X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২
ঈদসংখ্যা ২০২৩

উঁকিবাজ পিতা

সালমা বাণী
১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:১১আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৩৪

মাস্টারবেশন শেখানো 
এ্যা...এ্যা...এ্যা...ক্রমাগত চিৎকার ভেসে আসছে নিচ থেকে। প্রথমে চিৎকারটা ছিল ক্ষীণ, মৃদু ও হালকা।  ক্রমেই বাড়ছে, বাড়তে বাড়তে নিচতলা থেকে ওপর পর্যন্ত যেন লাফিয়ে লাফিয়ে, দাপিয়ে দাপিয়ে উঠে আসছে। আর তাই  এখন শোনা যাচ্ছে বেশ দাপটের সঙ্গে। দূরবর্তী কোনো অজানা প্রান্ত অথবা অজানা স্থান থেকে নয়, আশপাশের কোনো বাড়িঘর থেকে নয়, একেবারে নিচতলা থেকে আসছে এই চিৎকার।

সহজে রাগারাগি চেঁচামেচি করে না খুব শান্ত স্বভাবের দীপ্ত। তবে যদি কখনো রাগ হয় তাহলে সে যে চিৎকার করে। কিন্তু সেই চিৎকারের ধরন ভিন্ন। দুবছর বয়স থেকে দীপ্তের আনন্দ, ফুর্তি, অথবা রাগ-ক্ষোভ প্রকাশের যে চিৎকার সেই চিৎকার আর আজকের গুংরে গুংরে চিৎকার দুটো চিৎকার এক নয়। এটা একেবারে ভিন্ন এক চিৎকার। এই চিৎকারের পূর্ণ অর্থ বোঝে রওশন আরা মিনু। এই চিৎকার রওশন আরা মিনুকে করে তোলে ভিরু অসহায়, অস্থির যন্ত্রণাকাতর। আজ মাস কয়েক হয়ে এলো এমন বদলে গেছে দীপ্তের চিৎকার। মিনু অবশ্য চোখ বন্ধ করে বিড়বিড়িয়ে হিসাব করে বলে—জানুয়ারি মাস থেকে এমন করছে দীপ্ত।

দীপ্ত তখন একেবারে শিশু, সবে মাত্র শিখছে এ্যা এ্যা শব্দ করা। দুলে দুলে এ্যা এ্যা এ্যা...করত। মধুর সেই কান্না উতলা করে প্রতিটি মাকে! দুচোখ ভরা কান্না নিয়ে মিনু বুকের ভেতরে জাপটে ধরত দীপ্তকে গভীর আবেগে, পরম মমতায়। বলো বলো বাবা এ্যা, এ্যা এ্যা বলো মা...মা...মাম...মাম্মা...বলো বলো...। এভাবে দীপ্তকে কথা শেখানোর সে কী নিদারুণ প্রয়াস মা রওশন আরা মিনুর। আদরে সোহাগে ভরে দিত দীপ্তর তুলতুলে দুই গাল। চুমু চুমু আর চুমুর সঙ্গে মাথা নেড়ে নেড়ে ছেলেকে আদর বোঝাত। দীপ্তের বয়সী শিশুদের তুলনায় দীপ্তের শেখা ছিল তুলনামূলক একটু ধীর ও দেরিতে। সে কারণে দীপ্তের যে কোনো অনুভূতি প্রকাশ মিনুকে করে দিত আনন্দে দিশাহারা। 

আর এখন ঠিক তার বিপরীত। এভাবে যখন দীপ্ত গোঙায় তখন রওশন আরা মিনু ছুটে পালিয়ে যায় হৃদয়ে কাঁপন ধরা ভয় আর যন্ত্রণা নিয়ে। ভীরু অপরাধীর মতো ছুটে যায় স্বামী সফিক আহমেদের কাছে। ছুটে এসে কাঁপনধরা গলায় সফিক আহমেদকে প্রায় খাঁমচে ধরে—শুনতে পাচ্ছ, যাও, যাও জলদি নিচে যাও। দীপ্তর শরীরে তাপ উঠছে, গরম উঠছে যাও, যাও, জলদি যাও।

স্ত্রীর বিরতিহীন শঙ্কা উত্তেজনায় সফিক আহমেদ কখনো ছুটে যায় নিচে ত্রস্ত পায়ে। কখনো শুধ স্ত্রীর ভয় বা শঙ্কার কারণে নয়। হয়তো নিজেই হয়ে ওঠে উদ্বিগ্ন বা উৎকণ্ঠিত। আবার কখনো স্ত্রীর ওপর হয়ে ওঠে ভয়ানক ক্ষিপ্ত বিরক্ত। আজ ছেলের চিৎকারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সফিক আহমেদ। খ্যাপাটে রাগজড়ানো কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে—এমন করছ ক্যানওওও? কী হয়েছে ছেলে চিৎকার করলে? করতে দাও, চ্যাঁচাক, চ্যাঁচাক, চ্যাঁচাতে দাও। তুমি খুব ভালো মতোই জানো কেন এমন করছে। দেখতে পাচ্ছ না আমি জরুরি কাজ করছি, ব্যস্ত আছি?

কী এমন জরুরি কাজ করতেছ শুনি? দেখতেছি তো তোমার জরুরি কাজের ধরন। ছেলের কাজ আগে নাকি তোমার কাজ আগে? 

আরে আমাকে বলছ কেন? তুমি যাইতে পারছ না? তুমি গেলে কী হয় শুনি? নয়তো বা বলে, আমি এখন যেতে পারব না। তুমি যাও।

ম্লান অসহায় বেদনা বিহ্বল চেহারায় কান্না জড়ানো কণ্ঠে মিনু বলে, তোমার মাথার ঠিক নাই সফিক। তুমি জানো ছেলে অমনে চ্যাঁচায় ক্যান? চেহারায় আরও বিষাদ ও উদ্বিগ্নতা নিয়ে বলে, ছেলের শরীরের তাপ বাড়তেছে, ছেলে গরম হইছে। আমাকে বলতেছ ছেলের এই কঠিন অস্থির সময়ে কাছে যাইতে? তুমি বাড়িতে না থাকলে অন্য কথা!  তুমি বাবা হইয়া ঘরে বইসা থাকার পরও? তোমার কাজ আগে? নাকি অবুঝ পোলাটার প্রয়োজন আগে? ওকে হেলপ করা আগে? নাকি তোমার আঁতলামি আগে? এত্ত আঁতলামি ক্যান শো করো? এ্যাঁ, কী মনে করছ নিজেকে? মিনু কণ্ঠের সবটুকু ক্ষোভ রাগ একেবারে উপদা করে ঢালে স্বাভাবিকের চাইতে কয়েক গুণ উঁচু স্বরে চেঁচিয়ে।  

সাট আপ মিনু, আমি ঘরে বসে নাই। বললাম না কাজ করছি, জরুরি কাজ। ডোন্ট ন্যাগ মি, ডোন্ট মেক মি ক্রেজি। আমি তোমাকে বলছি, সব সময় কারণে অকারণে ছেলে নিয়ে আমাকে অতিষ্ঠ করো না! চ্যাঁচাচ্ছে, চ্যাঁচাক, চ্যাঁচাতে দাও। চ্যাঁচাক, এখন ও জানে কী করতে হবে। তুমি ভালোই জানো এটা ওর উত্তেজনা প্রকাশের স্বাভাবিক ধরন। অবুঝ বলে সে গোপনীয়তা বোঝে না।   

হঠাৎ ঝড়ে বাজ পড়ার মতো এবার আগের চাইতে আরও উঁচু স্বরে প্রায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে মিনু, সেইটাই তো তোমাকে বুঝাইতেছি, ও জানে না, না জানে, না, এখনও শিইখা উঠতে পারে নাই। এখনও নিজে এই কাম সে করতে পারে না। কিন্তু তুমি হ্যারে দিয়াই করাইতে চাও। আর নাইলে আমারে দিয়া।

ঝগড়ার নিয়ম ও সূত্রে এবার সফিক আহমেদও মিনুর সঙ্গে একই সমান্তরাল রেখে চেঁচায়। না পারুক, যা পারে করুক, য্যামনে পারে করুক। তুমি যেতে পারলে যাও, না হলে যেও না। আমাকে ক্রেজি করো না যন্ত্রণা দিয়ে। তুমি যাও, যেতে পারছ না? তুমিও তো মা! তুমি যেয়ে হেলপ করতে অসুবিধা কোথায়? এক মুখে দুই কথা কেন বলছ? তুমি কাছে যাইতে পারো না, এত করে ডাক্তারে কী বুঝাল? কাউন্সিলর কী বুঝাল? আমার মনে হয় তোমার মাথার ভেতরে কিছুই থাকে না। তুমি এই ব্যাপারটাতে ওকে এ্যাডাল্ট হিসাবে দেখছ কেন? এত করে ডাক্তার যে বলল ওকে এ্যাডাল্ট হিসাবে দেখা যাবে না। ওকে বাচ্চার মতোই ট্রিট করতে হবে আর সব কিছুর মতো এই ব্যাপারটাতেও। তুমি সেটা হয়তো ভুলে গেছ। তোমার কানে কি এই সব কথা ঠিকমতো ঢুকেছিল? নাকি কিছুই তোমার মনে নাই? সব কিছু একেবারে ভুলে গেছ বেমালুম? তুমি তো ওকে বাইরের মানুষদের মতো ট্রিট করছ মিনু! মায়ের মতো না! দুই-একবার তুমি গেলে কী হয়?  

আমিও তো তোমাকে বলতাছি যাইতে হয় তুমি যাইবা। তুমি যা ইচ্ছা তাই বুঝাইতে পারো আমারে কিন্তু তুমি থাকলে আমি যামু না। বুঝতে পারতাছ আমি কী কইতাছি? তুমি যত ইচ্ছা মেজাজ করতে পারো, তবে আমিও বইলা দিতাছি—তুমি ঘরে বইসা থাইকা আমাকে ম্যানেজ করতে বলবা না। মা হইছি তাই কী হইছে! তুমি ঘরে না থাকলে আলাদা কথা আাছিল। মা হইছি বইলাই কি এ্যাডাল্ট ছেলের সবকিছু আমাকে ম্যানেজ করতে হবে?

আমি ঘরে আছি, তুমি নাই? আমি তো এখন ঘরে বসে আছি। তুমি তো সারা দিন ঘরে বসে থাকো!

কী বললা? আমি সারা দিন ঘরে বইসা থাকি? কয়টা কাজের মানুষ রাখছ আমার জন্য? কয়টা রাখছ ছেলের জন্য? সারা দিন বাসার এত কাজ কে করে? কার মায়ে, কার বাপে আইসা কইরা দ্যায়? একদিন কাজ না করলে বুঝবা কে করে এত্ত কাজ? দীপ্ত যদি ছেলে না হইয়া মেয়ে হইত তা হইলে আমি তোমাকে কখনো বলতাম না। মেয়ে হইলে আমিই সামলাইতাম? আমি তোমাকে তোয়াজ করতাম না। কিন্তু দীপ্ত ছেলে আর তুমি বাবা। তোমাকেই সামলাতে হবে এই সব পুরুষালি ব্যাপার স্যাপার। 

তুমি আসলে আমাকে সারাক্ষণ কনটিনিউয়াস টর্চার করো মিনু। আমার কোনো কাজই তোমার কাছে ইম্পরটেন্ট মনে হয় না। ইচ্ছা করলেই তুমি ম্যানেজ করতে পারো। এটা তো আজ নতুন কিছু না! আমার মনে হয় আমাকে কম্পিউটার টেবিলে দেখলে তোমার অ্যালার্জি শুরু হয়? আরে বাবা আমি কম্পিউটারে চ্যাট করি না। ফেসবুক মারাই না, আমি গেম খেলি না, আমি জরুরি কাজ করি, জরুরি কাজ...অফিসের কাজ। এই সব বাক্য গলা ফাটিয়ে বলতে বলতে সফিক আহমেদ হাতের সামনে থেকে এক গাদা কাগজ, ম্যাগাজিন, নিউজ পেপার সব খামচে তুলে ছুড়ে মারে ঘরের কোণায়। সারা ঘরের ভেতরের অবস্থা হয়ে ওঠে ছোটখাটো ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিবেশ।   

আল্লার কসম তোমারে শয়তানে আছর করেছে সফিক? তুমি ঘরে থাইকা আমাকে বলতেছ ম্যানেজ করতে! ছেলের জরুরি ব্যাপার সামনে রাইখা তোমার কম্পিউটারের কাজ বুঝি ইম্পরটেন্ট হইল? তুমি বলছ আমার মাথায় কিছু ঢোকে নাই? আরে জিগাই, তোমার মাথায় ঢুকছে হ্যাঁ? এ্যাঁ? এত্ত কইরা তোমাকে কী বুঝাইল মিস ফানার্ন্দো? ওর মতো ছেলেরা সবাই এক রকম না। সবাই একইভাবে ম্যানেজ করে ফেলবে না নিজেকে? মিস ফার্নান্দো তোমাকে বলে নাই ও পারছে না শিখতে। ওর সময় লাগতেছে, ওকে ধৈর্য ধরে শেখাইতে হবে। তখন তো মাথা নেড়ে নেড়ে ভালো মানুষের মতো অভিনয় কইরা আসলা!

কথাটা শুধু আমার একার জন্য বলে নাই, তোমার জন্যও বলছে।

সঙ্গে সঙ্গে মিনু বলে ওঠে, কাইলই তো লম্বা লেকচার মাইরা আসলা সাপোর্ট গ্রুপের সামনে। সবার আগে বাবা-মা। বাবা-মাকে বুঝতে হবে মানসিকভাবে ধীর বা স্লো, একটু পিছিয়ে থাকা সন্তানদের সাইকোলজি...। ইস্ কত্ত বড় হিপোক্রেট তুমি! চান্স পাইলে বড় বড় লেকচার মারো আঁতেলদের মতো। আর কোনো দিন মাইনষের সামনে এ্যামনে চাপা পিটাইবা না। বাইরে তোমার এক রূপ আর ঘরে তোমার আরেক রূপ সফিফ! তোমার এই রূপ আমি ছাড়া কেউ চেনে না, কেউ জানে না!

ছেলে ছেলে ছেলে...ছেলের ছুঁতা ধরে সব কিছু আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছ মিনু? আমি পারব না তোমাকে বলে দিয়েছি? সব সময় আমি পারব না। তুমি নরমাল হও, তুমি ইজি হও। আমি বাবা—তো বাবা হয়ে কি পাপ করেছি নাকি? সব পাপ আমার! এখন আমাকে গলায় দড়ি দিতে হবে? আমার কপাল, শালার ফাটা কপাল! তা না হইলে বাপ হয়ে এখন ছেলেকে এই সব শেখাতে হয়?

ওহ, তাইলে ছেলেকে তোমার পাপ মনে হচ্ছে? এবার আরও ক্ষিপ্ত, ক্ষিপ্ততার সঙ্গে হতাশা আরও প্রবল চিৎকার। মেঘদের যুগপৎ উন্মত্ত গর্জন, দাপট আর ভয়ংকর চিৎকার মেশানো ত্রাহী ত্রাহী শব্দের ছুটে আসা, ঠিকই তো পাপ, আমার জীবনের পাপ, পাপ না হলে...চৌদ্দগুষ্টি পাগল। পাগল ফ্যামিলিতে গিয়ে ঢুকেছিলাম, পাগলের গুষ্টি ঠেঙাই! কোন অভিশাপে তোমার সাথে দেখা হয়েছিল! 

বাজে কথা বইল না সফিক। আবার তুমি আমার জাতগুষ্টি তুলে কথা বলছ? আমি তোমাকে বলেছি গুষ্টি তুলে কথা বলবা না। পাগলের গুষ্টি আমার না, তোমার? তোমার গুষ্টিতে পাগল, তোমার গুষ্টির ঘরে ঘরে পাগল। আমার গুষ্টির ঘরে ঘরে পাগল নাই। কয়টা পাগল পাইবা আমার গুষ্টিতে? এ্যাঁ, কয়টা পাগল? আমি তোমাকে আগেও বলছি, আবারও বলতেছি শোনো, আমার ফ্যামিলির ওইটা পাগল না। ফরসেফের কারণে মালেকের ব্রেন ড্যামেজ হইছে। তাছাড়া ও আমার খালার ছেলে। আমার গুষ্টির কেউ না, ওটা বংশগত না। কিন্তু তোমাদেরগুলা তো বংশগত। তোমার বংশের দোষে, তোমার রক্তের দোষে, তোমার জাতগুষ্টির দোষে এখন আমার ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী।

আরে রাখো, যত্তসব বালের কথা, ফালতু কথা শুনাইও না। আমার সব জানা আছে। আমার গুষ্টিতে পাগল নাই।  তোমার গুষ্টিতে ডজন ডজন পাগল ভরা। তুমি নিজেও তো পাগল।  

সফিক তুমি মায়ের কাছে মামার বাড়ির গল্প করতে আইসো না! এমনিতেই আমার মনের অবস্থা খুব খারাপ।  এখন তো মনে হচ্ছে ছেলের না। আমারই টেমপার ট্যানটরাম হবে তোমার অত্যাচারে। সফিক, তুমি ভদ্রলোক সাইজা মানুষের সামনে লম্বা লম্বা কথা মারাও। আর দিনরাত আমাকে মেনটালি এ্যাবিউজ করো। তোমার এই স্বভাব কি আর কোনো দিনও বদলাবে না? তুমি কি আমাকে এইভাবে টরচার করেই যাবে? দীপ্তের জন্য তোমার বুকের ভেতরে যতখানি ক্ষত, যতখানি যন্ত্রণা, আমারও তার থেকে কোনো অংশে কম না। বরং তোমার থেইকা আমার কষ্ট হাজার গুণ বেশি। কারণ আমি মা, ভুইলা যাইও না সেইটা।  

সফিক আহমেদ স্ত্রীর এই অভিযোগের কোনো উত্তর না দিয়ে আল্লা খোদার প্রতি বিরূপ মন্তব্য করতে করতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। কটা ধাপ নেমে আবার ঘুরে দাঁড়ায় সিঁড়ির মাথায়। স্ত্রী রওশন আরা মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখভঙ্গিতে শিশু-কিশোরদের মতো ভেংচি কাটে। ডান হাতের পাঁচ আঙুল উলটেপালটে নাচিয়ে নাচিয়ে বলে—এত আল্লা ডাকো, কই শুনছে না তো তোমার ডাক! তোমার ডাকাও তো কোনো কাজে লাগছে না। কী লাভ এত আল্লা, আল্লা করে?

আল্লার প্রতি রওশন আরা মিনুর অগাধ ভক্তি, বিশ্বাস। একদিন তার প্রার্থনা আল্লা পাক নিশ্চয় শুনবেন। দীপ্তকে আল্লা পাক তার মহান ও মহৎ ক্ষমতা দিয়ে, তার কুদরত দিয়ে নিশ্চয় একদিন সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দান করবেন। আল্লাহর অসীম রহমতে মরুভূমিতে ঝরনা হয়েছে। মাটি ফুঁড়ে জমজমের পানির ধারা বের হয়েছে। এগিয়ে এসেছে হজরত রাবেয়া বসরীর জন্য কাবা শরিফ। আর তার দীপ্ত দশটা ছেলের মতো স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না! এটা হতেই পারে না। ডাকার মতো ডাকলে ঠিকই আল্লা মাবুদ তার কথা একদিন নিশ্চয় শুনবেন। কোথাও এই ডাকায় ফাঁকি হচ্ছে! হচ্ছে ভুল বা ত্রুটি! তাই আল্লা মাবুদ তার ডাক আজও কবুল করেননি। স্বামীর এই রকম মন্তব্যে রওশন আরা মিনু খ্যাপা বাঘের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সেই চিৎকারে মনে হয় ঘরের ভিত পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে ওঠে। কাঠের পার্টিশনের দেয়াল, দরজা-জানালা সিলিং সব কিছুর ওপরে বজ্রপাতের মতো হামলে পড়ে তার রাগক্ষোভ চিৎকার।

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে রওশন আরা মিনু এবার বলে—আমি তোমারে নিষেধ করতাছি সফিক, ঘরের ভিতরে আল্লা মাবুদ নিয়া কোনো মন্তব্য কইর না। আমি ঠিকই এই জন্য একদিন একটা অঘটন ঘটাইয়া বসুম। হইতে পারে আমি তোমার মাথা ফাটাইয়া ফালামু, আর না হইলে তোমার ঘাড়ে দাওয়ের কোপ মারমু। কারণ তোমার এই সব বেদাতি মন্তব্যের কারণে আমার সন্তান সুস্থ হইব না কোনোদিন। তোমার নাফরমানির, বেদাতি কথাবার্তার জন্যই আমার এই রকম শাস্তি। তা না হইলে আমার এত্ত সুন্দর ছেলে ক্যান অটিস্টিক হইব, মানসিক প্রতিবন্ধী হইব! বজ্রপাতের পরমূহুর্তে যেমন বৃষ্টি নামে তেমনি চিৎকার দিয়ে প্রতিবাদ করতে করতে অঝোরে কাঁদতে থাকে রওশন আরা মিনু। শুধু কান্না নয়, কান্নার সঙ্গে বিলাপ। বিলাপের সঙ্গে নিজের চুল টেনে, ওড়না টেনে, সোফার ওপরে রাখা পিলোগুলো তুলে মাটিতে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে।  

দুজনের ঝগড়া তর্কবিতর্ক যখন এই রকম আপসহীন, নিচের থেকে দীপ্তের চিৎকার দ্বিগুণ মাত্রায় ওপরের দিকে উঠে আসে। সফিক আহমেদ আবার নামতে থাকে নিচের দিকে। সিঁড়ির অর্ধেক পর্যন্ত নামলেই যে ঘরে দীপ্ত  থাকে তার প্রায় সবটুকু নজরে আসে। কারণ লোয়ার লেভেলের সবটুকু দীপ্তের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় উন্নত করা হয়েছে এই বাড়ি কেনার পর।

বাড়ি কেনার সময় দোতলা পর্যন্ত টানা সিঁড়িওয়ালা বাড়ি খোঁজা হয়েছে। টেলিভিশনে প্রায়ই একটা রোলিং চেয়ারের অ্যাড দেখায়। সেটা যেন ভবিষ্যতে সেট করা যায় সিঁড়ির রেলিংয়ের সঙ্গে সেদিকে খেয়াল রেখে এই রকম বাড়ি খোঁজা। ওয়াশরুমের সাধারণ কমোড সরিয়ে মোস্ট লেটেস্ট, ডিজিটাল কমোড বসানো হলো। যে কমোডে অনেকগুলো বিশেষ বাটন আছে। একটা টিপলে পেশাব, একটা পায়খানা সব রকমের ছোচানো কাজ সবই করে দেয়। শাওয়ার বসানো হলো সেটাও স্পেশাল। ডানের কল শুধু গা ধোয়াবে। বাঁয়েরটা ঝরনার মতো ভেজাবে।  এ দুটোর ওপরে যেটা সেটা খুললে মাথা ধোয়াবে। বাথটাবে সামনের দিকে খোলা আর পেছনের অংশে বসার জন্য স্পেশাল স্পেস। যখন যতটুকু কায়দায় বসতে চায়, বসে মাথা ধোয়া, পা ধোয়া সব দীপ্ত নিজেই করতে পারবে। টেলিভিশনের সামনে সোফা আর বুকশেলফ, আর একটা রকিং চেয়ার। এসব পার হয়ে একটু এগুলে ছোট্ট একটা রুম। এই রুম দীপ্তের জিম। সেখানে আছে ম্যাসাজ চেয়ার, আর টেড্র মিল, ইলেপটিক্যাল আর ম্যাসাজ চেয়ার। ডানের কোণায় দীপ্তের বেডরুম। বেডরুমের পাশের খোলা জায়গা হলো লিভিং স্পেস। কম্পিউটার টেবিলটা বিছানার পাশেই সেট করা। লিওন’স থেকে কেনা কাঠের খাটের ওপর স্পেশাল মেট্রেস। এটার নাম ডু নট ডিসটার্ব। এই মেট্রেস থেকে ওঠানামার সময় কখনো নড়বে না, শব্দ করবে না। কত কিছুই আনা হয়েছে শুধু দীপ্তের আরাম আয়েশের কথা চিন্তা করে। 

সিঁড়ি থেকে নেমে দ্রুত এগিয়ে আসে সফিক আহমেদ। দীপ্ত তখন ওর বেডের পাশের কম্পিউটার চেয়ারে বসা।  পরনের সর্টসটা হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে শক্ত হয়ে ওঠা পুরুষ অঙ্গটি হাতের মুঠোয় ধরে নাচাচ্ছে। সফিক আহমেদ দ্রুত ওয়াশরুমে প্রবেশ করে টাওয়েল হোল্ডার থেকে টান দিয়ে টাওয়েল নিয়ে এসে দীপ্তের দুই হাঁটুর ওপরে মেলে দেয়।

তারপর দীপ্তের মাথায় হাত রেখে ইশারা করে যেভাবে তার শক্ত হয়ে ওঠা পুরুষাঙ্গটা নাড়াচ্ছিল সেভাবে নাচাতে।  পিতার সহযোগিতা পেয়ে এবার দীপ্তের দুলুনি বেড়ে যায়। এবং ওর অভিব্যক্তিতে উপচে ওঠে আনন্দ উচ্ছ্বাস। আঁ...আঁ...আঁ... গোঙানি তুলে নাচাতে থাকে। কয়েক পলক মাত্র—শিশুর মতো সরল ও পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ধরে বাবার মুখের ওপর। এবং পরমুহূর্তে খেলনা নিয়ে খেলার মতো মেতে ওঠে। পুনরায় সফিক আহমেদ ছুটে যায় ওয়াশরুমে। টাওয়েল নেয়ার মতোই ছোঁ মেরে তুলে আনে ভ্যাসেলিন লোশনের কন্টেইনার। কন্টেইনারের মাথায় আঙুলের শক্ত চাপ দিয়ে কয়েক পোচ লোশন ফেলে ছেলের পুরুষাঙ্গের ওপর। লোশনের কোমল পিচ্ছিল অনুভূতি হয়তো তখন দীপ্তের শরীরে বাড়তি শিহরণ জাগায়। বৃদ্ধি করে উত্তেজনা নামের অনুভূতি। ওর গোঙানি আরও একটু বৃদ্ধি পেয়ে জড়িয়ে যায়। বার আ...আ...আ... গোঙানির সঙ্গে মিশ্রণ ঘটে হিসহিসে ঘন নিঃশ্বাসের। আর ঠিক তখন দীপ্তের শুধু মাথা না সমস্ত শরীর দুমড়েমুচড়ে যেতে চায় নানা ভঙ্গিমায়।

পাশে দাঁড়িয়ে সফিক আহমেদ। চোখ বুজে সন্তানের উত্তেজনা দোলা মাথাটি নিজের তলপেটের কাছে চেপে ধরে। তখন তার চেহারায় ভার হয়ে ওঠে কঠিন এক বেদনা। সেই বেদনার সঙ্গে সোহাগ ভরা কণ্ঠে বলে—ইটস ওকে...মাই বেবি...ইটস ওকে, ডু ইট, কুইক, কুইক, ইয়াহ...মাই বেবি ক্যারি অন। দুই চোখের পাতা বন্ধ করে নিজের সামনে অন্ধকারের পর্দা টেনে সফিক আহমেদ ডান হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ছেলের কব্জি। পিতার কব্জির শক্তি দীপ্তের কাম বিহ্বল হাতে হয়তো সঞ্চারিত হয় দ্রুত। দ্বিগুণ হয় পুত্রের শীৎকার, কিন্তু এই আবেগ উত্তেজনা দখলের সময়টুকু এতই ক্ষণিকের, সফিক আহমেদকে দীর্ঘ সময় নিজের দুচোখের পাতা বন্ধ করা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। স্খলনের সংক্ষিপ্ত সময়টুকু মাত্র! তারপরই দীপ্তের সমগ্র অস্তিত্ব দখল করে শিথিল আবেশ, সুখের ক্লান্তি। চেয়ারের পেছনে ঘাড় এলিয়ে দেয়। দীপ্তের অবয়বে তখন স্খলন পরবর্তী পরিতৃপ্তি, নিমগ্নতা।

লোশনের মতো তরল বীর্যের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বারবার উচ্চারণ করে সফিক আহমেদ—ন্যাসটি, ডাআর্টি...হেই দীপ্ত...মাই বেবি, দিস...দিস...দিস ইজ ডার্টি। দুচোখ ভরা নিঃসরণ আবেশ নিয়ে মাথা দুলিয়ে দীপ্ত  উচ্চারণ করে ডাআআটি...ডাআআটি...ড্যাআডি...ডাআটি গুড...। সফিক আহমেদ লক্ষ করে সব সময় ডার্টি শব্দটি উচ্চারণের সময় দীপ্তের অবয়বে ফুটে ওঠে সুখের আমেজে তৃপ্ত অদ্ভুত এক হাসি। যে হাসি দীপ্তের খুব চেনা হাসির মতো না। এই হাসি নতুন তৃপ্তিতে, নতুন সুখের অনুভূতিতে পরিপূর্ণ এক হাসি। দীপ্তের চিরচেনা হাসির কোনো মিল থাকে না এই হাসির। এই হাসি যেন জীবনানন্দে পরিপূর্ণ অনাবিল লুকোচুরির হাসি। শিশুর মতো মানসিক বুদ্ধির সীমানায় আটকানো দীপ্তের অবয়বের সেই হাসিটা যেন বদলে যায়। সেখানে টলটল করে অনাবিল সুখ সুখ এক আনন্দ জড়ানো হাসি। ঠিক যুবক হয়ে ওঠার সময় অনেক মুখে আটকে থাকে যে হাসি। সেই হাসির ভেতর যেন এক গভীর অর্থ লুকোচুরি খেলে, অথবা লুকিয়ে থাকে। যে অভিব্যক্তি শুধু হস্তমৈথুনের পরই স্পষ্ট হয় দীপ্তের চোখের প্রান্তরে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সে জড়িয়ে জড়িয়ে ক্রমাগত বলে...ড্যাএ্যাডি...ড্যাএ্যা...ডি...গুড...এ্যা...এ্যা...গুউউউড...ডাটি গুড...ডাটি গুড ড্যাডি...

টাওয়াল দিয়ে স্খলিত বীর্য মুছিয়ে, সর্টস টেনে তুলে এবার ছেলের মুখোমুখি বসে। ভেঙে ভেঙে বোঝায় এভাবে তাকে হস্তমৈথুন করতে হবে। হাতের তালু ছেলের ন্যাতানো অঙ্গের পর হালকা করে ছুঁয়ে বলে—গুড, গুড মাই সান, দিস ইজ গুড, ওকে। গুড বলার সময় বারবার হালকা চাপ দেয় ছেলের এই অঙ্গের ওপর। ইশারায় দেখায় যখনই তার এই অঙ্গটা শক্ত হয়ে উঠবে এভাবেই দুই হাঁটুর ওপরে টাওয়েল পেতে দিতে হবে। একবার না, বারবার, বেশ কয়েকবার চাপ দিয়ে দিয়ে চেষ্টা করে শেখানোর।

আজ এতগুলো দিন হয়ে গেল দীপ্তকে শেখানো হচ্ছে। এখন পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। সফিক আহমেদ লক্ষ করেছে অনেক কিছু মনে রাখার ব্যাপারে দীপ্ত খুব ভালো। কিছু কাজ, যেমন কম্পিউটারে গেম খেলা। তখন অচেনা কেউ দেখলে ঠিক স্বাভাবিক যুবক বলেই মনে করবে দীপ্তকে। শুধু কম্পিউটারের বিষয় নয়। ছবি আঁকা, গান শোনা, মুভি দেখা এসব দীপ্ত স্বাভাবিক যুবকদের মতোই করে। কিন্তু কিছুতেই যেন বোঝানো যাচ্ছে না মাস্টারবেশনের ব্যাপারটা। দুটো টাওয়েল দীপ্তের হাতের সীমানায় এমনভাবে রাখা হয় যেন ওটা পেতে তার কষ্ট না হয়। এ্যারাওজাল হলেই যেন সেটা হাতের কাছে পায়। কিন্তু টাওয়েল বা লোশন টেনে নেয়ার প্রক্রিয়া খুব ধীর। কম্পিউটারের বিষয়গুলো সে শিখেছে খুব দ্রুত। মাস্টারবেটিংয়ের প্রস্তুতি এবং সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ওকে কিছুতেই শেখাতে পারছে না। ওর সাইক্রিয়াটিস্ট যা বলল, সেটার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পায় সফিক আহমেদ।

তখন মনে পড়ে নিজের দেহে সাগরের ঢেউয়ের মতো সেই প্লাবন আসার দিনগুলো। রাতে ঘুম ভেঙে অথবা উত্তেজনার সেই মুহূর্তে নিজেকে কতদিনই বা পেরেছে সামলাতে? বহুদিন সে ভুলে গেছে বিছানার চাদর, মশারি, নিজের লুঙ্গি সামলানো কথা। সুন্দর স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশে বিঘ্ন না থাকার পরও সফিক আহমেদ ভুলে গেছে পরিস্থিতি সামলাতে। তখন মনে হয়েছে পৃথিবী একদিকে আর নিজের দেহের সুখ অন্যদিকে। শরীরের ভেতর যখন আর এক অস্তিত্বের এমন দানবীয় আক্রমণ তখন কি মনে থেকেছে পরিষ্কার বা নোংরা বিষয়টা? অথবা অন্য কোনো শিষ্টাচারের কথা! সুস্থ সবল একজন যুবকের পক্ষে যদি এমন জংলি সময় সামাল দেয়া কঠিন হয়ে থাকে তাহলে তার দীপ্ত! তার পক্ষে তো একেবারে অসম্ভব হওয়ারই কথা। সফিক আহমেদ ভাবে, আর কতদিন লাগবে দীপ্তের এই দক্ষতা অর্জন করতে!

হতে পারে শুরু থেকেই সফিক ওকে সহায়তা দেয়ার কারণে ও শিখে নিতে পারছে না। অথবা ও ধরে নিয়েছে এই সময়ে ওর হাতের সঞ্চালন বাড়াতে দরকার ড্যাডির হাতখানি। যে কারণে সে শীৎকারের সময়ে মাআমি...মামম্মি...চিৎকার না দিয়ে ড্যাডি...ড্যাডি বলে গোঙাতে থাকে। 

ঘুমহীন রাতের ভাবনা
আজ শনিবার। সফিক আহমেদের অফিস বন্ধ। সকালের নাশতার পর দীপ্তকে নিয়ে গেল লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরি খুব পছন্দ দীপ্তের। সেখানে সে মনোযোগ দিয়ে সিডি বাছাই করে। সফিক আহমেদ অপলক তাকিয়ে থাকে তখন ছেলের দিকে। আর বুক চেরা দীর্ঘ নিঃশ্বাসগুলো তখন যেন বারবার সফিকের বুকের ভেতর ফিরে আসতে চায়। কখনোই বুকের ভেতরে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসগুলো হালকা হয় না। যেন সে বয়ে বেড়ায় পাথরের মতো কঠিন স্তব্ধ এক ভার, দংশিত এক যন্ত্রণা, যে দংশন কেউ কোনোদিন দেখতে পায় না। লাইব্রেরি শেষে ম্যাগডোনাল।

শনিবার সকাল থেকে শুরু হয় দীপ্তের মাথা দুলানো। আর ডান হাতের তালুর ওপর বাম হাতের তালু ঘষা। এভাবেই সে প্রকাশ করে আহ্লাদে বিগলিত অভিব্যক্তি। সে এখন বোঝে আজ সে বের হবে ঘর থেকে। বাবার সঙ্গে লাইব্রেরিতে যাবে। লাইব্রেরি শেষে বাবা তাকে নিয়ে যাবে ম্যাগডোনালসে।

গভীর ঘুমে বিছানার ভেতরে একাকার হয়ে আছে দীপ্ত। কালবৈশাখীর তাণ্ডবের পর প্রকৃতি যেমন ক্লান্ত শ্রান্ত স্তব্ধ  হয় তেমনই দশা। শরীরের উত্তাল উত্তেজনা প্রশমনের পর প্রায় ছয় ফুট লম্বা দেহটা গুটিয়ে শিশুর মতো জড়সড়ো হয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে পড়ে আছে। ছেলের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সফিক আহমেদ। বুকের ভেতরে সেই যন্ত্রণাটা সরীসৃপের মতো বিলবিলিয়ে ওঠে কণ্ঠনালি পর্যন্ত। কেন এমন হলো দীপ্তর জন্মটা? কার পাপ? তার না মিনুর? নাকি দুই বংশের কারও পাপের দায় বহন করছে দীপ্ত। পাপ পুণ্যিতে বিশ্বাস করে না সফিক। তারপরও অবচেতন মনের কোণে এসে ভর করে পাপ পুণ্যির দ্বন্দ্ব। বিজ্ঞান অথবা সংস্কার অথবা ধর্মের ব্যাখ্যা ভালো লাগে না সফিকের। কোনো যুক্তিই পারে না মনের গভীরে সান্ত্বনা অথবা স্বস্তি দিতে। যখন একাকিত্ব ওকে জড়িয়ে ধরে তখনই সে অনেক কেনর উত্তর খোঁজে মনের ভেতরের সব কিছু তছনছ করে। হাতড়াতে হাতড়াতে উত্তর না পেয়ে সফিক আহমেদ হতাশায় আক্রান্ত হয় গভীর হতাশা, ক্রোধ ও রাগে। কত দিন সে বিভ্রান্তের মতো গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেছে শহর থেকে হাইওয়েতে। 

কানাডার হাইওয়েগুলোকে ওর মনে হয় দীর্ঘশ্বাসের মতো। বিরতিহীন চলে গেছে শহরের বাইরে। হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে খোলা কোনো প্রান্তরের পাশে গাড়ি থামিয়ে চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে—আল্লা, খোদা, ভগবান, জেসাস তুমি কে? তুমি কোথায়? তুমি যদি সত্যি হয়ে থাকো—সুস্থ করে দাও আমার দীপ্তকে। পৃথিবী ভরা মানুষের এত জ্ঞান বুদ্ধি তুমি দিয়েছ, আমার দীপ্তকে কেন দিলে না তার বিন্দু পরিমাণ? আমার দীপ্তকে শুধু একটু স্বাভাবিক করে দাও। আর না হয় তুমি আমাকে করে দাও বোধহীন, অনুভূতিহীন পাথর হৃদয়ের। চিৎকার করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়ে সফিক আহমেদ। বিভ্রান্ত দুই হাতে নিজের চুল উপড়ে ফেলার মতো টেনে ধরে। বহুদিন ওর ইচ্ছা হয়েছে গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে একেবারেই হারিয়ে যেতে। কিন্তু পারেনি। শেষ পর্যন্ত নিজেকে শূন্যতার বিবর থেকে টেনে তুলে, নিজের বিবেক আর অনুভূতির সঙ্গে আপস করে পুনরায় হতে হয়েছে গৃহমুখী।  সেও তো দীপ্তর জন্যই! 

আজ কত বছর! সফিক আহমেদ হিসাব মেলায়। দীপ্তের জন্মের দুবছর বয়সের সময় ওরা জানতে পারে সে আর দশটি শিশুর মতো স্বাভাবিক শিশু নয়। দীপ্ত মানসিক বুদ্ধিতে ধীর স্থির। দীপ্ত কোনোদিন স্বাভাবিক শিশুর মতো ছুটবে না, খেলবে না, পড়বে না, কথা বলবে না! প্রথম কয়েক মাস বিমূঢ় বিহ্বল সময় গেছে। শুধু সফিক আহমেদ না। মিনুও ছিল পাথরের মতো নির্বাক, স্তব্ধ। বাড়িতে মৃত্যুর মতো শোকের আবহ পরিবেশ ছিল বহুদিন। তখনও সফিক মিনু দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে একসঙ্গে কেঁদেছে। দুজনের কাছে আশ্রয় খুঁজেছে দুজন। সান্ত্বনা খুঁজেছে দুজনকে জড়িয়ে ধরে। শিশুর মতো মিনুর বুকে মাথা পেতে হয়তো কেঁদেছে সফিক। অথবা সফিকের বুকে মাথা পেতে মিনু। মিনু, কী হয়ে গেল আমাদের জীবনের?  

একটি সন্তান জীবনের চারপাশ যেন করে দিল বেদনাবিধুর, আনন্দবিহীন কঠিন কষ্টময়। জীবনের সমস্ত হাসি আনন্দগুলো মিলিয়ে গেল শূন্যতায়। মিনু আর তার মাঝখানে এই একটি সন্তান খুব ধীরে ধীরে কঠিন পাথরের দেয়াল হয়ে দাঁড়াল। অথচ একটি সন্তানের জন্য কী ভয়াবহ আকুতি সৃষ্টি হয়েছিল সফিকের বুকের ভেতরে। মিনু আমি বাচ্চা চাই, বাচ্চা। একটা ফুটফুটে, তুলতুলে বাচ্চা। মনে হচ্ছে জীবনটা মরু হয়ে যাবে একটা সন্তানের পিতৃত্বের স্বাদ না পেলে। বদলে যাবে জীবনের সমস্ত সংজ্ঞা। আর একটুও দেরি নয়। যখন তখন মিনুকে ঘরের সোফা, বেড এমনকি কার্পেটের ওপরে পর্যন্ত ফেলে মেতে উঠছে মাতাল মিলনে। মিনুকে একটু নড়াচড়া পর্যন্ত  করতে দেয়নি সেক্স শেষ হলে। নাহ, নাহ, নড়ো না, নড়ো না, শুয়ে থাকো। এখন, এই এখনই তুমি আমার বাচ্চা কনসিভ করছ। নো নড়াচড়া, জাস্ট শুয়ে থাকো।

যেদিন মিনুর প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট পজিটিভ পেল সে কী মহানন্দ! নয় কেন! দুজনের সম্মতি ছিল বিয়ের দুবছর পর তারা সন্তান নেবে। দুবছর পার হবার পর তখন তারা বাচ্চা নেয়ার জন্য মানসিকভাবে তৈরি। শুরু নতুন এক অপেক্ষার। প্রতিমাসেই মেনুস্ট্রেশনের সময় ঘনিয়ে এলে মিনুর ভেতরে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে সেই অস্থিরতা সফিকের ভেতরও। অপেক্ষায় কেটে গেল তিনটা বছর। তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মিনু প্রেগন্যান্ট। আনন্দে আত্মহারা সফিক অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ফেলল এক সপ্তাহের। শুধু নিজে নয়, মিনুকেও ছুটি নেয়াল। পরিকল্পনা করে দুজনে জমিয়ে রেখেছিল অফিসের ছুটি। মিনুকে জড়িয়ে সারা দিন জল্পনা আর কল্পনার ভেলায় ভেসে বেড়ানো। কী নাম রাখা হবে ছেলে হলে, কী হবে মেয়ে হলে! কেমন করে সাজানো হবে বেবিরুম। এ দেশে ছেলে হলে ব্লু থিম আর মেয়ে হলে পিংক। ওরাও ঘর সাজাবে ছেলে হলে নীল থিম, মেয়ে হলে গোলাপি থিমে। মিনুর উঁচু পেটের ওপর হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে সফিক আহমেদ। আর আহ্লাদ করে বলে, শোনো মিনু, বেবিরুম সাজাব ঠিকই কিন্তু আমরা আমাদের বাচ্চাকে বেবিরুমে আলাদা রাখব না। যতদিন আমার বাচ্চা আমার কোলের ভেতরে ঘুমাবে ততদিন আমি ওকে আলাদা করব না। আমি কানাডিয়ান এই সব ব্যাপার স্যাপার বুঝি না। আমি বাংলাদেশি কায়দায় বুকের ভেতরে বাচ্চা রাখব। কতদিন বেবি তাদের সঙ্গে থাকবে, কেমন করে দুজন বেবির যত্নের জন্য কাজের সিডিউল ভাগ করে নেবে সেসব ছিল স্বপ্নে দোলা সময়।  

সেই সন্তানের জন্মের দুবছর পর সব যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। যখন ডাক্তার জানাল তাদের দীপ্ত অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে ভুগছে। কঠিন এক তুফানে তোলপাড় করে দেয়ার মতো সব কিছু কেমন তছনছ হয়ে গেল। বদলে গেল জীবনের সব আনন্দ ফুর্তি! সফিক আর মিনুর ভেতরে খুব ধীরে ধীরে সৃষ্টি হলো অদ্ভুত এক দূরত্ব। ক্রমেই সেই দূরত্ব দুজনের মাঝে যেন তুলে দিল এক অদৃশ্য দেয়াল। সেই অদৃশ্য দেয়াল এখন শুধু দৃশ্যমান শুধু নয় একেবারে স্পষ্ট। পাশাপাশি দুই বেডরুমে ঘুমায় দুজন, মাঝখানে দেয়াল। কখনো কখনো দীপ্তকে পাহারা দিতে হতো রাতভর। পালাক্রমে শুরু হয়েছিল এই পাহারা। তারপর এখন তেমন পাহারা দিতে হয় না।  কিন্তু আর কোনোদিন এক হয়নি তাদের বিছানা। আর কোনোদিন ফিরে আসেনি দীপ্ত জন্মপূর্ব প্রেম রোমান্স ভরা সেই রাতগুলো। সফিক ও মিনু দুজনের জীবনে দীপ্ত জন্মপূর্ব রাতগুলো রূপকাহিনি হয়ে গেছে। কবে কখন তারা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে এখন তাও যেন বিস্মৃত প্রায়। কখনো কখনো একাকী রাতে মিনু হয়তো ভাবে—দাম্পত্যজীবনের রেশনে ওটুকুই বোধ হয় বরাদ্দ ছিল সফিকের কাছ থেকে পাওয়া। 

মিনুর মতো সফিকও পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে বসে থাকে। আজ আর তার হিসাব নেই কত রাত কেটেছে ঘুমহীন!  বিভোর হয়ে শুধু এক ভাবনাতেই হয়তো ডুবে গেছে—এমন কিছু আবিষ্কার হতো, যা দিয়ে বদলে ফেলা যেত তার দীপ্তকে। দীপ্ত হয়ে উঠত আর দশটা স্বাভাবিক ছেলের মতো। কখনো কখনো হয়তো ভাবে—যদি তার ক্ষমতা থাকত তাহলে সে বদলে দিত দীপ্তের সব কষ্ট। 

জন্মের দায়
দীপ্ত একমাত্র সন্তান তাদের। অস্বাভাবিক এক জন্মের দায় এভাবে বয়ে নিয়ে বেড়াবে! কী ভুল করেছিল সে আর মিনু? তাদের কোন ভুলে দীপ্ত আজ মানসিকভাবে ধীর, অটিস্টিক? ডাক্তার, সাইক্রিয়াটিস্ট অনেকেরই মতামত মানসিক ধীর বা অটিস্টিক বাচ্চারা ভালো হয়। সঠিক খাদ্য, শিক্ষা আর ট্রেনিং এসবের দিকে খেয়াল রাখতে হবে খুব বেশি। এসব ঠিকমতো পেলে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার অথবা ডেভলপমেন্টালি স্লো শিশুরা অনেক উন্নতি করতে পারে। অনেক ইমপ্রুভ করতে পারে সময় দিয়ে শেখালে। সেই বিশ্বাস থেকে দিনের পর দিন ভিন্ন রকমের ট্রেনিং, ফুড, রিক্রিয়েশন, এন্টারটেইনমেন্ট, ফান, ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিজ, এক্সারসাইজ, কত কিছু করেছে। নাহ, দীপ্তের সুস্থ স্বাভাবিক হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। হয়তো এই সবে কিছুটা ইমপ্রুভ করে কিন্তু  একেবারে সুস্থ, স্বাভাবিক সেটা তো আর হবে না। সাইন্স তো আজও সেই ম্যাজিক দেখাতে পারেনি! টেস্ট টিউব থেকে শুরু করে পেটের ভেতরে সন্তান সুস্থ নাকি ডাউন সিনড্রম সেসবই পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারছে। কিন্তু  মানসিকভাবে ধীর একটা শিশুকে ভালো করার কোনো কিছু আজও আবিষ্কার করতে পারেনি। হয়তো সেই গবেষণার প্রয়োজন বোধ করেনি। অথবা চলছে সেই গবেষণা। কিন্তু সফিকের কিছু আসে যায় না অথবা দীপ্তের। একটা মানসিক ধীর সন্তানকে বাকি জীবন এভাবে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে! এসব ভাবনা সফিকের বুকের ভেতরে যন্ত্রণা বাড়ায়। দিনের পর দিন অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের ওপর স্টাডি করতে করতে তার মনে হয় সে নিজেই এখন রীতিমতো হয়ে গেছে একজন গবেষক।

জায়নামাজে আশ্রয়

যেদিন ডাক্তার জানাল তার দীপ্ত অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত সেদিন থেকে জায়নামাজ পেতে শুরু হলো মিনুর আল্লার কাছে কান্নাকাটি, করুণা ভিক্ষা। সেই কান্না আজ পর্যন্ত কেঁদে চলেছে মিনু। মিনুর এই বিরতিহীন কান্নার প্রতি প্রথম দিকে পূর্ণ বিশ্বাস ও ভক্তি ছিল সফিক আহমেদের। নিজেও রাতের পর রাত জায়নামাজে কেঁদেছে—আল্লা, তুমি আমার দীপ্তকে, আমার সন্তানকে সুস্থ করে দাও। ওর বুদ্ধির বিকাশ স্বাভাবিক শিশুদের মতো করে দাও তোমার অসীম ক্ষমতায়। তুমি মহান, তুমি দয়ালু, তুমি করুণাময় আল্লা। তখন সে নিজেও বিশ্বাস করত আল্লার কুদরত। অলৌকিক অথবা ঐশ্বরিক ক্ষমতায়। বিশ্বাস আল্লার কাছে কাঁদতে কাঁদতে একদিন আল্লার করুণা লাভ করবে। এবং সুস্থ স্বাভাবিক হবে সন্তান দীপ্তের বুদ্ধির বিকাশ। আল্লা তা’আলা তার কান্না শুনবে। নিশ্চয়ই শুনবেন। শুনবেন আল্লা পাক মিনুর কান্না। দীপ্তকে নিয়ে ছুটে গেছে আজমির শরিফে। ছুটে গেছে হজরত শাহ জালালের মাজারে। হজরত শাহ পরাণের মাযারে। কত মানত, কত ছদগা, কত সিন্নি দুই হাতে বিলিয়েছে মাজারের গরিব দুঃখী আল্লার অনুরাগীদের মাঝে। বছরের পর এতিমখানার শিশুদের জন্য পাঠিয়েছে অর্থ। দান ছদগা, জাকাত দিয়েছে বেহিসেবি। 

ভক্তিতে বিশ্বাসে মাথা কুটে কুটে কেঁদেছে মিনু। কিন্তু ক্রমেই সফিক বুঝতে পারে এই কান্না দিয়ে আর কোনোদিন সুস্থ হয়ে উঠবে না তার দীপ্ত। কোনো অলৌকিক অথবা ঐশ্বরিক ক্ষমতায় দীপ্ত কোনোদিন ফিরে পাবে না  স্বাভাবিক জীবন। সাইন্স অন্তত সেটা বলে না। সেটাই যদি হতো তাহলে এই পৃথিবীর সব অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুরা সুস্থ হয়ে উঠত।

দীর্ঘ পনেরো বছর পার হয়ে গেল দীপ্তের অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার ডায়াগনস হয়েছে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার নিয়ে এত বেশি পড়াশুনা, এত বেশি অনলাইনে বসে থাকা, সব কিছুর এখন শুধু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ মাত্র। সফিক আহমেদ এখন আর দীপ্তের সুস্থ হওয়া নিয়ে ভাবে না। কোনো দূরাশা পর্যন্ত নেই তার মনের কোণায়। সে ভাবে আসলে দীপ্তই সুস্থ, বাকি সবাই অসুস্থ। দীপ্ত যেমন তেমনটাই সুস্থতার ধরন। কারণ এটাই তো দীপ্তের কন্ডিশন। 

কিন্তু রওশন আরা মিনু সেই অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে দিনের বেশির ভাগ সময়ই জায়নামাজে বসে পার করে। আল্লার প্রতি বিশ্বাস ভক্তিতে এত বেশি আচ্ছন্ন থাকে তার নিজের কোনো স্বাভাবিক জীবন নেই। রোজা রাখে প্রায় বারো মাস। কোরান খতম দেয় প্রতি শুক্রবার। সারাক্ষণ হাতে ঝুলছে তসবি। সফিক আহমেদ হাসে আর ভাবে যত চোখের জল মিনু জায়নামাজে ফেলেছে, আল্লা সত্যি হলে নিশ্চয় এত দিনে দীপ্ত স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেত।

ক্রমেই বিশ্বাস আর আস্থা হ্রাস পেতে পেতে সফিক আহমেদ এখন একেবারেই অবিশ্বাসীদের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বাস করে না কোনো ধর্মের সৃষ্টিকর্তায়। শুধু তাই নয়। তার অবিশ্বাস, হতাশা এত তীব্র আকার ধারণ করেছে এই নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া বা বিতর্কের সৃষ্টি হয় মিনুর সঙ্গে। মিনুকে প্রতিনিয়ত ব্যঙ্গ করে ধর্মের অতি বিশ্বাস নিয়ে। যুক্তি দিয়ে বোঝায় অবিশ্বাসের কারণ। একজনের বিশ্বাস আর একজনের অবিশ্বাস এখন এতই তীব্র, প্রতিনিয়ত চরম আকার ধারণ করে এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব। অতিরিক্ত ভক্তি বিশ্বাস থেকে মিনু যেমন দুনিয়ার প্রায় সকল স্বাভাবিক কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে দ্বীনকে জাপটে ধরেছে। মিনুর চেতনা থেকে ইহকাল বলতে গেলে লোপ পেয়েছে প্রায় সম্পূর্ণ। সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকে পরকালের ভাবনায় আর অস্বীকার করে বিজ্ঞানকে। অথচ এই মিনু কেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছে ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো থেকে।

ঠিক বিপরীতে অবস্থান সফিক আহমেদের। অবিশ্বাস এখন কঠিনভাবে তীব্র ও দৃঢ় হয়েছে। অবিশ্বাস থেকে সে ক্রমেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সকল প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি থেকে। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পর তার দেহটা যেন  কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুশাসনে সৎকার করা না হয় সেই উদ্দেশে মৃতদেহকেও সে দান করে দিয়েছে বিজ্ঞানের গবেষণায়। হেলথ কানাডার ফরমের ওপরে নিজের দেহ দান করে দেয়ার সময় লিখেছে—মৃত্যুর পর চোখ, কিডনি, হার্ট সব কিছু অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার কোনো যুবকের জন্য ব্যবহার করতে।

সফিক আহমেদ মনে করার চেষ্টা করে আজ কত দিন হলো? সে তো তিন মাসের বেশি। তিন মাসে কতবার সে মাস্টারবেটিং করিয়েছে তার ছেলেকে? আর কিছুদিন এভাবে শিখতে শিখতে সে হয়তো একেবারে শিখে ফেলবে। তখন সে নিজেই করতে পারবে পরনের কাপড়চোপড় নোংরা না করে। মানবদেহের নিয়মে দীপ্তের দেহে এখন যে প্লাবন এসেছে সেই প্লাবন তো তার নিয়মে নির্গমের পথ খুঁজে নেবে। দীপ্তের ব্রেনের বিকাশ বা ডেভেলপমেন্ট হয়নি তো কী হয়েছে, ওর শরীর তো বাড়ন্ত যুবকের। এখনও শিশুর মতো দীপ্তের ব্রেনের বিকাশ কিন্তু দেহের বেড়ে ওঠাটা একেবারেই স্বাভাবিক। এমন বাড়ন্ত গড়ন সফিক আহমেদকে মনে পড়িয়ে দেয় তার বাবার সেই লম্বা চওড়া অবয়ব। দীপ্তের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে সফিক আহমেদ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে থাকে। এত মিল কেমন করে হয়। দীপ্তি যেন তার বাবা রফিক আহমেদের ফটোকপি। সেই কপাল-ভ্রু, চোখ নাক আহা, সেই উচ্চতা, হাত পা কী না! আহা আমার দীপ্ত এখন যদি স্বাভাবিক হতো, তাহলে! যদি মানসিকভাবে ধীর না হতো তাহলে! হয়তো বাবার মতোই একজন নাম করা আইনজীবী হতো। দেহের সমন্ত শক্তি সক্ষমতা উজাড় করে উপভোগ করত জীবনকে। 

যতদিন বেঁচে থাকবে তাকে বহন করে বেড়াতে হবে সন্তানের এই অস্বাভাবিক জন্মের দায়! দীপ্তের অস্বাভাবিক জীবনের দায় তো তারই। সাইন্স এখন যদিও আর সেটা বলে না। পিতামাতার জিনের ভেতরে এর কিছু নেই। পিতামাতার জিনের কারণে অটিস্টিক অথবা মানসিকভাবে ধীর সন্তান জন্মায় না। মিনুর সঙ্গে ঝগড়ার সময় যদিও সে মিনুকে দোষ দেয় গলার স্বর দেয়ালে আছড়িয়ে আছড়িয়ে। অকারণে চিৎকার করে মিনুর কাঁধে দায় চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এটা তো নিছক ঝগড়ার চরিত্র। যতই মিনুকে দোষারোপ করুক না কেন সে নিজেও তো খুব স্পষ্টভাবে জানে। আর তার বংশের ভেতরেও তো আছে অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার। 

আপন চাচার মেয়ে জুলেখা জন্মের পর থেকেই মানসিক ধীর প্রতিবন্ধী। বাবার আরও দুই চাচাতো ভাইয়ের ছেলেরও আছে একই রকম অবস্থা। বাংলাদেশে গ্রামের মানুষরা এদেরকে সাইন্টিফিক সংজ্ঞায় অটিস্টিক বলে না, এদের ডাকে জন্মপাগল। জিনে ধরা, বাতাস লাগা কত অশনি সংজ্ঞা। কত প্রাগৈতিহাসিক কারণ! কিন্তু এখনকার লেটেস্ট গবেষণা বলছে এর সঙ্গে জিন বা বংশের কোনো সম্পর্ক নেই। নানা রকমের বিষাক্ত কেমিক্যাল, জন্মের সময় ব্রেনের ওপর প্রেসার অনেক কিছুই এর জন্য দায়ী। তাহলেও তো সফিক নিজে অপরাধমুক্ত হতে পারে না। দীপ্ত জন্মের সময় দুই দিন মিনু কষ্ট পেয়েছে। ক্রিটিক্যাল ডেলিভারি ছিল মিনুর। তাহলে কি সেই সময়ই দীপ্তের ব্রেনের ক্ষতি হয়ে গেল!

মায়ের মুখে শুনেছে জুলেখা আপা যখন গর্ভে তখন চাচিকে জিনের আছর করেছিল। তখন সফিক আহমেদ সেটাই বিশ্বাস করেছে। হয়তো বা করেনি। কিন্তু কানাডা আসার আগ পর্যন্ত সফিক নিজেও বিশ্বাস করত জুলেখা আপা পাগল। জন্মপাগল! 

জুলেখার জীবন
জুলেখা আপাকে বাড়ির পেছনের ছোট্ট বেডরুমে আটকে রাখা হয়েছে তার জন্মের পর থেকে। জুলেখা আপা ও দীপ্ত, একই রকম বুদ্ধিবৃত্তিক ধীর অবস্থান নিয়ে জন্ম দুজনের। সফিক আহমেদ দীপ্তের জীবনের সঙ্গে জুলেখা আপার জীবনের তুলনা করে খুব কষ্ট পায়। কতটা বিবর্তিত জীবন! জুলেখা আপার জীবন কেটেছে অদ্ভুত বন্দি দশায়। একেবারেই ভিন্ন এক সামাজিক আড়ালে। সেদিনের জুলেখা আপার বন্দি সেই জীবনের কথা মনে হলেই গভীর ব্যথায়, অনুশোচনায় বুকের ভেতরে জমে থাকা জগদ্দল পাথরের মতো কষ্টগুলো হয়ে ওঠে আরও ভারী।     

দীপ্তের দেহে তখন মানব সাগরের জোয়ার আসছে। সেই সময়টার শুরুতে দীপ্তকে নিয়ে সফিক আহমেদ আর রওশন আরা মিনু একসঙ্গে বহুবার গিয়েছে ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে। সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে। দীপ্তের শরীরের ভেতরে যে অনুভূতি তীব্র হতে থাকে তার কিছুই সে মুখে প্রকাশ করতে পারে না। শরীরের ভেতর জেগে ওঠা তোলপাড় করা এক পরিবর্তনে সে শুরু করে অদ্ভুত ক্ষিপ্ত আচরণ। ডাক্তার বলেছে দীপ্ত এই অনুভূতির প্রকাশ আড়াল করতে জানে না। কিন্তু শরীরের ভেতরে জেগে ওঠা ভিন্ন এক চাহিদা তাকে করে তোলে অস্থির, ভিন্ন অনুভূতিপ্রবণ। এই সময়টাতে অনেক পুরুষ অথবা নারী যারা স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন তারাও অনেক অস্বাভাবিক আচরণ করে। দীপ্ত অচেনা এক যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে হাতের ভেতরে যা কিছু পায় ছুড়ে ফেলে, ভেঙেচুরে তছনছ করে। রক্তাক্ত করে ফেলে নিজের আঙুল হাত পা কামড়ে। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে মাথায় তোলে বাড়ির শান্ত পরিবেশ। ঠিক চ্যাঁচানি না বলে গোঙানি বললে ঠিক হবে, ডাক্তার জানায় এটাও টেমপার টেনট্রাম। অনেক কথাই প্রকাশ করতে পারে না বলে ছোটবেলা থেকেই আছে দীপ্তের টেমপার টেনট্রাম। আর শরীরের ভেতর চাহিদা জেগে উঠলে তার এই টেমপার টেনট্রামও বেড়ে যায় তখন।

দীপ্তের যে অনুভূতি সেটা তীব্র হলে রওশন আরা মিনু হয়ে ওঠে ভীতসন্ত্রস্ত। প্রথম দিকে ছেলেকে সামলাতে হিমশিম খেত। তখন উত্তেজনা প্রকাশের ভাষা না বুঝে অস্থির অচেনা আচরণ করত দীপ্ত। সবার সামনেই পায়জামা অথবা হাফ প্যান্টের ওপর হাতের মুঠোয় চেপে ধরত শক্ত হয়ে ওঠা পুরুষাঙ্গ। কখনো পুরো পুরুষাঙ্গটাইকেই প্যান্টের ফাঁকা দিয়ে বের করে সবার সামনে সেটা নিয়ে ব্যস্ত হতো। তখনও সে স্খলেনর সুখ উপলদ্ধি বোঝেনি। বেশির ভাগ সময়ই হয়ে উঠত ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ অস্থির। বহুদিন মিনুকে হাঁচড়ে পাঁচড়ে কামড়ে খামচে ক্ষতবিক্ষত বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ছোটখাটো পাঁচ ফুট লম্বা, মাত্র একশ পাউন্ড ওজনের হালকা পাতলা শুকনো ক্ষীণাঙ্গী মিনুকে সামলাতে হয়েছে ছেলের অব্যক্ত যন্ত্রণা।

এই তো সেদিন দীপ্তের এক ধাক্কাতেই একেবারে সুতো ছেঁড়া ঘুড্ডির মতো ছিটকে গিয়ে পড়ে দেয়ালের গায়ে। আরেকদিন কাত হয়ে সোফার কোণায় বেকায়দা পড়ায় ভেঙে গেল বাম হাতটা। ভাঙা হাত নিয়ে রওশন আরা মিনুকে কষ্ট পোহাতে হলো বহুদিন। সেদিনও এমন বেকায়দা পড়েছিল কব্জি আর কনুইয়ের মাঝখানের শক্ত হাড় একেবারে ভেঙে দুই ভাগ। তারপর থেকে টেমপার টেনট্রাম উঠলে বাঘের সামনে পড়া হরিণীর মতো ওপরে উঠে পালানোর পথ খোঁজে রওশন আরা মিনু।   

রাখ, ঢাক, বা গোপন করে কথা বলে না এ দেশের ডাক্তাররা। দীপ্তের শরীরের গড়ন তার বাবা অথবা দাদার মতো। সফিকের মতোই ছয় ফুট লম্বা হয়ে গেল চোখের পলকে। হাত পা বুকে গজিয়ে উঠল বর্ষার পানি পাওয়া ঘাসের মতো ঘন কালো লোম। মুখখানিও তেমনি! ভরে গেল দাঁড়ি মোচের বাড়াবাড়িতে। শরীরের ভেতর থেকে নতুন যে গন্ধটা বের হয়ে এলো সেটাও এখন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মতো। মিনু সাদৃশ্য খুঁজে পায় এই গন্ধের সঙ্গে তার স্বামীর শরীরের গন্ধের। স্বামী সফিক আহমেদকে অহংকার দেয়ার জন্য বলে—জানো দীপ্তের শরীরের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, আন্ডার ওয়ারের গন্ধ সব একেবারে তোমার শরীরের মতো।

ডাক্তার সব কিছুই শেখাল। প্রাইমারি কেয়ারটেকার সেও তার বিদ্যা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে সবই শেখাল। কী কী  পরিবর্তন ঘটবে দীপ্তের দেহে। একজন কিশোর যুবক হয়ে ওঠার সময় যেসব পরিবর্তন ঘটে তার সবই ঘটবে দীপ্তের। ডাক্তার অথবা সোশ্যাল ওয়ার্কার শেখানোর আগেই অনলাইনে, লাইব্রেরি থেকে অটিস্টিক পিউবারটি, অটিস্টিক অ্যাডাল্ট বিহেভিয়ারের বই এনে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিল সফিক আহমেদ এবং রওশন আরা দুজনেই। কিন্তু তারপরও মনে হয় কোথায় যেন অজ্ঞতা, অপারগতা, ব্যর্থতা।   

যেহেতু দীপ্ত মনের ভাব ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না, সেহেতু বাবা-মাক- অনেক কিছুই বুঝে নিতে হয়। বুঝে নিতে হয় তার জড়িয়ে যাওয়া জটিল অসম্পূর্ণ মনোভাব। বুঝে নেয়ার বিষয়টি কখনো প্রলম্বিত হলে অথবা বুঝতে অপারগ হলে দ্রুত টেমপার টেনট্রামে আক্রান্ত হয় দীপ্ত। হয়তো দীপ্তের নিজের ভেতরেও অনেক ক্ষোভ। বুদ্ধির বিকাশে অস্বাভাবিকতার জন্য ক্ষোভ প্রকাশের ভাষাও তো দীপ্ত জানে না। অথবা হয়তো দীপ্তের মা-বাবাও বুঝে উঠতে পারে না অনেক কিছু! তারাও হয়তো তাদের স্বাভাবিক স্বভাবের কারণে দীপ্তের স্বাভাবিকতার ভাষাটা রপ্ত করতে পারেনি সম্পূর্ণভাবে। শিশুর মতোই দীপ্তকে সব কিছু শেখাতে হবে। হয়তো তার ইরেকশন হবে, ইজাকুলেশন হবে, অথবা অর্গাজম। কিন্তু দীপ্তের ভাষা তো আর স্বাভাবিক যুবকদের মতো হবে না। দীপ্তের অভিব্যক্তি হবে দীপ্তের মতো ভাষায়।

দীপ্ত তো পিতার যে ভাষা সেটাও জানো না। সুতরাং সে তো পিতার সংজ্ঞার কোনো স্বাভাবিক নিয়ম মানবে না। গোপনে লোকচক্ষুর আড়ালে যেটা করা দরকার দীপ্ত তো জানে না সেই গোপনীয়তার সংজ্ঞা। কাপড়চোপড় নোংরা না করে গুছিয়ে মাস্টারবেটিং করানো শেখাতে সময় লাগবে। ওর সাইক্রিয়াটিস্ট বলেছে—মিস্টার আহমেদ, জাস্ট স্মরণ করো তোমার নিজের মাস্টারবেটিংয়ের স্মৃতি? নিশ্চয়ই বহুবার তুমিও করেছ? সেই দুর্বার কামনা, সেই দুরন্ত ইচ্ছা তোমার যেমন ছিল তোমার ছেলেরও তাই। তুমি তো জানো ওর এই সব ব্যাপার সবই স্বাভাবিক মানুষদের মতো হবে। তবে ও কন্ট্রোল করা বিষয়টি বুঝবে না প্রথম দিকে। তোমাদেরকে খুব সচেতন থাকতে হবে সেসব ব্যাপারে। তা না হলে দীপ্ত না, তোমরাই অপ্রস্তুত বোধ করবে মানুষের সামনে। কারণ গোপনীয়তা ব্যাপারটা সম্পূর্ণতই সামাজিক ব্যাপার। দীপ্তকে সেটা শেখাতে হবে।

প্রথম দিন খুব কষ্ট হয়েছিল সফিক আহমেদের। সন্তানের গোপন কাজটা পিতা হয়ে সম্পন্ন করাতে। এখন আগের চাইতে তুলনামূলক বেশি বুঝতে শিখেছে। তবে গুছিয়ে করতে শেখেনি আজও। আর স্খলনের কাজ পর্যন্ত সহযোগিতা করিয়ে দিতে দিতে এই কয়েক মাসে সফিকের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সন্তানের মাস্টারবেটিং করানো কাজটি। যেমন স্বাভাবিক হয়ে আছে ষোলো বছর ধরে গোসল করানো। যতদিন ডিজিটাল কমোড বসানো হয়নি ততদিন পায়খানা প্রস্রাবের পর ছোচানোর কাজ করানোটাও ছিল স্বাভাবিক।

প্রথম দিন সে নিজের হাত আত্মজার হাতের ওপর রেখে শিখিয়েছে ঠিক কোনভাবে নাড়াচাড়া করলে সে চূড়ান্ত সুখ পাবে। দীপ্ত যখন ছোট ছিল তখন একই ঘরে মা-বাবা দুজনের একসঙ্গে ঘুমাবার বিছানার পাশে ক্রীবের ভেতরে ঘুমাত। ক্রীব ছাড়ার পর যখন দীপ্ত একটু বড় হলো নিচতলার সবটুকুই গোছানো হলো দীপ্তের সুবিধার দিকে নজর রেখে। 

যখন দীপ্ত তিন বছরের শিশু তখন থেকে সফিক আহমেদ দীপ্তকে কোলের কাছে নিয়ে ঘুমায়। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমের অভ্যাস তখন থেকেই। আর ঠিক তখন থেকেই শুরু মিনুর সঙ্গে এক বিছানায় শোয়ার বিচ্ছেদ। ধীরে ধীরে দুজনের ভেতরে তৈরি হয় বিস্তীর্ণ ব্যবধান। আকাশের মতো বিস্তীর্ণ দূরত্ব। মিনু ঘুমায় সেকেন্ড ফ্লোরে বেডরুমে। আর সফিক নিচতলায় ছেলের সঙ্গে। এই দূরত্ব এখন শুধু বিছানা, ওপরতলা, নিচতলার সীমানা ছাড়িয়ে নয়। ছাড়িয়ে গেছে মনের সীমানা পর্যন্ত।   

বিছানার সবটুকু জুড়ে শুয়ে থাকে দীপ্ত। কখনো চিত হয়ে, কখনো উপুড় হয়ে হাত পা সব চারপাশে মেলে দিয়ে। সারা রাত এক কোণায় কাত হয়ে ঘুমিয়ে দূর হয় না শরীরের সবটুকু ক্লান্তি। কয়েক বছর হলো সফিক ছেলের বিছানার পাশে সেট করেছে আরেকটা সিঙ্গেল খাট।  

প্রতি শনিবার সকালের মতো আজও শনিবার বিছানায় শুয়ে আছে আলসেমিতে পাওয়া সফিক আহমেদ। মনের উঠোনের সবটুকু ঢেকে আছে এক খণ্ড কালো মেঘ। সেই মেঘের অন্ধকারে সফিক ক্রমেই তলিয়ে যেতে থাকে।  বুকের গভীর থেকে কষ্টের কালো মেঘটা কখনোই সরে না। সারা দিন কাজের ভেতরে নিজেকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে রাখলেও প্রতিটি মুহূর্তে কেউ হাতুড়ি দিয়ে ওর হৃদয়টা ছেঁচতে থাকে। কখনো কখনো কষ্টের বোঝা এত ভারী হয়ে ওঠে তখন মনে হয় সে যদি পারত তাহলে পালিয়ে যেত। যেখানে বোঝার মতো টেনে বেড়ানো দীপ্তের জীবনটাকে দেখতে হতো না। 

দীপ্ত, তার একমাত্র সন্তান, পৃথিবীর স্বাভাবিক সব কিছু উপভোগ থেকে বঞ্চিত। এই পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর, আনন্দের, বিনোদনের, উপভোগের সবটুকু এগিয়ে দিতে হয় দীপ্তের সামনে। না হলে সে কিছুই উপভোগ করতে জানে না। 

এখন দুরন্ত বয়স দীপ্তের। এক কথায় প্রকাশের বর্ণনায় দীপ্ত হ্যান্ডসাম। মাথা ভরা কোঁকড়ানো চুল, উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের ওপর চোখ দুটো গভীর কালো। চোখের পাথায় বাঁকানো ঘন পাপড়ি। উঁচু কপালের ওপর পরিপাটি ভ্রু জোড়া এত সুন্দর দেখে মনে হয় এই মাত্র পার্লার থেকে ট্রিম করে এনেছে। চাক চাক পেশি কাঁধের পাশ, বুক, পিঠ, আর বাহুর ওপর স্ফীত হয়েছে। ঠিক যেন শক্ত সবল পুরুষের ব্যায়াম করা শরীরের মতো। শরীরের এমন সুন্দর গড়ন প্রথম দেখায় বোঝা কঠিন দীপ্তের এই বয়সে একটি শিশুর মতো মানসিক পরিপক্বতা। দীপ্ত যখন কারও দিকে তাকায় তখনই বোঝা যায় ঐ দৃষ্টিতে কোনো ভাষা নেই। নেই কোনো অর্থ। আজ যদি দীপ্ত সুস্থ স্বাভাবিক হতো তাহলে কত মেয়ে হয়তো আগ্রহী হতো ওর বান্ধবী বা প্রেমিকা হবার জন্য। দীপ্তের সবল পৌরুষ মুগ্ধ করত কত সুন্দরী মেয়েকে। আকর্ষণ করত! অথবা দীপ্ত আকৃষ্ট হতো কোনো এক যুবতীর মিষ্টি প্রেমে! আহা আমার দীপ্ত পৃথিবীতে প্রেমের তীব্র আকর্ষণ, তন্ময়তা, প্রেমের অনাবিল আনন্দ কোনো কিছুই উপভোগ করবে না। কেন? কেন? কেন? আল্লা তুমি কোথায়? নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতে ইচ্ছা করে যন্ত্রণায়। কোথায় সেই না দেখা বিধাতা বা ঈশ্বর তাকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনতে ইচ্ছা করে সামনে। ইচ্চা হয় টুঁটি টিপে ধরতে সেই অদৃশ্য মহাশক্তির।  

যেটুকু সময় সফিক আহমেদ বাড়িতে থাকে বলতে গেলে একেবারে বিমগ্ন থাকে ইন্টারনেটে। শুরু হয়েছিল অটিস্টিক চাইল্ডদের সম্পর্কে যত আর্টিকেল আছে তার সব পাঠ দিয়ে। আর এখন এসে থেমেছে অটিস্টিক অ্যাডাল্টদের আর্টিকেলে। পৃথিবীর নানা রকম অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার মানুষদের কত রকমের ঘটনা দিয়ে ভরা ইউটিউব। আজ কিছুদিন যাবৎ ইউটিউবের প্রতি অদ্ভুত এক নেশা তৈরি হয়েছে। নানা রকমের ভিডিও দেখতে দেখতে পার হয়ে যায় মধ্যরাত পর্যন্ত। কখনো টিভি সিরিয়াল, কখনো মুভি, কখনো গান, কখনো সেমিনার লেকচার। এই সবই যেন সারা দিন কাজ করে রাতে বাড়ি ফেরার পর একমাত্র বিনোদন। 

ওকে কম্পিউটারের সামনে দেখলেই রওশন আরা মিনুর শুরু হয় আর এক রকম খ্যাপামি। ঘরের ভেতরে তখন সে অকারণে সৃষ্টি করে জটিল কিছু সমস্যা। এটা সেটা ছুড়ে ফেলা, ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে বিরতিহীন ঝগড়া বাধানো। এসব যেন হয়ে উঠেছে নিয়মিত বিষয়। 

সেদিন সার্চ করতে করতে হঠাৎ এসে ধরা দেয় নিক ভুজিছিছ নামের যুবকটি— নিক ভুজিছিছের শুধু শরীরটুকু আছে, কিন্তু হাত নেই। পা নেই। এমন কঠিন পঙ্গুত্ব নিয়ে নিক ভুজিছিছের জন্ম। এবং জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠা। কিন্তু ওর আছে চমৎকার সুন্দর মোহনীয় হাসি ভরা চেহারা। তীক্ষ্ন বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখ, কথা বলার আকর্ষণীয় ভঙ্গি। এইসব গুণ তার জীবনে এনেছে প্রেম, বিয়ে, সন্তান। এবং সার্থক মটিভেশনাল স্পিকার হওয়ার যোগ্যতা। ইউটিউব ভরা নিক ভুজিছিছের জীবন নিয়ে একের পর ভিডিও। আজ নিক ভুজিছিছ পৃথিবীবিখ্যাত মটিভেশনাল স্পিকার। নিকের দেহে জরুরি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হাত পা কিছুই নেই, কিন্তু তারপরও নিক ভুজিছিছ জীবনে প্রেমিকার প্রেম পেয়েছে। প্রেমের সার্থক পরিণতি পেয়েছে। প্রেমিকা হয়েছে স্ত্রী। পঙ্গুত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করার পরও পেয়েছে পিতৃত্বের অনাবিল আনন্দ আর অহংকার। শরীরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অভাব থাকলেও জীবনে প্রেম আসার পথে অন্তরায় হয় না। সার্থকতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করা যায়—এই সবই নিক ভুজিছিছের মটিভেশনাল বক্তব্যের বিষয়।  

সার্থকাতার চূড়ান্ত তার জীবন। অর্থাৎ আছে অর্থ, সচ্ছল জীবন, নিজের পরিচিতি আর মানুষের ভালোবাসা। যা থাকলে জীবনে সুন্দরী প্রেমিকা আসে, বিয়ে আসে, আসে স্ত্রী সন্তান। সবকিছুর সুখ আনন্দ। কিন্তু যদি চেতনা না থাকে! যদি বুদ্ধির বিকাশ না থাকে? বুদ্ধি চেতনাবিহীন মানুষের জীবন! একখানা দীর্ঘশ্বাস বুক কাঁপিয়ে বের হয়ে আসে। এলোমেলো ভাবনায় আচ্ছন্ন সফিক আহমেদ ইউটিউবে তন্ময় হয়ে থাকে। নিজের অজান্তে চোখ দুটো হয়ে ওঠে অশ্রুসজল। ইচ্ছা হয় অবুঝ শিশুর মতো ডুকরে কাঁদতে। একা একা পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলে—আল্লা, তুমি আমার দীপ্তকে পঙ্গুত্ব দিতে নিক ভুজিছিছের মতো। তারপরও যদি তুমি ওর বুদ্ধি দিতে! ওর শরীরের এত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকতে তোমার আক্রোশ কেন ওর ব্রেনের ওপর পড়ল?

কষ্ট হয় দীপ্তের জন্য। নিজের সন্তানের জন্য। এক সময় এমন কষ্ট হতো জুলেখার আপার জন্য। জুলেখা বড় ফুফুর একমাত্র মেয়ে। আদর করে বড় ফুফা ডাকত জুলি। জুলি ডাকার কারণে পরবর্তীতে সে বাড়ির সব বয়োজ্যেষ্ঠর জুলি আর বয়োকনিষ্ঠ ভাইবোনের জন্য হয়ে যায় জুলিপা। সংক্ষেপে আপার আ তুলে দিয়ে শুধু পাটুকু সঙ্গে লাগিয়ে বাড়ির সব ছোটরা ডাকত জুলিপা। জুলি আপার জন্ম আর জন্ম-পরবর্তী ইতিহাস দীপ্তের সঙ্গে অনেক মিলে যায়। ফুফু বলত জন্মের পর কঠিন টাইফয়েড আর হামে একসঙ্গে ভুগে আমার জুলি পাগল হয়ে গেল। হতেই পারে হাম, মিজেল, টায়ফয়েড এই সব অসুখে ব্যবহার করা কঠিন ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় অটিজম সিনড্রোম।

তাই যদি না হতো তাহলে জুলিপা হতো রাজরানি। রূপকথার রাজকন্যার মতো সুন্দরী হয়ে জন্ম নিয়েছিল জুলিপা।  কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস জুলিপা রাজরানি তো দূরের কথা বাড়ির সাধারণ একজন সদস্য হতে পারেনি। দীপ্তের জন্মের পর সফিক আহমেদ বুঝতে পেরেছিল জুলিপা পাগল নয়। জুলিপা ছিল অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের রোগী। কিন্তু জুলিপার ভাগ্যে জোটেনি দীপ্ত অথবা কানাডার অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুদের মতো সুযোগসুবিধা। বুদ্ধি হয়ে পর্যন্ত সফিক আহমেদ দেখেছে বাড়ির একেবারে পেছনে, আলমারির মতো ছোট্ট একটা রুমে জুলিপাকে লুকিয়ে রাখা হতো সংসারের অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মতো।   জন্মের পর জুলিপা কখনো বের হয়নি বাড়ির বাইরে। বের হয়নি মানে ওকে বের করা হয়নি। বা বের হতে দেয়া হয়নি। জুলিপার মতো সুন্দরী নারী আজও চোখে পড়েনি সফিক আহমেদের। এত রূপ না দিয়ে বিধাতা ওকে যদি ওর ব্রেনের কোষগুলো সচল রাখত। যদি জুলিপাকে সুস্থ স্বাভাবিক বুদ্ধির মানসিক বিকাশ দিত! জুলিপার সেই অপরূপ সুন্দর মুখখানি স্মরণে এলে সফিক আহমেদকে প্রায়ই বিষণ্ন করে তোলে।

দুপুরের গোসল আর খাওয়ার পর ঘরের মেঝেয় শীতল পাটির ওপর বসিয়ে রাখা হতো। তখন দেখে মনে হতো একখানি মূর্তি বেদি থেকে তুলে এনে মেঝের ওপর রাখা হয়েছে। মাথা ভরা ঘন কালো লম্বা চুল কোমর ছাড়িয়ে গেছে। সেই চুল শুকানোর জন্য জানালা দিয়ে আসা রোদের ওপর পিঠ পেতে চুল মেলে বসে থাকত জুলিপা। গোসল দিয়ে খাইয়ে দাইয়ে ওভাবে বসিয়ে রাখা হতো রোদে। বসার কায়দাটা অদ্ভুত রপ্ত করেছিল জুলিপা। দুপুর গড়িয়ে বিকাল পর্যন্ত জুলিপা ওভাবে বসে থাকত চিত্রে আঁকা ছবির মতো।  

মেট্রিক পরীক্ষার পর যখন বন্ধুরা অফুরন্ত সময় বেহিসেবির মতো ব্যয় করে বেড়াচ্ছে আড্ডা, সিনেমা, ভ্রমণ, খেলাধুলা ইত্যাদিতে। তখন সফিক আহমেদের আকর্ষণ ছিল একেবারে আলাদা। বন্ধুদের আড্ডা না, সিনেমা না, বই না, খেলা না, চুম্বকের মতো টানত জুলিপা। প্রতিদিন দুপুরের ভাতটুকু তাড়াহুড়া করে খেয়ে ঘোরলাগা এক কিশোর দুরন্ত গতিতে সাইকেল চালিয়ে ছুটে আসত বড় ফুফুর বাড়ি। বড় ফুফু আমি জুলিপাকে লেখাপড়া শেখাব। আমি রোজ জুলিপাকে পড়াতে আসব।

ওরে আমার পাগল মানিক রে, পাগলি বুইনকে কি আর পড়ালেখা শেখাতে পারবি? 

না বড় ফুফু তুমি পাগলি বলো আর যাই বলো—জুলিপার অনেক বুদ্ধি। তুমি দেখেছ কী সুন্দর ছবি আঁকে জুলিপা? যা দেখিয়ে দিই সেইটেই তো আঁকে হুবহু। 

তা, যা, তোর যদি মনে হয় পারবি তোর পাগলি বুইনকে পড়ালেখা শিখাতে যা শিখাগে। তোর তো এখন পরীক্ষা শেষ, করগে মাস্টারি। মুখের কথা শেষ করতে পারে না বড় ফুফু।

হাতে খড়ি পাওয়া শিশুদের মতো জুলিপাকে ভেঙে ভেঙে একটা করে অক্ষর শেখাত সফিক আহমেদ। তোতলায়ে তোতলায়ে জুলি আপা অনেক কথা বলতে শিখেছিল। শিখেছিল গালের ওপর হাত রেখে ছবি আঁকতে। অদ্ভুত ছবি আঁকত জুলিপা। যে কোনো ছবি এনে সামনে দিলে পেন্সিলের স্কেচ করে হুবহু এঁকে ফেলত। আহা যদি জুলিপাকে শেখানো যেত তাহলে হয়তো পৃথিবীর সেরা চিত্রশিল্পী হতে পারত জুলিপা। যেমন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক কেনজাবুড়ো ওয়ির ছেলে অটিজম স্পেকট্রাম সিনড্রোমের হওয়ার পরও পৃথিবীর সেরা পিয়ানো সুর সৃষ্টিকারীদের একজন হয়েছে! কেনজাবুড়ো ওয়ির ছেলের পিয়ানোর প্রতি আকর্ষণ কেনজাবুড়ো ওয়ি লক্ষ করেছিল তার শিশু বয়স থেকেই। ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিল পিয়ানো। রেখেছিল বাড়িতে পিয়ানো শেখানোর গৃহশিক্ষক। নিজেও জানত পিয়ানো বাজাতে। পাশে বসিয়ে ছেলেকে শিশু বয়স থেকেই পিয়ানোয় বসিয়ে আনন্দ দিত। 

একখানা চিরুনি দিয়ে জুলিপার কোমর পর্যন্ত ঘন কালো চুল পাটে পাটে আঁচড়ে দিত সফিক আহমেদ। খুব ভালো লাগত জুলিপার চুল আঁচড়ে দিতে। সেই আঁচড় যেন জুলিপার চুলে না, সফিকের ভালো লাগার অনুভূতির ওপর দিয়ে চিকন চিকন দাগ কেটে যেত। চুল আঁচড়াবার সময় কতদিন জুলিপার ঘাড় ছুঁয়েছে সাবধানে। দরজার দিকে চোরের মতো দৃষ্টি ফেলেছে ঘনঘন। বহুদিন ওর হাতখানি লোভি হয়ে উঠেছে কাঁধের পাশ দিয়ে আরও একটু নামিয়ে দিতে। জুলিপার গলার নিচটা সামান্য একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য আনচান করেছে দেহ মন। কিন্তু ভাবনাটুকুই!  অসাবধানতার ভান করে হাতটাকে গলা থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে অথবা একটুখানি পাশ দিয়ে নামতে সাহস হয়নি। এত ভীরু কেন ছিল সে! সফিক আহমেদ আজ অবাক হয়ে ভাবে। নিশ্চয় দুর্দান্ত সাহসী ছিল বড় ফুফার ভাইয়ের সেই হারামি ছেলেটা। মানে জুলিপার চাচাতো ভাই। বহুবার দেখেছে, জুলিপাদের বাড়িতে। তখন তার দুঃসাহসের কোনো নমুনা সফিকের নজরে আটকায়নি। কিন্তু যে কাজ সে করে গেল বাড়ি ভরা এত মানুষ থাকতে ওকে তো দুঃসাহসী বলতেই হবে! নাহ্ আসলে দুঃসাহসী না। ও ছিল এক হারামজাদা কামুক বেইমান। কী হতো জুলিপাকে ভোগ না করে ভালোবাসলে! কী হতো জুলিপাকে বিয়ে করে বউয়ের মর্যাদা দিলে! 

আচ্ছা জুলিপার কেমন লেগেছিল সেই মিলন। সেই সংগম! না মিলন বলা যায় না! সংগম বলাই যথাযথ। সংগম শব্দটার সঙ্গে মনের কোনো রকম মিলের প্রয়োজন হয় না। ভালোবাসার প্রয়োজন হয় না। দুজনের প্রেমের পরিণতি মিলন। আর সংগম একজনের বলপূর্বক বা প্রতারণারও পরিণাম হতে পারে। সংগম জুলিপার দেহে সেই তো প্রথম অনুভব। জুলিপার কি খুব ভালো লেগেছিল? সেটা কি সংগম ছিল নাকি ধর্ষণ? তখন তো জুলিপা শরীর ভরা টলটলে যৌবন। এমনকি হতে পারে সেটা ধর্ষণ হয়নি! জুলিপার বেশ ভালো লেগেছিল সেই অনুভূতি। শুধু একবারই কি ঘটেছিল? নাকি অনেক রাত, অনেকবার? আর জুলিপা কি অনেক সুখ পেয়েছিল! ঠিক যেমন সুখ দীপ্ত পায় ওর মাস্টারবেটিংয়ে! এই কানাডাতে মেয়েদের মাস্টারবেটিং নিয়েও তো ওপেন কথাবার্তা, আলোচনা কোনো ব্যাপার না। জুলিপা তো আর দীপ্তের মতো মাস্টারবেটিংয়ের সুখ পায়নি। কিন্তু তাই বলে তো জুলিপার দেহের প্রয়োজন ছিল। যেমনটি আজ দীপ্ত পেল! গোঙাতে গোঙাতে যেভাবে দীপ্ত বলে ড্যাডিইই...ড্যাডিইইই...ডাটিইইই...গুউউউদ...। এ দেশে আসার পর জেনেছে এখানে মেয়েরাও মাস্টারবেটিং করে।  তার আগে এ বিষয়ে একেবারেই গণ্ড মূর্খ ছিল সফিক আহমেদ।  

সেই দিনেগুলোতে সফিক আহমেদ লক্ষ করে মেঝেতে বসে জুলিপা দরজার দিকে ঘাড় কাত করে বসে থাকত। সফিক আহমেদের গালে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জুলিপা কী অনুভব করত? সফিক আহমেদের গাল! জুলিপার কি খুব ভালো লাগত নতুন দাঁড়ি গজানো পুরুষগাল ছুঁয়ে দেখতে! আজও চোখ বন্ধ করে সফিক আহমেদ জুলিপার হাতের স্পর্শ অনুভব করে গালের ওপর। সফিক আহমেদকে দেখলে জুলিপার চোখ দুটোতে খুসি আনন্দ উপচে উঠত একসঙ্গে।

আহা জুলিপা যদি দীপ্তের মতো স্পিচ থেরাপি পেত তাহলে হয়তো অনেক কথা বলতে শিখত। কত কথা আজ দীপ্ত বলে জড়িয়ে জড়িয়ে। সে তো শুধু স্পিচ থেরাপির কারণে। কানাডা বলে এই থেরাপি দিতে পেরেছে। কত রকমের সার্ভিস সারা কানাডায় অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে ভোগা শিশু, কিশোর, যুবক, এমনকি বুড়োদের পর্যন্ত। অটিস্টিক মানুষগুলোর জন্য সরকার অর্থ, প্রাইমারি কেয়ার গিভার কত কিছু দেয়। স্বাভাবিক মানুষদের মতো এদের জীবন যেন সবকিছু উপভোগের হয়। তাই সব রকমের সুযোগসুবিধা দিয়ে রেখেছে সরকার। কেয়ার গিভাররা প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে নিয়ে যাচ্ছে শপিং মলে সখের কেনাকাটায়। কেনাকাটা না থাকলে শুধু ঘুরে বেড়ানোয়। সামার এলে নিয়ে যাচ্ছে পার্কে, রিক্রিয়েশন সেন্টারগুলোতে। এরা পৃথিবীর সবকিছু উপভোগ করে। এদের জন্য সরকারের অভাব নেই কত রকম প্রজেক্টের। স্বাভাবিক শিশুকিশোর, যুবক, বৃদ্ধদের যা কিছু দেয়া হয় তার সবই দেয়া হয় এদেরকে। সরকারের সুন্দর ভাবনারই যেন ভাবনার অভাব নেই এদের জন্য। এরা মানুষ। অটিস্টিক স্পেকটার্ম ডিজঅর্ডার একটা কন্ডিশন মাত্র। পৃথিবীর সব সুন্দর অসুন্দর সবকিছুর ওপর ওদের অধিকার। এমন করে বাংলাদেশের মানুষেরা কবে ভাবতে শিখবে! 

দিনের আলো, খোলা আকাশ, রাতের জোৎস্না, জোনাকি, ঝমঝমে বৃষ্টি, সুবজ মাঠ, গাছ, পাখি, নদী, বিল, মানুষ প্রকৃতির সুন্দরের কিছুই উপভোগ করতে দেয়নি জুলিপাকে তার বাবা-মা। শুধু সামাজিক লজ্জা লুকানোর জন্য জুলিপাকে জন্মাবধি বাড়ির পেছন কোণায় গোপন কক্ষের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। যেমন লুকিয়ে রাখা হয় সংসারের ভাঙাচোরা অপ্রয়োজনীয় বস্তু আসবাবপত্র ইত্যাদি। তেমনি জুলিপাকে একেবারেই লুকিয়ে রাখা হতো।  জুলিপা ছিল বাড়ির অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাসিত, অপ্রদর্শিত জড়বস্তুর মতো। 

রাতের নির্জনতায় নিদ্রাহীন সফিক আহমেদের আজ খুব ভালো লাগে জুলিপাকে নিয়ে ভাবতে। চিত হয়ে শুয়ে ছায়াচিত্রের মতো জুলিপাকে নিয়ে ছোটবড়, আস্ত ভাঙাচোরা টুকরো টুকরো সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন করতে। পুরনো অ্যালবামের মতো একের পর এক পাতা উলটে ঝাপসা ছবিগুলোর ওপর ঝুঁকে থাকতে।   

হাতের কড়ায় গুনে জুলিপা বয়সে দশ বছরের বড় ছিল সফিক আহমেদের। সফিক আহমেদের বয়স তখন আনুমানিক পনেরো বছর। পনেরো বছরে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল বয়স বাড়িয়ে ষোলো করে। হঠাৎ বাড়িতে বড় ফুফুর এবং ফুফার যাতায়াত বেড়ে গেল অস্বাভাবিকভাবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে কী যেন জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আসে সকাল, বিকাল, দুপুর। ফুফু এবং ফুফা দুজনেরই চেহরায় সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা আর যন্ত্রণা। ফুফু তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত আর মাকে উদ্দেশ করে বলত—ভাবি, তোমরা আমাকে একটু সাহস দেও, আমি পারব। এক ডোজ দিয়ে দিই, চুকে যাক ঝামেলা। লজ্জা অপমানের বোঝা আর বইতে হবে না। আর পারি না আমি এই যন্ত্রণা সহ্য করতে। অনেক হয়েছে, এবার পাগলি চলে যাক দুনিয়া ছেড়ে। এই যন্ত্রণা, এই বোঝা, এই লজ্জা আর যে টানতে পারছি না। পরিবারের কাছের মানুষদের সামনে ফুফু জুলিপাকে পাগলি বলে ডাকত। মা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে বলত—হাশরের মাঠে কী বলে আল্লার কাছে জবাব দিবি? নিজের সন্তান পাগল হয়েছে বলে তাকে নিজের হাতে বিষ দিয়ে হত্যা করেছিস? ওলো কাঁদিসনে, কাইন্দে কিচ্ছু হবে নানে! আল্লা বিপদ দিইয়েছেন, আল্লাই আছান দেবেন! 

কী বিষয় নিয়ে বাবা-মা, ফুফু ফুফা এত আলোচনা করছে? কোথায় যেন অশনি সংকেত! গোপনে কান পেতে সফিক আহমেদ এইসব বৃত্তান্ত জানতে পারে—ফুফার ভাইয়ের ছেলে, অর্থাৎ জুলিপার চাচাতো ভাই জুয়েল এসেছিল বেড়াতে। জুলিপাকে রাতের অন্ধকারে গোপনে ভোগ করে পালিয়ে গেছে। জুলিপা কিছুই বলতে পারেনি। কে তাকে গর্ভবতী করেছে, কীভাবে করেছে? ধর্ষণ, অন্তঃস্বত্ত্বা, গর্ভধারণ, সন্তান, মাতৃত্ব এ সমস্ত বিষয় অবুঝ শিশুর মতো বুদ্ধিসম্পন্ন জুলিপার বোধের বাইরে ছিল। ফুফু ও ফুপা যখন জানতে পারে জুলিপা গর্ভবতী তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভ্রূণ থেকে বেড়ে প্রায় অবয়ব ধারণ করে ফেলা শিশুর গর্ভপাতে খুব কষ্ট পেয়েছিল জুলিপা। গর্ভপাতের পর ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে জুলিপা প্রায় চলে গিয়েছিল মৃত্যুর কাছাকাছি। হয়তো ফুফু এবং ফুফা দুজনেই গোপনে প্রার্থনা করেছিল জুলিপার মৃত্যু। হয়তো সেদিন মৃত্যু হলে ফুফা ফুফু পরিত্রাণ পেত সামাজিক লজ্জা থেকে। মাতৃত্ব বিসর্জনের ঝক্কি ও লজ্জা সামলে জুলিপা মৃত্যুকে জয় করেছিল সফিক আহমেদের মায়ের যত্নের কারণে। ফুফু আবার তখন সফিকের মাকে বলত—ভাবি সেবাযত্ন দিয়ে কী লাভ করলে, একটা বোঝা হালকা হতে দিলে না।  

সফিক আহমেদের আজও মনে পড়ে রক্তহীনতায় দুর্বল জুলিপার সেই ফ্যাকাসে মুখখানি। বাড়িতে সেই সময় মৃত্যুর চাইতে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছিল সামাজিক লজ্জা। প্রাণের চাইতে প্রিয় হয়ে উঠেছিল সামাজিক সম্মান। সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়ে যে যন্ত্রণাকাতর দিন কেটেছে ফুফা ফুফুর মনে হয় তার চাইতে তাদের মৃত্যু ছিল কম কষ্টের।

আল্লা তুমি আমাকে নিয়ে যাও। তোমাকে এত ডাকি, তুমি যদি আমার ছেলেরে ভালো করে না দাও, তাহলে আমার মৃত্যুর সঙ্গে তুমি আমার ছেলেকেও তুলে নাও। দীপ্তের মৃত্যু কামনা করে রওশন আরা মিনু যখন আল্লার কাছে এভাবে দিনরাত প্রার্থনা করে তখন সফিকের মনে পড়ে জুলিপার জন্য ফুফা ফুফুর সেই সব প্রার্থনার দিনগুলো। 

সফিক আহমেদ যখন ছেলেকে হস্তমৈথুন শেখাতে নিচের তলায় নেমে যায় তখন রওশন আরা মিনু দ্রুত অজু সম্পন্ন করে বসে পড়ে জায়নামাজে। চার রাকাত নফল নামাজ পড়ে মোনাজাতের উদ্দেশে হাত তুলে ভেঙে পড়ে কান্নায়। আর ক্রমাগত আল্লার উদ্দেলে বলে—আল্লা...আল্লা...আল্লাগো—আর সহ্য হয় নাগো আল্লা...হয় তোমার কেরামতি দেখাও। তোমার ক্ষমতা দেখাও। তুমি আমার সন্তানকে সুস্থ করে দেও। আর না হলে তুলে নিয়ে যাও দুনিয়া থেকে। এই লজ্জা, এই শরম, এই কষ্ট আর সহ্য হয় না মাবুদ। মোনাজাতে তোলা দুই হাত ক্রমশ কান্নার ভারে নুয়ে আসে। মোনাজাত শেষে রওশন আরা মিনু জায়নামাজে উপুড় হয়ে কাঁদতে থাকে ডুকরে ডুকরে বিরতিহীন।   

এই রকম বুক ভাঙা আর্তকান্না প্রতিরাতে এশার নামাজ আদায়ের পরে পরিণত হয়েছে রুটিনে। এই অসহায় কান্নার শুরুতে সফিক আহমেদ ছুটে আসত স্ত্রীর পাশে। ভালোবাসা আর সোহাগ ভরা কথায় সান্ত্বনা দেয়ার প্রয়াস চালাত। এখন অবশ্য মিনুর কান্নায় বিহ্বল হয় না সফিক আহমেদ। আজও প্রতিরাতের নিয়মে ক্রমে কমে আসে কান্নার রেশ। এ সময় হঠাৎ রওশন আরা মিনুর মনে পড়ে ছোটবোন রওনক আরা ঝিনুকে ফোন করার কথা। দ্রুত জায়নামাজ ছেড়ে উঠে আসে। কিছুদিন যাবৎ রওশন আরা মিনুর মাথার ভেতরে নতুন এক ভাবনার উদ্ভব ঘটেছে। ভাবনাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে যায় স্বামীর কাছে। আবেগে আপ্লুত হয়ে স্বামীকে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপে উঠেছিল সফিক আহমেদ—কী জঘন্য নোংরা তোমার ভাবনা মিনু? কী করে সম্ভব হলো এভাবে ভাবতে? তুমি দেশ থেকে গরিবের মেয়ে বিয়ে দিয়ে আনবে দীপ্তর সাথে? তার অর্থটা কী তুমি ভেবে দেখেছ?

সফিক যতই বিরোধিতা করুক তার কিছু আসে যায় না। সে যদি দীপ্তর জন্য একটা গরিবের মেয়ে বিয়ে দিয়ে নিয়ে আসতে পারে তাহলে অনেক ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে। বিশেষ করে দীপ্ত অ্যাডাল্ট হওয়ার পর এই মাস্টারবেটিংয়ের কাজটা! এমন নোংরা কাজ বাবা-মাকে শেখাতে হচ্ছে। অ্যাটলিস্ট দীপ্ত শারীরিক সুখ তো পাবে। আর তা ছাড়া দীপ্তের সেবাযত্নে জন্য একান্ত কাছের একজন আপন মানুষ থাকবে। রাতে সেল ফোনটা কোথায় রেখেছে খুঁজে পায় না। তছনছ করে খুঁজতে থাকে সেটাকে। অনেকটা সময় ধরে খোঁজার পর সেটাকে পায় বেড  সাইড টেবিলের ড্রয়ারে। তাড়াতাড়ি সেটাকে হাতে তুলে ফোন করে ছোট বোন রওনক আরা ঝিনুকে। বাংলাদেশে তার যোগাযোগের এখন একমাত্র অবলম্বন রওনক আরা ঝিনু। দেশের যত রকমের কাজকাম সব করে দেয় ঝিনু। একটা ফোনের অপেক্ষা মাত্র। বড় বোনকে কখানোই হতাশ করে না।

হ্যালো ঝিনু, কেমন আছিস? বাবা কেমন আছে?

আমি ভালো আছি, তবে বাবার শরীর তো খুবই খারাপ। গতকালও বাসায় নার্স এনে স্যালাইন দিতে হলো। এখনও স্যালাইন চলছে। তোমরা কখন আসতেছ? টিকিট বুকিং দিয়েছ?

না, আমি ভাবছি যদি বাবার শরীরটা একটু ভালো হয় তাহলে সেপ্টেম্বরের দুই তারিখের পর আসব। তখন টিকিটের দাম কমে যায়। এখন তো এখানে সামার। হাই সিজন। এই সময় টিকিটের দাম থাকে অনেক বেশি। আল্লা আল্লা করছি, বাবা একটু ভালো থাকলেই হইল।

দেখো তোমার যা সুবিধা হয়। তবে বাবার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। হাসপাতাল থেইকা বলছে যে কয়দিন আছে বাসায় রাখেন। ভালোমন্দ যা খাইতে চায় সেইটা খাওয়ান। পায়খানা পেচ্ছাব সবই তো বিছানায় করতাছে। দুই চামচ জাওয়ের ভাত ছাড়া তো কিছুই মুখে লয় না সারা দিনে। এরপরে তো আর কোনো আশা পাই না আপা। যখন তখন দুঃসংবাদটা শুনবা। টিকিটের অল্প কয়ডা টাকা বাঁচানোর জন্য বেশি দেরি কইর না আপা, তখন আবার পস্তাইবা।

না, না, ঠিক আছে তাইলে, কাল সকালেই আমি ট্রাভেল এজেন্সিতে কথা কইয়া টিকিট করতাছি। শোনো না ঝুনু, আমি একটা জিনিস ভাবছি আইজ কয়ডা দিন হইল। তুই আমাকে একটু হেলপ করবি? বোইন না, আমার লক্ষ্মী বোইন। তুই ছাড়া আমার বুকের ভিতরের লুকানো কষ্টডা কেউই বোঝে না। স্বামী তো বদলাইয়া গ্যাছে পোলার অসুখডা জানোনের পরই। তারে কানাডায় কয় হাউজ মেট। স্যায় তো এখন আমার হাউজ মেট, বুঝোস না! আর না হইলে অফাদার অব মাই চাইল্ড। মানে হইল আমার পোলার বাবা বুঝলি?

থাক ওইসব কথা আপা, আসল কথা বলো কী হেলপ করতে হইব?

 আমি ভাবছি আমার দীপ্তের জন্য যদি একটা গরিবের মেয়ে পাইতাম, তাইলে ওরে একটা বিয়ে দিতাম। 

কিন্তু আপা, দীপ্ত তো বিয়ার কিছুই বুঝে না? ওর কি বিয়া বইলা কোনো অনুভূতি আবেগ এইসব কিছু আছে? মানে হইল তুমগো দেশের ভাষায় কোনো ফিলিংস আছে?

রওশন আরা মিনু এপাশে সামান্য একটা তোতলায়। এ্যা এ্যা করে বলে—আসলে বিয়া প্রেম এইসব বিষয়গুলো বুঝে না। তুই ঠিকই কইছস। কিন্তু শরীরের কন্ডিশন তো স্বাভাবিক যুবকদের মতো। বুজিস না? জোয়ান মর্দ পোলাগো মতো। এখন সাবালক হইছে। শইললে যে যৌবন আইছে একেবারে স্বাভাবিক জোয়ান মর্দ পোলাগো মতোই। তুই তো জানোস দীপ্ত কত হ্যান্ডসাম। এখন আরও ম্যানলি হয়েছে রে আমার দীপ্ত দ্যাখতে। ওকে দ্যাখলে চোখ দুইটা একদম জুড়াইয়া যায় রে ঝুনু। যেহেতু ওর শরীরের গ্রোথ বেশি তাই এখন দেখতে এক্কেবারে হিন্দি সিনেমার নায়কগো মতো দেখায়। ভেরি ভেরি হ্যান্ডসাম ছেলে আমার। এখন ঠিক বিয়ের বয়স হইছে। আর বুঝোস না, শরীলের গ্রোথ ভালো বইলা বায়োলজিক্যাল নিডটা দ্যাহা দেয় যহন তহন। কিছুটা আমতা আমতা করে আবার বলে—আসল কথাটা কি বোঝাইতে চাইতাছি বুঝতে পারছস? বুঝলি না? মানে স্যাক্সট্যাক্সের ব্যাপার এইডা আর কি!

অপর প্রান্ত থেকে ঝুনুর উত্তর বেয়ে আসে সেইটা তো বুঝলাম আপা। কিন্তু আসল ব্যাপারডা হইল, ত্যামন মাইয়া তো খুঁইজা পাওনডাই কঠিন। জাইনা শুইনা একটা মানসিক প্রতিবন্ধী পোলারে কোনো মাইয়া বিয়া করতে চায় বলো? আইজকাইল তো আর মাইয়াগোরে জোর কইরা বিয়া দ্যাওন যায় না। আর এ্যামুন কোনো গরিবও মা-বাপও পাইবা না জাইনা শুইনা এ্যামুন পোলার ধারে মাইয়ারে বিয়া দিব। তারপরও আমি চোখকান খোলা রাখমুনে। 

শোন তুই আমার দীপ্তরে মানসিক প্রতিবন্ধী বলতাছস ক্যান? ওমনে কইস না। আমার খুব কষ্ট হয়। ও তো একদম পুরাপুরি প্রতিবন্ধী না। অনেক কিছু বুঝে, গান বুঝে, সিনেমা বুঝে, কম্পিউটারে অনেক ফাইল ওপেন করতে পারে। ওর শরীর স্বাস্থ্য খুব ভালো। আর আমার মনে হয় আমার ছেলে প্রেম ভালোবাসা জিনিসটাও বুঝে।  যদি একটা মেয়েরে বউ বা প্রেমিকার মতো কাছে পায় হয়তো প্রেম ট্রেমের মতো ব্যাপারডাও কিছুটা বুঝব!   

না, না, আপা, সরি, তুমি ভুল বুইঝো না। আমি দীপ্ত আব্বুরে সোনার চান্দরে মানসিক প্রতিবন্ধী বলতাছি না। কিন্তু বিয়ার প্রস্তাব নিয়া গেলে ওদের তো জানাইতে হবে দীপ্তের ব্যাপারটা? কী বলো? রাখ ঢাক কইরা আর যাই হউক বিয়ার ব্যাপার তো হয় না। তার ওপরে এই রকম প্রতিবন্ধী পোলার বিয়ার ব্যাপার তো অসম্ভব। বুঝলা না?

শোন ঝুনু, আমার ছেলে অটিস্টিক, স্লো। কিন্তু তোরা যেইটাকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলিস সেইটা না। আমার ছেলে অনেক কিছু বুঝে। ও যা বুঝে সেগুলা অনেক স্বাভাবিক মাইনষেও এত্তো ভালো বুঝে না। আমি জানি আমার পোলারে বাংলাদেশের অনেকে পাগল কইব। আসলে আমার পোলা পাগলও না, বুদ্ধি প্রতিবন্ধীও না। আমার পোলা বুঝেসুঝে একটু দেরি কইরা।

না না আপা, ছি ছি, আপা প্লিজ তুমি ভুল বুইঝো না, আমি সেইটা বলি নাই, তোমার পোলা আর আমার পোলায় ফারাগডা কী আপা? কইতে আছিলাম যে...

আইচ্ছা, বুঝছি, শুন, তুই যার কাছে প্রস্তাব নিয়া যাইবি, হ্যাগোরে বলবি যে ছেলের বুদ্ধিসুদ্ধি একটু হালকা মানে সহজ সরল। কোনো কিচ্ছু নিয়া প্যাঁচ খ্যালে না, প্যাঁচপুচ বুঝেও না, ঝামেলাও করে না। এইভাবে বলবি। এমন কইরা বললে মিথ্যাও বলা হইব না। আবার ফাঁকিও দেয়া হইব না। বুঝলি না? আর বলবি বিয়ার পর মেয়েকে আমরা কানাডা নিয়া আসব। বনানীতে আমাদের যে ফ্ল্যাটটা আছে সেইটা, আর উত্তরাতে আমাদের যে দুইটা প্লট আছে তার একটা মেয়ের নামে লিইখা দিমু। আর বলবি যে আমাদের একমাত্র ছেলে দীপ্ত। আর কোনো সন্তান বা ওয়ারিশ নাই। আমাদের কানাডার দুইটা বাড়ি, আমাদের দুইটা গাড়ি, টাকাপয়সা সবকিছুর উত্তরাধিকার সে। মানে মালিক হইব আমাগো দীপ্ত। তার মানে হইল দীপ্তের লগে যার বিয়া হইব, সে-ই হইব এই সবের মালিক। এত কিছু দিতে চাইলে কি গরিবের মাইয়ার অভাব হইব? তুই কঅ! বাংলাদেশে তো আশি বছরের বুইড়ারা চৌদ্দ পনেরো বছরের মাইয়া বিয়ে কইরা আনতেছে গরিবের ঘর থেইকা। কী কঅ আনতেছে না? বল?

ঠিক আছে আপা, ঠিক আছে। বুঝতে পারছি, তুমি তো আগে কখনো আমারে এইভাবে কও নাই। এখন বললা,  আমি আজই খোঁজখবর লাগামুনে। যদি ঠিকমতো না পাই তাহলে একটা প্রফেশনাল ঘটককে লাগামুনে। আমি কয়ডা মহিলা ঘটকরে চিনি। ঠিকই খুঁইজা বাইরা কইরা নিতেও পারুমনে আরও দুই চাইরডা। আর আমার মনে হয় জমিজমা, টাকাপয়সা শুধু মেয়ের নামে না, মেয়ের বাপ-মায়ের নামেও যদি কিছু দিতে পারো তাহলে কাজটা আরও সহজ হইয়া যাইব।

এ্যাঁ, দ্যাখছস? অখন তরও মাথায় আইডিয়া আইতাছে। মাইনষে চাইলে সবই করতে পারে!

তুমি ঠিকই বলছ, বাংলাদেশে গরিবের মাইয়ার তো আর আকাল নাই আপা। তুমি তো জানো সুলতানা আপার ল্যাংড়া পোলার জন্য কেমন সুন্দরী বউটা পাইল। শুধু টাকাপয়সার জন্যই তো! মেয়ের বাবাকে ছয় কাঠা জমির ওপরে দোতলা দালান দিছে লালমাটিয়াতে। মেয়েরে গুলশানে বাড়ি দিছে। এত দিলে মেয়ের অভাব হয় আপা? ল্যাংড়া খোড়া সুমনের এখন সবার চাইতে সুন্দরী বউ। মেয়ের বাবা-মা আগে থাকত বস্তিতে এখন সোজা আইসা উঠছে মেয়ের গুলশানের বাড়িতে।  

শোন ঝিনু, আমার দীপ্তের জন্য এত সুন্দরী মেয়ের দরকার নাই। তুই সুন্দরী টুন্দরী খুঁজতে যাইস না। যেমন পাস, মানে কালোটালো, মোটাগোটা, বয়স হইয়া গেছে, সেগুলোতেও কুনো অসুবিধা নাই। মোটকথা যেগুলার বিয়ে দিতে বাবা-মায়ের কষ্ট হইতাছে এমনগুলা খোঁজ। বুঝস না, তাইলে টাকাপয়সার লোভে রাজি হইয়া যাইব। তারপর মনে কর কানাডার আসতে পারব এটাও বলবি। আর বলবি যে তাদের মেয়ে কানাডা আসার পর তাদের পুরা ফ্যামিলি মানে বাবা-মা ভাইবোন সবাইরে নিয়া আসতে পারব। দেখিস আমি বললাম, অনেক মেয়ে পাবি। কানাডা আসার লোভে পুরা গুষ্টিসুদ্ধা লাফ দিয়ে উঠব। তুই কি মনে করোছ?

তা বুঝলাম, টাকার লোভে না হয় গরিবের মাইয়া পাইলা। কিন্তু বিয়ে দিলেই কি কানাডা নিয়া যাইতে পারব? কানাডিয়ান সরকার কি ওদরে পুরা ফ্যামিলিকে ইমিগ্রেশন দিবে?

কেন পারব না? মেয়েটা যদি দীপ্তের লিগ্যাল ওয়াইফ হয় ওরা নিশ্চয় ইমিগ্রেশন দিব। আমি তো দীপ্তকে সাথে কইরা নিয়া আসমু। দীপ্তরে তো আর লুকাইয়া রাইখা বিয়া দিমু না। মেয়ে তো দেইখা শুইনাই দীপ্তরে বিয়া করব। বিয়ার পর পার্টি দিমু সেনা কল্যাণের মতো বড় জায়গায়। দুইপক্ষের আত্মীয়স্বজন সবাইকে দাওয়াত দিমু। ডকুমেন্ট থাকব সব ধরনের। আর আমরা তো অবশ্যই মেয়েটাকে শিখাইয়া দিমু সবকিছু। সে ইন্টারভিউতে বলব, দীপ্তকে সে ভালোবাইসা বিয়ে করছে। দেবে না ক্যান ইমিগ্রেশন? হ্যারা দিব, হ্যাগো বাপেরে দিতে হইব। তাছাড়া ইদানীং বহু মেয়ে মানবতা দেখানোর জন্য অটিস্টিক, ডিজঅ্যাবল, অনেক রকম সমস্যা আছে এদেরকে বিয়া করতাছে। মিডিয়ার বাহবা পায়, রাতারাতি সেলিব্রেটি হইয়া যায়। তুই খোঁজ লাগা, আমার মন বলতছে দীপ্তের বউ পাইতে অসুবিধা হইব না।

আইচ্ছা, ঠিক আছে আপা, তুমি তো কইলা, আমিও চেষ্টা কইরা দেখি। চেষ্টা কইরা দ্যাখতে তো আর অসুবিধা নাই!

শুন, তারপরও কাইল সকালেই আমি আমার পরিচিত ইমিগ্রেশন ল’ইয়ারের কাছে যামু। সবকিছু জানাইয়া আলাপ আলোচনা কইরা আসুম। চেষ্টা করতে তো দোষ নাই, দেখি না কী হয়? কী বলোস?

ঠিকই আছে। তোমার কথা তো মন্দ না। তুমি বড়পা একটা শিক্ষিত পিএইচডি আপা, তোমার বুদ্ধি কখখনো খারাপ হইতে পারে না। আমগো পুরা ফ্যামিলিতে তুমি হইলা গিয়া অন্য রকম আপা। তোমারে আপা সবাই অন্য রকম ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তুমি সোময় দাও আমারে। আমি খুঁইজা দেখি। পাওয়া হয়তো যাইতেও পারে। তবে ভালো কইরা খোঁজ লাগাইতে হইব এই যা!

বল না, ঝিনু, তুই তো আমার মায়ের পেটের বোইন। তুই তো আমার কষ্ট বুঝবি। আমি মইরা গেলে আমার দীপ্তরে আপনজনের মতো কে দ্যাখব? সেই চিন্তাতেই তো আমি সারা দিনরাইত আধা মরা হইয়া থাকি। কত কইরা আরেকটা বাচ্চা নিতে চাইলাম, হারামির ঘরের হারামিটা কিছুতেই দিল না। শুধু কইল যদি আবারও আরেকটা দীপ্ত হয়! এখন আমরা দুইজন মইরা যাওনের পর দীপ্তকে কে দ্যাখব এই দুইন্নাতে? ওর তো আপন বলতে কেউ থাকব না রে। যদি একটা বিয়াটিয়া দিয়া দুই-একটা বাইচ্চা টাইচ্চা হয় তাইলেও তো সন্তানগুলা বাবারে দ্যাখব। কী কছ? দীপ্ত বুড়া হইতে হইতে বাচ্চারা বড় হইয়া যাইব। তুই কিছু বল না রে বোইন আমার? হাহাকার করে আর্তের মতো বিলাপ করতে থাকে রওশন আরা মিনু এপাশে। 

আপা...আপা...শুনো, কাইন্দো না। শুনো আপা, আমি অবশ্যই খোঁজ লাগামু। তুমি আগে দ্যাশেতে আসো। দীপ্তকে নিয়া কিছুদিন থাকো। আল্লা চাহে তো হইতেও পারে কোনো মেয়ে দীপ্তরে ভালোবাইসা ফেলবে। ওকে নিয়ে দেশে এসে কয়েক মাস থাকো। দুই সপ্তাহের জন্য তাড়াহুড়া করতে আইসো না। হাতে সময় নিয়া আসো, আসতে আসতেই যদি যাওয়ার সময় হয়ে যায় তাইলে কিন্তু কাম হইব না আমি কইলাম। এইসব কামের লাইগা সময় লাগে। কোনো গরিবের মেয়ের সামনে বাড়ি, গাড়ি, কানাডার ইমিগ্রেশন এইসব টোপ ফেললেই শুধু হইব না। আমার মনে হয় একটা গরিবের মেয়েকে বাড়িতে কাজে রাখতে হইব। তারপর দীপ্তের দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়া ওরে টাকা পয়সা গয়নাগাটি উপহার দিয়া দিয়া ভুলাইতে হইব। মানে ওর সাথে প্রেম করাইয়া দিতে হবে।

আল্লা তোর অনেক ভালো করব রে বোইন। অনেক ভাল করব, আমি তোর জন্য অনেক দোয়া করমু। ঠিক আছে, তাই কথা থাকল, তুই আজ থেইকাই মাইয়া খোঁজন শুরু কইরা দে। আমি তাইলে আইজকা অখন রাখি। আবার কাইল পরশু ফোন দিমুনে। আব্বারে কইস আমি আসতাছি।

আচ্ছা আপা শুনো, তুমি আব্বার জন্য ডাইপার আইনো কিন্তু, ভাইয়া যেগুলি আনছিল সব শেষ হইয়া আসতেছে। আর শুনো, আসল কথা হইল তুমি কিন্তু চাইর ছয় মাস সোময় নিয়া আইসো।

আইচ্ছা, আইচ্ছা, আনমুনে, আমি কাইল থেইকেই কিছু কেনাকাটা শুরু কইরে দিমুনে। আর হ্যাঁ শুন, ঐ যে বললাম—মেয়ের কথা, যা পাস তাই সই। কিন্তু বাইচান্স যদি মোটামুটি ফর্সা টর্সা একটা পাস তাইলে তো সোনায় সোহাগা কী বলোস? ফর্সা টর্সা সুন্দরী যদি একটা মেয়ে পাই তাইলে তো আমি রাজরানির মতো সোনা দিয়া মুড়াইয়া আনমু আমার দীপ্তের বউরে। ডবল ধুমধাম কইরাই বিয়ার অনুষ্ঠান করমু।  

হ্যাঁ, হ্যাঁ আপা, আমাদের দীপ্ত। আমরাও তো দীপ্তকে অনেক ভালোবাসি। নিজের সন্তানের মতো। তুমি কী মনে করেছ? আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করমু যাতে সব থেকে ভালোটাই করতে পারি। তুমি চিন্তা কইর না। তুমি টিকিটের বুকিং দিয়ে ফেলো। আব্বার শরীর খুব খারাপ আপা।  

দুজনার দুটি নতুন প্রস্তাব
প্রতিদিন ফজরের নামাজের জন্য খুব ভোরে উঠে রওশন আরা। অজু করতে ওয়াশরুমে গেলে ওপর থেকে পানি গড়িয়ে নামার ক্রমাগত শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সফিক আহমেদের। ভোরের ঘুমের আমেজ ভাঙার কারণে সফিক আহমেদ খুব বিরক্ত হয়ে ওঠে রওশন আরার নামাজ পড়ার ওপর। অথবা কানাডার এই কাঠের তৈরি বাড়িঘর নির্মাণ পদ্ধতির ওপর। আত্মগতভাবে স্টুপিড টেকনোলজিকে গালি দেয়। এত উন্নত করতে পেরেছে অথচ ওপরতলার ওয়াশরুমের পানির শব্দ কন্ট্রোল করে বাড়ি বানাতে পারে না! যত্তসব, এর থেকে বাংলাদেশের বাড়ি তৈরির সিস্টেমই ভালো। 

আজও ওয়াশরুমের পানির শব্দ ঘুমের ভেতর লাফিয়ে প্রবেশ করলে সফিক আহমেদ ধীরস্থির অলস ভঙ্গিতে চোখের পাতা দুটো মেলে ধরে। কিন্তু ওর দুই চোখে তখন ঘুমের আবেশ জড়িয়ে নেই। শুধু কপালের মাঝখানে স্পষ্ট হয় কুঁচকানো কয়েকটা ভাঁজ। মনে হয় যেন কোনো এক যন্ত্রণাদায়ক দংশন। হাত বাড়িয়ে মাথার পাশ থেকে বাড়তি বালিশটা নিয়ে একবার কানের ওপর চেপে ধরে। একবার নামায়, একবার ডান পাশ, একবার বাঁ পাশ নানাভাবে চেপে ধরে। ডান বা বাম এভাবে ক্রমাগত পাশ বদলে বদলে শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বিছানা ছাড়ে। বিছানা ছেড়ে নেমে উঠে বসে তার রকিং চেয়ারে। হাত বাড়িয়ে বিছানার ওপর থেকে কমফোর্টার টেনে আপাদমস্তক মুড়ে দেয়। শিশুর মতো কমফোর্টারে নিজেকে মুড়ে ছোট ছোট দুলিনেতে দুলতে থাকে রকিং চেয়ারে অর্ধশোয়া অবস্থায়। দুলতে দুলতে আনমনা হতে থাকে।

ফজরের নামাজের পর কোরান শরিফের এক পারা শেষ। সাতবার সুরা ইয়াসিন, সাতবার আয়াতুল কুরছি পাঠ শেষে পানিতে ফুঁ দিয়ে রাখে। নেয়ামুল কোরান, মোকসেদুল মোমেনিন, আর পির হুজুরের দেয়া তরিকা অনুযায়ী এইসব সম্পন্ন করতে প্রায় সাতটা বাজে রওশন আরা মিনুর। দোয়া পাঠ শেষে পানিতে তিনবার ফুঁ দিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর পানির বাটি হাতে সে নেমে আসে নিচে। সযত্নে দীপ্তের মাথায় হাত দিয়ে তার ঘুম ভাঙায়। ইশারায় দীপ্তকে পানি পান করতে বলে। বছরের পর বছর একই নিয়মে পানি পান করে দীপ্তের এই ব্যাপারে একেবারে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে গেছে। কোনো রকম জেদাজেদি করে না। বাধ্য ছেলের মতো মায়ের দেয়া পড়া পানি পান করে।     

আজ রওশন আরা দোয়া পড়া পানির গ্লাস হাতে নিচে নেমে এলে সফিক আহমেদ কমফোর্টারে ঢেকে রাখা মুখটা উন্মোচন করে। দীপ্তকে ঘুম ভাঙানোর আগেই সে কোমল মোলায়েম ভালোবাসা ভরা কণ্ঠে ডাক দেয় মিনু, শোনো!

কী ব্যাপার কখন উঠছ? রাইতরে এইখানে ঘুমাইছ? বিছানায় ঘুমাও নাই?

ঘুমিয়েছি। ঘুম ভেঙে গেছে, কাছে এসো...। হাত দিয়ে বিছানার প্রান্ত দেখিয়ে বহু বছর আগের ভঙ্গিমায় বলে—বসো, পাশে বসো। ছেলেকে নিয়ে কথাকাটাকাটি করতে করতে আমরা কাছাকাছি বসতেও ভুলে গেছি। বসো, বসো ডান হাত বাড়িয়ে সফিক আহমেদ রওশন আরা মিনুর হাত ধরে মৃদু টান দেয়।  

রওশন আরা মিনু স্বামীর এই কোমল আদুরে আহ্বানে বিস্ময় অভিভূত হয়ে পড়ে। এভাবে সোহাগ মাখা কণ্ঠে কবে যে শেষবারের মতো সফিক কথা বলেছে আজ আর মনে পড়ে না মিনুর। রওশন আরার মাথায় তখনও ওড়না জড়ানো। ঢাকা থেকে ঝিনুকে দিয়ে বানিয়ে এনেছে এই ওড়না। মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত ঝুলের ওড়না। একহাতে তসবি, আরেক হাতে পড়া পানি। সেইসব নিয়েই দ্বিধান্বিত মিনু স্বামীর শরীর ঘেঁষে বসে। মিনুর কোলের ওপর ডান হাতটা রেখে সফিক আহমেদ বলে— 

একটা আইডিয়া এসেছে মাথায় দীপ্তের জন্য। এই ব্যাপারটা খুব গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। এটা তোমার আমার দুজনের জন্যই একান্ত জরুরি। আমি যা বলব সেগুলো আমি তোমাকে শুধু ভেবে দেখতে বলছি। তোমার যদি ভালো না লাগে, পছন্দ না হয় তাহলেও আমরা বিষয়টা আমাদের ভেতরেই রাখব। তুমি এটা নিয়ে কারও সাথে আলাপ করো না। আমার কথাগুলো তোমার পছন্দ না হলে আমরা সেটা করব না। আর এখনই তোমাকে উত্তর দিতে হবে না। 

রওশন আরা মিনু এই ক্ষণিক সময়ের ভেতরে প্রত্যাশা করেছিল স্বামী হয়তো বা তাকে কাছে চাইছে। খুব কাছে, যেভাবে কাছে টেনে নিত দীপ্ত জন্মের আগে। বিয়ের পর সেই দিনগুলোর মতো। গর্বে বুকের ভেতরটা সামান্য স্ফীত হয়। কিন্তু সফিক আহমেদ যখন বলে সে দীপ্তকে নিয়ে আলাপ করতে চায়। মুহূর্তে মিনুর চেহারায় গভীর বেদনার ছায়াপাত ঘটে। বুকের ভেতরে সাবধানে চেপে ধরে নিঃশ্বাস। তারপর স্বামীর চেহারায় গভীর শান্ত দৃষ্টি আবদ্ধ করে। অপলক তাকিয়ে থাকে চোখ ভরা কষ্ট নিয়ে। কিন্তু সফিক আহমেদের দৃষ্টিতে হয়তো ধরা পড়ে না। 

দেখো, তুমি যতই দোয়া পড়া পানি খাওয়াও, আর যতই তুমি প্রতিদিন কোরান খতম করো, এটা তো তুমি বোঝো আমাদের দীপ্ত কোনোদিন ভালো হবে না। এটা সাইন্স বলছে, অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার ভালো হয় না। কিছুটা ইমপ্রুভ হয়তো বা করে, তবে সেটার চান্স কত কম তুমি ভালোই বোঝো। তুমি তো সাইন্সে পড়ালেখা করেছ, তুমি বলো মিনু, সাইন্স কী বলে? 

না, আমি বিশ্বাস করি না, সাইন্স নিশ্চয় আল্লা তা’য়ালার উপরে না? সাইন্স হইল আল্লা তা’য়ালার দান। আল্লা ইশারা করলে সবকিছুই ঘটাইতে পারে। আমি এইটা নিয়া তোমার সাথে অনেক ঝগড়া করেছি। আর ঝগড়া বিতর্ক করতে চাই না। আমি আমার মতো আল্লা তা’য়ালাকে ডাকব। তুমি এইটাতে বাধা দিতে আইসো না। দোহাই তোমার, তুমি তোমার মতো থাকো। তুমি অ্যাথিস্ট, অ্যাগনস্টিক যা ইচ্ছা তাই হও। আমার আর কিচ্ছু আসে যায় না। আমি আমার মতো থাকি। আমার মতো ইবাদত বন্দেগি করি, এবং করব। আমার মনপ্রাণ সবকিছু আমি আল্লার ইবাদতে উৎসর্গ করে দিয়েছি। তুমি জীবন দিয়া চেষ্টা করলেও আমাকে ফিরাইতে পারবা না।

আরে আমি তোমার নামাজ কালাম বিশ্বাস নিয়ে কিছু বলছি না। আমি বলতে চাচ্ছি যদি আমাদের দীপ্ত সুস্থ হয়ে না ওঠে তাহলে আমরা ওর জীবনটা কীভাবে আনন্দময় করে তুলতে পারি। কী করে দীপ্তের জীবনটাকে কানায় কানায় উপভোগ করাতে পারি সেটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। 

হ্যাঁ, আমি তো সেই চেষ্টাই করি। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকে ওর জন্য আমি কত কিছু করি তুমি কি তাঁর খবর রাখো? তুমি তো সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সোজা কম্পিউটারে। সারা দিন যা কিছু করানোর সবই তো আমি করি। 

আমি তো জানি, তুমি অনেক কিছু করো ওকে ভালো রাখতে। আনন্দ দিতে, আমি তো জানি তুমি খুব ভালো মা।  ওর জন্য তুমি তোমার কোনো ক্যারিয়ার করলে না। তোমার এত ভালো রেজাল্ট নিয়েও তুমি ফুলটাইম হাউজ ওয়াইফ। ফুলটাইম মাদার হয়ে গেলে। তোমার মতো এমন মা পাওয়া সত্যি সৌভাগ্যের ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমাদের দীপ্ত সৌভাগ্যবান। 

হ্যাঁ, কালও তো ভ্যারাইটি ভিলেজে নিয়ে গেছি। সুইমিং করাইছি, জামপিং করাইছি, আইসক্রিম পার্লারে নিয়া গেছি। মারিয়ার সাথে তো আমি সব সময়ই যাচ্ছি। একা ছাড়ছি না। কেয়ার না এলেও, রিছেস না এলেও আমি বসে থাকি না। সবই তো আমি একা করি। তুমি তো এসবে কিছুই করতে চাও না। আমি তো সে কারণেই তোমাকে বলি চলো নিয়ম করে যে সময়ে কেয়ার গিভার থাকে না সেই সময়গুলোতে তুমি আমি দুজনে একসাথে ওকে নিয়ে বাইরে যাই। কেয়ার গিভার দিয়ে তো সব হয় না। বাবা আর কেয়ার গিভার কি এক কথা হইল? কিন্তু না তুমি আমার সাথে যাইবা না। তুমি একা একা ওকে নিয়া যাইবা। যাও।

ওসব নিয়ে আমি ভাবছি না, কেয়ার গিভারের সাথে তো যাচ্ছেই ওসব করতে। ব্যাপার ওসব না, আমি বলছিলাম যেসব কাজ কেয়ার গিভারকে দিয়ে করানো সম্ভব না, সেইসব কাজের কথা। বলছিলাম যে সুস্থ স্বাভাবিক  ছেলেমেয়ে বড় হলে বাবা-মায়ের চিন্তা হয় কীভাবে ভালো বিয়ে দেবে। আমাদের দীপ্তকে নিয়ে আমরা তো তেমন করে ভাবতে পারব না। 

 আমার মাথায় হঠাৎ একটা চিন্তা এসেছে আজ কিছুদিন যাবৎ—তোমাকে বলিনি, বলব? 

হ্যাঁ বলো, কিন্তু তার আগে শোনো। বিয়ের কথা যখন বললে, আমার মাথায়ও সেই রকমই আইডিয়া আসছে। আমি কাইল রাইতরে ঝিনুর সাথে কথা বলেছি। ওকে আমি বলেছি একটা গরিবের মেয়ে খোঁজ করতে।  একেবারে খুব গরিব! কোনো বাবা-মা যদি রাজি হয় তাদের মেয়েটাকে বিদেশ পাঠাতে তাহলে আমরা দেশে গিয়ে দীপ্তের সাথে বিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে এলাম। বিনিময়ে আমরা মেয়েটাকে আর মেয়েটার বাবা-মাকে বেশ কিছু টাকাপয়সা জমিজমা লিখে দিলাম। টাকাপয়সা জমিজমা এসব পেলে অনেক বাবা-মাই রাজি হবে। তাছাড়া কানাডা শুনলেও অনেকেই একেবারে একপায়ে খাড়া হয়ে যাবে।

কী বলছ তুমি মিনু? তোমার মাথা টাথা ঠিক আছে? দীপ্ত মানসিকভাবে অসুস্থ। প্রেম বিয়ে এইসবের কিছু সে বোঝে? ভুলে যাচ্ছ দীপ্ত অটিস্টিক।

আমি জানি, আমার দীপ্ত এইসব কিছুই বোঝে না। আমি তো ওর প্রেম বিয়ে সংসার এইসবের জন্য বিয়ে দিতে চাচ্ছি না। আমি ওর দেখাশুনা করানোর জন্য একটা গরিবের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। পেটের দায়ে কাজের আয়া, বুয়া এইসব কাজ নিয়ে বাংলাদেশের গরিবের মেয়েরা কত দেশে চলে যাচ্ছে দালাল ধরে। আমরা তো আর বুয়া বানিয়ে আনছি না। আমরা তো বিয়ে দিয়ে টাকাপয়সা দিয়ে বাড়ির বউ বানিয়ে আনব। আর আমি তো কোনো কিছু মিথ্যা বলব না। আমি সবকিছু সত্য বলেই তবে আনব। 

ওহ, কামঅন মিনু...ইউ আর জাস্ট গোয়িং ক্রেজি, ইনোসেইন! অ্যাবসোলিউটলি ক্রেজি, জাস্ট ইনোসেইন! একেবারে ভুল ভাবনা মিনু, একেবারে ভুল। এইটা মিন, রুড, ইনহিউম্যান, ডার্টি ভাবনা, এটা সম্ভভ নয়। যা সম্ভব না, হবার না তাই করার চেষ্টা করে লোক হাসিয়ো না। বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে সফিক আহমেদ। 

কেন না? বাংলাদেশে গরিবের মেয়ের অভাব নাই। পেটে ভাত নাই, পরনে কাপড় নাই, খোলা রাস্তায় পইড়া থাকে লক্ষ লক্ষ মেয়ে। দেহ বেইচা পেটের ভাত জোগায়। আর আমি এত কিছু দিব তারপরও মেয়ে পামু না আমার পোলার জন্য! আরে এত কিছু দিব শুনলে মেয়ে নিয়ে এসে আমার দীপ্তের পায়ের কাছে রাইখা যাবে। আমার দরকার শুধু একটা বুদ্ধিসুদ্ধিওয়ালা মেয়ে। আমি তো সুন্দরী উচ্চ শিক্ষিত নামকরা ফ্যামিলি এইসব খুঁজতে যামু না। একেবারেই গরিব, ভাত পায় না, যেমন তেমন একটা পরিবারের মেয়ে হইলেই চলবে। আমি সেইটাও বলছি, যেমন ধরো টাকাপয়সার জন্য বিয়ে দিতে পারছে না। সেই রকমই খুঁজতে বলছি। 

হ্যাঁ, হয়তো তুমি ওরকম গরিবের একটা মেয়ে পাবে। কিন্তু আমি লিখে দেব কানাডা আসা পর্যন্ত। ছয় মাস যেতে না যেতে ঐ মেয়ে তোমার ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবে। যতদিন পিআর কার্ড না হয়। অথবা সিটিজেনশিপ না হয় ততদিন থাকবে। 

তারপর চোখ কান ফুটলেই চলে যাবে পুলিশ কল করে—অ্যাবিউজ করা হচ্ছে বলে। 

যখন যায় যাবে। আমি যখন দেশে যাচ্ছি আমি ট্রাই করবই করব। আমি তাই ভাবছি যদি রাজি হয়ে যায় কোনো মেয়ের মা-বাবা, তাহলে আমি ফাইনাল করে আসব। তোমাকে বলে দিলাম, তুমি হাজারবার না করলেও আমি শুনব না। দীপ্ত আমারও ছেলে মনে রাইখো। আমি ওর মা, আমার অধিকার ওর ওপরে তোমার চাইতে অনেক বেশি। তেমন কোনো মেয়ে পাইলে আমি দীপ্তকে অবশ্যই বিয়া দিয়ে দেব।

না, মিনু, এটা কোনোদিনও হবে না। যা হবে না সেটা ভেবে লাভ নেই। তুমি এই পাগলামি করতে যেয়ো না।  এইসব করে লোক হাসাবে। আর তাছাড়া কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন এত বোকা না। তুমি গরিবের মেয়েকে কানাডার ইমিগ্রেশনের লোভ দেখিয়ে একটা অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের ছেলের সাথে বিয়ে দিলেই ওকে ইমিগ্রেশন দিয়ে দিবে? আছ কোথায়? এত্ত সহজ কানাডার ইমিগ্রেশন? কোনোদিনও ঐ মেয়েকে ইমিগ্রেশন দিবে না। এখন আর কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট নাইনটিন এইটি অথবা নাইনটিতে নেই। এখন ওদের কাছে বাংলাদেশের সব ইনফরমেশন আছে।

দৃঢ়স্বরে জেদি স্বরে মিনু বলে, আমি চেষ্টা করে দেখব, চেষ্টা করতে তো দোষ নাই। 

না, তুমি এই রকম চেষ্টা করতে যাবা না, তোমার কাছে আমি রিকোয়েস্ট করছি, প্লিজ। তারপরও যদি তুমি এমন চেষ্টা করতে যাও আমি স্ট্রেইট ইমিগ্রেশনকে জানিয়ে দেব। বলে দেব তুমি কীভাবে মানুষের দারিদ্র্যতা ম্যানিপুলেট করে, দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে তোমার ছেলের বিয়ে দিয়েছ। দেখো মিনু, আমার কথা বোঝার চেষ্টা করো। আমার মাথায় নতুন আইডিয়া এসেছে, বরং তুমি এইটা ভেবে দেখো। শান্ত হও, আমি যা বলি শোনো প্লিজ। 

কী সেইটা কও শুনি?

ছেলের শরীরে সেক্সের তাপ উঠলে কেমন কষ্ট হয় তুমি তো দেখছ। তা ছাড়া মাস্টারবেটিং করে তো আর অরিজিনাল এনজয়মেন্ট হয় না ওর। বরং আমি বলি কি তুমি যদি রাজি হও তাহলে যেটা করতে পারি আমরা দেখে শুনে অ্যাডাল্ট সাইট থেকে দীপ্তের জন্য মেয়ে ভাড়া করে আনতে পারি। মাঝে মাঝে মেয়ে ভাড়া করে আনলাম—মেয়েটা আমাদের দীপ্তকে অর্গাজম করিয়ে দিয়ে যাবে। আমরা মেয়েটিকে ভাড়া করার আগে সব বুঝিয়ে বলব। তাতে করে আমাদের দীপ্তকে কিছুই করতে হবে না। মেয়েটি ইনিশিয়েটিভ নিয়ে দীপ্তকে অ্যারাউজ করা থেকে অর্গাজম করানো সবই করে দেবে। তুমি কী বলো? এটাতে আমাদের দীপ্ত অন্তত জীবনের এই অনাবিল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলো না। রিয়েল সেক্সের এনজয়মেন্ট হলো। দরকার হলে আমরা ওর ডাক্তারের সাথে এটা নিয়ে ডিসকার্স করলাম। 

রওশন আরা মিনু নিঃশ্বাস বন্ধ করে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে সফিক আহমেদের চোখে চোখ রেখে। কয়েক মিনিট বিস্ময়ে হতবাক তাকিয়ে থাকার পর উঠে দাঁড়ায়—ছিইই...ছিইই...সফিক! ছি...! তোমার লজ্জা করল না? নিজের সন্তান নিয়ে এমন নোংরা পাপের কথা ভাবতে? এইটা ছেলেকে দিয়ে ডাইরেক্ট মাগিবাজি করানো। একটা নিষ্পাপ অবুঝ ছেলেকে দিয়ে এমন কল্পনা করাটাও তো গুনাহ! কী করে তুমি এমনটা ভাবতে পারলা?

তুমি বাজেভাবে দেখছ কেন ব্যাপারটাকে? আমাদের দীপ্তকে এটা করানো আর দশটা স্বাভাবিক ছেলের এটা করার ভেতরে পার্থক্য আছে। একই জিনিসের মিনিং, ডেফিনেশন তো এক হয় না?

বাজে জিনিসকে বাজেভাবে দেখব না তো কীভাবে দেখব? পাপ, নোংরামি, গুনাহ এসবকে কীভাবে দেখব শুনি?  শিশুর মতো আমার ছেলের বুদ্ধিসুদ্ধি, চিন্তাচেতনা। ওর ভেতরে তো কোনো পাপ নাই সফিক! ওকে নিয়ে এই রকম একটা পাপের ভাবনা তুমি ভাবতে পারলে? 

আমি ভাবতে বাধ্য হয়েছি, ওর মাস্টারবেটিং তো আমি করাই। তুমি তো করাও না। আমি তাই অনুভব করতে পারছি। তুমি যদি কোপারেট করো তাহলে আমার দীপ্ত ওর সেক্স লাইফটা এনজয় করতে পারে। আমি জানি ও কতটা এনজয় করবে। তুমি আমি কোপারেট না করলে দীপ্ত কোনোদিন উপভোগ করতে পারবে না ওর জীবনে নারীসঙ্গের সেক্স লাইফ। 

এইসব বিতর্কের সময় সফিক আহমেদের চেহারায় স্পষ্ট হয় না কোনো পরিবর্তন। শুধু চোখের ওপরের পাতা জোড়া যৎসামান্য নেমে আসে নিচের দিকে। ঘন ঘন নিচের ঠোঁট দিয়ে ওপরের ঠোঁটটাকে ঠেলে একটা গোলাকার বৃত্ত মোচের ওপর ধরে রাখে। কয়েকবার চেষ্টার পর একগুচ্ছ মোচ কামড়ে ধরতে সক্ষম হয়। তবে মোচ কামড়ে ধরার এই অবস্থা কিছুই প্রমাণ করে না এই মুহূর্তে সফিক আহমেদ ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ অথবা হতাস কি না! ওর ঘন কালো মোচের তলে হয়তো অদ্ভুত এক হাসি আটকে যায়। হয়তো সেই হাসিটাও ক্ষুদ্ধ বিরক্ত মিনুর চোখে ধরা পড়ে না। তার এই শীতল অভিব্যক্তির ওপর হতাসাগ্রস্ত কঠিন দৃষ্টি ছুড়ে দেয় রওশন আরা মিনু। দৃঢ় কণ্ঠে বলে—

আমার ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে, ঘৃণা হচ্ছে তোমার নোংরা মানসিকতা দেখে। 

এবারও সেই একই রকম অভিব্যক্তি ধরে রেখে সফিক আহমেদ বলে, তুমি বুঝতে চেষ্টা করো মিনু। কোনোদিন আমাদের দীপ্তকে কোনো মেয়ে ভালোবাসবে না। ওর জীবনে কোনো নারীর প্রেম আসবে না।   

না, আসুক, দরকার নাই। প্রেম ভালোবাসা দিয়ে কী হবে? আমি তো তোমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম!  কোথায় প্রেম? কীসের প্রেম? একটা সন্তান অসুস্থ জন্মাল বলে তুমি আমাকে দ্বিতীয় একটা সন্তান নিতে দিলে না। আজ কত বছর হলো আমরা আলাদা বিছানায়? আলাদা ঘরে ঘুমাই? আবার প্রেম ভালোবাসার কথা শুনাও? আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট লোকের কথা।  

ঠিক আছে, প্রেমের দরকার নাই মানলাম। আমিও তোমার সাথে একমত। এগ্রি করছি, কিন্তু দীপ্তের দেহ? দীপ্তের শরীর? ওর দেহ, ওর শরীর এখন সেক্স চায়। এটা তো সত্য? এটা তো এগ্রি করবে আমার সাথে?

আল্লা...আল্লা...আল্লা...মাবুদ...মাবুদ...মাবুদগো তুমি মাপ করো। সফিক, আমি সারা দিনরাইত জায়নামাজে পইড়া থাইকা পারতাছি না। এত বছরে আল্লারে খুশি করতে পারি নাই। আর কিনা তুমি...তুমি, তুমি বেদাত এইসব কী বলতেছ? তোমার জন্য তো চব্বিশ ঘণ্টা জিকির করলেও আল্লায় ক্ষমা করব না। রওশন আরা মিনু ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। ক্রমাগত আসতাগফেরুল্লা পড়তে থাকে আওয়াজ করে।

আর তখন সফিক আহমেদ বিরক্ত খ্যাপাটে স্বরে বলে, আমার জন্য তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে না। আমি বেহেশত দোজখে বিশ্বাস করি নাকি! আজাইরা তোমাকে কে বলেছে আমার জন্য মাথা ঠুকে মাফ চাইতে।

আমি কি কারও বলার জন্য কেয়ার করি? আমি মাফ চাই, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি চাই আল্লা তোমার সুমতি দিক। দরকার নাই আমার ছেলের নারীসঙ্গ উপভোগের। আল্লা ওকে যেমন বানাইছে তেমনই সে উপভোগ করবে। ওর শরীর গরম হইয়া গেলে ও মাস্টারবেটিং কাইরা সেক্স এনজয় করবে। কিন্তু ওকে দিয়ে তুমি পাপ কাজ করানোর চিন্তা কইর না সফিক। ও শিশুর মতো সরল, পবিত্র আর নিষ্পাপ। প্রসটিটিউট দিয়া ওকে তুমি নারী ভোগ করানোর মতো নোংরা চিন্তা করলা কী কইরা? আমি ভাইবা অবাক হচ্ছি! ছি, সফিক ছি, ছিইই, তুমি এত নোংরা হইয়া গেছ? এত নিচে নেমেছ? সারাক্ষণ এই জন্য কম্পিউটারে হান্দাইয়া থাকো?

তুমি এতে পাপের কী দেখলে? সবকিছুর ভেতরে সারাক্ষণ পাপ পুণ্যি খুঁজতে খুঁজতে তুমি আসলে ফেনাটিক হয়ে গেছ। তোমার জীবনে এখন বাস্তবতা বলে কিছু নাই। টুমাচ...অ্যাবসোলিউটলি টুমাচ...সব তোমার ফেনাটিজম। 

সেই ভালো, আমি ফেনাটিক হয়ে গেছি, ফেনাটিক থাকতে চাই। কিন্তু আমার ছেলেকে আমি পাপ স্পর্শ করতে দেব না। রওশন আরা মিনু দ্রুত উঠে দাঁড়াতে গেলে সফিক আহমেদ শক্ত করে চেপে ধরে ওর কব্জি। ক্রুদ্ধ চাপা কণ্ঠে বলে—

বুঝতে পারছ না, এতে কোনো পাপ বা অন্যায় কিচ্ছু নাই! কোনো ক্ষতিও নাই। কারণ আমরা এত গোপনে কাজটা করাব কেউ জানতে পারবে না। ক্ষতি কী? আজ আমার দীপ্ত যদি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী হতো তাহলে কি তুমি দেখতে যেতে দীপ্ত কোথায় কী করছে? দীপ্তের বয়সী ছেলেরা কত মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গার্লফ্রেন্ড বানাচ্ছে। হোটেলে, মোটেলে, ফ্রেন্ডদের বাড়িতে কখন কোন মেয়ের সাথে সেক্স এনজয় করছে কে তার খবর রাখছে? ওরা হানড্রেড পার্সেন্ট জীবনটাকে উপভোগ করছে। এবার দ্বিগুণ জোরে ঝাঁকি দিয়ে রওশন আরা মিনু সফিক আহমেদের হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাতকে মুক্ত করে নিয়ে ফুঁসে ওঠে।

না, আমার দীপ্ত সুস্থ স্বাভাবিক হলেও কখনো এইসব খারাপ কাজ করত না। আমার সন্তানকে আমি সেইভাবেই শিক্ষা দিয়ে বড় করতাম। আল্লা যখন আমাকে সুস্থ সন্তান দিল না, তখন আমি এই অসুস্থ সন্তানকে বুকে নিয়ে আল্লা রসুলের পথে থাকব। আল্লা তা’য়ালা রহমানুর রাহিম আমাকে পরীক্ষা করছেন অসুস্থ সন্তান দিয়ে। কী ভেবেছ হ্যাঁ? আল্লা পাক আমাকে সুস্থ বুদ্ধিমান সন্তান দেন নাই বলে আমি তোমার মতো নন বিলিভার হয়ে যাব?

আমার তো মনে হচ্ছে তুমি একেবারেই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। আমি তো আলাপ করছিলাম তোমার সাথে।

আল্লা...মাবুদ তুমি এই নালায়েক বান্দারে রহম করো! আমি আল্লা রসুলে বিশ্বাস করি, এবং করব। এই ইমান নিয়াই আল্লা তা’য়ালা যেন আমার মৃত্যু দ্যান। তুমি দেইখো আল্লা আমার ডাক শুনবেন। এবং আমি দীপ্তকে সাথে নিয়াই এই দুনিয়া থেইকা বিদায় হমু। আমাকে যখন আর একটা সন্তানের মা হইতে দিলা না। দীপ্ত যদি সুস্থ না হইয়া ওঠে তাইলে সে একা একা এই দুনিয়াদারিতে কষ্ট করব না। ওর কোনো ভাইবোন থাকব না আমরা মইরা গ্যালে। এইটাও তোমার দোষে। যদি দীপ্তের মতো অটিস্টিক হয় এই সন্দেহে তুমি জোর কইরা আমার তিন মাসের বাচ্চাটা নষ্ট কইরা দিলা। আরেকটা সন্তানের মা না হইতে দিয়া তুমি আমাকে শুধু না, দীপ্তেরও সর্বনাশ করছ। এখন বুঝি সেইদিন তোমার কথা শুইনা কত বড় পাপ করছি। আইজ যদি দীপ্তের মায়ের পেটের আপন একটা ভাই অথবা বোন থাকত তা হইলে আমি ওরে বিয়া দ্যাওনের কোনো চেষ্টাও করতাম না। আমাদের দুইজনার মৃত্যুর পর ওর একজন অন্তত আপনজন থাকত। আল্লা এই পাপের ক্ষমা করবেন না। এইডার শাস্তি আমগো দুইজনরেই ভুগতে হইব।      

বুল শিট, আই গিভ ড্যাম তোমার আল্লাকে। যদি আল্লা এত মহান হয়ে থাকে, বলো না তোমার আল্লাকে তোমার একমাত্র সন্তানকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিতে। যদি আমার দীপ্ত সুস্থ হয়ে যায় তোমাকে কথা দিলাম আমি তা হইলে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা আল্লাকে ডাকব। আমি জায়নামাজ থেকে উঠব না। আমি দীপ্তের জন্য বাড়িঘর সব ছেড়ে দিয়ে মসজিদবাসী হব।

আসতাগফেরুল্লাহ, আসতাগফেরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ মিন জালেক। আল্লা তোমাকে ফানা দিন। তোমার মতো অবুঝকে মাফ করুন। আমার দিনরাত জায়নামাজে পইড়া থাকার আরেকটা কারণও তুমি। তোমার এই রকম গুনাহগারি কথাবার্তার জন্য আমাকে দিনরাত ক্ষমা চাইতে হইতাছে। রওশন আরা ছেলেকে দোয়া পড়া পানি পান করাতে ভুলে যায়। উঠে দাঁড়ায় পানির গ্লাস হাতে। স্বামীর দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধুপধাপ শব্দে উঠে আসে সিঁড়ি বেয়ে। তখন শুধু সিঁড়ি গড়িয়ে নিচের দিকে নেমে আসে মিনুর গুমরানো কান্নার শব্দ।

আড্ডায় চিৎকার
লিভিংরুমে জমে উঠেছে আড্ডা। সেই বিকাল চারটা থেকে আজ আসা শুরু হয়েছে সকলের। এরই মাঝে এসেছে শম্পা-মাঈনুল, মিতা-আসাদ, আয়েশা-রাসেল, শিখা-সজল, খুকু-নাজমুল, রূপা-বাবু, ইমরান-মেরি। দীপ্তকে সঙ্গে নিয়ে সফিক আহমেদ আর রওশন আরা মিনু যখন এলিভেটরের সামনে তখন দেখা হলো বাবু ও রূপার সঙ্গে। চারজনে একসঙ্গে একখানা বহুচেনা হাসি দিয়ে আন্তরিক শুভেচ্ছা মুখে না বলেও অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করে।  একসঙ্গে ওরা চারজন উঠে এলো গল্প করতে করতে। লিভিংরুমে এরই মাঝে বড়রা সবাই একসঙ্গে আড্ডা শুরু করছে। ছোটরা সকলেই ভেতরে বেডরুমে জড়ো হয়েছে একঝাঁক পাখির মতো। আর জমেছেও বেশ কিচিরমিচির। ছোটদের ভেতরে একেবারে পাঁচ মিশেলির মতো একঝাঁক ছেলেমেয়ে। দুবছরের সবেমাত্র নড়বড়ে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে এমন বয়সী থেকে সুইট সিক্সটিন পর্যন্ত সবই আছে। এখন এই বেডরুমের ভেতরে সবগুলো বাচ্চা মেতে আছে প্রিয় মুভি দেখায়। পার্টির সময় দারুণ একটা মুভি চালালে বাচ্চারা সবাই কিছুটা থিতু থাকে। তুলনামূলক কম থাকে লাফালাফি। এপাশের লিভিংরুমে জমে উঠেছে বড়দের তুমুল আড্ডা আলোচনা তর্কবিতর্ক। শিউলি ও বাবলুর বাড়িতে আজকের এই আড্ডা লং উইক এন্ডের। হালকা পানীয়ের সঙ্গে আছে গানবাজনা গল্প সবই।

সফিক আহমেদ আর রওশন আরা মিনুকে দেখে কয়েকজন আসেন আসেন বলে উচ্ছ্বসিত উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। কিন্তু শিউলির চেহারাটা হঠাৎ আলো নিভে অন্ধকার নামার মতো মলিন হলো। সারা বিকাল ও সন্ধ্যার সবটুকু সময় সে ছিল বেশ উৎফুল্ল। কিন্তু দীপ্তকে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করতে দেখা মাত্র তার এই দশা। 

ইদানীং দীপ্তকে নিয়ে পার্টিতে আসুক এটা একেবারে পছন্দ করে না শিউলি ও বাবলু। যখন ছোট ছিল তখন আলাদা ব্যাপার। কিন্তু দীপ্ত তো এখন বলতে গেলে অ্যাডাল্টের ক্যাটাগরিতে পড়ে। দেখতে একটা ফুল অ্যাডাল্ট, গ্রোন আপ ম্যান। তাকে কী করে পার্টিতে নিয়ে আসে! কিচেন থেকে সরাসরি ভেতরে প্রবেশের দরজা পর্যন্ত দেখা যায়। কিচেনের ভেতরে দাঁড়িয়ে শিউলি বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে শম্পাকে শুনিয়ে। শম্পা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে বলে—হ্যাঁ, ভাবি, আমি আপনার সাথে একেবারে একমত। এখন আর উনাদের উচিত না দীপ্তকে নিয়ে আসা। একটা বেবি সিটার অথবা সাপোর্ট ওয়ার্কার জোগাড় করে বাড়িতেই রেখে আসা উচিত। এই যে দ্যাখেন, এক্ষুনি আমার ছেলে ভয়ে চিৎকার করা শুরু করবে। দীপ্তকে দেখলেই আমার ছেলে ভয়ে কাঁপতে থাকে। দাঁড়ান আমার ছেলেকে বের করে নিয়ে আসি বলতে বলতে দ্রুত কিচেন থেকে বেডরুমের দিকে ছুটে যায় শম্পা। 

শম্পা যা ভেবেছিল তাই! দীপ্তকে দেখা মাত্রই শম্পার ছেলে ভয়ে গলা ফাটিয়ে শুরু করে দিল কান্না। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে মাথাটা বুকের কাছে চেপে ধরে বের হয়ে আসে শম্পা। ওকে...ওকে...মাই বেবি, ইটস ওকে... নো...আহাহা...এই যে অ্যাডাম, পাপা, মাই সুইট হার্ট, এই যে সুইট বয়, কোনো ভয় নেই, ডোন্ট ক্রাই, নো...নো...নো...। শম্পার ছেলের মাথায় সোহাগ ভরা হাত দিয়ে রওশন আরা মিনু আদর করতে গেলে ঘুরে দাঁড়ায় শম্পা। থাক থাক ভাবি, দীপ্তকে দেখে আমার ছেলে স্কেয়ার্ড হয়ে যায়। সব বাচ্চারাই ওকে দেখে ভয় পায়। আপনি একটা বেবি সিটার ডেকে ওকে রেখে আসলেই তো পারেন। এভাবে সকলের ফানটাকে নষ্ট করতে নেই ভাবি। দিস ইজ নট ফেয়ার।  

শম্পার কথায় থতমত বিব্রত রওশন আরা মিনু বোকার মতো মুখ দিয়ে চুকচুক আদুরে কয়েকটা শব্দ তোলে মাত্র। আর দীপ্তের হাতের কব্জি ধরে টেনে নিয়ে বিছানার এক প্রান্তে বসিয়ে দেয়। দীপ্তকে বার কয়েক টেলিভিশন দেখার কথা বলে। তারপর বেডরুম ভরা সকলের উদ্দেশ্যে বলে—অ্যানি, রিয়া, অ্যামান্ডা, নোভা, রাতুল, কেভিন, সোফিয়া—এই যে বেবিরা, সোনামণিরা, তোমরা দীপ্তকে একটু দেখো, ঠিক আছে? দেখো কিন্তু। ঠিক আছে আমার বাবারা? দীপ্ত কিছু চাইলে আন্টিকে ডেকে নিয়ে এসো। ওকে...? অলরাইট...? রাতুল আর সোফিয়া ওদের ভেতরে বয়সে সব থেকে বড়। প্রায় দীপ্তের বয়সী। ওরা দুজন একসঙ্গে বলে ওঠে, নো প্রবলেম আন্টি, আমরা আছি, দেখব, আমরা দীপ্তকে টেক কেয়ার করব। ইউ গো, হি ইজ ওকে, ইউ গো...।

দীপ্তকে বিছানার কোণায় বসিয়ে দিয়ে রওশন আরা মিনু হাসিমুখে বের হয়ে আসে। আজকাল আর কোথাও বের হওয়া হয় না দীপ্তকে নিয়ে। যখন দীপ্ত ছোট ছিল তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে যাওয়া হতো কোথাও না কোথাও দাওয়াতে। সামার হলে ব্যাক ইয়ার্ড পার্টি, বারবিকিউ পার্টি, পার্ক, ওয়াটার স্পোর্ট এমন কত কিছুতে। দীপ্ত বড় হওয়ার পর থেকে বলতে গেলে কোথাও নিয়ে যায় না সফিক। রওশন আরা মিনু ক্রমাগত অভিযোগ করতে থাকে—ছেলেটা আজ কতদিন একেবারে গৃহবন্দি। আমাদের তো সমাজ বলতে আর কিছু নাই...। মানুষের কি অটিস্টিক বাচ্চা হয় না? সবাই কি আমাদের মতো এই রকম সমাজ বিচ্ছিন্ন গৃহবন্দি জীবন কাটায় নাকি?  ক্রমাগত এই অভিযোগ শোনার পর হয়তো সফিক আহমেদ ছেলেকে নিয়ে একাই বের হয়ে যায়। ঘণ্টা দুই-তিন দীপ্তকে নিয়ে শপিং মলে, ম্যাগডোনালস অথবা অন্য কোথাও ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। হয়তো মাঝে মধ্যে ম্যাকডোনালস অথবা বার্গার কিং খাওয়ায়। ফিরে আসার পর রওশন আরা মিনু যদি প্রশ্ন করে কোথায় গেলে ছেলেকে নিয়ে? আমাকে বললেই পারতে, আমিও যেতাম। 

তোমার তো সবকিছুতেই প্রবলেম। ছেলেকে নিয়ে কোথাও না বের হলেও ঘ্যান ঘ্যান করবা। আবার বাইরে নিয়ে গেলেও তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। 

আরে আমি কি কৈফিয়ত চাচ্ছি নাকি? বলছিলাম এই সুযোগে আমিও একটু ঘুরে আসতে পারতাম!  

তোমার ঘুরে আসতে হয় যাও ঘুরে আসো। গাড়ি নিয়ে যাও। আমি তো বাসায় আছি। দীপ্তকে টেক কেয়ার করছি। তুমি যাও।

তুমি আমাকে নিয়ে গেলেই তো একসাথে ঘুরে আসতে পারতাম।

আমি কি নাকে খত দিয়েছি নাকি ছেলের সাথে সাথে তোমাকেও সার্ভিস দেয়ার? রওশন আরা মিনু তখন হয়তো আর কথা বাড়ায় না। হয়তো করুণ যন্ত্রণা আর ব্যথা ভরা দৃষ্টি মেলে দেয় সফিকের চোখের দিকে। হয়তো রওশন আরা মিনুর সেই দৃষ্টি সফিক আহমেদের দৃষ্টিকে ছুঁতে পারে না। সফিক আহমেদ তখন হয়তো ক্রোধ আর বিরক্তি ভরা দৃষ্টি শব্দহীনতায় ছুড়ে মারে রওশন আরার দিকে। মিনু বুঝতে পারে প্রায়ই সফিক বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি যায় আড্ডা দিতে। কিন্তু মিনুকে বলে যায় না। এমনকি জানানোরও প্রয়োজন বোধ করে না। 

লিভিংরুমে এসে রওশন আরা মিনু চারপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনে। সোফায়, কার্পেটে, এক্সট্রা চেয়ারে, সবাই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে নিবিড় আড্ডা জমিয়ে ফেলেছে। রওশন আরা মিনু কিচেনের ভেতর দিয়ে ডাইনিং স্পেসের দিকে এগোয়। ডাইনিং টেবিলের ওপর হরেক রকমের বাদাম, চিপস, চানাচুর, চটপটি, কোক, সি প্লাস, জিনজার‌্যাল সাজানো। মিনু কয়েকটা বাদাম হাতের মুঠোয় নিয়ে শান্তার পাশের চেয়ার ঘেঁষে বসে।

 এত দেরি করলে কেন মিনুদি? শান্তা জানতে চায়।

দীপ্তের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ও ঘুমিয়ে ছিল। সফিক যদি সকালেও জানাত তাহলে হতো। আগে থেকে রেডি হতে পারতাম। কিন্তু হঠাৎ করে বলল গেলে যেতে পারো। ওদিকে দীপ্ত ঘুমাচ্ছিল। ওর ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। তারপর উঠলে রেডিটেডি করে নিয়ে আসতে আসতে এই পর্যন্ত। আর এখান থেকে আমাদের বাড়ি তো অনেক দূরে। প্রায় এক ঘণ্টার ড্রাইভ।   

তোমার তো টরন্টোতে ভাই, বোন, ননদ সবই আছে। পার্টিতে যেদিন আসো সেদিন ওদের কারও কাছে রেখে আসতে পারো না দীপ্তকে? তাহলে টেনশন ফ্রি কোয়ালিটি টাইম এনজয় করতে পারো। 

নাআআরে ভাই, কী যে বলো! ওদের কাছে রেখে আসব? আমার ননদ রাখবে! আমার বোন! কী যে বলো? আগে যখন ছোট ছিল তখন আমার বোনের কাছে রেখে আসতে পারতাম। আমার বোনও তখন আহ্লাদ করে রাখত। অনেক আদরযত্ন করত। তখন দীপ্তকে যেখানে বসিয়ে রাখতাম সেখানেই বসে থাকত পুতুলের মতো চুপচাপ। রূপকথার দেবশিশুদের মতো সুন্দর মায়াবী ছিল আমার দীপ্ত। টোব্বা টোব্বা গাল, টানা দুটো চোখ, চোখের পাতা ভরা পাপড়ি, তাকালে ঘন কালো পাপড়ি কপালে গিয়ে ঠেকত। আর মাথা ভরা ঘন কালো কোঁকড়া চুল। শপিং মলে ওকে নিয়ে গেলে কতদিন অপরিচিত মানুষরা পর্যন্ত ওকে কোলে নিতে চাইত। 

আয়েশা আপা হাসিমুখে বসে মনোযোগ দিয়ে রওশন আরা মিনুর কথাগুলো শুনছিল এতক্ষণ। এবার সে বলে—ওমা, সেই কথা আর বলতে। আমাদের সামনেই তো জন্মাল দীপ্ত। এত্ত সুন্দর বাচ্চা হাজারে একটা চোখে পড়ে না। আমি কতদিন আপনার ভাইকে বলেছি—চলো না, দীপ্তকে কোলে নিয়ে আসি। শুধু দীপ্তকে কোলে নেয়ার জন্য আমি দুই ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আসতাম আপনাদের বাসায় মনে আছে মিনু আপা?

কী যে বলো আয়েশা, কেন থাকবে না, তখন সবাই আসত। এখন আর তোমরাও আগের মতো আসো না, আমাদেরও কোথাও যাওয়া হয় না।

না, না, এটা তো ঠিক না। আপনারা যাবেন। দীপ্তের জন্য আপনাদের জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারে না। আপনাদের তো লাইফ আছে। শান্তা ভাবি যা বলল, সেটা কিন্তু ঠিকই বলেছে। আপনার ভাই, বোন, ননদ ওদের  কাছে রেখে আপনাদের জীবনও কিছুটা এনজয় করবেন।

এখন তো দেখতেছোই কেমন লম্বা চওড়া হয়ে গেছে আমার দীপ্ত! একবার যদি রাগ হয়, কোনো কিছু বোঝাতে না পারে তাহলে আর আমার বোন, আমার ননদ ওরা কেউ সামলাতে পারে না। 

ও আচ্ছা, তাহলে তো তোমাদের জন্য খুবই সমস্যা ভাবি! এত ঝামেলা করে না আসাই ভালো তার চাইতে! পাশ থেকে ওদের আলোচনায় উত্তর দেয় মিতা ভাবি।

কী আর করব বলো? আল্লা যা দিয়েছেন তাতেই শুকরানা আদায় করি। আর আল্লার কাছে সারাক্ষণ প্রার্থনা করি— আল্লা তুমি অসীম ক্ষমতার আধার। তুমি দিনকে রাত, রাতকে দিন করে দিতে পারো। তুমি চেয়েছ বলে নবি করিম সাল্লালাহু আলাইয়ে ওয়া আসসালাম মেরাজ করেছেন। তোমার ক্ষমতায় নদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়। দুই ভাগ হয়ে নদী পথ করে দেন তোমার নবিকে। আবার মরুভূমির বুকে ঝরনাধারা প্লাবিত হয়। ঠিক না বলেন আপনি মেরি ভাবি? এবার আয়েশা ভাবির দিকে তাকিয়ে রওশন আরা মিনু সমর্থন প্রত্যাশা করে। কারণ আয়েশা ভাবি এ বছর হজ করে এসেছে।

সঙ্গে সঙ্গে আয়েশা ভাবি উত্তর দেয়—অবশ্যই, অবশ্যই। আল্লা চাইলে সবই হতে পারে। জানেন কী অটিস্টিক ছেলেমেয়েদের একটা সাইড খুব ট্যালেন্ট হয়। আপনাদের দীপ্তেরও কোনো একটা সাইড হয়তো খুব ট্যালেন্ট। আপনি আর সফিক ভাই মিলে সেটা ফাইন্ড আউট করেন। সেটা যদি ফাইন্ড আউট করতে পারেন তাহলে দেখবেন একদিন এই দীপ্তকে নিয়েই আপনারা খুব প্রাউড হবেন। 

আয়েশা ভাবির এইসব সান্ত্বনার কথায় রওশন আরা মিনুর দুই চোখ উপচে ওঠে অশ্রুতে। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলে—

আর ছেলের ট্যালেন্টস। অটিস্টিক সন্তানদের ট্যালেন্টস কি সব বাবা-মা খুঁজে বের করতে পারে? সুস্থদেরটাই পারে না। দোয়া করেন ভাবি আল্লা যেন আমার কান্না শোনেন।  

এপাশে কয়েকজন মহিলার একসঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা। রওশন আরা মিনু তাদের ভেতরে এসে বসে। আজ আরও কয়েকজন নতুন ভাবি এসেছে। মিনুর সঙ্গে আজই তাদের প্রথম পরিচয়। সফিক আহমেদ যেখানে বসেছে ওপাশটায় এখন জমে উঠেছে বিতর্ক। পুরুষদের ভেতর আজকের বিতর্কের বিষয় রাশিয়া, ইউক্রেন, আমেরিকা, কানাডা এইসব আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইস্যু। আরও আছে বাংলাদেশের প্রথম আলো আর সরকার, আওয়ামী লীগ, বিএনপি এইসব। বিতর্ক ক্রমেই জমে উঠছে একেবারে গোলটেবিল বৈঠকের মতো। ডাইনিং টেবিলের ওপাশে বসা রওশন আরা মিনু ও তার পাশে বসা মহিলাদের কানে হয়তো তার কিছু কিছু প্রবেশ করে। হয়তো গুরুত্ব পায়, হয়তো পায় না। অথবা মহিলাদের বিষয় হয়ে ওঠে না। তর্কবিতর্ক, মন্তব্য, বক্তব্য এসব মিলেমিশে যখন দারুণ আড্ডার আমেজ জমে উঠেছে তখন হঠাৎ এই ঘোর লাগা পরিবেশের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ভয়ার্ত চিৎকার। একসঙ্গে বসা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় সকলে এবং মুহূর্তেই একসেঙ্গে সবাই ছুটে যায় বেডরুমের দিকে।  

ওহ...নো নো...ড্যাডিইইইই...মাম্মি, মাম্মি...মাম্মিইইই...অ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা...এইসব ভয়ার্ত চিৎকারে বেডরুমের ভেতর অস্বাভাবিক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। একসঙ্গে সকলে রুমের ভেতরে লাফিয়ে প্রবেশ করলে কয়েকজন শিশু হাউমাউ করে কান্না ও চিৎকার জুড়ে দেয়। সফিক আহমেদ সবার আগে লাফিয়ে পড়ার মতো ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। কারণ তার উদগ্রীব মন সব সময়ই সতর্ক থাকে দীপ্তের জন্য। 

দীপ্ত দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে অ্যামান্ডাকে। হি হি শব্দে হাসছে আর অ্যামান্ডার বুকের কাছে মুখ ঘষে চুমু দেয়ার চেষ্টা করছে। ভয়ে বিবর্ণ অ্যামান্ডা বাঘের থাবায় আক্রান্ত হরিণের মতো কাঁপছে আর গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে। হয়তো তেরো চৌদ্দ বছর বয়স হবে অ্যামান্ডার। কিন্তু বাড়ন্ত গড়নের কারণে আরও কয়েক বছর বেশি মনে হয়। মাথা ভরা ঘন কালো চুল, ছড়িয়ে আছে পীঠ পর্যন্ত। ভয়ে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে হলদে ফর্সা রং। দীপ্তের দুই হাতে বন্দি হয়ে চোখ বন্ধ করে থরথরিয়ে কাঁপছে। সফিক আহমেদ দ্রুত দীপ্তের হাত থেকে অ্যামান্ডাকে ছাড়িয়ে নেয়। ততক্ষণে অ্যামান্ডার মা-বাবা অ্যামান্ডাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেছে। সফিক আহমেদের প্রতি ক্রুদ্ধ ক্ষুদ্ধ খ্যাপা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অ্যামান্ডার বাবা ইমরান রহমান প্রায় চিৎকার করে বলে—হোয়াট ননসেন্স ইউ আর সফিক সাহেব? কী জন্য আপনারা এই পাগল ক্রেজি ছেলে নিয়ে পার্টিতে আসেন? বাড়িতে রেখে আসতে না পারলে আসবেন না পার্টি করতে। 

আই অ্যাম সরি, সরি ইমরান। ইটস অ্যান ইনসিডেন্স। বিলিভ মি, দীপ্ত এমন কখনো করেনি। তাই বুঝতে পারিনি। লজ্জায় অপমানে বিব্রত সফিক আহমেদের লম্বা দেহটা উইপিং উইলোর মতো ঝুঁকে যায় মেঝের দিকে।  

বুল শিট, দিস ইজ নট অ্যান এক্সকিউজ। আপনাদের ছেলে আপনারা বুঝবেন না তো কে বুঝবে? ছেলের কন্ডিশন বোঝা উচিত। দিস ইজ অ্যা প্রবলেম ফর আপনাদের মতো বাঙালিজদের। সোশ্যাল ম্যানার জানে না বোঝে না। কোথায় এই ছেলেকে নিয়ে যাওয়া উচিত, কোথায় স্যুডন’ট সেটা বোঝেন না! ইডিয়ট, ননসেন্স। 

মেরি রহমান দ্রুত এগিয়ে এসে মেয়ের মাথা বুকের কাছে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। গালের ওপর ছোট ছোট চুমু দিয়ে বলে—ডোন্ট ওরি হান, বেবি, বেবি, মাই বেবি...ডোন্ট ওরি...। এই যে আমি, এই যে ড্যাডি। সরি...সরি..., মাম্মি সরি...মাই বেবি, আই অ্যাম সরি...। শিউলি রহমান স্বামী এমরান রহমানকে ঠেলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। আর বলে উই আর সরি এক্সট্রিমলি সরি মামণি...। এটা আর কখনো হবে না। যতই বুঝানোর চেষ্টা করে শিউলি রহমান ততই অ্যামান্ডা চিৎকার করে কাঁদে আর বলে—ড্যাডি, ড্যাডি, লেটস গো হোম। বাবাকে দুই হাতে জাপটে ধরেছে। বাবার কোলে মুখ গুঁজে, হাত ধরে টানতে টানতে সে দরজার দিকে এগোয়।

বেডরুম থেকে বের হয়ে কয়েক গজ লম্বা করিডরের মাথায় ক্লোজেট। এই ক্লোজেটে সকলেই তাদের উইনটার কোট খুলে রেখেছে। অ্যামান্ডার মা দ্রুত ক্লোজেট থেকে ওভার কোট নামিয়ে অ্যামান্ডাকে পরায়। উইনটার বুট বের করে নিজে মেঝেতে বসে দ্রুত পরিয়ে দেয় মেয়ের পায়ে। অন্য সময় অ্যামান্ডাকে উইনটার কোট অথবা বুট কিছুই পরিয়ে দিতে হয় না। সে নিজেই করে এইসব কাজ। কিন্তু আজ মেরি রহমান মেয়েকে সযত্নে এসব যখন পরিয়ে দিতে থাকে তখনও অ্যামান্ডা ভয়ে বিবর্ণ। সফিক আহমেদ আর রওশন আরা মিনু পাশে দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেঝেয় আটকে। তখন কান পেতে শোনে—অসভ্য ছোটলোকের জাত। পাগল, লুইচ্চা ছেলে নিয়ে মানুষের বাসায় আসতে লজ্জাও করে না! ছেলে যখন লুইচ্চা হয়ে উঠেছে তখন মানুষের বাড়িতে আসা কী দরকার! একদিকে দেখায় অটিস্টিক। অন্যদিকে লুইচ্চা কোথাকার। অটিস্টিক হইলে আবার লুইচ্চামি আসে কোত্থেকে? সোজা নাইন ওয়ান ওয়ান কল করে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া উচিত। এসব কথা বলতে বলতে অ্যামান্ডাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে ইমরান রহমান ও মেরি রহমান দুজনেই বের হয়ে যায় ক্ষিপ্ত পায়ে।  

হঠাৎ যেন কোনো এক জুজুর ভয়ে থমকে গেল ঘর ভরা আনন্দ। দুই ঘর ভরা মিশেল বয়সী মানুষদের হইচই ফুর্তির ওপর নেমে এলো বিষাদ বেদনা ভরা নীরবতা। গল্প কথা, হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকা অতিথিদের অভিব্যক্তিগুলো বদলে গেল বিষণ্নতায়।

অ্যামান্ডাকে নিয়ে ওর বাবা-মা বের হয়ে গেল। সফিক আহমেদ ও রওশন আরা মিনু অপরাধীর মতো কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। তখন ওদের কানের ভেতর প্রবেশ করে ছোটবড় আরও অনেক কষ্ট, যন্ত্রণা আর অপমানজনক মন্তব্য। যুগপৎভাবে দীপ্তকে উইনটার কোট ও বুট পরিয়ে সফিক আহমেদ আর রওশন আর মিনুও দ্রুত যেন পালিয়ে যায়।  

অব্যক্ত যন্ত্রণা
পাথরের মতো নীরব ছিল দুজনেই সারা পথ। সফিক আহমেদ গাড়ি চালিয়েছে আর বাকরুদ্ধ মিনু চলমান হাইওয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেছে কাতর চোখে। বাড়ি ফিরে দুজন চলে যায় ওপর নিচ দুই তলায়। ভুলে যায় ওরা দীপ্তকে রাতের খাবার দিতে। প্রতিরাতের নিয়মে আজ আর দীপ্তকে ডাকে না ডাইনিং টেবিলে। হয়তো দীপ্তের পেটের ভেতর তখন ক্ষুধার ডাক। নিজেই এসে বসে ডাইনিং টেবিলে, তোতলায়ে তোতলায়ে ডাকে ড্যাডি, ড্যাডি...। সফিক আহমেদ ক্ষুধাকাতর শিশুর মতো অবুঝ ছেলের মাথাটাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে রাখে বুকের কাছে। তারপর মিনুকে না ডেকে নিজেই ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে।

বেডরুমে হয়তো মিনুও জেগে আছে। হয়তো জায়নামাজে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। অথবা কাঁদতে কাঁদতে জায়নামাজের ওপরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আজকের এ লজ্জা যদিও তাদের হওয়ার কথা ছিল না কিন্তু হয়েছে। অপমানিত শুধু সফিক আহমেদ হয়নি। মিনু! মিনু কি কম লজ্জিত হয়েছে! মিনুর ওপর কেন সে রাগ করে? বহুদিন এই প্রশ্ন সে নিজেই করেছে নিজেকে। মিনু আর তার দুজনের অবস্থান তো একই বলয়ে। এত বোঝার পরও সে মিনুর ওপরই ঝাড়ে সমস্ত ক্ষোভ হতাশা। 

ঘুমিয়ে পড়েছে দীপ্ত। বুকের কাছে জাপটে ধরে রেখেছে কোল বালিশটা। সারা বছরই সর্টস পরে ঘুমাতে পছন্দ করে দীপ্ত। সেই ছোট বয়স থেকে। শীতের সময়ও ফুল পায়জামা পরতে পছন্দ করে না। আর সে কারণে ঘরের ভেতরে তুলনামূলক একটু বেশি হিটিং দিয়ে রাখতে হয়। সফিক আহমেদ দীপ্তের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। চোখের কোণায় একটু একটু করে অশ্রু জমছে। ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে চোখ দুটো। দীপ্ত, আমার দীপ্ত। কী সুন্দর পৌরুষদীপ্ত আমার দীপ্ত। আরও অশ্রু বাড়ে। গড়িয়ে পড়ে চোখ বেয়ে। গাল বেয়ে বুকের ওপর। দীর্ঘনিঃশ্বাস আরও দীর্ঘ হয়ে বুকের ভেতর ভারী হচ্ছে। কোথায় আমার ভুল ছিল দীপ্ত! বাবা আমার, মানিক আমার, সোনা আমার। কেন আমি তোকে সুস্থ রাখতে পারলাম না! কেন আমি তোকে স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না? কোথায় ছিল ভুল!  

আজ এমন বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেল! সে তো তারই ভুলে। সে যদি দীপ্তকে পাশে বসিয়ে রাখত। যদি বেডরুমে বসিয়ে রেখে না আসত তাহলে তো আর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ছি ছি...বাচ্চা মেয়েটা খুব ভয় পেয়েছে। পাবারই কথা। ইমরান রহমান ও তার স্ত্রী মেরি রহমানের কথাগুলো বারবার হাতুড়ির মতো পেটাচ্ছে মাথার ভেতর। যেন প্রতিধ্বানিত হচ্ছে মাথার ভেতর থেকে বের হয়ে সারা ঘরে। তখনই মনে হচ্ছে মাথার ভেতরের সমস্ত শিরা উপশিরা সব ছিঁড়ে যাচেছ। যন্ত্রণা হচ্ছে প্রচণ্ড। ওদেরই বা দোষ কোথায়! ওদেরও প্রাণপ্রিয় সন্তান। তখনই লজ্জা অপমান যেন আরও কঠিন, আরও শক্ত হয়ে আঘাত করছে। বারবার শুধু নিজের অপরাধকে ক্ষমা করতে পারছে না।

লজ্জা অপমানে বারবার মনে হয়েছে জীবন থেকে পালিয়ে যেতে। এমন যখন মনের অবস্থা তখন সেলফোনটা বেজে ওঠে। ওপাশে আরিফের কণ্ঠ। হ্যালো—সফিক?

হ্যাঁ, আরিফ, কেমন আছিস?

নাহ রে বন্ধু ভালো নাই।

বুঝি, তোর আর আমার তো একই অবস্থা।

কেমন আছে তোর পাপন? সফিক আহত কণ্ঠে জানতে চায়।

না, সফিক, তোর অবস্থা আর আমার অবস্থা একই রকম না। আমি বাংলাদেশে। আর তুই আছিস কানাডা। এমন একটা দেশে তুই থাকিস তোর দীপ্তের ভবিষ্যৎ ভেবে তোকে পাগল হতে হচ্ছে না। তোরা দুজন মরে গেলে দীপ্তের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরকার নিয়ে নেবে। কিন্তু আমার পাপন! আমরা দুজন মরে গেলে আমাদের পাপনের কী হবে? এই ভাবনা আমাকে ইদানীং পাগল করে তোলে। আমার পাপনের ভবিষ্যৎ একবার ভেবে দেখ!

মানছি, তোর কথার একবারে কঠিন যুক্তি আছে।

জানিস, আরিফ, আমার এখন মনে হয় খুব ভুল হয়ে গেছে। একটা সিবলিং থাকলে দীপ্তের জন্য অনেক ভালো হতো। তখন ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আবার যদি দীপ্তের মতো হয়! কিন্তু নাও তো হতে পারত!

তুই তো চাসনি সফিক, তাই হয়নি। কিন্তু আমি তো পেয়েও হারালাম। আমি তো ভালো সন্তানটাকেও বাঁচাতে পারলাম না। একটা সময় ছিল আমি ভাগ্যটাকে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এখন খুব বিশ্বাস করি। কেন আমার ভাগ্যটা এমন হলো বলতে পারিস সফিক?

এপাশ থেকে কান পেথে থাকে সফিক। সেলফোনের ভেতর দিয়ে সফিক অনুভব করে আরিফ কাঁদছে।

আরে শোন, তোর সৌভাগ্য তুই অনেক আত্মীয়স্বজন ভাইবোন সকলের মাঝে আছিস। তুই তো ভাগ্যবান আরিফ, তুই না থাকলেও পাপনের চাচা, মামা, খালা, ফুফু সবাই থাকবে। আমার এখানে? এখানে তো আমার দীপ্তের আপন আত্মীয় যারা আছে তারা তো নাম মাত্র।

না রে, পাপনের মতো ছেলের দায়িত্ব মামা, খালা, চাচা, ফুফু কেউই নিতে চায় না। ওরা দায়িত্ব নেবে শুধু আমার টাকাপয়সার, সম্পদের। যা কিছু পাপনের জন্য রেখে যাব সেটারই ওরা দায়িত্ব নেবে, আর আমার পাপনকে হয়তো না খাইয়েই রাখবে!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কিছু করতে পারে। তার মেয়ের কী যেন নাম?

পুতুল, পুতুল ওয়াজেদ, অটিস্টিক অনেক প্রোগ্রামের কথা বলছে। আন্তর্জাতিক সেমিনার ফেমিনারও করতেছে।  

রাইট, অনেক কথা বলতে দেখছি তাকে অটিস্টিক বাচ্চাদের জন্য। শুধু কথা না বলে যদি সিরিয়াসলি তেমন কিছু করে যায়, তাহলেই হইল। বাংলাদেশে তো কাজের থেকে কথা বলে বেশি। বক্তৃতা মারায় বেশি। যদি কানাডার মতো কিছু পারমানেন্ট প্রজেক্ট নেয় তাহলে অন্তত কিছু বাচ্চার উপকার হয়। পজিটিভ কিছু যদি হয় বাংলাদেশের অটিস্টিক বাচ্চাগুলোর জন্য!

করতেছে তো প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে শুনছি, দেখা যাক। সেমিনার ফেমিনারও করতেছে হরদম। সেমিনার ফেমিনারের চাইতে খুব বেশি দরকার ওদের জন্য পারমানেন্টলি কিছু করে যাওয়া।

জানি না কবে হবে, আদৌতে হবে কি না। অটিস্টিক বাচ্চাদের বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তাদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়া দরকার সরকারের। তাহলে এই অবুঝ মানুষগুলো নানা রকম নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাবে। তা না হলে কী যে হবে! আমি পাপনের কথা ভাবতে ভাবতে পাগলের মতো হয়ে যাই সফিক।

নাহ, এতটা ভেঙে পড়িস না। এতটা নিষ্ঠুর হবে না আপনজনেরা। হাজার হলেও আপন রক্ত।    

জানিস সফিক, আজকে বাবুর ছেলের বিয়ে ছিল। ওর ছেলের বিয়েতে গিয়ে খুব মন খারাপ হলো। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, বউ পেয়েছে একই রকম। ক্লাসফ্রেন্ড ছিল দুজন। দুজনেই এক সাথে পড়েছে। ওর ছেলের বউটা খুব ভালো চাকরি করছে। খুব মন খারাপ হচ্ছিল। আজ যদি আমার পাপন সুস্থ হতো, তাহলে আমিও এমন ধুমধাম করে ওর বিয়ে দিতাম। বাবুর ছেলের মতো কোনো লুক্রেটিভ জব করত। একই বয়সী তো আমাদের বন্ধুদের ছেলেমেয়েরা।

মন খারাপ করিস না আরিফ। তুই মন খারাপ করছিস ছেলেকে বিয়ে দেয়ার কথা ভেবে! আর আমি যে আজ সন্ধ্যায় কী পরিমাণ হেনস্তা, কী পরিমাণ অ্যামবেরাস হলাম দোস্ত, কী বলব!

কেন কী হয়েছে?

একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা মেয়েকে জড়ায়ে ধরে।

আহ্ হা, হা...বোঝেনি, অবুঝ শিশু তো সফিক, আমাদের ছেলেগুলো তো অবুঝ শিশু রে!

কিন্তু চারপাশের মানুষগুলো তো আরও অবুঝ রে আরিফ?

জানি রে জানি, তুই তো তবু পার্টিতে নিয়ে গিয়ে হেনস্তা হয়েছিস। আর আমি? আমি তো পাপনকে ঘর থেকে বেরই করি না।

না রে জানিস না, আমরা দেশ ছেড়ে চলে আসলে কী হবে! আমরা যাদের সাথে মেলামেশা করি তারা তো সবাই আমাদের মতো। তারা তো সবাই বোঝে না অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারটা কী? আজ যে কী পরিমাণ লজ্জিত হয়েছি তোকে কী বলব বল?

কেন কী হয়েছে?

পার্টিতে একটা বাচ্চা মেয়েকে দীপ্ত হাগ করেছে, তার বুকের কাছে মুখ নিয়ে, বুঝিসই তো ভেরি ইন্টিমেট ওয়েতে। বাচ্চা মেয়েটা খুব নার্ভাস হয়ে গেছে। আর ওদের বাবা-মা আমাকে মুখ দিয়ে যতটা সম্ভব ধোলাই করতে বাদ দেয়নি। আজকের পর থেকে আর কোথাও কোনো রকম পার্টিতে দীপ্তকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সামাজিকভাবে আমাদের মনে হয় বয়কট করবে সবাই। অথবা আমাদের নিজেদেরই উচিত না এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া। আজকে প্রমিজ করেছি আর কোনোদিন আমি দীপ্তকে কোনো পার্টি, মানুষজনের গ্যাদারিংয়ে নিয়ে যাব না।

এটা খুবই অন্যায় করা হবে ওর প্রতি, না না, এটা করিস না, যাইস কিন্তু পাশে পাশে রাখিস।

নাহ, কিচ্ছু করার নাই। অপদস্ত অপমান হওয়ার চাইতে না যাওয়া ভালো। 

আমার পাপনটাও একবার তেমন করেছিল। বাড়িতে একটা কাজের মেয়ে ছিল। সেই মেয়েটাকে একবার ওভাবে জড়িয়ে ধরে। সেটা নিয়ে সে কী যে কেলেঙ্কারি। আমি তো থাকি সরকারি কোয়ার্টারসে। কাজের মহিলার চ্যাঁচামেচিতে পুরো কলোনির লোক জড়ো হয়ে গেল। কেউ বুঝতেই চায় না যে আমার পাপন অবুঝ। পারলে কলোনির লোকজন আমার পাপনের হাড্ডি মাংস এক করে পিটিয়ে। পরে অনেক টাকাপয়সা দিয়ে নিস্তার।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় সফিক আহমেদের এপাশ থেকে। 

আরিফ আবার বলে, এই একই কারণে আমি আমার পাপনকে কোথাও নিয়ে যাই না। যেখানেই নিয়ে যাই মানুষজন এমনভাবে তাকিয়ে থাকে মনে হয় চিড়িয়াখানার কোনো জন্তুজানোয়ার দেখছে। ও যখন ছোট ছিল তখন তাও নিয়ে যেতাম। কিন্তু বড় হওয়ার পর থেকে পাপনকে আমি কোথাও নিয়ে যাই না। খুব ভোরে মাঝে মাঝে ওকে রমনা পার্কে নিয়ে যাই হাঁটাতে। জানিস, আজকে একটা নিউজ পড়লাম, সেটা হলো আমেরিকার অস্টিন মিনিসোটা সম্পূর্ণ অটিজম ফ্রেন্ডলি সিটি। দশ বছর আগে থেকে পরিকল্পনা গ্রহণ করে ওরা আজ প্রভিন্সটাকে সম্পূর্ণ অটিস্টিক ফ্রেন্ডলি সিটি বানিয়েছে। তোদের কানাডা অনেকটা মিনিসোটার মতোই। হবে কি কোনোদিন আমাদের বাংলাদেশ তেমন অটিস্টিক ফ্রেন্ডলি দেশ?

হতেও পারে, সরকার যদি প্রজেক্ট হাতে নেয় তাহলে কোনো কিছুই অসম্ভব না।

দোস্ত, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

কী আইডিয়া?

আমি বেঁচে থাকতে থাকতে কাজটা করব।

কী কাজ?

আমার ছেলেটাকে জীবনের সব আনন্দ ভোগ করতে হেলপ করব।

মানে?

মানে ঐ, ঐ যে আমরা যে করতাম, ভুলে গেলি?

বলবি তো কোনটা?

আ, হা...! ধুত শালা, তোর মাথায় দেখি এখন আর আগের মতো সবকিছু কুইক আসে না।

বল না, কোনটা? ঐ যে হাবীবের বাসায়, আমরা যেটা এনজয় করতাম। সেইটা।

তার মানে? হাও, কেমন করে?

সেম থিং। স্কট সার্ভিস। পে অ্যাজ ইউ গো।

দ্যাটস গুড, ভেরি গুড, হোয়াই নট?  

কিন্তু কথাটা বলতেই মিনু এমন ক্ষেপে গেল, কী বলব? পারলে আমাকে জ্যান্ত কবর দেয়।

সেটা মিনু ভাবি করবে। ধার্মিক হয়ে গেছে তো।

একটা ওয়ে আমি বের করে ফেলতে পারবই পারব বলেই চাপা হাসি হাসে সফিক আহমেদ এই প্রান্ত থেকে।  

তোর ওখানে সবই সম্ভব। কানাডাতে অনেক কিছুই সম্ভব, কিন্তু বাংলাদেশে সম্ভব না। আমি চাইলেও তো পারব না। এটা বাংলাদেশ, এখানে এটাতে যদি ধরা পড়ি তাহলে আমার চাকারি বাকরি সব শেষ। মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। হয়তো হাজত বাসও! তো আমি একটা জিনিসে ট্রাই দেব ভাবছি।

কী সেইটা?

আমি আমেরিকার ফ্যামিলি ভিসা নেয়ার জন্য দাঁড়াব। আস্তে আস্তে এদিকের সব গুটানো শুরু করছি। আমেরিকার ফ্যামিলি ভিসা হয়ে গেলে আমি সম্ভবত চলে যাব আমেরিকা।

খারাপ না আইডিয়াটা। দ্যাখ যদি হয় তাহলে চলে যা। ওকে দোস্ত আজ ছাড়ছি।

ঠিক আছে, আবার পরে কথা হবে। বাই।

নমিনি বিতর্ক
রওশন আরা মিনু রান্নাবান্না শেষ করে বিকালে। আছরের নামাজ শেষ করে। তারপর গোসল করে যায়  মাগরিবের নামাজ পড়তে। মাগরিবের নামাজ শেষ হলে প্রতিদিনের নিয়মে দীপ্তকে দেয় রাতের খাবার। দীপ্ত খাবার খায় খুব মনোযোগের সঙ্গে। ভাত তরকারি, পাস্তা, স্পেগেটি, নুডুলস যাই হোক কাঁটাচামচ দিয়ে সাবধানে তুলে তুলে মুখে দেয়। খাবারের সময় দীপ্ত খুব মনোযোগ দিয়ে যত্ন সহকারে খায়। দীপ্তের পোশাক বদলে স্লিপিং ড্রেস পরিয়ে টেলিভিশন অথবা কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে দেয় প্রতিরাতে। রাতের পোশাক না বদলে দিলে দীপ্ত নানাভাবে প্রকাশ করে অস্থিরতা। কিছুদিন পরপর বদল ঘটে দীপ্তের রুচি ও ইচ্ছার। কম্পিউটারে খেলতে খুব  পছন্দ করত একটা সময়। তখন কম্পিউটার ছিল একেবারে নতুন। টেলিভিশনে বাস্কেটবল দেখার নেশা ছিল অনেকদিন। যখন যেটা পছন্দ করে সেটাই করতে থাকে বিরতিহীন টানা অনেকদিন। ইদানীং হিন্দি সিনেমার প্রতি ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে। সারাক্ষণ হিন্দি সিনেমার গান দেখতে পছন্দ করে। ওসবের ভিডিও ছেড়ে দিয়ে রওশন আরা মিনু টেবিলে খাবার সাজায়। দিনের ভেতরে এই একটা মাত্র সময় একসঙ্গে তিনজন মানুষকে দেখা যায়। এই সময়টুকুতেই সংসারের প্রায়োজনীয় কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা হয় স্বামী-স্ত্রী দুজনের। 

কিছুদিন যাবৎ সেই ধরনও বদলে গেছে। খাবার টেবিলে সফিক আহমেদ কোনো রকম কথা না বলে মুখ বন্ধ করে খায়। কোনো কথা বলে না। সে কারণে রওশন আরা মিনু এখন একসঙ্গে আর খেতে বসে না টেবিলে। সফিক আহমেদ আসার আগেই শেষ করে ফেলে নিজের ডিনার। সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার ভেতরে বাড়ি এসে পৌঁছায় সফিক আহমেদ। সফিক আহমেদের জন্য টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে রওশন আরা এটা সেটা কাজ করে। সফিক আহমেদ খাবার শেষ করে কম্পিউটারে গিয়ে বসে আর রওশন আরা মিনু চলে যায় জায়নামাজে। 

আজও প্রতিদিনের রুটিনে ব্যতিক্রম ঘটে না। সফিক আহমেদ খেতে বসলে রওশন আরা মিনু অপেক্ষায় থাকে তার খাওয়া শেষ হওয়ার। হাদিসে নিষেধ আছে সারা দিন শেষে কর্মক্লান্ত স্বামী বাড়ি ফেরার মাত্র যাবতীয় দুঃসংবাদ না দেয়া। অথবা কঠিন আলোচনা থেকে বিরত রাখা। মিনু হাদিসের এই অংশটিও যথাযথভাবে মান্য করে। যতক্ষণ সফিক আহমেদের খাওয়া শেষ না হয় রওশন আরা মিনু কোনো প্রসঙ্গে আলোচনা করে না। সে যত জরুরি বিষয়ই হোক না কেন! 

আজও সফিক আহমেদ রাতের খাবার শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করে রওশন আরা মিনু। সে যখন আয়েশ করে সোফায় বসে তখন রওশন আরা মিনু চেয়ার টেনে স্বামীর মুখোমুখি হয়ে বসে—আমার একটা জরুরি কথা আছে সফিক।

বলো কী জরুরি কথা?

আব্বার অবস্থা খুব খারাপ। ঝিনু ফোন করেছিল। আমাকে দেশে যাইতে হবে।

যাও। কী করতে হবে আমাকে? টিকিট করে দিতে হবে?

সেইটা তো করবাই। কিন্তু তার আগে আমার একটা কাজ করতে হবে। হায়াত মউতের কথা বলা যায় না। আমাদের বয়স হচ্ছে। আমি ফ্লাই করার আগে আমাদের প্রপার্টির যা কিছু আছে সব একটা উইল করতে চাই দীপ্তের নামে। আর আমাদের লাইফ ইন্সুরেন্সের টাকা, সেভিংস অ্যাকাউন্টের টাকা সবকিছুর নমিনি তো হবে দীপ্ত। কিন্তু আমি সেইটার কিছু কন্ডিশন বদলাইতে চাই। আর কিছু অ্যাডিশনাল কন্ডিশন অ্যাড করতে চাই।  

দীপ্তের নামে সব উইল করে রাখো সেটা ভালো কিন্তু নমিনি কাকে করবে ঠিক করেছ?

আমি নমিনি করব ইছমত আপাকে। 

কেন ইছমত আপা কেন?

কারণ ইছমত আপা আমার মায়ের পেটের আপন বোন। সেও আমার দীপ্তকে আমার মতো ভালোবাসে। আমি যদি মরে যাই, অথবা তুমি আমি দুইজনেই মরে যাই তাহলে আমাদের দীপ্তের দেখাশুনা খাই খেদমত সবকিছুর দায়িত্ব নেবে ইছমত আপা। আর আল্লা না করুন হঠাৎ করে ইছমত আপারও যদি কিছু হয় তাহলে দীপ্তের দেখাশুনা করবে কিসমত। আমার ভাই, আমার আপন ভাই।

গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সফিক আহমেদ। যেন আজই সে প্রথম দেখেছে কোনো এক অচেনা নারীকে।  রওশন আরা মিনুর চোখের ওপর দৃষ্টি আবদ্ধ করে রাখে। তবে সে দৃষ্টির কোনো ভাষা পাঠের উপায় নেই। আরও কয়েক সেকেন্ড তেমন তাকিয়ে থাকে। তারপর ডাইনিং টেবিলের চেয়ার ছেড়ে লিভিং স্পেসের সোফার ওপর   টানটান সোজা হয়ে বসে। তর্জনী দিয়ে ইশারা করে মিনুকেও সোফায় এসে বসার জন্য। কঠিন একটুকরো হাসি গালের এক পাশে ঠেলে দিয়ে বলে—হ্যাঁ বলো বলে যাও। শুনছি, আর কী কী করতে চাও? ছেলের বিয়ে দিতে চাও। নমিনি বানাতে চাও তোমার ভাই বোনদের! কিন্তু সমস্ত কিছু ইছমত, আর কিসমত তোমার বোন ভাই কেন?

আমি ঠাট্টা তো করছি না, এভাবে কথা বলছ কেন সফিক? আমি দেশে যাবার আগে উইল করে যেতে চাই! এতে তোমার সমস্যা কোথায়?

খুব সহজ বাংলায় বলেছ, আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। তবে তনুজা, সাদেক ওরা কী দোষ করল? আমার ভাইবোন কেন নয়?

আমার অবর্তমানে আমার ছেলের দেখাশুনার দায়িত্ব আমি আমার বোন ও ভাইয়ের ওপর দিতে চাই। তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব। আমি আমার বোন ও ভাই দুজনকে ফার্স্ট ও সেকেন্ড নমিনি করতে চাই। কারণ ওদের ওপর আমি ভরসা করি বেশি। 

তুমি যেমন তোমার বোন ভাইয়ের ওপর দীপ্তকে রেখে মরে শান্তি পাবে আমিও তেমনি আমার বোন ভাইকে নমিনি করলে মরেও শান্তি পাব। শিথিল নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিয়ে সফিক আহমেদ টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টি আবদ্ধ রাখে।

না, অসম্ভব। আমি কোনোদিন তোমার বোন ভাইদেরকে দীপ্তের নমিনি করব না। তুমি ভুলে গেছ সফিক, আমি তোমার বোনকে নিজের চোখে দেখেছি দীপ্তকে পশুর মতো পেটাতে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা বেবি সিটিং করতে দিয়ে গিয়েছিলাম। কী মাইরটা না মারছিল আমার অবুঝ, অসুস্থ ছেলেকে। তোমার বোন বইলা আমি ওকে সেদিন পুলিশে দেই নাই। নইলে আমি ওকে পুলিশে ধরায়ে দিতাম।

আর কোনোদিন আমি ওকে বিশ্বাস করব ভাবছ? তোমার ভাইবোন সব একরকম। সব পাষণ্ড জানোয়ার। 

দীপ্ত ছোট্ট ছিল। দুষ্টমি করছিল। তনুজা ওকে শাসন করার জন্য ভয় দেখাতে দু-একটা চড় থাপ্পড় দিয়েছে। ওটা বাংলাদেশের সব খালা মামা, চাচা ফুপুরা করে থাকে। 

অসম্ভব, কী বলো তুমি সফিক? একটা অটিস্টিক শিশু। যে ভালোমন্দ কোনো ব্যাপারই বোঝে না। তাকে কিনা শাসন করছিল? আমি যদি সেইদিন আগে আগে বাড়ি না ফিরতাম তাহলে কোনোদিন জানতামও না আমার দীপ্তকে ওইভাবে আপন ফুফু মারতে পারে, পিটাইতে পারে। তোমার হৃদয় পাষণ্ড হয়ে গেছে সফিক। তাই তুমি এভাবে বলতে পারতেছ। যেভাবে তোমার বোন দীপ্তকে মারছিল আমি জীবনে কোনোদিনও সেই দৃশ্য ভুলব না সফিক। কোনোদিনও না। আমি কোনোদিন তোমার বোনকে ক্ষমা করব না। আল্লা ওকে এর জন্য ঠিকই শাস্তি দিব। আমি বেঁচে থাকতেই সেটা দেখে যাব। হ্যাঁ, কইলাম, দেইখা নিও, বইলা দিলাম। আহা, আমার বাচ্চারে। কিছু বলতে পারে না। ওর কোনো বোধ নাই। কত দিন না জানি পিটাইছে ঐভাবে আমার অবুঝ বাচ্চাটাকে। বলতে বলতে রওশন আরা মিনু ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে অবুঝ শিশুর মতোই।  

তুমি কী শুরু করলা? সারা দিন গাধার মতো কাজ করে আসার পর আমার ভালো লাগে না এইসব আজাইরা প্যাঁচাল। আমি কি বাসায় নাকি বের হয়ে যাব? শালার এই গজব আর ভালো লাগে না, ইচ্ছা করে আত্মহত্যা করি।  

সফিক আহমেদের রাগ ক্ষোভ দপ করে বাতাসে নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো থামিয়ে দেয় রওশন আরা মিনুর কান্না। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে—তাহলে তুমি কাল দেরিতে কাজে যেও। আমরা ল’ইয়ারের কাছে যাব। 

আমি বললাম তো তুমি আগে সিদ্ধান্ত নাও। তা না হলে ল’ইয়ারের কাছে গিয়ে আবার তর্কাতর্কি শুরু হবে। আমি দীপ্তের উইল, ইন্সুরেন্স সবকিছুর নমিনি আমার বোন এবং ভাইকে করতে চাই। তোমার বোন ভাইকে না, আমার কথা ফাইনাল। 

অসম্ভব, আমার জীবন গেলেও আমি ওদের নমিনি করব না, এবার স্বাভাবিকের চাইতে বেশি চিৎকার করে বলে মিনু।

তাহলে নমিনি করার দরকার নাই। আমরা মরে গেলে গভমেন্ট টেক কেয়ার করবে সবকিছু। গভমেন্ট ট্রাস্টির ফান্ডে সব থাকবে দীপ্তের নামে। এইটা কানাডা। এইখানে বাবা-মা মরে গেলে দীপ্তের মতো ছেলেমেয়েরা রাস্তায় পড়ে যায় না। দীপ্তদের মতো ছেলেমেয়েদের জন্য কানাডার সরকার আছে, আইন আছে।

একশবার নমিনি সিলেক্ট করার দরকার আছে। এইটাই আমার সিদ্ধান্ত। তুমি গেলে যাইবা, না গেলে না যাইবা। আমি কাইল একাই যাব ল’ইয়ারের কাছে। আমি আমার অংশেরটুকু উইল কইরা যাব। আর না হলে আমাদের দুইজনার ভাইবোনদের জয়েন্ট নমিনি করা যায় কী না দেখব।

নতুন এক অভিজ্ঞতা
লাগারদিয়া এয়ারপোর্টে বসে আছে রওশন আরা মিনু। পাঁচ ঘণ্টার ট্রানজিট। অনলাইনে দিনের অর্ধেক সময় ব্যয় করে সফিক শেষ পর্যন্ত এমিরেটস এয়ার লাইনসের টিকেট পায়। পরদিন সকাল আটটা চল্লিশের ফ্লাইট। এত ভোরে ঘুম ভাঙে না দীপ্তের। আবার দীপ্তকে ঘরে একা রেখে মিনুকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সফিক আহমেদ ছোট ভাই রফিককে অনুরোধ করলে সে রাজি হয়ে গেল। রফিক ভোরে চলে এলো মিনুকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত রাইড দিয়ে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত হেলপ করতে। মিনু সফিকের পরামর্শ মেনে নেয়। এই রুটটাতেই যাও মিনু, এটাই সবচাইতে ফার্স্ট। তুমি আমেরিকাতে পাঁচ ঘণ্টা ট্রানজিটে থাকলেও পৌঁছে যাচ্ছ দুদিন আগে। টরন্টো থেকে এমিরেটসে গেলে ট্রানজিট দুবাই। ওটাতে সময় বেশি লাগবে। কিন্তু যদি দেশে পৌঁছে বাবাকে দেখতে না পাও তাহলে আর গিয়ে লাভ কী? বরং এমিরেটসের এই রুটে আমেরিকা হয়ে যাও, দুদিন আগে পৌঁছাচ্ছ। 

হঠাৎ সফিক খুব দরদী হয়ে উঠল তার বাবার অসুস্থতার কথা শুনে! বাবার অসুস্থতার সংবাদ সত্য। এটাও সত্য বাবাকে দেখতে পাবে কি না সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন পায়নি মৃত্যুর পূর্বে মার মুখখানি শেষবারের মতো দেখতে। কিন্তু হঠাৎ সফিকের অতি আগ্রহী আর আন্তরিক হয়ে ওঠা ব্যাপারটা রওশন আরা মিনুকে করে তোলে সন্দেহপ্রবণ। 

বহুদিন পর আজ সফিকের কোমল, ভালোবাসা ভরা কথায় রওশন আরা বোবা হয়ে যায়। কবে এমন কথা শুনেছে রওশন আরার যেন আজ আর মনে নেই। সফিক আহমেদ বলে—দেখো, তুমি যদি দেশে না যাও তাহলে চিরদিন তোমার মনের ভেতরে একখানি যন্ত্রণা গ্লানি তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। তোমার বাবার অবস্থা একেবারে খারাপ। বুঝতেই পারছ। যে কোনো মুহূর্তে তোমার বাবা যদি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান চিরদিনের মতো। যদি তুমি দেখতে না পাও, তাহলে তুমি কী দিয়ে নিজের অবুঝ মনটাকে বুঝাবে। বাবার শারীরিক অসুস্থতা শুনেও যদি তাঁকে শেষ দেখা দেখতে না পাও তাহলে যতদিন বেঁচে থাকবে এক ভয়ংকর কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াবে। তোমার শুধুই মনে হবে কেন আর দুদিন আগে গেলাম না! 

পাঁচ বছর আগে সফিক আহমেদের বাবার অসুখের সংবাদে ওরা বাংলাদেশে গিয়েছিল। দীপ্তকে তখন সামলাতে খুব কষ্ট হয়েছিল সফিক আহমেদ ও রওশন আরা মিনু দুজনেরই। গাড়ির তীব্র হর্ন বাজার সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতে কান চেপে ধরে। পাগলের মতো মাথা ঠুকতে থাকে সামনে যা পায় তার ওপরে। সেবার সফিক আহমেদ বারবার প্রমিজ করেছিল—আর কোনোদিন ছেলেকে এই দেশে আনব না। তারপর দীপ্তকে নিয়ে আর যাওয়া হয়নি  বাংলাদেশে। এবার আবার দীপ্তকে দেশে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে মিনু। কাতর স্বরে বলে, বাবা দীপ্তকে দেখতে চেয়েছে। চলো না, সফিক আমরা তিনজন একসঙ্গে যাই। বাবাকে দেখা হবে আর দেশে বেড়ানো হবে।  বাবাকে দেখার পর দীপ্ত দাদাবাড়িও বেরিয়ে এলো। আমরা মরে গেলে তো আর দীপ্তের বাংলাদেশে যাওয়াই হবে না।

সঙ্গে সঙ্গে সফিক আহমেদ ক্ষেপে ওঠে—ভুলে গেছ, কী দশা হয়েছিল ছেলের? এমন অসভ্য প্রিমিটিভ টাইমের দেশে অসুস্থ ছেলেকে আবার টেনে নিতে চাও? নিয়ে যেতে চাও ওরকম হর্ন পেটানির দেশে? ওকে নিয়ে যেতে চাও? তোমার সাহস তো কম নয় মিনু। ওকে জোর করে নিয়ে গেলে ও বদ্ধ পাগল হয়ে দৌড়ে পালাবে। আর না হয় হার্টফেল করে মারা যাবে! আমি তোমাকে বলে দিলাম! 

তুমি না গেলে না যাও। আমি দীপ্তরে নিয়া যাই। সাউন্ড সাইলেন্স হেডফোনগুলো এখন অনেক অ্যাডভান্স বাইর হইছে। সেগুলো কিনে দিও। 

আগেও তো দিয়েছ কাজ হয়েছে? সারা দিন ওটা কানে আটকে দিয়ে ছেলেকে পাগল বানাব নাকি? তোমাদের বাড়ির পেছনের রেললাইনের কী হবে? আর তুমি ছেলের বিয়ের যে মহান পরিকল্পনার কথা শুনিয়েছ সেটার কী হবে? তারপর আর যাই হোক আমি আমার এই ছেলেকে দেশে নিয়ে দিতে পারি না। 

কী বলছ তুমি? বাবা তো সত্যিই দীপ্তকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করছে, এইটা কি মিথ্যা কথা নাকি?

দুটাই সত্য। তোমার বাবার ইচ্ছাও সত্য। তোমার ইচ্ছাও সত্য। তাই আমি কোনো সত্যকেই এখন আর সত্যরূপ নিতে দিতে পারি না। এটা আমার ফাইনাল কথা। এখন তুমি দেশে গেলে যাও, না গেলে না যাও। সেইটা তোমার ইচ্ছা।

সফিকের এই মন্তব্যের পর অনুরোধ, উপরোধ কিছুই করার উপায় থাকে। এটা সত্য অস্বাভাবিক কষ্ট হয়েছিল দীপ্তের। দীপ্তের সেই কষ্টের কথা মনে হতে আর ওকে দেশে নেয়ার সাহস হয় না। আজ সফিককে টিকিটের জন্য অনুরোধ করতে হয়নি। আগে যখন দেশে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে বহুবার অনুরোধ করতে হয়েছে টিকিটের জন্য। অনুরোধ ছাড়াই অনলাইনে ভিসা কার্ডে পে করে আজ টিকিট কেটে দিল সফিক আহমেদ।

রওশন আরা মিনুর পরিবারের জন্য চকোলেট, ক্যান্ডি, ড্রাই ফুড, সিরিয়াল, কিছু জ্যাম জেলি, থেকে শুরু করে নানা রকমের উপহারও কিনে আনল। সফিক আহমেদের এই ধরনের আচরণ মিনুর কাছে অতি যত্ন মনে হয়। তখন ওর মনে পড়ে—অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। বিদায়ের সময় রওশন আরা মিনুকে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখায়।  করুণ কণ্ঠে সে সফিক আহমেদকে—একটু এদিকে আসো, একটা কথা শুনে যাও। এই বলে বেডরুমের ভেতরে  ডেকে নিয়ে যায়। সফিক আহমেদের দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে। ডান হাতটা নিজের মাথার ওপর রেখে কান্না বিগলিত কণ্ঠে বলে—আমি আমার দীপ্তকে আল্লার হাওলা কইরা তোমার কাছে রাইখা যাইতেছি। ছেলেকে ভালো রাখার জন্য আমি দিনরাত আল্লাকে ডাকি। এই কানাডাতে কোনো কাজকাম, চাকরিবাকরি করলাম না। নিজের কোনো ক্যারিয়ার করলাম না।

এই দেশের মাস্টার্স, পিএইচডি নিয়াও কিছু করলাম না। শুধু আমার অসুস্থ ছেলের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিলাম। ওকে রাইখা আমি কোনোদিনও একা একা দেশে যাই নাই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দেশে না গেলে বাবাকেও তো আর কোনোদিন দেখব না। কথা দাও। আমার মাথা ছুঁয়ে কথা দাও, আমার অবর্তমানে তুমি ছেলের জন্য খারাপ কিছু করবা না। 

চট করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ক্ষেপে ওঠে সফিক আহমেদ। কী মনে করো আমাকে? আমি কি লুইচ্চা না বদমাইশ? আমি কিছুই করব না। তোমার ছেলের জন্য। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।

তারপরও রওশন আরা মিনু নিশ্চিত হতে পারে না। তার কাঁপন ধরা বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে থাকে খণ্ড বিখণ্ড দীর্ঘশ্বাস। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে—কথা দিলে তুমি? বলো—কথা দিলে? স্পষ্ট করে বলো।

বলছি তো আমার সাথে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চিন্তে যাও। আমি ছুটি নিয়ে নেব দুসপ্তাহের জন্য অফিস থেকে। ওকে আমি দেখব। ভুলে যেও না দীপ্ত আমারও সন্তান।  

যদিও সফিক কথা দেয় কিন্তু কেন যেন মিনু এই কথার ভেতর স্বস্তি ভরা নির্ভরতা পায় না। তীব্র সন্দেহের দলা কালো মেঘের মতো রওশন আরা মিনুর মনের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করে রাখে। ক্রমাগত তোলপাড় হতে থাকে মনের গভীরে। আজ অনেক বছর! কত বছর হবে? মিনু ভাবে, মনে মনে হিসাব মেলায়। প্রায় ষোলো বছর তো হবেই কোনো শারীরিক সম্পর্ক নেই। স্বামী-স্ত্রীর মিলন বলতে যা বোঝায় সেটা আর হয় না সফিকের সঙ্গে। সফিকের নিজেরও বোধ হয় আর কোনো চাহিদা নেই। কিন্তু সফিক সেদিন দীপ্তের জন্য যে প্রস্তাব করেছে সেটা শোনার পর থেকে রওশন আরা মিনুর শরীর, হৃদয়, আত্মা সবটুকু কেঁপে উঠেছে। মিনুর মনের ভেতরে পাথরের মতো জমাট বেঁধেছে কঠিন সন্দেহ, যন্ত্রণা, ভয়। তার থেকে কিছুতেই সে মুক্তি পাচ্ছে না।

সফিক কেন এমন প্রস্তাব করল? তাহলে কি সফিক বাইরে কোথাও অন্য নারীর কাছে যায়? এই কারণে কি সে আর তার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে না? তাহলে কি সফিক সেক্সের চাহিদা মিটিয়ে আসে অন্য কোথাও?  

ভাবা যায় না
ওয়েটিং এরিয়াতে রওশন আরা মিনু বসে থাকলেও ছটফট ছটফট করছে তার ভেতরটা। ভালো লাগে না এই অপেক্ষা, এই বসে থাকা। ত্রিশ বছর কানাডার প্রবাস জীবন। বেশ কয়েকবার দেশে গেছে একা। সেটা দীপ্ত  জন্মের আগে। তখন এমন অস্থিরতা গ্রাস করেনি। বরং ঘুরে ঘুরে উপভোগ করেছে ট্রানজিটের সময়গুলো। এয়ারপোর্টের ভেতরের শপিং মলের সমস্ত শপগুলো ঘুরে বেড়ানো। রেস্টুরেন্টগুলো থেকে এটা সেটা কিনে খাওয়া, বেশ ছিল। আজ ট্রানজিটে বসে মিনুর ইচ্ছা করে এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে ফিরে আসতে ছেলের কাছে। বেশ কয়েক বছর থেকে সে একখানা ছোট সাইজের কোরান শরিফ আর তসবি রাখে ব্যাগের ভেতর। যেহেতু কোরান শরিফ থাকে ব্যাগের ভেতরে সেহেতু কোরান শরিফের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধায় ব্যাগটাকে ধরে রাখে বুকের কাছে।  

অস্থিরতা যখন কিছুতেই কমে না তখন ব্যাগ থেকে তসবি বের করে পড়া শুরু করে। তসবি পড়ে আর সবকিছুর ওপর পেতে রাখে বিহ্বল দৃষ্টি। যে দৃষ্টি কোনো দৃশ্য ধারণ করে না, কোনো গল্প খোঁজে না। ওয়েটিং এরিয়াতে কত রকম মানুষের ভিড়! কিন্তু মিনু কিছুই দেখে না। শুধু দুলে দুলে তসবি পড়ে। প্লেনে ওঠার আগে যদি পাঁচ লাখ কলেমা খতম হয় তাহলে সে দীপ্তের জন্য বকশে দিতে পারবে। সেই ভাবনায় রওশন আরা মিনুর কলেমা পড়ার গতি বৃদ্ধি পায়। 

দুই লাখ কলেমা হয়তো তখন পড়া হয়েছে। এ সময়ে বছর এক বা দেড় বছর বয়সী শিশুকে স্ট্রলারে ঠেলে এক জোড়া দম্পতি এগিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে আনুমানিক চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটা ছেলে ও এগারো-বারো বছরের একটা মেয়ে। ঠিক রওশন আরা মিনুর পাশের চেয়ারে বসে মহিলা। তার পাশে পুরুষটি এবং পর্যায়ক্রমে ছেলে ও মেয়ে। স্ট্রলার এগিয়ে মহিলা তার সামনে রাখে। স্ট্রলারের সামনে ঝুঁকে বেল্টের বন্ধন মুক্ত করে সে যে শিশুটিকে বের করে কোলে বসায়। রওশন আরা মিনু অবাক বিস্ময়ে সেই শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সন্ধানী চোখে দেখে একবার পুরুষ একবার নারীটাকে। 

বেশ মনোযোগ দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে তাদের সঙ্গে টিনেজার মেয়ে ও ছেলেকে। একবার দেখে স্ট্রলার থেকে তুলে নেয়া শিশুটিকে। ক্রমাগত রওশন আরা মিনুর দৃষ্টি টেলিভিশনে পর্দায় আটকানো কোনো নাটক, সিরিয়াল  দেখার মতো স্থায়ী হয়। পাশে এসে বসা এই পাঁচজন মানুষের ওপর এবার ওর নজর শুধু নয়, সম্পূর্ণ আগ্রহ পর্যন্ত আটকে যায়। পুরো পরিবারের সবগুলো মানুষ সাদা অর্থাৎ যাদের বলে হোয়াইট। শুধু মহিলার কোলে যে শিশুটি সে সাদা নয়। রওশন আরা মিনু ভুলে যায় তার অবস্থান। দৃষ্টির বিভ্রম নয় সেটাও সে নিশ্চিত! সে সঠিক।  পাশের চেয়ারে বসা নারীটির কোলে যে শিশুটি সে সাদা নয়। এশিয়ান শিশু, এবং শিশুটি কন্যা শিশু। কারণ শিশুটির স্ট্রলার থেকে শুরু করে যাবতীয় কিছু গোলাপি রঙের মারমেইড ব্রান্ডের। রওশন আরা মিনু খুব কাছে বসে যেন প্রত্যক্ষ নয়, যেন পর্যবেক্ষণ করে চলে। শিশুটি ক্রমাগত কাঁদছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে বিরতিহীন।  পরনে হালকা গোলাপি সোয়েটার। সেটা খুলে দিলে এবার দেখা যায় ভেতরেও গোলাপি হাতা কাটা ফ্রক। পায়ে হালকা গোলাপি রঙের জুতা। চেয়ারে বসার পর নো, বেবি, নো...ডোন্ট ক্রাই মাই বেবি...এইসব সোহাগি কথা, আদর ভালোবাসায় ভরানো কথা। আহ্লাদি সুরে যেন আবৃত্তি করছে। করতে করতে শিশুটির পোশাক বদলায়। নতুন বীব বাঁধে। যখন শিশুটার মা এইসব কাজ করে তখন তাকে ঘিরে থাকে তার স্বামী এবং বাকি দুটো সন্তান। 

রওশন আরা মিনু কিছুতেই মেলাতে পারে না। মনে মনে হিসাব মেলায়—কী হতে পারে? স্বামী-স্ত্রী তো সাদা চামড়ার, বড় সন্তান দুটিও তাদের মতোই সাদা। তাহলে কোলের মেয়েটি দেখতে চাইনিজ বাচ্চাদের মতো কেন? এবং বাচ্চাটা দীপ্তের মতো অটিস্টিক। তবে শিশুটির অবস্থা দীপ্তের চাইতে নাজুক। দীপ্ত যখন ওর বয়সী ছিল তখন  ছিল ভারি সুন্দর। ধীর, শান্ত, আর হাসি ভরা মুখের শিশু। দীপ্তের মুখ দিয়ে ওভাবে কখনো লালা গড়াত না। দীপ্ত কখনো ওভাবে ক্রমাগত চেঁচিয়ে কাঁদত না। চেঁচিয়ে কেন, মনে হতো কোনো রকম কান্নাই সে জানাত না। দীপ্ত ছিল তুষার মানুষদের মতো শীতল। দীপ্ত হাসত, বেশ খিলখিল করে। আর হাসলে দীপ্তের গালে দুটো টোল পড়ত। আহা কী অপূর্ব ছিল সেই দীপ্ত। আর দীপ্তের স্বাস্থ্য ছিল নাদুসনুদুস। এক ফিডার দুধ পেলে চুকচুক শব্দে শেষ করে ফেলত কিছুক্ষণের ভেতরেই। আর একদৃষ্টিতে ফিডারটা ধরে রাখত চোখের সামনে। 

শিশুটির কান্নায় রওশন আরা মিনুর শিশু দীপ্তর স্মৃতিচারণে ছেদ পড়ে। মিনু লক্ষ করে বড় ছেলেটি মায়ের কোল থেকে প্রায় জোরপূর্বক তুলে নিল। তুলে নিয়েই বুকের কাছে সোহাগ ভরা যত্নে চেপে ধরে নো নো নো...বলে হাঁটতে হাঁটতে ভিড় থেকে বের হয়ে যায়। সে গিয়ে দাঁড়ায় কাচ ঘেরা জানালার ওপাশে। যেখান থেকে এয়ারপোর্টের পুরো দৃশ্য চোখে পড়ে। অসংখ্য প্লেন অপেক্ষায় আছে। ভাইটাকে ওখানে নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। মুহূর্তে অনুসরণ করে বোনটা। 

ওরা দুজন কান্নারত শিশুটাকে নিয়ে দূরে চলে গেলে রওশন আরা মিনুর পাশে হঠাৎ যেন নেমে আসে শান্ত নীরবতা। হাসিমুখে মহিলার ওপর দৃষ্টি আরোপ করে রওশন আরা মিনু। কয়েকবার দৃষ্টি বিনিময়ের পর মহিলা রওশন আরা মিনুকে হায় বলে হাসে। রওশন আরা মিনু বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করে তোমরা কোথায় যাচ্ছ? মহিলা হেসে উত্তর দেয় আমরা আসছি চায়না থেকে। যাচ্ছি ক্যালিফোর্নিয়াতে। ওহ, আচ্ছা, বলে রওশন আরা মিনু নিজের ভেতরে বাক্য সাজায়। কীভাবে প্রশ্নটা করবে! দুবার সাজিয়ে সে ইংরেজিতে জানতে চায়—তোমার কোলে বাচ্চাটা কি তোমার?

মহিলা ইংরেজিতে উত্তর দেয় এখন আমার বেবি। আমি ওকে চায়না থেকে অ্যাডপ্ট করে নিয়ে এলাম। 

আমিও দেখে অনুমান করতে পারছি। বড় ছেলে ও মেয়েটি তোমার বায়োলজিক্যাল, তাই না?

ওহ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরা আমার বায়োলজিক্যাল। কিন্তু লিটল ডটার সেও এখন আমার, মাই ওন। আই অ্যাম হার মাদার নাও। ও আমার মেয়ে, লিগ্যাল মেয়ে এখন। 

আচ্ছা, তোমার তো ছেলে ও মেয়ে দুটাই আছে, তারপরও তুমি অ্যাডপ্ট করলে কেন?

হ্যাঁ, আমার দুটোই আছে। ওরা আছে বলেই তো ছেলেমেয়ে পাওয়াটা গডের কত বড় আশীর্বাদ আমি সেটা অনুভব করতে পারি। ওদের প্রতি আমাদের অনেক দায়িত্ব। শুধু নিজের বায়োলজিক্যাল সন্তান না। পৃথিবীতে যেসব শিশু গড পাঠিয়েছে তাদের প্রতিও আমাদের অনেক দায় ও দায়িত্ব আছে। গড আমাদের দুটো সুস্থ, হেলদি চাইল্ড দিয়েছে এবং দুটো ছেলেমেয়েকে যথেষ্ট খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করার মতো সামর্থ্য দিয়েছে। তাই গডের কাছে গ্রেটফুলনেস প্রকাশ করার জন্য আমরা কী করব ভাবছিলাম। এ সময়ে একদিন টেলিভিশনে চায়নার ওপর একটা ডকুমেন্টরিতে দেখতে পেলাম। চায়নাতে এক মিলিয়ন অরফেন মেয়ে আছে। ওদের মা-বাবারা বোধহীন, বোকা। এই পিতামাতারা পুত্রসন্তান না পাওয়ার ব্যর্থতা ও হাতাশা থেকে এই মেয়ে শিশুগুলোকে পরিত্যক্ত করে ফেলে গেছে। আমাদের আয় হিসাব করে দেখলাম আমরা আমাদের ইনকামের সক্ষমতা দিয়ে আরও দুটি শিশুকে সচ্ছলতার সাথে প্রতিপালন করতে পারব। আমি আর আমার স্বামী পিটার তখন আমাদের ছেলে ডেভিড আর মেয়ে ক্যাথরিনের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম। ওরাও আমাদের পরিকল্পনা শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। 

রওশন আরা মিনু মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকে মহিলার পরিকল্পনার কথা। এই পর্যায়ে বলে—তো তোমরা কী করে একটা অটিস্টিক মেয়ে অ্যাডপ্ট করার সিদ্ধান্ত নিলে?

মহিলার চেহারায় ভোরের সূর্যের মতো উদ্ভাসিত হলো অহংকার, গর্ব আর প্রশান্তির হাসি। এ সময়ে একটি যুবক ও যুবতী এসে বসে ওদের মুখোমুখি। যুবকটির কাঁধে মাথা দিয়ে মেয়েটি দুচোখ বন্ধ করে আহ্লাদে। মহিলা ওদের দিকে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টি ফেলে মিষ্টি হাসে। তারপর একটু ঘুরে বসে যাতে রওশন আরা মিনুর আরও একটু বেশি মুখোমুখি হতে পারে। আবার বলে—আঁ হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম? 

ঐ যে তোমারা জাস্ট একটা শিশু অ্যাডপ্ট করতে চেয়েছিলে?

রাইট, ঠিক বলেছ, আসলে প্রথমে আমরা খুঁজছিলাম জাস্ট একটি মেয়ে শিশু অ্যাডপ্ট করতে। তারপরে পিটার আর আমি দুজনে সার্চ করা শুরু করলাম। আমরা কথা বললাম দুটো অরগানাইজেশনের সাথে যাদের মাধ্যমে আমরা অ্যাডপ্ট করব। শুরু হলো করসপনডেন্স। প্রতিদিন কাজের শেষে বাড়ি ফিরে আমার ফার্স্ট টাইম হয়ে উঠল অনলাইনে চাইনিজ অরফ্যান মেয়ে শিশুদের স্টাডি করা। তখন আমরা জানতে পারলাম চায়নার অরফানেজগুলোতে নাইনটি এইট পারসেন্ট শিশু এখন কোনো না কোনোভাবে ডিজঅ্যাবল। চায়নার ওয়ান চাইল্ড পলিসির কারণে এতিম মেয়ে শিশুর সংখ্যা এত বেশি হয়ে গেছে। কারণ দম্পতিরা শুধুমাত্র ছেলে সন্তান কামনা করে। সামাজিক সাংস্কৃতিক, নর্ম, মূল্যবোধের কারণে তাদের এই রকম সেক্সিস্ট মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে। ওরা চায় শুধু ছেলে সন্তান। তুমি বিশ্বাস করবে প্রতিবছর চায়নাতে আনুমানিক সাত মিলিয়ন অ্যাবরশন হয়! তার ভেতরে সেভেনটি পারসেন্ট হলো ফিমেল ফিটাস। 

ওদের কি ডিজঅ্যাবল শিশু জন্মদানের সংখ্যা বেশি? মিনু জানতে চায়।

না, কিন্তু মেয়ে শিশু জন্মের পর সেটাকে যখন ফেলে আসে তখন ক্ষুধায়, নানা রকম আঘাতে ওরা ডিজঅ্যাবল হয়ে যায়। কখনো ওরা ড্রেনের ভেতরে, কখনো ডাস্টবিনে, কখনো রাস্তার ধারে ফেলে যায়। যদি ভাগ্যক্রমে মানুষের চোখে পড়ে তো ওরা তুলে এনে রেখে যায় অরফানেজ হোমে। এই ট্রানজিশন সময়ে অনেকে ব্রেনে, বুকে, স্পাইনে, কচি হাত পায়ের হাড়ে আঘাত পেয়ে ডিজঅ্যাবল হয়ে যায়। এইসব পড়তে পড়তে আমার আর পিটারের মাথায় এলো আমরা দুটো ডিজঅ্যাবল বেবি অ্যাডপ্ট করব। একটা এনে একটু বড় করে পাঁচ বছর পর আরেকটা আনব। আমার নিউ বেবির নাম রেখেছি মেরি। মেরি যখন পাঁচ বছর বয়স হবে তখন আমরা আরেকটা মেয়ে আনব। তার নামও ঠিক করেছি অলরেডি, ওর নাম রাখব শেরি। কিন্তু আমাদের ভাবনার সাথে কুইক সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লেগেছিল। কারণ সর্বপ্রথম আমাদের প্রস্তুতি নিতে হয় মানসিকভাবে। প্রথমে তো একটা মেয়ে শিশুর অ্যাডপ্ট করার ব্যাপার ছিল। পরে সেটা যখন বদলাল আমাদের অনেক পড়াশুনা করতে হলো ডেভেলপমেন্টালি স্লো শিশুর পিতামাতা হওয়ার পূর্ব প্রস্তুতির। 

তোমার হাজবেন্ড এ্যাগ্রি করল? 

হ্যাঁ, হ্যাঁ, করেছে, এটা তো আমার একার সিদ্ধান্ত ছিল না। আমরা দুজনে একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তবে দুজনই আমরা প্রথমে একটু কনফিউজড ছিলাম। ডিসিশনের ইন বিটুইন, যখন ব্যাক অ্যান্ড ফোর্থ করছি তখন একদিন ডিনার টেবিলে ডেভ আর ক্যাথির সামনে কথাটা তুললাম। ওরা খুব ম্যাচিউর অ্যান্ড কাইন্ড। ওরা বলল—মাম, অ্যাডপ্ট অ্যা অটিস্টিক গার্ল। আমরা তোমার দুই ছেলেমেয়ে তো নরমাল। আমরা চারজন মিলে একটা অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বেবিকে বড় করব। সেবাযত্ন করব, এটা তো আমাদেরকে অনেক আনন্দ আর অহংকার দেবে। 

ওয়াও এই গল্প শুনতে শুনতে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ে রওশন আরা মিনু। নিজের অজান্তেই বারবার অস্ফুট শব্দে বলে ওয়াও...ওয়া...ও...তোমরা মানুষ না! তোমরা দেবতার সাক্ষাৎ দূত! তোমরা অ্যাঞ্জেল, তোমরা ফেরেশতা। তোমরা মহান। মানুষের হৃদয় এত মহৎ হতে পারে আমি ভাবতেও পারি না। 

কেন নয়? মানুষের কল্যাণের জন্যই তো মানুষের প্রয়োজন। আমরা যদি সবাই মানুষের কল্যাণের কথা ভাবতে পারি এবং দুখানি হাত একটু বাড়িয়ে দিতে পারি তাহলে পৃথিবীতে আর কোনো এতিম শিশু কাঁদবে না। এতিম শিশুদের হাসি আনন্দে ভরা এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারি আমরা। তুমি যদি এভাবে ভাবতে পারো তাহলে একদিন তোমার মনের প্রশান্তি অনেক বেড়ে যাবে।

রওশন আরা মিনু মোহাচ্ছন্নের মতো ডান হাতখানি এগিয়ে দিয়ে বলে—আমার নাম রওশন আরা মিনু। আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি, তোমার কথা মনে পড়বে সারা পথ? 

মহিলাটি রওশন আরা মিনুর হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে রেখে বলে—আমি হেলেন, হেলেন হিল। বন্ধুর মতো  একান্ত চেনা হাসি হেলেন হিলের অবয়বে। রওশন আরা মিনুর হাতটা আরও একটু চাপ দিয়ে ধরে। দৃঢ় কিন্তু আবেগ জড়ানো কণ্ঠে হেলেন হিল বলে—শুধু সারা পথ কেন মনে পড়বে? তারপর কী ভুলে যাবে?

না, না, তোমাকে কোনোদিন ভুলব না। তুমি আমার আইডল হলে আজ থেকে। মনে হচ্ছে মানুষ না, ফেরেশতার সাথে দেখা হলো।

কথা কথায় হেলেন হিল জিজ্ঞেস করে মিনুর হাজবেন্ড কী করে। কটা ছেলেমেয়ে। এই পর্যায়ে হেলেন হিল জেনে নেয় রওশন আরা মিনুর দেশ। আর্থিক সচ্ছলতা সবকিছু। তারপর বলে—একটা কথা বলি?

রওশন আরা মিনু আবেগে অভিভূত হয়ে বলে নিশ্চয় বলো। একটা গরিব দেশ থেকে এসে কানাডার নাগরিক হয়েছ। তার মানে তুমি এই পৃথিবীর ভাগ্যবান মানুষদের একজন। তুমি কি কখনো ভেবেছ একটা এতিম শিশুর মা হওয়ার কথা?

না ভাবিনি, তবে এবার ভাবব। আমার একটা ছেলে আছে অটিস্টিক। প্রথম সন্তানটা অটিস্টিক জন্মাবার পর আমার হাজবেন্ড আর দ্বিতীয় কোনো সন্তান নিতে দেয়নি। যদি আবারও অটিস্টিক জন্ম নেয়! আমার যদি আরও একটা সন্তান থাকত তাকেও তো নিশ্চয় খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করতে হতো। লেখাপড়া শেখাতে হতো। আরেকটি সন্তান হলে যেভাবে তার জন্য খরচ করতাম সেভাবে একটি এতিম শিশুকে মানুষ করার প্রজেক্ট নেব এবার আমি কানাডা ফিরে এসে।  

গুড, ভেরি গুড, আই অ্যাম সো হ্যাপি তোমার এই কথা শুনে। আমাদের আজকের পরিচয় ও আলাপচারিতা এই পর্যায়ে এসে অর্থবহ হলো, সার্থক হলো, কী বলো? 

রওশন আরা মিনু নিজের হাতের মুঠোয় হেলেনের হাতখানি শক্ত করে ধরে। তারপর আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলে—যাত্রাবিরতিতে বহু মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। কোনোদিন কারও কনটাক্ট নম্বর চাইনি। তোমাদের মতো মহান মানুষদের সাথে পরিচিত হয়ে আমি অভিভূত। যদি কিছু না মনে করো তোমার কনটাক্ট নম্বরটা দেবে?  আমি যখন বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসব তখন তোমার সাথে কথা বলতে পারব। একটা অটিস্টিক সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে আমাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাঝে আজ আর প্রেমের সম্পর্ক নেই। ভালোবাসা নেই। দুজনের দাম্পত্য সম্পর্ক নেই। আমরা দুজন এক বাড়িতে বসত করি ঠিকই, কিন্তু আমি থাকি ওপরের বেডরুমে। আর আমার স্বামী থাকে নিচের তলার বেডরুমে। অথচ তোমরা দুজন শখ করে একটা অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার  মেয়ে নিয়ে এলে তোমাদের জীবনে! আমার ভাষা রুদ্ধ হয়ে গেছে। কী বলে তোমার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করব জানি না।  

হেলেন হিল একইভাবে রওশন আরা মিনুর হাত চেপে ধরে রাখে মুঠোর ভেতরে। আবেগে রুদ্ধ প্রায় কণ্ঠে বলে—ওহ, নো, নো, আমি শুনে সত্যি কষ্ট পাচ্ছি। এটা তো ভুল! একটা নরমাল আর অটিস্টিক বেবি, দুটোর ভেতরে কী এমন পার্থক্য বলো? দুটোই তো শিশু, দুটোই তো সন্তান, দুটোই তো মূল্যবান লাইফ! 

এবার রওশন আরা মিনু কান্নায় নুয়ে পড়ে—তুমি বুঝবে না হেলেন। আমাদের বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুর জন্ম দেয়া একটা অভিশাপ। মনে করে এটা পাপের ফল। অটিস্টিক শিশু জন্ম দেয়া নারীদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।  ওরা পরিবার, সমাজ সকলের কাছেই পরিত্যক্ত। ওদেরকে সমাজের কেউ সহজভাবে গ্রহণ করে না। আর অটিস্টিক শিশুরা? ওরাও মানবেতর জীবনযাপন করে। আমি নিজের চোখে দেখেছি ওরা কত বঞ্চিত, কত অসহায়। ওরা এই পৃথিবীর কিছুই উপভোগ করতে পারে না। পারে না মানে ওদের সেই সুযোগসুবিধা করে দেয়া হয় না। দেশ, রাষ্ট্র যাই বলো এই ব্যবস্থা এখনও করতে পারে নাই।

এই আমেরিকা, কানাডার অটিস্টিক শিশুরা পৃথিবীর সবকিছুই ভোগ করে। কথা বলতে বলতে রওশন আরা মিনুর আগেব হয়তো আরও তীব্র হয়। হয়তো অনেক কষ্টের স্মৃতিতে জড়িয়ে যায়। আবেগে বিষাদে ওর কণ্ঠ বুজে আসে উদ্ভিন্ন কান্নায়। দুই হাতে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে...ওদেরকে আমাদের সমাজে পাগল মনে করা হয়। ওদেরকে বাড়ির ভেতরে, বাড়ির পরিত্যক্ত স্থানে আড়াল করে রাখা হয়। না পরিবার, না দেশ কেউ ওদের জন্য কোনো আলাদা সুযোগসুবিধা সৃষ্টি করে না। 

ডোন্ট ওরি, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে—রওশন আরা মিনুর পিঠে হাত রেখে হেলেন হিল সস্নেহে বলে। মিনুকে আরও কিছু সময় কাঁদতে দেয় হেলেন হিল। তারপর কান্নার রেশ কিছুটা কমে এলে হেলেন হিল নিজের পার্স খুলে একখানা বিজনেস কার্ড বের করে এগিয়ে দেয়।

তুমি যখন বাংলদেশ থেকে ফিরে আসবে, আমাকে ফোন করো। আমি প্রায়ই কানাডা আসি বেড়াতে। সেখানে আমার বোন থাকে। তখন তোমার সাথে দেখা করব। তোমার ছেলেকে দেখে আসব। 

ওদের আলোচনার এই পর্যায়ে ডেভিড, ক্যাথরিন স্ট্রলার ঠেলে ফিরে আসে। রওশন আরা মিনু লক্ষ করে—স্ট্রলারের মাঝখানে যেখানে শিশুদের বসানো হয় সেখানটা শূন্য। পিটারের বুকে মাথা পেতে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে চায়না থেকে সদ্য আনা অটিস্টিক এতিম শিশুটি। গভীর মমতায় পিটার তার বুকের কাছে ঠাঁই দিয়েছে শিশুটির মাথা। আর বাঁ হাত দিয়ে ধরে রেখেছে শিশুটিকে বুকের কাছে। শিশুটির কান্না থামিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে তবে ফিরেছে ওরা তিনজন।  

মোক্ষম সুযোগ
দুসপ্তাহের ছুটি পেয়েছে সফিক আহমেদ কাজের থেকে। পুরো দুসপ্তাহ বাড়িতে থাকবে সফিক আহমেদ। রওশন আরা মিনুকে বিদায় দিয়ে সফিক সোজা এসে বসে সোফার ওপর। দীপ্তের পাশে। দীপ্তের মুখের ওপর গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকার পর তার ঠোঁটের কোণায় স্পষ্ট হয় রহস্যজনক এক হাসি। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে—আয় আমরা উদর পূর্তি করি। উদর পূর্তি মানে বুঝলা মাই সান? স্টমাক ফুল!  পরে অন্য কিছু! সফিক আহমেদ ব্যস্ত হাতে দীপ্তের খাবার বাড়ে। মাইক্রো ওভেনে গরম করে খাবার সাজিয়ে দীপ্তকে টেবিলে আসতে বলে। খাবার টেবিলে বসে দীপ্ত চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে—ড্যাডি...মাআআম্মি...মাআআআম্মি...গোওওও মাআআআম্মি...। 

সফিক আহমেদ দীপ্তের চিবুকটা ধরে নিজের দিকে ফেরায়। চেয়ার টেনে ছেলের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। হাত দিয়ে ওড়ার সংকেত দেখায়। মাম্মি উড়ে গেছে। ইউর গ্রান্ডপার কাছে। বোঝাবার চেষ্টা করে মাম্মির ওড়া ও  বাংলাদেশ। বারবার একই ভঙ্গি করে বোঝাতে চেষ্টা করে মাম্মি বাংলাদেশে গেছে। আমি, আমি তোমাকে ম্যাগডোনালসে নিয়ে যাব। আমি তোমার জন্য পিজ্জা অর্ডার দেব। তুমি হিন্দি মুভি দেখবা...ওকে মাই সান? দীপ্তের শক্ত ঘন কালো কোঁকড়া চুলের গোছার ভেতরে আঙুল চালায়। মুঠোর মধ্যে ধরে নাড়া দেয়। ছেলের মাথা বুকের কাছে নিয়ে চুমো দেয় সশব্দে। তারপর বলে—অ্যান্ড, অ্যান্ড...আই উইল গিভ ইউ বেস্ট গিফট এভার মাই সান।  ডোন্ট ওরি...। ইউ ডোন্ট নিড টু স্ট্রাগল উইথ মাস্টারবেটিং আনটিল ইওর ফেনাটিক মাম্মি কাম ব্যাক। দ্রুত কথা বললে দীপ্ত কোনো কথা একেবারেই বুঝতে পারে না। উপলদ্ধি করতে পারে না কী বলা হচ্ছে। শেষের এই কথাগুলো যে দীপ্ত বুঝতে পারেনি সেটা বুঝতে পারে সফিক আহমেদ। 

এ্যাই দীপ্ত—কুইক ম্যান, ফিনিশ। দীপ্তকে তাড়াতাড়ি খাওয়ার জন্য তাড়া দেয় সফিক আহমেদ। যতই তাড়া দেয়া হোক, যতই তাড়াহুড়া করা শেখানো হোক, দীপ্ত সেসব বোঝে না। সে নিজের মতো করে ধীরে ধীরে কাঁটাচামচে খাবার তোলে। আর আস্তে আস্তে মুখে তোলে সাবধানে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে দীপ্তের খাওয়া শেষ হতে। দীপ্তকে খাইয়ে সফিক আহমেদ নিজে খেতে বসবে। এই ভেবে সফিক আহমেদ প্লেটে ভাত, ভাতের ওপর তরকারি, ডাল, ভাজি সব সাজায়। একবারেই সবকিছু গরম করে নেবে, তাহলে আর আলাদা করে গরম করতে হবে না। রওশন আরা মিনু তাড়াহুড়ার ভেতরেই সাত দিনের মতো মাছ, মাংশ, ভাজি, ডাল, চিকেন তান্দুরি, স্পেগেটি, পাস্তা, ইত্যাদি রান্না করে বক্সে সাজিয়ে রেখে গেছে। আর সাত দিনের খাবার রেখে গেছে ডিপ ফ্রিজে।  সবে মাত্র প্লেটে খাবার সাজানো শেষ এ সময়ে টেলিফোন বেজে ওঠে। এপাশ থেকে হ্যালো বলতেই শোনা যায়, ভাইয়া, তুমি ফিরেছ এয়ারপোর্ট থেকে?

না, আমি তো যাইনি, রফিক গিয়েছিল। 

উঠিয়ে দিয়ে এসেছে তোমার মিসেসকে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ...ফ্লাই করেছে।

তুমি কি খেয়েছ?

 না, খাইনি, এই তো সবেমাত্র দীপ্তকে খাওয়ালাম। এখন খাব।

না, না, তুমি খেয়ো না, আমি অলমোস্ট তোমার বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি। ওয়েট করো, আমি এলে তারপর খেয়ো। একসঙ্গে খাব আমরা দুজন। 

আবার ঝামেলা কেন করতে গেলি? মিনু তো রান্না করে রেখে গেছে এক সপ্তাহের মতো। অনেক খাবার আছে ফ্রিজে। হতাশা জড়ানো উত্তর দেয় সফিক আহমেদ। 

দ্যাটস ওকে ভাইয়া, আমাদের তো একসঙ্গে খাওয়ার সুযোগই হয় না। তোমার েউ তো আমাকে সহ্য করতে পারে না। মনে পড়ে ভাইয়া আমাদের সেই দিনগুলো? আমরা ভাইবোন বাবা আম্মা সবাই একসঙ্গে খেতাম। কী সুন্দর ছিল দিনগুলো। আর কোনোদিন তো আমরা আমাদের সেই দিনগুলো ফিরে পাব না! তনুজা কথার এই পর্যায়ে অস্থির হয়ে বলে—ওকে ওকে, ভাইয়া, পুলিশ, পুলিশ। টিকিট খাব, টিকিট, রাখি, আসছি, ওয়েট ফর মি।

টেলিফোন নামিয়ে রাখার সঙ্গে সফিক আহমেদের কপালের মাঝখানে কয়েকটা ভাঁজ স্পষ্ট হয়। সেই ভাঁজ সফিক আহমেদের কপালে এক নতুন নকশা তৈরি করে। একা একা বলে—উহু রে, তনু রে, তুই এখন না আসলেই পারতি। একা একা বিড়বিড় করে বলে আর ভাতের প্লেটের ওপর আরেকটা খালি প্লেট উলটে সেটাকে ফ্রিজে রেখে দেয়। মনে মনে ভাবে আজ তনুজা না এলেও হতো। যে কদিন মিনু দেশে থাকবে সে কদিন বলতে গেলে তনুজা রোজই আসবে। তনুজার এই আসাটা আপাতত বন্ধ করতে হবে কিছু একটা বলে।  

তখনও প্লেটে খাবারের অর্ধেক পড়ে আছে। তনুজা এসে প্রবেশ করে রিইউজঅ্যাবল গ্রোসারি ব্যাগ নিয়ে। কিচেন কাউন্টারের ওপর সেটা রাখে বেশ শব্দ করে। তারপর সেটার ভেতর থেকে সাবধানে বের করে ছোটবড় নানা সাইজের প্লাস্টিকের বক্স। একে একে ছয়খানা বক্স বের করে রাখে টেবিলের ওপর। তারপর কেবিনেট খুলে নামায় দুটো প্লেট। কণ্ঠে শ্লেষ মেশানো সুরে বলে—তোমার বউ তোমাকে সুস্থ ছেলে উপহার না দিতে পারলে কী হবে! কিচেন কিন্তু সাজাতে জানে খুব ভালো করে! তোমাকে দারুণ সাজানো একটা কিচেন গিফট করেছে...হাহাহাহা...।

এইসব কথাগুলো বলতে বলতে প্লেট দুটো নিয়ে আসে ডাইনিং টেবিলের ওপর। একটুও গরম করতে হবে না ভাইয়া, সব গরম। বক্সগুলোর ওপরের ঢাকনা খুলে টেবিলের একপাশে রাখলে সফিক আহমেদ দেখে ইলিশ মাছ, করলা ভাজি, কচুর লতি, কাঁচকি মাছের চচ্চড়ি, ভুনা ডাল। মোটকথা সফিকের সবগুলো প্রিয় খাবার তৈরি করে এনেছে তনুজা। 

একসঙ্গে খেতে খেতে তনুজা বলে—ভাইয়া, তুমি কী ভাবলে? এখন তোমার সো কলড বউটা দেশে গেছে। আমার মনে হয় এখন তোমার জন্য ডিসিশন নেয়া সহজ হবে। তুমি আমার কথা শোনো। প্লিজ। এখন তুমি মেন্টালি কিছুটা রিলিফ। তুমি রত্নার সঙ্গে অ্যাটলিস্ট ডেট করে দেখো। এভাবে থাকতে থাকতে তুমি তো বেশি দিন সুস্থ থাকবে না। তোমার হার্টের প্রবলেম হয়ে যাবে। 

নাহ, তনু, থাক। আর কী হবে! জীবনের এতগুলো সময় তো চলেই গেছে। বাকি সময়টুকুও চলে যাবে। তুই এটা নিয়ে ভাবিস না। 

আমি ভাবব না তো কে ভাববে ভাইয়া? ভাইয়ের জন্য বোনরা যতটা ভাবে, ভাইরা কি ততটা ভাবে কখনো বলো? তনুজার কণ্ঠস্বর আহ্লাদি হয়ে ওঠে। আমার যখন ডিভোর্স হলো তখন তুমি কি আমার মতো করে একবারও ভেবেছ? বলো? আমার বয়ফ্রেন্ড তো আমাকেই জোগাড় করে নিতে হয়েছে। প্রেম বিয়ে কোনোটাতে তুমি হেলপ করেছ বলো? তনুজার ঠোঁট চোখ, সমস্ত অবয়ব অভিমানী হয়ে ওঠে কথার সঙ্গে। 

আমতা আমতা করে সফিক আহমেদ বলে—আমি আসলে মনের মতো পাইনি। দু-একটা যা পেয়েছিলাম তা তোর পছন্দ হতো না। তোর নিজের পছন্দ তো বেশ ভালো। রাহুল তো তোর জন্য ভালো হয়েছে, এবার তো তুই হ্যাপি?

ঠিক বলেছ ভাইয়া। নাও আই অ্যাম হ্যাপি! আই অ্যাম নাও মোর দ্যান হ্যাপি! যদি সাজ্জাদকে ডিভোর্স না দিতাম তাহলে সারা জীবন তোমার মতো কষ্ট করতে হতো। সাজ্জাদের মতো একটা কনজারভেটিভ, ওল্ড ফ্যাশান্ড, আর অ্যাবিউসিভ নিয়ে ডেসট্রয় করতে হতো আমার টোটাল লাইফ। এখন তুমি আমার কথা শোনো ভাইয়া। তোমার বউ দুই সপ্তাহ দেশে থাকবে। এটা একটা গ্রেট চান্স তোমার জন্য। তুমি রত্নার সঙ্গে ডেট করো। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তুমি ওকে খুব লাইক করবে। সি ইজ ইওর পারফেক্ট ম্যাচিং, সাচ অ্যা মাই ডিয়ার লেডি। সো প্রিটি অ্যান্ড গরজিয়াস! তারপর তোমার এই ফ্যানাটিক, ক্রেজি বউটা ফিরে এলে তুমি সেপারেশনে চলে যাও। অবশ্য তুমি চাইলে সেপারেশনে না গিয়ে ডিরেক্ট ডিভোর্স ক্লেইম করতে পারবে। ব্যারিস্টার রেহনুমা চৌধুরীর কাছে আমি তোমাকে নিয়ে যাব। সি ইজ সো অ্যামেজিং। ওর কোনো ক্লাইন্ট কেস নিয়ে ঝুলে থাকে না। এত্ত ফার্স্ট সে ডিভোর্স কেস ফাইনাল করে তুমি সারপ্রাইজড হয়ে যাবে।  

দীর্ঘনিঃশ্বাস শূন্যতার দিকে ছুড়ে দিয়ে সফিক আহমেদ বলে—না, তনু, আর সেসব ঝামেলাতে যাব না, চলে যাক জীবন এভাবে। 

না, তা হয় না ভাইয়া, যে মহিলার কারণে তুমি একটা সুস্থ সন্তান পেলে না জীবনে, যে মহিলা তোমাকে বুঝল না সারা জীবনে! সারাক্ষণ জায়নামাজে পড়ে থাকবে। কাপড়ে চোপড়ে কাজের বুয়াদের মতো লাইফস্টাইল করে রাখবে। ওর লাইফ নেই বলে কি তোমারও লাইফ নেই? তোমার লাইফটা এভাবেই শেষ হয়ে যাবে? তুমি কি লাইফের কিছুই এনজয় করবে না? আমি বলছি তুমি ওকে ডিভোর্স করো। রত্নাকে বিয়ে করো, দেখবে তোমার একটা বিউটিফুল লাইফ হবে। অ্যান্ড রত্না ইজ ইয়াং। তোমার একটা নরমাল বেবিও হবে। তোমার আর রত্নার মতো স্মার্ট বউয়ের সঙ্গে। অ্যান্ড সি কুড গিফট ইউ অ্যা নরমাল বিউটিফুল চাইল্ড। 

না থাক ওসব কথা তনু, আমার আর ছেলেমেয়ের শখ নাই। সব শখ মিটে গেছে। যে কদিন বাঁচি দীপ্তকে দেখাশুনা করব। তারপর আমি চলে গেলে তুই যদি মনে করিস মাঝে মাঝে দীপ্তর একটু আধটু খোঁজখবর নিবি, দেখাশুনা করবি তো করিস। আমরা দুজন মরে যাবার পর গভমেন্টই সব দায়িত্ব নেবে দীপ্তর। আর তাছাড়া আমাদের টাকাপয়সা সব আমরা গভমেন্টের ট্রাস্টিতে রেখে যাব।

ভাইয়া, আসলে তোমাকে ডিপ্রেশনে ধরেছে। সে কারণে ইউ লস্ট অল ইন্টারেস্ট ফর দ্যা লাইফ। আর ধরবেই বা না কেন? এই রকম অসুস্থ ছেলে, এই রকম জায়নামাজে পড়ে থাকা ফেনাটিক বউ ডিল করতে হলে যে কোনো পুরুষেরই ডিপ্রেশন হবে! তুমি যে আজও বেঁচে আছ আমি তাই ভাবি। আমি হলে কবে সুইসাইড করতাম। বাব্বা, সাজ্জাদের দুই বছরের অত্যাচারে আমি সুইসাইডাল হয়ে গিয়েছিলাম। ওকে ডিভোর্স না করলে এতদিনে আমি কবরে থাকতাম। ভাইয়া, আমি তোমাকে বুঝাতে পারছি না। এখনও তোমার সময় আছে। তুমি এখনও দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম। তোমার বয়সী সব পুরুষরা তো একেবারে বুইড়া হয়ে গেছে। এখনও তোমাকে দেখলেই পছন্দ করবে যে কোনো মেয়ে। তোমার একটা ভালো পারমানেন্ট হাই স্যালারি জব আছে। তুমি কেন লাইফটা নতুন করে সাজাবে না? কেন লাইফটা এনজয় করবে না? 

আমি লাইফটা এনজয় করছি না তুই কেন সেটা ভাবছিস? 

না করছ না, এটাকে লাইফ এনজয় করা বলে না।

আচ্ছা বাদ দে না এইসব ঝামেলার কথা। অন্য কথা বল। বল তোর নতুন কোর্সের কতদূর?

রাখো আমার কোর্স ফোর্স। অন্য কী কথা বলব? এটাই তো সব থেকে জরুরি কথা এখন। কত বছর ধরে আমরা তোমাকে বুঝালাম। তুমি যদি বুঝতে তাহলে এতদিনে তোমার একটা নরমাল সংসার থাকত। থাকত একটা নরমাল বউ ও বাচ্চা।   

আরে না, তা হয় না, তোদের কথামতো অনেক ভেবে দেখেছি। এতে শুধু অশান্তি বাড়বে বই কমবে না। মিনুকে ছেড়ে দিলেও তো আমি দীপ্তের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারব না! দীপ্তের দেখাশুনার জন্য মিনু তো বাইরে কাজ করতে পারে না। তো দীপ্তের জন্য আমাকে সাপোর্ট দিতেই হবে। তখন দুটো সংসার টানতে টানতে আমার জীবন হবে ডবল মিজার‌্যাবল। অনে...ক...অনে...ক ঝামেলা। তার চাইতে যেমন আছি তেমনই থাক।

না ভাইয়া, তোমাকে কেন দুটো সংসার টানতে হবে? তুমি শুধু সাপোর্ট দিবা দীপ্তের। তখন তোমার এক্স ওয়েলফেয়ারে যাবে। তারটা সে জোগাড় করে নেবে। তোমাকে কেন ওর জন্যও সাপোর্ট দিতে হবে?

আহা, বেচারি তো আমার ছেলেরই দেখাশুনা করে। দীপ্তের জন্যই তো মিনু ওর ক্যারিয়ার ছেড়ে দিল। তা না হলে মিনু কত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল তোরা তো সবই জানিস। 

জানি ভাইয়া। ওরকম বইয়ের ভেতরে পাগলের মতো ঢুকে থাকলে আমরাও ভালো রেজাল্ট করতে পারতাম।  আমরাও কম ব্রিলিয়ান্ট না। তুমি তো শুধু ব্রিলিয়ান্ট ধুয়ে পানি খাবে না। তোমাকেও তো এনজয় করতে হবে তোমার লাইফটাও। লাইফ এনজয় করার জন্য আসলে দরকার ব্রিলিয়ান্ট বউয়ের চাইতে সেক্সি, প্রিটি, স্মার্ট পাটর্নার, বউ। 

ওসব এনজয় ফেনজয় নিয়ে আর ভাবি না। এখন দিনগুলো কেটে গেলেই হলো! বলতে বলতে সফিক আহমেদ প্লেট হাতে উঠে দাঁড়ায়। সিঙ্কের দিকে এগোয়, কল ছেড়ে হাত ও প্লেট একই সঙ্গে ধুয়ে ফেলে। ওভেনের হ্যান্ডেলে ঝুলে থাকা টাওয়েল দিয়ে হাত মুছে হাসতে হাসতে ডাইনিং টেবিলের পাশ কাটিয়ে লিভিংরুমের দিকে এগোয়।  তনুজা এবার দ্রুত চেয়ার ঠেলে প্লেট হাতে উঠে দাঁড়ায়। সফিক আহমেদের মতো কল ছেড়ে একই দ্রুততায় হাত ও প্লেট ধুয়ে অনুসরণ করে ভাইকে।

ভাইয়া তুমি আমাকে অ্যাভয়েড করো না তো এভাবে। অনেক হয়েছে, বহু বছর স্যাকরিফায়েস করেছ ছেলে ছেলে করে। কেউ অ্যাবানডান করতে বলছে না তোমার দীপ্তকে। তোমার সন্তান তুমিই তো টেক কেয়ার করবে। দীপ্তকে  ইমপরটেন্স দিয়েই নতুন করে জীবন শুরু করতে পারো। নতুন করে জীবন শুরু করেও তো তুমি পারবে দীপ্তের দায়িত্ব পালন করতে। সেখানে তো কোনো ব্যারিয়ার নাই। তুমি তো বিয়ের আগেই সেটেল করে নেবে দীপ্ত ইস্যু। বললাম তো...এসব এভরিথিং আমি সিরিয়াসলি ডিসকাস করেছি।

আচ্ছা, যা হবার না তাই নিয়ে জেদ করিস না তো তনু? এটা একটা পাগলামি, তুই বরং চা বানা। চল আমরা চা খাই।

না ভাইয়া, তুমি না করলেও আমি শুনব না। আমরা এটা হতে দেব না। তোমার লাইফটা এভাবে কিছুতেই স্পয়েল করতে দেব না। আম্মা, বড়পা, মেজপা, মেজ ভাইয়া সবাই এক কথায় রাজি। তোমার জন্য সকলের মনের শান্তি হারাম হয়ে আছে আজ এতগুলা বছর।

আমি বুঝতে পারছি না, কবে তোরা আমাকে এই জ্বালানো বন্ধ করবি! এবার কিছুটা রাগ জড়ানো ক্ষিপ্ত কণ্ঠে সফিক আহমেদ বলে, এই বিয়ে বিয়ে করে তো পাগল করে রেখেছিল আমাকে। আমি যে এটা কখনোই করব না এত বছরেও বুঝতে পারছিস না তোরা? আমি তোকে রিকোয়েস্ট করছি, এটা বন্ধ কর। তা না হলে আমি তোদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেব।

শোনো ভাইয়া, তুমি তো আম্মার দিকটা অন্তত দেখবে? আমাকে আম্মা রেগুলার ফোনে এই বলে কান্নাকাটি করে। আম্মা আমাকে দোষ দেয়। বলে আমি নাকি তোমাকে ঠিকমতো বুঝাই না। আমি রত্নাকে সব খুলে বলেছি। তোমাকে ওর অনেক পছন্দ আমি বুঝতে পারি। আমি কাল রত্নাকে তোমার সাথে ডেট করিয়ে দেব। কাল বিকালে রত্নাকে নিয়ে আসব তোমার এখানে। তুমি না করতে পারবে না। রত্নার মতো স্মার্ট মেয়ে আমি অন্তত দেখিনি এই টরন্টোতে। যে কয়েকদিন ভাবি এইখানে নাই সেই কয়েকদিন তুমি রত্নার সাথে ডেট করে দেখো। তোমার যদি ভালো লাগে তুমি ডিসিশন নিয়ো। না লাগলেও তো তোমার চয়েস ওপেন থাকবে। কী বলো?

সফিক আহমেদ তখনও কোনো উত্তর না দিয়ে একমনে তাকিয়ে থাকে কম্পিউটারের স্ক্রিনে। আর থেকে থেকে ভেসে আসে দীপ্তের এ্যা...এ্যা...ডাক।

ভাইয়া প্লিজ, তুমি না করো না, ভাইয়া...প্লিজ, আহ্লাদি সুরে কথা এভাবে বলে, আর সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। পেছন দিক থেকে সফিক আহমেদের গলা জগিয়ে ধরে বলে ভাইয়া—আমার কথা রাখবে না বলো? প্লিজ? ভাইয়া প্লিজ বলতে বলতে তনুজা আদুরে স্বরে কাঁদতে থাকে। আমার ভালো লাগে না ভাইয়া তোমার জীবনটা এভাবে স্পয়েল হয়ে যাওয়া দেখতে। মেঘ ছাড়া বৃষ্টির মতো দুঃখ ছাড়া কান্নায় ভরে ওঠে তনুজার দুই চোখ, টপটপিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়ায়। 

আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। আগে তুই যা, চা বানিয়ে আন। তারপর দেখা যাবে। এই বলে সে ভাবে—নাহ, তনুটা কোনোদিন আর বড় হবে না। এখন তো আর কচি খুকি না। তবুও কচি খুকির মতো কান্না করতে পারে। ড্রামা জানে বেশ ভালো।  

ছোট বোন তনুজাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে। আদরে সোহাগে আহ্লাদি করেছে পাঁচ ভাই মিলে। তনুজা যখন কোনো কিছু নিয়ে আবদার করে তখন সফিক আহমেদ এভাবেই তাকে সান্ত্বনা দেয়। আজও সফিক আহমেদ তনুজার আদুরে কান্না থামাতে থামাতে ভাবে কীভাবে তনুকে ঠেকানো যায়। হঠাৎ তার মাথায় আসে নতুন এক ফন্দি—তনু, শোন আমি আসলে রত্নার সাথে এই কদিন ঠিকই ডেট করতে পারতাম। না হয় একটা ট্রাই দিতাম। কিন্তু অসুবিধা হলো আমি আগেই টিকিট করে ফেলেছি। দীপ্ত খুব পছন্দ করে অ্যাকুরিয়ামের ফিশ দেখতে। তা ছাড়া ট্রেনে চড়তেও ওর খুব পছন্দ। ছুটি নিয়ে ফেললাম দুই সপ্তাহের। আর তো সহজে ছুটি পাব না। ভাবলাম বাড়িতে বসে ছুটিটা নষ্ট না করে ঘুরে আসি দীপ্তকে নিয়ে। ভ্যাঙ্কুভারে যাওয়ার টিকিট কেটে না ফেললে ঠিকই আমি তোর কথা রাখতাম। 

তনুজা ধপাস করে সোফার ওপরে বসে পড়ে দুই হাত দুই পাশে বিস্তৃত করে। কী বলছ ভাইয়া তুমি? কাল যে তোমার সাথে কথা হলো তখনও তো তুমি আমাকে বলোনি? 

আরে রাতে তোর সাথে কথা বলার পরই তো প্লানটা এলো মাথায়। ভাবলাম তোর ভাবি দেশে যাচ্ছে এই সুযোগে ঘুরে এলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। ফার্স্ট অফ অল সারা দিন দীপ্ত মাম্মি, মাম্মি করে জ্বালাবে না। ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে ও মাকে ভুলে থাকবে। আর সেকেন্ড হলো আমার একটা টিকিটের টাকাও বাঁচবে। তোর ভাবিকে নিয়ে যেতে গেলে একটা টিকিটের খরচ বেশি। সুতরাং এই সুযোগে একটা খরচও বাঁচালাম। তোর ভাবি চ্যাঁচামেচি করলে বলব—তোমাকে দেশে যাওয়ার টিকিট দিলাম। 

ওহ হো ভাইয়া, আমি এখন রত্নাকে কী বলি বলো? শিট। আমি একদম স্টুপিড অ্যাশহোল হয়ে যাব রত্নার কাছে।

আমি ঘুরে আসি, তারপর ভেবে দেখব। 

তুমি কবে ফিরছ? 

টোটাল টু উইকস।

তার মানে তুমি ফেরার সাথে সাথেই তোমার বউও ফিরে আসছে? 

সেরকমই তো, আমি পৌঁছাব সকালে আর মিনু ফিরবে রাতের ফ্লাইটে। 

অভিমান করে তনুজা ফিরে যায়। তনুজা চলে গেলে দীপ্তকে টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে সফিক আহমেদ এসে বসে কম্পিউটারে সামনে। এ সময়ে লক্ষ করলে যেটা নজরে আসত মেঘের আড়ালে উঁকি দেয়া চাঁদের লুকোচুরি খেলার মতো সফিক আহমেদের চেহারায় অদ্ভুত এক হাসির লুকোচুরি। চোখ দুটোতেও কেমন এক অনাবিল খুশি নাচছে। 

দীপ্তকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পুনরায় কম্পিউটারে ফিরে আসে। গুগুল সার্চ ইঞ্জিনে এসে সে টাইপ করে টরন্টো এসকর্ট সার্ভিস। সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের স্ক্রিন ভরে যায়। বিস্ময়ে দৃষ্টি যেন ক্রেজি গ্লু লাগানো কিছুর মতো আটকে যায় কম্পিউটারের স্ক্রিনে। এত এত সার্ভিস? এত এত মেয়ে। কত শত মেয়ের বর্ণনা! রাত গভীর থেকে গভীর হয়। বিছানার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে দীপ্তের নাক ডাকার শব্দ। বিছানায় যাওয়ার আগে একবার মনোযোগ দিয়ে দেখে দীপ্তের ঘুমন্ত মুখটা। 

গভীর এক ভাবনায় ডুবে যেতে থাকে। আজ সারা দিন কাজের ধকল গেল যেন অনেক বেশি। হঠাৎ ক্লান্তি আর অবসাদের ভারে শরীর মন যেন তলিয়ে যেতে থাকে গভীর কোনো সমুদ্রের অতলে। এমন ক্লান্তি তো কখনো গ্রাস করেনি। ক্রমেই বাড়ছে নিজের সঙ্গে নিজের দ্বন্দ্বটা। কাজটি কি ঠিক হবে? নিজেই উত্তর দেয় নয় কেন? বংশপরম্পরায় কার জিনে দোষ ছিল? কার জিনে খুঁত ছিল আমি জানি না, জানে না বিজ্ঞান। এখন আবার লেটেস্ট রিসার্চ বলছে এটা বংশের নয়। জিন নয়। এটা জন্মের সময় আর নানা ধরনের টকসিক প্রতিক্রিয়ার ফল।

বুঝতে চায় না সে এসব। দরকার নাই বোঝার। চিকিৎসাবিজ্ঞানের দয়ায় দীপ্তের অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার ডায়াগনস হয়েছে। দীপ্ত যদি বাংলাদেশের কোনো গ্রামে জন্মাত তাহলে তো ওকে বলা হতো জিনে ধরা। পাগল অথবা পঙ্গু। আমার অথবা মিনুর অক্ষমতা, দুর্বলতা অথবা আমাদের কোনো অজ্ঞাত ভুলে দীপ্ত অটিস্টিক। এ তো আমার অথবা আমাদের দুজনেরই অক্ষমতা। অকারণে আমার অথবা মিনুর বংশের অক্ষমতার দায় শোধ অথবা আমাদের বা পরিবেশের অপরাধ কেন দীপ্ত বহন করবে! বংশের দোষে অথবা অন্য কোনো অজানা কারণে জীবনের সব স্বাভাবিকতার বিনিময়? আমার ভীরুতার কারণে দীপ্ত বঞ্চিত হবে নিবিড় এক আনন্দ থেকে। দেহ নিংড়ানো সুখ থেকে! কেন ক্ষতি কোথায়? আমি তো পাপ দেখি না! আমার দীপ্তকে আমি সেই জীবন দেব। সে উপভোগ করবে, কানায় কানায়। পৃথিবীর সকল যুবক, সকল পুরুষ যা কিছু ভোগ করে আমার দীপ্তেরও অধিকার আছে তার সবকিছুই ভোগের। সফিক আহমেদ আত্মগতভাবে বিতর্কে জড়িয়ে যায়। আসামির কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে সমর্থন করে আত্মপক্ষ। অবতীর্ণ হয় নিজেই বাদী, নিজেই বিবাদীর ভূমিকায়। 

একটি সন্তান জীবনের চারপাশ যেন শূন্য করে দিল। মিনু আর তার মাঝখানে এই একটি সন্তানের অসুস্থতা তুলে দিল কঠিন পাথরের দেয়াল। অথচ এই সন্তানের জন্য কী ভয়াবহ আকুতি সৃষ্টি হয়েছিল একদিন সফিকের বুকের ভেতরে। মনে হয়েছে জীবনটা মরু হয়ে যাবে, জীবনের সমস্ত সংজ্ঞা বদলে যাবে যদি একটা সন্তান না জন্মে। যদি সে বাবা না হতে পারে। যদি সে বাবা ডাক না শোনে।    

সন্ধান শেষে সিদ্ধান্ত
আজ বিছানা ছাড়তে আলসেমি করে সফিক আহমেদ। অন্যদিন ওঠে ভোর সাড়ে ছয়টায়। তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে ঘর থেকে কাজে বের হয়ে যেতে হয় সাতটার মধ্যে। আজ ধীরে একেবারে অলস ভঙ্গিতে আটটার সময়ে বিছানা ছেড়ে মাথার পাশ থেকে রিসিভার তুলে নেয়। দীপ্ত এখনও ঘুমাচ্ছে একেবারেই অঘোরে। আটটার সময় দীপ্তকে ঘুম থেকে তুলে দাঁত ব্রাশ করে নাশতা খাওয়ায়। রেডি করে দিতে হয় স্কুলের জন্য। ঠিক সাড়ে ন’টায় আসে স্কুলের গাড়ি। বিছানায় জুত করে বসে প্রথমেই ফোন করে দীপ্তের স্কুলে। সেখানে ফোন করে জানিয়ে দেয় দীপ্ত দুই সপ্তাহ অনুপস্থিত থাকবে স্কুলে। কারণ ওকে নিয়ে যাচ্ছে ভ্যাকেশনে। দীপ্তের স্কুলের প্রিন্সিপাল নিয়মমাফিক বেশ অকেগুলো প্রশ্ন করে—কে নিয়ে যাচ্ছে, কখন যাচ্ছে, কবে ফিরছে, কে কে সঙ্গে থাকবে ইত্যাদি। 

সফিক আহমেদ নিজে নিয়ে যাচ্ছে শুনে একেবারে সংক্ষিপ্ত হয়ে যায় জেরা। সামান্য অযত্ন হচ্ছে সন্দেহ হলে এরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে পর্যন্ত ছেলেমেয়ে কেড়ে নিয়ে যায়। দীপ্তের বয়স এখন পনেরো। তবুও দীপ্তের অনেক কিছু একেবারেই শিশুদের পর্যায়ে বিবেচনা করা হয়। এইসব দেশে সামারে ভ্যাকেশন খুব পছন্দের বিষয়। এটা ভ্যাকেশন কালচারের দেশ। একবার বললেই হলো ভ্যাকেশনে যাবে, তাহলে আর কোনো প্রশ্ন নেই। দীপ্তের  প্রিন্সিপাল বেশ কয়েকবার অ্যাপ্রিশিয়েট করল সফিক আহমেদকে, ওয়াও...ইউ আর অ্যা ভেরি গুড ফাদার মি. আহমেদ। আই হাইলি অ্যাপ্রিশিয়েট ইট। এটা ওর মেনটাল হেলথ ভালো করবে। দীপ্ত ফিল করবে না ওর মাম্মির অ্যাবসেন্স।  

ডেড বেড ইমারজেন্সি, এই সংবাদ পেয়ে দীপ্তের মা বাংলাদেশে গেছে। এই কারণ দর্শিয়ে দীপ্তের বাবা কাজের থেকে ছুটি নিয়েছে দুই সপ্তাহের জন্য। এইসব তথ্য সব চুলচেরাভাবে নোট রাখা আছে দীপ্তের স্কুলের ফাইলে। প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা শেষ করে সফিক আহমেদ আবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ধরে দীপ্তের ওপর। তখনও দীপ্ত বিছানায় পড়ে আছে কোলবালিশ জড়িয়ে। বুকের ভেতরে একটা কোলবালিশ জড়িয়ে দীপ্ত ঘুমায়। ওটাই ওর বিছানার সঙ্গী।  তবে ঘুমের সময় দীপ্তের মুখ দিয়ে লালা গড়ায় না। এই একটা ব্যাপারে সফিক আহমেদ খুব সন্তুষ্ট।

দীপ্তের বয়সী অনেক ছেলে আছে দীপ্তের স্কুলে। কিন্তু ওদের কারও কারও মুখ দিয়ে ক্রমাগত লালা ঝরে। তেমনটা হলে দীপ্তের বালিশ বদলানোর আরেকটা ঝামেলার কাজ বহন করতে হতো জীবনভর। প্রায়ই এই বিষয়টি ভেবে আনন্দ বোধ করে সফিক আহমেদ। 

স্কুলের ব্যাপারটা আপাতত সামলানো হলো। এবার সফিক আহমেদ আইফোনের লিস্ট থেকে সার্চ করে প্রথমে প্রাইমারি কেয়ার গিভার আলফ্রেডকে এবং তারপর পরে মারিয়াকে। আলফ্রেড আসে প্রতি সোম, বুধ এবং বৃহস্পতিবার দুপুরে। দীপ্তকে টেড্র মিল উঠিয়ে ওয়ার্কআউট করিয়ে গোসল দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যায় আলফ্রেড। সপ্তাহে দুদিন বেড়াতে নিয়ে যায় কখনো পছন্দমতো জায়গায়। মারিয়া আসে মঙ্গল, শুক্র আর শনিবার। এরা দুজন যে সময়টা আসে শুধু সেই সময়টুকু রওশন আরা মিনু বিরতি পায়। 

সফিক আহমেদ টেলিফোন করে আলফ্রেড এবং মারিয়াকে। একই ভাবে অগ্রিম জানিয়ে দেয় তাদের আপাতত আসার দরকার নেই। ওদেরকেও সফিক আহমেদ একই কারণ দর্শায় কেন তাদের আসতে হবে না। 

টেলিফোন কথা শেষ করে সফিক আহমেদ ফিরে আসে কিচেনে। গরম করার জন্য পানি নেয় কল থেকে ইলেকট্রিক ক্যাটলিতে। কেবিনেট থেকে বড় একটা মগ বের করে মগ ভর্তি করে কফি বানায়। গরম কফিতে কয়েকটা চুমুক দিয়ে সে মগ নামিয়ে ফিরে আসে দীপ্তের বেডরুমে। দীপ্তকে আদর করে ডাকে—দীপ, হেই দীপ...ওয়েক আপ ম্যান, ওয়েক আপ...বিগ ম্যান।

কয়েকবার ডাকার পর দীপ্ত চোখ মেলে তাকিয়ে হাসে। হাসিমুখে দীপ্তের ঘুম ভাঙতে দেখে সফিক আহমেদের মুখেও অনাবিল এক হাসি ফুটে ওঠে। ছেলের চুলের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে মুঠোর মধ্যে ধরে নাড়া দেয়। এটাই সফিক আহমেদের আদরের ধরন। গুড ম্যান, গেট আপ ম্যান। কাম বলে হাত ধরে ছেলেকে টান দিয়ে বলে—লেটস গো ফর মর্নিং ওয়াশ, ইউ হ্যাভ টু ওয়াশ ইওর ফেস। 

সফিক আহমেদ জানে তার বেশির ভাগ কথাই দীপ্তের বোধের বাইরে। তবুও আত্মগতভাবে বলে—এখন আর কোনো মানুষের ঝামেলা নাই। সকলের আসার সম্ভাবনা বন্ধ করে দিয়েছি। মাই সান আই ক্যান টেক কেয়ার অফ ইউ ইভেন বেটার দ্যান অ্যানি বডি এলস। দীপ্তকে ওয়াশরুমে নিয়ে দাঁত ব্রাশ করে দেয়। সুন্দর করে চুল আঁচড়ে হাতে পায়ে ঘষে ঘষে লাগিয়ে দেয় লোশন। টয়লেট স্প্রে করে যখন বের করে নিয়ে আসে তখন দীপ্তর মেজাজও খুব ফুরফুরে। এই ফুরফুরে ভাবের আরেকটা কারণ। সেটা হলো ড্যাডি...। ড্যাডিকে কাছে পেতে খুব পছন্দ দীপ্তের। আজ সকালে ড্যাডিকে কাছে পেয়ে দুলে দুলে এ্যা...এ্যা...করে গান গায়। আজ আর এখন মাম্মি মাম্মি ডাকছে না। বা হাতের তালু পেতে তার ওপর ডান হাতের আঙুল দিয়ে ছোট ছোট তালি দিয়ে প্রকাশ করে গভীর উচ্ছ্বাস।  

সফিক আহমেদ জানে দীপ্ত তার মায়ের থেকে বাবার সঙ্গ বেশি পছন্দ করে। নাশতা শেষ করলে দীপ্তকে টেলিভিশনের সামনের সোফায় বসিয়ে হিন্দি গানের সিডি ছেড়ে দিয়ে নিজে এসে কম্পিউটারে বসে। এখন কয়েক ঘণ্টা দীপ্ত এভাবেই বসে থাকবে। আর আপাতত মগ্ন হয়ে থাকবে শাহরুখ খান আর দীপিকা পাডুকোনের গান, সালমান খান ক্যাটরিনা ওদের নাচগানে। প্রতি ঘণ্টায় একবার ওয়াশরুমে নিয়ে কমোডে বসিয়ে দিতে হবে প্রস্রাব করার জন্য। পুউউউ, পিইইই...এই দুটো শব্দ খুব ভালোমতো উচ্চারণ করতে পারে দীপ্ত। এই শব্দ দুটোর অনুভব আর উচ্চারণ করতে পারে বলে দীপ্তকে ডায়পার পরিয়ে রাখতে হয় না। আর এই ব্যাপারে তাই সচেতন থাকতে হয় না সফিক আহমেদকে।   

মাউস ক্লিক করে গতরাতে রেখে দিয়েছিল কয়েকটা ওয়েব অ্যাড্রেসের ওপর। এবার সে কম্পিউটারের ওপর ঝুঁকে বসে। গুগুল সার্চ ইঞ্জিনের ওয়েবসাইটগুলো একের পর এক পড়তে থাকে মনোযোগ দিয়ে—বনবনসটরন্টো ডট কম, টরন্টো প্রিমিয়ার এসকর্ট সার্ভিস, ক্যান্ডি ক্রাশ, হোম হট পিঙ্ক লিস্ট-টরন্টো, রাশিয়ান লেডিস টরন্টো এসকর্ট এজেন্সি। এইগুলো দেখতে থাকে একবারে মগ্ন হয়ে। টরন্টো সান নজরে আসতেই সেটাকে ক্লিক করে আরও একটু ঝুঁকে আসে। এতক্ষণ অক্ষরগুলো তুলনামূলক বড় ছিল। তাই চশমা ছাড়াই পড়েছে। টরন্টো সানের প্রথম পেজে—ক্লাসিফাইড লিস্টিং ফর এজেন্সি অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট এসকর্ট, অ্যাডাল্ট এনটারটেইনার। এই পেজটা গাঢ় গোলাপির ওপর নীল রঙের লেখা। সফিক আহমেদের পড়তে কষ্ট হয় এত ছোট্ট ফন্টগুলো। এবার সে চশমা বের করে নেয় হাত বাড়িয়ে। 

ক্রমেই সফিক আহমেদ আরও ঝুঁকে আসে নিজের অজান্তে—টরন্টো সান-এর মিডিয়া ক্লাসিফায়েড আঠারো বছরের ঊর্ধ্বে অ্যাডাল্টদের জন্য। এই সাইটে যেতে হলে শর্তের একটা বিরাট তালিকা। শর্তগুলো মনোযোগের সঙ্গে পড়ে তারপর অ্যাগ্রি বাটনে ক্লিক করতে বলা হয়েছে। সফিক আহমেদ মনোযোগ দিয়ে শর্তগুলো পড়তে থাকে এবং পড়া শেষ হওয়া মাত্র সে অ্যাগ্রি বাটনে ক্লিক করে। বিরাট এক তালিকা ক্লাসিফায়েড সেকশনে—অ্যামপ্লয়মেন্ট, এডুকেশন, বিজনেস, ফাইনানশিয়াল, অ্যাডাল্ট, রিয়েল এস্টেট, রেন্টালস, অটোমোটিভ। এসবের ভেতর থেকে সে অ্যাডাল্ট ক্লিক করে।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড—এবার সফিক আহমেদের সামনে ওপেন হয়ে যায় অ্যাডাল্ট পেজ। অসওয়া প্রিটি পেতি এশিয়ান, ডলার ছিক্সটি-টু গার্লস/ওয়ান আওয়ার, পারসোনাল কানেকশন চ্যাট। এইসব দেখতে দেখতে সে মাউস স্ক্রল করে নিচের দিকে নামে। অসংখ্য অ্যাড। দ্রুত সেইসবের ওপর সংক্ষিপ্ত দৃষ্টি ঘুরিয়ে সে আবার মাউস ব্যাক ক্লিক করে। কয়েকটা নাম পড়ার পর ক্যান্ডি ক্রাশ নামটা তার বেশ পছন্দ হয়। একা একা উচ্চারণ করে ক্যান্ডি ক্রাশ-উউউহুউউ...ক্রান্ডি ক্রাশ...ক্যান্ডি ক্রাশ...। আজ ঘরে মিনু নেই, সে আত্মগতভাবে কথা বলে বেশ উচ্চৈঃস্বরে।  ঘরের ভেতরে যা ইচ্ছা তাই বলুক কেউ শোনার নেই। আজ কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আজ কোনো কৈফিয়ত নেই। টেবিলের কোণায় রাখা রাইটিং প্যাড আর কলম এগিয়ে নেয়। এবার ক্যান্ডি ক্রাশের পেজে মনোযোগ স্থাপন করে। ক্যান্ডি ক্রাশ নামটা খুব মিষ্টি, ব্যতিক্রম ও আকর্ষণীয় মনে হয়।  

একটা মডেলের অ্যাড্রেসে হলো প্লাটিনাম মডেল। প্লাটিনাম মডেলের পেজ খুলে সে দাম দেখে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে—গোল্ড মডেল—তিনশ পঞ্চাশ ডলার, প্লাটিনাম মডেল—চারশ আশি ডলার, প্রতিটা মডেলই মূল্য ঘণ্টা হিসাবে। টাকার অঙ্কের পরিমাণের ওপর সফিক আহমেদ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। গোল্ড মডেল যেটা সব থেকে কম মূল্যের সেটাও ঘণ্টায় তিনশ পঞ্চাশ ডলার। 

এবার সফিক আহমেদ অস্থির হাতে ক্লিক করে টরন্টো সান-এর ক্লাসিফায়েড সেকশনের সেকেন্ড পাতায়। কাগজ কলম নিয়ে সে মনোযোগের সঙ্গে লিখতে থাকে ফোন নম্বরসহ নামগুলো—ইয়াং/ফিঞ্চ এশিয়ান বিউটি, স্কারবোরো এনা, সুইট ব্লন্ড আই, ইউ রিয়েলি লাইক। মাউস স্ক্রল করে নিচে নামাতে থাকে। যেটাই পছন্দ সেটাই সে টুকে রাখে নোট প্যাডে। এইগুলো টুকে রাখার সময় যখনই পারসোনাল কানেকশন চ্যাট আসে সেটা সে অ্যাভয়েড করে। মাউস স্ক্রল করে আরও নিচে নামে। অচেনা এক অস্থিরতা ওর ভেতরে বাড়ছে। আবারও নোট প্যাডের পাতায় লিখতে থাকে—ইটালিয়ান কিউট অ্যান্ড বাছটি জিনা, অ্যাজাক্স কিউটি/ফ্রেন্ডলি এশিয়ান, নিউ গার্ল, কনফার্ম ভাজির্ন, কনফার্ম ভাজির্ন শব্দ দুটি লিখে সে ভ্রু কুঁচকায়।

তারপর একটু হাসে, আর ভাবে আহা আমার দীপ্ত...কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে দীপ্তের দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে—দীপ...ম্যান...মাই বাডি বাবা...কনর্ফাম ভাজির্ন, ডু ইউ ওয়ান্ট দ্যাট? দীপ্ত যেখানে বসে আছে সেই সোফা থেকে ঠিক উলটো পাশে কম্পিউটার টেবিল। মাই সান, মাই দীপ এসব বলে ডাক দেয়ার কারণে দীপ্ত একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তখন চোখাচোখি হয় দীপ্তের সঙ্গে। হাসতে হাসতে সফিক আহমেদ বলে—ওকে...ওকে...বিংগো, ফাইনাল, কনফার্ম ভার্জিন। আই উইল গিভ ইউ কনফার্ম ভার্জিন। নো ম্যাটার যত টাকা লাগুক। বলে সে পেন হোল্ডার থেকে লাল রঙের পেন তুলে নিয়ে এই শব্দ দুটির সামনে তিনটে লাল রঙের স্টার মার্ক দেয়।

তারপর আবার লেখে—বিগ অ্যান্ড বিউটিফুল, টল, কার্ভড, ব্লন্ড, তারপর সে মাউস থামিয়ে মনোযোগ দিয়ে পরের পৃষ্ঠায় ক্লিক করে—এখানে সে বেছে বেছে লেখে—বেস্ট সেক্সি, ড্যানফোর্থ, এটা লেখা হলে সে গলা লম্বা করে আবার বলে—দীপ্ত, হেই ম্যান, দীপ...। কয়েকবার চিৎকার দিয়ে ডাক দেয়ার পর দীপ্ত আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বিগ ম্যান, আই গট ওয়ান ড্যানফোর্থ কিউটি, ইউ নেভার নো, ইফ ইউ আর লাকি ইউ কুড গেট রিয়েল ভার্জিন।  বাট আই থিংক ইউ উডনট মাইন্ড ম্যান। হা..., হা...হা...হা...উচ্চকিত হাসি হাসতে হাসতে উঠে যায়। ফুরিয়ে গেছে মগের কফি। আরেক মগ কফি বানিয়ে ফিরে আসে। পুনরায় নোট করে—ডলার হান্ড্রেড ছিক্সটি টু গার্ল/ওয়ান আওয়ার। আত্মগত আবার ভাবে আর বলে, গুড প্রাইস টু গার্ল। স্ট্যানিংলি বিউটিফুল, হট এশিয়ান সেক্সি অ্যামেজিংলি বিউটিফুল। নো, নো, নো এশিয়ান, আই উইল গিভ ইউ হোয়াইট ব্লন্ড। দীপ্তের উদ্দেশে এইসব রসিক মন্তব্য। কম্পিউটার স্ক্রিনের কোণায় সময় দেখে লাফিয়ে ওঠে—এ্যাই দীপ্ত, আর ইউ হাংরি ম্যান? দীপ্ত মাথা নেড়ে জানায় সে হাংরি। তখন সে গলা ছেড়ে বলে—আই নো ম্যান, ইউ আর হাংরি ফর বোথ, ফুড অ্যান্ড ফ্লেস। 

নাশতা আর লাঞ্চের মাঝখানে নানা রকম স্ন্যাকস, এটা সেটা খেতে দেয় রওশন আরা মিনু। আজ সফিক আহমেদ কম্পিউটারে ব্যস্ত থাকায় একেবারে ভুলে যায় দীপ্তকে কিছু খেতে দিতে। দীপ্তকে হাংরি বলার সঙ্গে সঙ্গে সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সফিক আহমেদ এবার কম্পিউটার টেবিল ছেড়ে উঠে আসে।    

লেটস গো ফর শাওয়ার, আই উইল মেক ইউ ক্লিন ম্যান টু ডে। ইউ নিড টু সেভ ম্যান, বলে সে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে ছেলেকে ওয়াশরুমে। কাম, ম্যান, কাম...ম্যান। শেষ কবে সে দীপ্তকে গোসল করিয়েছে ভুলেই গেছে। কারণ দীপ্তকে ব্যায়াম করানো, গোসল দেয়া, বেড়াতে বের করার জন্য আলফ্রেড আসে নিয়মিত। 

দীপ্তকে ওয়াশরুমে নিয়ে সে সমস্ত পোশাক খুলে টাওয়েল জড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। খুব সাবধানে সেভ করতে থাকে প্রথমে বগলের তল এবং পরে পুরুষাঙ্গ ঘিরে থাকা ঘন কালো লোম। পুরুষাঙ্গের চারপাশে গজানো লোম কাটার সময় এপাশ ওপাশ সরিয়ে সাবধানে রেজার চালায়। আর তখন মিটিমিটি হেসে বলে ম্যান ইউর ডিক ইজ রিয়েলি বিগ নাও...। গোসল শেষ হলে টাওয়েল পেঁচিয়ে দীপ্তকে কমোডের ওপর বসিয়ে সাবধানে দাঁড়ি মোচ সব সেভ করে। আফটার সেভ স্প্রে করে দীপ্তের পুরুষাঙ্গের চারপাশে। বগলতলায় ঘষে দেয় ডিওডরান। এইসব শেষে যখন শার্ট প্যান্ট পরিয়ে বের করে নিয়ে আসে তখন সফিক আহমেদ বলে—তুই দারুণ হ্যান্ডসাম রে দীপ। বুঝলি ম্যান? বলার সঙ্গে সঙ্গে দীপ্ত এমনভাবে হাসতে হাসতে মাথা নাড়ে দেখে মনে হয় সত্যি সে বুঝেছে।

কন্টেইনারে রাখা খাবার গরম করে দীপ্তকে খেতে দেয়। আজও প্রতিদিনের মতো দীপ্ত কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার তুলে তুলে খায় খুব দক্ষ হাতে। দীপ্ত যখন খেতে থাকে মনোযোগ সহকারে তখন সফিক আহমেদ চেয়ার টেনে দীপ্তের পাশে বসে। দীপ্তের দিকে মনোযোগ দিয়ে কী যেন ভাবে। তারপর ছেলের সেভ করা গালের ওপর আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে—ইউ ওয়ানা টু এনজয় লাইফ ম্যান? দীপ্ত হাসে আর মাথা দুলায়, এ্যা...এ্যা...এ্যা...

দীপ্তকে খাবার টেবিলে ব্যস্ত রেখে সফিক আহমেদের কী যেন মনে পড়ে। সে দ্রুত তার আইফোন নিয়ে আসে কম্পিউটার টেবিল থেকে। সার্চ করে জজের্র নম্বর বের করে জর্জকে ফোন করে। এক রিংয়ের পরই জর্জ অপর প্রান্ত থেকে হ্যালো বললে এই পার্শ্ব থেকে সফিক আহমেদ ইংরেজিতে যা বলে তার বাংলা করলে দাঁড়ায়—জর্জ, আমার ছেলের বেডরুমের দরজায় একটা পিপিং মিরর দেয়া দরকার, তুমি কি আজ আসতে পারবে?

টু ডে? জর্জ জানতে চায়? 

ইয়েস, আই নিড ইট আর্জেন্টলি, আই নিড ইট টু ডে, আজকেই, আজকেই করতে হবে জর্জ।

একটুখানি সময় নিয়ে অপর প্রান্ত থেকে জর্জ বলে—আই ক্যান, বাট নট বিফোর ছিক্স। তার মানে চারটার আগে আসতে পারব না।

কতক্ষণ সময় লাগবে তোমার ওটা লাগাতে?

দরজার ওপরে কি হোল আছে, নাকি করতে হবে?

না, না, নাই, ওটা করে তারপর সেট করতে হবে, মোটকথা সেট করতে যা লাগে তাই করবে। তাহলে কত সময় লাগতে পারে?

এ্যা হা...উউউ...অ্যারাউন্ড ফিফটিন টোয়েনটি মিনিট।

দ্যাটস ওকে...তুমি তাহলে ছয়টার সময় চলে আসো।

তোমার কাছে লুকিং মিরর আছে? না, না, নাই। তবে আমি কিনে আনতে পারি তুমি যদি বলো, হোম ডিপোতে তো পাব তাই না?

আ, হ্যাঁ, দ্যাটস বেটার। তুমি কিনে এনে রাখো, তাহলে আমার জন্য ভালো হবে, আমি এসেই সেট করে দিতে পারব। আই ক্যান সেভ আওয়ার টাইম।

দীপ্তের বেডরুমের দরজায় যখন লুকিং মিরর লাগানো শেষ হয় তখন রাত আটটা। জর্জ এলো ঠিক সাতটার সময়। কারণ জর্জ যদিও বলে সে ছয়টার ভেতরে আসবে, কিন্তু সে আসতে আসতে বাজায় সাতটা। লুকিং মিরর লাগাতে গিয়ে অবাক হয় জর্জ। প্রথমে জর্জ মনে করে সফিক আহমেদ ভুল বলছে। কিন্তু সফিক আহমেদ যখন বলে—তার ছেলে যখন ঘুমায় তখন সে বাইরে থেকে ছেলের ওপর নজর রাখতে পারবে। আজকাল ও যখন ঘুমায় তখন ওর ঘরে প্রবেশ করতে পারে না। কারণ ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘুম ভেঙে যায়। পুরনো বাড়ি তো পা ফেললেই ক্যাচর ম্যাচর শব্দ করে। 

সফিক আহমেদের এই যুক্তির সঙ্গে মাথা নাড়ে জর্জ। ঠিক আছে, কথাটার যুক্তি আছে। সফিক আহমেদ এখন যে বাড়িতে আছে এই বাড়ি কেনার পর জর্জের সঙ্গে পরিচয়। যখনই কোনো ছোটখাটো মেরামত কাজের প্রয়োজন হয় ডাক পড়ে জর্জের। বাড়ির কল থেকে শুরু করে দরজার লক পর্যন্ত যা কিছুই নষ্ট হয়, বা বদলানোর দরকার হয় এইসব কাজের জন্য সব সময় জর্জ হাজির। আজও তাকে দিয়ে দরজার লুকিং মিরর বসানোর কাজ করায়। দীর্ঘদিনের পরিচয়, জর্জ বেশি কিছু প্রশ্ন করে না। 

কাঠ ছিদ্র করার হেভি উিউটি মেশিন দিয়ে ছোট্ট একটা ছিদ্র তৈরি করে বসিয়ে দিল লুকিং মিররটা। পুরো কাজটা করতে আসলেও ওর কুড়ি মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু গপ্পসপ্প, নানা রকমের ইস্যু নিয়ে ডিসকাস, তারপর কফি। সব মিলিয়ে আটটা বাজালো জর্জ। জর্জ চলে যাওয়ার পর পুনরায় দীপ্তকে নিয়ে সফিক আহমেদকে বের হতে দেখা যায়। এবার সে গাড়ি বের করে না। বরং সে দীপ্তকে নিয়ে হাঁটতে থাকে সাইড ওয়াল্ক ধরে। হাঁটতে হাঁটতে দীপ্তকে উদ্দেশ্য করে বলে—ফলো মি দীপ। মাম্মির সাথে কথা বলবি বাবা? বাড়ি থেকে দুই ব্লক দূরে ছোট প্লাজায় বিরাট কনভিনিয়েন্স স্টোর। সেখানে এসে সে দুটো লোটো খেলে প্রথমে। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে আবার হাঁটে। এক ব্লক হাঁটার পর সে প্রবেশ করে শপার্স ড্রাগ মার্টে। এখানে ঢুকে সে সোজা ফার্মেসি সেকশন যে দিকে সেদিকে এগোয়।

শপার্সে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দীপ্তকে শক্ত হাতে ধরে রাখে সফিক আহমেদ। বাবার সঙ্গে শপার্সে ঢুকে বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে সে। ম্যাগডোনালসের মতো আরেকটা প্রিয় জায়গা শপার্স ড্রাগম মার্ট। যেসব স্টোর, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল দীপ্তের প্রিয় সেখানে প্রবেশের সঙ্গে সে হয়ে ওঠে বেশ উৎফুল্ল। আর চেষ্টা করে নিজের পছন্দের চেনা আইলের দিকে দৌড় দিতে।

ঘাড় থেকে মাথা সামনে এগিয়ে অনেকটা বকের মতো দৌড়ায় তখন। একটু আগের কনভিনিয়েন স্টোরের তুলনায় শপার্সের ভেতরে আলোর ঝলকানি অনেক বেশি। আর পণ্যের বাহার। এখানে এলে সব সময় দীপ্ত ইশারায় দেখায় চিপস আর চকোলেটের আইল। আজও সে হয়তো ভাবে তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে চিপস আর চকোলেট কিনে দেয়ার জন্য। দীপ্তকে সুখী ও শান্ত করতে দ্রুত সেদিকে এগিয়ে হাতে তুলে নেয় এক জোড়া চিপস ও দুটো কিটক্যাট। দীপ্তের মুখে এখন শিশুর মতো অনাবিল সরল হাসি। এবার দ্রুত সফিক আহমেদ এগোয় ফার্মেসি আইলের দিকে। সেখানে এসে দুই তিনটে আইল খোঁজার পর সে খুঁজে পায় কনডমের আইল। কয়েক রকমের কনডম নেড়েচেড়ে পড়ে দেখে। তারপর সে ট্রোজান ব্রান্ডের কনডমে সিন্ধান্ত নেয়। বক্সের গায়ে বড় বড় বোল্ড আকারে লেখা আলট্রা থিন, এক্সট্রা লুব্রিকেটেড। এসবের ওপর নজর দিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ে।  একই কনডমের কত রকমের কোয়ালিটি। ট্রোজান কনডম। বেশ কয়েকবার সে নামটা মনে মনে উচ্চারণ করে। বহুবার এই কনডম সে নিজের জন্য কিনেছে। তখন সে আর মিনু দুজনের মিলিত ইচ্ছায় ব্যবহৃত হতো এই কনডম।

ভুলেই গেছে কবে যেন শেষ এই কনডম সে কিনেছিল। আনমনা হয়ে ওঠে সফিক আহমেদ সামান্য সময়ের জন্য।  দীপ্ত জন্মের বছরখানেক আগের কথা। তাই তো। দীপ্ত জন্মের বছরখানেক আগে বন্ধ করেছিল কনডম কেনা। প্রায় বছরখানেক চেষ্টার পর দীপ্ত এলো। বিয়ের পর তিন বছর সে আর মিনু প্লান করেছিল তারা বাচ্চা নেবে তিন বছর পর। তিন বছর পর আর কোনো রকম কনট্রাসেপটিভের ব্যবহার ছিল না। কনট্রাসেপটিভের ইউজ বন্ধ করা হলো। তখন তারা দুজনেই বাচ্চা চাইছে। মিনু কখনো হতাশা প্রকাশ করত না। কিন্তু সে, সে যেন অধীর হয়ে উঠল। শুরু হলো ডাক্তারের কাছে যাওয়া। চিকিৎসার কত ধরন। এত ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় নাকি দীপ্তের এই ক্ষতি! এমন প্রশ্ন প্রায়ই তাকে তাড়া করে ফেরে।

তারপর! তারপর দীপ্তের জন্মের পর কয়েকবার কেনা হলো। সাধারণত যখন সে কনডমের প্যাকেট কিনত চব্বিশটার বড় একটা প্যাকেট কিনে নিত। বারবার যেন শপার্সে আসতে না হয় অথবা প্রয়োজনের সময় মজুত থাকে। কিন্তু সেও তো অনেক বছর আগের কথা। তারপর বহু বছর। আচ্ছা তখন কি আল্ট্রা থিন কনডম সে কিনেছে! ভুলেই গেছে সফিক আহমেদ! আজ এত বছর পর কনডম কিনতে এসেছে। তাও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। নিজের জন্য নয়, ছেলের জন্য! জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তো বটেই! এমন এক অভিজ্ঞতা—যে অভিজ্ঞতা শুধু দীপ্তের বাবা হলেই অর্জন করা যায়। এই অভিজ্ঞতা সে হয়তো বা শেয়ার করতে পারে বন্ধু আরিফের সঙ্গে। কারণ আরিফ তার মতোই ছেলে নিয়ে একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

এলোমেলো ভাবনার ভেতর সে ডুবে যায় কিছুটা সময়। হঠাৎ এ সময় ড্যাডিইইই ডাকে সে ফিরে আসে নিজের  ভাবনার জগৎ থেকে দীপ্তের জগতে। দ্রুত সে তুলে নেয় ট্রোজান কনডমের প্যাকেট। কাম দীপ, কাম...লেটস গো...।

প্রায় সাড়ে নটা বাজে। বাড়ি ফিরে বেশ অস্থিরতার সঙ্গে দীপ্তের জন্য দ্রুত রাতের ডিনার গরম করে। যেন সুকান্তের কবিতার মতো ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় হয়ে গেছে। তাড়াহুড়া করে ডিনার রেডি করতে এলেই তার মনে পড়ে সুকান্তের এই কবিতা। ডিনার দিয়ে সে দীপ্তের খুব একান্ত নিবিড় ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো কাছে বসে। দীপ্তের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ভালোবাসা আর সোহাগ জড়ানো হাতে। ড্যাডিকে সার্বক্ষণিক কাছে পেয়ে দীপ্ত আজ সারা দিন বেশ উৎফুল্ল উচ্ছ্বাসিত উদ্বেলিত হয়ে আছে। কী এক অদ্ভুত ব্যাপার। বাবাকে কাছে পেলে অন্যরকম সুখী উল্লাসিত অভিব্যক্তি দীপ্তর। বাবাকে কাছে পেলে দীপ্তের দেহমন যেন আনন্দে স্ফীত থাকে। দীপ্ত সব সময়ই ড্যাডিকে কাছে চায়।

কিন্তু সারা দিন বাড়ি থাকে মিনু। মিনুকে কাছে পেলে বরং এর থেকেও বেশি খুশি দোলায় দোলার কথা। কিন্তু উলটো, সফিক আহমেদের বাড়ি ফেরার সময় হলে দীপ্ত মেইন দরজার পাশে রাখা চেয়ারে এসে বসে থাকে বুভুক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মতো। উইনটারে দরজার এপাশটা বেশ ঠাণ্ডা, দরজার চিকন সুতার মতো কোনো ফাঁক দিয়ে বাতাসের চোরা প্রবেশ ঘটে। কিছুতেই ওকে ভেতরে বসিয়ে রাখা যায় না। দীপ্তের এই জেদের কারণে দরজার এপাশে একটা এক্সট্রা হিটিং বসাতে হয়েছে। কারণ কোনো কারণে তার বাবার আসতে দেরি হলে দীপ্তের রীতিমতো ঠাণ্ডা লেগে যায় শীতের কামড় সহ্য করতে করতে।

দীপ্তকে টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে তারপর সে ডায়াল করে বাংলাদেশে স্ত্রী রওশন আরা মিনুর বোন ঝিনুর নম্বরে। আজ একবারেই ঝিনু ফোন ধরে উৎফুল্ল স্বরে হ্যালো বলল। আর তেমনই স্বরে জানাল আপনি ধরেন, আপা ঠিকমতো পৌঁছেছে। ধরেন, আমি আপাকে ডাক দেই বলেই সে চিৎকার দিয়ে ডাক দেয়, আপা...। রওশন আরা মিনু অপর প্রান্ত থেকে ফোন ধরে জানায় সে ঠিকমতোই পৌঁছেছে। পথে কোনো অসুবিধা হয়নি। এই ধরনের কুশল বিনিময়ের পর সফিক আহমেদ রওশনকে জানায় সে দীপ্তকে নিয়ে এক সপ্তাহের জন্য ভ্যাঙ্কুভার যাচ্ছে। এই কথা বলা মাত্র ওপাশ থেকে রওশন আরা মিনু প্রায় চিৎকার করে ওঠে আর্তনাদের মতো।

কী বলো তুমি? আমি আসার সময় বলোনি ক্যান? কী কারণে তুমি এখন হঠাৎ কইরা ভ্যাঙ্কুভার যাইবা? বলো বলো আমাকে বলো কেন যাইতেছ ভ্যাঙ্কুভার? 

সফিক আহমেদ ধীর শান্ত স্বরে কোনো রকম উত্তেজনা অথবা হতাশা প্রকাশ না করে বলে, দীপ্ত মাম্মি মাম্মি বলে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। কয়েকদিন বেড়িয়ে নিয়ে বেড়ালে তোমাকে ভুলে থাকবে। অপর প্রান্তে রওশন আরা মিনু আর কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। বোবা ও হতবাক হয়ে অপর প্রান্তে রওশন আরা মিনু শুধু কান পেতে রাখে টেলিফোনে। এপাশে সফিক আহমেদ তখন দ্রুত রাখি বলে বিচ্ছিন্ন করে দেয় টেলিফোনের সংযোগ। 

রওশন আরা মিনুর তখন মনে পড়ে ত্রিশ বছর আগের অনেক স্মৃতি। সফিক আহমেদ তখন কত রকম কথার মালা যেন গেঁথে রাখত রওশন আরা মিনুকে মুগ্ধ করার জন্য। সফিকের যেন কথার শেষ ছিল সন্ধ্যার সেই একান্ত  নিবিড় সময়ে। তার গল্প, তার অনেক কথা বলার জন্য সফিকও যে উদগ্রীব হয়ে থাকত। যখন বিকাল ফুরিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে, হলে ফিরে যেতে হবে। তখনও সফিক আহমেদ সযত্নে মিনুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে করুণ আকুতি জানাত। আর তার চোখের পাতায় থাকত তখন জোৎস্না ঝরা উজ্জ্বলতা, আবেগ বিমুগ্ধতা। কণ্ঠে ছিল কবিতার মতো আবৃত্তি, আর একটু বসো না মিনু? 

কত কথা! জানো মিনু তোমাকে দেখা মাত্রই আমি বুঝে গেছি তুমিই আমার সেই কবিতা যার জন্য আমি থাকি পঙক্তি ঘোরের মোহে। শব্দ খুঁজি, ছন্দ মেলাই সারা রাত। কত বাক্য আমার আমার মাথার মধ্যে তৈরি হয়।  একটা কবিতা বানানোর জন্য আমি ঘুমহীন রাত কাটাই। তুমি কাছে এলে আমার দেহের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে যায় বিস্তীর্ণ এক অনুভূতি। সে অনুভূতির নাম আমি জানি না। হয়তো তাকেই বলে ভালোবাসা। কত ভাবে সফিক শুধু বোঝাতে চেয়েছে। যেন তার বলার মাঝে সবকিছুতেই সম্পূর্ণতা পায় না। জানো মিনু, তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমি সারা রাত ছটফট করি বিছানায়। জানো মিনু সারা রাত আমি কল্পনায় বহুবার তোমাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে কোলবালিশকে জড়িযে ধরি শক্ত হাতে। আর তখন অনেক কথা বলি বালিশের সাথে। কী কথা বলো সফিক জানতে চাইলে হয়তো বলেছে—সেসব কথা তো নৈসর্গিক। প্রেমে পড়লে সাধারণত একটি যুবক যা বলে থাকে!   সেই সফিকের এখন আর কোনো কথাই নেই বলার!  

রওশন আরা মিনুকে মুগ্ধতা, ভালো লাগা এবং পরিশেষে ভালোবাসার কথাটা বলার সাহস সঞ্চয় করতে নাকি পুরো দুই বছর লেগে গিয়েছিল। মিনুর প্রথম বর্ষ শেষ হয়ে দ্বিতীয় বর্ষ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সফিক আহমেদ কিছুতেই মিনুকে তার ভালোবাসার কথা জানাতে সক্ষম হয় না। যেতে পারে না বিন্দু থেকে বিসর্গে। বহুদিন তারা দুজন সন্ধ্যা অবধি মাঠে বসে গল্প করে। সফিক তার ভালো লাগার কথা বলার জন্য রওশন আরা মিনুর শরীর ঘেঁষে হেঁটেছে। হাঁটতে হাঁটতে আর্ট কলেজ, শাহবাগ পার হয়ে যায় বাংলামোটর তারপর ফার্মগেট! বলতে পারে না মিনু আমি তোমাকে ভালোবাসি এই সহজ কথাটা। যুগযুগান্তরের সহজ কথাটা হয়ে থাকে পাথর খণ্ডর মতো কঠিন আর ভারী। যেন চেতনার এক বিভ্রান্তিকর অবস্থা! 

আর যেদিন প্রকাশ করেছিল হাসতে হাসতে মিনু বৃষ্টির মাঝে ঝরা শিলাদের মতো গড়িয়ে পড়েছিল ঘাসের ওপর। তারপর ছন্দ তোলা নূপুরের মতো খিলখিলিয়ে বলেছিল—আচ্ছা আপনি এত মুখচোরা কেন বলেন তো? আমার চুলগুলো খুব সুন্দর বিলের ঢেউয়ের মতো। চুল খোলা রাখলে আপনার খুব ইচ্ছে করে আমার চুলের ভেতরে মুখ গুঁজে গন্ধ নিতে! এই কথা বলতে এত তোতলাচ্ছেন কেন? অথচ সেই সফিক এখন কত হিংস্র! কত নিষ্ঠুর! কত কঠিন কথা অনর্গল বলে চলে মিনুকে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত জর্জরিত করে দিতে! 

রওশন আরা মিনুকে সে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেতে চায়। এই ইচ্ছাটিও সফিক আহমেদ পিতামাতার নিকট প্রকাশ করতে পারত না। যদি না হঠাৎ একদিন বিকালে রওশন আরা মিনু ইউনিভার্সিটি থেকে সরাসরি সফিক আহমেদের খোঁজে তাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত না হতো। সফিকের খোঁজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সুন্দরী ছাত্রী বাড়ি পর্যন্ত এসেছে। এটা সফিক আহমেদের মা আয়েশা খাতুনকে আনন্দে বিহ্বল আর অহংকারী করে ফেলে এবং মেয়েটি দেখতে মায়াবী। কোমর পর্যন্ত কালো চুলের গোছা। ঢাকা শহরের ধানমন্ডিতে বাবার বাড়ি। বাবা পিডব্লিউডির ইঞ্জিনিয়ার। এইসব তথ্য এক বসাতেই বিবিসির সংবাদের মতো পেয়ে যায় সফিকের মা এবং সেদিনই সে মনে মনে রওশন আরা মিনুকে কীভাবে সফিকের সঙ্গে বিয়ে দেয়া যায় এই কল্পনায় পান চিবায়। টুকুর টুকুর শব্দে দাঁতে কাটে সুপারি। মিনুকে বউ করে নেয়ার সে কী আগ্রহ সফিকের মায়ের। ভাবখানা এমন সারা বাংলাদেশ চষে ফেললেও রওশন আরা মিনুর মতো এমন যোগ্য মেয়ে পাওয়া যাবে না! এই সেই সফিক আহমেদ এবং তার মা, সবাই এখন হিসাব করে কত বড় ভুল ছিল তাদের। রওশন আরা মিনুকে সেদিন পছন্দ না করলে আজ আর দীপ্তের মতো মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছেলের বাবা হতো না সফিক।  

অদৃশ্য উত্তেজনা
আজ সকাল থেকেই অদৃশ্য এক উত্তেজনায় আক্রান্ত হয় সফিক আহমেদ। প্রতিদিনের নিয়মে দীপ্তকে নাশতা দিয়ে সে এই সকালবেলাতেই মগ্ন হয়ে যায় কম্পিউটারে। এরই মাঝে একবার কম্পিউটার থেকে উঠে গতকালের মতো আজও দীপ্তকে গোসল দিয়ে সাজায়। দুপুরের খাওয়া দেয়। নিজে খেতে গিয়ে লক্ষ করে অচেনা এক অস্থিরতায় সে যে রীতিমতো আক্রান্ত। কারণে অকারণে বারবার চেয়ার ছেড়ে উঠছে দাঁড়াচ্ছে অস্থির পায়ে। 

অপ্রয়োজনীয় কাজে হাত দিচ্ছে। কিচেন কেবিনেট থেকে গ্লাস নামিয়ে পানি খাচ্ছে পিপাসা না লাগা সত্ত্বেও। এরই মাঝে পান করা হয়ে গেছে কয়েক কাপ পর্যন্ত কফি। সাধারণত সে এক কাপ বা দুকাপের বেশি কফি দিনে পান করে না। সে নিজেও অনুভব করতে পারে তার এই অবিরাম অস্থিরতা, এই ঘূর্ণিঝড়ের মতো উত্তেজনার বিষয়টা।

নিজে কফি নিয়ে দীপ্তকে বসিয়ে দেয় টেলিভিশনের সামনে। তারপর গতরাতের তালিকা থেকে বেছে বেছে নির্ধারণ করে দুটো নম্বর। দুপুর ঠিক তিনটের সময় সে ডায়াল করে প্রথম নম্বরটিতে। ক্রমাগত রিং বেজে চলে কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। দ্বিতীয় নম্বরটি ডায়াল করতেই একটি মেয়ের কণ্ঠ। ধক করে ওঠে সফিক আহমেদের বুকের ভেতর। তোলপাড় করে ওঠে সমস্ত অস্তিত্ব। অজানা উত্তেজনা তাকে একেবারে গ্রাস করে। দ্রুত সৃষ্ট উত্তেজনা সামলে সফিক আহমেদ তার টেলিফোন করার কারণ জানায়। মেয়েটিও সাবলীল উত্তর দেয়—কোথায়, কখন, কোন অ্যাড্রেসে আসতে হবে এবং তার সার্ভিস ফি। সফিক আহমেদ মেয়েটিকে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে জানায় তাকে সার্ভিস ফিয়ের চাইতে বেশি দেবে। নির্ভর করছে কতটা প্লেজার দিতে পারবে। 

মেয়েটির সঙ্গে এই ধরনের কথাবার্তা বলে। মেয়েটিকে ঠিোনা দিয়ে সফিক আহমেদ প্রায় ঝড়ে ভাঙা ডালের মতো মানসিক অস্থিরতায় ন্যুজ হয়ে থাকে অজানা এক শঙ্কায়। দীপ্তকে এই সময়ের ভেতরে ড্রেস বদলে নতুন ড্রেস পরায়। যে ড্রেসটা সব থেকে দামি ব্রান্ডের। সুন্দর করে আঁচড়ায় দীপ্তের চুল। চুলের ওপর লাগায় হালকা করে হেয়ার মুজ। দীপ্তের বেডরুমের কোথাও কিছু এলোমেলো থাকে না। বিছানার বদলে দেয় নতুন বেডশিট, বেড কভার। নিজের পারফিউম এনে স্প্রে করে দীপ্তের বিছানার ওপর। বেডরুম ও বাথরুমে হালকা স্প্রে করে এয়ার ফ্রেশনার।

ঠিক চারটার সময় বেজে ওঠে দরজার ডোর বেল। ভয় আর দ্বিধান্বিত পায়ে সফিক আহমেদ এগোয় দরজার দিকে। এ সময়ে তার মনে হয় পা দুটো কাঁপছে হালকাভাবে। সফিক আহমেদ দ্রুত ত্রস্ত হাতে দরজা খুলে ঢুকিয়ে নেয় মেয়েটিকে ঘরের ভেতর। তখন মেয়েটি যদি গভীর মনোযোগ অথবা তীক্ষ্নভাবে লক্ষ করত তাহলে তারও নজরে আসত সফিক আহমেদের দ্রুত এবং সংক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস নেয়ার ধরনটি।

এ বাড়ির দরজা জানালা সব আজ বন্ধ। যতগুলো মানুষের আসা বা টেলিফোন করার কথা ছিল সবগুলো সম্ভাবনা সফিক আহমেদ সামলে নিয়েছে গতকালই। আজ আর কেউ নেই প্রশ্ন করার। অথবা হঠাৎ চলে আসার। কারণ যাদের আসার সম্ভাবনা তারা সবাই জানে সে এখন ভ্যাঙ্কুভার। 

দরজা খুলে মেয়েটি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সফিক আহমেদ দরজা বন্ধ করে দেয়। মেয়েটিকে সোফা দেখিয়ে বসতে বললেও আপাত সফিক আহমেদ ভেতরে ভেতরে ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তু মেয়েটির চেহারায় লজ্জা বা ভীরুতার কোনো লক্ষণ নেই। মেয়েটি সুন্দরী সন্দেহাতীত। আকর্ষণীয় ফিগার। টরন্টো সানের বিজ্ঞাপন মিথ্যে নয়। অতিরঞ্জিত নয়। মেয়েটির শরীর থেকে বের হয়ে মিষ্টি পারফিউমের সুগন্ধ জড়িয়ে গেছে ঘরের বাতাসে। 

সফিক আহমেদ মেয়েটিকে একেবারে যেন নিরিখ করে চোখ দিয়ে। এই পেশার মেয়েরা ফিগারের সবটুকু প্রকাশের মতো পোশাকই পরিধান করে। মেয়েটিও তার ব্যতিক্রম না। সফিক আহমেদের নজর আটকে যায় কয়েকবার মেয়েটির স্তনের ভাঁজে। দুই স্তনের ভাঁজ দেখে বোঝা যায় বেশ বড়। কৃত্রিম নয়, কৃত্রিম হলে ভাঁজটা এত সুন্দর হতো না। কত হবে মেয়েটির বয়স? খুব বেশি হলে হয়তো পঁচিশ বা ছাব্বিশ। মেয়েটি সোফায় বসার সময় সফিক আহমেদের দৃষ্টি চলে যায় তার নিতম্বের ওপর। সেটাও আকর্ষণীয়। এই দুটোতেই সফিক আহমেদ বেশ সন্তুষ্ট হয়। মেয়েটি সম্ভবত অনুমান করতে পারে সফিক আহমেদ চোখ দিয়ে তাকে মাপছে। ভ্রু নাচিয়ে  হেসে মেয়েটি অদ্ভুত ভঙ্গিমা করে। বসতে গিয়ে হাত দিয়ে কয়েকবার সর্ট স্কার্টটা টেনে দেয়। 

সফিক আহমেদ মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে চা বা কফি চাও। মেয়েটি দ্বিধাহীন। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে—কফি নিতে পারি। সফিক আহমেদ কফি বানাতে এসে যেন কিছুটা সময় পায় কথা তৈরি করার। সে সিদ্ধান্ত নেয় কোনো রকম ভূমিকা না করে মেয়েটিকে সরাসরি বলবে—তোমাকে এনেছি আমার বিনোদন ফুর্তির জন্য নয়। তোমাকে এনেছি আমার ছেলেকে আনন্দ, আর দৈহিক সুখ দেয়ার জন্য। আবার ভাবে তাহলে যদি মেয়েটি রাজি না হয়ে চলে যায়? তাহলে সে প্রথমে কী বলবে, কীভাবে বলবে এমন এক অভিনব প্রস্তাবের কথা। 

দুই কাপ কফি হাতে সফিক ফিরে আসে সোফায়।

মেয়েটি কফির কাপে চুমুক দিয়ে চারপাশ নিরিখ করে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। তারপর জানতে চায়—তুমি একা থাকো? সিঙ্গেল? সফিক বলে না—আমি ম্যারিড, ওয়াইফ ভ্যাকেশনে গেছে। 

ওহ...আই সি, সো ইউ গট দ্যা চান্স টু চিট হার, সিওর, দিস ইজ দ্যা বেস্ট টাইম টু এনজয়। এটাই উপভোগ করার সেরা সময়।

অবশ্যই। আর আমি লাকি তোমার মতো এক্সট্রা অর্ডিনারি প্রিটি গার্ল! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এত সুন্দরী মেয়ে আসবে আজ। তুমি তো চাইলে মিস ইউনিভার্স কম্পিটিশনে যেতে পারো। আর আমি শিওর শুধু নয়, ওভার শিওর তুমি মিস ওয়ার্ল্ড হবে।

ইউ ক্রেজি, ইউ থিংক সো? নাকি আমাকে হ্যাপি করছ?

একটুও না, তবে তোমাকে পেয়ে আজকে আমি মনে করছি আমি লাকি, ভাগ্যবান।

ওহ, তাই নাকি? তাহলে আমাকে পেমেন্টটা বাড়িয়ে দিও, এক্সট্রা গিফট দিয়ে দিও।

ওহ, সেটা বলতে হবে না, আমি তোমাকে তোমার পেমেন্টের থেকেও অনেক বেশি দেব সেটা আগেই ভেবেছি। কিন্তু সত্য কথা হলো আমি তোমাকে আমার জন্য ডাকিনি। আমি তোমাকে ডেকেছি আমার ছেলের জন্য। 

হোয়াট? মেয়েটি বসা থেকে মনে হলো স্প্রিং লাগানো পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠল। আর ইউ ক্রেজি? 

সফিক আহমেদ এখন স্তব্ধ জলাশয়ের মতো শান্ত আর গম্ভীর। সফিক আহমেদ মেয়েটিকে বসতে ইশারা করে বলে, দেখো আমাকে তোমার কাছে ক্রেজি মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি ক্রেজি না। আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আমি খুব নরমাল আর লজিকাল। আমার ছেলে ডেভেলপমেন্টালি চ্যালেঞ্জন্ড। আই মিন অনেকে বলে অটিস্টিক। ওর বুদ্ধি হয়তো ডেভেলপ করেনি। কিন্তু ওর বডির গ্রোথ খুব ভালা। অ্যান্ড ওর ফিজিক্যাল ডিমান্ডও খুব হাই। মাস্টারবেটিং শেখাতে বলেছিল ওর ফ্যামিলি ডক্টর। ওটা শিখিয়েছি। খুব এনজয় করে। এখন ওটা সে করে বলতে পারো অলমোস্ট এভরি ডে। তুমি তো জানো ডেভেলপমেন্ট চ্যালেঞ্জের কারণে ওদের ব্রেনের ডেভেলপমেন্ট হলো শিশুর মতো। মাস্টারবেটিং করে দারুণ মজা পেয়েছে। এখন ওটা করতে চায় রোজই। কখনো কখানো দুবারও। ঠিক নতুন বিয়ের পর ইয়াং ম্যানরা যেটা করে ঠিক তেমন।

মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে গালে গালে হাত দিয়ে। একটি শব্দও করছে না।

একটুখানি বিরতি নিয়ে, দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সফিক আহমেদ আবার বলে, ওর জীবনে কোনো প্রেম আসবে না। আবার কোনো মেয়ে ওর সঙ্গে প্রেম করবে না ওর এই কন্ডিশন জেনেশুনে। আর তাহলে ওর জীবনে কখনো সেক্সের মতো এনজয় করার বিষয়টি থাকবে না? এটা ভেবে আমি ওর জন্য খুব খারাপ বোধ করি, ওর জন্য বুকের ভেতরটা টনটন করে ব্যথায়। এভরি টাইম আমি ওর মাস্টারবেশনে হেল্প করি, যখন হ্যান্ড দিই, তখন আমার শুধু মনে হয় কেন এই জীবনে সে সেক্স এনজয় করবে না? 

আমার সন্তানকে যতটুকু সম্ভব জীবন এনজয় করাতে চাই। কিন্তু ওর মা আমার সাথে একমত হয় না এ ব্যাপারে। হার্ডকোর প্রাকটিসিং মুসলিম হলো ওর মা। ওর মা দেশে গেছে বেড়াতে। এই সুযোগে আমি আমার ছেলেকে বেস্ট এনজয়মেন্ট উপহার দিতে চাই। 

ওয়াও...বিস্ময়ে মেয়েটি যেন হতভম্ভ ও স্থবির হয়ে গেছে। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে হয়তো দুই হাতের তালুতে আশ্রয় দিয়েছে ওর অবাক মুখমণ্ডলকে। তবে সেটা সামান্য সময়ের জন্য। সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে সফিক আহমেদের দিকে অপলক। তারপর তেমনই অবাক চোখে কণ্ঠে বিস্ময় ধরে রেখে বলে—তুমি ইনক্রিডিবল বাবা। আমি কখনো তোমার মতো ক্রেজি থিংকিংয়ের বাবা দেখিনি। 

তোমার কি মনে হয় আমি খুব অপরাধ করছি? পাপ করছি বাবা হয়ে ছেলের জন্য এই রকম একটা কাজ করে? সফিক আহমেদের কণ্ঠ কেমন যেন বেদনা কাতর হয়ে উঠেছে।

না, না, একটুও না, আমি তো কোনো দোষ দেখছি না। এবার তুমি বলো আমি কি কোনো দোষ করছি, পাপ করছি এই প্রফেশনে এসে? 

না, না, আমি সেটা মনে করি না। সফিক আহমেদ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, চোখে চোখ রেখে সরল অথচ দৃঢ় উত্তর দেয়। এই উত্তরের ভেতর মেয়েটা হয়তো কোনো সত্য কথন খুঁজে পায়। সে তখন দৃঢ় কণ্ঠে বলে, আমি তো কারও কোনো ক্ষতি করছি না। আমার একটা জব দরকার আমার লিভিংয়ের জন্য। আমার আয় করার দরকার। কিন্তু আমি কোনো হোয়াইট কালার জব পাব না। কারণ আমার ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি নাই। আমি কোনো অড জব করতে পছন্দ করি না। যেটা জানি সেটা করছি, কারও তো কোনো ক্ষতি করছি না।

অফকোর্স, আই অ্যাগ্রি উইথ ইউ।

ওয়েল, তুমি বলতে পারো এটা তো অড জব। আই সেইড ইয়েস ইট ইজ অ্যা অড জব। কিন্তু তারপরও তো আমার জবটাকে সোসাইটি ক্রাইম হিসাবে দেখে। এই কথা বলে মেয়েটি পুনরায় কফি কাপে চুমুক দেয় একটা ক্ষোভ ভরা শ্বাস ফেলে। তারপর এক রহস্যময় হাসি দেখা যায় ওর ঠোঁটের কোণায়। কফি কাপ থেকে মুখ তুলে সফিকের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায়। সফিক আহমেদের চোখে চোখ রেখে বলে—আমার তো মনে হয় তুমি একটা গ্রেট বাবা। ভেরি আনইউজুয়াল। নট ভেরি কমন। আই থিংক যে কোনো গ্রেট থিংকিং প্রথম দিকে আনইউজুয়াল অ্যান্ড অ্যাবনরমাল মনে হয়।  

তুমি যদি রাজি হও আমার ছেলেকে হ্যাপি করতে আমি তোমাকে ডবল পে করব। শুধু ডবল না, আমি তোমাকে তার থেকে অনেক বেশি পে করব, অ্যাজ অ্যা গিফট। আমার ছেলে কিছুই জানে না, সবটুকু তোমাকে করতে হবে। তুমিই একটিভ রোল প্লে করবে। আমার ছেলেকে অ্যারাউজ করবে তোমার সবটুকু ট্রিক আর এক্সপার্টিজ দিয়ে। আমার ছেলে বেডরুমে। তুমি ওকে দেখে আসতে পারো। যদি পছন্দ হয় তাহলে তুমি সিদ্ধান্ত নিতে পারো। আমি জানি তোমার ওকে পছন্দ হবে। ও খুব ইনোসেন্ট আর সেক্সি। অ্যান্ড অফকোর্স ভেরি হ্যান্ডসাম। সফিক আহমেদের এই মন্তব্যে মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে—ইউ আর ফানি অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং টু! আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার ফর দ্যা লুক! 

দীপ্তের বেডরুমের দিকটা দেখিয়ে বলে যাও—দেখে আসো আমার ছেলেকে। তবে তুমি রাজি হলেও আমার একটা শর্ত আছে। শর্ত হচ্ছে আমি দেখতে চাই তুমি ঠিকমতো সার্ভিস দিচ্ছ কি না, আমার ছেলেকে হ্যাপি করছ কি না। নাকি ফাঁকি দিচ্ছ।

হোয়াট? মেয়েটি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে! বিস্ময়ে হতবাক দৃষ্টি আবদ্ধ করে রাখে সফিক আহমেদের চেহারায়। তারপর বলে অনেক রকম ক্রেজি ক্লাইন্ট ডিল করি প্রায়ই, কিন্তু তোমার মতো ক্রেজি আজ পর্যন্ত পাইনি!  

ইয়েস। আমার ছেলের এই ব্যাপারে আমি খুব সিরিয়াস। আমি তো বলেছি ডবল পে করব। দরজার ওপরে লুকিং মিরর বসিয়েছি। আমি কনফার্ম হতে চাই তুমি ফাঁকি দিচ্ছ না। না, আমি এত খারাপ না, আমি রিয়েল লাইফ সেক্স দেখার জন্য এটা বলছি না! সেটা তো আমি চাইলেই বাইরে গিয়ে দেখে আসতে পারি। এই কানাডাতে তো সেটার অভাব নাই। সে উদ্দেশ্য হলে আমার নিজের ছেলেরটা কেন? আমি শুধু দেখব আমার ছেলেকে তুমি ফাঁকি দিচ্ছ নাকি। আমি এই দেশে ত্রিশ বছর আছি। আমি চাইলে কি সেগুলো সেই ইয়াং এজ থেকে দেখতে পারতাম না?

মেয়েটি চুপ করে থাকে কিছু সময়। কী যেন ভাবে, আর ছোট ছোট চুমুক দেয় কফি কাপে। কাপের কফি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে কথা বলে না। কফি শেষ করে কাপ নামিয়ে সফিক আহমেদের দিকে তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে বলে—ওকে, অল রাইট, আই অ্যাগ্রি, বাট ডবল পে করছ, রিমেমবার? মেক শিওর ইউ নট গোয়ানা চিট মি?

মেয়েটা দরজার দিকে এগোয়। আরও কিছুটা এগিয়েছে। সফিক আহমেদ পেছন থেকে আবার ডাক দেয়—শোনো! মেয়েটা ঘুরে দাঁড়ালে সফিক আহমেদ পকেট থেকে ট্রোজান কনডমের প্যাকেট বের করে এগিয়ে ধরে। হাসতে হাসতে মেয়েটা বলে—হোয়াট ডু ইউ থিংক আঁ? আম নট গোয়ানা গেট প্রেগনেন্ট বাই ইওর সান! হিয়ার ইউ গো? আই হ্যাভ ইট অলরেডি ইন মাই পার্স, বাট তুমি যখন দিতে চাচ্ছ দাও...।  

জীবনের মহরৎ
এটা নিশ্চয় একজন স্বাভাবিক পিতার কাজ নয়। এই মুহূর্তে যে পিতাটি দরজার পিপিং হোলে চোখ আটকে দাঁড়িয়ে আছে তার উদ্দেশ্য স্বাভাবিক নয় এবং তার শরীরের ভেতর ভিন্ন এক উত্তেজনা সরীসৃপের মতো ওঠানামা করছে। উত্তেজনায় এখন স্বাভাবিক নেই। এমনকি তার শ্বাসপ্রশ্বাসও। ডাঙায় তোলা শোল মাছের মতো দাপাচ্ছে ওর বুকের পাঁজর। দরজার পিপিং হোলে চোখ আটকানোর আগ থেকেই সফিক আত্মগতভাবে একই কথা বলেছে বহুবার—না আমি স্বাভাবিক পিতা নই। এখন আবার যে কথাটা সে মনে মনে বলছে সেটা এমন—দরজার পিপিং হোলে চোখ আটকে যে দৃশ্য দেখার জন্য একজন বাবা অপেক্ষায় থাকে সেই দৃশ্য অবলোকনকারী পিতা কখনোই একজন স্বাভাবিক পিতা হতে পারে না! পৃথিবীর তাবৎ মানুষ যদি আমাকে অস্বাভাবিক, মানসিক রোগী অথবা বিকৃত রুচির বলে বলুক। আমার সেটাতে কিছুই আসে যায় না। আমার সন্তানের আনন্দের জন্য আমি সেসব কিছু হতে রাজি! 

এমন ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকে কিছুটা সময়। তারপর আবার সফিক আহমেদ ভাবে—ছেলের সুখের জন্য পিতামাতা তার জীবনের অনেক কিছুই বিসর্জন দেয়। কিন্তু সেটা তো পিতামাতার দায় ও দায়িত্ব। জন্ম দেয়ার দায় ও দায়িত্ব। আর সে কারণে সন্তানের জন্য পিতামাতা যত কঠিন দায়িত্ব পালন করুক না তাকে ব্যতিক্রমী বলা যায় না। সফিক আহমেদ নিজেকে ব্যতিক্রমী পিতা হিসাবে ভেবেছে এই সময়। কিন্তু না, এখন আর ভাবছে না। পিপিং হোলে চোখ রাখার আগে সে মনে মনে বেশ কবার বলেছে। আজ আমার ছেলের, আমার একমাত্র সন্তানের জীবনের মহরৎ। আজ আমার সন্তানকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সুখ দেয়ার জন্য বেছে নিয়েছি ব্যতিক্রম এক ব্যবস্থা। যা সচারাচর কোনো পিতা করে না। আমি তো বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল দেশের সামাজ ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা এক পুরুষ। আমার সামাজিক প্রেক্ষাপট তো দূরের কথা। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপের মতো দেশের কোনো মানুষ আমার এই পরিকল্পনা শুনলে বলবে—আমি পারভারটেড।

এই উন্নত দেশে আজও গে-লেসবিয়ান বিয়ে নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে সমাজে। গে-লেসবিয়ান বিয়ের আইন পাস হলে পার্লামেন্ট থেকে এক গ্রুপ ওয়াল্ক আউট করে। অথবা পার্লামেন্টের সামনে, চার্চগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। চেষ্টা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আমার মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছেলের জন্য আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা নিয়ে তো আজ পর্যন্ত কোনো ইস্যুই তৈরি হয়নি। তার অর্থ এমন ভাবনা কেউ ভাবেনি।    

মানবজীবনের চরমতম সুখ হলো যৌন সুখ। এই সুখে অবগাহন করার জন্য শুধু মানুষ নয় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিকুলেরা বেছে নেয় তাদের সঙ্গী। প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতিও নাকি যৌন মিলন। যৌনতার চূড়ান্ত পরিণতি থেকেই সৃষ্টি, প্রোডাকশন, রিপ্রোডাকশন, জন্ম হাহাহা...। সফিক আহমেদ আত্মগত হাসি হাসে আর ভাবে—আমার দীপ্তের রিপ্রোডাকশন কেমন হবে?

হঠাৎ এ সময়ে দমকা হাওয়ার ধাক্কায় কড়কড়িয়ে ওঠে ওপরতলার কোনো এক দেয়াল। কাঠের তৈরি দেয়ালগুলোর ভেতরে ফাপা। গরম রাখার জন্য ফাইবার দিয়ে ঠাসা দেয়ালগুলো একটু হাওয়াতেই মড়মড় কড়কড় করে। বাতাসের ওপর বিরক্ত হলো সফিক আহমেদ। দুলে দুলে ওঠা ব্লাইন্ডের ফাঁকা দিয়ে চোরের মতো ভীরু দৃষ্টি আবদ্ধ করে বাইরে। নজরে আসে আকাশ কালো মেঘে ভারী হয়ে উঠেছে। মনে মনে মেঘলা আকাশ দেখে খুশি হয়। আয় মেঘ আয়...। পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাক। নাম বৃষ্টি নাম...। এমন বৃষ্টি হোক আকাশ ভেঙে, বৃষ্টির শব্দে দীপ্তের চ্যাঁচানি, গোঙানি, চিৎকার, শীৎকার সব মিশে যাক। চ্যাঁচা দীপ্ত, চ্যাঁচা আমার দীপ...। আমার জোয়ান মরদ পোলা, তুই প্রাণ খুলে, দেহ খুলে, তোর সমস্ত পৌরুষত্ব দিয়ে চ্যাঁচা। তোর যৌবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুমড়ে, মুচড়ে চ্যাঁচা। দীপ্তের উদ্দেশ্যে এইসব বাক্যগুলো একা একা আওড়াতে আওড়াতে নিজের দেহটার ভেতরে মোচড় দেয় বহু বছর আগে থেমে যাওয়া সেই অনুভূতি। সে চোখ রাখতে ভুলে যায় দরজার পিপিং হোলে। এবার সে ঘুরে দাঁড়ায়। তার পিঠের তলে আড়াল হয়ে গেছে পিপিং হোল।

বাইরে তখন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে হয়তো মিলেমিশে গেছে দীপ্তের জীবনের মহরৎ। 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেনি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেনি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কুড়িগ্রামে বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কুড়িগ্রামে বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান