X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২
ঈদসংখ্যা ২০২৩

ঘের

মোস্তাফিজ কারিগর
১৫ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০

দুপাশে কালো জলের ওপরে লবণে পোড়া ভাসমান কচুরিপানার অর্ধমৃত শরীর নিয়ে থব্ব ধরে থাকা ভোরবেলাকার বিলের বুক ফেড়ে মৃত সাপের মতো পড়ে থাকা আধাপাকা রাস্তাটাকে শাসাতে শাসাতে আকিজ গ্রুপের কর্মীবাহী বাসের খ্যাপাটে হেডলাইটের আলো এসে থামল মহারাজের অথর্ব-ধসাকাঙ্ক্ষী মাটির ঘরের সামনে, আকাশ ছোঁয়ার সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশমণি গাছের গোড়ার মাটি কামড়ে দাঁড়াল বাসের দাঁতাল চাকা; শাড়ির ফ্যানফেনে ঘোমটা টেনে জহুরা লাফিয়ে পড়ল বাসের উদরে, আর সেই বাস যেন দৈত্যপুরীর রাক্ষসী হাঙর—ঢাকুরিয়া, কাটাখালি, হরিদাশকাঠী, আঠারো পাকিয়ার ঘরগুলোর বউদেরকে—আজন্ম গৃহস্থ যারা, ফসলের খেতে পুরুষের নিত্য সহকর্মী, এমনকি গরুর বদলে হাল টানা নারীদের গিলে নিয়ে চলে গেল সুন্দলী বাজার পার হয়ে নওয়াপাড়া শহরের দিকে। নওয়াপাড়া রেলগেট পার হয়ে যশোর-খুলনা হাইওয়ের বুকে স্ফীতোদর আকিজ গ্রুপ জুটমিলের ভেতর বেয়াদব মাতালের মতো গৃহস্থ বউগুলোকে বমি করে দেবে বাসটা—দৈত্যপুরীর রাক্ষসী হাঙর।

বাড়ির পশ্চিমে কবরশালার বাঁশবনে পাখিদের সাংগীতিক রেওয়াজ কিংবা বকবকানি চরমে উঠে গেলে তেলচিটচিটে কাঁথা সরিয়ে ঘুমের গুহা থেকে বেরিয়ে নিম নয়তো আশশেওড়ার ডাল মুখে গুঁজে বাড়ির সামনের দিগন্তবিস্তীর্ণ বিলের দিকে মুখ করে দাঁড়াল মহারাজ। নুন-পান্তায় চির ভাসমান মানুষটির নাম কেন যে মহারাজ, তা কেবল বলতে পারত মহারাজের দাদা জাকোয়ান কবিরাজ; সেই কবেকার কথা—শ্রাবণের বাদল মাথায় চাপিয়ে বিলের উত্তর সিথান থেকে হাঁটু অবধি কাদা নিয়ে ঘোর সন্ধ্যাবেলায় হরিদাশকাঠী গ্রামে উঠে এসে কাঁধের বস্তাকৃতি ঝোলা থেকে মানুষের মাথার খুলি বের করে গরম চা ঢেলে খেয়েছিল জাকোয়ান কবিরাজ—তখন বিল দুবার ফসল দিত, বর্ষায় অঢেল মাছ—ভাজি, ভর্তা, ঝোল, শুঁটকি খেতে খেতে হরিদাশকাঠী, ঢাকুরিয়া, কাটাখালি, আঠারো পাকিয়ার মানুষের হাগা হয়ে যেত। পশ্চিমে মোল্লাদের বাড়ি, পুবে হোসেন ডাকাত, দক্ষিণে গফর কারিকরের বাড়ি ছাড়া আশপাশের ছিয়ানব্বই গ্রাম হিন্দু-নমঃশূদ্র; কেবল ঐ বিষ্ণু ঠাকুররাই ব্রাহ্মণ, চা-বিস্কিটের সঙ্গে পরিচিত—কয় ঘর মুসলমানরা তো দূর, নমঃশূদ্রদের ঠোঁটও চায়ের উষ্ণতাশূন্যতায় ভুগত; সেই সব দিনে জাকোয়ান কবিরাজ মানুষের মাথার খুলিতে চা ঢেলে খেত। এখন বেগুনতলায় হাট, দোকানে দোকানে নমঃশূদ্র-হুজুর-মাওলানারা ঠোঁট কামায় দেয় না। মুসলামানের ঘর বাড়তে বাড়তে হিন্দুপাড়াকে আবডাল করে দিচ্ছে, কয়েকশ গজ পরপর মসজিদ।

মেসওয়াক মুখে বিলের থইথই জলের জমিনে তাকিয়ে নিজেদের জমির সীমানা খুঁজতে থাকে মহারাজ—দাদা জাকোয়ান কবিরাজের রেখে যাওয়া ভিটের জমি আর বিলে সাড়ে চার বিঘা জমির কিছুটা বেচে খেয়েছে মহারাজের বাপ; সাংসারিক প্রয়োজন আর নানা সমিতি আর গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের খাতা থেকে নাম কাটাতে কিছুটা বেচে খেয়েছে মহারাজ; তলানিতে থাকা অবশিষ্ট দেড় বিঘা জমির ধানেই অনায়াসে বছর ঘুরে যেত মহারাজ-জহুরার সংসার, সংসারে জিগার আঠার মতো প্রেম; দেড় বিঘা জমির ধান আর কালেভদ্রে দাদা জাকোয়ান কবিরাজের দিয়ে যাওয়া ছবক বেচে গ্রামের দীনমানুষের রোগশোক সারানো, ভুল খোয়াব, জিন-ভূতের ভয় বন্ধ করে দেয়ার অছিলায় মহারাজ সামান্য যে দু-চার পয়সা পায় তাতেই সংসারে হালে জল জুটে যেত। গোয়ালে দুটো গরুও থাকত। কিন্তু গত কবছর এই ডুমুরিয়া বিলের জমিন আর জাগে না। দক্ষিণের নদীতে বাঁধ; স্লুইস গেটের মুখে পলির ঢিবি। সরকারের এস্কেভেটর খননে এলে দুদিন পরেই অত বড় বড় দানবীয় খননযন্ত্র বিমূর্ত ভাস্কর্য হয়ে পড়ে থাকে। দিনের আলোতেই মানুষের রূপ ধরে ভয়ংকর জিন-ভূত এসে কামড়ে ধরে এস্কেভেটরের চাকা, শুষে খায় ইঞ্জিনের গ্যালন গ্যালন তেল; পাছার কাপড় খুলে বিলের কাদা-জল টপকে জান নিয়ে বউ-ছেলে-মেয়ের কাছে ফিরে যেতে হয় খননকার্যের অপারেটরকে। বর্ষা-গ্রীষ্ম-শীত নেই, জলে নাকানিচুবানি খেয়ে থাকে বিল। ধানহীন, ঘাসহীন। বাড়ির গোয়াল শূন্য হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। যেই বিলের মাছ খেয়ে নওয়াপাড়া সরকারি হাসপাতাল ভরে যেত ডায়রিয়া রোগীতে; জলের সময় বিলের বুকের অধিকার ছিল সকলের, যেখানে খুশি জাল মারলেই মাছের কুদরতি, তাতে ব্যঞ্জন; সেই সব মাছ কোথায় উড়ে গেল। বিলে এখন বিরাট বিরাট রুই-কাতলা-পাঙাশ-চিংড়ি; সাতক্ষীরা-খুলনার রাঘব মৎস্য ব্যবসায়ীরা বিলের বুক ভাগ করে নিয়েছে। সঙ্গে স্থানীয় সাংসদের ছেলে-ভাই, দলের চাটুকারদের মদদ। যেখানে সেখানে জাল ফেলার সাহস হরিদাশকাঠীর মানুষ কবেই হারিয়ে ফেলেছে। সমস্ত বিল হয়ে উঠল ঘের। সকলের মতো ঘেরসন্ত্রাসীদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো শেষ দেড় বিঘা জলাবদ্ধ জমিও। প্রথম দুবছর সময়মতো চুক্তির টাকা পেলেও পরের বছরগুলোতে দুনলা বন্দুকের উড়ো শব্দে মুখে কুলুপ আটকে নিল মানুষেরা।

কৃষিহীন এই সব আজন্ম কৃষকেরা নওয়াপাড়ার কয়লাঘাটা, আকিজ জুট মিলেই শুধু নয়, নানা পেশার খোঁজে যশোর-খুলনার দিকে হুবড়ি খেয়ে পড়তে থাকে। পুরুষদের রক্ত-ঘামেই শোধ যায় না সংসার, মুসলমানপাড়ার ঘোমটা টানা বউয়েরা, এমনকি নুহিতন নানি, চুকো বুড়িদেরও উঠে পড়তে হয় কোম্পানির বাসে। দিন দিন ইঁদুরের সুস্থান হলো মসজিদের পেছনে মোল্লাদের উঁচু ভিটায় মহিলাদের তালিমঘর। সকাল কিংবা সন্ধ্যায় গ্রামের মহিলাদের সববেত কোরান তেলাওয়াতের সুর প্রাচীন বাঁশবনের কীটদ্রষ্ট পচাপাতার গন্ধে মিশে মহাশূন্যে নিষ্ফল ঘুরে ঘুরে হারিয়ে যেতে থাকল হরিদাশকাঠী গ্রাম থেকে। মহারাজও নওয়াপাড়ার কয়লাঘাটায় কিছুদিন খেটে ভূত হয়ে এলো। কিছুকাল নিষ্কর্মা থেকে লেগে গেল সুন্দলী বাজারের কোণায় হোসেন ডাকাতের ছেলে আরজানের স’মিলে, গাছের বুক চিড়ে টুকরো টুকরো করার কাজে। তাতে ভাতের খবর হলেও, জন্ম-জড়ুলের মতো বয়ে বেড়ানো সমিতির ঋণের খাতা সামলাতে জহুরাকেও কোম্পানির বাসে উঠতে হয়। সমিতির ঋণে ব্যাটারিচালিত ভ্যানও কিনেছে মহারাজ; তাতে স’মিলে কাঠ কাটার পরে ভ্যানে বয়ে দেয়ার বাড়তি আয়ও রোজকার অভাব ও ঋণের ঘুলঘুলি থেকে মুক্ত করতে পারে না তাদের।

সকালের নাবালক রোদ বখাটে হয়ে ওঠার আগেই ব্যাটারিচালিত ভ্যান নিয়ে পৌঁছে যেতে হবে স’মিলে। ঝুপড়ি হেঁশেলের হাঁড়িগর্ভে আটকে থাকা শূন্যতায় বাটিচালান করে নিষ্ফলা হলো মহারাজের হাত; উদরস্থ প্রাতঃক্ষুধা উদরেই জিইয়ে রেখে কেরোসিন স্টোভের নির্জীব জিহ্বাগুলোতে গ্যাসলাইটের আগুন ঢেলে পানি গরম করতে দিয়ে উত্তরসূরি হিসেবে পাওয়া দাদা জাকোয়ান কবিরাজের প্রাচীন ঝোলা থেকে মানুষের মাথার খুলি বের করল প্রতিদিনের মতোই। সফেদাগাছের সঙ্গে সিঁধেল চোরের মতো বেঁধে রাখা পায়াভাঙা চেয়ারে পায়ের ওপরে পা তুলে খুলির চায়ে কশে চুমুক দিয়ে বিভোর হয়ে যায় দুদিন আগের রাতে। মাসকাল আগে কেনা দ্বিতীয়হাত এক অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে নিজেদের মিথুনমুহূর্তের চলচ্চিত্র ধরে রেখেছিল মহারাজ। জহুরা বারবার নিষেধ রেখেছিল, মহারাজ শোনেনি—আমাগের খেলার ছবি, আমরা ভিডিও করি রাখপো, কোন শালার কী? মিথুনক্লান্ত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসতেই ডাকাত জ্যোৎস্না হরণ করে তাদের। উঠোনের সফেদাগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা চেয়ারে কোলের ওপর জহুরাকে বসিয়ে নিজেদের আদিম চলচ্চিত্র বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তারা, আর নক্ষত্রদের মতো হেসে রাত্রির নির্জনতাকে নাঁচিয়ে তোলে, তাদের হাসিতে জ্যোৎস্নামুখর হরিদাশকাঠীর বাঁশবনে ঘুমাশ্রিত পাখিরা উত্যক্ত হয়। চারপাশের বৃক্ষরা বেহেশতি পাখা হয়ে ওঠে। বিহ্বল বাতাসের ঝাপটায় দ্বিতীয়বার পরাগমিলনে মেতে ওঠে সফেদাগাছের নিচে জহুরার শরীর থেকে নামানো সাদা সাদা ফুলের ছাপওয়ালা শাড়ি বিছিয়েই। পুরো হরিদাশকাঠী পৃথিবীর শৈশবে ফিরে যায়, আদম ও ইভ হয়ে ওঠে তারা। সফেদাগাছটাই কি তাহলে গন্ধমগাছ? সেই কথা কি মহারাজ ভেবেছিল? হয়তো, হয়তো না। খুলির চায়ে চুমুক দিতে দিতে মহারাজ স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে সফেদাগাছ বা গন্ধমগাছের নিচে জহুরার শাড়ি থেকে নেমে আসা সাদা ফুলগুলো বেতাল গন্ধ ছড়াচ্ছে। জহুরির চোখ নিয়েও আবিষ্কার করতে পারে না শিউলি না বকুল না মালতি না হাসনাহেনা—ফুলগুলোর মদিরগন্ধ মেখে ভ্যানের সিটে চড়ে বসে মহারাজ, যেন বারো জোড়া আরবি ঘোড়ায় টানা গাড়িতে বিদেশ বিহারে যাচ্ছে কোনো মোগল সম্রাট।

ভেবেছিল—স’মিলে ভ্যান রেখে, সুন্দলী বাজারে সাধনের চায়ের দোকানে বনরুটি-কলা খেয়ে নেবে; কিন্তু স’মিলে ভ্যান রেখে মলিন ট্রাউজারের পকেটে হাত দিতেই বুঝতে পারে মোবাইলটা বাড়িতে ফেলে রেখে এসেছে মহারাজ। বাড়িতেই আছে নিশ্চিত। বেশিরভাগ সময়ই দ্বিতীয়হাতের এই মোবাইল ব্যালান্সশূন্য, চার্জহীন পড়ে থাকে যেখানে সেখানে। বিশেষ কোনো কলও আসে না, নিজে কল করবে সেরকম মানুষও খুঁজে পায় না। মাঝে মাঝে কেবল মেমরি কার্ডে জমা রাখা হিন্দি সিনেমার গান বা বিজয় সরকার বা ওয়াজ মাহফিল শোনে, নাটক দেখে—সেই সব নাটক দেখতে দেখতে হঠাৎ একদিন একটা পর্ন ভিডিও প্লে হয়ে যায় মোবাইলে। সেই পর্ন ভিডিও কতবার যে দেখা হলো মহারাজের। জহুরাকে সঙ্গে নিয়েও দেখেছে কতদিন! কয়দিন ধরে জহুরাকে বলছে—সামনের মাসে তুমারে একটা মোবাইল কিনে দেব, সেকেন হ্যান। তুমি মিলে গিয়েলে মাঝে মাঝে কল করব—কী করো জান, কখন আসবানে—অথবা জহুরাকে সোহাগে জড়ায়ে বলে—মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে আমরাও নিজেদের ভিডিও তুইলবো। জহুরা সায় দেয় না।

পকেট থেকে হাত বের করে চটাং আবার ভ্যানের সিটে চড়ে বসে মহারাজ।

আবার কনে যাও—বলে, তরমুজের বিচিসদৃশ দাঁত কেলিয়ে স’মিলের লেবার তাইজুল হাসির হররা ছোটাই।

বাড়ি যাই, আসতিছি ব্যস্তই—মহারাজ ভ্যান ছুটিয়ে দিতেই তাইজুল জানাল—মাল আমার কাছে, বাড়ি যায়ে কী করবা। কাল রাতে যাবার সুমাই ঐ যে তালগাছের মোথার উপর ফেলে রেখে গিছো, আমি তুলে বাড়ি না নিয়ে গেলে মালডা ফুস হয়ে যাতোনে।

ধড়ফড়িয়ে ভ্যান থেকে নামে মহারাজ—দে তাইজুল, দে ভাই মোবাইলটা।

তুমারে দেবার জন্যিই তো কলাম, আমি তো মারিও দিতি পারতাম মালডা। আমার সামনেই সেদিন সাধনের চোর ছাওয়ালডার থিন তেরোশ টাকা দিয়ে মোবাইলটা কিনিলে। আমিই তো তুমারে নওয়াপাড়া নি’যায়ে সিম তুলে দিয়িলাম। ন্যাও ন্যাও মালডা ন্যাও। দেখো, সব ঠিক আছে নাকি।—তাইজুলের হাত থেকে বাঘের থাবার মতো খপ করে নিয়ে জ্বলন্ত চোখে মোবাইলটা এদিক-ওদিক করে দেখে—যেন বিয়ের প্রথম রাতে ঘোমটা সরিয়ে টুথপেস্টে আলপনা আঁকা জহুরার মুখ দেখছে মহারাজ। জহুরার মুখটা আরও ফর্সা বানানোর জন্যে কোন কোম্পানির ট্যালকম পাউডার মেরেছিল বিয়ের সাজ সাজানো মেয়েগুলো, মহারাজের তা জানার কথা নয়। কিন্তু একটা মিহি-মিষ্টি গন্ধ ছিল পাউডারের। সেই পাউডারের গন্ধের ভিতরে ডুবে গেলে ঠোঁটে বরশি বাঁধিয়ে মহারাজকে টেনে-হিঁচড়ে তোলে তাইজুল—চলো, চা-সিগ্রেট মারি আসি।

মানুষের মাথার খুলিতে ছাড়া চা খায় না মহারাজ, সেই কথা ছিয়ানব্বই গ্রামের বিলের মুরগির বিষ্ঠা খাওয়া মাছেরাও জানে। তার পেটে খিদে। একটা বনরুটি আর কলা নিয়ে বাঁশের কাবারি দিয়ে বানানো বেঞ্চে বসতেই এপাশে ওপাশে দুর্বোধ্য কানাঘুষা, চাপা হাসি ছলকে পড়ে তার কানে। মনে হচ্ছিল—মানুষেরা যেন কথা বলা ভুলে কী এক ভৌতিক ফিসফিসানিতে ব্যস্ত; মানুষগুলো সব বিষাক্ত সাপ হয়ে গেল না তো! আর ছুটকো শয়তানের মিচকে হাসির জোয়ার ফুঁসে উঠতে থাকে সুন্দলী বাজারের চায়ের দোকানে, মিষ্টির দোকানে, মনিহারির দোকানে আর সবজি বাজারে। মানুষগুলো ঘাড় ঝুলে আছে প্রাগৈতিহাসিক দাসের মতো হাতের মোবাইলের দিকে। কী দেখছে সবাই? সেও কি মোবাইল বের করবে ট্রাউজারের পকেট থেকে? ভাবতে ভাবতে বনরুটির নরম দেহে দাঁতকে ব্যস্ত করে দিয়ে তাইজুলের মুখের দিকে তাকায় মহারাজ—তাইজুলের চেহারাটা কেমন মিরজাফরের মতো হয়ে উঠেছে।

বিকেলান্তেই বাড়ি ফিরল মহারাজ। উঠোনে ভ্যানের চাকা পৌঁছাতেই তো জহুরা ছুটে বের হয়ে আসার কথা। বিকেল হতে হতেই কোম্পানির গাড়ি নামিয়ে দিয়ে যায় জহুরাকে। বাড়িটা বড় নিস্তব্ধ, সফেদাতলার নিচের অন্ধকার ভারি কুৎসিত দেখাচ্ছে। না শিউলি না বকুল না মালতি না হাসনাহেনা—কোনো ফুল পড়ে নেই সফেদাতলায়। বিল থেকে উঠে এসে একটা বিরাটাকার ঢোঁড়া সাপ ক্যাটওয়াক করতে করতে কবরশালার বাঁশবনের ভিতরে ঢুকে গেল। কানাকুয়ো পাখিটা কেমন কান্নার মতো ডাকছে একনাগাড়ে। ঘরের দিকে এগোতেই দেখল—বিলের সন্ধ্যাকালীন হাওয়া হুড়মুড় করে ঢুকছে দরজা উদোম ঘরে। চৌকি থেকে জহুরার শাড়ির আঁচল মাটির মেঝেতে গড়াচ্ছে। একটা অজানা থুরকোচের ধারালো কাঁটা বিঁধতে থাকল মহারাজের মনের ভেতর—এখন জহুরার ঘুমানোর কথা নয়, হেঁশেলে রাতের ভাত-তরকারির বলক ছড়ানোই নিত্যকার রুটিন। ধীরে, খুব ধীরে, অতি ধীরে চৌকির দিকে এগিয়ে জহুরার পিঠে হাত রাখে—অদ্ভুত শীতল হয়ে আছে দেহটা। মৃদু ধাক্কায় নড়াতে চায়। অনড়। ভয় পাপড়ি মেলে ধরে। অপেক্ষাতর শক্তি খরচ করে শীতল দেহটাকে গোবরের ঘসির মতো করে উলটে দেয়—সেকি, জহুরার চোখের কুয়া থেকে বিন্দু বিন্দু রাঙতার মতো অশ্রু গড়িয়ে তেলচিটচিটে বিছানাকে রুপালি হ্রদ করে তুলেছে। মৃত গরুর চোখের মতো করুণ দুটো চোখ ঘরের তালকাঠের ডাবে প্রমাণাকৃতির দুটি টিকটিকি পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকা দৃশ্যের দিকে স্থির। ফড়িঙের পাখার মতো কাঁপছিল জহুরার ঠোঁট। অনেকক্ষণ কেঁপে কেঁপে ঠোঁটদুটো মুক্ত হলো—কত নিষেধ রাখিলাম, ফটোক না তুলতি। মিলের গেটম্যানের থেক শুরু করে ম্যানেজারের মোবাইল পর্যন্ত চলে গেছে আমাগের ল্যাঙটা ফটোক। ম্যানেজার আমারে ডাকি বলে দিছে, কাল থেক কামে না যাতি। কোনো নোংরা মেয়েছেলেক মিলে ঢুকতে দেবে না তারা।

কী বলিস, জহুরা?—মাথার ওপরে যেন বহুতল দালান ধসে পড়ে থেঁতলে গেল মাথার ঘিলু। ব্লু-টুথে ব্লু-টুথে একটা ভিডিও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হরিদাশকাঠী সুন্দলী ধোপাদী নওয়াপাড়ার মানুষদের মোবাইলের মেমরিতে লাফিয়ে ঢুকে যেতে পারে—নিরক্ষর, লঘুবোধের ঘেলুভরা মস্তিষ্ক নিয়ে মহারাজের তা বুঝে ওঠা দুষ্কর। বোবা প্রাণীর মতো গোঙাতে থাকে কেবল। তরমুজের বিচিমার্কা দাঁত কেলানো তাইজুলের খবিশ চেহারাটা ভূতের মতো নেচে ওঠে চোখের সামনে। রক্তে বিদ্যুৎ ছলকে ওঠে। চায়ের বদলে দাদার রেখে যাওয়া মাথার খুলিতে তাইজুলের রক্ত ভরে পান করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে আগামীকাল সকালে আরজানের স’মিলে গিয়ে গাছের গুঁড়ির বদলে তাইজুলের হ্যাংলা শরীরটা স’মেশিনে ঢুকিয়ে দিতে। বিধ্বস্ত জহুরা নিজের শরীরটাকে উঠিয়ে বসায়। কাছে টেনে মহারাজকে বলে—যা হবার হয়া গেছে, ক্ষোভ করে কী ফল! তাইজুলের কাছে মোবাইল গেল কী করে। আর এত লোকই জানল কেরাম।—যন্ত্রকৌশলের যুগে নাদান এই দম্পতি এই সব ইলেকট্রিক ডিভাইসের খেলাধুলা সম্পর্কে বকমূর্খ। চৌকির ওপরে দুই ট্যাঙের ভিতরে গর্দান গুঁজে দিয়ে মহারাজ বিড়বিড় করে—ভ্যান চালায়ে আসতি আসতি আঠারো পাকিয়ায় ওসমানের দোকানের সামনে মোয়াজ্জেক ভাইয়ের সাথে দেখা, কইল—তুমার ফোনেততি ভিডিওডা তাইজুল শুয়োরের বাচ্চা ব্লু-টুথে নিইছে শুনলাম, ও দিছে সুন্দলীর নগেন বিশ্বাসের ছাওয়াল ঝটুকে, ঝটুই ইন্টারনেটে ছাড়িল।

—তালি তো সারা দ্যাশের লোক দেখিছে আমাগের ন্যাঙটা ছবি।

—দ্যাশের লোক কী, আমারে মালোশিয়াততি আসগর ভাই ফোন করিল; কুয়েতেততি লোকমান চাচার মেজ ছাওয়াল, সৌদিততি আনোয়ার...আমি তো বোকাচোদা হয়া গিয়েলাম...

—তালি তো আমরিকার পেসিডেন্টও আমাগের ন্যাঙটা ছবি দেখিল মনে হচ্ছে...

—দেখলিও দেখতি পারে...

রাতের অন্ধকার কষাটে হয়ে উঠলে মহারাজ-জহুরা আবিষ্কার করে ঘন রৌরবশব্দ—তাদের বাড়ির চারপাশে ঘোঁতঘোঁত ধ্বনি; যেন কাউরাদের শাসন ছিঁড়ে হাজার হাজার গোঁয়ার শুয়োর ঘিরে ফেলেছে বাড়িটাকে। শুয়োরগুলো মদমত্ত সংগম-শীৎকারে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে রাতের মদির নির্জনতা। ভিনশব্দের বিকৃত উল্লম্ফনে ওদের ঘুম ডুমুরিয়া বিলের গোপন কুয়ায় লবণাক্ত জলের গভীরে হারিয়ে গেল, সাঁড়াশি দিয়ে টেনেও চোখের পাতাদের সম্মেলন ঘটানো সক্ষমতার বাইরে চলে যায়। রাত গভীর হতে হতে আরও আরও বিচিত্র শব্দ—যেন, মৃতপশুর শরীর ছিন্নভিন্ন করে খেতে খেতে অযুত শকুন নিজেদের কৌমের মধ্যে বিশ্রী ঝগড়া বাধিয়ে নিয়েছে অথবা দুইশ বছর আগের ইংরেজদের পরিত্যক্ত নীলকুঠির কড়িকাঠে ঝুলন্ত লক্ষ লক্ষ চামচিকার সম্মিলিত ডাকের আওয়াজে আক্রান্ত হচ্ছে বাড়িটা; রাত্রির নিকষ পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকলে তারা ঠাওর করতে পারে—পুরো হরিদাশকাঠীর মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে রাস্তায় আর মানুষের অশ্লীল ফিসফিসানি মহারাজ-জহুরার শ্রবণক্ষমতাকে বিকল করে দিতে চায়। গোবিন্দপুরের রঞ্জিত পালের গোয়ালঘরের পেছনে ঘোড়ানিমগাছের নিচে প্রতিমাশালার বাঁশের চটায় আধা কাদামাটি লাগানো অসম্পূর্ণ প্রতিমার মতো চৌকির ওপরে বসে থাকতে থাকতে রাতের শেষ প্রহর আসন্ন হলে উৎকট শব্দপ্রবাহ ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ—এবার এক আশ্চর্য অচেনা গন্ধ বাড়িটাকে মহাশূন্যে ভাসিয়ে তোলে। চৌকি থেকে নেমে ঘরের দরজা টপকে বাইরে পা রাখতেই মহারাজের মনে হলো ফেরেশতা হোক আর জিন হোক, বালতি বালতি জ্যোৎস্না ঢেলে রেখে গেছে উঠোনে; অথচ মহারাজ ভালো করেই খেয়ালে রেখেছে পূর্ণিমার চাঁদ চক্র সম্পন্ন করে প্রতিপদে অবস্থিত—এত আলো কোথা থেকে—আরও আশ্চর্য হলো চারদিকে তাকিয়ে—মুরগির বিষ্ঠার গন্ধভরা বিশাল ডুমুরিয়া বিল অন্ধকারে তলিয়ে আছে, কেবল ঘেরের ভেতরে ভেতরে মাচান করে বানানো বন্দুকঘরগুলোর চতুর আলো শিং জাগিয়ে আছে। এই পিচুটি অন্ধকারে চোখ ছুটিয়ে দিয়ে সবেধন দেড়বিঘা জমির সীমানাও আবিষ্কার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে—আর কোনোদিন কি জমির সীমানা বুঝে পাবে মহারাজ, আর কোনোদিন ধান এনে ভড়ে তুলতে পারবে তাদের ক্ষয়িষ্ণু ভাঁড়ার, নাকি পাবে বছরচুক্তির টাকা—কিন্তু এসব ছাড়িয়েও মহারাজের সমস্ত ইন্দ্রিয় চলে যায় উঠোনের সফেদাগাছের তলায়—আশ্চর্য গন্ধটা ভুস ভুস করে বের হচ্ছে সেখান থেকেই। নবজাতকের পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সফেদাতলায় এগিয়ে যায় মহারাজ—গাছে বাঁধা অশীতিপর চেয়ারে সফেদ আলখাল্লা পড়ে দাদা জাকোয়ান কবিরাজ মানুষের মাথার খুলিতে চা খাচ্ছে। মহারাজ ঘাবড়ে যায়, মাথার খুলিটা দাদার রেখে যাওয়া বিশালাকৃতি ঝোলার মধ্যেই তো রাখা আছে। ঝোলাটাও ঘরের মধ্যে যত্ন করে রাখা। দাদার দেহাবসানেরও বয়সকাল দেড়যুগ পার হয়েছে। ঐ তো উঠোনের পশ্চিমে হাসনাহেনার ঝোপে ঘেরা দাদাজানের কবর। মানুষের মাথার খুলি থেকে চায়ের ধোয়া মৃদু ঘূর্ণি তুলে উড়ে যাচ্ছে। আরেকটু এগিয়ে যায় মহারাজ; সে তো তোতলা নয়, তবু জিহ্বা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন—দা দা দা দাদা, আআআআপনে...

—হ আসিলাম। তোদের একটু দেখে যাই।

—তুমি তো...

—মইরে গেছি তো! হ, দেহটা মরিছে। আমি কি আর মরি...নিজেরে কেউ নিজে মারতি পারে। মহব্বত আছে না। দেহটা তো খাঁচা, ভাঙা যায় গড়া যায়। যে বানায় সেই তো ভাঙে। খাঁচা বানায়ে নিজেই সে খাঁচায় ঢোকে, খাঁচার তো জরা আছে। জীর্ণ হলে নিজেই সে খাঁচারে ভাইঙে বাইরে আসে, আবার খাঁচা গড়ে, আবার ঢোকে...এই তো চলিছে।

—তাহলি কি মানুষের খুলিটা নিইয়ে যাবার আসিলে?

—আরে না, জিনিসটা তো তোর এহন, তোরই থাকিবে। আমি আইলাম, ভাবিলাম একটু চায়ে চুমুক দিয়ে যায়।

—ও জিনিস তো তোমার ঝোলায় রাখি দিছি। তুমি নিলে কিরাম...

—জহুরাই তো দিল, কলেততি জল আনি চা করি দিল। নরেন্দ্রপুরের থেন জহুরাকে তো আমিই আনিলাম, তোর কোলবালিশ ঘষা বন্ধ করলাম, ভুলে গেছিস। আমারে সে খেদমত করবে না...।

—জহুরার তো বিরাট মন খারাপ, কানদে ভাসায় দ্যাচ্ছে।

—এত কাঁদিছে ক্যান। তোরা নিজেরা রঙ্গরস করিলি, তার আবার ভিডিও করি নিরলে নিজেদের আদিম লীলা দেখিবার চায়িলি, এতে গ্রামসুদ্ধ দ্যাশসুদ্ধ তোদের পোঙায় লাগিল ক্যান। পরের মাগির ছবি তুলিছিস তুই? কেন ভয় পাতিছিস...হুজুগ তো এরামই। এখন হুজুগের কাল। শালি না থাকলে যেমন দুলা ভাইয়ের মোজা নষ্ট, হুজুগ না থাকলে আজকাল পৃথিবী অচল। সব হুজুগই সনপাপড়ি, জিহ্বায় রাখতি রাখতি নাই। ভয় নিসনে মনে। আয় দেখি, এগুয়ে আয়। আমার মুয়ের দিকে তাকা।

শিকার নিরিখ করা বাঘের জো’র মতো অরবে পদসঞ্চালন করে সফেদাগাছের আরও কাছে এগিয়ে দাদাজানের মুখের দিকে তাকায় মহারাজ—একি, এত তার নিজেরই মুখ।

ভোরবেলাকার গ্রাম্য ঘুমগুলোকে চপেটাঘাত করতে করতে কোম্পানির বাস ভোঁ ভোঁ করে গ্রামান্তে শহরের হাঁ-মুখের দিকে চলে যায়। মহারাজ-জহুরার ঘরের সামনে থামল না আজ। লজ্জা ভেঙে আকাশের আব্রু ছিঁড়ে সূর্য তার প্রকৃত স্বরূপ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে মহারাজ ভ্যান বের করল, স’মিলে যাবে বলে। নিচু মাটির উঠোন থেকে অপক্ষোকৃত উঁচু রাস্তায় উঠতেই মহারাজ টের পায়—রাস্তার ওপরে হাক্কুর দোকানে, ঈদগাহ মাঠের বিরাট রাধাচূড়ার নিচে, এর ওর বাড়ির কানাকুঞ্চিতে দু-চার পাঁচ-দশজন করে নারী-পুরুষ জটলা পাকিয়ে আছে। সবার ঘাড় নমিত হাতের মোবাইলে। এমনকি বিলের ধারে শিয়াকুলের ঝোপেঝাড়ে কিংবা বাঁশবনের ঘুপটিতে কিংবা খেঁড়বনের আড়ালে লুকিয়ে হাতে হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ফ্রি-ফায়ার গেম খেলতে খেলতে মেরুদণ্ড বাঁকা করে ফেলা হরিদাশকাঠী গ্রামের বালক-কিশোরেরাও এই শিশুসকালে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সমবেত, মোবাইল স্ক্রিনের ভার্চুয়াল জগতে গদের আঠার মতো লদকে আছে—হঠাৎ কী এক বদ হাওয়া মেখে হরিদাশকাঠীর এই সব স্কুলগামী, অনেকাংশ অধ্যয়নচ্যুত বালকেরা মোল্লাদের বাড়ির উত্তরে তরুণ মেহগনিগাছে সজ্জিত ফুটবল-ক্রিকেট খেলার মাঠ থেকে উঠে এসে, বিলের কাদার ভেতরে শিঙ-টাকি-কই-বাইম মাছ হাতড়ানো ফেলে এসে একজন আরেকজনের দিকে পাছা ঘুরিয়ে দিয়ে দিনরাত গুলজার করে দেয় ফ্রি-ফায়ার নামের কী এক অলৌকিক খেলায়; গ্রামের নির্জন বাঁশবন-খেঁড়বন থেকে দুর্গাটুনটুনি কিংবা বসন্ত বৌরির ডাক এখন কচিৎ কদাচিৎ—ফ্রি-ফায়ার গেমের গুলির আওয়াজে এই সব নির্জনপ্রতিমারাই শুধু নয়, সুনসান দুপুর কিংবা কিছুটা রাত করে হাট-ঘাট থেকে ফেরা মানুষেরদেরও চমকে উঠে বুকে থুতু নিতে হয়; প্রযুক্তির পৃথিবীতে এই সব যুদ্ধশেখা বালকদের মোবাইলেও এখন মহারাজ-জহুরা।

কানে অদৃশ্য গালা গুঁজে নিয়ে মহারাজ ঝড়ের চরিত্রে স’মিলে পৌঁছাতেই আরজান এগিয়ে এলো—তুমার আর কাম করতি হবে নানে, মহারাজ। লিজের বোক নিয়ে ব্লু-ফিলিম বানাচ্চাও তুমি। তোমার মতো নোংরা লোকরে আমার স’মিলে রাখা ইজ্জতের ব্যাপার! গাঁ-গঞ্জে মুখ রাখিবার পারব কি?

—তা আমি কি জনে জনে দেখায়ে বেড়াইলাম। সেদিন মোবাইলটা ফেলে রাইখে গিয়েলাম তালগাছের মুথার উপুর। তাইজুল তুলে বাড়িত লিয়ে গিছিল। ঐ নাকি ঝটুকে দিছে ভিডিওডা, ঝটু ইন্টারনেটে...

—বানচোৎ লোক। লিজের বোর সাথ তাওয়া-রুটি বলবা, তা আবার ভিডিও করে রাখপা আর লোকে ইন্টারনেটে দিলি লোকের দোষ। বানচোৎ...

স’মেশিনে মস্ত বড় একটা মেহগনি গাছের বুক ফেড়ে খানখান করতে থাকা তাইজুল তাকায় মহারাজের দিকে। মহারাজের চোখে যেমন জ্বলন্ত অগ্নি, তেমনি অসহায়ত্বও। সেই আগুন দেখে তাইজুলের ভয় হয়, মহারাজের অসহায়ত্বের পাশে দাঁড়ানোরও কোনো বাস্তবতা নেই তার—কেবল নিজের আচোদা ফাঁপা মস্তিষ্কের ঘেলু চটকাতে থাকে।

আশপাশের দু-চার-পাঁচ গ্রামের মানুষেরা মহারাজকে দেখলে মুখে কুলুপ ঠেলছে। সুন্দলী বাজারের মুদি, সবজি বিক্রেতারা মহারাজের গরিব খুঁতির ভেতরে টাকার বিনিময়েও চাল-তরকারি নামাতে নারাজ। খুঁতির ভেতরে বাতাস ভরে নিয়ে ঘরে ফিরে দেখে চুলার ধারে বসে আছে জহুরা। ধায় ধায় করে ঘরে ঢোকে মহারাজ, তন্ন তন্ন করে মোবাইলটা খোঁজে—বালের যন্তরটার গুষ্টি মারি দেব আজ—খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ, ফিরে আসে চুলার ধারে।—মোবাইলটা কোথায় রাখি গিয়েলাম রে জহুরা।

প্রাগৈতিহাসিক পাথরের নিচে চাপা পড়ে থাকা কান্নার গোঙানি জহুরা কণ্ঠনালি টপকে বাইরে বেরিয়ে আসে, সঙ্গে বেরিয়ে আসে কয়েকটি বাক্য—সারা দিন কত যে কল আইলো মোবাইলে। আমি ধইরে হ্যালো বলতিই লোকেরা খালি কয়—ঐ মাগি, আমার সাথে করবি; তোর মহারাজের চে ভালো পারবানি...। জহুরার কান্নাজর্জর কথারা মহারাজের চোখকে চুলার দিকে নিয়ে যায়। চুলার ভেতরে এক টুকরো আগুনের দলা।

মহিষের পালের মতো অন্ধকার নেমে বাড়িটাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। ডুমুরিয়া বিল বুকের সমস্ত কপাট খুলে বাতাস পাঠাচ্ছে বাড়িটার দিকে। একটা দুটো কানাকুয়ো ডাকছে কি বাঁশবনে? হয়তো ডাকছে। কবরশালায় দাদা জাকোয়ান কবিরাজের কবরের ওপরে ঝুঁকে থাকা হাসনাহেনার ঝোপ থেকে ভুস ভুস করে গন্ধ ছুটে আসছে। মহারাজ আর জহুরা টের পায়—দুপাশের লবণাক্ত জলের মধ্যে মৃতের মতো ভেসে থাকা নিশুতি রাতের রাস্তাটা ওদের ডাকছে। চুলার ভেতরের এক টুকরো আগুনে কিছুটা চা-জল ফুটিয়ে দাদা জাকোয়ান কবিরাজের রেখে যাওয়া মাথার খুলিতে ঢেলে নেয় মহারাজ। খুলিটা জহুরার হাতে ধরিয়ে ভ্যানে বসিয়ে বিলের রাস্তাটা ধরে মানুষের জনপদ থেকে অনেক দূরে চলে আসে। হঠাৎ ব্যাটারিচালিত ভ্যানটা চলার সক্ষমতা ফুরিয়ে ফেলে। ভ্যানটাকে রেখে হেঁটে হেঁটেই অচেনা পথে আবার কোনো অচেনা মানুষের জনপদে আশ্রয় নিতে হবে ওদের। তার আগে ভ্যানে বসে পায়ের ওপরে পা তুলে প্রাচীন চৈনিক সাম্রাজের রাজা-রানির মতো মাথার খুলিতে চা পান করে নিচ্ছে তারা।

অমাবস্যাতেও আজ পূর্ণিমা।

তবু দূর দূর বিলে মানুষের গড়া ঘের থেকে চৌকিঘরের আলোরা এসে কামড়ে দিতে চায় এই আদিম মধুপূর্ণিমাকে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেননি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেননি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কুড়িগ্রামে বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কুড়িগ্রামে বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান