রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের ছাত্রলীগের পদধারী আবাসিক ছাত্রীদের পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করিয়ে থানায় নিয়ে চালান দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন এক প্রাধ্যক্ষ। বৃহস্পতিবার ওই হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি ওই হুমকি দেন।
ছাত্রলীগের পদধারী ছাত্রীদের হুমকি দেওয়া ওই প্রাধ্যক্ষের নাম অধ্যাপক জামিরুল ইসলাম। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ। ওই সভার ২৩ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডের একটি অডিও ক্লিপে প্রাধ্যক্ষকে হুমকি দেওয়ার কথা বলতে শোনা যায়। হলের এক আবাসিক ছাত্রী সাংবাদিকদের অডিও ক্লিপটি সরবরাহ করেছেন। তিনি তাদের উদ্দেশে এই মন্তব্য করার কথা স্বীকার করে বলেছেন, আসলে এভাবে মন্তব্য করাটা ঠিক হয়নি।
ছাত্রলীগ নেত্রীদের উদ্দেশে প্রাধ্যক্ষকে বলতে শোনা যায়, ‘স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করেছে। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। তোমাদের তো অস্তিত্ব থাকার কথা না, তোমাদের তো মাথামুণ্ডু আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা। তোমাদের তো সেটা হয় নাই। সেদিন তোমাদের একটা ডিসিশন দেওয়ার পরও তোমরা যাও নাই। এতে তোমরা আইন ভঙ্গ করেছো। তোমাদের হল থেকে বহিষ্কার করার জন্য সিম্পলি এই অভিযোগটাই যথেষ্ট।।তোমরা জেনে থাকবে যে, এর আগে কিছু ছেলেকে ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কার করা হতো, মামলা দেওয়া হতো, গুম করা হতো, ক্রসফায়ারে দেওয়া হতো, তাদের দোষ ছিল তারা নামাজ পড়তো, মুখে দাড়ি রাখতো। সেই দোষে যদি ভালো ভাল ছেলেগুলোকে মামলা দেওয়া হয়, ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়, সেখানে তোমাদের সরাতে আমাদের দুই মিনিটও সময় লাগবে না। আমরা খারাপ পথে যেতে চাই না, কিন্তু তোমরা বাধ্য করছো। তোমাদের ছয় মাসের জেলে দেওয়ার মতো প্রমাণ আছে আমাদের কাছে।’
হলছাড়া করার হুমকি দিয়ে অধ্যাপক জামিরুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ ফোর্স, সেনাবাহিনী সকল কিছু রেডি আছে। তোমরা যদি উল্টাপাল্টা কিছু করো, তাহলে প্রত্যেকটা মেয়েকে এখান থেকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে চালান দেওয়া হবে। সকল কিছু আমাদের কাছে আছে। আমাদের রূঢ় হতে বাধ্য করো না। তোমাদের স্পর্ধা এটা। একজন প্রভোস্ট যখন কোনও অর্ডার করেন, সেটা আইন। তোমরা শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করেছ।’
যারা ছাত্রলীগের পদধারী, তাদের প্রত্যেককে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়ে প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘তুমি পোস্টেড ছিলা কি না, তুমি দরিদ্র, তোমাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আজ তোমাদের মুখ থেকে এসব গান বের হচ্ছে। এসব কোনও গান চলবে না। যারা পোস্টেড (পদধারী) ছিলা, তাদের চলে যেতে হবে। মাদক কারবারি যারা ছিলা, চলে যেতে হবে। এলিগেশন আসলে চলে যেতে হবে। তুমি ছিলা কি ছিলা না, আমরা তদন্ত করে তুমি ইনোসেন্ট হলে আমরা তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।’
এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক লাভলী নাহার স্বাক্ষরিত এক নোটিশে হলে অবস্থানকারী ছাত্রলীগের পদধারী শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করতে সময় বেঁধে দেন। পরদিন ১৫ সেপ্টেম্বর দুপুরের মধ্যে তাদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তারা হল ছাড়েননি। বৃহস্পতিবার সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে বেলা ১১টায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েকটি হলের প্রাধ্যক্ষসহ হল কর্তৃপক্ষ আলোচনায় বসে। সেখানেই ছাত্রলীগ পদধারী ছাত্রীদের উদ্দেশে নানা ধরনের মন্তব্য করেন অধ্যাপক জামিরুল ইসলাম।
এ ব্যাপারে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক লাভলী নাহার বলেন, হলের ১২৮ জন শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সেখানে তারা ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও নির্যাতন করার অভিযোগ করেছেন। ওই অভিযোগ পড়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি শান্ত করতে তিনি (অধ্যাপক জামিরুল) এসব কথা বলে ফেলেছেন। তবে দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে সেগুলো বলা ঠিক হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক জামিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেয়েরাই অভিযোগ করেছে, তাদের বাধ্য করা হয়েছে। এরকম অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলেছি যে, আগে যারা নিপীড়নকারী ছিল, তারা এটা বাধ্য করেছে। সে কথাটিই বলেছি। যদিও এটা আরেকটু ভালোভাবে বলা দরকার ছিল।’
এক হলের প্রাধ্যক্ষ হয়ে আরেক হলে গিয়ে এমন মন্তব্য করার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রাধ্যক্ষ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনও হলের প্রাধ্যক্ষ সাহায্য চাইলে আমরা যতজন পারি গিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করবো। সেই অবস্থান থেকেই আমার যাওয়া। না হলে সেখানে যাওয়ার মতো আমার কোনও আইনত বৈধতা নেই বা ওখানে আমি যেতে পারি না।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ড. আমিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোনও তথ্য প্রমাণ ছাড়া কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের শিষ্টাচারবহির্ভূত শব্দ ব্যবহার করা আসলে খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। আমি মনে করি, একজন হলের প্রাধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের মঙ্গল কামনা করেই সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি নিয়মের মধ্যে থেকে তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু অন্য হলের প্রাধ্যক্ষ যদি সংকট মুহূর্তে তাকে সাহায্য করতে যান, সেক্ষেত্রে তার কর্তব্য হবে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা যায়। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয় এমন কোনও বার্তা বা শব্দ ব্যবহার না করা। এ ধরনের শিষ্ঠাচারবহির্ভূত শব্দ শুধু শিক্ষক না, কোনও মানুষেরই ব্যবহার করা উচিত নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি এ বিষয়ে অভিযোগ আসে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে তদন্তের প্রয়োজনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন তাহলে নিশ্চয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে।