১.
জগতে মুক্তির স্বাদ যারা পায়, তারা হয়ত অন্যের বন্দিত্ব থেকেই অর্জন করে সে মুক্তির স্বাদ। যদি তাই না হবে, তবে কেন মুক্তি এবং বন্দিত্বের অবস্থান একে অপরের বিপরীতমুখী? এর কোনো উত্তর নেই। যেমন উত্তর নেই—সমাজের ভাঙনে কিছু মানুষের অযাচিত ভূমিকা নিয়ে!
আজ নগেনের ছেলেকে নিয়ে যে বিচার বসেছে নগেনের উঠানে, সে বিচারের গোড়ার হাল-হকিকত কারোরই অজানা নয়। মতলব মিয়ার বড় ছেলে নজিবুল্লাহ নিজের পকেটের টাকা খরচ করে নগেনের ছেলেসহ আরও অনেকের ছেলেকেই গাঁজাখোর বানিয়েছে এতদিনে; আজ সেই ছেলে গাঁজার টাকা জোগাড় করতে না পেরে চুরি করে বসেছে প্রতিবেশী কার্তিকের মোবাইল। কী একটা বিদিকিচ্চি অবস্থা! বিচারও বসেছে আবার নগেনের উঠানে। দুনিয়ার মানুষের সামনে নিজের উঠানেই বেইজ্জতি হবার আয়োজনটা তাই নগেনকে যেন আরও বেশি করে ভোগায়! মেম্বার রুস্তমের পাশে বসে নগেন যেন একটা পাথরের মূর্তিতে রূপ নিয়েছে। রুস্তমের সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকা নগেনের বিশ-বাইশ বছরের ছেলে কমলের চেহারায় কোনো অপরাধ বোধ নেই। কমলের চেহারার দিকে তাকিয়ে বিচারের দায়িত্বে থাকা রুস্তমের কথায় যখন তা স্পষ্ট হয়, অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা নগেনের স্ত্রী কামিনী তখন হুড়মুড় করে কাছে এসে কমলের গালে-মাথায় এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি বসাতে থাকে। এই এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি দেয়ার মাঝে কামিনী নিজের শাড়ির আঁচলে পারা লেগে মাটিতে পড়ে গেলে, উপস্থিত লোকসমাগমে একপ্রকার হাসির রোল পড়ে। এ যেন জগতের এক অদ্ভুত বিচার, একদিকে মানুষের আত্মসম্মানের বিচারকার্য চললেও তা পরিণত হয় উপস্থিত মানুষের হাসির খোরাকে। উপস্থিত সবাই হাসাহাসি করলেও হাত দশেক দূরে একটি রোগা সুপাড়ি গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আজিরনের মুখে কোনো হাসি নেই। গাদাখানেক কৌতূহল খেলা করে আজিরনের চোখে-মুখে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোখলেছের মাকে খোঁচা দিয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বলে। মোখলেছের মা কান এগিয়ে আজিরনের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, খিলখিলিয়ে হাসে। হঠাৎ আজিরন ব্যস্ততা দেখায়, তড়িঘড়ি করে মোখলেসের মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ও বু তুই থাক, মোর তো মনেই নাই—দোকানোৎ খাবার নিয়া যাওয়া নাগবে; ছ্যাড়াটা না খায়ায় দোকানোৎ গেচে—অর বাপও বিয়্যানে দুক্যান উটি খায়্যা গেচে—এ ব্যালা কিচু খায়ও নাই। থাক বু মুই যাম। এই বলেই আজিরন দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
২.
আজকে আজিরনের ব্যস্ততা একটু বেশি; আবুলটা দুপুরে না খেয়েই দোকানে গ্যাছে। যাবার সময় এত করে নিষেধ করল আজিরন, কিন্তু কে শোনে কার কথা! গজগজ করতে করতে ঘাড় বাঁকা করে এক পাইলে যেন হাঁটা ধরেছে দোকানের দিকে। আজ-কাল হুটহাট রাগ করে বসে আবুল, মা হিসেবে আজিরনের এগুলো যেন আর সহ্য হতে চায় না। আঙিনায় চুলার পাশে বসে বড় গামলায় ভাত সাজাতে সাজাতে একা একাই বকে আজিরন, মোর আর এ্যগ্ল্যা যা ভালো নাগে না তো, তুই ঘরের চ্যাংড়া ঘরৎ থাক্পু বাহে—তোর ক্যা এতো ইচ্যাল্লী; কীসের বলে পেচবুকোৎ ইল বানাবে, এ্যকন তার জন্যে বলে ট্যাকা দেও—খালি ট্যাকা আর ট্যাকা! কাম-কাজের খোঁজ নাই, খালি খরচ আর খরচ।
আজিরনের কথা শুনে অদূরে বসে থাকা মন্টুর মা খ্যাকখ্যাক করে হাসে। মন্টুর মা সম্পর্কে আজিরনের জা, সম্পর্কে জা হলেও এই অসময়ে মন্টুর মায়ের হাসি আজিরনের ভালো লাগে না, মন্টুর মায়ের হাসি আজিরনের রাগ যেন আরও বাড়িয়ে দেয়, গাড়োয়ার নাকান হাসিস ন্যা তো—মোর কনু পিত্তি জ্বলি যায়! কথা শেষ করে আজিরন নিজেও মুচকি মুচকি হাসে। একটু পরে আজিরনের মুচকি হাসি আর মুচকি থাকে না, ফিক করে হেসে দিয়ে আজিরন আবারও বলতে থাকে, পিত্তি জ্বলব্যানয় ক্যা—ক তো? আইত- বির্যতোৎ মুকোৎ নিপিস্টিক দিয়্যা মাতাৎ এ্যকান গামচা বান্দি খালি থেই থেই করি নাচে—কীসের বলে ইল বানায়!
কথার সাথে আজিরনের অঙ্গভঙ্গি দেখে মন্টুর মা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। মাটি থেকে উঠে পেটে হাত চেপে আবারও হাসতে থাকে মন্টুর মা, ভিটিও বানায় গো—ভিটিও, তোর ব্যাটা ভাউর্যাল হোবে—ভাউর্যাল হি হি হি! মন্টুর মার কথা শুনে আজিরন নাক সিটকায়, ধুরু, খালি আজারি কাম... তুই চ্যাংড়া মানুষ, তুই ক্যা চেংড়ি মানষের নাকান নিপিস্টিক দিয়্যা নাচানাচি করবু! দুনিয়্যাৎ কি কাম-কাজের অভাব?.. তাই বলে ফির ভাইর্যাস হোবে—কও দেকি কাণ্ড! ...এ্যলা, ভাইর্যাস হোলে মাইনষে মারব্যানয়?
—হি হি হি.. ভাইর্যাস নয় গো বেটিছোল— ভাউর্যাল হি হি হি।
মন্টুর মা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। আজিরন মিটমিট করে হাসতে হাসতে কাপড়ে বাঁধা খাবারের বড় গামলাটি কাঁখে চেপে দোকানের দিকে হাঁটা শুরু করে। একটু অগ্রসর হয়ে আবার থামে। ঘাড় ঘুরিয়ে মন্টুর মাকে বলে, গরু দুট্যাক্ এ্যনা পল দেইস তো গো মন্টুর মাও। মন্টুর মা হাসতে হাসতে উত্তর করে, আচ্চা দেইম এ্যলা, তোমরা যাও। আজিরন দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে।
৩.
আবুল দোকানেই ছিল তখন, দোকানে থেকে বাবাকে যতটুকু সহযোগিতা করবার কথা তার, ততটুকু সহযোগিতা তাকে করতে দেখা যায় না। আবুলকে দোকানের কাজের প্রতি উদাসীন দেখায়। আবুলের বাবা সাইদুর ক্রেতাদের জন্য চা বানাতে ব্যস্ত।
আবুল ক্যাশে বসে মোবাইল টেপে, তার যাবতীয় ধ্যানজ্ঞান যেন ফেসবুকের রিল বানানোর কাজে। একজন ক্রেতা চা-সিগারেটের বিল দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলেও আবুল সেদিকে খেয়াল করে না। ঠিক এমন সময় আজিরন দোকানে আসে। আবুলের দিকে চোখ পড়তেই সজোরে গজগজ করে ওঠে আজিরন, এদ্যাংকা কল্লে ব্যাপসা চাঙ্গোৎ উটতে কৎক্ষোণ!...কাস্টমার বিল দেওয়ার জন্যে খাড়ে থাকে—আর হারামজাদা পড়ি আচে মোবাইল নিয়্যা। আজিরনের কথা শুনে সাইদুর চা বানানোর ফাঁকে আবুলের দিকে এক ঝলক তাকায়, মুখে পান থাকায় ঠিক মতো কথাও বলতে পারে না, ইশারায় কাস্টমারের কাছ থেকে বিল রাখার জন্য তাগাদা দেয় সাইদুর। বাবার তাগাদা পেয়ে আবুল ক্রেতার কাছ থেকে বিল রাখে। বিল রাখা হলে আবারও মনোযোগ দেয় রিল বানানোর কাজে। এসব দেখে আজিরন গজগজ করতেই থাকে, গজগজ করতে করতে দোকানের ভিতরে গিয়ে স্বামী-ছেলের জন্য প্লেটে খাবার সাজায়। সাইদুরের চা বানানো হলে, একে একে তা ক্রেতাদের সামনে পরিবেশন করে, এরপর হাতমুখ ধুয়ে ছেলেকে টেনে নিয়ে নিজেও খাবার খাওয়ার জন্য বসে যায়।
খাবার খাওয়ার সময়ও আবুলের চেহারা অনেক মলিন দেখায়। সাইদুর সেদিকে খেয়াল করে না, কিন্তু আবুলের মলিন চেহারা আজিরনের চোখ এড়ায় না; ছেলের মলিন চেহারার দিকে তাকিয়ে আজিনের চোখ যেন ছলছল করে ওঠে। মায়েদের এই এক সমস্যা, খাবার প্লেটের সামনে সন্তানের মলিন চেহারা তাদের যেন বুক ফাটা কান্নার খোরাক জোগায়! আজিরন আঁচল দিয়ে চোখ মুছে। মাড়ি শক্ত করে দুএকবার নাক টানে। স্বামীর উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে কথা বলে আজিরন, বিক্যাল ব্যাল্যা বলদটা নিয়্যা হাটোৎ যান! হঠাৎ গরু বিক্রির কথা শুনে সাইদুর যেন আকাশ থেকে পড়ে, বলদ বেচি কী করবু তুই?
—দ্যাকেন না ছোলট্যা ট্যাকার জন্যে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়্যা ক্যাংকা মোনমরা হয়্যা আচে! মোক্ এ্যল্ল্যা দেক্ক্যার মোনায় না।
–হ এ্যদ্যাংকা হোপ হয়্যা থাকলেই বলদ ব্যাচা নাগবে?
—তা নাগব্যানয়! এলা, এ্যল্ল্যা কার জন্যে? একটায় ব্যাটা, ধন-সম্পত্তি যদিল কোনো কামোতেই না নাগল, তালে এ্যগ্ল্যা কি হামরা কবোরোৎ নিয়্যা যামো?
আজিরনের এ কথার পর সাইদুর আর কথা বাড়ায় না। ভাত মুখে দিয়ে চাবাতে চাবাতে সম্মতির সুরে আবুলের দিকে তাকায়। বাবার চোখে চোখ পড়তেই আবুল কিঞ্চিৎ সংকুচিত হয়ে যায়, মিটমিট করে হাসে, নিজের একটি চ্যানেল দাঁড় করাতে পারবে—সে কথা ভাবতেই যেন আবুলের চোখে-মুখে খুশির জোয়ার খেলা করে।
৪.
বেলা গড়িয়ে বিকেল হলে, আবুল এবং সাইদুর গরু নিয়ে হাটের দিকে হাঁটা শুরু করে। প্রায় মাইল দুয়েকের পথ। গরুর দড়ি ধরে সাইদুর সামনে হাঁটে, পিছনে আবুল; বাবা-ছেলে গল্প করতে করতে হাঁটতে থাকে। বাবার সাথে গল্প করতে থাকলেও আবুলের মনে যেন অন্য গল্প খেলা করে। বাজারের কোন মোবাইলের ভিডিও ভালো হবে, স্ট্যান্ড কোনটা ভালো কাজ করবে, কোন সাউন্ড ডিভাইস ভালো হবে, কীভাবে রিলের ভিডিওগুলো আরও ভালোভাবে তৈরি করতে হবে—এসব আজগুবি ভাবনা আবুলের মনে যেন অনবরত ঘুরপাক খেতে থাকে। সর্বোপরি আবুলকে আজ অনেক খুশি খুশিই দেখায়। এরকম খুশি অতীতে আরও একবার হয়েছিল আবুল, বছর পাঁচেক আগে। বছর পাঁচেক আগে দশম শ্রেণি থেকে আবুলের পড়ালেখা বাদ দেবার সিদ্ধান্ত যখন সাইদুর আর আজিরন মেনে নিয়েছিল, তখন। ঐ সময়ও আবুল যারপরনাই খুশি হয়েছিল। তবে আজকে তার খুশির মাত্রা যেন একটু বেশিই মনে হয়। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে দুহাত বাঁকা করে উদ্ভট অঙ্গভঙ্গিতে নাচার চেষ্টা করে আবুল, থেকে থেকে মুখে আবার ‘আউ’ ‘মাউ’ ‘ইয়া’ এই জাতীয় শব্দও করে বসে। আবুলের অঙ্গভঙ্গি দেখে পথে চলতে থাকা দুএকজন পথচারী ঠোঁট টিপে টিপে হাসে। পথচারীরা ঠোঁট টিপে টিপে হাসলেও আবুল সেদিকে গুরুত্ব দেয় না, তার মনোযোগের কেন্দ্র কেবল যেন সে নিজে!
বাজারে আজ ক্রেতা সমাগম না থাকলেও গরু বিক্রি করতে সাইদুর এবং আবুলের খুব একটা বেগ পেতে হয় না! তবে গরু বিক্রির পর সাইদুরের চেহারা অনেকটাই মলিন হয়ে যায়। খুব যত্নে বড় করা গরু, দীর্ঘদিন লালনপালন করার কারণে পরস্পরের মধ্যে যে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, আজ হাটে এসে সে সম্পর্ক রূপ নিয়েছে চিরকালীন বিচ্ছেদে! জগতে মমতার বন্ধনগুলোর পরিণতি যেন এমনই হয়, প্রয়োজনের কাছে পরাজিত হওয়াটাই যেন মমতার নিয়তি! বিষয়টি মেনে নিতে সাইদুরের একটু সময় লাগে, কষ্ট হয়। গরু বিক্রির পর সাইদুরের ভেতরটা তাই হু হু করে ওঠে, বাজারে কিছু সময়ের জন্য পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সাইদুর, আনমনে কী যেন ভাবে। তার ভাবনার জগৎ অনুভূতি হয়ে অনবরত প্রকাশ করে চলে সীমাহীন সব হতাশার চিত্র।
বাজারে সাইদুর এবং আবুল ঘুরে ঘুরে পছন্দের সব বাজার-সদাই করে। গরুর মাংস, মাছ, তেল এবং প্রয়োজনীয় সব সবজিও থাকে তাদের বাজার তালিকায়। বাজার করা হয়ে গেলে, সাইদুর ছেলের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ বাঁকা সুরে জিজ্ঞেস করে, ক্যা বাহে, আরো কিছু কেনা নাগবে নাকি? সাইদুরের কথা শুনে আবুল মুচকি হাসে, একটু আমতা আমতা করে বলে, আব্বা এ্যটা গামচা কেনা নাগলোহয়! আবুলের কথা শুনে সাইদুর কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ করে। কিন্তু বিরক্ত বোধ করলে কী হবে! এখানে তার তো কিছুই করার নেই। ছেলের প্রয়োজন মেটাতেই যেখানে এতকিছু, সেখানে গামছা কোনো আহামরি বিষয় নয়। নিজের বিরক্তি চেপে সাইদুর ছেলেকে নিয়ে একটি গামছার দোকানে গিয়ে বসে। দোকানে বসার পর, আবুল দোকানিকে ভালো কিছু গামছা দেখাতে বলে। আবুলের কথামতো দোকানিও যেন বাহারি সব গামছার পসরা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। গামছার সেই বাহারি পসরা থেকে, আবুল তার পছন্দের লাল টুকটুকে একটি গামছা বেছে নেয়। দোকানি আবুলের পছন্দের গামছাটি ভাজ করে পত্রিকার কাগজ দিয়ে ভালোভাবে পেঁচিয়ে তুলে দেয় আবুলে হাতে। আবুল গামছা হাতে নিলে, সাইদুর গামছার দাম পরিশোধ করে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে।
৫.
সাইদুর এবং আবুল যখন দোকানে পৌঁছায়, রাত তখন প্রায় আট কী নয়টা বাজে; তখনও দোকান খোলাই ছিল। বাপ-ছেলের অনুপস্থিতিতে আজিরনই সামলেছিল পুরোটা দোকান। স্বামী এবং ছেলের আগমনে আজিরন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। সাইদুর দোকানে ঢুকে দোকানের এক কোণায় বাজারের ব্যাগটি রেখে জগ ভর্তি পানি নিয়ে দোকানের বাইরে যায়। আবুল দোকানের ভিতরে শেষ বেঞ্চে গিয়ে নীরবে জড়সড় হয়ে বসে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আবুল এটা বোঝে যে, তার মা তার প্রয়োজনের জন্য টাকার জোগান দিলেও একপ্রকারের ঝড়-তুফানের অভিজ্ঞতা না দিয়ে তাকে ছেড়ে দেবে না। আবুলের অভিজ্ঞতার সত্যতাও পাওয়া যায়। আজিরন আচমকা আবুলকে উদ্দেশ্য করে বকাঝকা শুরু করে, হারামজাদাটা খালি ধ্বংসের ওস্তাদ, সেই ন্যাংটাকাল থাকি মোর জেবনটা এ্যকেবারে জ্বলে খালো!.. ব্যাটার আর কী দোষ, ব্যাটার বাপেরেই তো কোনো হোদবোদ নাই..। আজিরনের কথা শুনে দোকানের বাইরে থাকা সাইদুর মুচকি মুচকি হাসে, হ হ তামান্ দোষ এ্যকন মোর,... তুই ন্যা নিজে কলু গরু বেচ্চ্যার কতা—এ্যকন ফির মোর ঘাড়োৎ দোষ দেইস ক্যা! দোকানে উপস্থিত দুএকজন ক্রেতা আজিরন আর সাইদুরের কাণ্ড দেখে হো হো করে হাসে। ক্রেতারা হো হো করে হাসলেও আবুলের কাছে পরিস্থিতি অনেকটা গম্ভীর হয়ে ধরা দেয়। আজিরন গজগজ করতে করতে বাজারের ব্যাগটি নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেলে, মায়ের বলা কথাগুলো ভেবে আবুলের অনেক মন খারাপ হতে থাকে, অনেকটাই চুপসে যায় আবুল। হাতে ধরে রাখা পেপারে মোড়ানো গামছাটি আস্তে করে বেঞ্চের উপর রাখে, আনমনে গামছার দিকে তাকায়, তাকানোর পর মোড়ানো পেপারটির একটি হেডলাইনে চোখ আটকে যায় আবুলের। আবুল বিড়বিড় করে হেডলাইনটি পড়ে—‘‘সবকিছু ছেড়ে দিয়ে গোরুর খামারি হলেন ফেসবুকের মালিক”। হেডলাইনটি পড়ার পর, পুরো সংবাদটি পড়ার আর আগ্রহ হয় না, আবুলের ভিতরটা কেমন জানি ডুকরে কেঁদে ওঠে, দুচোখের কোণায় জমাট বাধা পানি যেন জানান দিয়ে যায় তার অপরাধের পরিমাণ। অপরাধ বোধে ভোগে আবুল। অপরাধ বোধে ভুগতে ভুগতে কপালে ভাঁজ তুলে সে হারিয়ে যায় ভাবনার জগতে। তার ভাবনার সে জগতে, আকাশ-পাতাল একাকার করে আবুল খুঁজতে থাকে নিজের অবস্থান। নিজের অবস্থান খুঁজতে খুঁজতে আবুল হঠাৎ আবিষ্কার করে, তার অবস্থার সাথে নগেনের ছেলে কমলের অবস্থার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই!