বাতাসে এখন বসন্ত। কোকিল খুব ডাকছে। গলা ফাটিয়ে ডাকছে। শিগগিরি গলা বসে যাবে যাবে ভাব। প্রতিদিন সমস্ত গাছে গাছে নতুন পাতারা তৈরি হচ্ছে। হালকা কচি সবুজ পাতায় ভরে যাচ্ছে ডালগুলো! কোন সেই কল, কোথায় সেই কারখানা, এত ধূসরতার ভেতরেও এত্ত এত্ত সবুজ পয়দা করছে?
নিশি বাসের জানালায় মুখ সাঁটিয়ে বাইরে দেখছিল। ময়দান পার্ক স্ট্রিট চৌরঙ্গী পেরুতে পেরুতে দেখে ফেলল এক অদ্ভুত দৃশ্য। শাল নিম মহানিম জাম ও জারুল , শিরীষ, আম আর বেঁটে রঙ্গনের গায়ে কাঁচা সবুজের ছিটে লেগেছে। কে যেন ওদের ছুঁয়ে দিয়েছে আজ। ম্যাজিক।
শহরের দক্ষিণ থেকে উত্তর। এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তের রোজকার যাওয়া আসা। ক্লান্তিকর। তবু আজ মন শিহরে ভরে গেল। আসলে, হঠাৎ অবাক হয়ে নিশি এটাও ভাবছিল যে, যে শহরে সে বাঁচে সেখানে খাঁচা-সদৃশ, গ্রিলসর্বস্ব বাসভূমির ফাঁকে ফাঁকে এত্ত গাছও গুঁজে রাখা ছিল? এত এত গন্ধ ময়লা আর খিস্তির পাশাপাশি?
শহর এত বিস্ময় পেতে রাখে? যেন পেতে রাখা কালচে গালিচার ওপর সার সার উঠে দাঁড়াল একবগগা ডবকা কিশোরীরা।
শহরের মাঠ, শহরের বৃক্ষরাজি সারা বছর ঝুপ্পুস ধুলোয় ঢেকে থাকে। উপরন্তু গত কয়েক মাসে এতটুকু বৃষ্টিবাদলা হয়নি। বৃষ্টি এলে তবু ধুয়ে দেয় ধুলো। কিছুদিন ঝকঝকে হয় সব। কিন্তু এ যাবৎ শীতের শুখাপন, খরা। ফলত পাতাগুলো ধূসর সবুজ, মরা মরা। শীতে পাতা ঝরায় না এই ট্রপিকাল গাছেরা। শুধু মরিয়া হয়ে ধরে রাখে পুরনো খসখসে পাতাদের।
বাসের জানালা ঘেঁষে বসে নিশি নিজের অজান্তে নিজের খসখসে ঠোঁটে গালে হাত বুলিয়ে নেয়।
বয়স আর বসন্ত। এই দুটো জিনিস দুদিকে খতরনাক। বসন্তের সঙ্গে ওই গাছেদেরও একটা বোঝাপড়া আছে। নিশির বয়স উলটোপানে টানছে। খুব তাড়াতাড়ি বাবা জোর করে বিয়ে না দিয়ে দিলে ওর এত বড় ধাড়ি ছেলে থাকত নাকি? যাই হোক, ষোলো বছরের ছেলের মায়েরাও আজকাল প্রচুর প্রেম ফ্রেম করে। স্কার্ট পরে, স্লিভলেস টপ পরে। ওর কলিগদেরই অনেকে নিত্য প্রেমে পড়ার বাই। যৌবন ধরে রাখবে বলেই নাকি ওর কলিগ সুষমা একাধিক বিএফ রেখেছে।
নিশি পারে না, মানে ওর ধকে পোষায় না। কেন যেন ওর কেবলই মনে হয়, সম্পর্কে ঢোকা বেরুনো করার পিচ্ছিল লুব্রিকেশন ওর নেই। ও খুব খটখটে। ওর মন নৈতিকতায় ভারাক্রান্ত তাই!
আরোগ্যবিধানে আজ সকালের শিফট।
প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক কোম্পানি। রিসেপশনিস্টরা ছোট ছোট ছাপ দেয়া ইউনিফর্মের মতো শাড়ি পরে আসে। নিশির যদিও কামিজ কুর্তিই পছন্দ। বিশেষত টাইট, শরীরের প্রতি খাঁজ দেখা যায় যাতে। কিন্তু সে উপায় নেই। কাজ বেঁধে দিয়েছে সাজ।
যদিও এ এয়ারপোর্টে চেক ইন ডেস্কে যারা বসে তাদেরই মতো, হাল ফ্যাশনের সুন্দর কাটের ব্লাউজ, ছোট্ট নেট দিয়ে আটকানো খোঁপা এইসব সাজুগুজু আছে নিশিদেরও। বেজায় ভিড় থাকে ডায়াগনস্টিক কোম্পানিতে। পেশেন্টের পর পেশেন্টের সারি। দেখতে দেখতে অসাড় হয়ে গেছে মানুষ দেখা চোখ। নতুন কিছু নেই। মাঝে মাঝে চায়ের ব্রেক। শিফট চেঞ্জে অন্য মেয়েকে বুঝিয়ে দেয়া কাজ।
সাদা ল্যামিনেট ঝকঝক করছে। সাদাতর নিয়ন আলো সারা দিন গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে। সাদা এসি মেশিন একটা যান্ত্রিক ঠাণ্ডা হাওয়া উগরোচ্ছে। আর মানুষ এসে নিজের হাঁচি কাশি, বুকে ব্যথা, পায়ের ঘা, শরীরের ভেতরের কঠিন দগদগানি সব উগরে দিয়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের মতো। সমস্যা সমস্যা সমস্যা। ক্রিমিকীটের মতো আরোগ্যবিধান মানুষের সমস্যার ঘায়ের ভেতর বসে বসে নিজের পুষ্টি নিচ্ছে, টাকা রোজগার করছে, ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে।
প্রথমে বড় রাস্তার মোড়ে দোতলা বাড়ি কিনে চালু হয়েছিল, এখন আশপাশে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে যাচ্ছে আরোগ্যবিধান।
এ শহরে ওষুধ আর ডাক্তারের কারবার সবচেয়ে ভালো চলে।
নিশি বাস থেকে কচি সবুজ পাতার কনসেপ্টটা মাথায় ডলতে ডলতে অফিসে ঢুকল। লেবুপাতা কচলানোর মতো একটা সবজেটে গন্ধ চারিয়ে যাচ্ছে মাথায়। কচি মেয়েদের দিকে তাকিয়েও আজ মন ভালো লাগছে। অজানা কারণেই তর হয়ে আছে। কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে সিঁড়িতে পা রাখে। কোকিলের কুহুতে কেমন যেন তার নতুন জামা কিনতে ইচ্ছে করে।
আগের একটা অফ ডেতে একটু বেরিয়েছিল। আগের দিনের কেনা নতুন কুর্তি পরেছিল। বেরুবার সময়ে অরিন্দমের চোখে পড়েছিল। এমনিতে অরিন্দম এসব বোঝে টোঝে না। সেদিন হঠাৎ বিশ্রীভাবে অ্যাই! অ্যাই! করে চিৎকার করেছিল। দরজা খুলে বেরুতে যাবে। থমকে দাঁড়াল নিশি। কাশতে কাশতে অরিন্দম বিষ ঝেড়েছিল কফের মতো। অ্যাই! তোমার রোজ কুর্তি কেনার টাকা আসে কোত্থেকে? পে স্লিপ দ্যাখাবি পরের মাসে আমাকে। টাকা ফাঁকি দিচ্ছিস।
আজ ও এসব ভাববে না। আজ আলমারি হাঁটকে নতুন খবরের কাগজ পেতে ফেলতে ইচ্ছে করার মতো বসন্তকাল। নতুন কাগজের ওপরে প্লাস্টিক বন্দি একগাদা কম্বল, চাদর, শীতের শাল, সোয়েটার, ন্যাপথলিন দিয়ে রাখতে হয়। তোয়ালে দিয়ে মুড়ে দিতে হয় ভারী পশমবস্ত্র। শীতবস্ত্র তুলে ফেলার দিন এখন। এই তোলা আর পাড়া। বড্ড ধকল। কিন্তু তাও মন চনচন করে।
আর, ওই যে, উসখুসও করে। হয় নতুন প্রেমের জন্য নয় নতুন শাড়ির জন্য। হঠাৎ হলুদ শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয়।
নিশির জীবনে কোনোটাই নেই যদিও। সেদিনের পরে আজই অরিন্দম আবার ওর হাত মুচড়ে চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছে।
চোপ মাগি। তোকে থাকতে দিই আমার বাড়িতে। আমি বাড়ি বানিয়েছি নিজের কষ্টের পয়সায়। গলায় রক্ত তুলে রোজগার করতাম। তোকে এখন নিজের ছেলেকে নিয়ে এ বাড়িতে থাকার ভাড়া দিতে হবে। মাথার ওপর ছাত দিয়েছি। এটুকু বাড়িভাড়া দিবি না!
মাসে মাসে নিশিকে নিজের মাইনের পুরো টাকা তুলে দিতে হয় অরিন্দমের হাতে। অরিন্দম সারা দিন ধরে কীসের যেন ব্যবসা করে। বাড়িতেই বসা। শুধু ফোনে ফোনে কত সব লোককে ফোন করে। লাখ লাখ টাকার কথা বলে। তেজি মন্দার কথা বলে।
সন্ধেবেলা গজল শোনে। মদ খায়। সারা দিন সিগারেট। সিগারেটের ছাই জমে থাকে অ্যাশট্রেতে। আগে নিশি ফেলত। এখন ফেলেও না।
একদা ও চাকরি করত। হিল্লি দিল্লি ট্যুর করে বেড়াত। তখন ওর শরীর ছিল। কাজ করার মন ছিল। এখন কিছু নেই। তেতো পচা একটা মন আর শরীর নিয়ে অরিন্দম বাড়ির প্রধান অঞ্চলে একটা ডিভান জুড়ে আছে। ডিভানের চাদর পালটাতে দেয় না। হাকুচ ময়লা চাদরটাকে দেখলে বমি উঠে আসে নিশির।
বসন্ত এলে পুরনো চাদর পালটে নতুন চাদর পেতে দিতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু করবে না ও। কেন করবে? কার জন্য করবে?
কিন্তু যে কথা হচ্ছিল। সবুজ পাতা। এই রং দেখলে বুক শিরশির করে, শরীরে কুলকুল করে ঝরনা বয়। এত কাঁচা রং কোথায় লুকিয়ে রাখে গাছ? কীভাবে রাখে? কেন রাখে? শুধু বসন্তকালে বেরিয়ে আসবে বলে?
এই নিন ম্যাডাম, কফি। ল্যামিনেট করা ওয়ার্ক স্পেসের ওপর ঠক করে নামাল কাগজের কাপ। কাপের গায়ে নামি কফির কোম্পানির লোগো আঁকা। কফিটা বেরিয়েছে কফি মেশিন থেকে। যেন কত ইয়ারের দোস্ত। হাসিটা খুব মোলায়েম।
এটা তরুণ গুপ্ত। সাদা শার্ট, বুকে আরোগ্যবিধানের আইডি কার্ড ঝুলছে টিং টিং করে। তরুণের গালে ভোঁতা ব্লেড দিয়ে দাড়ি কামানোর সবজে আভা। নিশির ওকে ভালো লাগে না।
কিন্তু তরুণের নিশিকে লাগে।
তরুণের চোখ পড়ে নেয় নিশির ভুখা রুখা শুখা শরীর। তরুণ যেন চোখ দিয়েই বুঝে নিয়েছে নিশিকে কেউ স্পর্শ করেনি বহুদিন। হয়তো বারো বছর হয়তো দশ বছর। বুঝে নিয়েছে নিশির শরীরে বহুদিন পলাশ শিমুল ফোটে না...
তরুণ এই বাজে কাজের চাকরিতে ঢুকেছে ডাক্তার ব্যানার্জির হাত ধরে। ডাক্তারের দারুণ পশার। আগে নিজের বাড়িতে চেম্বার করতেন। তারপর শহরের তিনটে এমন সেন্টারে বসেন। আরোগ্যবিধানে বসার পর থেকে তরুণের কলি ফিরেছে। ও ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট রাখে। পেশেন্টকে ডেকে ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকানোর আগে বাইরে প্রেশার মাপে, অক্সিমিটার দিয়ে পালস, অক্সিজেন লেভেল মাপে।
তরুণ ফটো তুলতে ভালোবাসত। কম বয়সে একবার পয়সা জমিয়ে এসএলআর ক্যামেরা কিনেছিল। এখন সব ডিজিটাল। ফোনের ভালো ক্যামেরাতেই কত লোক ছবি তুলে উলটে দিচ্ছে সব। তরুণের খুব পুরুলিয়া যেতে ইচ্ছে ছিল। এ বছর পুরুলিয়াতে গিয়ে যেভাবে সবাই রাশি রাশি পলাশ আর শিমুলের ছবি তুলেছে। এক এক বছর এমন হয় নাকি। পলাশ শিমুলের বিস্ফোরণ হয়েছে এ সালে। পথে পথে হাইওয়ের ধারে ধারে, গ্রামীণ বোর্ডের রাস্তার ধারে...শুধু পলাশ শিমুল...তরুণের যাওয়া হবে না। এবারও।
দুই.
একলা গলিটার এই অংশটা চিপা, দুধওয়ালার ডিব্বার মতো লম্বাটে গর্ত আকারের।...কিন্তু এই গলিটা, যেটা খানিক দূরে গিয়ে একটা টাইমকলের চৌহদ্দিতে পড়েছে এবং যে জায়গাটা সর্বদা পিছল, সেটাই আরও এগিয়ে বিস্তৃত এক বস্তির সার সার ঘরের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সেই বস্তি, যেখানে সামাজিক রটনায় বেশ কিছু খারাপ মেয়ে থাকে। কিন্তু বস্তুত থাকে না, থাকে গেরস্ত বউয়েরা। যাদের বরেরা সাইকেল সারায় আর গাড়ি ধোয় আর ইস্তিরি করে। আর মেয়েগুলো উঁচু ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে রান্না, কাপড় কাচা বাসন মাজার কাজ করে...এদের প্রত্যেকের জানালায় আছে রঙিন শাড়ি কাটা পর্দা। টিয়াপাখির খাঁচা। আর দরজার দুপাশে ছোট রঙিন প্লাস্টিকের টবে টবে গাছ...। পুষ্টির অভাবে বেঁটে হয়ে থাকা ছেলেপুলের মতো খর্ব কিন্তু সবুজ।
খাঁজে খোঁজে কিছু হাফগেরস্ত থাকলেও থাকতে পারে। সাড়ে তিনটে মুদির দোকান আছে। প্রতি বাড়ির সামনে অসংখ্য জলের ছোটবড় প্লাস্টিকের কানেস্তারা। টাইম কল থেকে ঝগড়াঝাঁটি মারামারি মন কষাকষি করে ভরা। যেগুলো সুনিপুণ কায়দায় একটা আরেকটার ওপরে বসানো থাকে। অনেক দড়িতে অনেক শুকনো আর আধাশুকনো নানা রং কাপড়। দেখলে কে পুরো আর কে হাফ সেসব বোঝার উপায় নেই। এমনিতেও তো এদের কোনো প্রাইভেসি নেই। অতিমারি হলে এরা রাস্তায় পাতা খাটিয়া থেকে ঘরে যেতে পারে না। একটা আট বাই আট ঘরে দশজন...নাহ, ‘ঘরে থাকুন’ এদের জন্য নয়। এদের প্রাইভেসি নেই বটে তবে প্রাইভেট টিউটর আছে।
ফোনে মোবাইল গেম খেলা ছেলেটার নাম পুঁটো। ওর বন্ধুটার নাম রঘু। কিন্তু দুজনেই অতিমারির সময়ে স্কুলছুট। অনলাইনে পড়ার জন্য বাবা মায়েরা পুরো একটা মোবাইলফোন, তাও স্মার্টফোন, তাও আবার ডেটা ভর্তি, ওদের দিয়ে দেবে? কোথায় থাকো মামণি? বাড়িতে ভাইবোন থাকলে ভাইটা তাও পেতে পারে বাবার ফোন। পড়ার জন্য। বোনটা মায়ের সঙ্গে কুটনো কোটার ক্লাসে গেছে দুবছর। কিন্তু পুঁটো বা রঘুর জন্য সেটুকু ছিল না বলে ওদের পেরাইভেট টিউশনে দিয়েছে মা। মাসে তিনশ টাকা। পাশের বস্তি থেকে একটা দিদি আসে। দিদিটা নিজেই এবার টুয়েলভ দেবে। ওটুকু পড়িয়ে দিন গুজরান হবে দিদিটার। তাই। পুঁটো আর রঘু কেউ ভালো ছাত্র না। তাই দুজনের পিঠে মাঝে মাঝে স্কেলের বাড়ি মেরে ক্লান্ত দিদি নিজের পড়া করে, ওদের দুপাতা হাতের লেখা লিখতে দিয়ে। ওরা লেখে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং। দিদিমণি নিজের কাজ করে।
পুঁটোর কাছে অফার আছে। মুম্বাই চলে যাবে ও। রেস্তোরাঁয় কাজ দেবে।
কে কাজ দেবে রে তোকে? রঘু অবাক হয়।
আছে আছে, এজেন্ট আছে।
আমিও যাব। ইশকুল ভাল্লাগে না।
তুই তো যাসই না।
কর্পোরেশনের স্কুলে বাবা পাঠাবে না বলেছিল। পেরাইভেটে পড়াবে বলছিল। কাজ নেই বলে আর পড়াবে না।
আরে দুবছর সব বন্ধ ছিল না? বিরুকাকু বলেছে, লেখাপড়া এমনিও তোর হবে না। সুরাতে নিয়ে যাব। হীরের কাটিংয়ের কাজ শিখে নিবি। সোনার দোকানের কাজ শিখে নিবি। খেতে দেবে। থাকার জায়গা দেবে। তাছাড়া মাইনে পাবি।
কত মাইনে পাবি?
তা জানি না। হাজার। দুহাজার।
ধুস, তুই কিচ্ছু জানিস না। আমার একটা জ্ঞাতি দাদা ওইভাবে গেছিল। ওরা আটকে রাখে। ফিরতে দেয় না। এক বছর হাতে টাকা দেয়নি।
অতিমারির সময়ে অবিশ্য ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর লোকেরা ‘ঘরে থাকুন’ মানে। পিচরাস্তায় বিছানা পাতে না। একটা তাওয়ার মতো গরম আকাশের নিচে শুয়ে ঘামাচি মারে না। এসি চালানোর চেষ্টা করে। সর্বস্ব খরচ করে আটশ স্কোয়ারফিটের বিল্টাপ এরিয়া থেকে কত স্কোয়ারফুট কার্পেটেড এরিয়া হয় তার অঙ্ক কষতে কষতে হয় শীতল দাম্পত্য নয় ধর্ষণময় দাম্পত্য যাপন করে। কোনো কোনো ছোট্ট বারান্দাবাগানে ফুলও ফোটে, কোনো কোনো জীবনে প্রেমও আসে। প্রেম থেকে ক্রমশ তা উদ্বেগের উদ্যাপনে পৌঁছায়।
এই গলিতে দাঁড়িয়েই আব্বাস রোজ ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলে।
তিন.
পেশেন্ট এসেছে। সন্তান লাভের জন্য উদগ্রীব নববিবাহিত কাপল। কাপলের দুজনই নভিস। পুরুষ নারী, সন্তানের আকাঙ্ক্ষা আকুল। কত নধর, কত আশাবাদী। কত চকচকে পোশাক। চিকিমিকি জরির পাড় শাড়ির মেয়ে। ফিটফাট জামার ছেলে। জামাকাপড়ে এরা কত খরচ করে। নেল আর্ট করিয়েছে মেয়েটা। অথচ সন্তান পাচ্ছে না বলে বিয়ের ছমাসের মধ্যেই ডাক্তারের দোরে দোরে হত্যে দিয়ে পড়েছে। হয়তো দেখা যাবে ঠিক করে সেক্স করতেই জানে না। কিন্তু সেক্স ঠিক করে করতে পেরেই বা নিশির কী হলো। অরিন্দম তো ওরকম হয়ে গেল। একটা সন্তান পয়দা করা ছাড়া আর কিছু তো পায়নি নিশি জীবনে।
সাত দিন আপনাদের আলাদা থাকতে হবে। বুঝেছেন। নো ইন্টারকোর্স।
নিশি প্রফেশনাল ভঙ্গিতে জানায় দম্পতিকে। এই এই জায়গায় সই করুন। এই এই বিধি মেনে চলবেন। কাগজে লেখা আছে। সাত দিন অ্যাবস্টেইন করবেন।
অ্যাবস্টেইন মানে বোঝেনি দম্পতি। মেয়েটির চুলে হাইলাইট করা। ছেলেটা হাঁ করে চেয়ে আছে।
কথোপকথনের মধ্যে প্রধান ঢুকে গেল। একটু আগে তরুণের এনে দেয়া কফি শেষ করে কাপটা মুড়িয়ে ও বাস্কেটে ফেলে দিয়েছে। এখন প্রধান এনেছে মুড়িবাদাম। নিশির মতোই শুকনো। স্ন্যাক্স হতে হবে তেলহীন, এ সময়ের বরাদ্দ, দশ টাকার এক ছোট ঠোঙা। এটা টিফিন। এর পর, অনেক অনেক ঘণ্টা, আরও অনেক অনেক মূর্খ দম্পতিকে ‘আলাদা থাকা’র মানে বোঝানোর পর, নিশি লাঞ্চ ব্রেকে যেতে পাবে। গোল স্টিলের কৌটো থেকে রুটি আর আলু সয়াবিনের তরকারি বার করে খাবে। বিস্বাদ লাগবে সেই খাবারও। কিন্তু চটপটি মশলাদার খাবার খেতে পারে না নিশি। খেলে অসুখ করবে অবধারিত।
প্রধানকে দেখে নিশির মনে পড়ল। এই প্রধান। মুখটা ক্রমশ বৃদ্ধ, কুঁচকে যাওয়ামতো। কোনো এক দেশে যেমন মুণ্ডচ্ছেদের পর বর্শাফলকে গাঁথা শত্রুপক্ষের মুণ্ডকে রাখতে আর ক্রমশ সে মুণ্ড শুকিয়ে শীতল। প্রধানের দু-তিন বছর আগেও এমন ছিল না। দু-তিন বছর আগেও প্রধান ছিল চটপটে। ছোটখাটো চেহারা কিন্তু ভেতরে যেন ব্যাটারি লাগানো। এই আরোগ্যবিধানের অতি তৎপর পিয়ন। নীলচে ইউনিফর্মের বুকে লেখা লোগো। বৃদ্ধ পেশেন্টদের ধরে ধরে আনা, পোয়াতি মেয়েদের বসার জায়গা খুঁজে দেয়া। এসি কমিয়ে বাড়িয়ে সবাইকে খুশি রাখত। দরকারে হাসিমুখে হুইলচেয়ার বা স্ট্রেচার ধরত।
তা বাদেও প্রধান অনেক কিছু পারত। লোক ডেকে ছাতের বিশাল ওভার হেড ট্যাংক পরিষ্কার করাতে পারত। ব্লিচিং ঢেলে নিজে ট্যাংকে ঢুকে পা দিয়ে রগড়ে পরিষ্কার করে দিত। আবার নিয়মমতো বেলায় বেলায় টাইমের জল আসার টাইমে পাম্প চালিয়ে জল তুলে তুলে আস্তে আস্তে ট্যাংক ভর্তিও করে দিত। পেশেন্ট বসার জায়গার কুলার পরিষ্কার, এসির খাঁচা খুলে ময়লা জাল বের করে ধুয়ে সাফ করা এসব তো ওর টুসকি। সর্বকর্মে পটু আর কোনো কাজে না নেই।
এই প্রধানই সপ্তাহের একখানা ছুটিতে প্রায় হাওয়ায় উড়তে উড়তে ও চলে যেত মেদিনীপুরে। নিজের ঘরে, নিজের দেশের বাড়িতে ফিরতে কারুর আলাদা কষ্ট হয় না। বাড়িতে বউ, মা, ছাতে লকলকে লাউডগা ইত্যাদি ইত্যাদি। লতায় দুলছে কচি শশা। বাড়িতে ভাজা হচ্ছে গরম গরম লাল মুড়ি। গন্ধে প্রাণ হারানো মানুষেরও জান ফিরে আসে।
তাই প্রধানের শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া অনায়াস ও সাবলীল। শরীরে ব্যথাবেদনা মরে যায় হাইওয়ে থেকে গ্রামীণ রোডের দিকে নামার সময়ে সবুজ গন্ধ পেলে। খানাখন্দের সুবাসে প্রাণ হাঁকপাকায়।
প্রধান বাস ধরত ধর্মতলা থেকে। বাসে চেপে বসতে পেলেই টপ করে ঘুমিয়ে পড়ত। জেগে উঠত বাড়ির স্টপের ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে। ধানের বস্তা আর তেলের টিনে বোঝাই, অজস্র গৃহগামী মানুষে বোঝাই বাস।
কিন্তু সংসার! সংসার! কয়েক বছর পরেই ওর উসখুস শুরু হলো। বিয়ের পর তিন বছর ঘুরল, সন্তান হচ্ছে না। বউটাকে আরোগ্যবিধানেই আনল প্রধান, দেখল নিশি ওকে। ডাক্তার ব্যানার্জিকে বলে ব্যবস্থাও হলো টেস্টের। বউটা মিষ্টি, টুলটুলে। পানপাতার মতো মুখ ওর। হাতে ছোট সস্তা রেক্সিনের গোলাপি ভ্যানিটিব্যাগ। শাড়ি উঠিয়ে পরা। গোড়ালি দেখা যায়।
প্রধানের দুশ্চিন্তা বাড়ছিল। দেশে মা আর অন্য মহিলারা ওর বউকে খুব দুষছিল। ওর বউ বাঁজা। এই মারে কি সেই মারে। কথায় কথায় অভিশাপমন্যি করে। বউটার কিছুতেই পেট হয় না। অপয়া আর অলক্ষুণে মেয়ে। অধীর হয়ে উঠেছিল গ্রামসুদ্ধ জ্ঞাতিগুষ্টি। মাঝে মাঝে সপ্তাহের একদিন বাড়ি গিয়ে বউয়ের নাকেকান্না অসহ্য হতো। ভাবত, দিই দুঘা মেরে। কিন্তু হাত উঠত না। প্রধান অনেকটা বয়সে বিয়ে করেছে। বউটা এখনও কচি।
তাই প্রধান এখানেই এনেছিল বউকে। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে নিশিই কথা বলিয়ে দিয়েছিল। ওদের দুজনেরই টেস্ট হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বউটার নয়, প্রধানেরই দোষ পাওয়া যায়।
স্পার্ম কাউন্টের সমস্যা। বুঝিয়ে দিয়েছিল রিপোর্টটা নিশি নিজেই। তারপর থেকে প্রধান কেমন নিভে গেল। মুখ চুন হয়ে গেল প্রধানের।
এরপর প্রায় যেন কোন জাদুমন্ত্রে কে ওর সব জান শুষে নিয়েছে। ক্রমশ দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে গেছে ও। পৌরুষ এমন জিনিস। নিজের পৌরুষে খুঁত! নিজের ক্ষমতার আদত জায়গায় খোঁট। জানতে পারলে বাঘও সারমেয় হয়ে যায় বোধ হয়।
এই আরোগ্যবিধান কত কত বাইরের লোকের পয়সা দিয়ে চিকিচ্ছের ব্যবস্থা করে। কত লোক আসে, ফল পায়। সন্তান পায়। প্রধান এই আরোগ্যবিধানকে জীবনের কুড়িটা বছর দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পায়নি কিছু। কোনো সুবিচার, সুবিধান দেয়নি ওকে আরোগ্যবিধান। জীবন কেন এমন? নিশি ম্যাডাম ওর টেস্টের খরচ মওকুফ করিয়ে দিয়েছিল, এইটুকুই শুধু। লাভ কী হলো? ফল কী হলো?
নিষ্ফলা প্রধানের মা মারা গেছে গত বছর। মায়েরও মনে আঘাত লেগেছিল কি? তার পরপরই মা পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙল। আর হাসপাতালের ওপর ভরসা ছিল না প্রধানের। ও মাকে লোকাল মেডিকেল সেন্টারেও নিল না। বাড়িতেই ফেলে রেখে দিল। সেপটিক হয়ে গেল মা-টার। হাড়গোড়ের বাসা হয়ে পড়ে রইল মা। তারপর একদিন মরে গেল।
কপালে যা আছে তাই হবে। বউকে তো কম গঞ্জনা করেনি মা।
প্রধানের বাড়ির চালে ফনফনিয়ে ওঠা লাউচারা আর লাউ দেয় না। ফুল ফোটে না বসন্তেও। প্রধানকে দেখলেই বোঝা যায়। ওর মাইনের টাকা পুরোটা বাড়ি অবধি আর পৌঁছায় না। হয়তো শুকনো কোনো নেশা ধরেছে প্রধান? কে জানে?
নিশির মন উদাস হয়ে যেতেই ও নিজেকে সামলে নেয়। জোরে জোরে ফোনে কথা বলা একটা পেশেন্টকে ওয়েটিং রুম থেকে বাইরের বারান্দায় পাঠিয়ে দেয়। ঠিক সামনের এক পেশেন্ট পার্টির সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে। ঝগড়া করতে করতে আবার শরীরে বল ফিরে পায়। নিজের মনের সাড় ফিরে পায়।
চার.
প্রিয়জনের উদ্বেগ আব্বাসের নেই। আব্বাসের ক্লায়েন্ট কল আছে। এই দুই নতুন ফ্ল্যাটের মাঝের চিপা অংশটা অনেকটা জেলখানার করিডরের মতো বা লম্বাটে আকারের দুধের ডাব্বার তলদেশের মতো ফাঁপা আর অনেকটা ওপরে গিয়ে আকাশের দিকে মুখখোলা বলেই, এখানে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বললে সে কথাগুলো গমগম করে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে হতে ফ্ল্যাটের সর্বোচ্চ খুপরি ঘর অবধি উঠে যায়।
এই কোম্পানিগুলো হারামজাদা কত! একজন আরেকজনের সঙ্গে তুমুল কম্পিটিশন দিচ্ছে। নিজের প্রোডাক্ট চালাবে বলে অন্যের প্রোডাক্ট ঘেঁটে দিতে কল করে রেখেছে এমন। ওস্তাদির চূড়ান্ত। এই যেমন আপেল আঁকা ফোনটা আবার পুতুল আঁকা ফোনটার সঙ্গে হেব্বি ঝাড় করে রেখেছে। কাল এই চক্করে কানে শোনার ভালো একখানা জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে আব্বাসের। দামি একটা কানের যন্তর! কোনো মানে হয়। ওটাকে আপেল আঁকা যন্ত্রের থেকে গান শুনবে বলে লাগিয়েছিল। ব্যস। সেটা গেল বসে। না শোনা গেল গান, না হলো কাজ। তারপর আর ফিরে সেটাকে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সঙ্গে লাগানোই গেল না। অ্যান্ড্রয়েডও আর তাকে চিনতেই পারল না। পরদেশি করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। যেন অচ্ছুৎ হয়ে গেছে একবার আপেলের সঙ্গে পেয়ারিং করেই।
পাজির পাঝাড়া। প্রতি কোম্পানির নিজস্ব যন্ত্র কিনতে হবে। প্রতি কোম্পানির নিজের নিজের আলাদা আলাদা পেয়ারের জিনিস। পেয়ারিং করা জিনিস। আজ ইয়ারফোন কেনো তো কাল চার্জার। খারাপ হচ্ছে তো হচ্ছেই এদিকে। এমনকি ছবিও। আপেলের ছবি অ্যান্ড্রয়েডের ছবি আলাদা ফরম্যাট। একটা যন্ত্র দিয়ে অন্য যন্ত্রের ছবি দেখা যাবে না। কেন? একগাদা ছবি এভাবে হারিয়ে গেছে এক যন্ত্র থেকে আরেক যন্ত্রে নিতে আব্বাসের।
কাজের জন্য যত এদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে, আব্বাসের মনে হয় ধীরে ধীরে অদৃশ্য সাঁড়াশি এনে তাই দিয়ে ওর গলা টিপে দিচ্ছে ওরা। বৃহৎ সব গুণ্ডার দল। টাকার কুমির। দাঁতের ফাঁকে ফেলে পিষছে আব্বাসকে।
এখন আর ইয়ারফোন নেই। ক্লায়েন্টকে কল করে আব্বাস ফোন স্টিরিওতে রাখল। চেঁচিয়ে কথা বলছিল ও। সারা পাড়াটা কাঁপছিল ওর চিৎকারে। যেভাবে রোজ কাঁপে।
এটাই আব্বাসের স্টাইল। ওর জানান দেয়ার স্টাইল, আমি আছি, আমি বাঁচি।
সবাই এভাবেই। এটাই নিয়ম। নিজেকে জানান দাও। নইলে মরো!
হঠাৎ কলোনির মাঠের নামটাই মাঠ। আসলে মাঠটার অস্তিত্ব নেই। শুধু রাস্তা আর বাজার। পাশে একটা বস্তি আছে। বস্তির মুখের কাছে গলি। কর্পোরেশনের হলুদ লাল ইন্টারলকিং টালির মোজেইক করা গলি। সদ্য সদ্য হয়েছে কাজটা। এখনও টালিগুলো সাইকেল আর বাইকের চাকার ধাক্কায় ভেঙেচুরে এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়নি।
আব্বাস সকালে এই রাস্তা দিয়েই বেরুল। তখন দেখেনি। দুটো ছোট ছেলে ফ্ল্যাটের সামনের সিঁড়িতে বসে ফোনে চোখ লাগিয়ে গেম খেলছে। স্পষ্টই স্কুল পালানো হাড্ডিসার বাচ্চাদুটো। সামনের বস্তির একটি গোলগাল বউ জল তুলছে টাইমের কল থেকে। টেনে টেনে বালতি রাখছে। আব্বাসকে গেটের সামনে দাঁড়াতে দেখতেই, ছেলেদুটোকে এক ধমক দিয়ে সরিয়ে দিল।
ওদের এই গলিটার এক অন্তে বস্তি। অন্য দিকে দুদিকে দুটো নতুন তৈরি হওয়া ফ্ল্যাটবাড়ির খাড়া নিরেট পাঁচিল উঠে গেছে। দুটো ফ্ল্যাটে ষোলোটা আলাদা অ্যাপার্টমেন্ট। তার মধ্যে ছ-সাতটা বাড়ির কমবয়সীগুলো মাঝে মাঝে মধ্যরাতে অনলাইনে খাবার অর্ডার করে। তখন সুইগির ডেলিভারি ম্যান এসে এই লাল হলুদে পথ হারায়। আর ফোন করে করে চেঁচায়। কোথায় ম্যাডাম দুইয়ের তিন? কোথায় চারের এক? কী জ্বালা। পথ খোঁজার এই খেলা চলে সমস্ত দিনই। কিন্তু রাত্রে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে হাডুডু।
জটিল গোলকধাঁধার মতো এই অঞ্চল তখন হয়ে যায় ভুতুড়ে কল্পকথার বিপজ্জনক অন্ধগলি। সে পথ সর্পিল, পিচ্ছিল, মসৃণ। পুরো পথটা ছানবিন করতে করতে আগুপিছু করতে করতে ভোঁচক্কর হয় ছেলেগুলো। কালো জামা হলদে লোগো সুইগিম্যান। ফোনে কথা বলা কণ্ঠস্বরগুলো বেজে বেজে ওঠে মাঝরাতে। অন্যদের ঘুম খানখান করে।
আব্বাস ওই ষোলোটা ফ্ল্যাটের একটার বাসিন্দা। তার ঘরে এক পিস বউ আর এক পিস মা আছে যারা সারাক্ষণ পরস্পরকে টেক্কা দিতে চায় এবং দুজনেই সারা সন্ধে একই বা আলাদা আলাদা শাশুড়ি বউ সিরিয়ালে মজে থাকে।
একদা আব্বাসের দখলে থাকত বাড়ির কেন্দ্রীয় অংশ। ইন ফ্যাক্ট, প্রায় প্রতি পরিবারের পুরুষদের সম্পর্কে এই কথা সত্য ছিল যে, তাদের দখলে সারা সকাল থাকত খবরের কাগজ আর সারা সন্ধে থাকত টিভি। কিন্তু গত পনেরো বছর ধরে বাড়ির পুরুষদের হাত থেকে বাড়ির কেন্দ্রীয় অংশ ক্রমশই পিছলোতে পিছলোতে বেরিয়ে গেছে। এবং কেন্দ্রীয় টিভি এবং/অথবা বেডরুমে রাখা অ্যান্সিলিয়ারি টিভি দুইই বেরিয়ে গেছে তাদের অধিকার থেকে। তারা এখন ফোনে ফিলিম দেখে, ওটিটিতে অসভ্য বা সেমি অসভ্য ইংরেজি সিরিজ বা ছায়াছবি দেখে, এবং তাদের অফিসের কাজও ফোনেই হয়। ফোন করার সময় তারা প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত চেঁচিয়ে কথা বলে কারণ তাদের ক্লায়েন্টরা সচরাচর মুম্বাই দিল্লি গুরগাওঁ বা বেঙ্গালুরুতে থাকে। বাড়ির সাড়ে ছয়শ বা সাড়ে আটশ স্কোয়ারফিটের ভেতরে এই সব চেঁচিয়ে অফিসের কথোপকথন সন্ধের দিকে করলে মা এবং অথবা বউয়ের সিরিয়াল দেখার ডিসটার্ব হয়। অথবা ভাইসি ভার্সা।
মোটমাট পারিবারিক শান্তি ও ক্লায়েন্ট কলের ভব্যতা বজায় রাখতে আব্বাস বা আব্বাসের মতো আরও অনেক পুরুষই এখন হয় চিলতে বারান্দায় এসে তারস্বরে চিৎকার করে কথা বলে। আরেকটা কারণ আছে। তা হলো ডেটাপ্যাক ও ফোনের সিগনালের সমস্যা। বাইরে না এলে দেয়াল ভেদ করে ঢুকতে চায় না সিগন্যাল। প্রতি উঁচু বাড়ির ছাতে ছাতে বানানো সেলুলার টাওয়ার ঝনঝন করে কাটাকুটি করছে আকাশে, তাদের যাবতীয় সিগন্যাল। কিন্তু উঁচু বাড়িগুলোর ভেতরে ঢুকতে পারছে না। কাচ কাঠ ইঁটে আটকে যাচ্ছে। ফলত বারান্দায় আসতে হচ্ছে নয়তো রাস্তায় নেমে যেতে হচ্ছে। বারান্দাকে এরা সচরাচর ব্যালকনি বলে যদিও...যাদের চিলতে বারান্দা ভেজা লন্ড্রিতে পরিপূর্ণ (এরা কাপড়চোপড়কে আজকাল লন্ড্রি বলে) তারা তাই সোজা রাস্তায় নেমে পড়ে ও হাঁটতে হাঁটতে পাগলের পারা কথা বলে। একাধিক লোক অনেক সময় নেমে পড়ে গলিতে। ব্লুটুথে কথা বললে তাদের খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথরের মতন দেখায়...একলা কথা বলা দুটি কি তিনটি অদ্ভুত চরিত্র পাশাপাশি হেঁটে চলে বেড়ায়...কারুর কথা বোঝাও যায় না তখন। একটা সম্মেলক কলরোলে ঢেকে যায় পাড়া।
আব্বাস প্রথমে হায়দরাবাদের ক্লায়েন্টের সঙ্গে টুটাফুটা ইংরেজি ও হিন্দিতে কথোপকথন চালাল। তারপর সেই কথাগুলো সে বাংলায় রিলে করছিল তার অফিসের অধস্তন সাগরকে।
অধস্তন বসে আছে হাওড়ায়...তার সামনে ল্যাপটপ। সে খুলেছে একটি সরকারি ওয়েবসাইটের পাতা নিজের সামনে। আইটি রিটার্নের পাতা। আইটি স্যাভি সাগর। তাকে জমা করতে হবে হায়দরাবাদের ক্লায়েন্টের কিছু তথ্য, জমা করতে হবে ট্যাক্স। বের করতে হবে চালান। ই চালান যার নাম।
সাগরের নেট স্লো এবং আব্বাসের মেজাজ অধৈর্য। ফল যা হবার তাইই হচ্ছে। সে চিৎকার করতে করতে হাঁটছে এবং প্রতি পাঁচ মিনিটে এক একবার সাগরকে বোকা-দা বলে সম্বোধন করছে। অফিসের ঘেরাটোপে এককাপ ফেনা ওঠা কফির সঙ্গে এই সম্বোধনে একটা মিষ্টি দাদাসুলভ পিঠে হাত রাখা ব্যাপার থাকে কিন্তু এ মুহূর্তে ঘরে থাকুন-এর সময়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোমে, তার তারস্বরে চিৎকার ষোলো ফ্ল্যাটের বাসিন্দার কানে বিঁধছে, থ্যাংক টু ওই সরু লম্বা দুধের ডিব্বার মতো গলি।
ইতোমধ্যে একটা বাসি চাঁদ উঠে গেছে মাঝ আকাশে। দুধের মতো তরল আলো ঢালছে। দুদিকের দেয়ালে গড়াতে গড়াতে সে আলো ভুতুড়ে হয়ে নেমে আসছে নিচে।
একটা বড় আশশ্যাওড়া গাছ গলির মুখে। তার নিচে ছেলেপিলেরা স্বাধীনতা দিবসের পতাকা তোলে তাই তেল রং দিয়ে ডোরা কেটে কমলা সাদা সবুজ করা। ওপরের আকাশ তামাটে...চাঁদের আলোতে ঝাপসা।
খুব জটিল দাম্পত্য সম্পর্ক যেন। ক্ষণে মেঘ ক্ষণে বেগ। কখনো রেগে লাল কখনো হেসে সবুজ। নানা বিন্দু, নানা চিহ্ন...আপনি কি অমুক অমুক কাজ কোনোদিন করেছেন, যদি করে থাকেন তো আপনাকে দিতে হবে তার জন্য গুনাগার...গুনাগার দেবার জন্য পরবর্তী স্তরের অপেক্ষা করুন...তমুক বিন্দুতে হাত রাখুন, অমুক ফর্ম ফিলাপ করুন, যদি না করে থাকনে তো সবুজ তিরচিহ্নে চাপ দিয়ে চলে যান পরের পর্বে...
নতুন একটা অ্যাপে দেশের সর্বোচ্চ অর্থ দপ্তর রিটার্ন সাবমিট করতে বলেছে। গুষ্টি গুষ্টি মিটিং করে এই দাম্পত্যে এক রকমের স্থিরতা, নড়বড়ে রকমের আপাত স্বস্তি অর্জন করা গেছে। যে দেশ সবচেয়ে এগিয়ে গেছে আইটিতে, দেশে-বিদেশে যাদের আইটি কর্মীরা ঝকঝকেতম বিদ্যাবুদ্ধির নিদর্শন রেখেছে, শ্রেষ্ঠতার তকমা পেয়েছে, তারাই আইটি রিটার্নের অ্যাপে এসে কিঞ্চিত ঢেঁড়াল। ওই আইটির সঙ্গে এই আইটির মিলন সুগম হয়নি প্রথমে। দশবার আরও ডাকা করিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, ধমকানি চমকানি দিয়েছেন। বারে বারে অ্যাপ ডাউন হয়েছে, থেমে গেছে অ্যাপের গতি...গোল গোল ঘুরেছে চাকা।
তারপর বহু পরিচর্যা করে এখন ঠিক করা হয়েছে সব। অ্যাপটায় ঢুকতে পারা যাচ্ছে। কিন্তু সিংহের গর্তের মতো বেরুতে পারা যাচ্ছে না। এত শর্ত, এত যুক্তি, এত ধরা দেয়া, এত কথা বলা, এত মান, অভিমান। খুব জটিল দাম্পত্য সম্পর্ক যেমন হয় আর কি।
সাগর, এবার স্ক্রোল করে উপরে যা, এবার ওই লিঙ্কে ক্লিক কর...ফর্মটা খুলেছে? আরে নতুন ফর্ম নম্বর অমুকতমুকটায় যা না বা...আরে গাম্বাট, এটাও বোঝো না...তোমার ডেটার স্পিড এত কম কেন বোকাচো-...এই চলছে এক ঘণ্টা ধরে।
এরই ভেতরে হঠাৎ আব্বাস নজর করে দেখে ওদিকের বারান্দায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা তার দিকেই শুধু দেখছে না মেয়েটা? কেন? কেন শুধু তার দিকেই? কিছু ব্যাপার?
কথা বলতে বলতেই আব্বাসের হাত ঘামতে থাকে।
পাঁচ
বিরু ভুবনেশ্বর স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল। পুরি তরকারি কিনেছে তিনটে জায়গায়। শালপাতার থালা থেকে আলুর ঝোল চুইয়ে পড়ছিল।
বিরক্তিতে মুখ দিয়ে গালি বেরিয়ে এসেছিল ওর। ছিক করে থুতু ফেলেই ছেলেদুটোকে ডেকে, কামরার জানালার শিক গলিয়ে আলু পুরির থালা ওদের কাছে চালান করে।
নিজের পুরির ভেতরে আলু মুড়িয়ে নিয়ে দুকামড়ে পেটে চালান দিয়ে মুক্ত হয়ে প্যান্টে হাত মুছে নেয় বিরু।
অ্যাই, তোদের কাছে ফোন নেই তো?
না। স্মার্টফোন আনা মানা ছিল আগেই জানত পুঁটো রঘু। কাজ করতে যাচ্ছিস, মজা মারতে না। আর ন্যাকা বড়লোকি চাল একদম নয়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাবা-মাকে জানানো। এমনিও তো পালিয়েই যাওয়া। ফোন তো বাবার, এমনিও। নিলে চুরিই করে নিত।
দুজনেই বাড়িতে না বলে এসেছে। পুঁটোর দাদা আগেই মুম্বাই চলে গিয়েছিল। হোটেলে রান্না করে। দিনে চারশ রুটি বেলে। ওরা যাবে চেন্নাই। সোনার দোকানে কাজ দিয়েছে বিরুকাকু। ভালো কাজ। ট্রেনে নিয়ে যাবার সময়ে বারবার করে বলেছে ফেরার কথা মনেও না আনতে।
বিরুর নিজের কিন্তু কাঁধ আর কান অ্যাংগেলে রাখতে রাখতে জমে গেছে। চাপা আছে ফোনটা সেই কোণে। ফোনে বারবার চেন্নাই থেকে ফোন আসছিল। আরও কিছু ছেলেকে জোগাড় করে এনেছে বিরু। আলাদা কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছে। তাদের আবার সঙ্গে চেন্নাইয়ের একটা এজেন্ট আছে। গলায় চকচকে ক্রস লাগানো কালো সুতোয়। মুশকো ভয়ংকর চেহারা।
রঘু একটা ছোট ফোন নিয়ে এসেছিল সঙ্গে। বিরুকে না বলে পাছ পকেটে রেখেছিল। স্মার্টফোন না। তাই বলেনি কিছু।
ট্রেন চলছে। ধূসর পথ। কোথাও কোথাও ছোপ সবুজের। একঘেয়ে। বিরক্তিকর।
বাংলা ছেড়ে এলেই বাইরেটা কেমন রুক্ষ হয়ে উঠতে থাকে। বুকের ভেতর শুকিয়ে উঠতে থাকে। রঘুর মনে পড়ে যাচ্ছে, কদিন পরেই পাড়ায় প্যান্ডেল খাটিয়ে বাসন্তী পুজোর হল্লা হবে মস্তি হবে। রঘু পুঁটো তাতে থাকতে পারবে না। বুকে চিনচিন ব্যথা।
হঠাৎ কোনো একটা বিজ্ঞাপনের ফোন এসে গেল রঘুর ওই ছোট কালো ফোনে। রঘু নিজেই চমকে উঠল। রি রি করে আওয়াজটা ছড়িয়ে যাচ্ছে গোটা চলমান কম্পার্টমেন্টে।
ওপাশ থেকে দৌড়ে এল বিরু।
কার ফোন বাজে?
একটা বিরাশি কেজির চড় নেমে এলো রঘুর গালে। ফ্যাকাশে মুখে রঘু এগিয়ে দিল ফোনটা। বিরু এক হাতে নিয়ে কট করে লাইন কাটল। তারপর তুমুল রাগে একদলা থুতুর সঙ্গে বেজন্মা-বাচক গালাগাল দিতে দিতে ফোনটা নিয়ে এগিয়ে গেল জানালার দিকে।
তিনটে পালটি খেয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ছোট নোকিয়া ফোনটা পড়ল বাইরে। ছিটকে নয়ানজুলিতে নামল কালো কালো বোল্ডারে টক্কর খেয়ে।
পইপই করে শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছি তোদের। তারপরও ইয়ের বাচ্চারা, মাথায় ঢোকে না কিছু। দাঁতের ভেতর দিয়ে হিসফিস শব্দ করল বিরু। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি বেড়াতে যাচ্ছিস আমার সঙ্গে। আমি তোদের আপন কাকা। মনে আছে?
ছয়.
শুকনো জীবনে এসবই আছে। চাঁদের উঠে যাওয়া যেন একটা সরু সরল রেখায় দেখতে পেলে দেখ। স্লাইড যেন। দুটো ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যের স্লাইড। ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় বাগান করেছ তুমি লংকা ফলিয়েছ, জবা ফুটিয়েছ। কিন্তু চাঁদ দেখবে? এত্ত সাহস?
চাঁদ আসবে, কিন্তু সরু সরু প্যাকেজে। প্যাকেজ ডেটার মতো। অল্পক্ষণ জ্যোৎস্না নেবে তারপর মেসেজ দেবে তোমার ডেটাপ্যাক শেষ। আবার টাকা ভরো।
সরু, এক চিলতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অন্য এক ফ্ল্যাটের ছয়ের তিন থেকে কাজরী রোজ চাঁদ দেখে। আব্বাসের কথা শোনে। সে স্টক করে। মেয়ে স্টকার কাজরী। পূর্ণিমার চাঁদ ও আব্বাস দুইকেই স্টক করা তার কাজ।
এসব আব্বাস জানে না। সিরিয়ালে বাঁধা থাকা আব্বাসের স্ত্রী জানে না। এসব গোপনীয় ও ব্যক্তিগত। প্রতিদিন আব্বাস যখন নেমে আসে আর দুধের ক্যানিস্তারার মতো সরু এই দুদিকে-দেয়াল-গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে, চেঁচিয়ে আইটি রিটার্নের অ্যাপের গল্পটা বলে সাগরকে, নানান ক্লায়েন্টের সমস্ত গোপন তথ্য যখন তারস্বরে বলা হয়ে চলে চারপাশে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে, তখন, এই গোপন তথ্য পাবলিক করা সময়ের প্রতিভূ হয়ে, আরেকটি মেয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে দাঁড়ায়।
সেই মেয়ে, কাজরী...বর বাড়ি ফেরার আগে আগে সারা সন্ধে সেজেগুজে নিজের ফোনের ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে ১৩৪টা সেলফি তুলেছে। শাশুড়ি ততক্ষণ নিজের মতো সিরিয়াল দেখছিল। তারপর বর ফিরেছে, মাংস অর্ডার দিয়েছে সুইগিতে। কুমড়োর ঘ্যাঁট দিয়ে রুটি সে খাবে না। তারপর সে মাংসে সাঁতার কেটেছে। খাটের সলিড কাঠের রেলিংটায় মাথা ঠুকে দিয়েছে কাজরীর...অনেকক্ষণ ধরে দুঃস্বপ্নের মতো রমণ। তারপর সে ঘুমিয়ে পড়েছে। গোপনে বরের ফোন ঘেঁটেছে কাজরী অনেক...কত মেয়ের হাই পেয়েছে, চুমু আর লাভিউ চিহ্ন পেয়েছে...। সেসব গোপন কথা কারুকে ফাঁস করবে না কাজরী। শুধু মধ্যরাতে উঠে আসবে ব্যালকনিতে। একা।
ঘরে ঘরে টুঁশব্দ না করা এমন অনেক গোপনীয়তা আছে। এমনই সব পেরাইভেট রাতের পরপর, একটা সকাল জানে দরজা অল্প ফাঁক করে কাগজ নেয়া, দুধের প্যাকেট নেয়া, কাজের মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে নেয়া...তারপর ঠোঁটের কালশিটে লিপস্টিকে ঢেকেঢুকে রাখা...বর অফিস গেলে বিছানায় ফের এসে শুয়ে পড়া...
তারপর সারা বিকেল, বরের অনুপস্থিতিতে কাজরী সাজে, ভিডিও বানায়, ঠোঁট ফুলিয়ে ছবি তোলে, রঙিন রঙিন পোস্ট করে ইনস্টাগ্রামে। আর অনেক রাতে, তাকে ধামসিয়ে বর যখন শুয়ে পড়ে, ভোঁস ভোঁস ঘুমায়, সে এসে দাঁড়ায় চিলতে বারান্দায়।
বারান্দা ভেসে যায় চাঁদের আলোয়। আর নিচ থেকে ভেসে আসে আব্বাসের চিৎকার। অদ্ভুত রোমাঞ্চের মতো, অনেক অচেনা লোকের প্রাইভেট তথ্য ছড়িয়ে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়। তামাটে রাগি পোড়া আকাশ শুধু ওপর থেকে নিচে তাকায়।
কাজরীর এই জীবনের জন্য কাজরীর মা দায়ী। কাজরীর মায়ের ছিল সুখী দাম্পত্য। বাবার জন্য চিঁড়ের পোলাও বা হাতে বানানো হিংয়ের কচুরি বানাত মা। অফিস থেকে বাবা ঠিক সময়ে ফিরত। ঝুরো টিপ পরে সাজত ওর মা, বিকেল বিকেল গা ধুয়ে পাটভাঙা শাড়ি পরত। দুপুরে পাড়ার লাইব্রেরি থেকে আনা প্রেমের গল্প পড়ত। বিছানায় শুয়ে ভাতঘুম দিত ওর মা। সে সময়ের বধূদের জীবনের সারল্য ও সচ্চিদানন্দ সবই ছিল মায়ের। অবরে সবরে ছিল সিনেমায় যাওয়া। সিনেমা হলগুলোর নাম ছিল সব ছন্দ মেলানো, কবিতার মতন। উত্তরা পূরবী উজ্জ্বলা, মিনার বিজলি ছবিঘর। যারা অভিনয় করত তাদের নামও কেমন যেন তিন অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে হতো। উত্তম সুচিত্রা সৌমিত্র অপর্ণা অনুপ মাধবী। এমন কেন হতো কে জানে। সিনেমায় যেতে প্রচুর সাজত মা। সরু জরির পাড় শাড়িটা ন্যাপথলিন গন্ধমাখা আলমারি থেকে বেরুত। সেদিন রাত্তিরে সাংগুভেলিতে চিকেন কাটলেট খাওয়াবে বাবা, মাকে।
মায়ের অনেকগুলো বেড়াল ছিল। ছাতে ঘুরত মা, ছাতের আলিশা ঝেঁপে গোলাপি বুগেনভিলিয়ার ঝাড়। যত্ন লাগে না বুগেনভিলিয়াতে। সহজেই ঝাড় হয়ে ওঠে। বসন্তে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়।
মায়ের বেড়াল, মানে কাজরীদের বেড়াল...কী ভালোবাসত ওদের। ভূতি, মিনি, আলফা বিটা গামা নাম দিয়েছিল। গায়ে পিঠে কোলে বেড়াল নিয়ে বসে কাজরী মাধ্যমিকের পড়ায় ফাঁকি দিত। জানালার বাইরে তাকিয়ে।
কাজরী এই জীবনটা চাইত। তাই মায়ের মতোই ভেবেছিল সুসংসারি মেয়েদের চাকরি করতে লাগে না। বাড়িতে থাকলেই গৃহলক্ষ্মী হয়ে যাবে সে। তার মনে হয়েছিল মা ষষ্ঠীর কৃপায় অনেকগুলো বেড়াল থাকবে আর মা লক্ষ্মীর কৃপায় গৃহ সর্বদাই স্বর্গ হবে। তাই হয়তো প্রথম দিকে কাজরী খুব যত্ন করে রাঁধত বাড়ত। ঘরে সাজানো জিনিস পরিষ্কার রাখত। হাতে ঝাড়ন নিয়ে ঘুরত। টেবিলে চেয়ারে এক কুচি ধুলো পড়লেই একটু ঝেড়ে দিত। রোববারে মাথায় তোয়ালে বেঁধে টুলে উঠে পাখা বা সিলিং থেকে ঝুল ঝাড়ত। রান্নায় লংকা দিয়ে আবার তুলে নিত শাশুড়ির পেটে আলসার ছিল বলে।
কাজরীর বিএ পরীক্ষা অসমাপ্ত রইল। জীবনটাকে অন্য খাতে বওয়াবে বলে ও কষ্ট করল না পরীক্ষা টরীক্ষার। ভেবেছিল সব পাসের ওপরে এই পাস। বিবাহ।
একদিন কাজরী বাড়িতে ঢোকার মুখে নিচের সিঁড়ির পাশে একটা ছোট ভিজে সরু হয়ে যাওয়া বেড়ালবাচ্চা পেল। চিঁ চিঁ আওয়াজ বেরুচ্ছে গলা দিয়ে। বস্তির বাচ্চাগুলো বলল, মা হারা বাচ্চা। মা ফেলে দিয়ে গেছে। চলে গেছে। সচরাচর যায় না। বোধহয় বাচ্চাটার কোনো অসুখ ছিল।
মায়েরা যখন বোঝে বাচ্চা আর বাঁচবে না। বেড়াল মায়েরা। তখন ফেলে চলে যায়। ত্যাগ করে।
বাচ্চাটাকে কাদামাখা, টিংটিং ল্যাজ, অনেক চেঁচিয়ে ক্লান্ত অবসন্ন, নিয়ে এসেছিল ফ্ল্যাটে।
সঙ্গে সঙ্গে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল ওর পিটপিটে শাশুড়ি। বাড়িতে ঢোকাতে দেয়নি। ছি ছি, রাস্তা থেকে কোন আক্কেলে বেড়ালছানা তুলে আনছ। ছাইভস্মের এঁটোকাঁটার গাদার মধ্যে ছিল। গায়ে গন্ধ। পোকা। হেগেমুতে একশা করবে।
বাড়িতে কখনো কোনো পোষা পাখি খরগোশ কুকুর বেড়াল রাখেনি কখনো ওরা। ওর বর, শাশুড়ি, জন্তু দেখলেই বলে দূর দূর, ছাই ছাই।
সারা সময়টা কাজরী ওর কোলে একটা খবরের কাগজ পেতে ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়িতেই বসেছিল বাচ্চাটাকে নিয়ে। দুধ চেয়েছিল শাশুড়ির কাছে রান্নাঘর থেকে। মুখ অন্ধকার করে, নাক সিঁটকে শাশুড়ি বলেছিলেন এক ফোঁটা কিছু খাওয়াতে দেব না। আজ এই করে ছুঁচ হয়ে ঢুকে তুমি ফাল হয়ে বেরুবে। কাল দেখব বাড়িতে নড়াচড়ার জায়গা নেই। যেদিন তোমাকে দেখতে গেছিলাম বাবা গো আজও অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে ভাবলে। সারা বাড়িতে বেড়ালের পেচ্ছাপ আর পায়খানার গন্ধ। ওই বাড়ির মেয়ে তুমি। তোমার মায়ের কোনো আক্কেল ছিল না। এত্ত বেড়াল পুষত।
সেদিন ওর কোলেই চিঁ চিঁ করে কাঁদতে কাঁদতে মরে গিয়েছিল বাচ্চাটা। ওকে নিচে নেমে ছাইয়ের গাদার পাশে অল্প মাটিতে গোর দিয়েছিল ও, বস্তির বাচ্চাগুলোর সঙ্গে মিলে।
ফিরে সোজা বাথরুমে ঢুকেছিল, দরজা খুলে ওকে যে ঢুকতে দিয়েছিলেন ওর শাশুড়ি এই বড় ভাগ্যি।
কাপড় কেচে, গরম জল সাবানে স্নান করে শ্যাম্পু করে বেরিয়েছিল একবারে।
এখনও সে গল্প ওর দোষাবলির একটি বিশিষ্ট কাহিনি হয়ে শ্বশুরবাড়ির মুখে মুখে ফেরে।
রাত্রে ওর বর ফিরতেই পাঁচকাহন করে সে গল্প প্রচারিত হয়েছিল।
ওরা রবীন্দ্রনাথ পড়া, দেয়ালে স্বামীজি আর শ্রী অরবিন্দের ছবি ঝোলানো বাড়ি। শাশুড়ি কলেজে ফিলজফি পাস করে সংসারের সব বিষয়ে মত দিয়েছেন পণ্ডিতের মতো। এমনকি খাদ্যের আয়রন ক্যালসিয়াম ভিটামিন নিয়ে ওঁর বক্তব্য আছে।
এ হেন শিক্ষিতার শুধু একটা জিনিসেই না। বাড়িতে জন্তুজানোয়ার আনা। কী গন্ধ কী নোংরা কী ঘেন্না মা গো!
ওর জীবনে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ার আওয়াজ নেই কোথাও। বিয়ে ভেঙে যায়নি কাজরীর। পেছনে আঠাকাগজ মারা কাচের মতো চিড় খেয়েও টিকে আছে। লেগে আছে।
আর সে, স্টকার হয়ে গেছে।
ঠুন ঠুন শব্দ করে কাজরীর ফোন হঠাৎ নড়ে উঠল। অচেনা নম্বর। কাজরীর পিঠ টান হয়ে গেল।
হ্যালো, কাজরী!
ফোনে একটা চাপা গলায় কথা বলে উঠল একটা অচেনা গলা। কাজরী বারান্দায় গিয়ে সেই ফোন ধরল। নতুন কথা শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে যে আজ, আর আজই নতুন কেউ ফোন করেছে।
কে? গলাটা নিজের কনট্রোলে নেই।
আমি আঁধার রাতের একলা পাগল।
চমকে ওঠে কাজরী। হাত থেকে প্রায় পড়ে যায় যন্ত্রটা।
ফেসবুকে ইনবক্সে এই লোকটার সঙ্গেই তার চ্যাট হয় সমস্ত রাত্রি জুড়ে প্রায়। এ যে পুরুষ, সত্যিই পুরুষ, তাও ভালো করে বুঝত না কাজরী প্রথমে। বেড়ালের ছবি দিয়ে প্রোফাইল করেছে। অসংখ্য বেড়াল পোষে। কে জানে হয়তো সে জন্যেই কাজরীর টান হচ্ছিল প্রোফাইলটার প্রতি। তারপর কবে যেন ইনবক্সে কথা শুরু হলো।
হাই, কেমন আছ?
প্রথমেই আছ! তুমি করে বলছে!
আমি ঠিক। আপনি?
আপনি কেন? আমরা বন্ধু না নাকি?
হ্যাঁ তো বন্ধু। কথা ঘোরাতে চায় কাজরী। ওর বুকের ভেতরের লাফ দিয়ে পড়া আওয়াজখানা এবার বাইরেও শোনা যাবে তো! আচ্ছা, আপনি খুব বেড়াল কুকুরপ্রেমী, না?
হ্যাঁ তো। আমার রাস্তায় ৩৭টা বেড়াল খায় রোজ। ৫টা পথকুকুরকে পালি। তুমি বেড়াল ভালোবাস?
হ্যাঁ বাসি।
বেড়ালরা খুব আদুরে হয়, তাই না? সুখ পেলে গলায় ঘড়ঘড় করে। পৃথিবীতে মেয়েরা আর বেড়ালরাই সবচেয়ে খতরনাক গো!
বোঝাই যাচ্ছিল চ্যাট থেকে, এ পুরুষ। যেভাবে চ্যাট গড়িয়ে গেছে আশ্লেষের দিকে...অব্যর্থভাবে টেনেছে সেই একলা পাগল। ক্রমশ বেড়াল কুকুর থেকে নেশায় উঠে গেছে ওদের গল্পগাছা।
ওকেও স্টক করত কাজরী। স্টক করে করে একদিন পেয়েছে বেড়াল কোলে ওর ঝুঁকে পড়া ছবি। পিঠের রেখাগুলো বলে দিয়েছে ওকে বাহাদুর এক প্রেমিক এই ছেলে।
একদিন ও মইয়ে চড়ে কার্নিশ থেকে বেড়াল উদ্ধারের গল্প লিখেছিল। সেই দিনের ইনবক্সে কাজরীর ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছিল।
কবে, কে জানে, ভুলেও গেছিল। এতদিন পর লোকটা ফোন করল!
হঠাৎ নম্বরটাতে ডায়াল করে লোকটা ভার্চুয়ালের গা ছমছমানি থেকে দগদগে জীবনের সত্যিকারের একটা সেতু জুড়ে দিল যেন। এতদিন যা ছিল ভার্চুয়াল, আজ কানে শোনা গলাটা ওর বোধকে আচ্ছন্ন করে। হাত পা শিথিল হয়ে যায়। দেখা হলে, দেখা হলেও কি এরকমই হতো?
সত্যি ওকে কেমন দেখতে? এবার একটা ছবি চাইবে। বেড়াল কুকুরের ছবি বা নিছক পিঠ। এতে চলবে না। আর।
সাত.
প্রধান আকার পায় গ্রামে ফিরলে।
বাস এসে তাকে উগরে দেয় গাছতলার মোড়ে। মোড়ের মুখে জটলা। পানসিগারেটের দোকান। সেখানে মাঝে মাঝে ফোনে ফোনে কুড়ি টাকায় গরম ছবিও ভরে নেয় মানুষ। গরম ছবির কাঁপুনিতে নিজেরা কাঁপে। সেখানে খাবার দোকান আছে। মবিলে ভাজা কচুরি। ঘন লাল রং ঢালা আলুর দম। খুব মিষ্টি জিলিপি, সঙ্গে ফ্রি অনেক মাছি।
চিনিতে আটকে মরে থাকা মাছি আর পিঁপড়ের মতো মানুষ এখন ভাইব্রেশন মোডে নীল ছবি দেখছে। গ্রামে গ্রামে, মফস্বলে শহরে। গ্রাম মফস্বল শহর আর আলাদা নেই। ঘন ঘন মোবাইল টাওয়ার। ভালো ফোনের জন্য ভাই ভাইকে খুন করে ফেলেছে প্রধানের পাশের গাঁয়ে।
প্রধান তবু আকার পায় গ্রামে ফিরলেই। সারা দিন শহরে সে যেন কাগজের মতো ফিনফিনে থাকে। বাস স্টপ থেকে সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল ফেরত নেয় প্রধান। নিয়ে প্যাডেলে চাপ দিয়ে যেই গভীরে যায়, ক্রমশ সবুজ থেকে গাঢ় সবুজের দিকে যায়, ওর মন ওপর দিকে ওঠে। শরীরে বল পায়।
ওর শরীর থেকে ভার নামে। সারা দিনের পেশেন্ট ঠ্যালার ভার। ছাই ছাই ধূসর ইউনিফর্ম পরে থাকা প্রধানের ইউনিফর্ম এখন ভাঁজ করে তার ছোট কালো চৌকো কাপড়ের ব্যাগে ঠোসা।
আজ ডাক্তারবাবুর বাড়িতেও কাজ ছিল। লোক খাবে। ডাক্তারগিন্নি আরোগ্যবিধান থেকে একটা কোনো লোক চেয়েছিল তাই প্রধানকেই ডাকা হয়েছিল। ডাক্তার প্রধানের সবকটা গুণ জানেন। আগে তো আরও বেশি বেশি করে এইসব কাজে ডাক পড়ত প্রধানের। ভীষণ বিচক্ষণ বলে ওর সুনাম ছিল।
আজও গেল ও চকচকে করে সাজানো বাড়িতে। পুরনো, বাপের আমলের সব আসবাব ফেলে ম্যাডাম নতুন আসবাবে ঘর সাজিয়েছে। সেইসব নতুনের মধ্যে নানা গোলমাল থাকে। প্রধানকে টেনে, ঠেলে, গুছিয়ে ঘরখানা আরও জমকদার করতে হবে।
ও প্রধান। ওদিকটা দেখ। ওয়াশিং মেশিনটার পায়া লক হচ্ছে না।
ভেঙে গেছে লকটা ম্যাডাম।
কাগজ দিয়ে ঠুসে দাও। বাথরুমে রাখবে। কোণায়। অ্যালুমিনিয়াম সিঁড়িটার পাশে। অ্যালুমিনিয়াম সিঁড়ি ঠিক করে ঢাকো। গেস্ট বাথরুমে গেলে যেন অড না লাগে।
ম্যাডাম কাপড় কাচার সময়ে ওয়াশিং মেশিনের নাচন কোদন দেখছিল। সড়সড় করে সরে আসা ওয়াশিং মেশিনের দিকে রোষকষায়িত দৃষ্টি দিচ্ছিল।
প্রধানের হাসি পাচ্ছিল। গাঁয়ে বাছুর ধরে গোমাতার দুধ দুয়েছে যারা, গরুর চাঁট খেয়েছে যারা, তাদের আবার ওয়াশিং মেশিনের হাঁটাহাঁটিতে ভয়!
আজ ফাল্গুনের প্রথম বৃষ্টি। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিগুলো প্রধানের গায়ে এসে পড়ছিল। আরাম, ভালোবাসা। সুখ। এসব শব্দ কতদিন ভাবেই না। মাথার ভেতরে এসব শব্দ নেই প্রধানের। কষ্ট করে ভাবনায় আনতে হয় এসব শব্দ।
আজ আসছিল। এ বছর যেন ঝেঁপে পলাশ শিমুল ফুটেছে। গাছতলার মোড় থেকে প্রধানের গ্রাম বেশিদূর না। তিন কিলোমিটারের ভেতরে। সরু রাস্তায় চিড়চিড় শব্দ করে সাইকেল ছুটেছে। প্রধান চোখ তুলে দুপাশের ফুল দেখছিল। অন্যদিন সন্ধের সময়েও যেন নিয়নবাতির মতো জ্বলে পলাশ শিমুল।
লোকে আজকাল দিনের বেলায় চড়া রোদ্দুরে পলাশের ছবি তুলতে শহর থেকে আসছে। ছোট পানবিড়ির দোকানে এসব শুনতে পায়। আজও শুনে এসেছে একদল শহুরে বাবুর কাণ্ড। ভালো ভালো ক্যামেরা নিয়ে পলাশ শিমুল তুলে নিয়ে যেতে এসে বৃষ্টিতে পড়েছে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু। ছাগলতাড়ানি বিষ্টিতে বাবুগুলো সব ছাগল হয়ে গেসে গো! হো হো হো।
শীতের খরা কেটে গেল তবে! এই বৃষ্টি গাছের ঘাসের গায়ের সব ধুলো ধুয়ে দেবে। বাড়ি ফিরেই দেখল বউ গা মুড়ছে।
কী হলো, আবার জ্বর? বুকের মধ্যে কান্না আর দুঃখের বাতাস আসে। মায়ের ছোট এক চিলতে ঘরে আলো দেয়া হয়নি কেন?
জ্বর না। মনটা ভালো লাগে না। মাথাটাও ঘুরতেছে।
একটা ইলেকট্রিক বাতি আছে এই গোটা তল্লাটে। তার চুইয়ে আসা আলোতে প্রধান দেখল বউ কাঁথা মাদুর গুটিয়ে উঠে পড়ল। বারান্দায় ঢাকা দিয়ে রান্নার জায়গা করা। সেখানে গিয়ে নিবু আঁচে বসানো রাতের রান্নার হাঁড়ি নামাল।
এবার সবজি কুটবে, রাঁধবে। তার আগে চা করে দেবে প্রধানকে।
এখনও ভালো করে চা করতে পারো না!
সামান্য স্নেহ মেশানো বকা দিল প্রধান। আজ তার কেমন একটা করছে বুকটা। হয়তো এসবই এই অকাল বর্ষণের ফল। পাঁচটা টাকা খরচা করে মামা ভুজিয়ার একটা প্যাকেট কিনে এনেছে। ঘরে কী আছে রে? মুড়ি নেই, না? তবে একটু চিড়ে নেড়ে দে আমায়। বউকে নির্দেশ দিয়ে কলতলায় হাত পা ধুচ্ছিল প্রধান।
বউ শুকনো খোলায় চিড়ে দিয়ে নাড়ছিল, ওপর থেকে ছোট শিশি থেকে চুইয়ে দিচ্ছিল সামান্য তেল। একটা শুকনো লংকা খটখটে করে ভেজে দিতেই হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে হাঁচতে শুরু করে দিল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ভাজা মরিচের তীব্র সুগন্ধ।
কদিন ধরে যে তোর বমিটমি হচ্ছিল সেসব কমেছে?
লজ্জা পেয়ে আড়ষ্ট পায়ে বউ এসে প্রধানের সামনে একটা উঁচু কানার খোরার ভেতরে ভাজা চিড়ে রাখল। প্রধান কালো ব্যাগের ভেতর থেকে বার করে আনল ভুজিয়ার প্যাকেট। চিলিমিলি ছিঁড়তেই সাদা চিড়ের ওপর ছড়িয়ে পড়ল হলুদ ভুজিয়া।
নে তুইও একটু নিস। অনেকটাই তো আছে।
একটা পেয়ালায় চা ঢেলে, অন্য আরেকটা গেলাসে অর্ধেক চা নিয়ে বউ বসল তার মুখোমুখি। একটু আড় করে।
মুখ নামানো।
হঠাৎ প্রধানের মাথার ভেতরে বিদ্যুৎ চমকাল। সরু পিচ রাস্তা ভেঙে যেন সাইকেলটা এসে পড়ল কাদা মাখা রাস্তায়। এমেনরেগা ইস্কিমের রাস্তা পাকা করার প্রকল্পটা অর্ধেক অবধি পাকা করেছে, তারপর কাদা আর কাদা।
বউটা পোয়াতি তবে! ও যখন বসল, কেমন কষ্ট করে, সাবধানে। পা টিপে টিপে হাঁটছে উঠোনে। বৃষ্টিপিছল উঠোন পেরিয়ে এসে উঠল যখন প্রধানের কাছে। সবকিছুর স্পষ্ট মানে হয়ে উঠল।
সরু রাস্তায় সাইকেল চালাতে চালাতে আকাশ ভাঙা বিদ্যুৎ দেখেছিল প্রধান। এখনও বিদ্যুৎ দেখল। মাথার ভেতরে। তবে? তবে? সারা দিন বাড়িতে থাকে না। সেই সময়ে বউটা...
তারপর চিড়ে আর ভুজিয়ার সঙ্গে এক ঢোক চা গেল গলায়। ভেতরটা তৃপ্তিতে শান্ত, সমাহিত হয়ে গেল প্রধানের। সমস্ত সন্দেহকে ও চিড়া ভাজার সঙ্গে চায়ের মিষ্টি দুধেলা গন্ধ দিয়ে মেরে ফেলল। ওর মন অন্যরকম হয়ে গেল।
দুশশালা, যে আরোগ্যবিধানে ও জীবনের মরা মরা কুড়ি বছর দিয়ে দিল, জ্যান্ত জ্যান্ত এই বনমালীপুর গ্রামের থেকে বেরিয়ে লাশ হতে হতে শহরে গিয়ে গিয়ে যে ডায়াগনস্টিকের দোরে নিজের জান কবুল করে রাখল, সে ব্যাটা যে ঠিক, কে গ্যারান্টি দিয়েছে? ওদের সব ভুল, ওদের রিপোর্ট ভুল, ওদের যন্তরপাতি ভুল। শুধু একটা টাকা করার মেশিন ওটা। শরীরের থেকে বেরুনো একটুখানি তরল পদার্থ নিয়ে কাচের তলায় ফেলেই ওরা যেন পৃথিবীর সব জেনে বসে আছে।
কিসসু জানে না ওরা। কিসসু বোঝে না। বড় করে শ্বাস নেয় প্রধান।
এই সেই দিন। যার জন্য জীবনটা তেষ্টায় মরে ছিল।
ঘরে একটা নতুন প্রাণ আসুক।
ঘরের ছাতের দিকে তাকাল প্রধান। আকাশে ঈশ্বর আছেন কি নেই জানে না, তবে লতিয়ে ওঠা লাউডগার মুখের কাছে একটা মাঝারি লাউয়ের আকার দেখতে পেল সে। অলৌকিক তো জগতে আছে। সন্দেহ করবে না কারুকে প্রধান। পৃথিবীতে সুখ শান্তি নেমে আসুক।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ভেতরে এক মুঠো চিড়ে আর ভুজিয়া মাখা তুলে বউকে হাতে দিল প্রধান। জোর করল। খা না, খা! ভালো করে খাওয়াদাওয়া করবি বউ।
আট.
তরুণ এসে আর্ট মেরে দাঁড়াল। নিশি ম্যাম, নাটু নাটু দেখেছিলেন কাল? দীপিকা কেমন অস্কার মাতালো, দেখলেন?
লার্জার দ্যান লাইফ।
ধুস। পাশ থেকে সহকর্মী চিত্রক বলে উঠল। যা তা একদম। ফালতু গান ফালতু সিনেমা। ভাবতে পারো! অস্কারের স্ট্যান্ডার্ড কি পড়ে গেছে?
হুঁ, স্টিরিওটাইপড। ভীষণ অবাস্তব। কিন্তু মজা আছে ভাই!
নাটু নাটু গানটায় আছেটা কী? একটা চনমনে তালবাদ্য শুধু।
আরে ভাই, এই কালচারই এখন বিশ্বের লোকে খাচ্ছে।
বিশ্ব আসলে কীই বা? একটা বাজার শুধু। বাজার পণ্য বোঝে। বোঝে বিক্রিবাট্টা। বোঝে কিছুটা, হাওয়া কোনদিকে বইছে। তার ওপরেই ডিপেন্ড করে, কে কাকে কিনবে। কে কাকে ভাইরাল করবে।
নিশি মন দিয়ে ভাউচার কাটছিল। টাইপ করছিল কম্পিউটারে, হিসেব মেলাচ্ছিল ধরে ধরে। ওর এসব শোনার সময় নেই। তরুণকে পাত্তা না দেয়াটাই যথাযথ। যুক্তিযুক্ত। লোকটা গায়ে পড়া।
নিশি নিজের এক্সট্রা ইনকাম নিয়ে বেশি ভাবে আজকাল। প্রেম নিয়ে নয়। জানে পে স্লিপ চেক করবে অরিন্দম। ও ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা স্যালারি ক্যাশে নিচ্ছে। কিছুটা ইপিএফে কাটিয়ে ফেলছে। ছেলের ভবিষ্যৎ দেখতে হবে। নিশির টাকা চাই। নিজের টাকা। যে টাকায় ভাগ বসাবে না কেউ। আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয় পরকিয়া করার মতোই সুখ এতে।
এই তো সেদিন অফিসের টাইম চুরি করে ব্যাংকে গেল। অচেনা ব্যাংক। ডাক্তার ব্যানার্জির রেফারেন্সে একটা অ্যাকাউন্ট খুলল নিশি। এখন মাঝে মাঝে ওটাতে টাকা জমা দিয়ে আসে। টুং টুং শব্দ করে মেসেজ ঢোকে ফোনে। নিশি কেঁপে ওঠে। অবৈধ প্রেমিকের সংকেত বার্তার মতো ওই নতুন ব্যাংকের টাকা ঢোকার মেসেজে কাঁপন ধরে বুকে। সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট করে দেয়।
উঠে গিয়ে, কুলার থেকে জল খেল নিশি। প্লাস্টিকের কাপ টেনে নিল হোল্ডার থেকে। নিশির গলা উঁচু করে জল খাওয়ার দৃশ্য দূর থেকে দেখল তরুণ। ইচ্ছে হলো ছবি তুলে রাখে একটা। তোলা হলো না।
প্রধান এসে দাঁড়িয়েছে।
কিছু বলবে, প্রধান?
নিশি অবাক হয়ে দেখল, প্রধানের মুখ চোখ পালটে গেছে। কোথায় যেন আলো একটা। শুকিয়ে যাওয়া মাথা মুখ, টান ধরা কুঁচকোনো চামড়ার ভেতর থেকে আবার উঁকি দিচ্ছে নতুন বিস্ময় আনন্দের বৈভব। বেশ চমকে দেবার মতো পরিবর্তন।
কালো চাল নেবেন ম্যাডাম?
কালো চাল?
প্রধান একটা ছোট কাগজ দেয় নিশির হাতে। একটা এনজিও। প্রধানের জেলায়, ওর বাড়ির কাছেই এদের একটা সেন্টার হয়েছে। ওরা ঢেঁকি ছাঁটা কালো চাল পাঠাচ্ছে অর্ডারের ভিত্তিতে। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ চাল। সুগার রুগিরাও খেতে পারে।
প্রধানের চোখ চকচক করে ওঠে। ডাক্তারবাবু নিয়েছেন। বললেন দারুণ উপকার। ম্যাডামের তো সুগার আছে। এটা খেয়ে প্রেশার সুগার সব কমে যায়। আপনিও নিন।
দামের ট্যাগ দেখে নিশি ফেরত দিয়ে দেয় কাগজটা। চালটা অল্প ট্রাই করলে হতো প্রধান। কিন্তু দাম বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা। ডাক্তারবাবুকে বলেছি। যদি ওয়েটিং রুমে একটা পোস্টার লাগাতে দেন। এনজিওর।
তুমি কি খামার আমার-এর এজেন্সি ধরলে নাকি প্রধান! হো হো করে হাসে নিশি। নিজের ছোট প্রিন্টের ইউনিফর্ম শাড়ির আঁচল তুলে মুখ মোছে। ভালো, ভালো, একটা আলাদা জীবন। একটা বিজনেস।
প্রধানের ছোট ছোট চোখের ভেতর আলো। ওর দুচোখের কোণে কাদাখোঁচা পাখির পদচিহ্ন। ও যেন কত নতুন কাজে আবার হাত দেবে। দেখে ভালো লাগে নিশির। নিজের মনের মধ্যেও শিরশির করে। নিজের কাউন্টারে ফিরে এসে এবার কাজ গুছিয়ে, কম্পিউটার শাট ডাউন করে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়ে।
তরুণ বেরুবার মুখে বলে, আমার এক বন্ধু দারুণ ক্যামেরা দিচ্ছে একটা। খুব সস্তায় পাচ্ছি। আপনার কটা ভালো ছবি তুলে দেব একদিন। অফ ডে তো শনিবার? হর্টিকালচারে যাবেন?
আরে বাস। এ তো খুল্লম খুল্লা লাইনবাজি শুরু করেছে এবার। নিশি হেসে ফেলে। ফুল আমার ভালো লাগে না তরুণ। তার চেয়ে ফুলকপি ভালো। রান্না করা যায়।
নয়.
আব্বাস খুব কাজের। অফিসসুদ্ধ লোক জানে।
প্রথমে অনলাইন অফিস হচ্ছিল। বস ডেকে নিয়েছিল তারপর। সবার মাথার ওপর মুখোমুখি বসে ছড়ি না ঘোরালে বসটার তো প্রাণে জল আসছিল না, না?
তখন জুমে মিটিং চলত রাত্তির অবধি। ক্লায়েন্ট কলে থাকত বলে আব্বাস এড়িয়ে যেত। তাও যখন তখন মিটিং।
এখন সকালবেলা অফিস যাও। অফিসে একবার সকালে মিটিং, একবার সন্ধেতে। আব্বাসের মতো ধুরন্ধর, তুখোড়, হুনহার ছেলেকে কে ঝাড়বে, বকবে? তবু বসটা খেঁচাবে। ঘুরিয়ে কথা শোনাবে।
একটা ক্লায়েন্ট আব্বাসের নামে কোত্থাও কিচ্ছু কমপ্লেন না করলেও, ঐ যে, ম্যাদামারা, ন্যাকা সাগরটা। সেই ভিজে বেড়ালটা গিয়ে আব্বাসের নামে লাগিয়েছে। ওর আন্ডারে কাজ করবে না বলেছে সুপ্রতিম বসুকে। বলেছে, নেট স্লো বলে আব্বাস স্যার আমার ধুরধুটি নেড়ে দিত, যা তা গালাগাল দিত। আব্বাস স্যার ভীষণ খতরনাক। ক্লায়েন্টদেরও ছেড়ে কথা কয় না।
সাগরের বডি ল্যাংগুয়েজ দেখলেই রাগ হয় আব্বাসের আজকাল। দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। দিক ওকে পালটে। এমন অধস্তন চাই না। কামচোর। যেন সারাক্ষণ মা চামচ দিয়ে দুধ খাইয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে।
পড়ত আব্বাসের মতো অবস্থায়, বুঝত।
সেই ছোট্টবেলা থেকে একেবারে শহর থেকে একশ মাইল দূরের গ্রামে নাক চোখ বন্ধ করে পড়েছে। তারপর মফস্বল শহরে এসে আইটির ট্রেনিং নেয়া। প্রেমে পড়ে গেল সহপাঠিনী। রিয়া রায়।
ব্যস। সবর্ণ হিন্দুদের ইজ্জতের সেই পুরনো ব্যাপার। রিয়ার বাবা লেঠেল লাগিয়েছিল। সুপারি দিয়েছিল আব্বাসকে খুন করার। রিয়াটাও এমনি হাঁদা, কেঁদে কঁকিয়ে অস্থির। তাকে তো বাড়িতেই বন্দি করে দিল বাবা। কদিন পরে রিয়াকে নাকি কীসব পড়াশুনোর নামে মুম্বাই পাঠিয়ে দিয়েছিল।
আব্বাস সে শহরের পিজি থেকে বোরিয়া বিস্তারা বেঁধে সোজা লম্বা। তারপর কত জল বয়ে গেল গঙ্গা পদ্মায়। পালিয়ে বাঁচা আব্বাস এ বিশাল রাজধানী শহরে এসে এখন সেঁধিয়ে গেছে। শুধু নিজের কাজের আর কব্জির জোরে কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছে। ফ্ল্যাট কিনেছে। বিয়ে করেছে। আম্মাকে নিয়ে এসেছে গ্রাম থেকে। আব্বু কবেই চলে গেছে মাটিতে।
এই বিল্ডার অন্তত অত কথা জিজ্ঞেস করেনি। নাম জাত পাত বিশ্বাস অবিশ্বাস সব এখন বড় হয়ে গেছে মানুষের। দেয়ালের পর দেয়াল উঠিয়ে শান্তি নেই। ঘরে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে অন্ধকার। এ মাঝারি বড় বিল্ডার। তবে হ্যাঁ। বড় পাড়ার বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টগুলোর বৃহৎ বিল্ডারদের তো আজকাল নিচে শিবমন্দির, মাথায় ত্রিশূল। সদর্পে বাড়িগুলোর গায়ে স্বস্তিকচিহ্ন। বাঙালি হোক, আর মাড়োয়ারি, লোকগুলো উপায় করে বাড়ি বানাচ্ছে, কিন্তু নিজের হাতের জোরের ওপর ভরসা নেই। মানুষের এই জিনিস দরকার। এই বিশ্বাস। যে পুজো আচ্চা করলে, অঙ্গে পাথর টাথর ধারণ করলে গ্রহ রত্ন দেব দেবী শান্ত করলে ভালো হয় সব। তাদের বছরে কয়েকদিন গুরুর নামে ভান্ডারা আর এই দিবস সেই দিবস, হোলি থেকে শুরু করে দীপাবলির সব উৎসবেই প্যান্ডেল হবে। মাইকে গান বাজিয়ে ভক্তি উদযাপন হবে। তবে সে এ পাড়াতে বস্তিতেও হয়। এ পাড়াতেও প্রচুর উৎসব পালনে ঘটা। পুরো গলি বন্ধ করে মাইক বাজিয়ে শিবরাত্রি গণেশপুজো হনুমান চালিশা। বস্তির ঘোমটা দেয়া বউ থেকে বড়লোকি দেখানো শর্ট স্কার্টের মেয়ে কারুর কোনো খামতি নেই শিবের মাথায় জল ঢালায়।
এসব ফ্ল্যাটের বিল্ডাররা খুব সরু চোখে তোমার ক্রেডেনশিয়াল দেখবে। তোমার বিশ্বাস তোমার ধর্ম, এমনকি তুমি কী খাও তাই নিয়েও বিশাল চর্চা। কিন্তু অন্য সময়ে কেউ কারুর না। কেউ মরে থাকলেও পচে গন্ধ না বেরুনো পর্যন্ত খবর খোঁজ পাবে না কেউ। এমনকি, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে লিফটে করে তাকে নামিয়ে হাসপাতালে নেবার সময়ে আর পাঁচটা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে যাবে না।
আব্বাস ছোটবেলায় দেখেছে পাড়াসুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ে কী আদর করে নতুন নিকে করা বউকে ঘরে তোলা হতো আর কত শ্রদ্ধা সম্মানের সঙ্গে আব্বুর জনাজা বেরিয়েছিল।
অন্য বাড়ির বউটাকে এক ঝলক দেখে আব্বাস গলা নামিয়ে নিয়েছিল। নিজেকে জানান দেয়ার ইচ্ছেটা মিইয়ে গিয়েছিল সেদিন। ওর খুব হুনহার মাথা পড়ে নিয়েছিল এই নীরবতা খানখান করার কোনো মানে নেই। কেউ কারও কথা শোনে না যেখানে সেখানে ক্লায়েন্ট কলে কে কী বলছে কেউ শুনবে না।
তাও সেদিন ওর মনে হয়েছিল একটা পৌরুষের দাপট নিয়ে ও ঘুরে ঘুরে বাইরে কথা বলে, সে পৌরুষে কোনো মেয়ের ভেতরে ঢেউ উঠুক ও চায় না।
সাগর আর সুপ্রতিম মিলে অকথ্য আকছার নোংরামি করছে অফিসে আব্বাসের সঙ্গে। আব্বাস এখানেও নিজের ফলা বের করতে চায় না। ভিক্ষে চাই না বাবু, কুকুর সামলান। আমি কারুর থ্রেট নই। হতে চাই না। আমি চেঁচাই, গালি দিই, সবটাই যুগের নিয়ম মেনে। কিন্তু বাইরে থেকে কেউ দেখে না বুঝুক আমি তার চাকরি খেয়ে নিতে চাই।
আমি উন্নতি করব। নিজের হিসেবে। নিজের ইচ্ছেতে। নিজের কব্জির জোরে। আমার মতো ভালো, দ্রুত, নিখুঁত কাজ নামাতে কেউ পারে না। কম্পিউটার আমার দাস। আমার হাতে কথা বলে অ্যাপ, প্রোগ্রামেরা। ট্যালি থেকে স্যাপ, আমি মসৃণ চলাচল করব। কারুর সাধ্যি থাকে তো আমাকে থামাক। আমাকে চেপে দিক।
পারবি না, কেউ পারবি না তোরা। গাঁয়ে আমি ফুটবল খেলতাম। কাদা মাখা শরীরে বল ড্রিবল করে নিখুঁত গোলের দিকে নিয়ে যেতে পারি।
দশ.
কাজরীকে একলা পাগল ফোন করে শেষ পর্যন্ত টাকাই চাইল। পৃথিবীর সব সম্পর্কের শেষ টাকায় হয়।
কাজরী জানত ভার্চুয়ালের লোক কখনো সত্যিকারের সম্পর্কে আসতে চায় না। এলো যে, কারণ ছিল তো। টাকা চাওয়ার কারণ।
বুঝেও কাজরী কিছু করতে পারল না। কেননা ওর রাগ ছিল। নিজের শ্বশুরবাড়ির প্রতি রাগ।
বেড়াল ঢুকতে দিল না ওরা এ বাড়িতে। কাজরীর কোলে মরে যাওয়া বেড়ালবাচ্চাটার চোখদুটো ভুলতে পারে না কাজরী আজও।
তাই ওর বেড়াল কুকুর পালনের খরচা দিচ্ছে কিছু কিছু কাজরী।
একলা পাগলের নাম সুবীর দাস। একলা থাকে। বাড়ির বাইরে অনাথ পশুদের খাবার দেয়। রোজ দুকিলো চালের ভাত রাঁধে। বাজার থেকে নিয়ে আসে ছাঁট মাছ, মাংস। সেই দিয়ে ওদের রেঁধে খাওয়ায়। কেরোসিন স্টোভে। এসব নিয়ে ওর মাসে যা খরচ, নিজের ছোট চাকরি থেকে ওঠে না।
কাজরী নিজের জমানো টাকা থেকে দিচ্ছে। বরের টাকা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। শাশুড়ির বাজার খরচের টাকাও তো কোথায় রাখা থাকে সে জানে। ওরা টের পাবে না। টের পেলেই বা কী। নিজের শাড়ি গয়না কেনার কথা বলবে কাজরী।
একদিন শপিংয়ের নামে বেরিয়ে বুকের উথালপাথাল নিয়ে এবার কাজরী একদিন পৌঁছে যাবে একলা পাগলের বাড়িতেও। ওখানেই...ওই ছোট তক্তপোষেই, বাহাদুর ছেলের কোলে ধরা দেবে নিজেকে। সমস্ত বিছানাময় বেড়ালের লোম, বেড়ালের হিসির গন্ধ...ঠিক ছোটবেলার মতো...ও পাবে। সুখ পাবে। না না সুখ না। আনন্দ। আনন্দ।
পুঁটো ভয় খেয়ে গেছিল। ভয় খেয়ে পেট ভরে গেছে। কিছু মুখে তুলছিল না। ভাত সাম্বার দিয়েছিল ওদের। ভাইজাগ স্টেশনে।
রঘু বিড়বিড় করে বলছিল, আরে চল না, চল। এ বান্দাকে তো চেনে না। আমার ভয়ডর নেই। পারলেই পালাব তুই আর আমি। বন্দি করে রাখা আমাকে অত সোজা না। পালাব, বুঝলি?
রেলগাড়ি আবার চলছিল। দুলুনিতে রঘুর ঘুম আসছিল। পুঁটোর আঁতে ভয় বসে গিয়েছে। বিরাশি সিক্কার চড়টা ভুলতে পারছে না পুঁটো। পাতলা পায়খানা হচ্ছে শুধু। বারে বারে বাথরুম যাচ্ছে।
বিরু প্রতিবার ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে বসাচ্ছিল। প্রতিবার দরজা ধরে দাঁড়াচ্ছিল টয়লেটের বাইরে। কখন কী করে বসে ছেলেটা। খোলা দরজা দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফটাফ না দেয়! বোকা হাবা ক্যাবলা কোথাকার। মাথায় গোবর পোরা নাকি কে জানে।
বোতলে জল ট্রেনের কল থেকেই ভরে ভরে এনে দিচ্ছে বিরু। প্রতিবার একটা শুঁটকো লোকের সঙ্গে গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে যাচ্ছে। আনকা নাকি? বিরক্তিকর!
এসে পুঁটোকে বলছিল বারবার বিরু, জল খা রে ব্যাটা। আরে ঘাবড়াস না। মাঝে মাঝে আমি আমার ফোন থেকে কথা বলিয়ে দেব মায়ের সাথে। পৌঁছে একবারে পৌঁছ সংবাদ দিবি তো? নাকি? এখনই কীসের এত তাড়া?
পুঁটো চুপটি করে কাঠের সিটে মাথা হেলিয়ে বসে ছিল। চোখ দিয়ে গড়ানো জলের পাতলা রেখা তৈরি হয়েছে। মাঝে মাঝে জোরে নাক টানছিল। রঘু ওর পায়ের সঙ্গে নিজের পা ঠেকিয়ে রেখেছিল। মুখে কিছু বলছিল না। কী আর বলবে।
হঠাৎ দুজনেই বাইরে তাকিয়ে থ হয়ে গেল। গাছে গাছে বেগুনি ফুল ছেয়ে আছে। চোখে যেন ঘোর ঘোর লেগে গেল! মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছে। টানা যেন আলো ছড়ানো বেগুনি ফুলের চাদর পাতা পাহাড় সরে সরে যাচ্ছে চোখের ওপর থেকে।
বিরুর পেছনে, ট্রেনে, পুলিশের খোচর লেগেছিল। ওর ভাব গতিক ফোনে কথা বলা, ওর সমস্ত কাজ লক্ষ করছিল। টোটাল চোদ্দটা আন্ডার এজ ছেলে এ ট্রেনে চেন্নাই যাচ্ছে।
গতমাসেই চেন্নাইয়ের সোনার কারখানা থেকে বাইশটা আন্ডার এজকে ‘বন্ডেড লেবার’ থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। সপ্তাহখানেক হোমে রেখে, বিশেষ বগিতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এই কেসটা একই রকম। চেন্নাই অবধি সঙ্গে যাচ্ছে খোচর। বিরু জানে না।
এদের ফেরত দিতে হবে। বাবা-মার কাছে। জামবাটি ভর্তি দুধ মুড়ি আর ইশকুলের কাছে।
এইটুকুই। সুখ। আনন্দ। এইটুকুই। নিশি একটা জলের বোতল নিয়ে শোবার ঘরে আসছিল। হাতে করে বোতল আনার সময়েও ওর মনের মধ্যে একটা জিনিস কাজ করে। ভার বহন করার ধরনটা। বোতলটা এক লিটারের। ও একটু তুলে রাখা হাতে তাকে ব্যালান্স করতে করতে আসে। ধীরে ধীরে মনে হয়, শুকনো শরীরে একটা হালকা তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে। ব্যায়ামের ফলে যে তরঙ্গ আসে।
তরুণ বলেছিল, শুনবেন নিশি ম্যাডাম। গানগুলো খারাপ নয়। নাটু নাটুর সঙ্গে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করবেন। নিশি সারা দিন কে কে কীরাবানির গান শুনছে এখন। বাহুবলির গানও অনেক শুনল। ভালো বিটস। এই তালবাদ্যের সঙ্গেও চমৎকারভাবে ব্যায়াম করা যায় কিন্তু।
চারদিকে খুব কথা চলছে। নানারকম কথা। লবিং করে নাকি এই পুরস্কার এসেছে। অফিসেও চলছে এই কথা। এসব পুরস্কার পাওয়ার হিসেবটা কী? অঙ্কটা কোথায়? বল তো?
কিন্তু এলিফ্যান্ট উইস্পারারস? সেও কি লবিং? পশুপাখি। অরণ্য। মানুষ। ভারতের এশিয়ার বৃষ্টিলালিত ট্রপিকাল অরণ্যের পশু আর মানুষ জড়াজড়ি করে বাঁচছে। দুই বুড়োবুড়ি হাতিদের কানে কানে নিজের ভাষায় কথা বলে, হাতিরা ঘাড় নাড়ে, ঘণ্টা পরা মাথা দুলিয়ে সায় দেয়। শিশু হাতিদের সঙ্গে মাতৃত্বের বন্ধন গড়ে ওঠে ওদের। এও তো আমাদেরই গল্প।
নিশি শুনেছিল তামিলনাড়ুর ওই মুদুমালাইয়ের জঙ্গলে প্রতি বারো বছরে একটা বেগুনি রঙের ফুল ফোটে। সমস্ত বন পাহাড় জ্বলে যায়, স্নিগ্ধ এক বেগুনি আগুনে। সেই ফুলের শোভা দেখতে বিদেশ থেকেও লোকে আসে।
শুধু বারো বছর বাদে বাদেই ফোটে ফুলটা। ফুলটার নাম নীলকুরুঞ্জি। ছোট ছোট বেগুনি চোঙাকৃতির ফুল। নীলবেগুনির বর্ণোদ্ভাসে ভরে যাওয়া পাহাড়টাকে যেন চোখের সামনে দেখতে পায় নিশি। কোনোদিন সেখানে গিয়ে পৌঁছতে পারবে সে? মাত্র বেয়াল্লিশ বছর বয়সে তাকে বিছানা থেকে ঠেলে বের করে দিয়েছে অরিন্দম। মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে তার জীবন একটা শুকনো নৌকোর মতো হয়ে গেছে।
এ বছর নীলকুরুঞ্জি ফুটে গিয়েছে। আবার বারো বছর অপেক্ষা করতে হবে।