মানুষটি তখন সটান শুয়ে তার পায়ের প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে লঞ্চের ডেকের ওপর পাতা নরম বিছানাটায়। শুয়ে কাতরাচ্ছিল। তখনও তার আশপাশে কোনো হিতাকাঙ্ক্ষী মানুষের হাত বা মুখকে বা কোনো অবয়বকে দেখতে পায়নি জাকিয়া। দেখেছিল কী! কাউকে! না। যদিও একটু আগেই মানুষটির গা ছুঁয়ে সুন্দরবনের জলা এলাকার গোলপাতার নিচে মানুষটির স্ত্রী ও নরম আলোর মতো কিশোরী মেয়েটিকে মোবাইলফোনে ছবি তোলার ফাঁদে অনেকক্ষণ সময় কাটাতে দেখেছিল সে। ফোনে ছবি তোলার এই উন্মাদনাকে ফাঁদ বলতেই ভালোবাসে জাকিয়া। তার ধারণা জীবন থেমে রয়েছে এই মোবাইলফোনের ভিতরেই। সারা পৃথিবীর মানুষ এই জিনিসটি হাতে নিয়ে লাম্পট্যের জয়গান করছে নাচতে নাচতে।
জাকিয়ার বয়স হয়েছে। কিন্তু শরীর এখনও শক্ত-পোক্ত। নিয়মিত যত্ন আর চমৎকার স্মার্ট পোশাকের কারণে তাকে ততটা বয়স্ক মনে হয় না। তার চুলগুলো লালচে ডাই করা। ফর্সা রঙের সঙ্গে মানিয়ে গেছে বেশ। কালো সালোয়ার আর সাদা প্রিন্টেড সার্টিনের কামিজে তাকে দারুণ লাগছে। সঙ্গে কালো প্রিন্টেড স্কার্ফ।
সে বিদেশেই সেটেলড। দুই ছেলের জন্ম বাংলাদেশে হলেও তারা বিদেশে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। তবু দুঃখ রয়ে গেছে। তার ছেলেদের বাংলাদেশের প্রতি কোনো টান নেই। জাকিয়া মনে করে, এটা তারই ব্যর্থতা। হুম, এটা তারই ব্যর্থতা। আর এই ব্যর্থতা তাকে কুরে কুরে খায়। তাই যন্ত্রণাটা সামান্য লাঘবের জন্য হলেও জাকিয়া বছরে একবার মাতৃভূমিতে আসবেই। যতই বয়স হোক, এই গভীর টান সে এড়াতে পারে না। এখানে আসার একমাসের মধ্যেই সুন্দরবনের ট্যুরের অফারটি সে পেয়ে গেল গুলশান ক্লাবের কিছু পরিচিতজনের মাধ্যমে। এখানে ভালোই কাটছে গত একদিনের যাত্রাকাল। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সাপের মতো ফুঁসে ওঠা ঢেউগুলোর জাদুকরী শোভা দেখতে দেখতে সে ভাঙা গলায় গেয়ে উঠেছিল, ‘ও আমার দেশের মাটি’।
পৃথিবীর অনেক দেশে বেড়িয়েছে সে। পঞ্চাশ পেরিয়ে বয়স এখন ষাটের কাছাকাছি। গত বছরই তো ষাট হলো! জলের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়েছে, কত শতাব্দী কাল ধরে সে শুধু ভাসছে, ভাসছেই।
একটু ক্লান্ত হয়ে ডেকের দিকে এগিয়ে আসতেই মানুষটির তীব্র গোঙানি প্রকটভাবে শুনতে পেল জাকিয়া। একজন একা মানুষ। একা! কিন্তু তার সুন্দরী স্ত্রী ও আলোর মতো কিশোরী কন্যা আছে। তবুও একা! একাকী জাকিয়া নিজেও ভেবে পাচ্ছে না কী করবে! চারপাশে ইঞ্জিনের বিকট শব্দ। সেই শব্দে হারিয়ে যাচ্ছে লোকটির নিঃসঙ্গ যন্ত্রণার ভাষা। বাকি মানুষেরা কোথায়! ওরা কি সবাই এই স্যাটেলাইট আর জ্ঞানের যুগে হারিয়ে গেছে! প্রশ্ন করলে, এখন হাজারটা উত্তর জড়ো হবে, নিজেকে জাস্টিফাই করার জন্য। মানুষ এখন অনেক জ্ঞান জড়ো করেছে। আর জ্ঞান তাদেরকে তৈরি করেছে, আবেগহীন, নিরুত্তাপ, খুনি। কেন যে এমন করে ভাবছে সে! একা একা কিছুই করতে পারছে না বলে!
এখনও এই একাকী মানুষটি হাঁটুর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, অথচ কিছুই করতে পারছে না জাকিয়া! যন্ত্রণা কি শুধুই হাঁটুতে! না বুকে! বা অন্য কোথাও! আচ্ছা, এই ব্যথা তো আমারও হতে পারত! পারত না! জাকিয়া ভাবে।
এখানে সবাই তাকে জাকিয়া আন্টি বলেই ডাকে। বয়সে বড় বলেই এই আন্টি সম্বোধন। কিন্তু তার শক্তিতে ও বুদ্ধিতে কিছুই কুলোচ্ছে না এই মুহূর্তে। ওদের গ্রুপে একজনে ডাক্তার আসবার কথা ছিল, কিন্তু কোনো এক বিশেষ কারণে তিনি আসতে পারেননি। কেন যে আসলেন না! উনি থাকলে বেশ ভালো হতো। অন্তত এই সময় একজন ডাক্তার থাকা খুবই জরুরি। তাছাড়া আরও চার দিন থাকতে হবে লঞ্চটিতে! কত বকম অসুস্থতা ঘটতে পারে! সত্যিই একজন ডাক্তার খুব জরুরি ছিল!
একটু পরই সূর্যটা ডুবে যাবে। বাকি লোকজনরা কোথায়! সবাই কি ওপরের ডাইনিংয়ে বিকেলের চা খেতে গেছে! হ্যাঁ, প্রোগ্রামে এমনই কথা লিখা ছিল। চা ও নুডুলস খাবার পর হাউজি খেলা হবে ডেকের ওপরে। রাত এগারোটা পর্যন্ত ওখানেই সময় কাটানোর কথা। তবে কি সবগুলো কেবিন ফাঁকা! কাউকে পাওয়া যাবে না! লোকটির স্ত্রী বা অন্য পরিচিত কাউকে! জাকিয়া এত অল্প সময়ে তেমন করে কাউকে চিনে উঠতে পারেনি। তাছাড়া বয়ষ্ক মানুষ হিসেবে যুবক-যুবতীদের সঙ্গে সময় মিলিয়ে নেয়াও তার জন্য কষ্টকর। তবু সে এসেছে এখানে জীবনের ক্লান্তি থেকে দুদিন অবসরের জন্য। এই লোকটির চ্যাঁচানোর শব্দ কানে না এলে জাকিয়া হয়তো একটু পরে ধীরে ধীরে হাউজি খেলার জন্য ডাইনিংয়ের দিকেই যেত! চা খেত, বারান্দায় বসে অন্ধকারে নদীকে দেখত, অথবা তুমুল উত্তেজনায় হাউজির অঙ্ক মেলাত।
দুদিন আগে সবাই মিলে যাত্রারম্ভের সময় জাকিয়া লঞ্চে ওঠার সময় লোকটির স্ত্রীকে তাদের কিশোরী মেয়েসহ তাদের জন্য নির্দিষ্ট কেবিনটিতে ঢুকে পড়তে দেখেছে। হ্যাঁ, মনে পড়ছে ঠিক! সে দেখেছিল। কিন্তু পঞ্চাশজন সদস্যের ভিতর দু-চারজনের সঙ্গে কিছুটা আলাপ জমলেও এই ব্যথাক্রান্ত লোকটির সঙ্গে কোনো আলাপ জমাবার সময় হয়নি, জাকিয়ার। এখন এই লোকটির গোঙানির শব্দে কেমন যেন ধাঁধা লেগে যায় তার। একবার নিচের কিচেনে দৌড়ে যাবার কথা ভাবে সে। আরেকবার ওপরের ডাইনিংয়ের দিকে। কিন্তু এতগুলো সিঁড়ি টপকে দ্রুত ওপরে যাওয়াটা এই বয়সে তার কাছে সহজ মনে হচ্ছে না। অথবা নিচের সিঁড়ি টপকে ডাইনিংয়ের দিকে! হাতের ছোট্ট পার্টস থেকে মোবাইলটা বের করে, আয়োজকদের নম্বরে ফোন করার চেষ্টা করে সে। বনের এতটাই গভীরে লঞ্চটা এসে ভিড়েছে যে, এখানে কোনো নেটওয়ার্ক নেই গ্রামীণফোনের। দু-একজনের কাছে টেলিটকের সিমটা আছে, যা দিয়ে দু-একজনকে সে ঢাকায় যোগাযোগ করতে দেখেছে। কিন্তু জাকিয়ার তা নেই। কী করবে সে এখন! লোকটির গোঙানি ও চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে জিভটিও যেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কী যে করবে সে! আহা! ভেরি ব্যাড সিচুয়েশন! জাকিয়া এবার তার কেবিনের পাশের বদ্ধ কেবিনগুলোতে কাউকে পাওয়া যায় কি না তার চেষ্টায় দ্রুত দৌড়াতে থাকে। কেবিনগুলো ভিতর থেকে বদ্ধ। দরজায় নাম লেখা আছে। চশমাটা সঙ্গে নেই বলে স্পষ্ট করে পড়তে পারছেন না জাকিয়া। তবু আলো অন্ধকারের প্যাসেজের ভিতর দিয়ে কিছুটা দ্রুত হেঁটে বদ্ধ একটি কেবিনের দরজায় কান পাতলেন তিনি। লোক আছে ভিতরে! ভিতর থেকে কিছু শব্দ আসছে, কিছুটা চাপা গলায়, নারী ও পুরুষের যৌথ শব্দ, কিছুটা নিশ্চুপ ও গোঙানি। পরপরই যেন তীব্র চাপা অস্পষ্ট শব্দ যেন শীৎকারের শব্দের মতো। কী হচ্ছে এখানে!
এমন ভর সন্ধ্যায়, যখন একটি মানুষ যন্ত্রণায় একা, লঞ্চটি এগুচ্ছে তীব্রতায়। তখন এই আকস্মিক মিলনকাতর শব্দ! গোপনে সেই শীৎকারের শব্দ, লঞ্চের হঠাৎ তীব্র বিকট আওয়াজ, আর একলা মানুষটির আর্তচিৎকার মিলেমিশে একটি গভীর অন্ধকারের বলয় মৃত্যুর অন্ধকারের মতো মনে হয় জাকিয়ার কাছে। এই অনন্ত প্রবাহমান জল ও সময় একই কাতারে দাঁড়িয়ে এক বিপন্ন মুহূর্তের সৃষ্টি করে। জাকিয়া যেন খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে সময়ের কাছে। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে সেই বদ্ধ দরজায় সে ক্রমাগত ধাক্কা দিতে থাকে। প্লিজ, দরজা খুলুন! প্লিজ! একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে!
দরজাটা খোলা হয় না। জাকিয়া আবার তীব্রভাবে ধাক্কা দিতেই থাকে। ধাক্কা দিতে দিতে টের পায়, বয়স হলেও কব্জিতে এখনও জোর আছে। দরজা খুলে একজন লম্বামতো মানুষ বেরিয়ে আসে। পুরো শরীর কালো বোরকায় ঢাকা। বিস্মিত হয়ে জাকিয়া তাকিয়ে থাকে কিন্তু অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পায় না। তবু সে অসুস্থ ব্যক্তিটির কথা জানাতে থাকে উচ্চৈঃস্বরে। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন কালো বোরকা পরিহিত মানুষ দ্রুত রুমের ভিতর থেকে বেরিয়ে দৌড়াতে থাকে। জাকিয়া কারও মুখই দেখতে পায় না, তারা উভয়ে কালো বোরখা নিয়েই ওপরের ডাইনিংয়ের দিকে দৌড়াতে থাকে। তবু পিছন থেকে তাদের অবয়ব দেখে মনে হয়, এখানে প্র্রায় সমান উচ্চতার দুজন রয়েছে। হতে পারে দুজন নারী, অথবা একজন নারী ও অন্যজন পুরুষ। জাকিয়া হতভম্ব! এরা কি এই লঞ্চেরই যাত্রী! জাকিয়া নিশ্চিত হবার জন্য রুমের নম্বরটি ও তার গায়ে সেঁটে দেয়া মানুষদের নামগুলো পড়তে চায়। কিন্তু অন্ধকার প্যাসেজে নাম ও নম্বর দুটিই অস্পষ্ট লাগে। উদ্ধার করা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। ততক্ষণে দোতলার ডাইনিং থেকে সকল মানুষেরা জোরেসোরে নামতে থাকে অসুস্থ মানুষটির দিকে। তারা ঘিরে ধরে চারপাশ। জাকিয়া অনেক লোকের ভিড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। বোরকা পরিহিত দুজনকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু সে বিভ্রান্ত হয়। কারও শরীরেই বোরকা নামের কালো কাপড়টি নেই। লোকের কোলাহলের ভিতর অসুস্থ লোকটির জান্তব আওয়াজ দ্রুত বাড়তে থাকে। ততক্ষণে জাকিয়া ভিড়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে একটু আগে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলোকে মনে করতে ব্যস্ত। কিন্তু তার মন এখন লোকটিকে ছাড়িয়ে অন্য প্রশ্নের দিকে যেতে থাকে। এখানে ফুলহাতা পাঞ্জাবি পরা মানুষ, টি-শার্টের ভিড়, মেয়েরাও পরেছে জিনস ও টি-শার্ট। বোরকা পরিহিত কেউ নেই। তবে কী! কী হতে পারে...! সে চেষ্টা করে মানুষদের উচ্চতার পরিমাপকে সাজিয়ে নিতে। কিন্তু মেয়েদের অনেকেই লম্বা। তারা হাই হিল পরায় উচ্চতাটাও মেপে নেয়া যাচ্ছে না, প্রত্যেকেই প্রায় লম্বা ছেলেদের ঘাড় পর্যন্ত লম্বা। কেউ কেউ সমান সমান। জাকিয়ার নিজের প্রতি বিশ্বাসটা দুমড়ে যেতে থাকে। তবে কি সে চিহ্নিত করতে পারবে না! সে দুটো মানুষকে! মানুষ দুটি কি নারীই ছিল! না, তার ভুল হয়নি। ওরা একজন নারী ও অন্যজন পুরুষ ছিল।
অনেক মানুষের ভিড়ে একটি বেশ সুন্দরী চমৎকার নারীকে সে আবিষ্কার করে, অন্ধকারেও কালো সানগ্লাসটি দিয়ে সে তার চোখজোড়া ঢেকে রেখেছে। তবে কি সে দেখতে চাচ্ছে না এসব দৃশ্যপট! অথবা সে কালো সানগ্লাসের আড়ালে কাউকে ফলো করছে! কাকে! কেন!
দুই.
দুবলার চরে রাস পূর্ণিমার মেলা চলছে। পূর্ণিমা আজ রাতেই শেষ হয়ে যাবে। তার মানে মেলাও আজই শেষ। দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা ভিড় করে এই মেলায়। লঞ্চটাকে হিরন পয়েন্টের কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় ভিড়িয়ে দিয়ে লঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি বড় নৌকা। এখন সকাল নটা বাজে। সকাল সাড়ে সাতটা থেকেই লঞ্চের ডাইনিংয়ে সকলেই হাজির। ডিম, পরোটা, লটপটি, মিষ্টি, চা, কফি সকল কিছুই রয়েছে। পানীয় জলেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে এখানে। তবুও পাঁচ লিটারের একটি বোতল জাকিয়া তার নিজের রুমে নিয়ে রাখে। যদি আবার জলের সমস্যা দেখা দেয়! দ্রুত নাশতা সেরে সে তৈরি হয়ে নেয় নৌকায় করে হিরন পয়েন্টে যাবার জন্য। সে একটু বয়স্ক বলে, আয়োজক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী এগিয়ে এসে উনার হাতটি ধরে নৌকার পাটাতনের দিকে ধীরে ধীরে পৌঁছে দেয়। ভদ্রলোক একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। দেখতে ভারি সুন্দর ও তেমন বয়সী বলে মনে হয় না। আর ব্যবহারটিও চমৎকার। লঞ্চের প্রায় পঞ্চাশজন যাত্রীর প্রতিই তার বিশেষ নজর রয়েছে। জাকিয়াকে নৌকায় তোলার সময় উনি একটি আপেল ও এক বোতল পানি ধরিয়ে দেন। জাকিয়া এই আপ্যায়নে খুশি হয়। প্রত্যেককে চমৎকার একটি নীল রঙের টুপি ও কচি কলাপাতা রঙের টি-শার্ট উপহার দেয়া হয়। অনেকেই সেটি মাথায় ও গায়ে পরে নেয়। কারণ হিরন পয়েন্টে কেউ যেন একা, বনের গভীরে হারিয়ে না যায়, সেজন্যই এই ব্যবস্থা।
আজকের সকালটা ভারি সুন্দর। গতকালের অসুস্থ ভদ্রলোকটিও আজ সুস্থ বোধ করছেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেশ সুখী। জাকিয়া খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন, এই দম্পতিকে। তার মেয়েটি যেন স্বর্গীয় আলোর মতো। কাঁচা সোনা গায়ের রং, আর কী মিষ্টি! এই নৌকাটিতে জায়গা হয়েছে প্রায় পঁচিশজনের। লঞ্চের পাশে কোস্ট গার্ডের একটি নৌকা বাঁধা। সম্ভবত নিরাপত্তার জন্য এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অন্ধকারে গতরাতে যাদের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখা হয়নি, আজ এই আলোর সকালে জাকিয়া সকলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। এই নৌকায় মধ্যবয়সী ছয়টি নারীর একটি গ্রুপ এসেছে। প্রত্যেকেই সুন্দরী, স্বাস্থ্যবান, ঝলমলে। এরা খুব হইচই করতে ভালোবাসে। নৌকায় বসে দারুণ সব মজা করছে। আরেকটি মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে, সুন্দরী। তবে সে একটু যেন আলাদা। সে রয়েছে তার নিজস্বতায়। নীরবতাই তার সঙ্গী। মাঝে মাঝে বাইনোকুলার দিয়ে দেখছে জঙ্গলকে। কখনো বা ছবি তুলছে, ক্যানন ক্যামেরায়। জাকিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মেয়েটিকে। সে সহজ, গভীর, শীতল বা উষ্ণতায় ভরা। ঠিক যেন বোঝা যায় না তাকে, আবার যেন জলের মতো স্বচ্ছও লাগে কখনো কখনো। এখানে দু-চারজন যারা গান জানে, তাদের সঙ্গে মেয়েটিকে সে গলা মিলাতে দেখেছে। তবে জাকিয়ার সঙ্গে তার একটি জায়গায় মিল আছে। সেও জাকিয়ার মতোই একেবারে এসেছে একা। বাঙালি মেয়েরা স্বামী-পুত্র রেখে একা কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, এমনটি সাধারণত দেখা যায় না। তবে এই মেয়েটিকে তার দারুণ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে, যেন সে বাংলাদেশে থেকেও রপ্ত করে নিয়েছে বিদেশি মেয়েদের জীবনের দৃঢ়তা, স্বাধীনতা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। এতে তাকে ঝামেলায়ও পড়তে হচ্ছে, কারণ এখানে উপস্থিত অনেকেই তাকে ঠিকঠাকভাবে নিতে পারছে না।
জাকিয়া অনেক কিছুই ভাবতে থাকে। জগৎকে তিনি দেখেছেন নানাভাবে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সেটেলড করা, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া, বলতে গেলে একটা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন জলের ওপর সাঁতরে পার হওয়া। এত করেও কি ইচ্ছেমতো বাঁচা যায়! বড় ছেলেটি বিদেশিনী বিয়ে করেছে। দেখাদেখি, তার পরেরটিও। কিছুই করার ছিল না জাকিয়ার। দৃশ্যের গভীরে দেখেছে ছেলেদের বিপন্ন সংসার। কোনোরকমে আপস করে টিকে আছে।
না, এখানে বেড়াতে এসে এসব নিয়ে সে ভাবতে চায় না। সে মোটেই ভাববে না, এইসব নেতিবাচক ভাবনা! মায়ের আঁচলের স্নেহ সে তাদের দিয়েছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে সমাজে-সংসারে। এখন বরং ঝাপসা হয়ে আসা অতীত, আর প্রিয়মুখগুলোর ছায়া জড়িয়ে থাক মনের গভীরে।
তিন.
এক অজানা নিয়তির দিকেই কী তার যাত্রা! বোটের একপাশে চুপচাপ বসে ভাবছিল দিলরুবা! ছোটবেলা থেকেই গড়পড়তা মেয়েদের চেয়ে সে আলাদা। দেখতে অসাধারণ সুন্দরী। তার গভীর কালো চোখ যেন অন্তহীন রূপ আর রহস্যের ঠিকানা। শরীরের গঠন ও বুদ্ধি, অন্য মেয়েদের তুলনায় একেবারেই আলাদা। এমন সুন্দর গড়নের মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। যদিও নিজের দিকে তখন একেবারেই তাকাবার অবসর ছিল না। স্কুল, পরীক্ষা, ছোট ভাই-বোনদের আবদার, সমাজ-সামাজিকতা কত কিছুই না! তখন নানা রকম পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে সে সফল হয়েছে ঠিকই। কে জানত! আসল পরীক্ষাগুলো তো দিতে হয় জীবনের পরবর্তী ধাপে। তার আসল পরীক্ষাটা ছিল বিয়ের পর। ভাবেনি সে, ছিমছাম সংসারে প্রতিটি দিনের লড়াই এরকম হতে পারে! কী চেয়েছিল সে! একটুকু ভালোবাসাই তো! শরীর আর মনের মিলিত আনন্দের অনুভব। সুন্দর দুটি শিশু, কিছু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। না, সবকিছুতেই নিরাশা তাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। দুর্বল রোগা স্বামী, মেটাতে পারত না দেহের সাধ। হ্যাঁ, সরকারি চাকরির দুর্নীতির টাকায় ২০০০ স্কয়ারফিটের ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ি সবই দিয়েছিল। সন্তানও দিয়েছিল। এসব দিয়ে চেয়েছিল তার মন জয় করতে। তবু পুরুষের নিচে জড় অবস্থায় শুয়ে থাকা, সে পারল না! পারল না। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পুরুষ তাকে খাওয়াবে, পরাবে, আর সে হবে সেই পুরুষের আদর্শ রমণী! অনেকেই হয়তো পারে! কিন্তু না পারার দলের নারীরাও কি কম! পেরেছিল কি চোখের বালি! এমনকি দস্যু ফুলন দেবীও কি হাতের বন্দুক ফেলে সাপ্তাহিক যৌনতায় অভ্যস্ত হননি!
কী করে যেন পার্টিতে যেতে যেতে, স্বামীর বন্ধুদের অনেকের প্রতিই তার ভালো লাগার বোধ তৈরি হলো। নিজেকে সে ভাসাল-ডুবাল এদিক ওদিক। সংসারের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল। কিন্তু কোনোভাবেই নিজঘরে আর ঠিকঠাক পৌঁছতে পারল না সে। বদ্ধ মাতাল পুরুষেরা কেমন করে তার নগ্ন সুন্দর দেহটিকে নেড়েচেড়ে দেখে, তার মধ্যেও জীবনের এক লবণাক্ত জলের স্বাদ সে নিয়েছিল, আবেশিত হতে হতে। জীবন কখনো কখনো জন্ম দেয় এমন ঘোর, এমন তরল সময়, এমন উগ্র খেয়াল আর উগ্র শিহরণ! হ্যাঁ, ভোগ করেছে সে জীবনকে, অনিঃশেষে। এই যে এখানে সে এসেছে, সে জানে আয়োজক ভদ্রলোকটির প্রতিটি নিঃশ্বাসের ওঠানামার শব্দটি কেমন! যদি প্রেম বলতে কোনো শব্দ থাকে অভিধানে, বা তার নিজের অনুভবে, তবে তা, ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তিটির সঙ্গেই। সে তাকে ভালোবাসে তার সবসুদ্ধ। তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা—সকলকে মিলিয়েই তার এই ভালোবাসার নিয়তি। যদিও দিলরুবা জানে, লোকটি তার গুণমুগ্ধ, তাকে ভোগও করেছে আকণ্ঠ কিন্তু লোকটি তাকে মোটেই ভালোবাসে না। আড়ালে মাগি বলতেও দ্বিধা বোধ করে না। তবে এই নিয়ে দিলরুবার কোনো ভাবনা নেই। পুরুষদের নিয়ে খেলতে খেলতে সে এখন বড় খেলোয়ার। সে জানে, কখন, কীভাবে গুটি চালতে হয়।
নিজের ভাবনার ভিতর থেকে হঠাৎ লঞ্চের তীব্র গর্জন তার ভাবনার জগৎটিকে তছনছ করে দেয়। নিজের ভিতরে নিজেরই আর এক অবয়ব প্রশ্ন তোলে! আমি কি ভাবতে চাই কিছু!
না, কখনো না। এই ভালো। ভাবনাহীন।
কিন্তু এখানে বেড়াতে আসার সবটুকু পরিকল্পনা তুমিই করেছ!
হ্যাঁ, করেছি। আমি এই সময়টুকু চেয়েছি। চেয়েছি নিজের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে। সময়ের গতির ধারণা পেতে। যে ব্যক্তিটিকে আমি ভালোবাসি, তার মধ্যে আমি কতটুকু আছি, তার একটা হিসাব নেয়া জরুরি ছিল। নিজেকে আর বাদুড়ঝোলা অবস্থায় দেখতে আমার ভালো লাগছিল না।
তোমরা কি এক হতে পেরেছিলে—এই ঝুলে থাকা সময়ে!
আমার মরচে ধরা অসহায় শরীরকে আমি বারন করতে পারিনি। যখন আকাশ নীল হয়ে উপুড় হয়ে পড়েছিল লঞ্চের ডেকের ওপর, তখন সন্ধ্যাকালের আলো-অন্ধকার আমাদেরকে গ্রাস করেছিল। আমার চোরা কুঠুরিতে রাখা সবটুকু ভালোবাসা আমাকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে টেনে এনেছিল তার কাছে। লঞ্চের প্রবল গর্জনকে উপেক্ষা করে, আমরা ঢুকে পড়েছিলাম ওই কেবিনটিতে। কেবিনটি খালি ছিল। যার নাম লেখা সে উপস্থিত নেই। এত অস্থিরতার মধ্যেও আমার পরিকল্পনায় কোনো ফাঁকি ছিল না। আমার পর্যবেক্ষণও ছিল শাণিত। কালো বোরকাদুটি যে কারণে কিনে রেখেছিলাম, তার যথার্থ প্রয়োগ করেছিলাম। সামান্য ছোট্ট সময় আমার শরীরের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল। আমি তৃপ্ত।
এমন তৃপ্ত তুমি আগেও হয়েছিলে!
হ্যাঁ, তখন আমার আর তার মধ্যে তৃতীয় কেউ ছিল না। আমরা মিলিত হয়েছিলাম অনেক জায়গায়। রক্তে, ঘামে, বীর্যে। সমস্ত কামশাস্ত্র উজাড় করে। কেবল ভোগ, ভোগ আর ভোগ! কিন্তু গত বছর থেকেই তার মধ্যে আমি অস্থিরতা টের পাই। আমি বিস্মিত হই, তার অস্থিরতায়। আমি জানতে চাই, আমি ছাড়া এই তালিকায় আর কজন আছে!
তাই বুঝি এত পরিকল্পনা করে এগোলে!
হ্যাঁ, সারা রাস্তায় আমাকে সানগ্লাস চোখে রাখতে হলো। এমনকি অন্ধকারেও! আমার প্রেমিক কোন বিশেষ নারীটির প্রেমে পড়েছে, তা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য। ইস্, এটিও আমায় করতে হলো!
কিন্তু তোমার স্বামী আর তোমার প্রেমিকের স্ত্রী যে বঞ্চিত হলো, তাদের কথা ভাবলে না! এত সুন্দর চাঁদের রাত! তোমরা দুজনে যখন কামের আগুনে পুড়ছ, ওরা ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ছে তোমাদের নিষ্ঠুর অবহেলায়!
না, ভাবিনি। কোকিল যে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে! কেন পাড়ে! আমি শরীরের পূর্ণতা চেয়েছিলাম। এতে আমার কোনো গ্লানি নেই।
সেও তাই চেয়েছিল!
জানি না। শুধু জানি আমার শরীরকে। আমার শরীর প্রেম ও স্বপ্ন মিলিয়ে এই সুন্দর প্রকৃতিতে জেগে উঠতে চেয়েছিল। আমি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তাকে চেয়েছিলাম। প্রকৃত আধার ও আধেয় মিলে আমি পূর্ণ হয়ে উঠেছিলাম। না, কোনো দ্বিধান্বিত প্রশ্নের সামনে আমি দাঁড়াব না। কত রাত্রিকে আমি আগুনে পুড়িয়েছিলাম আমি জানি। আমার লোভ ও কৃতজ্ঞতা সব মিলিয়েই আমি তার বাহুতে পেয়েছিলাম জীবনের প্রকৃত স্বাদ।
এসব ভাবনায় এলোমেলো ভারে পা দুটি টলছিল দিলরুবার। যেন সে আর টলমল পায়ে দাঁড়াতে পারছিল না। চারদিকে রাশি রাশি জল। জলের নিয়মে। রেলিংয়ের কিনার ধরে নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন তাকে এক অন্য আনন্দের মাত্রা দেয়। টেলিফোনটা হাতে নিয়ে সে একবার তার প্রেমিকের মুখটি খোঁজ করে। যদিও সে জানে, ওই ব্যক্তিটি প্রতিটি মুহূর্তকে ভাগ করে নিচ্ছে, আরও অনেক অপরিচিত মেয়েদের সঙ্গে। সমস্ত সম্পর্কটাই ছলনা! মনের ভিতরের যে সিঁড়িটি চলে গেছে অতীতের দিকে, তার পুরোটা জুড়েই ব্যথার পেরেক। হঠাৎ প্রতারিত হবার যন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠে দিলরুবার হৃদয়।
গতকাল ডেকের বিছানায় স্বামী রায়হানের যন্ত্রণাক্লান্ত মুখটা মনে পড়ে দিলরুবার। রায়হান কি পারত না! দৃঢ়ভাবে তাকে শাসনে রাখতে! সে চাইলে বাইরের শাসন দিয়ে আটকে রাখতে পারত দিলরুবাকে! কিন্তু তা ও করতে চায়নি। হয়তো তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, সে ফিরে আসবেই।
গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে, পালিত পশুর জীবনে, চোখে ঠুলি দিয়ে রেখেও জগতের কিছুই পালটানো যেত না, কখনো যায় না, তা রায়হান ভালোভাবেই বুঝেছিল। তাতে দুটি সন্তানকেও ঠিকঠাক মানুষ করে তুলতে পারত না। তার নিজস্ব স্বাধীন জীবনে তিক্ততা রয়েছে, কিন্তু তাদের দাম্পত্যে স্বাধীনতার ও সামাজিকতার অভাব নেই। শেষ পর্যন্ত এই তিক্ত জীবনের ভার দিলরুবা যে একাই বহন করবে, তাও রায়হান জানে, কিন্তু তার সন্তান বা স্বামীকে সামাজিক জীবনে কিছুতেই ছোট করবে না।
যদিও গতকালের বিচ্ছিরি ঘটনাটা তার ভাবনার বিপক্ষেই গেছে। হঠাৎ কেন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল রায়হান! তবে কি সেও বোঝে নিঃসঙ্গতার জ্বালা! ওর শরীরের আলো কত আগেই তো নিভে গেছে। সেই অন্ধকার ভূতের মতো। তাতে হারিয়ে যায় সকল সুস্থ বুদ্ধির অবসর। রায়হান তো খুব ভালো করেই জানে, ‘আমার শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় কতটা অগভীর ছিল সে। আমি হতে পারিনি নোরার ডল পুতুল! আমি হইনি সেই গৃহপালিত নারী, যাকে শরীরের যে কোনো অংশে যখন-তখন ভোগ করা যায়। বরং পুরুষদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমিই নিয়েছি। তবে কি আজ এখানে বেড়াতে এসে, সেও নিজেকে কিছুটা বদলে নিতে চাইছে! রায়হান! বেচারা! আমার ভোগলিপ্সা তাকে চূড়ান্তভাবে ঠকিয়ে দিল। বেঁচে থাকার রীতিনীতিগুলো বড়ই অদ্ভুত! মানুষেরা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বড্ড দুমুখো। রায়হান কোনোরকম একটা রুটিন সেক্স হলেই খুশি ছিল। কখনো বোঝার চেষ্টাই করেনি, পুরুষ একটি বিশেষ নারীতে, নারী একটি বিশেষ পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয় কীভাবে! শুধু সেক্স দিয়ে, শুধু রূপের কদরে! নাকি কোনো বিশেষ গুণে! না, এসব কিছুই না। যৌনতার বিশেষ ভূমিকাটি আজও সমাজে তেমনভাবে কেউ স্বীকারই করল না। বুঝলও না।’
রায়হানের জন্য মনটা কেমন করে ওঠে দিলরুবার। মনে পড়ে, তার জামাকাপড় থেকে উঠে আসা গন্ধ। বিশেষ পারফিউমটির। এই অচেনা জায়গায় সে কি আমায় চেয়েছিল! চেয়েছিল কি আমাকে নিজের ভিতর ডেকে নিতে! আর এই ডেকে নিতে গিয়েই কি আমার বিচিত্র ইচ্ছেগুলোর মুখোমুখি হয়ে আমাকে আর চিনতে পারছিল না! অথবা আমাকে একেবারেই ছেড়ে দেবার ভাবনায় ছিল! হতে পারে! ডিভোর্স! ভেবেছিল কি এই শব্দটি! হ্যাঁ, হতেও পারে! আর তাই হয়তো বুকের ব্যথায় মুষরে পড়েছিল ডেকের ওপর!
জলের গভীরে নিজমুখের ছায়া দেখতে দেখতে সে যেন এক গভীর অপরাধবোধ থেকে নিজের কাছে ফিরে আসতে চায়। নিজের কাছে ফিরে আসাটাই এখন অনিবার্য। নিজ মুখের পাশে তার মেয়ের মুখটিও ভেসে থাকে। একটু দূরে তার প্রেমিকের মুখের সঙ্গে রায়হানের মুখটিও জলের ভিতর টলোমলো। সব জল আজ একাকার হয়ে কীসের সংকেত দিতে চায়!
চার.
মাসুদ একাই দাঁড়িয়ে ছিল অন্ধকারে। আকাশে একটা বিরাট চাঁদ। তার আলো এসে পড়েছে তোলপাড় করা জলে। কী চমৎকার ঝিকমিক করছে! কিন্তু এইসব আনন্দের উপকরণও আজকাল পানসে ঠেকে। কী জানি কেন! বয়স হয়েছে বলেই কি! হুম। অন্ধকারে নিজের দিকেই একবার তাকায় সে। শরীরটা বড্ড ভারী আর থলথলে হয়েছে। শক্ত শারীরিক গঠনটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! একসময় এই শরীরটা আরাধ্য ছিল কত মেয়ের! সত্যি কি জাদুময় ছিল সেসব দিন! এই গত বছর সে রিটায়ারমেন্টে গেল! যাবার পরদিন থেকে একসপ্তাহ ধরে তার বাসায় অসংখ্য নারী এসেছে উপহারসহ।
এরা সবাই তোমার কলিগ! প্রশ্ন করেছিল নাসিমা। তার স্ত্রী।
নাসিমার মনে একটু সন্দেহ ছিল, তাই এই প্রশ্ন। খুব কায়দা করেই সামলে নিয়েছিল সে।
কখনো কোনোদিন নাসিমাকে প্রশ্ন করার অবকাশ সে দেয়নি। স্ত্রীকে ও প্রেমিকাকে কীভাবে একত্রে খুশি রাখা যায়, এই মহাবিদ্যায় সে যৌবনেই দীক্ষা নিয়েছিল। নাসিমার সঙ্গে জীবনটাও জুড়ে দেয়া হয়েছিল অনেকটা পারিবারিক সিদ্ধান্তেই। তখন তার বয়সটাই বা কত! ঠিক বাইশ বছরেই নাসিমাকে পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে করেছিল সে। অথচ, তার মনের সবটুকু জুড়ে তখন মাধবী। মাধবীর কথা সে কোনোদিনও উচ্চারণ করতে পারেনি, কারও সামনেই।
সতেরো কি আঠারো বয়স। এর মধ্যেই ঊনসত্তরের আন্দোলন। পুরান ঢাকার বনেদি পাড়ায় তাদের বাস। খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে সে পড়ত। তখনই মাধবীর সঙ্গে দেখা আর জানাশোনা। মাধবী, মাধবীলতা! হুম, সে আমার মাধবীলতা। দোতলার বারান্দার কোণে অন্ধকারে বসে, একসঙ্গে দুটি প্রাণের মধুরতম উচ্ছ্বাসে আমি মগ্ন হয়ে রইতাম। আমাদের ঠিক পাশের বাড়িটিতেই তার বাস। অসাধারণ সুন্দরী সে। তার পিঠ ছাপানো কালো কোঁকড়ানো চুল, শরীরের লম্বাটে গঠন, আর অপরূপ চেহারার আভিজাত্যের মধ্যে আমি নিমিষেই হারিয়ে ফেলতাম দিন, কাল, সময়ের ঠিকানা। ওর চোখের দিকে তাকালে কী এক অজানা ব্যথায় বুকটা টনটন করে উঠত। পরে জেনেছি, একেই বলে প্রেম।
হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই আমার সত্যিকারের প্রেম হয়েছিল। প্রেম! সত্যিকারের! হুম!
সেই ছিল আমার শরীর ও মনের একান্ত আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। তার চোখের ভিতর ছিল আশ্চর্যভাবে নিজেকে আবিষ্কারের এক অন্তহীন পথ। তার শরীর ছিল গভীর প্রাপ্তির পর এক চুপচাপ বসে থাকা। আর যেন কোথাও যাবার তাড়া নেই। এক অফুরান অবসরের ভিতর যেন অনন্তকাল বসে থাকা। মনে পড়ে—সেই কবেকার কথোপকথন—
তোমার কাছে বসলে মনে হয় যেন নদীর পারে বসে আছি। কী গভীর শান্তি!
মাধবী একচিলতে হেসে বলে, তাই বুঝি! শান্তির চেয়ে অস্বস্তি হয় না বুঝি! কেমন একটা ভয়! কেউ যেন এখনই দেখে ফেলবে, আমাদের দুজনকে!
বাহ্! দেখলেই কী! আমি তোমাকে বিয়ে করে ফেলব!
এতই সহজ! ভুলে যাচ্ছ কেন! আমাদের বাবারা সম্পর্কের দিক থেকে খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু দুজনেই ভীষণ গোঁড়া। যদিও দুজনেই রাতে ঘুমাবার আগে রবীন্দ্রসংগীত শোনে।
মাসুদের কপালে চিন্তার একটা সূক্ষ্ম রেখা তীক্ষ্নভাবে যেন যন্ত্রণা দিয়ে যায়। চিন্তিত মনেই সে বলে, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ তুমি। আমার আব্বু আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছে, এখনও রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে ঘুমাতে যায়, কিন্তু মনের ভিতরটায় কোথায় যেন কাঁটা বিঁধে আছে।
আমার বাবাও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এতদিনে আমাদের কলকাতায়ই থাকবার কথা ছিল। বাবা রাজি হলেন না। বড় জেঠু সেদিনও চিঠিতে লিখল, সাতচল্লিশের পর ওদেশে থেকে যাওয়াটা ভালো করিসনি সুবোধ। অশান্তি আর হিংসা যেন কোনোদিনই যাবে না মানুষের মন থেকে।
তাহলে, এখনই চলে যাও! যাও! যাও! মাসুদ ভুরু কুঁচকে বলে। গলার স্বরে তীব্র অভিমান।
মাধবী ঠোঁট দিয়ে চেপে দেয়, মাসুদের সেই অভিমানের স্বর উচ্চারিত ঠোঁট। আকাশের গায়ে একটা চিকন চাঁদ। স্তম্ভিত সাক্ষী হয়ে দেখছিল, অন্ধকার বারান্দায় মানব-মানবীর এক আশ্চর্য তরঙ্গময় অভিজ্ঞতা। মানব-মানবী যেন এক তোলপাড় তরঙ্গে নিজেদের দিচ্ছিল বিলিয়ে, আবার যেন এক পলকা হাওয়ায় উড়িয়ে দিল নিজেদের, সমগ্র অস্তিত্বের মধ্যে যেন এক উন্মাদনার উল্লাস। বারান্দার কোণের মালতীলতার ঝাড়ের গায়ে দুলে ওঠে আচমকা বাতাস। অন্ধকারে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে তার গন্ধ। থরথর কেঁপে ওঠা শরীরের মতো মালতীলতার গন্ধরাও ইথারে ছড়িয়ে পড়েছিল ম-ম করে। আর মাধবীর ঠোঁটের ভিতর ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে সে নিয়েছিল জীবনের এক অপূর্ব স্ফুলিঙ্গ। পরস্পরের কোল ঘেঁষে নিজেদের সম্পূর্ণ করে পেয়েছিল ওরা নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে। দুটি ছটফটে শরীরের ভিতর এক চেনা সুরের তরঙ্গ, মিলে যাচ্ছে সমে, ঢেউ এসে ছড়িয়ে পড়ছে বেলাভূমিতে—সময় যেন থেমে গেল এক জীবনের মতো। ওই অন্ধকার চিলতে বারান্দায় সেই মুহূর্তে স্বর্গ নেমে এসেছিল।
জীবনের আর সবটুকু দৈন্যের ভিতর ওই পাওয়াটুকুই যে শ্রেষ্ঠ, মাসুদ তা জানে। আজও দীর্ঘ বছর পর ওই মুগ্ধতাকে সে দীর্ঘসময়ের ব্যবধানে পরখ করে। পরখ করে জানতে চায়, তার তীব্রতা। এটা তীব্র সত্যি যে, মাধবীই ছিল, তার একমাত্র প্রেম। যদিও ভিন্নধর্মের চূড়ান্ত বাধাটি বারবার তার মনের মধ্যে ঝুলে থাকত। হঠাৎ একদিন সত্যি সত্যিই মাধবীর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওরা কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। তাছাড়া তখন রাজনৈতিক অবস্থাটিও বেসামাল ছিল। ঝুঁকি নেয়া অসম্ভবও ছিল। তাই খুব শীঘ্রই তাদের কলকাতা চলে যেতে হয়। ঊনসত্তরের পর একাত্তর চলে আসে খুব দ্রুতই। দেশের পরিস্থিতি পালটাতে থাকে। ওরা সেই যে গেল, ঘরবাড়ি ছেড়ে, আর ফেরেনি।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতেই বড় চাচার মেয়ে নাসিমার সঙ্গে তার পারিবারিকভাবে বিয়ে দেয়া হয়। যদিও তার সবটুকু ভালো লাগা বেঁচে ছিল মাধবীকে ঘিরেই, আর এই অসম্ভব কথাটি অনেকবার বলতে চেয়েও, সে আজও উচ্চারণ করতে পারেনি, কারও কাছে। নাসিমার কাছে তো নয়ই। কেন যে পারল না! তাহলে জীবনের জটিলতা কিছুটা তো কমত! নাসিমার সঙ্গে বিবাহিত জীবন পুরোটাই দায়িত্বে ঘেরা। কেবলই সম্পর্কের দায় নেভানো। যুদ্ধের ভয়ানক পরিস্থিতিতে চাচাতো ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল নাসিমার পরিবারের জন্য এক ভয়ানক নিয়তি। গ্রামের রাজাকাররা বেশ কয়েকবার শাসিয়ে গেলে নাসিমার পরিবার বাধ্য হয় যুদ্ধ শেষের দুমাস আগে গ্রাম ছেড়ে পালাতে। নাসিমার পুরো পরিবারকে নাসিমার ফুফুর গ্রামে পালাতে হয়। মাসুদও তখন তার পরিবার নিয়ে ওই ফুফুর বাড়িতেই। পরিবারের সবার সম্মতিতেই বিশেষ করে নাসিমার নিরাপত্তার খাতিরেই বিয়েটা হয়েই যায়। সোমত্ত মেয়েদের নিয়ে তখন ভয়ের যেন শেষ নেই! মাসুদের বাবারও ভয় ছিল, ছেলে যদি আবার মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়! যদিও মাসুদের ছোট ভাইটিকে শেষ পর্যন্ত আটকে রাখা যায়নি কোনোমতেই! মাত্র ষোলো বছর বয়সেই মাসুদের ছোট ভাইটি যুদ্ধে যাবার জন্য ঘর ছেড়েছিল।
লঞ্চের ছাদে, দড়িদাড়ার মধ্যে, বড় একটা আকাশের তলায়, লঞ্চের গর্জন আর অন্তহীন জলের দিকে চেয়ে কেমন এক অন্ধকার যেন দুলে উঠল মাথার ভিতর। সেই জলের দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগল, পৃথিবীকে যতটা সম্ভব আমি দেখেছি, কিন্তু তার পরেও সার্থকতা কোথায়! ঘরের আরাম, বাইরের সুখকর অভিজ্ঞতা, অজস্র নারীর শরীর, সরকারি ঊর্ধ্বতন চাকরির মর্যাদা, দুধের ওপর জমে থাকা সরের প্রলেপের মতো একটা সুখ ভাব ক্রমশই আমাকে মুড়ে রাখে। তবুও প্রাণ কেন কাঁদে! “প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন—তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে!” অনেক কিছুই তো জীবনের মধ্যে ভরে রাখলাম! তবু কোথায় যেন সুখের প্রলেপটাকে মিথ্যের প্রলেপের মতো মনে হয়! এই জন্যই কি সবাই আমায় ছেড়ে গেল! একে একে! শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলেটিও। সিয়াম, আমার ছেলে। আমার মতোই দেখতে, সুন্দর, সাস্থ্যবান, পড়াশোনায় ভালো। আমার স্ত্রী নাসিমার একমাত্র ভরসার স্থল। সে অনার্স পাস করল, বিদেশে পড়তে গেল, প্রেমে পড়ে বিয়েও করে ফেলল। ওর মা মেনে নিলেও আমার ভালো লাগল না ওর সিদ্ধান্ত! এখন এই অন্ধকারে একা একা জলের ধারে দাঁড়িয়ে আমার নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে, আমার কেন ভালো লাগেনি! কেন আমি সিয়ামের সিদ্ধান্তকে মানতে পারলাম না! কারণ! কারণ এখন আমি জানি। মাধবীকে না পাওয়ার জ্বালা আমাকে সারা জীবন ধরে পুড়িয়ে দিয়েছিল! তাকে পাবার জন্য আমি কী না করেছি! শেষ পর্যন্ত দিল্লিতেও গিয়েছিলাম! কিন্তু নকশাল আন্দোলন আমার সব পরিকল্পনাই শেষ করে দিয়েছিল। তাই নিজের ছেলের প্রেমের সিদ্ধান্তকে, প্রেমের মিলনকে আমি মানতে পারিনি। একটা নিষ্ঠুর, কাঠখোট্টা, কর্কশ, হিংস্র মানুষ আমার ভিতর আস্তানা গড়ে নিয়েছিল। সে আমারই সত্তার অংশ। আমি মানতে পারিনি সিয়াম আর তিথির শুভ পরিণয়। যদিও ছেলের চাপে পড়ে বিয়েটা আর দশজনকে দেখিয়ে মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু মন থেকে মানতে পারিনি। সিয়াম আর তিথি গত পাঁচ বছরেও দেশে ফিরল না। তিথি মানে আমার বউমা, দেশে এসে নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে যায়, আমাদের বাড়িতে আসে না। কতটা দুঃখজনক! ছেলে সঙ্গে এলেও বেশির ভাগ সময় কাটায় শ্বশুরবাড়িতে। কতটা দুঃখজনক! নাসিমাকে সুস্থ রাখা তখন বেশ কষ্টসাধ্য! হ্যাঁ, আমি সত্যিই সকল দিক থেকেই অপারগ ছিলাম। মেয়েটা তখন ক্লাস নাইনে পড়ছে। একদিকে নাসিমার অসুস্থতা, অন্যদিকে ছেলে ও বউমার প্রত্যাখ্যান, সরকারি চাকরির নানা ঝামেলা, মেয়েটার মানসিক যত্ন সব মিলিয়ে আমি যেন অপার সমুদ্রে সাঁতরাচ্ছি। এদিকে সে বছর আম্মুও মারা গেলেন। তার আগের বছরে আব্বু! বড়মাপের সরকারি অফিসার হওয়ার যন্ত্রণাটাও টের পেতে লাগলাম তখন। কোন দিক সামলাব! সে সময়টায় নাসিমা একেবারেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। একেবারেই শয্যাশায়ী। ছেলের শোকে মৃত প্রায়। শারীরিক শ্রমের ক্ষমতা তার কোনোদিনই ছিল না। কাজেকর্মে, গৃহিণীপনায় সে যদিও পারদর্শী ছিল কিন্তু তা একেবারেই আটপৌরে ধরনের। তাতে আধুনিকতার জায়গাটি মোটেই ছিল না। সত্যি বলতে কি ওর শরীর, মন কোনো কিছুই আমাকে টানেনি। একটি জড়বস্তুকে যেন কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। সেই সময়টায় অফিসের অনেক জুনিয়র মহিলা কলিগকে আমার ভালো লাগত। সত্যিই ভালো লাগত। হুম, তাদের একপলক সুন্দর চাউনিতেও আমি নিজেকে নতুন করে ভাববার অবকাশ পেতাম। যেন ওইটুকুই আজকের দিনটার জন্য যথেষ্ট ছিল! হ্যাঁ, একটি পরিপূর্ণ রাত—শরীর আর মন মিলিয়ে আমাকে ইচ্ছেমতো নিয়ে যাবে সময়ের ও চেতনার নানা স্তরে! আমি চাইতাম সেটা। কারণ নিজেকে ওই অন্ধকারের গভীরে না ভেঙে আবার নতুন করে গড়বার প্রণোদনা, এটা ছাড়া সম্ভব ছিল না। আমাকে অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজ সামলাতে হতো। খুব নির্বিঘ্নে এইসব সামলে নেবার জন্য একটা নিবিড় প্রেমের প্রয়োজন ছিল তখনই। দিলরুবা-দিলরুবা-দিলরুবা—তাকে পেয়েছিলাম আমি সেই মরুভূমিতে। প্রচণ্ড বালির ঝড়ের ভিতর, অন্ধকারের ভিতর সে এসেছিল এক নতুন ফর্মে। আমাকে ডুবিয়ে নিয়েছিল, ভাসিয়ে নিয়েছিল। সত্যিই আমার তখন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে আমি চাইওনি। কেন চাইব! চির রোগা স্ত্রী, যেন বিছানায় পড়ে থাকত কেন্নোর মতো। না ছিল মেরুদণ্ড, না ছিল শরীর। এক প্রবল ঘৃণার ভিতর দিলরুবা আমায় আবার নতুন করে গোলাপের রং চেনাল। শুধু চেনালই না। তার প্রকট যৌবনকে মেলে ধরল আমার চোখের সামনে। ন্যায়-অন্যায় ভুলে আমি তার শরীরে ছুটে গেছি বারবার। ভরসা পেয়েছি, বেঁচে থাকার। ক্রমাগত অভ্যস্ততায়, আমাদের শরীরী ভাষাটা এমন হয়ে গেছে যে, ঠিক দশ মিনিট ওর সঙ্গে থাকলেই আমি উন্মত্ত হয়ে উঠি। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় কেবিনে ওকে একা পেয়ে, আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। কী যে হলো আমার। তীব্রভাবে তাকে চেয়েছিলাম। ও ভীষণ বুদ্ধিমতী! ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল। বোরকা জোগাড় করে রেখেছিল। সেজন্যই ওকে এত ভালো লাগে! আসলে আমি ওর হাতের পুতুল! শুধু আমাকেই নয়, এক বছরের মেলামেশায় সে নাসিমাকে আমূল বদলে দিল। নাসিমাকে এখন দেখতে বেশ স্মার্ট লাগে। নাসিমাকে এখন সে সারিয়ে তুলেছে—সিয়ামের নাম করে এখন আর কাঁদে না। আমার ভালো লাগে এই পারিবারিক বন্ধুত্ব।
আজ এত বছর পরেও মেয়েদের দেখলে মনে হয়, ওরা সুগন্ধি আতর। আচ্ছা, এই যে মেয়েদের নিয়ে এই ভাবনাটা আমি ভাবছি, কোনো আধুনিক মেয়ে আমার এই ভাবনার প্রতি আঙুল তুলবে! কিন্তু কেন! এভাবে ভাবলে ক্ষতি কী! একটি তীব্র অনুভব যদি সময় ও বাস্তবতাকে উড়িয়ে নেয়, তবে কার ক্ষতি! যদি আজকের এই তীব্র বাতাসে উড়ে যায় আমার সকল শূন্যতা, আমার মুখোশ, আমার দীর্ঘচর্চার আমলাতান্ত্রিক সিগনেচারগুলো, তবে কার কী ক্ষতি! সত্যিই মনে মনে আমি একটি সর্বনাশ চাই যা আমার এই সমস্ত জীবনটাকে উড়িয়ে নিতে পারে। মাঝে মাঝে ভালো লাগে না এই সংগমক্লান্ত জীবন। এই কুকুর-বিড়ালের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা!
পাঁচ.
অনাদি কালের বোবা যন্ত্রণা নিয়ে বয়ে যাওয়া জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল নাসিমা। জীবজগতের আদি যে ভাষা, সে প্রাণময় ভাষাতেই সকল কিছুর সঙ্গে তার আদান-প্রদান। শৈশবের সেই পুকুরঘাটের জল, আর এই বহমান জলের ভিতর সে যেন কোনো পার্থক্যই করতে পারল না। অথবা চোখের সামনে কোনো পার্থক্য থাকলেও মনের আয়নায় তাকে স্বীকার করতে চাইল না। জগতের একটি ভাষাকেই সে আয়ত্ত করেছে, আর তা হলো ভালোবাসা। পৃথিবীর সকল বস্তুতে এক আন্তরিক ভালোবাসা ছাড়া তার যেন যোগাযোগের কোনো ভাষাই নেই। ছোটবেলা থেকেই তার এই স্বভাবের জন্য সে ঠকে গেছে অবিরাম। প্রতিটি আপনজন তাকে তার এই ভালোবাসাপূর্ণ মনের জন্য দুর্বল ভেবেছে। সে চেয়েছিল ভালোবাসার একটি পলকের মধ্যে বাঁচার আস্বাদ। অথচ বিধিবাম। দুটি নরনারীর মধ্যে প্রাপ্তির যে অনন্ত বিস্তার, তা সে পায়নি। কিন্তু তাতে তার প্রাণ অবশ হলেও সে নিজের মধ্যে বাজিয়েছিল দাম্পত্যের এক একাকী সুর, ফাগুন বাতাসের মিঠে সুর। যার আস্বাদন ধীরে ধীরে অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল সংসারে, দাম্পত্যে আর সন্তানের ভিতর।
নিজেকে নিয়ে তার প্রশ্নগুলো কবেই যেন হারিয়ে গেছে। ছিল কি কোনো প্রশ্ন! নিজেকে নিয়ে! কিন্তু অনুভব ছিল। নিতান্তই এক জৈবিক বেঁচে থাকা যেন। মনের ক্ষুধাগুলো রয়ে গেছে কোন গভীরে! তবু এক জীবন ধারণ! ক্ষুধা, ক্ষুধা নিবৃত্তি, সন্তান ধারণ। এসব শারীরিক বেঁচে থাকার মধ্যে তার মনে পড়ত তার শৈশবের ছোট্ট বাড়িটির কথা। দোতলা বাড়ির পিছনে মস্ত পানা ভরা বিল। কোনো ঋতুতেই কেন যেন তাতে ফুল ফুটত না। কেন যে ফুল ফোটে না ওই পানা ভরা বিলে! মনে মনেই সে জানতে চায়! কচুরিপানা ফুলের হালকা বেগুনি রঙের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠত তার মন। ফুল ফোটার জন্য অপেক্ষা করে করে একদিন মুক্তিযুদ্ধ এলো। যুদ্ধের সময় তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে মাসুদ ভাইয়ের সঙ্গে হঠাৎ তার বিয়ে হয়ে গেল। যে বিয়ে নিয়ে তার মধ্যে কোনো স্বপ্নই ছিল না। তারপরেও পরিবারের সবাই যখন খুশি, তখন তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী তার চোখের তারায় গভীর কালো আর এক বিস্ময় নিয়ে সে রাতারাতি বিয়ের কনে হয়ে গেল।
তবু এতসবের পরেও বিয়ের পর তার হঠাৎ করে মনে পড়ল এই গ্রামেরই আসাদ নামের এক যুবক তাকে শবনম বলে ডাকত। তার নিজের তো একটা নাম ছিল! তবু শবনম! সে তখন কিশোরী। একদিন তার বাড়ির পিছনের বিলের পাশেই সেই যুবকটি তাকে দেখিয়েছিল চে গুয়েভারার একটি ফটোগ্রাফ। চে’র সবুজ পোশাকটার দিকে চেয়ে নাসিমা অবাক হয়ে বলেছিল, কচুরিপানার গায়ের রং! আসাদ উত্তরে বলেছিল, ‘অলিভ গ্রিন কালার। ওকে তো জঙ্গলে থাকতে হয়।’ নাসিমা কিছুই বোঝেনি এই কথার। শুধু এর উত্তরে আসাদের সঙ্গে চোখাচোখি হবার পর ফিক করে হেসে পালিয়েছিল। আসাদ ছিল ওর চাচাতো ভাইয়ের বন্ধু। ওরা দুজনেই পরিবারকে না জানিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে একদিন সেই বিলের পাশে আসাদকে আরেকদিন দেখেছিল নাসিমা। তখন তার সম্পূর্ণ অন্যরকম চেহারা। নাসিমা প্রথমটায় চিনতেই পারেনি। বিলের ভিতর নেমে পড়া হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সারিবদ্ধ কলাগাছের আড়ালে দাড়ি গোঁফে ভরে থাকা আসাদের মলিন মুখটা দেখা গেল। হঠাৎ তাকে নরম গলায় ডেকে বলল—
শবনম, এদিকে আসো।
আমার নাম কি শবনম!
এতদিন ধরে যে ডাকলাম—কোনোদিন তো আপত্তি করো নাই! আজ কী হলো!
না, কিছু না, এমনিই।
তোমার কোনোদিন জানতে ইচ্ছে হয় না তোমাকে কেন শবনম ডাকি!
না, হয় না। তবে এখন জানতে চাই, আপনি হঠাৎ এত অচেনা লাগছেন কেন! আমার সত্যিই ভয় লাগছে! আপনি কি এখন ফটোর সেই মানুষটার মতো জঙ্গলে থাকেন!
হ্যাঁ, শবনম! আজকাল জঙ্গলেই থাকি! এই যে দেখছ, আমার হাতে! এলএমজি, মানে শর্ট মেশিনগান! আজ আর বেশি কথা বলার সময় নাই। পাঞ্জাবি সৈন্যরা আমাদের বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার ট্রানজিস্টরটাও নিয়ে গেছে। থাকলে তোমাকে আমার এই স্মৃতিটুকু দিয়ে যেতাম। আমার পরিবারের সবাই ভারতে চলে গেছে। যদি কোনোদিন ফিরে আসি তবে আবার দেখা হবে। তোমার চাচাতো ভাই হারিস আমাদের গ্রুপেই আছে। ভালো আছে। তার পরিবারের সঙ্গে দেখা হলে বলো।
নাসিমা হঠাৎ এতগুলো কথার ভার একসঙ্গে নিতে না পেরে বলে উঠল, আপনি যেদিন আসবেন সেদিন ওই কচুরিপানায় বেগুনি ফুল ফুটবে।
আসাদ হাসতে হাসতে বলল, তাই যেন হয়! এই জন্যই তো তোমাকে আমি শবনম বলে ডাকি! তুমি ভোরের শিশিরের মতো সুন্দর! সব কিছতেই তুমি সুন্দর দেখো।
সেই যে আসাদের চলে যাওয়া দেখল সে বিলের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, যেমনি সে দেখেছিল হাঁসগুলো জলে নামছে, অথবা জঙ্গলের ভিতর দিয়েই সরসর শব্দে জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটা সাপ—, যেন সবকিছুই খুব স্বাভাবিক।—আর সে নীরবে দেখে গেছে—কোথাও টু শব্দটি না করে। যেন পৃথিবীর দিকে চোখ তুলে তাকালেও অন্যায় হবে, বা কখনো কাউকে কিছু প্রশ্ন করাটাও অন্যায়!
কারও কাছে কোনোদিন কোনো দাবি বা আবদার কিছুই ছিল না নাসিমার। যেহেতু সে পরিবারের বড় মেয়ে ছিল, আর মাসুদের সঙ্গে বিয়ে হবার পর হতে যাচ্ছিল সে বাড়ির বড় বউ—সে সময় নাসিমার মা তাকে শুধু একটা কথাই বলেছিল, ‘মনে রেখো, আমরা খুব পর্দা মেনে চলি। এ বাড়ির সম্মান রাখার দায়িত্ব তোমার! এ বাড়ি আর তোমার শ্বশুরবাড়ি দুইটাই খুব খানদানি পরিবার। পরিবারের সবার সঙ্গে মানিয়ে চলবা। যদি কোনোদিন এ বাড়িতে আবার একা ফিরে আসো, মনে রেখো, তুমি না তোমার লাশ আসবে। সংসার করতে গেলে অনেক ভালোমন্দ দেখবা। সবকিছুতে খুশি থাকারই চেষ্টা করবা।’ মায়ের সেই কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করেছে সে।
সে যেন ছিল সত্যিই এক শিশিরবিন্দু। তার না ছিল অতীত, না বর্তমান, না ভবিষ্যৎ! সে যেন কেবলই শিশিরবিন্দুর মতো প্রতিফলিত করত তার জীবনে একের পর এক ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো। মাসুদ দেখতে অসাধারণ সুন্দর, শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের সন্তান। সেরা ছাত্র। কাজেই মাসুদের বিষয়ে তার কিছুই বলার নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পেরেছিল, দাম্পত্য বিষয়টি সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। নাসিমা বিয়ের পরপরই সিদ্ধেশ্বরীতে তাদের নতুন বাড়িতে এসে উঠল। তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। নতুন শিশুর মতো একটি নতুন দেশ। মাসুদদের পুরনো বাড়িটা যুদ্ধের সময় গোপনে রাতারাতি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল মাসুদের বাবা। কারণ ওর ছোট ভাইয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টা ততদিনে জানাজানি হওয়াতে তাদের পরিবারের ওপর শান্তি কমিটির শ্যান দৃষ্টি ছিল।
শ্বশুর শাশুড়ির গভীর ভালোবাসা পেয়েছিল নাসিমা। তাই দাম্পত্যের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল জটিলতাহীন। সে ক্রমেই সংসারের সকল কাজে পারদর্শী হয়ে উঠল। সেখানে তার বন্ধুর মতোই তাকে আগলে রাখেন শাশুড়ি আম্মা। রান্নাবান্না ছাড়াও সে পারদর্শী হয়ে উঠল সকল রকম সূচিশিল্পে। যদিও কখনো কখনো মাসুদের অবহেলাটা সে টের পেত, কিন্তু বুঝতে পারত না। সম্ভবত, মাসুদের আম্মু সেটা টের পেত। আর তাই, একটু বেশিই যত্ন করত নাসিমার।
দেশ স্বাধীন হবার পর, মাসুদ আবার নতুন করে পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে থাকে। সে বরাবরই লেখাপড়ায় ভালো ছিল। কিন্তু মাঝখানের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর জীবনের নানা রকম বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কারণে তার পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ হয় না। সে আবার দ্বিতীয়বার মাস্টার্স পড়ার সুযোগ নেয় এবং তা দিল্লিতে।
নাসিমা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, এইসব কিছুই মাসুদের পূর্বপরিকল্পিত। পরিবারের চাপে সে বিয়ে করেছিল ঠিকই, কিন্তু তা ছিল এক নিগূঢ় ভ্রান্তি! প্রেমিকাকে না পাবার ব্যর্থতাকে সে চাপা দিতে চেয়েছিল একটু কৌশলী হয়ে। কিন্তু তাতে বিষাদের ভার কমেনি একটুকুও। পরবর্তীতে দিল্লিতে যাবার ভাবনাটাও সে সুকৌশলে প্রয়োগ করে, আর তাতে পরিবারের সকলেই সহমত প্রকাশ করে। মাসুদের ভদ্র চেহারা আর অতি ভদ্র ব্যবহার এতটাই সবাইকে মুগ্ধ করে রাখত যে কোনো প্রশ্ন করার স্পর্ধাই টেকে না। যথারীতি সে দিল্লি চলে গেল প্রায় তিন বছরের জন্য। এদিকে তখন নতুন একটি শিশুরাষ্ট্র নিয়ে সমস্ত দেশ স্বপ্ন দেখছে। মাসুদের পরিবার যেহেতু সর্বতোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি, তাই দিল্লি থেকে ফিরে এসেই মাসুদ পরীক্ষা দিয়ে মন্ত্রণালয়ে যোগ দিল।
অফিসার হিসাবে সে ছিল খুবই দক্ষ। কিন্তু সুখ বেশিদিন কপালে সইল না। সে কাজে যোগ দেবার কয়েক মাসের মধ্যেই পঁচাত্তরের ভয়াবহ আগস্ট এসে গেল। যা কিছু সম্ভাবনার বীজ, তা যেন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হলো। তবে চাকরিটা শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গিয়েছিল—কিন্তু দীর্ঘদিন ওএসডি থাকার পর তাকে পানিশমেন্ট ট্রান্সফার দেয়া হলো সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায়। কর্মসূত্রে মাসুদ সেখানে চলে গেলেও নাসিমার যাওয়া হলো না। পরিবারটির ওপর দিয়ে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে, রাজনৈতিক কারণে। নাসিমা তখন অন্তঃস্বত্ত্বা। অনেক অমঙ্গল আর অস্থিরতার মধ্যেও নাসিমার আগত সন্তানকে ঘিরে তার কাছেই পরিবারের সবার আকাঙ্ক্ষা। রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরাট একটি অশুভ প্রভাব তখন ঝাঁপিয়ে আছে পরিবারটির ওপর। সে সময় ধৈর্য ছাড়া পরিস্থিতি সামলানোর আর কোনো উপায় নেই। নাসিমা নীরবে সহ্য করে গেল, যাবতীয় উত্থানপতন। মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করার যে প্রতিভা থাকা দরকার—সেটা নাসিমা রপ্ত করেছিল।
মাসুদের সন্তান সে পেটে ধারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু তার মনে হতো মাসুদের সঙ্গে যেন তার কোনোদিন দেখাই হয়নি। সবই যেন পরিবারের নির্দেশে তৈরি হওয়া, তার জীবনের একটি ঘটনা মাত্র। যা সে কোনোদিন গভীরভাবে অনুভব করার সুযোগই পায়নি। বরং সামান্য অবসরেও তার শুধুই মনে পড়ত আসাদের কথা। আসাদ! সন্তান ধারণের পুরোটা সময় সে সময়ে-অসময়ে, অথবা সুয়েটার বুনতে বুনতে এক অদ্ভুত কারণেই মনে পড়ত তার আসাদের সেই চোখ, যা তার মুখের ওপর ঝুঁকে ছিল বিদায় বেলায়। ততদিনে সে শুনেছে, মুক্তিযুদ্ধে নিহত অসংখ্য মৃত্যুর কথা। যদিও সেই সব শোক সরাসরি তাকে আক্রান্ত করেনি, কারণ তার চাচাতো ভাইটি ফিরে এসেছিল যুদ্ধ শেষে। পরে তার কাছ থেকেই সে শুনেছিল আসাদের নিরুদ্দেশ হবার খবর। সে এও শুনেছিল, আসাদ পরে যোগ দিয়েছিল সিরাজ সিকদারের বাহিনীতে। তারপর সে অনেকদিন গোপনে খবর নিয়েছিল তার বাড়ির পিছনের সেই বিলে কচুরিপানার ফুল ফুটেছিল কি না! এক অনির্দেশ্য যোগসূত্র সে নিজের মনেই আবিষ্কার করতে চাইল আসাদের ফিরে আসা, তার গর্ভের সন্তান, তার ভালো লাগার মুহূর্ত আর কচুরিপানার বেগুনি ফুল ফোটার অপেক্ষার মধ্যে। এসব কারণের কোনো যোগসূত্রই সে কোনোদিন আবিষ্কার করতে পারেনি। পৃথিবী কেন এত জটিল, মানুষেরা কেনই বা জীবনকে জটিল করতে করতে নানা রকম সমস্যার দিকে এগিয়ে দেয়, সে সেটা বুঝতেই পারত না। তার নিজস্ব শুদ্ধ মনের আলোতে নিমিষেই ধরা পড়ে যেত যাবতীয় অসংগতি। বিয়ের রাত থেকেই সে বুঝতে পেরেছিল, মাসুদ তাকে ভালোবাসে না। বয়সে সে ছিল মাসুদের চেয়ে প্রায় দশ বছরের ছোট, তবুও সে তার নিজস্ব সত্য অনুভবে বুঝে নিয়েছিল কঠিন সত্য। তবু সে মেনে নিয়েছিল, মায়ের সেই কথাগুলো। বাড়তি যেটুকু পেয়েছিল, তা হচ্ছে শাশুড়ি মায়ের গভীর ভালোবাসা। তাই সে ভালোবাসার পরিবেশে নিঃশ্বাস নিতে তার কষ্ট হয়নি। সুস্থ সন্তানের জন্ম হয়েছিল তার গর্ভে। আর নতুন ছেলে শিশুটিকে নিয়ে পুরো পরিবারের সে কী আনন্দ! আর উচ্ছ্বাস! বছর ঘুরতেই ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিল সে—আর অবাক বিস্ময়ে দেখল তাদের এত বছরের বিলটি ভরে উঠেছে কচুরিপানার বেগুনি ফুলে। সত্যি! সত্যিই স্বপ্নের সেই বেগুনি ফুল! এক প্রাকৃতিক সংকেতে সে বুঝতে পারত, আসাদ যেখানেই থাকুক সে ভালো আছে। যদিও আসাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার একটা ছোট্ট আকুতি মনের মধ্যে ছিল, কিন্তু কখনো দেখা হয়নি।
কিছুদিন পর সে ঠিক কোনো না কোনোভাবে খবর পেত, আসাদ সর্বহারা পার্টিতে কোন অবস্থায় আছে। ব্যাপারটি অলৌকিক হলেও সে ঠিক ঠিক সংকেত পেয়ে যেত, কারও না কারও মাধ্যমে। কখনো কোনো আত্মীয়ের মাধ্যমে, কখনো চাচাতো ভাইয়ের কাছে, কখনো পত্রিকায়।
ছেলে কোলে নিয়ে সে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবত, আসাদের কথা। নিস্তব্ধ দুপুরে ছিটেফোঁটা তন্দ্রার ভিতর কে যেন তাকে ডাকত—শবনম! তার শুদ্ধজীবন চর্চা, প্রকৃতি আর প্রেম মিলিয়ে এক অপূর্ব অনুভবের বার্তা কে যেন পৌঁছে দিত মনের দরজায়! সে তেমন উচ্চশিক্ষিত ছিল না, ছেলে হবার পর ধীরে ধীরে গ্র্যাজুয়েশন করেছিল শাশুড়ির অনুপ্রেরণায়—কিন্তু প্রকৃতির তীক্ষ্ন সংকেতগুলো তাকে এতকাল ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল। আসাদের প্রতি এই তীক্ষ্ন টান যেন গোপনে ঈশ্বরের প্রতি তীক্ষ্ন টানের মতোই তার হৃদয়ে অনুভূত হতো।
জলের সরলতার দিকে তাকিয়ে সে জলের ঘূর্ণিগুলো নিয়ে ভাবতে থাকে। এমন ঘূর্ণি তার জীবনে প্রথমবার এসেছিল মায়ের কথায়। আহা! তখন সে কত ছোট! কথাগুলোর বোঝা মেনে নেবার বয়সই তার হয়নি। ‘জীবনে ভালোমন্দ যা আসে পরিবারের স্বার্থে সব মেনে নিবা’—তাই প্রথম যখন সে তার উপলব্ধিতে টের পেল মাসুদের সঙ্গে সম্পর্কটা শিকড়হীন—তখনকার হাহাকারের কথা সে কাউকে বলতে পারেনি। সে বুঝতে পেরেছিল, তার সঙ্গে তার জন্মদাত্রী মায়ের সম্পর্কটাও কোনো এক স্বার্থের দিক থেকেই বন্দি। সেটা ছিল পরিবারের সম্মান রক্ষার দিক থেকে। তার মরা-বাঁচায় পরিবারের কিছুই যায় আসে না।
তার জীবনে প্রবল ঘূর্ণিটা এসেছিল তখন, যখন সে তার চাচাতো ভাইয়ের কাছে মাসুদ সম্পর্কে সবই জেনেছিল। আহা! ব্যথায় সে নীল হয়ে গিয়েছিল! দিল্লিতে অবস্থানের সময় মাসুদ মাধবীর সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছিল। বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়, কারণ মাধবীর দেবর ছিল সেসময় নকশালের সমর্থক। যে কোনোভাবে পুলিশের কাছে সব রিপোর্ট চলে যায়, আর পরবর্তীতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হবার মতো এই ঘটনাটিও পুলিশের নজরে আসে। আসাদ তখন সর্বহারা পার্টিতে, কোনো এক বর্ডারের দিকে লুকিয়ে থাকত। নকশালদের সঙ্গে তার গোপনে যোগাযোগ ছিল, আর তার ভিত্তিতেই নাসিমার চাচাতো ভাই এই খবরটি পেয়েছিল। যদিও চাচাতো ভাইয়ের ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা কথাটির সত্যতা সে তখন উদ্ঘাটন করতে চায়নি, বা বিশ্বাসও করতে চায়নি কিন্তু কিছুদিন পর অতর্কিতভাবেই মাসুদের স্যুটকেস গোছানোর সময় ভিতর থেকে মাধবীর লেখা সব চিঠিগুলো তার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। চিঠিতে সবই লেখা ছিল—কবে-কোথায়-কখন—?
হিরন পয়েন্টে এসে আজকের বাতাসের গতি, আকাশের রং, জলের উচ্ছ্বাসের দিকে চেয়ে মুগ্ধ হলেও, সেদিনের সেই অনিবার্য প্রত্যাখানের দাউ দাউ আগুন যেন সে আজও জলের ভিতর ছড়িয়ে যেতে দেখল। যেন আজও তার আঁচে পুড়ে যাচ্ছে সে। সে যে এখনও নানাভাবে প্রত্যাখ্যাত সেটা সে জানে। সে টের পায় দিলরুবার সঙ্গে মাসুদের সর্ম্পকের গভীরতা, ওঠানামা—যেখানে সে কেবলমাত্র একজন দর্শকমাত্র। নীরব দর্শক! বারবার উষ্ঠা খেয়ে মাটিতে পড়ে হেসে ওঠার অভিনয় করতে করতে আজকাল সে অবলীলায় কেবল হাসতেই পারে। অত হাসির আড়ালে শুকিয়ে গেছে তার অশ্রু। রয়ে গেছে আগুনের দাউ দাউ।
‘যে আগুন কুণ্ডলী পাকিয়ে ভিতরে ভিতরে গ্রাস করেছিল আমাকে, আর আমি দেখলাম পুড়ে যাচ্ছে আমার ঘর। দাউ দাউ আগুনে পুড়ে পড়ে থাকল একরাশ ছাই। এক গভীর শূন্যতা যেন ছাইয়ের মতো পলকা আর উজ্জ্বল কিন্তু তা জ্বলে উঠে আমায় পথ দেখিয়েছিল সেদিন। সেই আলোতেই আমার একার সংসার হলো সন্তানকে বুকে করে। দূরের ওই শান্ত জলের মতো আমি ছিলাম সংসারের সঙ্গে মেশে, আমার ভিতরের ঘূর্ণি কেউ কখনো টেরই পেত না।
মাসুদ অনেকবার রাজনৈতিক কারণে চাকরির সমস্যায় পড়েছে, অনেকবার তার অবস্থার উন্নতিও হয়েছে—এই দুই ধরনের পরিবেশেই আমি ছিলাম একই রকম সংসারী ও সেবাকারী। কিন্তু একবারই ভেঙে পড়েছিলাম, যখন সিয়ামের বিয়েটা নিয়ে মাসুদ আপত্তি করেছিল। সত্যিই আমার জীবনে যেন সেদিন উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটাও নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে শাশুড়িমায়ের মৃত্যু আমাকে একেবারেই একা করে দিয়েছিল। সেসময় একটা মাইন্ড স্ট্রোক হয়েছিল, তবু বেঁচে উঠলাম। এখন চাই আরেকটি মৃত্যুর আয়োজন, নিবিড়, নিঃশব্দে!’
ছয়.
সোনিয়া সবার মধ্যে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সুযোগ পেলেই একা একা তার ক্যামেরায় তুলে নিচ্ছিল চারপাশের জল আর জঙ্গলের রহস্যময় দৃশ্যগুলো। গতকাল বিকেলে কেবিনের বারান্দা থেকে তোলা ছবিগুলো তার ক্যানন সেভেনটি ক্যামেরায় এক মোহনীয় রূপে ধরা দিয়েছে। রাতে লঞ্চটা যখন থেমেছিল তখন কোন দূর থেকে সমস্বরে ঝিঁঝির ডাক তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল জঙ্গলের নীরবতাকে। আবার একটু পরেই কেবিনে শুয়ে স্পষ্ট কানে আসছিল উড়ুক্ক মাছ লাফানোর শব্দ। পরদিন ভোরের কুয়াশায় সূর্যের মুখ দেখতে একটু দেরি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভোরবেলার অজস্র পাখিরা লঞ্চের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নিজেদের কলকাকলিতে মুখর ছিল।
সকালের জলখাবার শেষ হলে পরে, হিরন পয়েন্টের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের ফলক বরাবর খালের উলটোদিকে প্রায় এক কিলোমিটারের পথ পেরিয়ে কয়েকজনের একটি দল এগিয়ে গেল কেওড়াশুটির বনের দিকে। সোনিয়াও সেই দলটির সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। দ্রুত পরে নিয়েছিল তার ক্যাডস, জিনস আর টি-শার্ট। ওই দলটিতে একটু অল্পবয়স্করা ছিল। কারণ, অনেকটা পথ হাঁটার ঝুঁকি বয়স্করা নিতে চাইছিল না। শ্বাসমূলের ওপর দিয়ে পায়ে চলার পথ তৈরি করে দিয়েছে বনবিভাগ। সোনিয়া লিড দিতে দিতে হেঁটেছিল সেই দলের সঙ্গে। গল্পে-আড্ডায় সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছিল, সেই সময়টায়। এমনিতে সে লাজুক ও যেচে কথা বলতে নারাজ। কিন্তু এখানকার সতেজ প্রকৃতি তাকে কিছুটা বদলে দিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। সবাইকে তার ব্যাগে রাখা ড্রাই ফ্রুট দিচ্ছিল সে হেঁটে যেতে যেতে। আর চেষ্টা করছিল তার ক্যামেরায় যতটা সম্ভব বাঁদর, বুনো কাক, মায়াবী হরিণ, গুইসাপ, মাছরাঙা আর ঝাঁক বেঁধে গাছের ওপর বসে থাকা বকদের অসাধারণ কিছু ছবি তুলতে।
সোনিয়া আজকাল খুব ভালো করেই শিখে নিয়েছে গ্রাফিক্স ডিজাইনিংটা। আর ছবি তোলার শখ তার ছোটবেলা থেকেই। এখন গ্রাফিক্সের বিভিন্ন সফটওয়ারে সে ক্যামেরার ছবিগুলোর নতুন ডাইম্যানশন আনার চেষ্টা করে, নতুন নতুন ক্রিয়েটিভ ওয়ার্কের ভিতর দিয়ে। গ্রাফিক্সের কাজটি সে দারুণ ভালোবেসে করে।
আসলে সে হতে চেয়েছিল ডাক্তার। সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল! কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জীবনের ইকোয়েশনটা সম্পূর্ণই বদলে গেল। প্রথম বর্ষে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়বার সময়ই হঠাৎ করে একদিনের পারিবারিক সিদ্ধান্তে তার বিয়ে হয়ে যায়। কারণটা ছিল, ছেলে ডাক্তার আর দেখতে অসাধারণ সুন্দর। সুন্দর ছেলে ছাড়া আমি কখনো বিয়ে করব না! হাসতে হাসতে একমাত্র ভাবিকে প্রায়ই বলত সে এই কথাটি! এই সব দুষ্টুমিই শেষ পর্যন্ত জীবনের গতিকে অন্যদিকে নিয়ে গেল! হয়তো বা!
সোনিয়ার পারিবারিক স্ট্যাটাসটা অনেক ভালো। বড় ভাই আর ভাবি দুজনেই আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। সোনিয়ার বাবা ও মা দুজনেই ছিলেন সরকারি প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবী। ডাক্তার ছেলেটির প্রস্তাব এনেছিল সোনিয়ার ভাই ও ভাবি। ভাবির ধারণা ছিল, ছেলেটি যেহেতু দেখতে অসাধারণ সুন্দর আর তা ছাড়া সে দেশের বাইরে কোর্স করতে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে সোনিয়ারও একই প্রফেশনের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। সোনিয়ার জন্য ভালো একটা পাত্র খুঁজে পেতে সে সচেষ্ট ছিল। সোনিয়া নিজেও দেখতে খুবই সুন্দর, ইরানি মেয়েদের মতো। সোনিয়ারও ভালো লেগেছিল ছেলেটিকে। কিন্তু ভালো করে কথাবার্তা হবার আগেই ঘরোয়া পরিবেশে বিয়েটা রেজিস্ট্রি হয়ে গেল। আর তার দুদিন পর খুব তড়িঘড়ি করে একটি হোটেল ভাড়া করে বিয়ের বাসর ও কিছু পরিচিতজন নিয়ে একটি চমৎকার আয়োজনের ব্যবস্থা করল মেয়ের পক্ষ থেকে। ছেলের বাবা নেই, মা আর দুই বোনের পরিবারের লোকেরা উপস্থিত হয়েছিল সেই বিয়েতে। যেহেতু ছেলে এক সপ্তাহ পর দেশের বাইরে চলে যাবে, তাই সবাইকে নিয়ে এই উদযাপন ছিল সবার কাছেই কাম্য। ঠিকঠাকই হলো সব। শুধু বাসররাত্রিটাই কালরাত্রিতে পরিণত হলো। হোটেলের দুটি রুম পাশাপাশি নেয়া হয়েছিল। একটি ছিল ভাই-ভাবির জন্য, অন্যটি ছিল নতুন বর-বঁধুর। যতই রাত বাড়তে থাকে, বরের মুখে কোনো কথা নেই। সোনিয়া অবাক হয়ে ভাবছিল, সে কী বলবে! কী বলা উচিত! যেহেতু উনি তার চেয়ে অনেক সিনিয়র, কীভাবে কথা বলা শুরু করবে! এই লোকটিই তার জীবনে প্রথম পুরুষ। মনে মনে সে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেয় যে এত সুন্দর ও গুণী একজন মানুষের সঙ্গে তার জীবন শুরু হতে যাচ্ছে!
কিন্তু লোকটি মধ্যরাত পর্যন্ত তার সঙ্গে কোনো কথাই বলল না। হোটেলরুমের টিভি চালিয়ে ওর দিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত না করে শুধুমাত্র টিভিই দেখছিল। রাত গভীর হতে হতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল সোনিয়া। তারপর হঠাৎ মধ্যরাতে সে নিজেকে আবিষ্কার করল আধো আলো অন্ধকার ঘরে এক হিংস্র হায়েনা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। লোকটি তাকে যথারীতি ধর্ষণ করেছিল মুখচাপা দিয়ে। আর ভয়ে চিৎকার করেছিল সোনিয়া। সম্ভবত ওর ভাই ও ভাবি শুনেছিল সেই চিৎকার পাশের রুম থেকে। আর তাৎক্ষণিকভাবে ওর ভাবি এসে নক করেছিল দরজায়। সোনিয়া ভেবে পাচ্ছিল না কী বলা উচিত! তবু কিছুটা কমনসেন্স থেকেই সে চেপে গিয়েছিল, আর বলেছিল, ‘কিছু না ভাবি! বাথরুমে পড়ে গেছি!’
পরদিন ওর মা-বাবার সামনে যাওয়ার অবস্থাটা ছিল রীতিমতো ভয়ংকর! সে হাঁটতেই পারছিল না। কোনো রকমে বাড়ি ফিরে সে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। ওর মা ব্যাপারটি নিমিষেই বুঝতে পেরে বলেছিল, ‘আমরা বোধহয় কোথাও ভুল করে ফেলেছি। বিয়েটা ভালো হয়নি।’ ভালো যে হয়নি সেটা তখনই বোঝা গিয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল তাকে। গাইনির ডাক্তার তার হাজব্যান্ডকে বলেছিল, ‘আপনি যে একজন ডাক্তার, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে! কী করে সম্ভব!’
ডিভোর্সের ফাইলটা তার দুদিন পরেই খোলা হয়। কারণ ততদিনে এই লোকটির অতীত জীবনের নানা কাহিনি বের হয়ে আসে! সে মেডিকেলে পড়ার সময় যে মেয়েটিকে ভালোবাসত সে ইউকেতে চলে যায়। সে অনেক চেষ্টা করেছিল মেয়েটিকে ডিভোর্স করে দেশে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু মেয়েটি আসতে চায়নি। মেয়েটি চেয়েছে, ছেলেটি ইউকেতে চলে যাক। কিন্তু এদিকে পরিবারের কেউ রাজি নয়, বিয়ে না করে বিদেশে যাবার ব্যাপারে। শেষ পর্যন্ত অসমর্থ হয়ে সে পরিবারের কথা রাখতে এই বিয়েটা করে। এর একটি কারণ ছিল, সেই মেয়েটিকে বোঝানো যে সে একজন সুন্দরী, শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেছে—অর্থাৎ সেই মেয়েটি যেন ঈর্ষার জ্বলনে অতি শীঘ্রই ডিভোর্স দিয়ে তার কাছে ফিরে আসে। আরেকটি কারণ হলো, পরিবারকে হাতে রাখা—যে তাদের কথামতো সে বিয়ে করেছে, এবার সে দেশের বাইরে যেতে পারবে পারিবারিক সমর্থনে। আর প্রথম রাতেই সোনিয়াকে সে বোঝাতে চেয়েছিল, যদি এই সম্পর্কটিতে সোনিয়া পরিবারের চাপে পড়ে থেকেও যায়, সে কোনোদিনই সোনিয়াকে ভালোবাসবে না। আসলে লোকটি ছিল, মানুষরূপী পশু। বিবেকবোধের কিছুই তার অবশিষ্ট ছিল না।
এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থাটি কেন তার জীবনেই? কেন সে এভাবে ব্যবহৃত হলো? এর কোনো হিসাব মেলাতে না পেরে সোনিয়া ক্রমেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল। বিষয়গুলো জানাজানি হয়ে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ল বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয় মহলে। ক্রমাগত ট্রমাটাইজড হতে হতে সে হয়ে পড়ল প্রচণ্ড ডিপ্রেশনের শিকার। ঠিকঠাক মনোযোগ না দিতে পারার কারণে মেডিকেল কলেজের পড়াটায় সে এগোতেই পারল না। আত্মবিশ্বাসের শক্তিটা ক্রমেই লোপ পেয়ে গেল। তারপর দুবছরের বিরতি।
বাবা-মা বলল, কিছু একটা তো করতে হবে! কিন্তু কী করা! চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে সবকিছু! কিন্তু মেয়ের মুখ চেয়ে কিছু বলার সাহস হয় না। সেই সময় পাড়ার এক ছেলে তাদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলো আচমকা একদিন। সত্যিই কি আচানক! ছেলেটির একটি পোষা কুকুর ছিল। নাম—পুটুস। জার্মান শেফার্ডস। গেট খোলা দেখে কুকুরটি ঢুকে গিয়েছিল সোনিয়াদের বাড়িতে। কুকুরটি ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে একদম ঢুকে পড়েছিল সোনিয়ার বেডরুমে। কী করে যে এলো! সোনিয়া তাকে দেখে ভয় পাওয়াতে কুকুরটি খুব অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে, তারপর আস্তে আস্তে ঝুঁকে সোনিয়ার পায়ের কাছে আভূমি লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পড়ল। বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুত! আর অবিশ্বাস্য! সেই যে সোনিয়ার পায়ের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে—অনেকক্ষণ—নট নড়ন-চড়ন। বিস্ময়ে জগতের একটা নতুন রূপ যেন ধরা দিল নিমিষেই। এই অদ্ভুত বিষয়টা সোনিয়ার মনোজগতের ওপর এতদিনের ক্লান্তির ছাপকে যেন এক মুহূর্তেই উড়িয়ে দিতে চাইল। দীর্ঘদিন পর কুকুরটির সারা গায়ে আদর বুলিয়ে দিয়ে তার মনে হলো, মানুষের চেয়ে কুকুর সত্যিই ভালো। পৃথিবী এখনও ভালোবাসারই জায়গা! সত্যিই!—এই বোধটি যেন আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল দুটি প্রাণের স্পর্শে। এদিকে সারা বাড়ি তুলকালাম করে ছেলেটি খুঁজে বেড়াচ্ছে পুটুসকে। তারপর একসময় ঠিকঠিক খুঁজে পেল সোনিয়ার ঘরে। ঘটনাটি সোনিয়ার বাবা-মাকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। তারা খোঁজ-খবর করল ছেলেটির বিষয়ে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, তাদেরই প্রতিবেশী। ভদ্র পরিবারের এই একটিই ছেলে। মৃদুল—সুশ্রী, মিষ্টি ব্যবহার, গায়ের রং কালো। ছেলেটি সম্প্রতি মাস্টার্স শেষ করেছে ইংরেজি সাহিত্যে, পাশাপাশি গ্রাফিক্সের কাজ করতে ভালোবাসে। সোনিয়ার বাবা-মা অনেকটা যেচেই পরিচিত হলো ওই পরিবারটির সঙ্গে। মেয়েকে সুস্থ করে তোলার জন্য এর আর কোনো বিকল্প ছিল না।
সোনিয়া অসামাজিক জীবনযাপন করতে করতে একসময় ভুলেই গেছে কী করে কথা শুরু করতে হয়! প্রাণ খুলে হাসতে হয়! সোনিয়ার মায়ের অনুরোধেই ছেলেটি পরে নিয়মিত আসতে শুরু করে ওদের বাসায়। সঙ্গে পুটুস। ল্যাজ নেড়ে নেড়ে আহ্লাদে ভরিয়ে দেয় সোনিয়াকে। আর নরম চোখ দুটি তুলে এমনভাবে তাকায়!
তাই দীর্ঘদিনের দুঃসময়ের পর আবার সুসময়ও আসে। ছেলেটি আর পুটুসের সান্নিধ্য একসময় সোনিয়ার মধ্যে নিয়ে এলো এক নতুন রূপান্তর। আস্তে আস্তে মানসিক শক্তি ফিরে পেল সে। ছেলেটির কাছেই শিখতে লাগল গ্রাফিক্স ডিজাইনিং। পুটুসের সাদা সাদা নরম পশমে আদর করতে করতে সোনিয়া একসময় খুঁজে পেল ভালোবাসার স্বর। ছাদে বেড়াতে গিয়ে বিকেলের লাল মেঘে দেখল আলোছায়ার খেলা। কিন্তু পুরুষকে বিশ্বাস করার শক্তিটা যেন সে হারিয়েই ফেলেছিল। আর বিবাহ প্রথাটিই তার কাছে হয়ে উঠল নৈরাশ্যের এক বিকট কালো অন্ধকার। তার বরং ভালো লাগে একটি নিরেট বন্ধুত্ব! তাদের দুজনের মাঝে বসে পুটুস আদর মেখে নেয় তার গায়ে। সেই আদর ছড়িয়ে যেতে থাকে সোনিয়া ও ছেলেটিকে ঘিরে। ছেলেটি মনে মনে বিবাহ চাইলেও, বন্ধুত্বের বাইরে সে পা ফেলেনি।
তারপরে মাঝখানের সময়গুলো কেটে যায় অনেক দ্রুত। কত দ্রুত কেটে গেল পাঁচটি বছর! পাঁচ বছরের ভিতর ছেলেটির পরামর্শেই সে ইংরেজিতে মাস্টার্স করে। গ্রাফিক্সের কাজটিও সে ভালোবেসেই শিখে নেয়। পুটুস এখন বুড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু তার স্নিগ্ধ সাহচর্য দিয়ে ঘটিয়ে দিয়েছে মানুষ আর জীবজগতের সম্পর্কের মিশেল।
ওরা দুজনেই এখন ভালো উপার্জন করে। কিন্তু সোনিয়ার বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটা কিছুটা অসংগত মনে হলেও, একসময় ছেলেটিও মেনে নেয়, সোনিয়ার এই দৃঢ়তা। বিয়ে হয়নি তাদের, কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব আজও অটুট!
এখানে বেড়াতে আসার সময় সোনিয়া তার বন্ধুটিকে আসতে বলেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ছেলেটির অফিসে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যাওয়াতে সে এই ভ্রমণটিতে যোগ দিতে পারেনি। টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছিল, সেইভাবেই। তবে এখানে এসে সোনিয়া কেবলই তার কথা ভাবছে। ইস্! মৃদুল এখন থাকলে বেশ হতো! এখানকার আলো, হাওয়া, কুয়াশা, ফুল, জল সবকিছুই এত অপরূপ ভাষায় তাকে আনন্দ দিচ্ছে যে সে কেবলই থেকে থেকে তার বন্ধুটির কথাই ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। মৃদুল! দেখ জলের ভিতর ডলফিন! আর ওই যে দূরে কুমির—পিঠে রোদ মাখছে! নেটওয়ার্ক এখানে পাওয়া যাচ্ছে না। যদি খানিকটা পাওয়া যায় সোনিয়া বার র চেষ্টায় ছিল, তার কাছে পৌঁছতে। এখানকার অজস্র গল্প জমা হচ্ছিল তার ঝুড়িতে। জঙ্গল দেখতে দেখতে, সুগন্ধি চালের ভাত, চিংড়ির মালাইকারি, ভেটকি, আমোদি মাছের ফ্রাই এসব খাবারের এক রাজকীয় অনুভূতি তাকে তার বন্ধুর কাছ থেকে বিরহ আর ব্যবধানের সত্যতাটিকেও স্পষ্ট করে তুলল।
লঞ্চের বাবুর্চিটি এই অঞ্চলের স্থানীয় লোক। সোনিয়া তার কাছ থেকে সময়ে সময়ে শুনে নিয়েছিল নানা গল্প। আইলার হামলা, লঞ্চে ডাকাতি, মধু ভাঙে কেমন করে, বাঘ আর কুমিরের শিকার ধরার কাহিনি, বনবিবির গল্প। কত রকমের গাছের নাম—হেতাল, গরান, গোলপাতা, গেওয়া—আর ছুরির মতো শ্বাসমূল তো রয়েছে নদীর দুধারে।
এসব দেখতে দেখতে সোনিয়ার মনে পড়ে জিম করবেটের গল্প! ছোটবেলায় কী রোমাঞ্চকর ছিল সেই সব কাহিনি!
মৃদুল সঙ্গে থাকলে কত কী গল্প করা যেত! নিজেকে কেমন যেন অসম্পূর্ণ মনে হলো তার। এই অনুভবটা এখানে একা না এলে হয়তো হতোই না। এখানে নেটওয়ার্ক নেই। বিপজ্জনক কিছু ঘটলে তার বন্ধুটি কখনো জানবে না এই মুহূর্তে তাকে ছুঁয়ে থাকবার আর্তির কথা।
সোনিয়ার মনে পড়ছে, অনেক বছর আগে, সে যখন অসুস্থ ছিল, মৃদুল একদিন তাকে বলেছিল, ‘তুমি যেন ঠিক এলিজাবেথের মতো। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং যার প্রেমে পাগল হয়েছিল। এলিজাবেথ রুদ্ধ ঘরে রাতদিন নিঃসঙ্গ আর অসুস্থ থাকত। কবির বই আর চিঠি ছিল তার একমাত্র সঙ্গী। এলিজাবেথের মা অসুস্থ মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে রাজি ছিলেন না। একদিন দুজনে পালিয়ে চলে গেলেন ইতালি। সেখানেই জীবনের বেশির ভাগ সময় ওরা কাটিয়েছিল। সুখে-দুখে-আনন্দে—। ব্রাউনিং ও এলিজাবেথ—দুজনের কাছেই জীবন ছিল ভালোবাসার, তপস্যার, সাধনার।’ হয়তো জীবনের গভীরতার দিকটা সোনিয়াকে বুঝাতে চেয়েছিল সে! সবকিছুর ওপরেই জীবন! তাই কি!
এই গল্পটির কিছুদিন পর সোনিয়াও একটি গল্প মৃদুলকে শুনিয়েছিল। রুশোর স্বীকারোক্তি বই থেকে গল্পটি পড়েছিল সে, আর ভীষণভাবে দাগ কেটে গিয়েছিল মনে। ‘রুশো একবার দারুণভাবে বিমোহিত হয়ে পড়েছিল জুলিয়েত্তা নামে ইতালির এক দেহপোজীবিনীকে দেখে। মেয়েটির ঘরে ঢুকেই রুশোর মনে হয়েছিল, সেটি যেন ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের পীঠস্থান। মেয়েটির সজীব ত্বক, নিখুঁত সুঠাম শরীর আর মধুর ব্যবহারে সে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে পড়েছিল। তারপর এক ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে মেয়েটির বুকে ডুবে যেতে যেতে রুশো স্তম্ভিত হয়ে দেখেছিল, তার শুধু একটিই স্তন! এই অপ্রত্যাশিত বিষয়টি তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল আর তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তা মেয়েটির কাছে লুকাতে চাননি। মেয়েটিও তা বুঝে ফেলে, আর রুশোকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। এই ঘটনাটি রুশো সারা জীবনেও ভুলতে পারেননি।’ মৃদুল চুপ করে ছিল, গল্পটি শোনার পর। কেন এই গল্পটিই সে বলেছিল! মৃদুলকে!
সোনিয়ার মুখে এই গল্পটি শোনার পর ছেলেটি আর কখনো তার দুর্বলতাকে প্রকাশ করেনি। তার মনে হয়েছে, সোনিয়ার বন্ধুত্বের জায়গাটি অনেক বেশি স্বচ্ছ। বিয়ের দ্বারা তাকে জোর করে অধিকার করতে গেলে জটিল মনস্তাত্ত্বিক সংকট আসতে পারে। আর এই সব ব্যাপার সে হয়তো এড়াতে পারবে, কিন্তু সোনিয়ার পক্ষে এই সংকট থেকে বের হওয়া হয়তো সম্ভব হবে না।
আজ এখানে জঙ্গলের নিস্তব্ধতার ভিতর সোনিয়া তার এক নিজস্ব পুনরুদ্ধারের মাঝে তার নিজেকে দেখতে পেল স্পষ্টভাবে। শহরের কোলাহলময় কাজের জীবন তাকে কতকিছুই না ভুলিয়ে দেয়। এখানে আলো-অন্ধকারে, জলে-জঙ্গলে, এক অলৌকিক বোধের ভিতর সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। এবার ঢাকা গিয়েই সে ছেলেটিকে বলবে বিয়ে করে ফেলতে। আর কতকাল অপেক্ষা করবে সে! পাঁচ বছর শেষ হয়ে গেল! না, আর কিছুতেই তাকে দেরি করতে দেয়া যায় না। অনেক অন্যায় হয়ে গেছে। সত্যিই! মৃদুল খুব ভালো ছেলে। তাকে এভাবে সে কষ্ট দিতে পারে না।
পৃথিবীকে সে যেভাবে বুঝেছে, সেখানে বিষাদের রংটা গভীর কালো। তবু সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে যে সে ওই কালো রং থেকে উত্তরণের কিছুটা উপায় সে পেয়েছে বন্ধুটির হাত ধরে। যদি সেদিন সে মৃদুলের দেখা না পেত! তবে কি আজও পড়ে থাকত! একলা অন্ধকারে! অথবা অ্যাসাইলামে! আহা! আরও কত অজস্র মেয়ে আছে, যারা এভাবেই অন্যায়ের শিকার হয়ে কালো ব্ল্যাকহোলের ভিতর ডুবে যায়। সেই ট্রমার ভিতর থেকে বের হবার কোনো পথই থাকে না তাদের! জলের পরিসীমা ছাড়িয়ে দূরস্থ বিস্তৃত জঙ্গলের সবুজের দিকে চেয়ে সে নতুন এক ইউটিউব চ্যানেলের স্বপ্ন দেখে যেখানে ট্রমাক্রান্ত মেয়েদের একটি প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।
সাত.
জলস্রোত, কুয়াশা, শিশির, আলো-আঁধার, রাতের গভীরে জেগে ওঠা জল ও জঙ্গলের অপরূপ শোভা সব মিলিয়ে মাসুদের কাছে আজকের রাতটা খুবই আকর্ষণীয়। আগামীকাল ভোরেই ওরা ঢাকার পথে রওনা হবে। গত পাঁচ দিনে কত জায়গাই না ঘুরে দেখা হলো। আন্ধারমানিক, শরনখোলা, কচিখালি অভয়ারণ্য, জামতলা কটকা বিচ। গত কয়েক রাতেই হয়েছিল দারুণ আড্ডা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর হাউজি খেলা। আজ ঠাণ্ডা বাতাস বইছে বেশ! কাল ভোরে যাবার প্রস্তুতির কারণে আজ সবাই নীরব। গত কয়েক রাত্রিতে ঘুম হয়নি, তাই অনেকেই নিজ নিজ কেবিনে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। মাসুদের গুছিয়ে আনা চিন্তাগুলো আজ যেন বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে চাইছে। বিছানায় অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পর ঘুমের ভান করে পড়ে থাকা নাসিমার শরীরটা তার ভিতর একটা ঘৃণার উদ্রেক করে। এই ঘৃণাটিকে ঠাণ্ডা জিঘাংসার দিকে যেতে দেয়া ঠিক হবে না মনে করে মাসুদ তার ব্রিফকেসের ভিতর থেকে হুইস্কির বোতলটা বের করে কেবিনের বারান্দায় গিয়ে বসে। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস। উফ্! কী ঠাণ্ডা! গ্লাসে দুই পেগ হুইস্কি ঢেলে আয়েশ করে সে উপভোগ করতে থাকে নিজেকে।
একসময় সে কবিতা পড়তে ভালোবাসত। কবিতা! কত যুগ আগে ছেড়ে এসেছে সে সেইসব সজীব সময়! কিছুই মনে পড়ে না আজ! আজ জীবনের চারপাশ ঘিরে যেন ক্লান্তি আর বিপন্নতা। সবাই ভাবে সে খুব সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। আসলে তার ভিতরের ভাঙচুরের বিপন্ন চেহারাটা তাকে সবসময়ই লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। মুখোশ আর মুখোশ! প্রতিযোগিতাময় এই পৃথিবীতে কেবলই ছদ্মবেশ পরে থাকতে হয়! সমাজ ও জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ক্রমাগত তার নিজের কাছ থেকে পালিয়ে সে ক্রমেই হয়ে উঠেছে আত্মসর্বস্ব এক নার্সিসাস। রাত্রির বুকে নদীর জলকে কেমন যেন গভীর কালো লাগছে। যেন তারই এক দীর্ঘায়ত বিষাদের রূপ। ভিজে ঠাণ্ডা বাতাসের সোঁদা সোঁদা গন্ধের মাতাল করা হাওয়া। নানা রকম ভাবনায় তলিয়ে যেতে যেতে মাসুদের ইচ্ছে হলো একটি সিগারেট ধরানোর।
সিগারেট আনতে গিয়ে দেখল, নাসিমা তখনও ঘুমায়নি। ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছে মাত্র। তার খোলা পিঠের দিকে তাকিয়ে জোয়ায়ের জলের মতো আছড়ে পড়ার ইচ্ছে হলো মাসুদের। আবার ভ্রান্তি! না, নাসিমাকে সে এভাবে পেতে যাবে কেন! মনেই পড়ে না, নাসিমার ঠোঁটে শেষ কবে চুমু খেয়েছিল। নাসিমাকে দেখলেই আজকাল মনে হয়, ‘হিয়ার লাইজ দ্যা উইম্যান উইথ সোল সো ডেড’।
নদীর বাতাসের বিরুদ্ধে লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল মাসুদ। সিগারেটের ছাই ওড়াতে ওড়াতে স্মৃতির ঘূর্ণি যেন তাকে ভাসিয়ে নিতে থাকে। সত্যিই নাসিমাকে কোনোদিন সে ভালোবাসি শব্দটি বলতে পারেনি। কত অজস্র নারীকে সে অবলীলায় বলেছে। নাসিমাকে এই কথা বলা আর নিজের দাঁত তুলে ফেলা যেন সমান কথা। তবু এতগুলো বছর ভালো না বেসেই কি কাটিয়েছি! মাসুদ জানে, নাসিমার জ্বলে যাওয়া চোখের চাউনিতে এই প্রশ্ন তার ওপর এসে পড়ে। আর সে কেবলই এড়িয়ে যায়, নিজেকে লুকায় বারবার।
গত কয়েক রাত ধরেই ঘুম হয়নি। খুব ক্লান্ত লাগছিল মাসুদের। এক শীতল মদিরতা নিজের মধ্যে অনুভব করতে করতে স্বপ্ন আর ঘুমের মাঝখানে হেঁটে হেঁটে সে একসময় বিছানায় এসে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
কতক্ষণ সে ঘুমিয়ে ছিল তা তার মনে নেই। তবে সকাল হয়ে লঞ্চ ছাড়বার তীব্র আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আর তৎক্ষণাৎ সকালের ব্রেকফাস্টের আয়োজন ঠিকঠাক হচ্ছে কি না দেখতে ওপরে খাবারের রুমে গিয়ে দাঁড়াল। ব্রেকফাস্ট প্রায় শেষ পর্যায়ে। টেবিলে টেবিলে নানা রকম গল্পে আড্ডায় সবাই ব্যস্ত। জাকিয়া আন্টি অনেক বছর আগে একবার এই অঞ্চলে এসেছিলেন। সেই সময় দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার কোনো যোগাযোগ ছিল না। তিনি হাসতে হাসতে সেই সময়কার যাত্রার বর্ণনা করছিলেন কয়েকজনের সঙ্গে। বর্ষাকালে কেমন করে কাদায় ডুবে যাওয়া পা নিয়ে চলতে হতো। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে লঞ্চে উঠতে হতো। নিচতলার মানুষের সঙ্গে ছাগল, ভেড়ার পাল, কাঁঠালপাতা আর তাদের মলমূত্রসহ মহা আনন্দে জলযাত্রা কেমন ছিল তার নিঁখুত বর্ণনা আর হাসির শব্দের সঙ্গে মাসুদ নিজেকেও খানিকটা যুক্ত করল।
টেবিলে টেবিলে ব্রেকফাস্টের পরে চা, কফি, ডেজার্ট এসব দেয়া ছিল। প্রত্যেক যাত্রীই আনন্দমুখর। দিলরুবার ফ্যামিলির সঙ্গে দেখা হলো, এক কোণের টেবিলে। ওরাও দারুণ হাসিখুশি মুডে রয়েছে। চারদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখার পর সে নাসিমাকে খুঁজল কিছুক্ষণ। তাকে দেখতে পেল না কোথাও। একটু দূর থেকে সে আবার প্রতিটি যাত্রীকেই গুনে নেবার চেষ্টা করল। না, সবাই আছে ঠিকঠাক। বাচ্চারা খেলছে। সোনিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক জোড়া দম্পতির সঙ্গে গল্প করছে। নাসিমা কোথায় গেল! ওর তো সবার আগেই এখানে চলে আসার কথা। নাসিমা রোজই সূর্যোদয় দেখে। বলতে গেলে, এটা তার অভ্যাসের অংশ! এটা কী করে সম্ভব! এখনও কি সে ঘুম থেকে ওঠেনি! ভাবতে ভাবতে মাসুদ হেঁটে গেল নিচতলায়, সারিবদ্ধ বাথরুমের পাশে। আবার ওপরে উঠে গেল চালকের রুমের পাশে নীরব জায়গায়। আবার একবার খাবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতে না পেয়ে দিলরুবাকেই সরাসরি জিজ্ঞেস করল, নাসিমার সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না!
দিলরুবা উত্তরে না বলে, একটু মুখ ঘুরিয়ে হাসল, অন্য ইঙ্গিতে। একটু অশ্লীল ইঙ্গিতে।
মাসুদ ইঙ্গিতটি ধরতে পেরেও না বোঝার মতো ভাব দেখাল, আর একটু বিরক্তও হলো যেন। সে দারুণ চিন্তিত মুখে নিজের রুমে ফিরে এলো। একটা চূড়ান্ত উদ্বেগ তাকে ভিতরে ভিতরে তাড়া করছিল! নাসিমা কি কারও রুমে গিয়ে গল্প করছে! এমন তো হওয়ার কথা নয়! সে খুবই কম কথা বলে। নিজের মতোই থাকতে ভালোবাসে, নীরবে, ঘরের কোণে। তাছাড়া এখন আমাদের সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার কথা! ব্রেকফাস্টে উপস্থিত হবার কথা! কোনোদিন নাসিমাকে ব্যতিক্রমীভাবে সে দেখেনি। কোথায় যাবে সে! এই সাত সকালে! নানা ভাবনায় সে একটি সিগারেট হাতে নিয়ে কেবিনের বারান্দার দিকে যেতেই স্তব্ধ হতবাক হয়ে গেল। কেবিনের বারান্দার মেঝেতে শান্ত হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে নাসিমা। সকালের রোদ এসে পড়েছে তার মুখে। স্নিগ্ধ আর শান্ত মুখ। মাসুদ মেঝেতে বসে তাকে ধাক্কা দিতেই গড়িয়ে যায় সে। তার একপাশে পড়ে থাকা হাতটি হাতে নিয়েই চমকে ওঠে মাসুদ। ঠাণ্ডা হাত, স্পন্দনহীন দেহ! সে বেঁচে নেই! নাসিমা বেঁচে নেই! হার্টফেইল! কী করে সম্ভব! নাকি অন্যকিছু! সে যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। শিরদাঁড়া ঠাণ্ডা করা একটি শীতল স্রোত যেন অনুভব করল শরীরে। সে আবারও নাসিমার শরীরে ধাক্কা দিয়ে নিশ্চিত হতে চায়। এবার পাগলের মতো তার নাম ধরে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে। না, সত্যিই সে আর বেঁচে নেই।
থমথমে ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে বারান্দার মেঝেতেই থপ করে বসে রইল মাসুদ। চোখের দৃষ্টি তার ঝাপসা হয়ে এলো। উৎকণ্ঠা আর অব্যক্ত যন্ত্রণায় সে যেন কুঁকরে যাচ্ছিল।
ওপরে চলছে ব্রেকফাস্ট টেবিলগুলোতে আনন্দের মাতামাতি আর হল্লা। জোড়ায় জোড়ায় লোকজন মেতে রয়েছে গল্পগুজবে। এখন এই পরিস্থিতি কীভাবে সবাইকে জানাবে, সে ঠিক বুঝতে পারল না।
আবার নাসিমার দিকে তাকিয়ে ঝুঁকে সে ভাবছে, ঠিক কতক্ষণ আগে ঘটেছে এই ঘটনাটি! যখন সে রাতের বেলায় হুইস্কির বোতলটি বের করল, তখন সে জেগে ছিল। তারও দুঘণ্টা পর, যখন সে সিগারেট নিয়ে বারান্দার দিকে—তখনও নাসিমা বিছানায় এপাশ ওপাশ করছিল। ঘুমাতে পারছিল না বেচারি! আহা! তখন যদি তাকে একবার জিজ্ঞেস করতাম—তোমার কি শরীর খারাপ! কেন পারলাম না! তাহলে কি ভোরের দিকেই হার্ট অ্যাটাক হলো! লঞ্চে একজন ডাক্তার খুব জরুরি ছিল। ভুল হয়ে যায়—সর্বত্রই ভুল! এখন সবাইকে কী করে বলি! মাসুদের বিস্ময়ের ঘোরটা এতক্ষণে কেটে গেছে। নাসিমার স্তব্ধ নিঃসাড় হাতটি নিজের মধ্যে নিয়ে সে বসেই ছিল। কেবিনের দরজা খোলা। সে বুঝতেই পারছিল না কী করা উচিত!
এদিকে এতক্ষণেও এদের দুজনের ব্রেকফাস্টটা করা হয়নি দেখে লঞ্চের বাবুর্চির সহকারী ছেলেটি তাদের জন্য নির্ধারিত খাবারগুলো কেবিনে দিয়ে যাবে কি না জিজ্ঞেস করতে এলো। ছেলেটি ঢুকেই কাউকে দেখতে না পেয়ে গলা খাকারি দিয়ে ভিতরে ঢুকে বারান্দায় উঁকি দিল। হঠাৎ সে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল একটা। মাসুদ তাকে বিস্মিত হতে না দিয়ে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল, ম্যাডাম অসুস্থ। ওপর থেকে জাকিয়া ম্যাডাম আর দিলরুবা ম্যাডামকে ডেকে আনো।
ওরা তখনই এসে পড়ল দ্রুত। মাসুদ থেমে থেমে নিচু গলায় শুধু একটি কথাই বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমার স্ত্রীর ঘুম আর ভাঙছে না। সকাল থেকে অনেক ডাকলাম, সে আর সাড়া দিচ্ছে না। চোখের জলে মাসুদের চোখ ঝাপসা।
খবর ছড়িয়ে গেল দ্রুত। একে একে নেমে এলো সবাই। নিশ্চিত হলো, মৃত্যুই ঘটেছে। সবার চোখেমুখে একটা আতঙ্কের ছাপ। কারও মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন! মৃত্যু হলো কীভাবে! কখন! তরতাজা, হাসিখুশি চেহারাটায় পড়ে আছে সকালের রোদ। আকাশের সব কুয়াশা কেটে গেছে। ভিজে বাতাস বয়ে আনছে জলের লবণ গন্ধ। লঞ্চ চলছে দ্রুতগতিতে। যতটা সম্ভব দ্রুত পৌঁছাতে হবে।
সবাই কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে প্রত্যেককে। যার যার কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বা বসে তারা দেখে চলছে জলের অবিরাম স্রোত! সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে জীবনের নির্মমতাকে। যেন তারা ভয়ার্ত হয়ে উঠছে, কোনো এক অনির্দিষ্ট যাত্রার কথা ভেবে। তাই জলের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত করতে চাইছে তাদের যাত্রার গতিকে। অজানা প্রশ্নগুলো প্রত্যেকের মনের গভীরে নেমে এসেছে অজানা অন্ধকার হয়ে। জাকিয়া তার প্রশ্নের উত্তরগুলো যেন কিছুটা মেলাবার চেষ্টা করছে। দিলরুবার বয়স যেন এক মুহূর্তেই বিশ বছর বেড়ে গেছে। বুকের ভিতরটায় যেন পাথর চাপা। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কাঁদতেও ভুলে গেছে। সোনিয়ার কেবলি মনে হচ্ছে, এই মৃত্যুটির সঙ্গেও একটি রেপ কেসের কাহিনি আছে, যা কখনো কেউ জানবে না।
মাসুদ সেই ঘটনার পর থেকে একফোঁটা পানিও মুখে দেয়নি। লঞ্চের সার্বিক দায়িত্ব জাকিয়া আন্টি আর দিলরুবার ওপর ছেড়ে দিয়ে সে বসে আছে সাদা কাপড়ে ঢাকা নাসিমার মৃতদেহটির পাশে। তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব যেন হারিয়ে গেছে। নিজেকে মনে হচ্ছে এক অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা। চারপাশে যেন গা ছমছমে শোঁ শোঁ আওয়াজ, আঁশটে গন্ধ আর নোনা বাতাস। সে যেন চিনতে পারছে না নিজের ছায়াকেও। বিড়বিড় করে সে নিজের সঙ্গে স্বীকারোক্তি করে, ‘হ্যাঁ, এটা স্ট্রোক নয়। এটা খুন! আর এই খুনটা আমিই করেছি। দিনের পর দিন প্রচণ্ড অবহেলায় তার দিকে উগরে দিয়েছি লুকানো বিষাক্ত পাথর। তাই অন্তহীন অভিমান নিয়ে সে চলে গেল। বাস্তবতার নির্দিষ্ট জগৎটিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কেবল মুখোশ পরেছি। প্রকৃতির অনির্দেশ্য জগৎটিকে ভুলে থাকতে চেয়েছি বারবার। তাই প্রকৃতির প্রতিশোধ! কী জানি এই অনির্দেশ্য জগতের কোথায় আরম্ভ! কোথায় শেষ! আজ সবকিছু ভেঙেচুরে—আমার শেষ তৃণটুকু পর্যন্ত ভাসিয়ে নিচ্ছে!’