X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২
ঈদসংখ্যা ২০২৩

উপরওয়ালা

সঞ্জয় পাল
১৬ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:০০আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:০০

টিনের ওপরে জল পড়ার শব্দ পেয়ে জানালা থেকে মুখ বের করে রমিজ আকাশের দিকে তাকিয়ে গলা চেঁচিয়ে বলল—তোদের বাপের টিনের চাল পেয়েছিস নাকি, শালারা? তারপর অজস্র গালিগালাজ। আকাশের ‍দিকে তাকিয়ে বিধাতা বা দুপাশের বহুতল ভবনের বাসিন্দাদেরকে সমস্ত শক্তি, সাহস খাটিয়ে এতটুকু প্রতিবাদই তার করার আছে। প্রাগ-ঐতিহাসিক কাল থেকেই এই প্রতিবাদ চলছে।

পেছনে হেলে পড়া টিনের বাড়ির দুপাশে পাঁচতলা দুটো বিল্ডিং, সামনে রাস্তা আর পেছনে ফাঁকা জায়গা। পাশের দুটো দালান রমিজের দুই ভাইয়ের। রমিজকে এই দুই ভাইয়ের কাছেই হাত পাততে হয়। বিশেষভাবে বড় ভাই রেদওয়ানের কাছে যে সংকোচ, শ্রদ্ধাবোধ সে দেখায় তার অনেকটাই ভাসাভাসা; পেছনে নির্দ্বিধায় সমালোচনা করে। অন্যদের জন্য এই সমালোচনা প্রায় ক্ষেত্রেই দুর্ব্যবহারের পর্যায় পড়ে যায়।

চকচকে ফার্নিচার, লাইটিং আর তার সঙ্গে উপযুক্ত সাজসজ্জা নিয়ে গড়ে তোলা রেস্টুরেন্ট ব্যবসাটা এক মাসের মাথায়ই ঝিমিয়ে আসল। পাশাপাশি পাঁচ-ছয়টা রেস্টুরেন্টেরই এমন দশা। এর পাশে অন্য যে চারজন পুরাতন রেস্টুরেন্ট মালিক তারা আগেই ধীরে ধীরে নতুন ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছিল। অথচ ব্যবসা তুলে নেয়ার মতো এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা রমিজকে কেউ বলেনি। অবশ্য রেস্টুরেন্টের মালিকেরা ব্যবসার শুরুতেই তার প্রতিযোগীতে পরিণত হয়েছিলে। বড় ব্যাপার হলো শহরে সন্ধ্যায় মানুষে জমজমাট স্থান পুকুরপাড় থেকে ভিড়টা কী এক গোপন কারণে যেন পরিবর্তিত হয়ে বেশ দূরে চৌমাথায় চলে গেছে। জমজমাট স্থানটা ঝিমিয়ে পড়ার পরে ওই পুরো এলাকাটাই একই ছবিতে আসল। আবার পুরনো স্বভাব ফিরে পাওয়ার জন্য এলাকার দোকানগুলোতে দু-একটা করে চকচকে রঙিন লাইট কমতে থাকল। মনে হয় মানুষ এতে এখানের রাস্তা, পুকুরপাড়, দোকানপাট সম্পর্কে আরও নির্বিকার হয়ে উঠল। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রেস্টুরেন্টগুলোর প্রচার প্রচারণা, ভোক্তা আটকে ফেলার সমস্ত কৌশল প্রয়োগের পরও লোক টানতে ব্যর্থ হলো। শেষে ভদ্রতার খোলস ছেড়ে সস্তা হোটেলগুলোর মতো খদ্দের ডেকে ঘরে তোলার রেওয়াজ চালু হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। লজ্জা ঢাকতে নিজেরাই সেটা বন্ধ করল।

রমিজকে মাস ছয়েকের মধ্যে নতুন ব্যবসার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হলো ফলে রেস্টুরেন্টটাকে পুনরায় চাঙ্গা করার জন্য কিছু অর্ধেক বাস্তবায়ন করা সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হলো। ঋণের কিস্তির চাপ এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে আসার জন্য তাকে রেস্টুরেন্টের সমস্ত কিছু বিক্রি করতে হলো। রেস্টুরেন্টের ফার্নিচার, সাজসজ্জা, জিনিসপত্র তাকে বিস্ময়কর রকমের সস্তা দরে বিক্রি করতে হলো। কোনো রকম টিকে থাকার ব্যাপারটা যেহেতু তাকে নাকচ করে দিতে হয়েছে। তাকে নতুন উপায় খুঁজতে হলো যেটা একেবারেই সস্তা দরের মোড়কে প্যাঁচানো। প্রথমে কাচ্চি বিরিয়ানি ঘর। তারপর ব্যবসাটা আরও একটু পালটে ভাতের হোটেল। ভদ্র সমাজ থেকে একবারে গণপর্যায়ে নামা পর্যন্ত নিজেকে বদলে নিতে হয়েছে। বদলে নিতে হয়েছে তার ব্যবহার, বেশভূষা। মিষ্টি গলা থেকে তাকে নামতে হয়েছে চোখ রাঙানি আর কর্কশ গালাগালির পর্যায়ে। লাগাম টেনে ঘোড়া চালাবার মতো করে প্রত্যেককে চালাতে হয় তাতে শুধু চাবকানো বাকি থাকে। কিছু সময় পরপর হাঁক দিয়ে বলতে হয়—ওই টেবিলটাতে দেখ। তিন নম্বর টেবিলটাতে কী লাগবে দেখ।

রমিজ বেশ রাতে এসে ঘরে ঢোকে। বিলকিস রমিজ ঘরে ঢোকার পর দরজা আটকে দেয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। যদিও রমিজকে তার ব্যবসার খাতিরে কথা, আচরণ, পোশাক সবই পালটাতে হয়েছিল কিন্তু বিলকিস আর রমিজের সম্পর্ক আছে একই রকম। রমিজ বাড়িতে আসার পরও আরেকটা নতুন ব্যবসা শুরু করে বাড়তি টাকা জোগানোর কথা ভাবতে থাকে। তার ফাঁকে ফাঁকে বিলকিস সারা দিনের বিবরণী দিয়ে যায়। বলে—আজকে জানেন। আঁচলের হাতটা কেটে গেছে। সে কী রক্ত মাগো! এতটুকু মানুষের গায়ে এত রক্ত কোথা থেকে এলো কে জানে।

—ইসাম কি পড়াশুনা করছে আজকে?

—খালি দুষ্টামি করে। আপনি বাড়ি থাকেন না। আজকে কী করল জানেন? পাশের বাসার বড় ভাবি কেবল আমাদের বাসায় এসেছে।

রমিজ তার দিকে চোখ বড় বড় করে চাইল। বিলকিস আবার তার পারিবারিক কথায় ফেরত আসল। আজকে ঘটা খবরের পিঠে পুরনো আলাপ অল্প অল্প করে যুক্ত হতে থাকে। ধীরে ধীরে পুরনো বিষয়গুলো সমস্ত গুরুত্ব নিয়ে নেয়; চেপে ধরে রাজত্ব বিস্তার করে। দুজনেই বিরক্ত হয়ে ওঠে। দুজনের গলার স্বরেই ঝাঁঝালো ভাবটা ফুটে উঠতে থাকে। পাশ ফিরে বিরক্তিকর বিষয়টা রমিজ এড়িয়ে যায়। শুয়ে পড়ার পর বিলকিসের মাথায় প্রায়ই কিছু কথা জমা হতে থাকে সেগুলো বলার জন্য তাকে কিছু পন্থা খুঁজতে হয়। পুরনো রাস্তায় তাকে হাঁটতে হয়। রমিজের জন্য সে পানি নিয়ে আসে। গ্লাসটা সে রমিজের মুখের সামনে ধরে বলে—এই যে পানি, নাও।

রমিজ প্রায় প্রতিবারই তার দিকে চেয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে—পানি চাইছিলাম বুঝি। পরিবারের ছোটখাটো বিষয় খেয়াল না করা, ভুলে যাওয়ার দুর্বলতা তার বহু পুরনো। এই ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা তার ব্যবসা দেখাশুনার ক্ষেত্রে প্রায় অনুপস্থিতই বলা চলে। তাই এখানে বিলকিস সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করে। নিজের চাহিদা অনুযায়ী বিষয়গুলোকে সাজিয়ে নেয়।

বিলকিস ধীরে ধীরে বলল—এমনি নিয়ে আসছি। খেয়ে নিন। তাতে এমন সুরের বাহানা থাকে যে রমিজ নীরবে তার ভুল স্বীকার করে নেয়।

বিলকিস ধীরে ধীরে বলতে থাকে—ছেলের ড্রয়িং আর রান্নাঘরের কিছু জিনিস কেনা দরকার। আপনি আমার সাথে যাবেন?

রমিজ বরাবরের মতোই যাবে না। ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য সে টাকা দিতে রাজি হয়ে যায়। টাকার এই বরাদ্দটা বিলকিসের সম্পূর্ণ খেয়ালখুশির এখতিয়ারে পড়ে যায়। রমিজ আবার ধীরে ধীরে চিন্তার ভেতরে ডুবে যায়। বিলকিস প্রতিদিনই ঘুমিয়েছে চিন্তা করে মশারি টানিয়ে লাইট বন্ধ করে দেয় নতুবা বিলকিসকেই বসে বসে ঝিমাতে হবে।

রমিজের দিনে দোকানের ভিড়ের মধ্যে ভাবতে হয় বড় ভাই রেদওয়ানের কথা। সেদিন সন্ধ্যায় রমিজের উপস্থিতির উপহারস্বরূপ তার বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয় একটা বড় রুই মাছ। সারা দিন বসে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথার একটা অভ্যাস ধরেছে রমিজের সেটা থেকে মুক্তির জন্য তাকে রাতে পুরো শহরটাই হাঁটতে হয়। তারপর মুখস্থ কয়েকটা গলির পর তার বাড়ি। বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের জন্য কয়েকটা চিপস, চকোলেট গুঁজে সিঁড়ি বেয়ে সে ওপরে উঠে পড়ে।

রেদওয়ান মুখ ভার করে বলল—তোর দোকানের দিকে আমি গড়ে রোজ আটবার তাকাই। ভাতের হোটেল হবার পরই তুই আমার কাছে এলি। আর ভাতের হোটেল হবার পরই দেখলাম সেখানে ছাগলের লদি পড়া শুরু হয়েছে। রেদওয়ান জোরে জোরে হাসল। বলল—হাসি শরীরের জন্য ভালো, রাগ কমায়।

তবুও রমিজের রাগটা বেড়ে উঠল। রমিজের তখনই নজর পড়ল জানালার দিকে, এখান থেকেই তার টিনের চালের ওপর পানি ফেলানো হয়।

রেদওয়ানের হার্টে রিং পরানোর পর তার মুখে অসংলগ্ন কথা, কথা আটকে যাওয়া বা আবেগতাড়িত হওয়া এগুলো বেড়েছে।

—ভাইয়া আপনার শরীর কেমন আছে? দেখুন এই তো সেদিন একসাথে স্কুলে গেলাম। আর এখন আমাদের যাবার সময় হয়ে এসেছে। আমরা তিন ভাই একসাথে ছিলাম। আমিই খালি কাদায় পড়ে আছি। কত তফাত হলো এই কয় বছরে! রেদওয়ানের বউ বকুল তার কথার উদ্দেশ্যটা ধরতে পেরে তার ‍দিকে তীক্ষ্ণভাবে চেয়ে আছে। এরপর একদিন কী আবদার হবে তা নিশ্চিন্তে বলা যায়। রমিজ আবার বলল—আমি ভাবি আর ভাত বেচি! কথাটা বলে রমিজের হাসি পেয়েছিল। আবার আগের কথার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বলল—আপনার হাঁটা-চলা করতে অসুবিধা হয় শুনছি। নিচতলায় নামবেন তা কিন্তু আমি জানি। নামুন। আমি প্রতিদিন আপনাকে দেখতে আসব। দুজনে একসাথে হাঁটব।

রেদওয়ান, বকুল তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। তবে দুজনেরই উদ্দেশ্য আলাদা।

—জানি সেই পুরনো দিন তো আর ফিরে আসবে না। বাবার সেই রিকশা ভাড়ার ব্যবসা! আপনার মনে আছে?

রেদওয়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল তখন তার চোখে জল জমেছে। বলল—আনন্দ তো আমরা চাই না। শুধু সব খেতে চাই। আমি সব চিবিয়ে খেতে শিখেছি। তাতে কী হলো! দীর্ঘদিন ধরে দাঁড়ানো পায়ের ওপরও আর ভরসা করা যায় না।

রমিজ তাকে ভরসা দিল।

এরপরে আরও কয়েকবার রমিজকে তার ভাইয়ের কাছে যেতে হয়েছে। তারপর একযোগে কিছু টাকা এসেছে তার ভাইয়ের কাছ থেকে। টাকা সে অন্য কাজেও লাগাতে পারত কিন্তু নতুন একটা আয়ের পথ খোঁজাই তার একমাত্র উপায় মনে হলো। নতুন কতগুলো পথই তার হাতে ছিল। তবে সে খুঁজল নিশ্চিত এবং নির্দিষ্ট একটা আয়ের পথ। এক্ষেত্রে পরিচিত ব্যবসার দিকেই রমিজ ভরসা করতে চাইল। যতবার যতদিক থেকে রমিজ ভেবেছে তার বাবার আমলের রিকশার ব্যবসাটাই তার মাথায় এসেছে। অথচ এই ব্যবসাটা এই এলাকা থেকে উঠে গেছে। রমিজ ভাড়ায় কোনো জায়গা না নিয়ে একটা স্থায়ী সমাধানের জন্য বাড়ির একটা অংশ ব্যবহারের জন্য মনস্থির করল। সিদ্ধান্তটার বাস্তবায়নের বিষয়টা নিয়ে সে যখন ভাবছে তখন দুপুর।

চট করে একজন লোক রমিজের চোখের সামনে টাকা ঝুলিয়ে বলল—টাকাটা খুচরা করে দিন তো।

দুপুরে তখন ‍ভিড়ের গরম, গুমট গন্ধ, চারদিকে ছা-পোষা গিজগিজে মানুষ। রমিজ এদেরকে আসলে খুব একটা পছন্দ করে না তবুও তাদের নিয়ে তার কারবার। সে মেজাজটা ধরে রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল। লোকটা বিস্মিত হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। দোকানের সামনে কিছু লোকজন ভিড় করে আছে। তারা কিছুক্ষণের জন্য আড়াল হলো। কয়েক মিনিট পরে নতুন কিছু লোক সেখানে খেতে ভিড় করেছে। কিছুক্ষণের জন্য যেন রমিজ একগুঁয়ে হয়ে সবাইকে তাড়িয়ে দিল। তারপর নিজে চলে এলো বাড়ি। যেটা তার সম্পূর্ণ স্বভাববিরোধী, ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর; কর্মচারীদের কাজ ফাঁকি দেয়া, চুরির ‍সুযোগ তৈরি করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

রমিজ বাড়িতে রিকশা রাখার সিদ্ধান্তটা বিলকিসকে জানানো প্রয়োজন বিধায় বলার জন্য সে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই। তখন রাতে ভাত খাওয়ার পর বিলকিস কটা মুড়ি খেতে বসেছে। ভাত খাবার পর মুঠো ভরে হলেও সে কিছু খাবেই। পুরনো অভ্যাস। যেমন গোসলের পর চুল মুছে গামছাটা প্রতিদিন সে ওই দরজার ওপরই শুকাতে দিবে। পাশের আলনাটা ‍প্রথমে ছিল এলোমেলো বস্তার কাপড়ের স্তূপের মতো। বিলকিসের হাতে পড়ে সেটা সাজানো হয়ে গেছে। তবে রমিজ যখন কোনো শার্ট সেখানে খুঁজে পায় না তখন তার একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে বিলকিস।

আলনাটার দিকে চেয়ে রমিজ ভেবে বলল—আলনাটা ধরো তো।

আলনাটা ধরে খাটের এপাশে আনল। তারপর আলনার জায়গায় পাশের ঘর থেকে একটা টেবিল। সামনের রুমে যে একটা খাট ছিল সেটা আসল একবারে পেছনের রুমে যেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটা ডাইনিং টেবিল আনার জন্য ডিজাইন দেখা হয়েছিল এবং টেবিলটা বসানোর জন্য জায়গাটা দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা পড়েছিল। বিলকিস বিভ্রান্ত হয়ে বলল—আমি তো আগেই বলছি এখানে ডাইনিং টেবিলের জন্য জায়গা লাগবে। কী করবে এখন?

—যখন কিনে আনব তখন দেখা যাবে।

—তাই বলে সামনের বারান্দা ফাঁকা রেখে কি চাপাচাপি করে থাকতে হবে?

—বাঃ! চাপাচাপি কোথায় দেখলে? বেশ জায়গা তো ঘরে।

কথাটা এখানে থামার পর অন্য বিষয়ে আড়াল পড়ে গেল।

তখন বেশ রাত। বিলকিস, রমিজ লাইট বন্ধ করে শুয়েছে। দীর্ঘক্ষণ কারও মুখে কোনো কথা নেই। কোনো প্রয়োজনীয় কথা না থাকলে এমন চুপ থাকার চর্চা দীর্ঘকাল ধরে হয়ে আসছে। স্বাভাবিকভাবে বিলকিসই আগে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ করে তার স্বামীর ঘরের ফার্নিচারের বিন্যাসে এমন আগ্রহী হয়ে ওঠা তাকে ভাবিয়ে তুলল। কারণ বিয়ের পর কখনো সে এমন হতে দেখেনি। বিলকিস রমিজের না ঘুমানোর ব্যাপারটা জানে। সে একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। তার মনে যে সন্দেহ দানা বাঁধছিল তা থেকে বলল—তুমি কি সেই আলুর ব্যবসায় আবার নামছ? প্রতিদিন সেই পচা আলুর বড়া। কী বিশ্রী! সারা ঘরে পচা আলুর গন্ধ। ছিঃ।

তখন রমিজের ঘুম পড়ার মতো শ্বাস-প্রশ্বাস শুরু হয়েছে। বিলকিস অন্ধকারে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তারপর রাগে গজগজ করতে করতে বাথরুমে এসে মাথায় পানি দিয়ে শুয়ে পড়ল। অভ্যাসবশত পরের দিন রমিজের সঙ্গে তার কথা বলা বন্ধ করে দেয়ার কথা।

সকালে পরিস্থিতি আরও গুমোট হয়ে উঠল যখন চারজন লোক এসে বিলকিসের ঘরের সামনের বেড়াটা ভাঙতে শুরু করল। একজন তাকে বলল—এখানে একটা রিকশার গ্যারেজ হবে। রমিজই তাদের ঠিক করেছে, দেখিয়ে দিয়েছে। 

বাড়ির সামনে ঠিক পাঁচ হাত জায়গা। সব মিলিয়ে গ্যারেজ যে খুব বড় করা যাবে তেমনও না। বিলকিসের কাছে রমিজ এসব ব্যাপারে কোনো কথাই বলেনি। তাছাড়া বিলকিসের এই ছোট্ট তিনটা কক্ষের বাড়িতে তার একচেটিয়া অধিকার ছিল তা হারাবে। আরও বড় ব্যাপার পরিবেশের, একতরফাভাবে ছোট হয়ে যাওয়ার। রমিজের বড় ভাই রেদওয়ানের কাছে এই অবিবেচক ব্যাপারটার একটা বিচার চাইতে তাকে যেতে হলো। খবরটা রেদওয়ান আগেই জানে। তার উদাসীন ভাবটা তাকে আরও রাগিয়ে দিল। তবুও রেদওয়ান বিচারের প্রতিশ্রুতি দিল। বাড়ি ফিরে এসে গালাগাল করে বিলকিসকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই মেনে নিতে হলো।

কয়েকদিন পর কোথা থেকে পাঁচটা রিকশা গ্যারেজে আসল। এর আগের দিনগুলোতে রমিজের প্রথম কাজ ছিল হোটেলে খেতে আসা লোকগুলোর শরীর, পোশাক, বিড়ির গন্ধ নিয়ে রিকশাওয়ালাদের চিহ্নিত করা। তাদের দোয়া মাহফিলে আসার জন্য বলা। সেদিন বিকেলে দোয়া মাহফিলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যাতে খবরটা বেশি সংখ্যক খদ্দেরের কাছে পৌঁছায়। কাজেই তাকে জিলাপির পেছনে ভালোই খরচ করতে হলো। রমিজ সেটাকে ঋণের বিপরীতে বিলাসিতা মনে করে অথচ ওটা স্রেফ বিনিয়োগ।

রিকশার গ্যারেজ হওয়ার কিছুদিন পরই তার সামনে একটা অস্থায়ী চায়ের খুপরি বসল। তারপর একদিন কোথা থেকে এক মহিলা কয়েকটা গামলা-থালা নিয়ে দুপুরে ভাত বিক্রি শুরু করল। জায়গাটা ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে উঠল। তার সঙ্গে যুক্ত হলো কিছু বেওয়ারিশ লোকজন। তাদের শহরে করার মতো কাজ নেই শুধু ঘোরাফেরা করা ছাড়া। যখন তখন বাজি ধরে বেড়ায়, যেখানে সেখানে বসে পড়ে। রাস্তার ফুটপাতটুকু তারা দখল করে ফেলেছে তাতে তাদের সময় লেগেছে এক সপ্তাহেরও কম। পাড়ার লোকেরা নতুন আমেজটাতে ডুবে যেতে মোটেই দ্বিধা করেনি, প্রতিবাদ করেনি।

এত লোক দেখার আনন্দে এসব পরিবর্তনে রেদওয়ানের কোনো কিছুই মনে হলো না। তার পরিবারের সবাই বেশ কিছু ‍দিন হলো নিচে নেমেছে। সকাল হলেই সে জানালার ধারে বসে। সারি ধরে রিকশা বের করা দেখে। রেদওয়ান প্রচণ্ড স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। সঙ্গে প্রত্যেকের ‍মুখ ফুটে চলে গালিগালাজ। এসবে তার কোনো বিকার নেই। অনেক সময় তার চোখে জল আসে আর সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস। বিলকিস বেশ কিছুদিন তার হাবভাব দেখেছে। এই গ্যারেজ আর তার চারপাশের পরিবর্তনে সে খুবই বিরক্ত। বিশেষ করে রমিজের তার বড় ভাইয়ের বাসায় বারবার যাওয়া। ভাবির সঙ্গে কথা বলতে গেলে রমিজের চাহনি ওরকম পালটে যাওয়া, কোনোভাবেই বিলকিস ভালো চোখে দেখতে পারে না। তবে সব ব্যাপারগুলোই এত বারবার ঘটে যে একবার চোখে পড়ার পর আর কোনোবারই চোখ এড়ায় না। এই ছোট ছোট ঘটনাগুলো বিলকিসকে সবকিছুতেই প্রচণ্ড সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে। আশপাশের কোনো সাধারণ ব্যাপারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার নেশা তার ভেতরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকল। এছাড়া ছেলেমেয়ে দুটো কেমন লাগাম ছাড়া হয়ে উঠেছে। তাদের কথা বলার ধরনে, চলাফেরায় এক ধরনের উগ্রভাব গজিয়ে উঠেছে যা ‍বিস্ময়করভাবে বদমেজাজ আর একগুঁয়েমিতে ভরা। বিলকিস তাদের বুঝিয়ে, মেজাজ দেখিয়ে যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না তখন তাদের ওপর হাত চালাতেও দ্বিধা বোধ করল না। তবে তার সব রকম চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলো। তারপর থেকে বিলকিসের মধ্যে কেমন একটা উদাসীন শূন্যতার উদয় হলো। রেদওয়ান যখন সকালে জানালার ধারে মাঝে মাঝে চোখ দিয়ে পানি ঝরাত তখন বিলকিস উপচে পড়া কান্না চেপে ঘরের ভেতর ঢুকত। অথচ কদিন আগেও ব্যাপারটা বিলকিস খামখেয়ালি আর পাগলামিতে ভরা মনে করত।

শেষে বিলকিসের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনাই চূড়ান্ত বিষয় হয়ে উঠল। বিষয়টা একবার স্থায়ীভাবে রমিজের কানে তোলার জন্য বিলকিসের মাথায় চিন্তাটাকে তিন দিনের জন্য পুষে রাখতে হলো। তখন রাত। দুজনেই পাশাপাশি শুয়ে আছে। চারদিকে নীরব অন্ধকার। তখনকার একমাত্র বিদ্রোহী প্রতিনিধির মতো বিলকিস বলল—ওসব ঋণ, টাকা-পয়সা চুলায় যাক। আমি ওসব মানি না। আমি আগের মতো থাকতে চাই। তারপর একতরফাভাবে জমে ওঠা কান্না চলল। মাঝে মাঝে আক্ষেপের সুরে দু-একটা কথা সে বলে। শেষে সব নীরব হয়ে যায়।

রমিজের হাতে কোনো কিছুকে বন্ধ কারার উপায় ছিল না। অন্য ‍উপায় হিসেবে বিলকিসের পরদিন বাবার বাড়ি যাওয়াই সমাধান হিসেবে ঠিক হলো। অথচ বিলকিসের চাওয়া বিচারের সমাধান রেদওয়ানও করতে পারত। তবে সমাধানটা রেদওয়ানের অযাচিত মৃত্যু দিয়ে সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে গেল। আপাতত কিছু দিনের জন্য বিলকিসকে থেকে যেতে হবে। রমিজকে ওবাড়ির ব্যাপারগুলোতে ভালো রকম ব্যস্ত হয়ে ‍উঠতে হলো। ভেতরের এবং বাইরের ব্যাপারে সমানভাবে। ফলে সাময়িকভাবে রিকশা ভাড়া দেয়া, টাকা আদায় করা বিলকিসের কাজ হয়ে উঠল। শুরুতে তার ইতস্তত বোধ হলেও ধীরে ধীরে সে পেশাদার হয়ে ‍উঠল। ভাড়ার টাকা তোলার জন্য গালাগালি পর্যন্ত করতে হয়। ফলে তার বাড়ির বাইরে পা ফেলার কোনো উপায় থাকল না। তাদের পাশের সস্তা যে বাসাগুলোতে লোক পাওয়া যেত না সেখানে রিকশাওয়ালারা গাদাগাদি করে থাকে। রাস্তার পাশে সস্তার দোকান উঠেছে। নতুন কিছু আঞ্চলিক গালি সেই দোকানগুলোর সামনে একে অন্যেকে চেঁচিয়ে বলে। সবাই এই সবে অভ্যস্ত হয়ে ‍উঠেছে। শখ করে মুখে এঁটে বসা এসব জিনিস নিশ্চয়ই এক সময় সাধারণ পর্যায়ে আসবে। মাঝে মাঝে ঝামেলা হয়, মারামারি হয়। অনেকে এই গ্যারেজটাকে মনে করে শনির বাহন। শুধু এই গলির মোড়েই আরও দুটো রিকশার গ্যারেজ হয়েছে তবু বিলকিস তাদের গ্যারেজটা বন্ধ করার কথা ভাবে না। অথচ রমিজের হাতে থাকাকালীন সে বহুবার প্রতিবাদ করেছে, বন্ধ করতে চেয়েছে।


শেষের এই কয়েক মাস থেকে রমিজ বাড়িতে খুবই অনিয়মিতভাবে থাকছে। মাঝে দু-তিন ‍দিন একেবারেই তার দেখা নেই। এমন প্রায়ই হয়। রমিজকে রেদওয়ানের দামি ঘড়ি, সোনার আংটি পরতে দেখা যায়। বিলকিস কিছু বলবে বলবে ভেবেও কথাগুলো চেপে বসে আছে। হঠাৎ একদিন রেদওয়ানের বাড়ির চাকরটা এলো। তার কাছ থেকে বিলকিস প্রথম শুনল বড় ভাবিরা আবার তিনতলার বাসায় উঠেছে। চাকরটা ধীরে ধীরে বলল—বিলকিস ভাবি আমাকে রমিজ ভাইয়ার জামাকাপড়গুলো দেখিয়ে দিন।

তখনও বিলকিসের মাথায় তেমন কিছু ছিল না। সে জামাকাপড়গুলো দেখিয়ে ‍দিল। চাকরটা যখন জামাকাপড়গুলো নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন জিজ্ঞেস করল—জামাকাপড়গুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?

সে সংকোচের সঙ্গে বলল—ও বাসার তিনতলায়।

বিলকিস অসহায়ের মতো চেয়ে থাকল। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার মতো করে সে কান্নায় বসল। ঘটনা সম্পর্কে সে যা ভেবেছে তাই হয়েছে। হয়তো সে আটকাতে পারত, না হয় পারত না। তবে তাকে রমিজের রিকশার গ্যারেজের ওপর আরও নির্ভরশীল হতে হলো।

মাঝে মাঝে তিনতলার ওপর থেকে পানির ঝাপটা পড়ে তখন বিলকিস তীব্র স্বরে গালাগাল করে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। রমিজ তিনতলার জানালা থেকে দূরে সরে এসে হাসে। বকুল তখন অনাগত সন্তানের জন্য ছোট ছোট কাঁথা সেলাই করছে। কোনো দিকে না ফিরে ভদ্রভাবে বলল—আচ্ছা, ‍মহিলা গলা চেঁচিয়ে এমন বিশ্রী গালাগাল করে কেন?

রমিজ দৃঢ় কণ্ঠে বলল—ও তো একটা পাগল।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেননি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেননি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কুড়িগ্রামে বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কুড়িগ্রামে বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান