X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রবন্ধ

চাঁদ বণিকের একার যুদ্ধ

মনির-উল হক
১৪ অক্টোবর ২০২১, ১৪:০০আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২১, ১৪:০০

‘চাঁদ বণিকের পালা’ বহুরূপী  পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘বটুক’ ছদ্মনামে। নাটকের তিনটি পর্ব প্রকাশের সময়কাল ১৯৬৫, ’৬৬ ও ’৭৪ সাল। নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে।

সন-তারিখ উল্লেখ করার কারণ এজন্য যে, ‘মনসামঙ্গল’-এর আখ্যানটিকে শম্ভু মিত্র হুবহু ব্যবহার না করে বিনির্মাণ করেছেন লৌকিক জীবনের প্রেক্ষিতে। এখানে শিব ও মনসা ব্যক্তি মানুষ বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীরই প্রতীক। এখানে গ্রিক মিথ বা নাটকের মতো সবকিছু পূর্বনির্ধারিত নয়, মানুষ কেবল ভবিতব্যে অভিনয় করে যাচ্ছে না; বরং শম্ভুর মানুষ ক্ষমতাদ্বন্দ্বের বলি। তাই অলৌকিকভাবে কারও মুক্তি মেলে না, কিংবা পতিতও হয় না।

লৌকিক জীবনে চাঁদের আদর্শিক দৃঢ়তা, সংগ্রাম ও অপরদিকে চম্পকনগরে চলমান মাৎস্যনায় আমাদের মনে করিয়ে দেয় নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং তা দমনপীড়নে ক্ষমতাসীনদের তৎপরতা। চম্পকনগর হয়ে ওঠে গোটা ভারতবর্ষ।

নাট্যকার শম্ভু মিত্র কোথাও নাটকের সময়-কাল উল্লেখ না করলেও একটি চরিত্রের মুখ দিয়ে তিনি প্রকাশ করেন, ‘...আমাদের আধুনিক শাস্ত্রমতে সমুদ্দুরে যাত্রা করা পাপ। তা আমরা তো আধুনিক? সুতরাং অধুনা যা সকলেই মানে সেইটারে উল্লঙ্ঘন করা অতীব গর্হিত–’ এরা সদলবলে আসে লখিন্দরের জন্য নির্মিত বাণিজ্যতরী ছিদ্র করে তার সলিলসমাধী রচনা করতে।

নাটকে শিবভক্ত চাঁদ বণিক জ্ঞান, সংগ্রাম ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক, অপরদিকে চম্পকনগরের ক্ষমতাসীনরা অন্ধকারবাসী-সাপের পূজারি তথা মাৎস্যনায়ের প্রতীক। আশ্চর্যের বিষয় ‘চাঁদ বণিকের পালা’ কখনও মঞ্চস্থ হয়নি, কেউ কেউ বলেন হতে দেয়া হয়নি নীরব সেন্সরশিপের কারণে।

নাটকের শুরুতে আমরা দেখি চাঁদের স্ত্রী সনকা মনসার গোপন পূজারি। তবুও তাদের ছয়পুত্র সাপের ছোবলে নিহত হয়। তিনি মনসার কাছে সন্তান ও স্বামীর নিরাপত্তা চান। কিন্তু শিবভক্ত চাঁদ স্ত্রীর এই বিশ্বাসঘাতকতায় ভীষণ ক্ষুব্ধ। এসময় তিনি তার দলবল নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করে রাজ-আজ্ঞা অমান্য করে। তখন লখিন্দর সনকার গর্ভে।

দীর্ঘদিন পর চাঁদ সমুদ্র-ডুবিতে সবাইকে হারিয়ে চম্পকনগরে ফিরে আসেন ভিখারির বেশে, ছদ্মবেশি ওডেসিয়াসের মতো। তবে লক্ষ্য ভিন্ন এবং সত্যি সত্যি যৌবন হারানো এক বৃদ্ধ তিনি। স্ত্রীর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন, এমনকি স্ত্রীকে নিয়ে চম্পকনগরী ছেড়ে পালিয়ে যেতে চান; কিন্তু স্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তার জীবনের অসফলতার জন্য। এদিকে চাঁদকে দলে ভেড়ানোর জন্য ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতালোভী দুই পক্ষ টানাটানি করে। তারা আবার সমুদ্রযাত্রার ব্যবস্থা করে দেবে এই টোপ দিয়ে তাদের দলে ভেড়ানো ও প্রকাশ্যে মনসার পূজা দিতে বলেন। কিন্তু চাঁদ মৌখিকভাবে হ্যাঁ-না বললেও নিজের আদর্শের প্রতি অনড়। একই সময় লখিন্দর এসেও তার পিতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অপমানে আশাহীন করে দেয়। যে কিনা বেণীমাধব ‘জারজ’ সন্তান গালি খেয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে পিতার সামনে দাঁড়ায়। তখন সমাজে চলে হত্যা ও ক্ষমতাদ্বন্দ্বের লড়াই। চাঁদ হয়ে পড়ে মদ্যপ।

তবও চাঁদ আশা ছাড়ে না, ভবিষ্যতের ভেতর স্বপ্ন দেখে। লখিন্দর সমুদ্রযাত্রায় যেতে রাজি হয়। তার জন্য চাঁদের সমস্ত সম্পদ খরচ করে বানানো হয় বাণিজ্যতরী। বাণিজ্যযাত্রার আগে তিনি বেহুলার সঙ্গে তার বিয়ে দেন। সনকা ভবিতব্য জেনে লোহার বাসর নির্মাণ করেন এবং ওঝাদের হাজির রাখেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন পক্ষ বাসর বানানো মিস্ত্রিকে ভয় দেখিয়ে বাধ্য করে তাতে ছিদ্র রাখতে। সেই ছিদ্রে সাপ ছেড়ে দিলে লখিন্দর সাপের ছোবলে নিহত হন। রীতি মাফিক কলাগাছের ভেলায় স্বামীকে নিয়ে বেহুলা ভাসানযাত্রা শুরু করে। মনসার বেহুলা স্বর্গে গিয়ে বেদতাদের অশ্লীল নাচ দেখায়, আর শম্ভুর বেহুলা জগতের কামুক পুরুষদের।

একদিন বেহুলা চাঁদের কাছে আসে পুত্রের জীবন ফিরে পাবার সংবাদ নিয়ে এবং একই সঙ্গে মনসার পুজার শর্ত নিয়ে। ততদিনে চাঁদ ভিখারি ও ক্ষমতাসীন বেণীমাধবের বাড়িতে আশ্রিত। সনকা পাগল হয়ে রাস্তাবাসী। বেহুলার শর্তে চাঁদ রাজি হয় সন্তানকে ফিরে পেতে, কিন্তু শিবপূজার বেলপাতা দিয়েই তিনি মনসার পূজা করেন। প্রকারন্তরে তিনি শিবেরই পূজা করেন। ততক্ষণে বেহুো-লখিন্দর তাদের জীবনের অসফলতা ও পরস্পরের বিচ্ছন্ন হয়ে যাবার আশঙ্কায় বিষপাণ করে আত্মহত্যা করেন।  

মনসামঙ্গলে দেখি চাঁদ বণিক মনসার পায়ে নতজানু, অনুতপ্ত। মনসা চাঁদকে ফিরিয়ে দেয় ছয়পুত্র ও সপ্তডিঙা। একইসঙ্গে মঙ্গলকাব্যের রীতি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা পায় দৈব অনুগ্রহ বা তার মহিমা।

শম্ভু মিত্র মনসামঙ্গলের মতো মিলনাত্মক পথে পা বাড়াননি। তিনি পুত্রবধূ বেহুলার কথায় মনসাকে পূজা দিলেও মনসা-পূজার উপাচার গ্রহণ না করে বিশ্বপত্র দিয়েই পূজা করেছেন। কৌশলগতভাবে তিনি নমনীয় হলেও আদর্শচ্যূত হননি। কিন্তু তার অবিচল আদর্শবোধ তাকে আপতদৃষ্টিতে কিছুই দেয়নি। না ফিরে পেয়েছে মৃত সন্তানদের, না সপ্তডিঙ্গা।  

আদর্শ তার জীবনে ক্রমাগত ব্যর্থতাই বয়ে এনেছে। স্ত্রী সহধর্মীনী হয়ে বিশ্বাসী থাকেননি, তার কাছে তিনি ব্যর্থ স্বামী। না মানসিক, না শারীরিক কোনো অনুভবের সঙ্গেই তিনি নিজেকে চাঁদের সঙ্গে জড়াতে পারেননি। একটি ব্যর্থ দাম্পত্যের অবশিষ্ট লখিন্দর, সেই পিতাকে অপমান করতে ছাড়ে না।    

লখিন্দর বলে, ‘মানুষ কি শুধু কতগুল্যা প্রতিক্রিয়া? শুধু প্রতিক্রিয়ার সমষ্টি?’ বা ‘রক্ত দেও, মুখ বুজে কাজ করে যাও, কথা কয়ো নাকো।’

চম্পকনগরীর বৃদ্ধরা আসে তাদের সন্তানদের হদিস পেতে। সমুদ্রযাত্রায় যদি সবাই নিহত হয় তবে, চাঁদ বণিক কিভাবে বেঁচে ফেরে? এই প্রশ্ন সবার। তবে কি চাঁদ তার সহ-নবিকদের হত্যা করে সমস্ত সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছে? বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই চম্পকনগরে। লখিন্দরকে কেন্দ্র করে চাঁদের ভবিষ্যতের ভেতরও বীজ বপন করা হল না।

একজন ব্যর্থ, রিক্ত, মদ্যপ চাঁদ কেবল শূন্যের ভেতর উচ্চারণ করে, ‘শিবাই শিবাই।’ কিন্তু শিব তাকে রক্ষা করে না। মনসা তথা অন্ধকার শক্তিরই পরাক্রম দেখি সমাজে।

ক্ষমতাসীন বল্লভাচার্য ও বেণীমাধবের দল, বিপরীতদিকে ভৈরব করালীদের দল– উভয়েই চম্পকের ক্ষমতা ভোগের প্রতিযোগি রাজনৈতিক শক্তি।  তার নগর ও জনতার উন্নতি ভাবে না, রক্ষা করতে চায় না। এই স্বার্থপরতার রাজনীতির ঘূর্ণিতে চাঁদ একা। তার লড়াই করারও শক্তি নেই। আশাবাদ ছাড়া যার কিচ্ছু নেই।

কিন্তু চাঁদ ‘শুধু বেঁচে থাকা বলে কোনো কথা নাইরে জীবনে’ তথা জীবনের অন্য আদিকল্পের সন্ধান সে করতে চেয়েছিল। সে কেবল কিছু ‘চেয়েছিল’র প্রতীক। যার বিপরীতে মনসার অন্ধকার।

‘চাঁদ বণিকের পালা’ মঞ্চস্থ করতে অনেক চ্যলেঞ্জের মধ্যে রয়েছে এর ভাষা। লেখক নিজেই বলেছেন, ‘বইটি পড়তে গিয়ে কোনো পাঠক কিছু শব্দের বর্ণবিন্যাসে বিভ্রান্ত হতে পারেন। অভ্যাসের বসে চলিত লিপির সাহায্যে আমরা উচ্চারণটা অনুমান করে নেই। কিন্তু বিপদ হয় অচলিত ভাষার ক্ষেত্রে। তাই অসমাপিকা ক্রিয়াপদের মধ্যে যেখানে উচ্চারণ লিখিত স্বরবর্ণের ঠিক– য় নয়, আবার– ই-ও নয়, মাঝামাঝি যেমন, –করে– কইরে বা কোয়রে নয়, সেই স্বল্পস্বর বোঝাতে শব্দের অন্তে ‘্য’ [য ফলা] ব্যবহার করা হয়েছে।’

নাট্যকারের এই কৃত্রিম ভাষা মনসামঙ্গল থেকে ‘চাঁদ বণিকের পালা’কে যেমন আলাদা করেছে, তেমনি আধুনিককালের একটি অনির্দিষ্ট কালপর্বের সঙ্গে এই ভাষা সখ্য গড়ে তোলে। এই ভাষা না-প্রমিত, না-আঞ্চলিক। এই ভাষা হয়ে উঠেছে ‘চাঁদ বণিকের পালা’র ভাষা।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!