এক.
আশফাক, এই আশফাক! নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে আশফাক। বিকেলবেলা স্বর্ণকার পট্টি দিয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছিল। নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই তার; হাইস্কুল মাঠে যেতে পারে—আজিজুল, মনির, আবু সাঈদরা আড্ডা দিচ্ছে সেখানে কিংবা গোরানের পাশ দিয়ে নদীর পারে—গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল ফুটে আছে যেখানে; অথবা অন্য কোথাও যেখানে তার মন চায়—এমন একটা ভাব নিয়ে হাঁটছিল। যেতে যেতে তার মাথার মধ্যে কতগুলে লাইন ঘুরতে থাকে।
‘আজকাল বুকের নিচে কেমন আক্ষেপ আক্ষেপ ঘ্রাণ পাই—
আমাদের মরা ডোবাটার পাশে বাঁশবাগান নাকি আতাগাছের
ঝোপের তলায় কারা যেন রোজ সন্ধ্যায় সুর করে কাঁদে—
আমার এত পরিচিত মনে হয়! মনে হয় শৈশবে
এমনি এক আহ্লাদ মাখা সুর আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিত...’
লাইন কটা সে বারবার মনে মনে বলে; পরের লাইন কী হবে ভাবে; এমন সময় ভেসে এলো ডাক। পেছন ফিরে দেখে খালেদ। খালেদ তার বন্ধু। প্রাইমারিতে তারা একসাথে পড়ত। ফাইভে ওঠার তিন মাস পর আশফাককে হাফেজি মাদরাসায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু সে হাফেজ হতে পারেনি। হাফেজি মাদরাসার কড়া নিয়ম। একদিন হাফেজি মাদরাসা থেকে এসে আর গেল না। এর মধ্যে তার এক বছর নষ্ট হয়ে গেল। পরের বছর আবার ফাইভে ভর্তি হলো। খালেদরা তখন সিক্সে উঠে হাইস্কুলে চলে গেছে। আশফাক যখন সিক্সে উঠল খালেদরা তখন সেভেনে। ওদের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। আশফাকের নতুন বন্ধুবান্ধব হলো। খালেদদের সাথে যে দেখাসাক্ষাৎ হয় না তা না। তারা একই কলেজে পড়ে। খালেদ ডিগ্রি ফার্স্ট ইয়ারে আর আশফাক ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। কলেজ ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎ হয়। তবে আগের যোগাযোগটা আর নেই। প্রাইমারিতে খালেদ আশফাকের ভালো বন্ধু ছিল। যাকে বলে অন্তরঙ্গ বন্ধু। একসাথে তাদের অনেক স্মৃতি। খালেদ ইদানীং রাজনীতিতে জড়িয়েছে। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন করে। কলেজে মাঝে মাঝে তাকে মিছিল করতে দেখা যায়। বক্তৃতা দিতে দেখ যায়। বিরোধী ছাত্রসংগঠনের সাথে মারামারিতেও তার ভূমিকা থাকে। খালেদ বলল, কিরে এমন আত্মভোলা হইয়া কই যাইতেছিস! কতবার তোরে ডাকতেছি; তুই শুনিসই না! আশফাক খানিকটা লজ্জা পায়। বলে, না রে খেয়াল করি নাই। তুই আছিস কেমন?
: ভালো। কই যাস?
: কোথাও না। এই হাঁটতেছি।
: তোর কোনো কাজ আছে এখন?
: না।
: চল নদীর পারে গিয়া বসি। অনেকদিন তোর সাথে কথা হয় না।
তারা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পারে এসে ঘাসের ওপরে বসে। ওপারে অজস্র কাশফুল ফুটে আছে। আকাশটা বেশ পরিষ্কার। স্নান করার পর ষোড়শী বালিকার মুখাবয়ব থেকে যেমন একটা শুভ্রতার আভা ফুটে ওঠে চারদিকে তেমন একটা পরিচ্ছন্নতা। আকাশে তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ। আশফাক বলে, পরিবেশটা চমৎকার তাই না! খালেদ বলে, হুম। কলেজ ম্যাগাজিনে তোর একটা লেখা দেখলাম। তুই আজকাল লেখালেখি করিস নাকি!
আশফাক মূলত কবিতা লেখার চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে তার বুকের ভেতরে এমন সব অনুভবের জন্ম হয় যা প্রকাশ করতে ইচ্ছা হয়; কিন্তু সেগুলো এমন অদ্ভুত এবং বিচিত্র যে সবার কাছে বলাও যায় না। সেই অনুভূতিগুলো আশফাক লিখে ফেলে। সেগুলো ঠিক কবিতা হয় কি না কিংবা হলেও তার মান কোন পর্যায়ে সে বিষয়ে তার নিজেরই সন্দেহ আছে। তাই এ বিষয়ে কারও সাথে আলাপ করে না। তার ডায়েরির পাতা ভরে উঠেছে কবিতায়। কলেজ ম্যাগাজিনে একটা নিবন্ধ লিখেছিল। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে। আশফাক লাজুক মুখে বলে, না না তেমন কিছু না; এই টুকটাক করি আরকি!
: লেখাটা আমি পড়ছি। তোর লেখার হাত আছে। ভালো লিখছিস। তোর দেখলাম ছাত্ররাজনীতির ওপরে অনেক ক্ষোভ!
আশফাক এবার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বলে, ক্ষোভ না থাকার কোনো কারণ আছে—ছাত্ররাজনীতির নামে তোরা যা করস! এইগুলারে গুণ্ডামি ছাড়া আর কী বলে! আমি যা লিখছি তার সাথে কোথাও তোর দ্বিমত থাকলে স্পেসিফিকলি বল। খালেদ বলে, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস তোর জানার কথা। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ এমনকি ৯০’র সৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের যে ভূমিকা সেইটাকে অস্বীকার করবি? ছাত্ররাজনীতি না থাকলে দেশ স্বাধীন হইত?
: আমিও তো সেই কথাই বলি। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, যে ঐতিহ্য আর বর্তমান সময়ে ছাত্ররাজনীতির দিকে তাকা। সত্যি কইরা বল, তোর লজ্জা লাগে না?
: প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। তার চিন্তা-ভাবনাও আলাদা। এইটাকে আমি সৌন্দর্যই মনে করি। বর্তমান রাজনীতি নিয়া আমার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা আছে। সেইটার সাথে তোর দ্বিমত থাকতেই পারে। তবে আজ রাজনীতির আলাপ থাক। তোর সাথে অন্য একটা বিষয়ে আলাপ করতে চাই। অনেকদিন থেকে মনে মনে তোকে খুঁজতেছি।
: বল।
খালেদ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আশফাককে একটা দেয়। নিজে একটা ধরায়। আকাশের দিকে মুখ তুলে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, বন্ধু আমি একটা সংকটের মধ্যে পইড়া গেছি। বিষয়টা কারও সাথে শেয়ার করতে পারতেছি না। আবার এড়াইতেও পারছি না। সারাক্ষণ মাথার ভেতরে বিষয়টা ঘোরাফেরা করে। এইভাবে থাকা যায় না।
: তোর সংকটটা কী নিয়া পরিষ্কার কইরা বল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারতেছি না।
: অমলকে তো তুই চিনস! আমাদের বন্ধু। ওর বোন লাবণ্য!
: হ। তো কী হইছে লাবণ্যর!
: তুই কবি মানুষ। তুই বুঝতে পারতেছিস না?
: লাবণ্যর প্রেমে পড়ে গেছিস?
: হুম।
: তো এইখানে সংকটের কী হইল? লাবণ্য দেখতে সুন্দর। কালচারড। যতদূর জানি মানসিকতাও উন্নত। এমন একটা মেয়ের প্রেমে পড়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার।
: তুই বুঝতে পারছিস না! ওরা তো হিন্দু! আর অমল আমার বন্ধু। অমল যদি জানে! ও কী মনে করবে? ওদের পরিবারের সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক। বিশেষ করে অমলের মা। তিনি আমাকে ছেলের মতো ভালোবাসেন। আর লাবণ্যও বিষয়টা কীভাবে নিবে! ওদিকে দিনরাত ওকে মনে পড়ে। ওর মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিছুতেই ভুলতে পারি না।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যায় খালেদ। তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে রাজ্যের বিষণ্নতা। আশফাক মনোযোগ দিয়ে শোনে। দুজনেই কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আশফাক বলে, বুঝতে পারছি। তুই এইভাবে ভাইঙা পড়িস না। তুই কোনো অপরাধ করস নাই। লাবণ্যকে ভালো লাগাটা স্বাভাবিক। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ এখনও ধর্মের বেড়াজালে আটকে আছে বন্ধু। কিন্তু মানুষের মন তো এই নিষেধাজ্ঞা মানে না। জগতে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। হিন্দু-মুসলমানের প্রেম কিংবা বিয়ে নতুন কিছু না। মনে রাখিস মানুষের একটাই পরিচয়—সে হলো মানুষ। দুজন মানুষ যদি একে অপরকে ভালোবাসে তার চেয়ে পবিত্র আর কিছু নাই। কিন্তু কথা হইল লাবণ্য কি তোরে ভালোবাসে?
আশফাকের কথায় স্বস্তি পায় খালেদ। তার মনটা হালকা হয়ে যায়। আশফাকের প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে যায়। সে বলে, জানি না। তুই তো জানস ওরা কালচারাল ফ্যামিলি। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক চর্চা আছে। লাবণ্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গায়, আবৃত্তি করে। ‘ও’ যে প্রকৃতির মেয়ে, যে কারও সাথেই সহজ করে কথা বলে। আমার সাথেও এমন সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলে! আমার প্রতি ওর একটা শ্রদ্ধাবোধ আছে এইটা বুঝতে পারি। কিন্তু সেইটা তো ভালোবাসা না! আমি ওরে কিছু বলি নাই। ‘ও’ এই বিষয়ে কিছু আন্দাজ করে কি না জানি না। কিন্তু আমি আর থাকতে পারছি না। দিনরাত ওর কথা মনে পড়ে।
: ওকে তো তোর মনের কথাটা জানানো দরকার।
: হ। এইখানেই তোর সাহায্য দরকার। এই কথা তো আর মুখ ফুটে বলা যায় না। একটা চিঠি লিখছি, কিন্তু সেই লেখা আমার নিজেরই পছন্দ হয় নাই। আমি আসলে গুছায়া লিখতে পারি না। ক্যাম্পাসে বক্তৃতা করলেও দেখলাম লেখা ব্যাপারটা আসলে ভিন্ন; এর ক্যামিস্ট্রি আলাদা। বলে সে পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে আশফাকের দিকে দেয়। আশফাক লেখাটা পড়ে। আসলেই লেখাটার ভেতরে কোনো আবেদন নাই।
আশফাক বলে, না বন্ধু লেখাটা আসলেই ভালো হয় নাই।
: তুই সাহায্য কর বন্ধু। তুই লেইখা দে।
আশফাক কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে, আচ্ছা চেষ্টা করে দেখি।
এরপর আশফাক জেনে নেওয়ার চেষ্টা করে লাবণ্যকে কীভাবে ভালো লাগল, কবে থেকে ভালো লাগা শুরু হয়েছে; টুকিটাকি ঘটনাপ্রবাহ।
দুই.
লাবণ্য,
নিজের সম্পর্কে আমার একটা ভালো ধারণা ছিল—আত্মবিশ্বাস ছিল—আমি মোটামুটি গুছিয়ে লিখতে পারি। লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু এ লেখা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে সে ধারণা সঠিক না। কী দিয়ে শুরু করব আর কীভাবে আমার অভিব্যক্তি প্রকাশ করব সেটা ভেবে পাচ্ছি না। তার অবশ্য কারণ আছে, যে কথাগুলো বলব সেটা আমাদের সমাজ বাস্তবতায় অসংগতিপূর্ণ এবং অনভিপ্রেত। এবং তুমিও বিষয়টাকে কীভাবে গ্রহণ করবে সে বিষয়ে নির্ভার নই। জানি স্বাভাবিকভাবে না নেওয়াটাই স্বাভাবিক। তদুপরি আমাকে লিখতে হচ্ছে। কারণ না লিখে থাকতে পারছি না। এ দুঃসহ ভার আর সইতে পারছি না।
জানি এ লেখা হবে অগোছালো এবং অসংলগ্ন। সেটাই হচ্ছে। হওয়ারই কথা। কারণ আমার মন এই মুহূর্তে যেমন চঞ্চল আর বিশৃঙ্খলপূর্ণ তাতে গুছিয়ে লিখতে পারার কথা না। একটাই ভরসা, যদি তুমি হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করো। জানি, সেটা করবে। কেননা তুমি হৃদয়বতী। আজ যেহেতু লিখতে বসেছি কোনো রাখঢাক না রেখে সমস্ত কথাই বলতে চাই—
তোমাকে আমার ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে। তোমার মুখশ্রীর ভেতরে এমন একটা শিল্পময়তা আছে যা আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। এ আকর্ষণ থেকে নিজেকে কিছুতেই নিবৃত করতে পারি না। ঠিক কবে থেকে এবং কীভাবে এ ভালো লাগা শুরু হয়েছে সঠিক বলতে পারব না। তবে এটুকু জানি দীর্ঘদিন। তুমি একবার ঢাকায় তোমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেশ কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গেলে। পুরো শহরটা আমার কাছে নিরানন্দের শহর হয়ে উঠল। যেখানেই যাই শান্তি পাই না। আড্ডা দেওয়া কিংবা তুমি তো জানো মাঝে মাঝেই আমরা এখানে ওখানে ঘুরতে যাই এবং বিমল আনন্দ পাই; কিন্তু ঐ কদিন কোথাও কিছুতে এতটুকু সুখ পাইনি। যখন তোমাদের বাসায় যাই, তোমাকে দেখতে না পেলে বুকের ভেতর কেমন একটা খাঁ খাঁ শূন্যতা জমে ওঠে। আর তোমাকে দেখতে পেলে মনে হয়, না সবকিছু ঠিকঠাক আছে। পৃথিবীটা সত্যিই সুন্দর!
কতদিন ভেবেছি তোমাকে ভালো লাগার বিষয়টা তোমার সাথে শেয়ার করব। কারণ তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কারও কাছে এটা শেয়ার করা যায় না। এদিকে এমন গভীরতর আনন্দ এবং প্রগাঢ় কষ্টময় অনুভূতি একা একা বয়ে বেড়ানো যায় না। অসম্ভব। তাই অগণনবার ভেবেছি তোমার সাথে শেয়ার করব। কীভাবে সেটা করব তার জন্য অনেক প্ল্যান করেছি। কী কী বলব মনে মনে রিহার্সেল দিয়েছি—দেখা গেল তোমাদের বাসায় গেলাম। তুমি ছাড়া বাসায় কেউ নাই। এ কথা সে কথার পর হঠাৎ বললাম, লাবণ্য তোমার সাথে একটা সিরিয়াস কথা বলতে চাই। তুমি বললে, বলেন। আমি শুরু করলাম। তুমি সুন্দর...। ওরকম একা একা যে দু-একবার পাইনি তা না। তবে বলতে পারিনি।
অনেক সময় কলেজ ফাংশন শেষে তোমাকে এগিয়ে দিতে গিয়েছি। অমল কিংবা তোমার কাকা ছিলেন না। এমন কোনো একবার তোমাকে এগিয়ে দিতে গেলাম। কলেজ রোড পার হয়ে পোস্ট অফিস মোড় ঘুরলাম। দুই পাশে বিস্তীর্ণ চক। মাঝখান দিয়ে তোমাদের বাড়িতে যাবার পিচঢালা রাস্তা। চকে থইথই পানি। যেন একটা শান্ত সমুদ্র। আকাশে তখন মস্ত চাঁদ। জোছনায় চারদিক ঝলমল করছে। একটা ফুরফুরে বাতাস শরীরে রি রি করে বয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে আমি বললাম, পরিবেশটা চমৎকার তাই না! তুমি বললে, হুম। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর গ্যাসলাইট বের করতে করতে আমি বললাম, খুব সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি যদি একটা সিগারেট ধরাই তুমি কিছু মনে করবে?
: আপনি সিগারেট খান? অমলদাও খায়, তাই না!
: হুঁ। অমল অবশ্য মাঝে মাঝে খায়। ধরাব?
: আচ্ছা, ধরান।
সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলব, লাবণ্য তোমার সাথে সিরিয়াস একটা কথা বলতে চাই।
: বলেন।
: তুমি সুন্দর। এত সুন্দর যে তোমাকে না দেখে থাকতে পারি না। তোমাকে আমি...
কলেজ ফাংশন শেষে ওরকম একা একা ওই পথে দু-একবার তোমাকে নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু বলতে পারিনি—ভয়ে, সংশয়ে। ভয় মূলত দুটি। প্রথমত, অমল কিংবা কাকিমা যদি বিষয়টা জানতে পারেন! আমাকে কী ভাববেন তারা? সেটা ভাবতেও পারি না। দ্বিতীয়ত, তুমি যদি বিষয়টা না নিতে পারো! কষ্ট পাও! তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। তুমি কষ্ট পাও, বিব্রত হও এমন কিছু কখনোই করতে চাই না। আমি সর্বান্তকরণে চাই তুমি ভালো থাকো। সুখে থাকো। আনন্দে থাকো।
হয়ত বলবে, তাহলে এমন একটা বিষয় কেন লালন করেন? মানুষের মন কী বিচিত্র আর জটিল! সে কোনো নিয়ম মানে না; সমীকরণ মানে না। আর সত্যি কথা বলতে মানুষকে আমি মানুষ হিসেবেই গণ্য করি। এইসব জাত-পাত ধর্ম-অধর্ম আমি মানি না। মানুষের একটাই পরিচয়—সেটা হলো মানুষ। তুমি তো সংস্কৃতিবান মানুষ তাই বলি, মানুষকে ভালো লাগা যদি অপরাধ হয়, ভালোবাসা যদি পাপ হয়; তবে আমি অপরাধী। পাপী। যে শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেব। তবু হৃদয়ের এই অনুভবকে আমি অস্বীকার করব না; শত সহস্রবার ঘোষণা করব আমি তোমাকে ভালোবাসি।
জানি না এ লেখা তুমি কীভাবে গ্রহণ করবে। যদি সহজভাবে নাও সুখী হব। দীর্ঘ সময় নিয়ে এ লেখা পড়ার জন্য তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
তোমার প্রতিক্রিয়া জানিও। প্রতীক্ষায় রইলাম।
তুমি ভালো থেকো।
খালেদ।
চিঠিটা লেখার পর আশফাক বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে। যদিও চিঠিটা শেষ করতে করতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। তবু সে রুম থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যায়। ঘরের সাথেই তার আলাদা রুম। তুষি, আব্বা এবং মা থাকেন বড় ঘরে। বড় ভাই আশরাফ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। রুমে সে থাকে একা। ইচ্ছেমতো রুম থেকে বের হওয়া যায়। আব্বা কিংবা মা কেউ টের পান না। অবশ্য কলেজে ওঠার পর আগের সেই কড়া নিয়ম আর নাই। আগে যেখানেই থাকত সূর্য ডোবার আগে ঘরে ফিরতে হতো। নিলুফা ইয়াসমিনের কড়া হুকুম। এর ব্যতয় করার উপায় ছিল না। রুমের পাশেই মাটির সরু রাস্তা। দুই পাশে মেহগনি, কড়াই আর নানান রকম জংলি গাছের সারি। এমনিতেই এ রাস্তা নিরিবিলি। এখন চারিদিকে কেমন সুনসান নীরবতা। আশফাক হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পাশে বড় মাঠটায় এসে বসে। সপ্তমীর চাঁদ নৈঋতে হেলে পড়েছে; তবু একটা আবছা আলো চারদিকে লেপটে আছে। আশফাক একটা সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ধোঁয়া ছাড়ে। তার ইচ্ছা হয় এখনই সে চিঠিটা খালেদের কাছে পৌঁছে দেয়। খালেদ কি এ লেখা পছন্দ করবে কিংবা লাবণ্য কি চিঠিটা পড়ে আদৌ কোনো প্রতিক্রিয়া জানাবে? কেমন একটা অস্থিরতা ভর করে তার ভেতর।
সকালে কলেজে গেলে খালেদ উৎসাহের সাথে বলে, লিখছিস! আশফাক বলে, চল বাগানে যাই। কলেজের আর্টস বিল্ডিংয়ের পেছনে লস্করদের একটা বিশাল বাগান। সেখানে নানান রকমের গাছ। কেমন ছায়া ছায়া একটা ভাব। সেখানে তারা মাঝে মাঝেই আসে। গল্প করে। আশফাক পকেট থেকে চিঠিটা বের করে খালেদকে দেয়। খালেদ আগ্রহের সাথে চিঠিটা পড়তে থাকে। আশফাকের বুকটা কেমন দুরু দুরু করে। কে জানে কেন! এক নিঃশ্বাসে চিঠিটা শেষ করে খালেদ। বলে, দোস্ত চমৎকার হইছে। একেবারে আমি যে কথাগুলো বলতে চাইছি সেই কথাগুলা লিখছিস। ধন্যবাদ দোস্ত। বলে সে আশফাককে জড়িয়ে ধরে। আশফাকের বুক থেকে একটা ভার যেন নেমে যায়।
এরপর কয়েকদিন কেটে যায়। খালেদের সাথে আশফাকের দেখা হয় না। আশফাক অবশ্য দুদিন কলেজে যেতে পারেনি। হঠাৎই সে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে। দিনের বেলা গরম। ফ্যান ছাড়া থাকা যায় না। রাতে ঠাণ্ডা। সকালের দিকে কাঁথা গায়েও শীত শীত লাগে। একদিন বিকেলে খালেদ আশফাকের রুমের সামনে এসে ডাক দেয়, আশফাক! আশফাক কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। সে বলে, আয়। ভেতরে আয়। খালেদের চোখে মুখে একটা উদ্বিগ্নতা ফুটে আছে। চোখ রক্তবর্ণ। বোঝা যায় রাতে ঘুম হয়নি। আশফাক বলে, খবর কী বল।
: খবর আছে। বলে সে পকেট থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা মার্জিন করা কাগজ বের করে আশফাককে দেয়। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা :
খালেদ ভাই,
আপনাকে আমি ভাইয়ের চোখেই দেখেছি। অমলদা কিংবা মাও হয়ত তাই ভাবেন। আপনাকে নিয়ে অন্য কোনো ভাবনা মাথায় আসেনি। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। সেটা আজীবন করতে চাই।
সত্যি কথা বলতে কি ইতোপূর্বে আমি বেশ কিছু চিঠি পেয়েছি। কোনো চিঠির প্রতিউত্তর করিনি। না, অহংবোধ থেকে নয়। সেসব চিঠির ভাষায় একটা মেকি মেকি ভাব ছিল। আর আমিও কোনো মানসিক সম্পর্কে জড়াতে চাইনি। এখনও চাই না। আপনার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছি। জাত-পাত আমিও মানি না। তবু সমাজ এবং পরিবারকে অস্বীকার করা যায় না। করা উচিত না। তাই বলব বিষয়টা ভুলে যান।
ভালো থাকবেন।
লাবণ্য।
চিঠিটা পড়ার পর আশফাক চুপ করে থাকে। লাবণ্য প্রতিউত্তর দিয়েছে এতেই সে আনন্দিত। লেখাটা তাহলে খারাপ হয় নাই। লাবণ্যর মনে আঁচড় কাটতে পেরেছে। খালেদ বলে, কিরে চুপ কইরা আছিস ক্যান?
আশফাক ভারিক্কি চালে মাথা নাড়ে। বলে, হুম।
খালেদ খানিকটা বিরক্তই হয়। তবু যেন নিজের মনে বলছে এমনভাবে বলে, লাবণ্য ওরে ভুইলা যাইতে বলছে; কিন্তু আমি তো অরে কিছুতেই ভুলতে পারতেছি না। সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারি নাই। কী যে অসহনীয় কষ্ট!
আশফাক এবারে মুচকি হাসে। বলে, মানুষ প্রেমে পড়লে শিশু হয়ে যায়। কোনো লজিকই তখন কাজ করে না। সে ভীষণ অভিমানী হয়ে ওঠে। তোকে দেখে আবারও তা প্রমাণিত হলো। বোকা! মেয়েরা কি এত সহজে ভালোবাসার কথা বলে! তোকে যে লাবণ্য ভালোবাসে এ চিঠিতে সেটা স্পষ্ট। প্রথমত, সেটা না হলে সে তোকে লিখত না। আর দ্বিতীয়ত, এটাই সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; ‘ও’ জাত-পাত ধর্ম-টর্ম মানে না; তুই বুঝতে পারছিস এটা কত বড় কথা! সবচেয়ে বড় বাধাটাই তো লাবণ্য উত্তরণ করে দিল!
খালেদের ইচ্ছা হয় আশফাককে জড়িয়ে ধরে। ওর কাছে এলে সত্যি মনটা ভালো হয়ে যায়। নিজেকে সে সংযত করে। বলে, আমিও যে এভাবে ভাবি নাই তা না। তবু স্বস্তি পাচ্ছি না কেন?
: তোর মনটা দুর্বল হয়ে আছে। লাবণ্যকে নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনার ফলেই এমনটা হইছে। দুর্বল মন সবসময় নেতিবাচকতার দিকে ঝোঁকে।
খালেদ এবার সত্যি চাঙ্গা হয়ে ওঠে—তোর শরীরের কী অবস্থা! উঠতে পারবি? চল কার্তিকদার দোকানে যাই। মাখন টোস্ট খাই। আশফাক দুর্বল শরীরেও গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। বলে, চল।
তিন.
এরপরে চিঠি চালাচালি চলে। নিজের লেখার প্রতি আশফাক আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ভীষণ দরদ আর প্রেম দিয়ে লেখে একেকটা চিঠি। চিঠির ভেতরে নিজের লেখা কবিতার অংশবিশেষ কিংবা কোথাও পুরো কবিতা জুড়ে দেয়। এমন হয় যে চিঠির প্রয়োজনেই সে লাবণ্যর জন্য কবিতা লেখে। সেই কবিতায় লাবণ্যর অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা আর লাবণ্যর জন্য গভীর আকুতি ফুটে ওঠে। সে চিঠি পড়ে ক্রমে দুর্বল হতে থাকে লাবণ্য। অবশেষে চতুর্থ চিঠিতে আসে সম্মতি।
চার.
একদিন খালেদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। উদ্ভ্রান্তের মতো তার চেহারা। আশফাক বলে, কিরে আবার কী হইল! এমন অবস্থা ক্যান তোর?
খালেদ যা বলে তার সারমর্ম এরকম :
লাবণ্যর পিসির ভাসুরের ছেলে থাকে কানাডা। স্টুডেন্ট ভিসায় গিয়ে লেখাপড়া শেষ করেছে। সেখানেই সেটেল্ড। দেখতে শুনতেও বেশ। সে দেশে এসেছে। বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে কানাডায়। তারা লাবণ্যকে দেখে পছন্দ করে গেছে। ছেলের ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে। তাই তারা শুভ কাজটা দ্রুত সারতে চায়। লাবণ্যর পরিবার রাজি। এমন সুপাত্রে যেকোনো অভিভাবকই কন্যা সম্প্রদান করতে চাইবেন। আগামী শুক্রবার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। এদিকে লাবণ্য কেঁদে-কেটে অস্থির। লাবণ্য জানিয়েছে সে খালেদকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। সে যেন তাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়।
আশফাক বলে, তুই কী চিন্তা করছিস! কী করবি এখন।
: আমিও লাবণ্যকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।
: তাহলে তো ঠিকই আছে। কোথায় যাবি ঠিক করছিস কিছু?
খালেদ কিছু ঠিক করতে পারে না। তার মাথা কাজ করছে না। এমন হুট করে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে। তা ছাড়া লাবণ্যকে নিয়ে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে; সে কেবল ডিগ্রি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে—সামনে তার পরীক্ষা। তা ছাড়া এই মুহূর্তে তার হাতের অবস্থাও ভালো না। সর্বসাকুল্যে একশ পঁয়ত্রিশ টাকা আছে পকেটে। সে সবকিছু খুলে বলে আশফাককে।
আশফাক বলে, চিন্তা করিস না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সময় সবকিছুকে স্বাভাবিক করে দেয়। তবে এটা তোর জীবনে একটা বড় সিদ্ধান্ত। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর। নিজের হৃদয়ের কাছে জিজ্ঞেস কর কী করবি।
: আমি অনেক ভেবেছি—লাবণ্যকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।
এরপর দুইজনে মিলে নানান পরিকল্পনা করে অবশেষে ঠিক করে, আশফাকের এক মামা থাকেন খুলনায়। তিনি পাটের কোম্পানিতে চাকরি করেন। ব্যাচেলর মানুষ। মানুষ হিসেবে খুবই ভালো। আশফাকের সাথে সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। আপাতত ওরা তার কাছেই উঠবেন। আশফাক চিঠি লিখে দেবে। টাকারও একটা বন্দোবস্ত হয়ে যায়।
পাঁচ.
অতঃপর খালেদ ও লাবণ্য সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিল...
এ গল্পের শেষটা এখানেই হতে পারত। লাবণ্য ও খালেদ হয়ত ভালোই আছে। তারা খুলনায় পৌঁছেছে। মামা তাদের ভালোভাবে রিসিভ করেছেন। খালেদের চিঠি মারফত এ খবর আমরা জেনেছি। কিন্তু আশফাকের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। চিঠি লিখতে লিখতে কখন যে আশফাক লাবণ্যর প্রেমে পড়ে গেছে সেটা সে টেরও পায়নি। বিদায়ের সময় বাসের জানালা দিয়ে যখন লাবণ্য কৃতজ্ঞতা ভরা দুটি ডাগর চোখে আশফাকের দিকে চাইল আর ধীরে ধীরে বাসটা স্টপেজ ছেড়ে চলে গেল তার বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেল। তার মনে হলো সে আর লাবণ্যর কাছে চিঠি লিখতে পারবে না!
আশফাক বরাবরই যৌক্তিক মানুষ। সে খালেদের ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করে। মন থেকে চায় ওরা সুখী হোক। সে জানে লাবণ্যকে নিয়ে তার এই ভাবনা অনাহুত এবং পাপ; তবু সে নিজেকে সংববরণ করতে পারে না; দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা লাবণ্যর কথা মনে পড়ে। লাবণ্যকে নিয়ে লেখা কবিতার কথা মনে পড়ে। চিঠিতে লেখা সমস্ত কথা মনে পড়ে; আর লাবণ্যর জন্য বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে। তার এই ভালো লাগার কথা ভালোবাসার কথা পৃথিবীর কারও কাছে বলা যায় না; এমনকি নিজের কাছেও না। একটা ভীষণ দ্বন্দ্ব তার হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। রাতবিরাতে নদীর পার ধরে সে একা একা হাঁটে আর তার চোখের কোণ বেয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।