X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঘর ও বিদ্যুতে বদলে গেছে মানতা সম্প্রদায়ের জীবন

সাদ্দিফ অভি, পটুয়াখালী থেকে
২৩ মার্চ ২০২২, ১০:০০আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২২, ১০:০০

একসময় সমতল ভূমির বাসিন্দা হলেও ক্রমাগত নদী ভাঙনের কারণে ‘মানতা’ সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা হয়ে ওঠে নৌকাকেন্দ্রিক। সমতল বিচ্ছিন্ন এসব মানুষের নাগরিকত্বই ছিল না। এই সম্প্রদায়ের শিশুরাও সমতলের শিক্ষা ও খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত ছিল। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর পেয়েছেন পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার দুর্গম চর মন্তাজের মানতা সম্প্রদায়ের ২৯টি পরিবার। সেই সঙ্গে পেয়েছেন নাগরিকত্ব, এমনকি দুর্গম চরের সেসব বাড়িতে এসেছে বিদ্যুৎ।

জেলেদের মতো মানতা সম্প্রদায়ের মানুষেরও জীবিকা চলে মাছ ধরে। নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করে নৌকাতেই। মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়েছেন তারা। শুধু ঘরই নয়, দুর্গম চরের এই ঘরে এখন জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতিও।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় সুবিধাবঞ্চিত এসব মানুষের হাতে ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় ধাপে দুই শতক জমির মালিকানাসহ এসব উপকারভোগীদের সুদৃশ্য রঙিন টিনশেডের সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। প্রতিটি ঘরে রয়েছে দুটি বেডরুম, একটি টয়লেট ও রান্না ঘর। একেকটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা। এর আগে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় প্রথমধাপে রাঙ্গাবালীতে ৪৯১টি ও কলাপাড়ায় ৫৫০ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেওয়া হয়েছিল।

ঘর ও বিদ্যুতে বদলে গেছে মানতা সম্প্রদায়ের জীবন

ঘর পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই এসেছে বিদ্যুৎ। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সূত্রে জানা গেছে, ভোলা থেকে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার চরকাজল, চরবিশ্বাস ইউনিয়নে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন চালুর কাজ হাতে নেওয়া হয়। ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীতে সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে এ লাইন স্থাপন করা হয়েছে, যা দেশে দীর্ঘতম সাবমেরিন ক্যাবল লাইন। প্রতিটি গ্রাহকের বাড়িতে মিটারের লাইনের তার টানা হয়েছে। এই উপজেলার বিদ্যুতের সুবিধাভোগী প্রায় ২৪ হাজার মানুষ।

রাঙ্গাবালী উপজেলায় বিদ্যুতায়নের প্রকল্প শুরু হয় ২০২০ সালে। ১৪ মাসের মধ্যে এই কাজ শেষ হয়। এখন উপজেলা সদর, চর মন্তাজ, চলিতাবুনিয়া, চর কাজল, চর বিশ্বাস, চর কাশেম, ছোট বাইশদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার ২৫ হাজার ৩৩৮ জন বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। মোট ছয়টি ইউনিয়নের দুর্গম ১০৪টি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। এতে ব্যয় হয়েছে ২৬০ কোটি টাকা।

পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ জানায়, জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে রাঙ্গাবালীর ছোট বাইশদিয়া ইউনিয়নের গহিনখালীতে ১০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বসানো হয়েছে। ভোলার মুজিবনগর উপকেন্দ্র থেকে আমগাছিয়া বাজার হয়ে বুড়াগৌরাঙ্গ নদের দুই কিলোমিটার তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল পৌঁছেছে গহিনখালী উপকেন্দ্রে। এর আগে আরও দুটি নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল টানতে হয়। পুরো উপজেলায় বসানো হয়েছে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটারের বেশি সঞ্চালন লাইন।

ঘর পাওয়া এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অনেকেই জন্মের পর থেকেই ছিলেন ভাসমান, নৌকাতেই ছিল সংসার। তাদের সন্তানেরা কখনো পায়নি সমতলে খেলার সুযোগ। এমনকি অনেকের সন্তান পানিতে ডুবে মারাও গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে পানির জীবন থেকে সমতলে থাকার স্বাদ পাচ্ছেন তারা। আর কুপির আলোতে জীবন কাটলেও এখন বিদ্যুতের মাধ্যমে আলো পাচ্ছেন তারা।

ঘর ও বিদ্যুতে বদলে গেছে মানতা সম্প্রদায়ের জীবন

চর মন্তাজের বাসিন্দা ফুলবানুর চার সদস্যের পরিবার। স্বামী মাছ শিকার করে তাদের সংসার চালায়। জন্মের পর থেকেই নৌকায় থাকতেন ফুলবানু। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যেভাবে রাখসিল সেভাবেই থাকতাম। নৌকার মধ্যে ঘুমাইতাম, রান্নাবারাও নৌকার মধ্যে করসি। মাছ ধইরা বাজারে বিক্রি কইরা সংসার চলে। যেদিন মাছ বেশি আসে ওইদিন আয় ভালো হয়, আর নাইলে কম।’

তিনি বলেন, ‘পাঁচ মাসের মতো হইসে, এই ঘর পাইসি। আগে নৌকায় কষ্টে আসিলাম। ঘর পাইয়া কষ্ট একটু কমসে। পোলাগরে একটু লেখাপড়া করাইতাম পারি। পোলা দুইডা এখন ঘরের সামনে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে, খেলতে পারে। নৌকার মধ্যে তো পারতো না। ঘর পাওয়ার দুই মাস পর কারেন্ট আইসে। কারেন্ট যখন ছিল না তখন সোলার দিয়ে শুধু মোবাইল চার্জ দিতাম। আর কিসু চলতো না। এখন ফ্যান লাইট সব চালাইতে পারি।

তিন ছেলে নিয়ে স্বামীসহ নৌকায় বাস করতেন রোকেয়া বেগম। এখন দুর্গম চরে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের বাড়িতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা আমাগোরে ঘর দিসে দেইখা পাইসি। আমাগোরে চেয়ারম্যান স্যারে ডাইকা নিসে, নিয়ে বলসে আপনাগো ঘর বাড়ি নাই। ঘর-বাড়ি ঠিকানা নাই, নদীতে থাকি মাইনষে গইরাল বলে। উনি আমাদের নামটাম দিসে, আমরা ঘর পাইসি। ঘরে ওঠার কয়েকদিনের মধ্যে কারেন্ট আইসে। এতকিসু পাওয়ার পর কইসি- আমাগোরে এত কিসু দিসে। দোয়া করি আল্লাহ যেন হেগরে ভালো রাহে।’

রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাশফাকুর রহমান বলেন, পটুয়াখালীর মূল ভূখণ্ড থেকে আশেপাশের ইউনিয়নগুলো পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। এখানে বিদ্যুৎ দিতে হলে সাবমেরিন ক্যাবলের বিকল্প নেই। রাঙ্গাবালীতে একটি পরিবারও যাতে বিদ্যুতের বাইরে না থাকে সেজন্য ১৪ মাসে এখানে সংযোগের কাজ শেষ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে হবে। এই সম্প্রদায়ের মানুষের নদীতেই জীবন নদীতেই মরণ— এমন কথা প্রচলিত ছিল। তাদের সমস্ত জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, তারা একেবারেই নিঃস্ব।

তিনি বলেন, তারা এতই জনবিচ্ছিন্ন ছিল যে, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা তা থেকেও তারা বঞ্চিত ছিল। তবে মৎস্য শিকারের জন্য তাদের নদীর কিনারেই থাকতে হবে। এজন্য তাদের নদীর কিনারেই ঘর দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা সহজেই মাছের জন্য নদীতে যেতে পারে। এখানে মূল সমস্যা ছিল তাদের যেহেতু স্থায়ী ঠিকানা ছিল না, কোনও ইউনিয়ন তাদের ভোটার করতে পারেনি এবং তাদের নাগরিকত্বও ছিল না। আমরা প্রথমে তাদের নাগরিকত্ব দিয়েছি, যাতে করে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা যায়। সেটা করার পর প্রাথমিকভাবে আমরা ২৯টি পরিবারকে এখানে পুনর্বাসিত করেছি। আরও ৩১টি পরিবারের জন্য জায়গা করা হয়েছে পাশেই।

এখানে একটি প্রাইমারি স্কুল করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান মাশফাকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রায় ২০০ শিশু আছে। তারা কখনোই লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। এক কর্মসংস্থান থেকে ভিন্ন কর্মসংস্থানে যাওয়ার সুযোগ কিন্তু আগে ছিল না। বিদ্যুৎ আসায় এখন কিন্তু সে সুযোগ হয়েছে। এখন অনেকেই দোকান দিচ্ছে এবং আগে যারা মাছ ধরতে তাদের অনেকেই মৎস্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়েছে।

/ইউএস/
সম্পর্কিত
কোথাও যাতে ভোক্তাদের হয়রানি না হয়, নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
দেশের অর্ধেক জেলা সম্পূর্ণ ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত
বিএনপি-জামায়াতের সুমতি হোক, অগ্নিসন্ত্রাস বন্ধ করুক: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
কাপ্তাই হ্রদে নাব্য সংকট, ৫ উপজেলার যোগাযোগ বন্ধ
কাপ্তাই হ্রদে নাব্য সংকট, ৫ উপজেলার যোগাযোগ বন্ধ
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু