গত এক বছরে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পদক্ষেপ রাশিয়ার স্বার্থবিরোধী বিবেচিত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও জাতীয় স্বার্থ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশকে ওইসব পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এরপরও দুই দেশের সম্পর্ক ক্ষুণ্ন হয়নি। বরং বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থান যে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে আরও সুদৃঢ় হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত ও নিরাপদ করেছিলেন রাশিয়ান নৌবাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে রাশিয়ান জাহাজকে ভিড়ার অনুমতি দেয়নি বাংলাদেশ। গত বছরের শেষ দিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত এক জাহাজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পাঠালে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে বাংলাদেশকে। নিজেদের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজারের সতর্কবাণী বাংলাদেশ উপেক্ষা করেনি। রুশ জাহাজকে বন্দরে ভিড়ার অনুমতি দেয়নি সরকার।
এ বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময়ে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, বিশেষ করে যুদ্ধটি জাতিসংঘ সনদ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একটি বড় ঝুঁকি। এর মাধ্যমে রাশিয়ার নাম না নিয়েও দেশটিকে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দোষারোপ করা হয়েছে। ওই যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ ও জাপান ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে এবং আইনের শাসন মেনে অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের ওপর গুরুত্ব দেয়।
বাংলাদেশ-জাপান যৌথ বিবৃতি প্রকাশের পর মস্কো তার অখুশির কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশকে। এমনকি গত ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফরকালে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বলেন। ‘আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে পরিষ্কার দেখতে পাবো যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ব্যবহার করছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে চীনকে ঠেকানো এবং রাশিয়াকে পৃথক করে রাখা’—বলেন তিনি।
তৃতীয় যে পদক্ষেপ বাংলাদেশ নিয়েছে সেটি হচ্ছে গত ১১ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঢাকা সফরের পরে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা। ওই বিবৃতিতেও জাপানের মতো নাম প্রকাশ না করে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে দোষারোপ করা হয়। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করা হয় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একসঙ্গে কাজ করার।
চতুর্থ যে পদক্ষেপ সেটি হচ্ছে গত বছর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের জন্য রাশিয়ার গ্লাভকসমসের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছিল সরকার। কিন্তু ম্যাক্রোঁর সফরের সময়ে ফ্রান্সের এয়ারবাস থেকে ওই স্যাটেলাইট কেনার জন্য চুক্তি করেছে সরকার। অর্থাৎ রাশিয়ার বদলে বাংলাদেশ এখন ফ্রান্স থেকে স্যাটেলাইট কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের জানান, ফ্রান্সের সঙ্গে প্রথম স্যাটেলাইটে যেহেতু আমরা সন্তুষ্ট, সেজন্য স্যাটেলাইট-২ তৈরি করার জন্য তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। রাশিয়ার সঙ্গেও স্যাটেলাইট বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি রাশিয়ার সঙ্গে যেটি হয়েছিল, সেটিতে সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছিল অনেক বেশি। সে কারণে আমরা রাশিয়ার দিকে যাইনি।’
ফ্রান্সের সঙ্গে সুদের হার কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি বলতে পারবো না।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা অর্থাৎ স্ট্র্যাটেজিক সভরেইনটি রয়েছে দেশটির। অন্যদিকে রাশিয়া একটি বৃহৎ শক্তি এবং অন্য দেশগুলোর সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করতে পারে।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, “যেকোনও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ওঠানামা থাকবে। সবসময় মতের মিল হবে এরকম যেমন নয়, আবার সবসময় মতের অমিল–সেটিও নয়। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কে ‘টার্ন অ্যান্ড টুইস্ট’ থাকতেই পারে।”
জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সব দেশ সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে এবং এর বড় প্রমাণ হচ্ছে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের ঢাকা সফর। ওই সফরের রাজনৈতিক বার্তা হচ্ছে বাংলাদেশের পাশে আছে রাশিয়া।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়ার সহযোগিতায় তৈরি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন ওই প্রকল্প সঠিক সময়ে তৈরি হবে। কোনও ধরনের বড় অস্বস্তি থাকলে প্রকাশ্যে এটি বলা হতো না।’
গত ৫০ বছরে, বিশেষ করে গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে বাংলাদেশের সক্ষমতা এখন আগের যেকোনও সময়ের থেকে বেশি। অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে দেশটি সবার নজরে আছে বলে তিনি জানান।
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, “বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখন একটি পরিপক্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে ‘না’ বলার পরেও অন্য দেশের সঙ্গে সুন্দরভাবে সম্পর্ক অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে।”
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি এবং একই সঙ্গে কৌশল হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে এই ভারসাম্য নীতি অব্যাহত রাখা দরকার। এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে একটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে। গোটা পররাষ্ট্রনীতিকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা দরকার। পররাষ্ট্রনীতিতে সঙ্গতি ও ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ একই বিষয়ে এক দেশের জন্য এক ধরনের আচরণ এবং অন্য আরেকটি দেশের জন্য ভিন্ন আচরণ হলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না।’