X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

দাফন

শাশ্বত নিপ্পন
০৯ মে ২০২১, ০৭:৩৯আপডেট : ০৯ মে ২০২১, ০৭:৩৯

ছুটে এসে মাহতাব ট্রাকের কেবিনে উঠে ড্রাইভারের পাশে বসে ড্যাসবোর্ডে সিগারেট, পানি আর পান রাখতে রাখতে উত্তর করে, ‘গাড়ি বাড়ান ওস্তাদ, চাক্কার গ্যাটিস তো নাইক্কা।’
‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবানাকা...’ বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে ইগনেশনে চাপ দিতেই, পাঁচ টনের টাটা ষোলো ছত্রিশ মডেলের দানবটা হুহু করে স্টার্ট নেয়। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে গিয়ার দিতেই মাহাতাব জানালা দিয়ে পিছনে তাকিয়ে চিৎকার দেয়, ‘উপরে উঠসো তো? কেডা?’―বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে ড্রাইভার বিল্লাল।
‘কাঙালি উস্তাদ; নীলফামারীর মাল।’
‘হালার পো হালা―তুমি টিরিপ না পাইয়া মাতারি তুলছস? খানকির পোলা।’
‘উস্তাদ ছোট মাল উডাইছি, লগে...’
‘লগে কী?’
‘একডা মাইয়া উস্তাদ; বিলকিস আক্তার নাম। নীলফামারী যাইব।’ বলে ফিচ করে ইঙ্গিতপূর্ণ একটা বিশ্রী হাসি দেয় হেলপার মাহাতাব। গাড়ি তখন একটা ছোট সাইড নিয়ে টপ গিয়ারে উঠে পূর্ণ গতিপ্রাপ্ত হয়। হুহু করে ছুটছে রাস্তার উস্তাদ। সাইড নিচ্ছে বেশি দিচ্ছে কম। একটা গাছের বড় ডালকে দক্ষ হাতে কাটিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে মাহাতাবের দিকে তাকায় বিল্লাল ড্রাইভার। জানালা দিয়ে রাস্তার আগপাছ ভালো করে দেখে নিয়ে মাহাতাব বলে, ‘গারমেনছে কাম করে; চিপার বিতরে বইয়া কানতেছিল।’
‘বাইনচোত, খাইছস তুই?’
‘আরে নাহ; খোদার কসম না; তয় খামু উস্তাদ।’ বলেই খিচখিচ করে আবার বিশ্রীভাবে হাসে মাহাতাব। তারপর সামান্য চুপ করে আবার বলে, ‘আকাশে ম্যাঘ দেখতাছেন না; আল্লায় একটু পানি দিলেই মালডারে কেবিনে আনুম নে। হেরপর আগে আপনি উস্তাদ উসকে বাদ আমি।’―বলেই খ্যাক করে একদলা থুতু দলা পাকিয়ে রাস্তায় ফেলে মাহাতাব।
রাস্তা ভেজা, প্রবল ঝড়ের রেশ এখনো শেষ হয়নি। সারা পথেই ধ্বংসযজ্ঞের চি‎হ্ন। গত ঝড়ে মনে হয় সারা দেশটাকেই তছনছ করে গেছে। উপড়ে পড়া গাছ, গাছের ডাল, ছেঁড়া বিদ্যুতের তার রাস্তায় পড়ে আছে বিপজ্জনক ভাবে। ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। একদিকে প্রাণঘাতী রোগ করোনার লকডাউন আর অন্যদিকে বৈশাখী ঝড়―গোদের ওপর বিষফোঁড়া। সেই প্রবল বাতাসের রেশ এখনো আছে। ফাঁকা মাঠের বুক ধেয়ে আসছে উদার বাতাস। সেই বাতাসে মিশে আছে বৃষ্টির কুচি। ঠান্ডা হিমেল বাতাসের দমকায় শরীর মন ঠান্ডা হয়ে যায় মুহূর্তেই। মাহাতাব পাশের জানালা দিয়ে মুখ ঝুলিয়ে সামনের বিবরণ দিতে থাকে, পেশাদারি ভাষায়-ট্রাকের শরীরে বাড়ি মেরে সে তারস্বরে বলতে থাকে―‘সামনে ডবল, ডবল আছে, বাঁয়ে জমা, হালকা ডানে উস্তাদ, বাঁয়ে পিলাসটিক।’ তবে সব কথা কানে নিচ্ছে না বিল্লাল। ‘হালকা উস্তাদ, ডবল, তেডবল।’ আবার চেঁচিয়ে ওঠে মাহাতাব। সামনে দুচোখ স্থির রেখে যন্ত্রের মতো গাড়ি চালাচ্ছে বিল্লাল। মাহাতাবের সব নির্দেশনা শোনা গেলেও কানে তোলে না বিল্লাল। ডান হাতের খোলা জানালা দিযে হুহু বাতাস ওর শরীরে শীত ধরিয়ে দিচ্ছে। স্থিরদৃষ্টিতে রাস্তাটা যত ভাসছে তার চেয়ে বেশি দোল খাচ্ছে একটা মেয়ের উদোম শরীর। ডবগা শরীরের থলথলে স্তন, মেয়ে মানুষের শরীরের গন্ধ, কালো দাগ ধরা নাভি। নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে বিল্লাল―‘বয়স কিমুন রে মাহাতাব?’ জানালার বাইরে মুখ রেখে যান্ত্রিক গলায় মাহাতাব উত্তর করে, ‘মুখে মাস্কটা দিয়ালন; খানকির পোলারা রোডের বিতরে খাড়াইয়া আছে।’ ইদানীং সার্জেন্ট গাড়ির কাগজ দেখার আগেই মুখে মাস্ক দেখছে।

দুই
এছাড়া বিলকিসের সামনে আর কোনো পথ খোলাও ছিল না। শেষমেষ অবশ্য তার কপালে একটা ট্রাক জুটল―তাই-বা কম কিসের! গত এক সপ্তাহ সে ফ্যাক্টরিতে যেতে পারেনি। তার বুকের ব্যথাটা বেড়েছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ফুসফুসে বাতাস পাচ্ছে না মোটেও। জমানো টাকা বলতে ফ্যাক্টরিতে দুমাসের বেতন পাওনা আছে। এই করোনাকালে ফ্যাক্টরি বন্ধ হয় হয়―এমন সময় টাকার কথা মুখে তোলা অন্যায়। দুপুরের পর বিলকিসের একবার বমি হলো। তারপর গা কাঁপিয়ে এল জ্বর। ভেজালটা বাধল সন্ধ্যার একটু আগে। মহল্লার মেডিসিন কর্নারে বিলকিস গিয়েছিল জ্বর আর মাথাব্যথার বড়ি কিনতে। মেডিসিন কর্নার মানে টিনের চালের ঔষুধের দোকান। ঔষধ বলতে সস্তা ব্যথার বড়ি, কাশির সিরাপ, নাপা, প্যারাসিটামল জন্মনিরোধ বড়ি আর কনডম। তারপরও ভিড় লেগেই থাকে―বিশেষ করে বিকেলের দিকে। বিলকিস সামান্য হেঁটেই ভীষণ হাঁপিয়ে উঠল। সে দেখল অনেকেই মুখে মাস্ক ঝুলিয়ে কথা বলছে। দোকানদার রবিউল ডাক্তারের মুখেও একটা গেঞ্জিকাটা মাস্ক। বিলকিস লাইনে দাঁড়ায়। হঠাৎই দোকানদার উঁচু গলায় বলে, ‘ধারে আইও না, ফারাকে খাড়াও।’
‘ক্যান কি অইছে?’ শরীরের সবশক্তি একত্রিত করে জবাব দেয় বিলকিস। তারপর বলে, ‘জ্বরের বড়ি দ্যাও ডাক্তার।’
‘ত্যাজ কমাও, তোমারে তো ধরছে―টেস করাও, চালু।’ চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে বলে দোকানদার রবিউল ডাক্তার। মুহূর্তে সবকটি চোখ বিলকিসকে তাড়া করে। দোকান ফাঁকা হয়ে যায় চোখের পলকে। আর টেস্ট করা লাগেনি বিলকিসের। রবিউল ইসলামের কথার সাথে সাথে বিলকিসের কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে গেল। ‘বিলকিস রে করোনায় ধরছে’―এই খবর দাবানলের মতো মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে। সবাই নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। নিঃসঙ্গ হয়ে যায় সে। সন্ধ্যা নামতেই বিলকিসকে ছাড়াতে হয় মেস। একঘণ্টা মিটিং করে মুরুব্বিরা তাকে মহল্লাছাড়া করল রাতেই। আর অসুস্থ হার্টসহ অ্যাজমা রোগী বিলকিস আক্তার এসে দাঁড়াল খোলা আকাশের নিচে―তখন চাঁদ উঠেছে আকাশজুড়ে। বিলকিসের মনে হয় মাটিতে যখন নাড়ি ছেঁড়া ঘটনাগুলো ঘটে তখনই আকাশে এমন চাঁদ জাগে। যেদিন বিলকিসের মা গলায় দড়ি নিয়েছিল, সেদিনও আকাশ রাঙিয়ে উঠেছিল চাঁদ। সৎমা যেদিন ওকে তাড়িয়ে দেয় সেরাতও ছিল অপূর্ব চাঁদ। প্রাইমারি স্কুলের নির্জনে সৎমায়ের ভাই বিলকিসের পায়জামা খুলেছিল―সেদিন সেই দাজ্জালের বুকের নিচে শুয়ে যে একফালি চাঁদ ওর চোখে পড়েছিল, তার চেহারাটাও এরকমই মায়াময় শান্ত। সে রাতেও নিলফামারীর আকাশজুড়ে উঠেছিল এমনই জোছনামাখা চাঁদ। সেই চাঁদ দেখেই বিলকিস ভুলে থেকেছিল তার সারা শরীর দুমড়ান ব্যথা আর তলপেট ছেঁড়া যন্ত্রণা।
বিলকিস দাঁড়িয়ে থাকে ‘আপার স্কাই’ গার্মেন্টসের সামনে। তারপর হাউমাউ করে সে কেঁদে ওঠে। তার কান্না অন্ধকারকে আরো জমাট করে। রাতের শান্ত রাস্তার আছড়ে পড়ে চিৎকার করে ওঠে বিলকিস, ‘বাজান গো তোমার বিটি ছ’র জান যাবার নাগছে, হামার দ্যাশত যাওনা লাগবি; তোমার চেংরি খাওয়া বিনে মরি যাইছে, বাজান গো। হামার ঘরত যাওয়া লাগবি গো বাজান।’ চারদিকে গুমোট অন্ধকার, বাতাস নেই কোথায় একচিলতে। আকাশের কোন মেঘ জমেছে―ঘন কালো গভীর মেঘ। বিলকিসের মনে পড়ে ছেলেবেলায় নীলফামারীর আকাশে বৈশাখী মেঘ জমত। মা বলত, ‘এ্যকুন ঘরত থাকেন, বাইরে যাওয়া নাগিবে না, ম্যাঘত কালো বুড়ি আসি গেইছেন।’ আজ মা নেই কিন্তু আকাশে কালো বুড়ি আজো আসে যায়। বিলকিস তার ফোনটা বের করে, তারপর অতি সাবধানে আব্বা জালাল শেখের নাম্বার বের করে ইয়েস বাটনে চাপ দেয়।
গুড় গুড় করে মেঘ ডাকে। বিলকিস আকাশের দিকে তাকায়। ঝড় আসবে না কি? আর আসলেই-বা কি তার মাথায় কোনো চাল বা ছাদ নেই। তবে এক সময় বিলকিসের মনে স্বপ্ন বাসা বেঁধেছিল―ঘরের স্বপ্ন, বাসরের স্বপ্ন, বর্ষণমাখা দুপুরে থিকথিকে ক্লান্ত একচিলতে উঠানের স্বপ্ন। সেস্বপ্নের দাপটে বিলকিসের চোখে ঘুম আসত না। আসতে দিত না মুনতাজ ব্যাপারী। তার সাথে অনেকটা পথ সে হেঁটেছে ঘনঘোর মোহে। সবকিছু তুলে দিয়েছিল সে ব্যাপারীর হাতে। তার বিশ্বাস, রোগগ্রস্ত শরীর, পোকায় খাওয়া যৌবন আর স্বপ্ন। এক সময় মুনতাজ সবকিছু বিলকিসের আঁচলে রেখে, তার জমানো তের হাজার টাকা নিয়ে লাটাই কাটা ঘুড়ি হয়ে মিলিয়ে যায় কোনো জনসমুদ্রে। এখন সে দৌলতদিয়ার ফেরিঘাটে অষ্টধাতুর আংটির হকারি করে। থাকে দৌলতদিয়া ঘাটের নিষিদ্ধ পাড়ায়।
আজ এই দুঃসময়ে হঠাৎ মুনতাজ ব্যাপারীর কথা মনে হয় তার। বিলকিস নাম্বারটা টিপে অপেক্ষা করতে থাকে আগ্রহ নিয়ে। দুবার রিং হতেই উত্তর আসে―‘হ্যালু, কেডা?’ কাশির দমকটা সামলে বিলকিস বলে, ‘হ্যালো, ব্যাপারী হামার শরীলতা ভালো না, জ্বর, চারদিন, বুকের বাতাস পাই না, বুক চাইপ্যা ধরে। আপনে হামারে নিয়া যান।’
‘ভাইরাচ না কি?’
‘কি কন? হ্যালো’―কথা শেষ না হতেই কাশি আসে বিলকিসের। নিশ্বাস নিতে ছাতি ফেটে যায় তার। ব্যাপারী দু-একটা কথা হু হ্যাঁ উত্তর দিয়ে মুখ খুলে দিলো ম্যান হোলের ঢাকনার মতো, ‘অই লটি মাগির ছাওয়াল, খানকি মাগি, তুই যার তার লগে হুইয়া ভাইরাস বাদাইছস্, আর আমারে তুই ফুন দ্যাস, কাইট্যা গাঙে বাসাই দিমু।’ তারপর লাইনটা কেটে যায়।
শো শো শব্দে ঝড় ওঠে দুনিয়া কাঁপিয়ে। সাথে আঁধার করা বৃষ্টি। বিলকিস গার্মেন্টেসের গ্যারেজের ফাঁকায় এসে দাঁড়ায়। শূন্যচোখে ঝড়ের তাণ্ডব দেখতে থাকে। সবমিলিয়ে খোলা আকাশের নিচে বিলকিস চারদিন পড়ে থাকে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, ঔষধ নেই, চোখে ঘুম আর ফুসফুসে বাতাস নেই―গায়ে তার জ্বর। চোখ লাল। বিলকিসের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মৃত্যুও তাকে বাঁচাতে আসে না। দুপুরের দিকে সে মাহাতাবের দেখা পায়।
ফ্যাক্টরির এদিকটা ফাঁকা দেখে মাহাতাব এসেছিল সিগারেটের মসলা ফেলতে। সিগারেটের রেজলা খালি হলে তার বাঁতালুতে থাকা গাঁজাটুকু ঢোকাবে। গাড়ি ছাড়তে এখনো দেরি আছে। দক্ষ হাতে মাহাতাব দ্রুত কাজটা করতে থাকে। আর কাজের ফাঁকেই চোখাচোখি হয় বিলকিসের সাথে। মুহূর্তেই মাহাতাবের ভিতরটা চনমনিয়ে ওঠে। মাহাতাবের মধ্য থেকে কে যেন তাকে অচেনা অদেখা মেয়েটার দিকে এগিয়ে যেতে বলে। তার তলপেট বেয়ে এক শিরশিরানি অনুভূত হতে থাকে। তার শিশ্নে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হতে থাকে। বাতাসে সে মেয়েটার গায়ের গন্ধ পেতে থাকে। আরো একটা লম্বা দম দিয়ে চোখ বন্ধ করে মাহাতাব। তার চোখে ভেসে ওঠে থলথলে স্তনের বাদামি চাকধরা স্তনচূড়া, অপরিছন্ন আগাছার মতো নরম লোমে ঢাকা আনন্দ ঝরনার গিরিখাদ। চোখাচোখি হতেই বিলকিস তার ক্ষয়িষ্ণু নারীশক্তির মাধ্যমে বুঝতে পারে এই অচেনা অপরিচিত এই ছোরাটাকে গাঁথতে হবে তার রমণীয় জালে। এই হতে পারে তার বাঁচার ভেলা। বিলকিস তার সমস্ত শক্তি একত্র করে একটা প্রশ্রয়ী হাসি ঢেলে দেয় তার শুকনো দুঠোঁটে। আর তখনই মোহগ্রস্থ পোকার মতো বিলকিসের মায়াময় কুহকি জালে আটকে যায় হেলপার মাহাতাব। এক-দুপা এগিয়ে গিয়ে সে জিজ্ঞেসা করে―‘আফা, আপনে যাইবেন কই? একা বইস্যা ক্যান?’ নিজের মধ্যে সবটুকু শক্তি বাজি ধরে বিলকিস শক্ত হয়। তারপর চোখেমুখে চটুলতা নামিয়ে উত্তর দেয়, ‘জাহান্নামে যামু রে ভাই। হামাক কেউ ডি নিতাছে না। হ্যার লাইগ্যা বইস্যা বইস্যা ওয়েট করতাছি; অহন কানদুম।’ গাঁজাভরা সিগারেট লম্বা দুটো টান দিয়ে মাহাতাব তার মনে মনে হিসাব নিকেষ মিলিয়ে নেয়। তারপর বলে, ‘যাই-বা কই?’
‘যেখানে তুমি লইবান।’
‘হাচায়?’
‘তয়? মজাক করতাছি নি? যামু নীলফামারী; আফনে যাইবেন কই? গাড়ি আপনের?’
‘হ, তুমারে লাবাইদিমুনে; তয়!’
‘তয় কী?’ কাশির দমক সামলে, সামান্য ঢঙ করে বিলকিস জিজ্ঞেস করে, তারপর বলে, ‘আপ্নেগো খাতির করা নাগবি?’
‘লগে কিন্তুক ওস্তাদ আছে।’
ফিচ্ করে একটা হাসি দিয়ে বিলকিস বলে, ‘ট্যাকা দিবেন পাঁচশ?’ আর তখনি উস্তাদ ডাক দিলো। বিলকিস আক্তারকে ট্রাকের পিছনে উঠতে বলে মাহাতাব দৌড় দেয়।


তিন
পাক্কা আড়াই ঘণ্টা জ্যামে আটকে থেকে যখন বিল্লালের ট্রাক গতি পেল তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। হু হু বাতাস বইছে, সাথে বৃষ্টি বন্ধ আকাশের বুকে কালো মেঘ পাড়ি জমাচ্ছে দূর অজানায়। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় পড়ে থাকা কচি ডালপালাগুলোকে নির্দয়ভাবে পিষে দিয়ে ছুটে চলেছে বিল্লাল। একবার শুধু সে প্রশ্ন করে গোঙানির মতো করে, ‘অই মাইয়াডার বয়স কিমুন রে?’ প্রশ্নটা যেন বাতাসের দমকায় ভেসে যায়। ট্রাফিক যখন রাস্তা পরিস্কার করছিল, সেই লম্বা সময়ে একবার মাহাতাব উঠে আসে ট্রাকের পিছনে, ‘খাও আফা, এই যে পাউরুটি কলা আর পানি।’ কাছে গিয়ে বসে মাহাতাব। তারপর ছোট করে জিজ্ঞেস করে, ‘বিয়াশাদি কি হইছে?’ তখন রাস্তার পাশে বিল্লাল ড্রাইভার চা খাচ্ছিল রঙিন টেলিভিশনে চোখ রেখে। বিলকিস শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ‘বিয়া করছ?’ আবারো জিজ্ঞেস করে মাহাতাব। উত্তরের প্রতীক্ষা করতে করতে বিলকিসের বা-বগলের নিচ দিয়ে খামচে ধরে ওর বাঁ-বুকের মাংস পিণ্ডটাকে। গায়ে হাত রেখেই চমকে উঠে মাহাতাব। বিলকিসের গা পুড়ে যাচ্ছে। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তুমার শরীর খারাপনি?’ জড়িত কণ্ঠে বিলকিস বলে, ‘হ; জ্বর।’ ভড়কে যায় মাহাতাব। কেবিনে এসে আর কথা বলে না সে।
আকাশে কালো মেঘের ছেঁড়া খণ্ড ভেসে আসছে চাঁদের ওপর, আবার সরেও যাচ্ছে। তখনই চাঁদের আভায় ভাসছে চরাচর। ফাঁকা প্রান্তরের বুকে চিড়ে ধেয়ে আসছে বাতাস, সাথে মিশে থাকা বৃষ্টির কুচি। বৃষ্টিভেজা কালো রাস্তাকে ট্রাকের মায়াবি আলোয় পাইথন সাপের কালো পিঠের মতো চকচকে দেখায়। ঝড়ের গতিতে বিল্লাল ছুটে চলে একটা নির্জন জায়গার খোঁজে। তার মনোজগতে শুধুই এক অপরিচিত মেয়ের উদোম শরীর দুমড়েমুচড়ে যেতে থাকে প্রতিমুহূর্তে। এদিকে বিলকিস আর টিকতে পারছে না। হু হু বাতাসের মাঝেও তার বুভূক্ষু ফুসফুস বাতাস পাচ্ছে না। গায়ের তাপমাত্রা সীমাহীন এখন। গলা শুকিয়ে মরুভূমি। কাশিও আসছে দমকে দমকে, কাশি শুরু হলে থামতে চায় না আর। বিলকিস আবার কাশতে থাকে; কাশতে কাশতে ওর ফুসফুস শূন্য হয়ে যায়। ওর চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে এসছে কাশির দমকে। সে উবু হয়ে কাশতে কাশতে গড়িয় পড়ে একপাশে। এর মধ্যেই বিলকিসের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। বিলকিস তার কোটর থেকে বেরিয়ে আসা নিস্পলক চোখে দেখতে থাকে, হু হু গতির সাথে তাল মিলিয়ে নির্লজ্জ চাঁদটা ছুটে চলছে তার সাথি হয়ে। চাপ চাপ শীতল অন্ধকার ভেদ করে, সে দেখতে পায়, নীলফামারীর খোলা মাঠ, মাঠের পাশে গরু, মরা খাল আর খালের ওপর পুরনো সাঁকো। ভুবন রাঙানো সরিষাখেতের আইল দিয়ে বিলকিস আক্তার দৌড়াচ্ছে। দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। ওর বেণি করা চুল দুলছে ছন্দে। ক্লান্ত মহিষের পিঠে একটা লেজঝোলা পাখি ঝিমুচ্ছে গম্ভীর হয়ে। মহিষ না কি গরু? না কি শূন্যে ভেসে পাখিটা? বিলকিসের নিথর চোখ দিশে পায় না। তার হাঁ মুখ যেন গিলে খেতে চায় মায়াবী চাঁদটাকে। সেই কালো শুকনা মুখের গহ্বর থেকে খানিকটা ফেনা গড়িয়ে পড়ে। আধখাওয়া পাউরুটি থেকে একটা নীল রঙের মাছি একফাঁকে উড়ে এসে এই বিশ্রী মুখে বসে কাঁপতে থাকে তিরতির। গাড়ির দুরন্ত ঝাঁকিতেও মাছিটি ওড়ে না।
সামনের বিশাল বাবলাগাছের ভুতুড়ে অন্ধকারে ট্রাকটা থামিয়ে রাস্তার পাশে লুঙ্গি তুলে বসার আগে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বিল্লাল বলে, ‘অই মাহাতাব, খানকির পোলা ব্যবস্থা কর, আইতাছি।’ মাহাতাব যন্ত্রের মতো নেমে যায়। কেন যেন তার মন সায় দিচ্ছে না, কিছুই ভালো লাগছে না তার। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাত আন্দাজ করার চেষ্টা করে। তারপর ট্রাকে পিছনে উঠতে গিয়ে বিড়বিড় করে, ‘হালা হুয়ারের বাচ্চা লুচ্চা।’
আগের থেকে বাতাসের বেগ কমলেও এই ফাঁকা মাঠের মাঝে বাতাস বইছে হু হু করে। গোল চাঁদ তীর্যক হয়ে পড়েছে। চাঁদের আলোয় বেঢপ ছায়া দেখে মাহাতাবের গাটা কেন যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল। মাহাতাব চাপা গলায় ডাক দেয়, ‘অই আফা ঘুম যাননি?’ উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করে সে, ‘অই আফা?’ আওয়াজ নেই। এবার সে বিলকিসের গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দেয়। প্রথমে মাহাতাবের মনে হয়, সে সাপের গায়ে হাত দিয়েছে, তারপর তার মনে হয়, নাহ! সাপ নয় বরফ! মাহাতাব হাত দিতেই ঠান্ডা শরীরটা উল্টে যায় অন্যদিকে। মাহাতাব এবার চিৎকার করে উঠে―‘উস্তাদ! হালার মাগি তো মরছে।’ আর তখনই জমাট নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা লোডেড ট্রাক মাটি কাঁপিয়ে ঢাকার দিকে ছুটে যায় চাঁদকে সাথে নিয়ে। দিশাহারা ফ্যাকাসে চোখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে মাহাতাব। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘আল্লা!’ এত বাতাসের মাঝেও মাহাতাব ঘেমে ওঠে মুহূর্তে। তার অবিন্যস্ত চুলগুলো বাতাসে মৃদু উড়তে থাকে। ততক্ষণে বিল্লাল উঠে এসেছে। বাইরের মাটিতে সুবিধা হবে না। সেকারণে আরো সুবিধাজনক স্থান খোঁজার জন্যই বিল্লালের উপর আসা। কিন্তু মাহাতাবের এই চিৎকার তার ভিতরের মদনানলে হঠাৎই কলসি কলসি পানি ঢেলে দিয়েছে। সে অপলক তাকিয়ে থাকে। সে চাহুনি থেকে ঝরে পড়ে অসহায়ত্ব আর ভয়।

চার
আদিতমারি থানার এএসআই বাতেন যখন স্পটে পৌঁছাল তখন সূর্যের ঝলমলে আলোয় চারপাশ তছনছ হচ্ছে। হাইওয়ের পাশে গোদাগাড়ি মাঠে একটা বোডি পড়ে আছে, ওসি হারুন-উর-রশিদ তাকে ওয়ারলেস করে সকাল সাড়ে ৭টায়। বাতেন দারোগা আসার আগেই, শতশত মানুষ জুটেছে লাশ দেখতে, মেয়েমানুষের লাশ। এদিকে ঝড়বৃষ্টি নাই, প্রচণ্ড গরম। এএসআই বাতেন পৌঁছাতেই ভিড় ভাঙতে শুরু করে। এদেশের মানুষ পুলিশের ধারে কাছে ঘেঁষতে চায় না সহজে।
বাতেন লাশের খুব কাছে যায়নি। তার পিপিই নেই। থানায় যেকটি এসেছে তার থেকে এখনো বাতেন পায়নি। তবুও কাজ করতে হচ্ছে। কিছু লোককে জিজ্ঞাস করে। তার সোর্স লাগিয়ে সে লাশের পরিচয় জেনে ফেলল ঘণ্টা দু-একের মধ্যেই। তারপর ওসি হারুন-উর-রশিদকে ফোন দিলো, ‘স্যার, লাশ, মানে ভিকটিমের নাম বিলকিস আক্তার, বয়স ত্রিশ, অনুমেয় স্যার, বিবাহিত কিনা তা এখনো জানা যায় নাই স্যার, বাড়ি হচ্ছে পাশের গিরামে স্যার, পিতা জালাল শেখ, জনখাটে খবর পাটাইছি স্যার।’
তারও ঘণ্টাখানেক পর গ্রাম পুলিশের এক সদস্য এসে খবর দিলো, ‘ছ্যার জালাল বেটা দ্যাশথ থে পলাইছে, হ্যেরা খবর পাইছেন ফজরের কালে। বত্তোমানে ছার বাড়িত তালা, চেংড়ির মাও পলাইছে, হ্যেরা লাশ নিবু না। চেংরি ঢাকত ছিল। জারুয়্যা হইতে পারে। ভাইরাচত মরিব্যার পারে।’ এএসআই আরো একটা সিগারেট জ্বালায়। লম্বা একরাশ ধোঁয়া গিলে আবার ওসি হারুন-উর-রশিদরক ফোন করে। তারপর পুরো বিষয়টা খুলে বলতে থাকে। কথা শেষ না হতেই খেঁকিয়ে ওঠে ওসি―‘অই বাতেন, মাড়ের বিতরে খারাইয়া গুয়া মরা না দিয়া, হেই বেশ্যা মাগির পোলারে উডাইয়া, হ্যার হোগায় চাইরডা বাড়ি দেতে কি মোরে দারে কওন লাগে। বাল হালাইতে দারোগা হইছ মিয়া।’ ফোন কেটে যায়। এএসআই বাতেন দূরের পাটখেতের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তার চোখে তিরতির করে কাঁপতে তাকে শূন্য ভাসমান জলরেখা। তার চোখ জ্বালা করে পাকস্থলি কাঁপিয়ে একটা টক ঢেঁকুর উঠে এসে গলায় জমা হয়। রাতজাগা অম্ল। বাতেন দারোগা ফুরিয়ে আসা সিগারেটে লম্বা টানা দিয়ে, কিলো গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ি চালু করতে বলে বিড়বিড় করে, ‘শালার বিটা চুতমারানি।’
জালাল শেখকে ধরে আনা হয়েছে। সে এখন আদিতমারী থানার বারান্দায় শূন্যদৃষ্টি নিয়ে বসে আছে। ফ্যালফ্যালিয়ে সে তাকাচ্ছে সবার দিকে। জালাল শেখের তলপেট ফাটার উপক্রম প্রস্রাবের চাপে। বুক শুকিয়ে খাঁখাঁ করছে বিড়ির তৃষ্ণায়। তার বাম কানে এখনো ভোঁ ধরে আছে। জালাল মিঞা কাকে জিজ্ঞাসা করবে যে, এখানে পিসাবের জায়গা আছে কি না, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ওসি হারুন দারুণ ব্যস্ত। এএসআই বাতনেও বিশ্রাম পায়নি এখনো। এসপি স্যার আসবেন নীলফামারী থেকে, সাথে ডিসি সাহেবও। স্থানীয় সাংবাদিক বিষয়টি অনলাইনে প্রচার করেছে। থানার বাতাসে বিরিয়ানির খশবু উড়ছে। স্যারেরা লাঞ্চ এখানেই করবেন। স্মার্ট জোওয়ানেরা প্রস্তত আছে গার্ড অফ অনার দেওয়ার জন্য। আদিতমারী থানায় একটা উৎসবের আমেজ বইছে। লাশটাও আনা হয়েছে। থানার উত্তর দিকে অর্জুন গাছের নিচে একটা ভ্যানের ওপর পাটি জড়িয়ে রাখা আছে বিলকিসের ফুলে ওঠা দেহ। পাটির ফাঁক দিয়ে লাল পিঁপড়ের একটা লম্বা সারি তৈরি হয়েছে এই দুপুর রোদেও। পাটির উপরে তিনটে নীলরঙের মাছি উড়ছে পালা করে। জালাল শেখ চোখ সরিয়ে নেয়। লাশ দেখতে তার ভয় হয়।
লাঞ্চের পর বড় স্যারদের লম্বা মিটিং শেষে সাংবাদিকদের সাথে স্যারদের কথা হয় বিস্তারিত। যখন জালাল শেখের ডাক পড়ল তখন ক্লান্ত বিকেল। সূর্যের রঙিন আভায় রাঙা হয়ে উঠেছে থানার অর্জুন গাছের মাথাটা। সেন্ট্রি কাছে আসতেই জালাল সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল―‘মুই কিছু জানি না বাহে, হামাক ছ্যাড়ি দ্যান বাহে।’ ওসি নরম গলায় জালাল শেখকে জিজ্ঞাসা করে―‘অই বেডি আপ্নের কে লাগে?’
‘জে হামার কন্যা।’
‘নাম?’
‘জে, চিংড়ির নাম এ্যলা বিলকিছ ছার।’ কথার মাঝেই এসপি সাহেব বলেন, ‘তা আপনি তার বডি দেখছেন?’
‘না বাহে, মুই লাশ দেখিবার পারো না, মোর।’
‘এটা আপনার মেয়ে তো?’ এসপি সাহেবের গলায় বিস্ময়।
‘হ, এ্যলা লোক তো তাই বলিচ্ছে ছার।’
এতক্ষণে ডিসি সাহেব আন্তরিকভাবে বলেন, ‘তা আপনি এই বডি নিচ্ছেন না কেন?’
নোংরা জামায় চোখ মুছে জালাল শেখ উত্তর করে, ‘ছার মুই গরিব নোক বাহে, চেংড়ি রে হামি ঘরত নিবের চাঁইছো, হামার ঘরত, হ্যার সৎমাও কহেছে, এ্যলা চেংড়ির ভাইরাস। সমাজে হামাক তো থাকা নাগবি ছার।’ জালাল শেখ আবারো হু হু করে কেঁদে বলে―‘হামি গরিব নোক বাহে মুই কিছু। এই ছার এ্যলা হামাক একডা থাবড় দেছে। মোর কান ভোঁ ধরি গেইছে ছার।’
বিচার শেষে স্যারেরা জালাল মিঞাকে বুঝিয়ে একথালা ঠান্ডা বিরিয়ানি খাইয়ে পাঁচ হাজার টাকা তার জীর্ণ জামার পকেটে গুঁজে দিয়ে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে উপদেশ দিয়ে হাসি মুখে গাড়িতে উঠলেন। জালাল লক্ষ করল, বাইরে জাঁকিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। থানার উজ্জ্বল বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে, শুধু অর্জুনগাছের নিচে ঘন অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে।
পকেটে পাঁচ হাজার টাকা আর একবুক প্রশান্তি নিয়ে জালাল শেখ থানার বাইরে এসে দাঁড়ায়। সামনের চায়ের দোকানগুলোতে তখন থইথই ভিড়। সবার চোখ রঙিন টেলিভিশনের পর্দায় করোনার সংবাদ দেখছে। একটা লোক এগিয়ে এসে জালাল শেখের সামনে একটা সিগারেট মেলে ধরে। গোটা একটা সিগারেট! জালালের মনে হয়, কতযুগ সে বুকভরে ধোঁয়া নেয় না। সিগারেটটা ঠোঁটে ছোঁয়াতেই জ্বলন্ত একটা কাঠি এগিয়ে দেয় লোকটা।
‘বিচার মিটি গেইছে বাহে? বড় স্যার আসিচ্ছেন, এ্যলা মোর ভয়োত জান উরি গেইছাল’ লোকটার গলায় আন্তরিকতা ঝরে পড়ে।
জালাল শেখ লম্বা টান দেয়। গলাটা খাদে নামিয়ে লোকটা বলে, ‘মোর একটা কতা শুনিবেন বাহে?’ এতক্ষণে জালাল শেখ লোকটার মুখের দিকে তাকায়। আলো আঁধারে লোকটা অশুভ দূরাত্মার মতো দেখায়। লোকটা শ্লেষা মেশানো গলায় বলে, ‘মোর হাতত ম্যালা নোক আছেন হে, অর্ধেক ট্যাকা আপনে রাখি দ্যায়। এ্যলা বাকি ট্যাকা দিয়া চেংরির নাশ দাফন করি তোমাক খবর করিবেন বাহে।’ বলেই লোকটা মোবাইল ফোন বের করে। তার মোবাইলের নীলচে মায়াবি আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে জালাল শেখের মনে হয়, পাঁচ হাজার টাকার অর্ধেক মানে কত টাকা? কত কুড়ি? হঠাৎ তার সেই হারিয়ে যাওয়া প্রস্রাবের বেগটা আবার ফিরে আসে। পথের পাশেই লুঙ্গি তুলে বসে যায় জালাল শেখ। প্রস্রাবের বেগ তার শরীরে শিহরন জাগায়, সারা শরীর কেঁপে উঠে। সে হিসাব করতে থাকে পাঁচ হাজারের অর্ধেক মানে কত কুড়ি―কিন্তু তার হিসাব সব জট পাকিয়ে যেতে থাকে। মুহূর্তে জালাল শেখের চোখে পড়ে থানার অর্জুনগাছটা। সারা গায়ে অন্ধকার মেখে গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, স্থির। তার নিচেই পাটিতে জড়ানো চেংরির শরীর পড়ে আছে নিঃসঙ্গ। জালালের মনে হয় ঝামেলাটা শেষ করা দরকার, লাশ পড়ে থাকলে আজাব বাড়ে।
প্রয়োজনীয় কাজটা সেরে এসে জালাল আবার লোকটার মুখোমুখি হয়। লোকটার প্রস্তাব জালাল মিঙার মনে ধরেছে।
কিন্তু―
জালাল মিঙা বলে, ‘আপনে তো কহেচেন বাহে, এ্যলা ট্যাহাডা ইকটু বেশি কহেচ্ছেন’―লম্বা টান দিয়ে বুকভর্তি কুয়াশা রঙের ধূসর ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে বিশ্রী একটা চাপা হাসি খেলে যায় অন্ধকার মেশানো লোকটার মুখে। এর অর্থ হলো, শিকার সে গেঁথে ফেলেছে তার বরশাতে। গলা আরো একধাপ খাদে নামিয়ে লোকটা বলে, হামাক আপনি বলিচ্ছেন! ঘামি কি আপনার টাহার ভাগ চাহিছ? এ্যলা তোমার চেংড়ি হামার চেংড়ি না? এ্যতগুলান মানুষ এ্যলা কাজ করিবিন, বাঁশ, চাটাই, কাফন, বডি―এ্যলা ম্যালা ঝামেলা বুজিচ্ছেন না?’
জালাল মিঙা সমস্ত ইচ্ছাশক্তিতে একত্রিত করে বলে, ‘আন্নে দুইডা হাজার রাখেন, এ্যলা এত্ত গুলায় টাহা! আল্লা হামাক দেছেন, বাড়িঘরতের কাম করিবার নাগে বাহে’―অন্ধকারে ঢাকা লোকটা শুধু শুনে যায়। আর মনে মনে খ্যাকসা হাসি দ্যায়। তারপর সারা শরীরে সম্মতির ঢেউ তুলে আন্তরিক হাসি হেসে বলে, ‘এক কাপ চা খাইবেন বাহে?’

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা