উপাচার্য-শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্বের দীর্ঘসূত্রিতায় একমাস ধরে বন্ধ রয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) সব ধরনের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম। পুরো ক্যাম্পাসে বিরাজ করছে অচলাবস্থা। একে একে স্থগিত হচ্ছে বিভাগগুলোর পরীক্ষা। ক্যাম্পাস কবে খুলবে এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। শিক্ষার্থীরা পড়েছেন সেশনজটের শঙ্কায়। তাদের দাবি, আমাদের ভবিষ্যৎ যে হুমকির মুখে পড়েছে, সেটার দায়ভার নেবে কে?
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্য-শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ গত এক মাসে কমপক্ষে আটটি বিভাগের চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। তাছাড়া বিভাগুলো থেকে সংশোধিত হয়ে আসা চূড়ান্ত পরীক্ষার নোটিশগুলোও প্রকাশ স্থগিত রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে উপাচার্য-শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্বে প্রায় দুইমাসের অধিক সময়জুড়ে অনিয়মিত ছিল শিক্ষা কার্যক্রম। নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজনীতিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফলে একমাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে।
এই বিষয়ে ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী সাইমুল ইসলাম শুভ বলেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি। এভাবে একমাস সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, এর আগে আরও কয়েক দফা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, এভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আমাদের ঠেলে দিচ্ছেন ওনারা। এভাবে পড়াশোনা চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক। ওনাদের সমস্যাগুলো ওনাদেরকেই বুঝতে হবে। আমরা কেন এটার জন্য ভুগবো?
মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিমা খাতুন বলেন, প্রায় একমাস হলো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। আমরা সম্ভবত খুব দ্রুতই সেশনজটে পড়তে যাচ্ছি। বন্ধে পরীক্ষা, মিডটার্ম, অ্যাসাইনমেন্ট সব স্থগিত। এসবের দায় তো আর কেউ নেবে না। আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত খুলে দেওয়া হোক। আর কত ঘরে বসে থাকবো?
শুরু থেকেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে আসছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি। একপর্যায়ে গত ১৩ মার্চ সাধারণ কার্যনির্বাহী সভায় তারা সাত দফা দাবি উত্থাপন করেন। পরে সিন্ডিকেট সভা ডেকে প্রশাসন কর্তৃক সেই সাতটির চারটি পূরণ করা হয়েছিল বলে জানান উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন।
কিন্তু শিক্ষক সমিতির দাবি, তাদের দাবিগুলো যথাযথভাবে মানা হয়নি। পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত বলে দাবি তাদের।
এদিকে, ২৮ এপ্রিল উপাচার্য নিজ কার্যালয়ে প্রবেশের সময় উপাচার্য-শিক্ষক সমিতি এবং ছাত্রলীগের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী এবং চাকরিপ্রার্থীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা করেন।
শিক্ষক সমিতির দাবি, শিক্ষকদের ওপর এই হামলার প্রকাশ্য মদদদাতা হচ্ছেন উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ স্বয়ং। সেই সুবাদে তারা সাত দফা দাবি ত্যাগ করে উপাচার্য-কোষাধ্যক্ষের পদত্যাগ চেয়ে এক দাবি ঘোষণা করেন। সেই দাবিতে এখন পর্যন্ত তারা ১৪ দিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আবু তাহের জানান, উপাচার্য-কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ না করা পর্যন্ত এই অবস্থান কর্মসূচি চলবে।
গত ২৮ এপ্রিল শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ স্বরূপ অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষক সমিতি। এর আগেও তারা দাবি আদায়ে দফায় দফায় ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছিল। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় চালু অবস্থায়ই সব কার্যক্রম অচল।
এদিকে শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গত ৩০ এপ্রিল দুপুরে শিক্ষক সমিতি মানববন্ধন করে। মানববন্ধনে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান উপাচার্য ড. এ এফ এম আবদুল মঈনকে ‘ক্যাসিনো মঈন’ ‘আমদানিকৃত পচা মাল’ ‘নারী নির্যাতক’ ‘ডাস্টবিন’ ‘প্রশাসনিক প্রতারক’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করেন। ক্যাম্পাস শিক্ষক সমিতির কার্যক্রমে উত্তাল হয়ে ওঠে।
এমতাবস্থায় গত ৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি এবং চলমান সংকট নিরসন বিবেচনায় জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক হলসমূহ বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর থেকেই স্থবির হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম। কবে নাগাদ খুলছে বিশ্ববিদ্যালয়, নেই নিশ্চয়তা।
এই বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবু তাহের বলেন, উপাচার্য সিন্ডিকেট ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিক। তারপর আমরা সাধারণ সভা ডেকে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে যা সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটাই গ্রহণ করবো। আমরাও ক্লাসে ফিরতে চাই। সেজন্য আগে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হবে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, আমরা দুই এক দিনের মধ্যে সিন্ডিকেট ডাকার চেষ্টা করবো। সিন্ডিকেটে পরবর্তী সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলোচনা করবো।