এলাকাতেই থাকেন। একটা স্কুলে পড়ান। মাথায় একটু সিট আছে। মাঝেমধ্যেই থানায় এসে পাগলামি শুরু করেন। নেহাত ভদ্রলোক বলে তার বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আর পাগলামিটা ঘন ঘন করে না বলে পাগলা গারোদেও চালান হয়নি। এই ধরেন কয়েক মাস আগে এসে বললেন তিনি যুদ্ধাপরাধী, কারণ যে ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং প্রকৃত ইতিহাস জানেন না এবং অন্যকে জানান না তিনিই নাকি যুদ্ধাপরাধী। ইত্যাদি, ইত্যাদি। এর গল্প বলে শেষ হবে না।’
হাবিলদার চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ সাজ্জাদ সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন। আজ তার চাকরির প্রথম দিন। জীবনের লক্ষ্যের ব্যাপারে তিনি সবসময় দ্বিধাহীন। পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়া শেষ, এখন জীবনের স্বপ্নকে পূরণ করতে হবে। কিন্তু তিনি শুধু ভাবতে থাকলেন, ‘আসলে আমাদের অন্তর ছোট। আমাদের সাহস ছোট। আমাদের দূরত্ব মানবতা থেকে। আমরা অসত্য, অন্যায় আর শয়তানের নিকট বাঁধা।’

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাড়ি ঘেরাও করে সাবেক মেয়রকে আটক করে পুলিশে দিলেন স্থানীয়রা
বাড়ি ঘেরাও করে সাবেক মেয়রকে আটক করে পুলিশে দিলেন স্থানীয়রা
ছিন্ন শেকড়ের আত্মগাথা
ছিন্ন শেকড়ের আত্মগাথা
সরকার জাতীয় নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে স্থানীয় নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছে: শামসুজ্জামান দুদু
সরকার জাতীয় নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে স্থানীয় নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছে: শামসুজ্জামান দুদু
রিমান্ড শেষে কারাগারে সাবেক এমপি তুহিন
রিমান্ড শেষে কারাগারে সাবেক এমপি তুহিন
সর্বাধিক পঠিত
অবশেষে রিজার্ভে আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ হলো
অবশেষে রিজার্ভে আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ হলো
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
ক্যাম্পাসে নতুন সভাপতির প্রবেশ ঠেকাতে দুদিন পাঠদান বন্ধ!
ঢাকা সিটি কলেজক্যাম্পাসে নতুন সভাপতির প্রবেশ ঠেকাতে দুদিন পাঠদান বন্ধ!
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
বাসা থেকে বিচারকের স্ত্রীর লাশ উদ্ধার
বাসা থেকে বিচারকের স্ত্রীর লাশ উদ্ধার