X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

ওস্তাদ ডেকেই গুলিস্তান পার হই!

জাকিয়া আহমেদ
০২ মে ২০১৭, ১০:৪১আপডেট : ০২ মে ২০১৭, ২২:১৪

ওস্তাদ ডেকেই গুলিস্তান পার হই!

আমার বাসা ওয়ারিতে। প্রতিদিন গুলিস্তান মোড় জিরো পয়েন্ট পার হওয়ার সময় অনেক ভিড় থাকে। পা ফেলার জায়গা থাকে না। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, ‘জিরো পয়েন্ট থেকে গুলিস্তান কিভাবে পার হন আপনি?’ উত্তরে আমি বলি, ‘সারা রাস্তা আমি ওস্তাদ বলে বলে পার হই।’ কথাগুলো বলছিলেন নুসরাত জাহান দিনা। ঢাকার রাস্তায় সাইকেল চালানো সাহসী নারীদের একজন তিনি।

ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় মাথায় হেলমেট, দুই হাতে হাতমোজা, পায়ে কেডস আর পিঠে ব্যাকপ্যাক বেঁধে মেয়েদের সাইকেল চালাতে দেখা যায়। সম্প্রতি সাই চালানো নুসরাত জাহান দিনা, সামসুন্নাহার লিজা চৈত্র, আয়েষা সিদ্দীকা এবং ইন্দ্রানী হালদার বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে এক আড্ডায় বসেছিলেন।

নুসরাত জাহান দিনা

তারা বলেন, বাবা-মায়েরা যদি তাদের মেয়েদের যাতায়াতের ঝামেলার কথা চিন্তা করেও সাইকেল চালানোর অনুমতি দেন তাহলে মেয়েরা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে পথ চলতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্ত ঘরের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, লোকের কথা। হয়তো নিজেরা মেনে নিচ্ছেন, কিন্তু লোকে কী বলবে সে চিন্তায় মেয়েকে সাইকেলের অনুমতি দিচ্ছেন না। তাই দশ ঘরের মেয়ে যদি সাইকেল নিয়ে বের হন, তাহলে বাকি পরিবারগুলো আর চিন্তাই করবে না এ নিয়ে। তখন সমাজ এমনিতেই বদলাবে, কারণ তখন আর কেউ কাউকে বলার থাকবে না।

ইন্দ্রানী মল্লিক ও আয়েশা সিদ্দিকা

নুসরাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের সাইকোলজি আলাদা। রিকশাচালক, ট্রাক-বাস ড্রাইভার, ভ্যানচালকের সাইকোলজিও আলাদা। একটা মেয়ে সাইকেল চালাচ্ছে- এটা দেখতে তারা অভ্যস্ত নন। ফলে তারা নানাভাবে হেয় করতে চায়। তাই যখন রাস্তায় বের হই, তখন ওদের সাইকোলজিটাও বুঝতে চেষ্টা করি। মনে হয় অ্যাগ্রেসিভ হলেই তারা বিরক্ত হয়। কিন্তু আমি তো সাইকেল চালাবো এবং সেইফলি রাস্তা পার হবো, তাই কাউকে খেপানোর দরকার নেই।’

সাইকেল চালানো কবে থেকে শুরু? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকে সাইকেল চালানোর শখ ছিল। মফস্বল শহরে থাকলে সব শখ পূরণ হয় না মেয়েদের। বাসার পাশেই একটা সাইকেলের দোকান ছিল। যেখান থেকে সাইকেল ভাড়া দিতো ছোটদের চালানো শেখার জন্য। আমিও সেই দোকানদারকে প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার সময় দুই টাকা দিয়ে আসতাম সাইকেল নিয়ে আসার জন্য। প্রতিদিন আমি অপেক্ষা করি কিন্তু সে আর আসে না। এভাবে চার-পাঁচদিন চলার পর যখন তাকে সাইকেল না নিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলাম, তখন সে উত্তর দিল, আপনি আমাকে দুই টাকা দেন। আর বিকালে বাসার কাছে গেলেই খালাম্মা পাঁচ টাকা দেয় সাইকেল নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য। এই ছিল আমার ছোটবেলার গল্প।’

তিনি আরও বলেন, হঠাৎ করেই চোখে পড়ে বিডিসাইক্লিস্ট গ্রুপ, সাইকেল না থাকার পরও সেখানে ২০১২-তে জয়েন করি। ২০১৩ সালে ১ ঘণ্টার মধ্যে সাইকেল চালানো শিখি।

নুসরাত জাহান দিনা ও শামসুন নাহার লিজা

নুসরাত বলেন, ‘আমার স্বামী ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম কিরণ আমাকে নিয়ে বেরুতেন রাতের বেলায় সাইকেল নিয়ে। হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের ভেতরে আমাকে সাইকেল নিয়ে ছেড়ে দিতেন। বলতেন, তুমি চালাও, আমি আছি। আমার দুই ছেলেকে নিয়ে সে আমাকে চিয়ার আপ করতো, সবসময় সে বলেছে, তুমি চালাও, তুমি পারবা।’  এখন পর্যন্ত আমি কোনও অ্যাক্সিডেন্ট বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ফেস করতে হয়নি বলে তিনি জানান।

একই রকম কথা বলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইন্দ্রানী মল্লিক। তিনি বলেন, ‘মিরপুর থেকে প্রতিদিন কর্মস্থলে যাতায়াতের পথে নানারকম পরিস্থিতিতে পড়েছি। কোনোদিন বাসায় গিয়ে অঝোরে কেঁদেছি। প্রায় সাড়ে তিন থেকে চারঘণ্টা আমাকে রাস্তায় কাটাতে হতো। কিন্তু এখন সাইকেলে করে মাত্র আধাঘণ্টা আগে বেরুলেই আমি ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারি। ’

ইন্দ্রানী মল্লিক

ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দীকা। তিনি বলেন, ‘বাসে মেয়েদের নিতেই চায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। হেলপাররা হাতে ধরে, পিঠে হাত দিয়ে বাসে ওঠায়। দাঁড়িয়ে থাকার সময় পুরুষ যাত্রীদের কত রকমের নোংরা ইঙ্গিত দেয়। এসব বিষয় যদি বাবা-মায়েরা একবার চিন্তা করেন তাহলে তারা সাইকেল চালানোর বিষয়ে নিরাশ করবেন না।’

আয়েশা সিদ্দিকা

আয়েশা বলেন, ‘সাইকেল চালানোর পর থেকে প্রতিমাসে আমার যাতায়াত ভাড়া বাবদ পাঁচ থেকে ছয় হাজার বেঁচে যাচ্ছে। এ টাকা দিয়ে আমি প্রজেকশনের কাজ করতে পারছি, ঘুরতে যেতে পারছি, নিজের হাত খরচ নিজেই চালাতে পারি।’

লিজা বলেন, ‘আমি যখন সাইকেল চালানো শুরু করি তখন বিডিসাইক্লিস্টের এক ভাইয়া বলেছিল, প্যাডেলের দিকে তাকানোর দরকার নেই, সামনে তাকাও, ব্যালেন্স হবে। তার মতো করেই বলতে চাই, জীবনে ছোট ছোট বাধা বিপত্তি আসবেই, সেগুলোর দিকে নজর দেওয়ার দরকার নেই, সামনে তাকালেই সব ব্যালেন্স হয়ে যাবে।’

শামসুন নাহার লিজা

নুসরাত জাহান দিনা, সামসুন্নাহার লিজা চৈত্র, আয়েষা সিদ্দীকা এবং ইন্দ্রানী হালদার বলেন, আমরা শুরু করেছি। ঢাকার রাস্তায় এখন অনেকেই দেখা যায় সাইকেল চালাতে। সবকিছুতেই যারা শুরু করে তাদেরকে বাধা বিপত্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয়, আমরাও যাচ্ছি। তবে আমাদের পরের প্রজন্মের আর ভয় রইলো না, আমরা বাধা পেরিয়ে ওদের জন্য পথটা মসৃণ করে দিলাম। ওদের আর কেউ কিছু বলবে না। নির্বিঘ্নে তারা এগিয়ে চলবে প্যাডেলে পা চালিয়ে, সামনে দৃষ্টি রেখে।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন।

/জেএ/এমপি/এসটি/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অনুদান হবে সীমিত: রুবিও
যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অনুদান হবে সীমিত: রুবিও
ত্বকের যত্নে আমের খোসা কাজে লাগাবেন যেভাবে
ত্বকের যত্নে আমের খোসা কাজে লাগাবেন যেভাবে
ব্রহ্মপুত্রে নৌকাডুবি: আরও দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার
ব্রহ্মপুত্রে নৌকাডুবি: আরও দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার
রাজশাহী মহাসড়কে ফেলা হচ্ছে বর্জ্য, তৈরি হচ্ছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
রাজশাহী মহাসড়কে ফেলা হচ্ছে বর্জ্য, তৈরি হচ্ছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
সর্বাধিক পঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
অবশেষে রিজার্ভে আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ হলো
অবশেষে রিজার্ভে আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ হলো
ইলিশের দাম নির্ধারণের প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন
ইলিশের দাম নির্ধারণের প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল